০১. পত্রাবলী ৩৭৫-৩৮৪

৩৭৫*

শ্রীনগর, কাশ্মীর
১ অক্টোবর, ১৮৯৭

কল্যাণীয়া মার্গ,
অনেকে অপরের নেতৃত্বে সবচেয়ে ভাল কাজ করতে পারে। সকলেই কিছু নেতা হয়ে জন্মায় না। কিন্তু শ্রেষ্ঠ নেতা তিনিই, যিনি শিশুর মত অন্যের উপর নেতৃত্ব করেন। শিশুকে আপাততঃ অন্যের উপর নির্ভরশীল বলে মনে হলেও, সে-ই সমগ্র বাড়ীর রাজা। অন্ততঃ আমার ধারণা এই যে, এই হল নেতৃত্বের মূল রহস্য। … অনুভব করে সত্য, কিন্তু জনকয়েকেই মাত্র প্রকাশ করতে পারে। অন্যের প্রতি অন্তরের প্রেম, প্রশংসা ও সহানুভূতি প্রকাশ করার যে ক্ষমতা, তাই একজনকে অপরের অপেক্ষা ভাব প্রচারে অধিক সাফল্য দান করে।

তোমার কাছে কাশ্মীরের বর্ণনা দেবার চেষ্টাও করব না। শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, এই ভূস্বর্গ ছাড়া অন্য কোন দেশ ছেড়ে আসতে আমার কখনও মন খারাপ হয়নি। সম্ভব হলে, রাজাকে রাজী করিয়ে এখানে একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবারও যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। এখানে অনেক কিছু করবার আছে—আর উপকরণও এত আশাপ্রদ!

বড় অসুবিধা এইঃ আমি দেখতে পাই—অনেকে তাদের প্রায় সবটুকু ভালবাসাই আমাকে অর্পণ করে; কিন্তু প্রতিদানে কোন ব্যক্তিকে আমার তো সবটুকু দেওয়া চলে না; কারণ একদিনেই তাহলে সমস্ত কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। নিজের গণ্ডীর বাইরে দৃষ্টি প্রসারিত নয়—এমন লোকও আছে, যারা এরূপ প্রতিদানই চায়। কর্মের সাফল্যের জন্য যত বেশী সম্ভব লোকের উৎসাহপূর্ণ অনুরাগ আমার একান্ত প্রয়োজন; অথচ আমাকে সম্পূর্ণভাবে গণ্ডীর বাইরে থাকতে হবে। নতুবা হিংসা ও কলহে সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। নেতা যিনি, তিনি থাকবেন ব্যক্তির গণ্ডীর বাইরে। আমার বিশ্বাস তুমি একথা বুঝতে পারছ। আমি একথা বলছি না যে, অপরের শ্রদ্ধাকে তিনি পশুর মত নিজের কাজে লাগাবেন, আর মনে মনে হাসবেন। আমি যা বলতে চাই তা আমার নিজের জীবনেই পরিস্ফুট; আমার ভালবাসা একান্তই আমার আপনার জিনিষ, আবার প্রয়োজন হলে—বুদ্ধদেব যেমন বলতেন ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়’—তেমনি আমি নিজ হস্তেই আমার হৃদয় উৎপাটিত করতে পারি। এ প্রেমে উন্মত্ততা আছে, কিন্তু কোন বন্ধন নেই। প্রেমের প্রভাবে অচেতন জড়বস্তু চেতনে পরিবর্তিত হয়। বস্তুতঃ এই হল আমাদের বেদান্তের সার কথা। একই সদ্বস্তু অজ্ঞানীর চক্ষে ‘জড়’ এবং জ্ঞানীর চক্ষে ‘ভগবান্‌’ বলে প্রতিভাত হন এবং জড়ের মধ্যে যে চেতনের ক্রমিক পরিচয় লাভ—তাই হল সভ্যতার ইতিহাস। অজ্ঞানীরা নিরাকারকেও সাকাররূপে দেখে, জ্ঞানী সাকারেও নিরাকার এর দর্শন পান। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-নিরানন্দের মধ্যে আমরা শুধু এই শিক্ষাই পাচ্ছি। … অতিরিক্ত ভাবপ্রবণতা কর্মের পক্ষে অনিষ্টকর। ‘বজ্রের মত দৃঢ় অথচ কুসুমের মত কোমল’—এটিই হচ্ছে সার নীতি।

