স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে ০৭-০৯

স্থান—শ্রীনগর
কাল—২২ জুন হইতে ১৫ জুলাই

প্রতিদিন প্রাতঃকালে স্বামীজী পূর্বের ন্যায় আমাদের নিকট আসিয়া দীর্ঘকাল কথাবার্তা কহিতেন—কখনও কাশ্মীর যে-সকল বিভিন্ন ধর্মযুগের মধ্য দিয়া চলিয়া আসিয়াছে তাহাদের সম্বন্ধে, কখনও বা বৌদ্ধধর্মের নীতি, কখনও বা শিবোপাসনার ইতিহাস, আবার হয়তো বা কণিষ্কের সময়ে শ্রীনগরের অবস্থা—এই সকল বিষয়ের কথোপকথন চলিত।

একদিন তিনি আমাদের মধ্যে একজনের সহিত বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে কথা কহিতে কহিতে হঠাৎ বলিলেন, ‘আসল কথা এই যে, বৌদ্ধধর্ম অশোকের সময়ে এমন একটি কার্যের জন্যই উদ্যোগী হইয়াছিল, যাহার জন্য জগৎ এ যুগেই [সবেমাত্র আজকালই] উপযুক্ত হইয়াছে!’—তিনি সর্বধর্ম-সমন্বয়ের কথা বলিতেছিলেন। কিরূপে অশোকের ধর্মবিষয়ক একচ্ছত্রত্ব বার বার ঈশাহি ও মুসলমান ধর্মের তরঙ্গের পর তরঙ্গ দ্বারা চূর্ণ হইয়াছিল, কিরূপে আবার এতদুভয়ের প্রত্যেকেই মানবজাতির ধর্মবুদ্ধির উপর একচেটিয়া অধিকার দাবী করিত, অবশেষে কি উপায়ে এই মহাসমন্বয় স্বল্পকালমধ্যেই সম্ভবপর হইবে বলিয়া অনুমিত হইতেছে—এই সকল বিষয়ের অবতারণা করিয়া তিনি এক অপূর্ব চিত্র আমাদের সমক্ষে উপস্থিত করিলেন।

আর একবার মধ্য-এশিয়ার দিগ্বিজয়ী বীর জেঙ্গিজ খাঁ অথবা চেঙ্গিজ খাঁ সম্বন্ধে কথা হইল। তিনি উত্তেজিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, ‘লোকে তাঁহাকে একজন নীচ পরপীড়ক বলিয়া উল্লেখ করে, তোমরা শুনিয়া থাক; কিন্তু তাহা সত্য নহে! এইরূপ মহামনা ব্যক্তিগণ কখনও কেবল ধনলোলুপ বা নীচ হন না! তিনি এক রকম একত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার (সময়ের) জগৎকে তিনি এক করিতে চাহিতেছিলেন। নেপোলিয়নও সেই ছাঁচে গড়া লোক ছিলেন এবং সেকেন্দারও এই শ্রেণীর আর একজন। মাত্র এই তিন জন—অথবা হয়তো একই জীবাত্মা তিনটি পৃথক্ দিগ্বিজয়ে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল।’ তারপর একই অবতার-আত্মা ঐশী শক্তি দ্বারা পূর্ণ হইয়া জীবব্রহ্মৈক্য-সংস্থাপনের নিমিত্ত বারংবার ধর্মজগতে আবির্ভূত হইয়া আসিতেছেন বলিয়া তিনি যে বিশ্বাস করিতেন, তাঁহারই সম্বন্ধে বর্ণনা করিতে লাগিলেন।

এই সময়ে ‘প্রবুদ্ধ-ভারত’ মান্দ্রাজ হইতে মায়াবতীতে নবপ্রতিষ্ঠিত আশ্রমে স্থানান্তরিত হওয়ায় আমরা সকলে প্রায়ই ইহার কথা ভাবিতাম।

স্বামীজী এই পত্রিকাখানিকে বিশেষ ভালবাসিতেন। তৎপ্রদত্ত সুন্দর নামটিও তাহার পরিচয়। তাঁহার নিজের কয়েকখানি মুখপত্র থাকে, এজন্য তিনি সদাই উৎসুক ছিলেন। বর্তমান ভারতে শিক্ষাবিস্তার-কল্পে মাসিক পত্রের কি মূল্য, তাহা তিনি সম্যক্‌রূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন, এবং অনুভব করিয়াছিলেন যে, বক্তৃতা এবং লোকহিতকর কার্যের ন্যায় এই উপায় দ্বারাও তাঁহার গুরুদেবের উপদেশাবলী প্রচার করা আবশ্যক। সুতরাং দিনের পর দিন তিনি যেমন বিভিন্ন কেন্দ্রের লোকহিতকর কাজগুলির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কল্পনা করিতেন, তাঁহার কাজগুলির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও ঠিক সেইরূপ করিতেন। প্রতিদিন তিনি স্বামী স্বরূপানন্দের নব সম্পাদকত্বে আশু-প্রকাশোন্মুখ প্রথম সংখ্যাখানির বিষয়ে কথা পাড়িতেন। একদিন বৈকালে আমরা সকলে বসিয়া আছি, এমন সময়ে তিনি একখণ্ড কাগজ আমাদের নিকট আনিয়া বলিলেনঃ একখানি পত্র লিখিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু উহা কবিতাকারে এরূপ দাঁড়াইল—To the Awakened India.১১

২৬ জুন। আচার্যদেব আমাদের সকলকে ছাড়িয়া একাকী কোন শান্তিপূর্ণ স্থানে যাইবার জন্য উৎসুক হইয়াছিলেন। কিন্তু আমরা ইহা না জানিয়া তাঁহার সহিত ক্ষীরভবানী নামক শুভ্র প্রস্রবণগুলি দেখিতে যাইবার জন্য জেদ করিতে লাগিলাম। শুনিলাম, ইতঃপূর্বে কখনও কোন খ্রীষ্টান বা মুসলমান সেখানে পদার্পণ করে নাই, পরে আমরা ইহা দর্শন করিয়া যে কতদূর কৃতার্থ হইয়াছি, তাহা বর্ণনাতীত; কারণ ভগবান্‌ যেন স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন যে, এই নামটিই আমাদের নিকট সর্বাপেক্ষা পবিত্র হইয়া উঠিবে।

২৯ জুন। আর একদিন আমরা নিজেরাই বিনা আড়ম্বরে দুই তিন সহস্র ফুট উচ্চ একটি ক্ষুদ্র পর্বতের শিখরদেশে খুব ভারী ভারী উপকরণে গঠিত ‘তখ‍্‍ৎ-ই-সুলেমান’ নামক এক ক্ষুদ্র মন্দির দর্শন করিলাম। সেখানে শান্তি ও সৌন্দর্য বিরাজিত, নিম্নে বিখ্যাত ভাসমান উদ্যানগুলি চতুষ্পার্শ্বে বহু ক্রোশ ব্যাপিয়া রহিয়াছে, দেখা গেল। মন্দির এবং স্মৃতিসৌধাদির নির্মাণোপযোগী স্থান-নির্বাচনে হিন্দুগণের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যানুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়, এই বিষয়টির অনুকূলে স্বামীজী যে তর্ক করিতেন, তখ্‌ৎ-ই-সুলেমান তাহার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণস্থল। লণ্ডনে তিনি যেমন একবার বলিয়াছিলেন যে, চারিদিকের দৃশ্য উপভোগ করিবার উদ্দেশ্যেই ঋষিগণ গিরিশীর্ষে বাস করিতেন, তেমনি এখন একটির পর একটি করিয়া ভূরি ভূরি দৃষ্টান্তসহকারে দেখাইয়া দিলেন যে, ভারতবাসিগণ চিরকাল অতি সুন্দর এবং প্রধান প্রধান স্থানগুলি পূজামন্দির নির্মাণপূর্বক পবিত্রতা-মণ্ডিত করিয়া তুলিতেন। সেই সময়ের অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি মনে পড়িতেছে, যথাঃ