চিরস্নেহশীল সত্যাবদ্ধ
বিবেকানন্দ

৩৭৬

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

মরী
১০ অক্টোবর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,
কাশ্মীর হইতে গত পরশু সন্ধ্যাকালে মরীতে পৌঁছিয়াছি। সকলেই বেশ আনন্দে ছিল। কেবল কেষ্টলাল ও গুপ্তের মধ্যে মধ্যে জ্বর হইয়াছিল—তাহাও সামান্য। এই Address (অভিনন্দনটি) খেতড়ির রাজার জন্য পাঠাতে হইবে—সোনালি রঙে ছাপাইয়া ইত্যাদি। রাজা ২১।২২ অক্টোবর নাগাদ বোম্বে পৌঁছিবেন। বোম্বেতে আমাদের কেহই এক্ষণে নাই। যদি কেহ থাকে, তাহাকে এক কপি পাঠাইয়া দিবে—যাহাতে সেই ব্যক্তি রাজাকে জাহাজেই ঐ Address প্রদান করে বা বোম্বে শহরেতে কোথাও। উত্তম কপিটি খেতড়িতে পাঠাইবে। একটি মিটিং-এ (সভাতে) ঐটি পাস করিয়া লইবে। যদি কিছু বদলাইতে ইচ্ছা হয়, হানি নাই। তাহার পর সকলেই সহি করিবে; কেবল আমার নামের জায়গাটা খালি রাখিবে—আমি খেতড়ি যাইয়া সহি করিব। এ বিষয়ে কোন ত্রুটি না হয়। যোগেন কেমন আছে পত্রপাঠ লিখিবে—লালা হংসরাজ সাহানি, উকিল, রাওলপিণ্ডির ঠিকানায়। রাজা বিনয়কৃষ্ণের তরফের Address (অভিনন্দন)-টা দুদিন নয় দেরী হবে— আমাদেরটা যেন পৌঁছায়।

এইমাত্র তোমার ৫ তারিখের পত্র পাইলাম। যোগেনের সংবাদে বিশেষ আনন্দিত হইলাম এবং আমার এই চিঠি পাইবার পূর্বেই হরিপ্রসন্ন বোধ হয় আম্বালায় পৌঁছিবে। আমি তাহাদিগকে ঠিক ঠিক advice (নির্দেশ) সেখানে পাঠাইব। মা-ঠাকুরাণীর জন্য ২০০ টাকা পাঠাইলাম—প্রাপ্তিস্বীকার করিবে। … ভবনাথের স্ত্রীর সম্বন্ধে কিছুই কেন লিখ নাই। তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলে কি?

ক্যাপ্টেন সেভিয়ার বলিতেছেন যে, তিনি জায়গার জন্য অধীর হইয়া পড়িয়াছেন। মসূরীর নিকট বা অন্য কোন central (কেন্দ্রস্থানীয়) জায়গায় একটা স্থান যত শীঘ্র হয়—তাঁর ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছা যে, মঠ হতে দু-তিন জন এসে জায়গা select (পছন্দ) করে। তাদের মনোনীত হলেই তিনি মরী হতে গিয়ে খরিদ করে একদম বিল্ডিং শুরু করবেন। খরচ অবশ্য তিনিই পাঠাবেন। আমার selection (পছন্দ) তো এক আমাদের ইঞ্জিনিয়ার। বাকী আর যে যে এ বিষয়ে বোঝে—পাঠাবে। ভাব এই যে, খুব ঠাণ্ডাস্থানেও কাজ নাই, আবার গরমও হয় না। দেরাদুন গরমিকালে অসহ্য—শীতকালে বেশ। মসূরী itself (খাস মসূরী) শীতকালে বোধহয় সকলের পক্ষে ঠিক নয়। তার আগিয়ে বা পেছিয়ে—অর্থাৎ ব্রিটিশ বা গাড়োয়াল রাজ্যে জায়গা পাওয়া যাবেই। অথচ সেই জায়গার বারমাস জল চাই নাইবার-খাবার জন্য। এ বিষয়ে মিঃ সেভিয়ার তোমার খরচ চেয়ে পাঠিয়ে চিঠি লিখছেন। তাঁর সঙ্গে সমস্ত ঠিকানা করবে।

আমার plan (পরিকল্পনা) এক্ষণে এই—নিরঞ্জন, লাটু, দীনু এবং কৃষ্ণলালকে জয়পুর পাঠাই; আমার সঙ্গে কেবল অচু আর গুপ্ত। মরী থেকে রাওলপিণ্ডি, তথা হতে জম্মু, সেখান হতে লাহোর, তারপর একেবারে করাচি তথা হতে। আমি এখান হইতেই মঠের জন্য collection (অর্থসংগ্রহ) আরম্ভ করিলাম। যেখান হতে তোমার নামে টাকা আসুক না, তুমি মঠের ফণ্ডে জমা করিবে ও দুরস্ত হিসাব রাখিবে। দুটো ফণ্ড আলাদা—একটা কলিকাতার মঠের জন্য, আর একটা famine work etc. (দুর্ভিক্ষে সেবাকার্য ইত্যাদি)। আজ সারদা ও গঙ্গার দুইটি চিঠি পাইলাম। কাল তাদের চিঠি লিখব। আমার বোধহয় সারদাকে ওখানে না পাঠিয়ে Central Province (মধ্যপ্রদেশ)-এ পাঠান ভাল ছিল। সেখানে সাগরে ও নাগপুরে আমার অনেক লোক আছে—ধনী ও পয়সা-দেনেওয়ালা ইত্যাদি। যাহা হউক, আসছে নভেম্বরে সব হবে। আজ বড় তাড়া। এখানেই শেষ।

শশীবাবুকে আমার বিশেষ আশীর্বাদ ও প্রণয় দিও। মাষ্টার মহাশয় এতদিন বাদে কোমর বেঁধে নেমেছেন দেখছি। তাঁকে আমার বিশেষ প্রণয়ালিঙ্গন দিও। এইবার তিনি জেগেছেন দেখে আমার বুক দশহাত হয়ে উঠল। আমি কালই তাঁকে পত্র লিখছি। অলমিতি —ওয়া গুরুকী ফতে—To work! To work! (কাজে লেগে যাও, কাজে লেগে যাও)। তোমার সব চিঠিপত্র পেয়েছি। ইতি

বিবেকানন্দ

৩৭৭

[স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লিখিত]

মরী
১০ অক্টোবর, ১৮৯৭

কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে তোমার শরীর তেমন ভাল নয় শুনিয়া দুঃখিত হইলাম। Unpopular (অপ্রিয়) লোককে যদি popular (লোকপ্রিয়) করতে পার, তবেই বলি বাহাদুর। পরে ওখানে কোন কার্য হইবার আশা নাই। তদপেক্ষা ঢাকা বা অন্য কোন স্থানে যাইতে পারিলেই ভাল হইত। যাহা হউক, নভেম্বরে যে work close (কাজ বন্ধ) হইবে, সেই মঙ্গল। শরীর যদি খারাপ বেশী হয় তো চলিয়া আসিবে। Central Province-এ (মধ্যপ্রদেশে) অনেক field (কার্যক্ষেত্র) আছে এবং famine (দুর্ভিক্ষ) ছাড়াও আমাদের দেশে দরিদ্রের অভাব কি? যেখানে হউক একটা ভবিষ্যৎ বুঝে বসতে পারলেই কাজ হয়। যাহা হউক, দুঃখিত হইও না।