‘তুলসী জগমে আইয়ে সবসে মিলিয়ে ধায়।
ন জানৈ কেহি ভেকমে নারায়ণ মিলি যায়॥’

তুলসী জগতে আসিয়া সকলের সহিত মিলিয়া মিশিয়া বাস করে। জানি না কোন্ রূপে নারায়ণ দেখা দেন!

‘একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা।
কর্মাধ্যক্ষঃ সর্বভূতাধিবাসঃ সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণশ্চ॥’

একমাত্র দেবতা সর্বভূতে লুকাইয়া আছেন; তিনি সর্বব্যাপী, সর্বভূতের অন্তরাত্মা, কর্মনিয়ামক, সর্বভূতের আধার, সাক্ষী, চৈতন্যবিধায়ক, নিঃসঙ্গ এবং গুণরহিত।

‘ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং’

সেখানে সূর্য প্রকাশ পান না, চন্দ্র-তারকাও নহে।

কিরূপে একজন রাবণকে রামরূপ ধারণ করিয়া সীতাকে প্রতারণা করিবার পরামর্শ দিয়াছিল, সে গল্পও আমরা শুনিলাম। রাবণ উত্তর দিয়াছিলেনঃ আমি কি এ-কথা ভাবি নাই? কিন্তু কোন লোকের রূপ ধারণা করিতে হইলে তাঁহাকে ধ্যান করিতে হইবে; আর রাম স্বয়ং ভগবান্‌। সুতরাং যখন আমি তাঁহার ধ্যান করি, তখন ব্রহ্মপদও তুচ্ছ হইয়া যায়—তখন পরস্ত্রীর কথা কিরূপে ভাবিব?—

‘তুচ্ছং ব্রহ্মপদং পরবধূসঙ্গঃ কুতঃ?’

পরে স্বামীজী মন্তব্যস্বরূপে বলিলেন, ‘সুতরাং দেখ, অত্যন্ত সাধারণ বা অপরাধীর জীবনেও এই-সব উচ্চ ভাবের আভাস পাওয়া যায়।’ পরদোষ-সমালোচনা সম্বন্ধে বরাবর এইরূপই হইত। তিনি চিরকাল মানবজীবনকে ঈশ্বরের প্রকাশ বলিয়া ব্যাখ্যা করিতেন, এবং কখনও কোন ঘোর দুষ্কার্যের বা দুষ্ট লোকের জঘন্য ও দুর্বৃত্ত ভাবটা লইয়া টানাটানি করিতেন না।

যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ॥১৩ যাহা সর্বলোকের নিকট রাত্রি, সংযমী ব্যক্তি তাহাতে জাগরিত থাকেন; যাহাতে সকল লোক জাগরিত থাকে, তাহা তত্ত্বদর্শী মুনির নিকট রাত্রি (নিদ্রা-স্বরূপ)।

একদিন টমাস আ কেম্পিসের কথা এবং কিরূপে তিনি নিজে গীতা ও ‘ঈশানুসরণ’ মাত্র সম্বল করিয়া সন্ন্যাসীর বেশে ভ্রমণ করিতেন—তাহা বলিতে বলিতে বলিলেন যে, এই পাশ্চাত্য সন্ন্যাসি-প্রবরের নামের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত একটি কথা তাঁহার মনে পড়িলঃ

ওহে লোকশিক্ষকগণ, চুপ কর! হে ভবিষ্যদ্বক্তৃগণ, তোমরাও থামো! প্রভো, শুধু তুমিই আমার অন্তরের অন্তরে কথা কও।