যাহা করা যায়, তাহার নাশ নাই—কখনও নহে; কে জানে ঐখানেই পরে সোনা ফলিতে পারে।

আমি শীঘ্রই দেশে কার্য আরম্ভ করিব। এখন আর পাহাড় বেড়াবার আবশ্যক নাই। শরীর সাবধানে রাখিবে। কিমধিকমিতি

বিবেকানন্দ

৩৭৮

[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]

মরী
১০ অক্টোবর, ১৮৯৭

কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্র পাইয়া বিশেষ আনন্দিত হইলাম। লম্বা প্ল্যানে এখনও কাজ নাই, যাহা under existing circumstances possible (বর্তমান অবস্থায় সম্ভব) হয়, তাহাই করিবে। ক্রমে ক্রমে the way will open to you (তোমার পথ খুলিয়া যাইবে)। Orphanage (অনাথাশ্রম) অতি অবশ্যই করিতে হইবে, তাহাতে আর সন্দেহ কি? মেয়েটিকেও ছাড়া হবে না। তবে মেয়ে Orphanage-এর (অনাথাশ্রমের জন্য) মেয়ে সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট চাই, আমার বিশ্বাস ‘—’ মা এই বিষয়ে কাজ করতে বেশ পারবেন। অথবা উক্ত গ্রামের কোন বৃদ্ধা বিধবাকে এ কার্যে ব্রতী করাও, যাঁর ছেলেপুলে নাই। তবে ছেলেদের ও মেয়েদের স্বতন্ত্র স্থান হওয়া চাই। সেভিয়ার সাহেব এ কার্যের জন্য তোমায় টাকা পাঠাইতে রাজী। তাঁহার ঠিকানা Nedon’s Hotel, লাহোর। যদি তাঁকে চিঠি লেখ, উপরে লিখিবে ‘To wait arrival’ (আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করিবে)। আমি শীঘ্রই কাল বা পরশু রাওলপিণ্ডি যাইতেছি, পরে জম্মু হইয়া লাহোর ইত্যাদি দেখিয়া করাচি প্রভৃতি হইয়া রাজপুতানায় আসিব।

আমার শরীর বেশ ভাল আছে। ইতি

বিবেকানন্দ

পুঃ—মুসলমান বালকও লইতে হইবে বৈকি এবং তাহাদের ধর্ম নষ্ট করিবে না। তাহাদের খাওয়া-দাওয়া আলগ্ করিয়া দিলেই হইল এবং যাহাতে তাহারা নীতিপরায়ণ, মনুষ্যত্বশালী এবং পরহিতরত হয়, এই প্রকার শিক্ষা দিবে। ইহারই নাম ধর্ম—জটিল দার্শনিক তত্ত্ব এখন মাথায় তুলে রাখ।

বি

আমাদের দেশে এখন আবশ্যক Manhood (মনুষ্যত্ব) এবং দয়া। ‘স ঈশঃ অনির্বচনীয় প্রেমস্বরূপঃ’—তবে ‘প্রকাশ্যতে কাপ্পি পাত্রে’২—এই স্থলে এই বলা উচিত, ‘সঃ প্রত্যক্ষ এব সর্বেষাং প্রেমরূপঃ’—তিনি প্রেমরূপে সর্বভূতে প্রকাশমান। আবার কি কাল্পনিক ঈশ্বরের পুজো হে বাপু! বেদ, কোরান, পুরাণ, পুঁথি-পাতড়া এখন কিছুদিন শান্তি লাভ করুক—প্রত্যক্ষ ভগবান্‌ দয়া-প্রেমের পুজো দেশে হোক। ভেদবুদ্ধিই বন্ধন, অভেদবুদ্ধিই মুক্তি, সাংসারিক মদোন্মত্ত জীবের কথায় ভয় পেও না। অভীঃ, অভীঃ। লোক না পোক! হিন্দু, মুসলমান, ক্রিশ্চান ইত্যাদি সকল জাতের ছেলে লও, তবে প্রথমটা আস্তে আস্তে, অর্থাৎ তাদের খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি একটু আলগ্ হয়; আর ধর্মের যে সর্বজনীন সাধারণ ভাব, তাই শিখাইবে। ইতি

বিবেকানন্দ

৩৭৯

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

মরী
১১ অক্টোবর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,
কাশ্মীর হতে আজ দশ দিন পর্যন্ত সমস্ত কাজ যেন একটা ঝোঁকে করেছি বলে মনে হচ্ছে। সেটা শরীরের রোগ হোক বা মনেরই হোক। এক্ষণে আমার সিদ্ধান্ত এই যে, আমি আর কাজের যোগ্য নই। … তোমাদের উপর অত্যন্ত কটু ব্যবহার করেছি, বুঝতে পারছি। তবে তুমি আমার সব সহ্য করবে আমি জানি; ও মঠে আর কেউ নেই যে সব সইবে। তোমার উপর অধিক অধিক কটু ব্যবহার করেছি; যা হবার তা হয়েছে—কর্ম! আমি অনুতাপ কি করব, ওতে বিশ্বাস নাই—কর্ম! মায়ের কাজ আমার দ্বারা যতটুকু হবার ছিল ততটুকু করিয়ে শেষ শরীর মন চুর করে ছেড়ে দিলেন ‘মা’। মায়ের ইচ্ছা!

এক্ষণে আমি এ সমস্ত কাজ হতে অবসর নিলাম। দু-এক দিনের মধ্যে আমি সব ছেড়ে দিয়ে একলা একলা চলে যাব; কোথাও চুপ করে বাকী জীবন কাটাব। তোমরা মাপ করতে হয় কর, যা ইচ্ছে হয় কর। মিসেস বুল বেশী টাকা দিয়েছেন। শরতের ওপর তাঁর একান্ত বিশ্বাস। শরতের পরামর্শ নিয়ে সকল মঠের কাজ কর, যা হয় কর। তবে আমি চিরকাল বীরের মত চলে এসেছি—আমার কাজ বিদ্যুতের মত শীঘ্র, আর বজ্রের মত অটল চাই। আমি ঐ রকম মরব। সেইজন্য আমার কাজটি করে দিও—হারা-জিতার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নাই। আমি লড়ায়ে কখনও পেছপাও হইনি; এখন কি … হব? হার-জিত সকল কাজেই আছে; তবে আমার বিশ্বাষ যে কাপুরুষ মরে নিশ্চিত কৃমিকীট হয়ে জন্মায়। যুগ যুগ তপস্যা করলেও কাপুরুষের উদ্ধার নেই—আমায় কি শেষে কৃমি হয়ে জন্মাতে হবে? আমার চোখে এ সংসার খেলামাত্র—চিরকাল তাই থাকবে। এর মান-অপমান দু-টাকা লাভ-লোকসান নিয়ে কি ছমাস ভাবতে হবে? … আমি কাজের মানুষ! খালি পরামর্শ হচ্ছে—ইনি পরামর্শ দিচ্ছেন, উনি দিচ্ছেন; ইনি ভয় দেখাচ্ছেন তো উনি ডর! আমার চোখে এ জীবনটা এমন কিছু মিষ্টি নয় যে, অত ভয়-ডর করে হুঁশিয়ার হয়ে বাঁচতে হবে। টাকা, জীবন, বন্ধু-বান্ধব, মানুষের ভালবাসা, আমি—সব অত সিদ্ধি নিশ্চিত করে যে কাজ করতে চায়, অত ভয় যদি করতে হয়তো গুরুদেব যা বলতেন যে, ‘কাক বড় স্যায়না—’ তার তাই হয়। আর যাই হোক, এ-সব টাকা-কড়ি, মঠ-মড়ি, প্রচার-ফ্রচার কি জন্য? সমস্ত জীবনের এক উদ্দেশ্য—শিক্ষা। তাছাড়া ধন-বাড়ী স্ত্রী-পুরুষ প্রয়োজন কি?