আবার আবৃত্তি করিতেনঃ

তপঃ ক্ব বৎসে ক্ব চ তাবকং বপুঃ।
পদং সহেত ভ্রমরস্য পেলবং
শিরীষপুষ্পং ন পুনঃ পতত্রিণঃ॥১৪

কঠোর দেহসাধ্য তপস্যাই বা কোথায়, আজ তোমার এই সুকোমল দেহই বা কোথায়? সুকুমার শিরীষপুষ্প ভ্রমরেরই চরণপাত সহিতে পারে, কিন্তু পক্ষীর ভার কদাচ সহ্য করিতে পারে না। অতএব উমা, মা আমার, তুমি তপস্যায় যাইও না। আবার গাহিতেনঃ

এস মা, এস মা, ও হৃদয়রমা পরাণপুতলী গো,
হৃদয়-আসনে হও মা আসীন, নিরখি তোমারে গো।
আছি জন্মাবধি তোর মুখ চেয়ে,
জান গো জননী কি যাতনা সয়ে,

একবার হৃদয়-কমল বিকাশ করিয়ে প্রকাশো তাহে আনন্দময়ী।

প্রায়ই মধ্যে মধ্যে গীতা সম্বন্ধে (সেই বিস্ময়কর কবিতা, যাহাতে দুর্বলতা বা কাপুরুষত্বের এতটুকু চিহ্ন মাত্র নাই!) দীর্ঘ কথোপকথন হইত। একদিন তিনি বলিলেন যে, স্ত্রীলোক এবং শূদ্রের জ্ঞানচর্চায় অধিকার নাই—এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ, সকল উপনিষদের সারভাগ গীতায় নিহিত। বাস্তবিকই গীতা ব্যতীত উপনিষদ্ বুঝা একপ্রকার অসম্ভব; এবং স্ত্রীলোক ও সকল জাতিই মহাভারত-পাঠে১৫ অধিকারী ছিল।

৪ জুলাই। অতি উল্লাসের সহিত গোপনে স্বামীজী এবং তাঁহার এক শিষ্যা (শিষ্যাগণের মধ্যে কেবল তিনিই আমেরিকাবাসী নহেন) ৪ জুলাই তারিখে একটি উৎসব করিবার আয়োজন করিলেন। ‘আমাদের আমেরিকার জাতীয় পতাকা নাই, এবং থাকিলে উহা দ্বারা আমাদের দলের অপর যাত্রিগণকে তাঁহাদের জাতীয়-উৎসব উপলক্ষে প্রাতরাশকালে অভিনন্দন করা যাইতে পারিত’, এই বলিয়া একজন দুঃখ করিতেছেন—ইহা তিনি শুনিতে পান। ৩ তারিখে অপরাহ্নে মহা ব্যস্ততার সহিত তিনি এক কাশ্মীরী পণ্ডিত দর্জীকে লইয়া আসিলেন এবং বুঝাইয়া দিলেন যে, যদি এই ব্যক্তিকে পতাকাটি কিরূপ করিতে হইবে বলিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে সে সানন্দে সেইরূপ করিয়া দিবে। ফলে তারকা ও ডোরা দাগগুলি (Stars and Stripes) অত্যন্ত আনাড়ীর মত একখণ্ড বস্ত্রে আরোপিত হইল এবং উহা চিরশ্যামল গাছের (evergreen) কয়েকটি শাখার সহিত, ভোজনাগাররূপে ব্যবহৃত নৌকাখানির শিরোভাগে পেরেক দিয়া আঁটিয়া দেওয়া হইল। এমন সময়ে আমেরিকাবাসিগণ স্বাধীনতা-লাভের দিবসে (Independence Day) প্রাতঃকালীন চা পান করিবার জন্য নৌকাখানিতে পদার্পণ করিলেন। স্বামীজী এই ক্ষুদ্র উৎসবটিতে উপস্থিত থাকিবার জন্য আর এক জায়গায় যাওয়া স্থগিত করিয়াছিলেন, এবং তিনি অন্যান্য অভিভাষণের সহিত নিজে একটি কবিতা১৬ উপহার দিলেন। সেটি এক্ষণে স্বাগত-স্বরূপে সর্বসমক্ষে পঠিত হইলঃ To the Fourth of July.