এজন্য টাকা গেল, কি হার হল—আমি অত বুঝতে পারি না বা পারব না। লড়াই করলুম কোমর বেঁধে—এ আমি খুব বুঝি; আর যে বলে, ‘কুছ পরোয়া নেই, ওয়া বাহাদুর, আমি সঙ্গেই আছি’ … তাকে বুঝি, সে বীরকে বুঝি, সে দেবতাকে বুঝি। তেমন নরদেবের পায়ে আমার কোটি কোটি নমস্কার; তারাই জগৎপাবন, তারাই সংসারের উদ্ধারকর্তা! আর যেগুলো খালি ‘বাপ রে এগিও না, ওই ভয়’—ডিস‍্‍পেপ্‌টিকগুলো—প্রায়ই ভয়তরাসে। তবে আমার মায়ের কৃপায় মনের এত জোর যে, ঘোর ডিস‍্‍পেপ্‌সিয়া কখনও আমায় কাপুরুষ করতে পারবে না। কাপুরুষদের আর কি বলব, কিছুই বলবার নাই। কিন্তু যত বীর এ জগতে বড় কাজ করতে নিষ্ফল হয়েছেন, যাঁরা কখনও কোন কাজ থেকে হঠেননি, যে সকল বীর ভয় আর অহঙ্কারবশে হুকুম অগ্রাহ্য করেননি, তাঁরা যেন আমায় চরণে স্থান দেন। আমি শাক্ত মায়ের ছেলে। মিন‍্‍মিনে ভিন‍্‍ভিনে, ছেঁড়া ন্যাতা তমোগুণ, আর নরককুণ্ড আমার চক্ষে দু-ই এক। মা জগদম্বে, হে গুরুদেব! তুমি চিরকাল বলতে ,‘এ বীর!’—আমায় যেন কাপুরুষ হয়ে না মরতে হয়। এই আমার প্রার্থনা, হে ভাই! … ‘উৎপৎস্বতেঽস্মি মম কোঽপি সনামধর্ম’—এই ঠাকুরের দাসানুদাসের মধ্যে কেউ না কেউ উঠবে আমার মত, যে আমায় বুঝবে।

‘জাগো বীর ঘুচিয়ে স্বপন; শিয়রে শমন, … তাহা না ডরাক তোমা’—যা কখনও করিনি, রণে পৃষ্ঠ দিইনি, আজ কি … তাই হবে? … হারবার ভয়ে লড়াই থেকে হঠে আসব? হার তো অঙ্গের আভরণ; কিন্তু না লড়েই হারব?

‘জাগো বীর ঘুচিয়ে স্বপন; শিয়রে শমন, … তাহা না ডরাক তোমা’—যা কখনও করিনি, রণে পৃষ্ঠ দিইনি, আজ কি … তাই হবে? … হারবার ভয়ে লড়াই থেকে হঠে আসব? হার তো অঙ্গের আভরণ; কিন্তু না লড়েই হারব?

তারা! মা! … একটা তাল ধরবার মানুষ নেই; আবার মনে মনে খুব অহঙ্কার, ‘আমি সব বুঝি’। … আমি এখন চললাম; সব তোমাদের রইল। মা আবার মানুষ দেন—যাদের ছাতিতে সাহস, হাতে বল, চোখে আগুন জ্বলে, যারা জগদম্বার ছেলে—এমন একজনও যদি দেন, তবে কাজ করব, তবে আবার আসব; নইলে জানলুম মায়ের ইচ্ছা এই পর্যন্ত। … আমার এখন ‘ঘড়িকে ঘোড়া ছোটে’ আমি চাই তড়িঘড়ি কাজ, নির্ভীক হৃদয়।

সারদা বেচারীকে অনেক গাল দিয়েছি। কি করব? আমি গাল দিই; কিন্তু আমারও বলবার ঢের আছে। … আমি হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর article (প্রবন্ধ) লিখেছি। সব … ভাল নইলে বৈরাগ্য হইবে কেন? … শেষটা কি মা আর আমায় জড়িয়ে মারবেন? সকলকার কাছে আমার অনেক অপরাধ—যা হয় কর।

আমি তোমাদের সকলকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করছি—মা যেন মহাশক্তিরূপে তোমাদের মধ্যে আসেন, ‘অভয়প্রতিষ্ঠং’ অভয় যেন তোমাদের করেন। আমি জীবনে এই দেখলাম, যে সদা আত্ম-সাবধান করে, সে পদে পদে বিপদে পড়ে। যে মানের ভয়ে মরে, সে অপমানই পায়। যে সদা লোকসানের ভয় করে, সে সর্বদা খোয়ায়। … তোমাদের সব কল্যাণ হোক। অলমিতি।

বিবেকানন্দ

৩৮০*

মরী
১১ অক্টোবর, ১৮৯৭

প্রিয় জগমোহনলাল,
… আমি জয়পুরে যে তিন জন সন্ন্যাসীকে পাঠাচ্ছি, তাদের দেখাশোনা করবার জন্য—আপনি বোম্বে যাবার পূর্বে—কাউকে বলে যাবেন। তাদের খাবার ও থাকার একটি ভাল জায়গার ব্যবস্থা করবেন। আমি সেখানে না যাওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবে। তারা সরল মানুষ—পণ্ডিত নয়। তারা আমারই লোক, একজন আমার গুরুভ্রাতা। যদি তারা চায়, তাদের খেতড়িতে নিয়ে যেতে পারেন, আমি শিঘ্রই সেখানে যাব। এখন চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই বছর বেশী বক্তৃতাও করব না। এই সমস্ত হট্টগোলে আমার আর কোন আস্থা নেই, এতে কার্যক্ষেত্রে কোন কল্যাণই সাধিত হয় না। কলিকাতায় আমার প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার জন্য আমাকে নীরবে চেষ্টা করতে হবে; আমি তাই অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রে চুপচাপ ঘুড়ে বেড়াচ্ছি।

আশীর্বাদ সহ আপনার
বিবেকানন্দ

৩৮১

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

মরী
১২ অক্টোবর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,
কল্যকার পত্রে সবিশেষ লিখিয়াছি। কোন কোন বিষয়ে বিশেষ বিশেষ direction (নির্দেশ) আবশ্যক বোধ করিতেছি। … (১) যে যে ব্যক্তি টাকা যোগাড় করিয়া পাঠাইবে … তাহারা acknowledgement (প্রাপ্তিস্বীকার) মঠ হইতে পাইবে। (২) Acknowledgement দুইখানা—একখানা তার, অপরখানা মঠে থাকিবে। (৩) একখানা বড় খাতায় তাদের সকলের নাম ও ঠিকানা entered (লিপিবদ্ধ) থাকিবে। (৪) মঠের ফণ্ডে যে টাকা আসিবে, তাহার যেন কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব থাকে এবং সারদা প্রভৃতি যাহাকে যাহা দেওয়া হচ্ছে, তাদের কাছ হতে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব লওয়া চাই। হিসাবের অভাবে … আমি যেন জোচ্চোর না বনি। ঐ হিসাব পরে publish (ছাপিয়া বাহির) করিতে হইবে। (৫) পত্রপাঠ উকিলের পরামর্শ নিয়ে এই মর্মে উইল রেজেষ্ট্রী করে নিয়ে এস যে, in case (যদি) আমি তুমি মরে যাই তো হরি এবং শরৎ আমাদের মঠের যা কিছু আছে, সব পাবে।

আন্বালা হইতে এখনও কোন সংবাদ পাই নাই—হরিপ্রসন্ন প্রভৃতি পৌঁছিয়াছে কিনা। অপরার্ধ মাষ্টার মহাশয়কে দিও। ইতি

বিবেকানন্দ

৩৮২*

[‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’কার ‘শ্রীম’কে লিখিত]

C/o লালা হংসরাজ
রাওলপিণ্ডি
১২ অক্টোবর, ১৮৯৭

প্রিয় ম—
C’est bon mon ami (বেশ হচ্ছে, বন্ধু)—এখন আপনি ঠিক কাজে হাত দিয়েছেন। হে বীর, আত্মপ্রকাশ করুন। জীবন কি নিদ্রাতেই অতিবাহিত হবে? সময় বয়ে যায়। সাবাস্, এই তো পথ।

আপনার পুস্তিকা প্রকাশের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ; শুধু এই পুস্তিকার আকারে খরচ পোষাবে কিনা তাই ভাবছি। … লাভ হোক বা নাই হোক গ্রাহ্য করবেন না, তা দিনের আলোতে বেরিয়ে আসুক! এজন্য আপনার উপর যেমন অজস্র আশীর্বাদ বর্ষিত হবে, তেমনি ততোধিক অভিশাপও আসবে—চিরন্তন ধারাই এই।

এই তো সময়!

ভগবদাশ্রিত
বিবেকানন্দ

৩৮৩*

জম্মু
৩ নভেম্বর, ১৮৯৭

প্রিয় মিস নোবেল্‌,
… অত্যধিক ভাবপ্রবণতা কাজের বিঘ্ন করে; ‘বজ্রাদপি কঠোরাণি মৃদুনি কুসুমাদপি’—এই হবে মূল মন্ত্র।

আমি শীঘ্রই স্টার্ডিকে লিখব। সে তোমায় ঠিকই বলেছে, বিপদে-আপদে আমি তোমার পাশে দাঁড়াব। ভারতে আমি যদি একটুকরা রুটি পাই নিশ্চয় জেন তুমি তার সবটুকুই পাবে। আমি কাল লাহোরে যাচ্ছি; সেখানে পৌঁছে স্টার্ডিকে চিঠি লিখব। কাশ্মীরের মহারাজের কাছ থেকে কিছু জমি পাবার আশায় গত পনর দিন আমি এখানে আছি। যদি এদেশে থাকি তো আগামী গ্রীষ্মে আবার কাশ্মীর যাব এবং সেখানে কিছু কাজ শুরু করব ভাবছি।

আমার অফুরন্ত স্নেহ জানবে।

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৩৮৪

[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]

লাহোর
১১ নভেম্বর, ১৮৯৭

অভিন্নহৃদয়েষু,
লাহোরে লেকচার একরকম হইয়া গেল। দু-এক দিনের মধ্যেই দেরাদুন যাত্রা করিব। তোমাদের সকলের অমত এবং অন্যান্য অনেক বাধাবশতঃ সিন্ধুযাত্রা এখন স্থগিত রহিল। আমার দুইখানি বিলাতী চিঠি কে রাস্তায় খুলিয়াছে। অতএব আমার চিঠিপত্র এক্ষণে আর পাঠাইবে না। খেতড়ি হইতে লিখিলে পাঠাইবে। যদি উড়িষ্যায় যাও তো এমন বন্দোবস্ত করিয়া যাও যে, কোন ব্যক্তি তোমার প্রতিনিধি হইয়া সমস্ত কার্য করে—যথা হরি। বিশেষতঃ এক্ষণে আমি প্রতিদিন আমেরিকা হইতে টাকার অপেক্ষা করিতেছি।

হরি ও শরতের নামে যে উইল করিবার জন্য বলিয়াছিলাম, তাহা বোধ হয় হইয়া গিয়াছে।

এখানে সম্ভবতঃ সদানন্দ ও সুধীরকে ছাড়িয়া যাইব একটি সভা স্থাপন করিয়া। এবারে লেকচারাদি আর নয়—একেবারে হুড়মুড় রাজপুতানায় যাচ্ছি। মঠ না করে আর কথা নয়। শরীর regular exercise (নিয়মিত ব্যায়ম) না করিলে কখনও ভাল থাকে না, বকে-বকেই যত ব্যারাম ধরে, ইহাই নিশ্চিত জানিও। সকলকে আমার ভালবাসা। ইতি

বিবেকানন্দ