৫ জুলাই। সেই দিন সন্ধ্যাকালে একজন, পাশ্চাত্যসমাজে প্রচলিত মেয়েলি শাস্ত্র অনুযায়ী পরিহাসচ্ছলে কবে তাঁহার বিবাহ হইবে দেখিবার জন্য নিজ থালায় কয়টি চেরী ফলের বিচি অবশিষ্ট আছে, গনিয়া দেখেন! স্বামীজী ইহাতে দুঃখিত হন। কি জানি কেন, স্বামীজী এই খেলাটিকে সত্য বলিয়া ধরিয়া লন এবং পরদিন প্রাতঃকালে যখন তিনি আসিলেন, তখন দেখিলাম, শ্রেষ্ঠ ত্যাগের প্রতি তাঁহার প্রবল অনুরাগ উথলিয়া পড়িতেছে।

৬ জুলাই। অপরাধীর সহিত যেন এক চিন্তা-ক্ষেত্রে দাঁড়াইবার যে সহৃদয় বাসনা তাঁহাতে প্রায়ই পরিলক্ষিত হইত, সেই ইচ্ছা-প্রণোদিত হইয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘এই সব গার্হস্থ্য এবং বিবাহিত জীবনের ছায়া আমার মনে পর্যন্ত মাঝে মাঝে দেখা দেয়!’ কিন্তু এই প্রসঙ্গে তিনি, যাহারা গার্হস্থ্য জীবনের জয়গান করে, তাহাদের প্রতি দারুণ অবজ্ঞাভরে ত্যাগাদর্শের উপর জোর দিবার সময় যেন বহু উচ্চে উঠিয়া গেলেন। বলিয়া উঠিলেন, ‘জনক হওয়া কি এত সোজা?—সম্পূর্ণরূপে অনাসক্ত হইয়া রাজ-সিংহাসনে বসা? ধনের বা যশের অথবা স্ত্রী-পুত্রের প্রতি কোন খেয়াল না রাখা?—পাশ্চাত্যে আমাকে বহু লোকে বলিয়াছে যে, তাহারা এই অবস্থায় উপনীত হইয়াছে। কিন্তু আমি এইটুকুমাত্র বলিতে পারিয়াছিলাম—‘এমন সব মহাপুরুষ তো ভারতবর্ষে জন্মান না!’

তারপর তিনি অন্য দিক্‌টির কথা কহিতে লাগিলেন।

শ্রোতাদের মধ্যে একজনকে তিনি বলিলেনঃ এ-কথা মনে মনে বলিতে এবং তোমার সন্তানদিগকে শিখাইতে কখনও ভুলিও না যে,

মেরুসর্ষপয়োর্যদ‍্‍বৎ সূর্যখদ্যোতয়োরিব।
সরিৎসাগরয়োর্যদ‍্‍বৎ তথা ভিক্ষুগৃহস্থয়োঃ॥

মেরু এবং সর্ষপে যে প্রভেদ, সূর্য এবং খদ্যোতে যে প্রভেদ, সমুদ্র এবং ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে প্রভেদ, সন্ন্যাসী এবং গৃহীতেও সেই প্রভেদ।

‘সর্বং বস্তু ভয়ান্বিতং ভুবি নৃণাং বৈরাগ্যমেবাভয়ম্।’

পৃথিবীতে সকল বস্তুই ভয়যুক্ত, মানবের পক্ষে বৈরাগ্যই ভয়রহিত।

ভণ্ড সাধুরাও ধন্য, এবং যাহারা ব্রত উদ্‌যাপন করিতে অক্ষম হইয়াছে, তাহারাও ধন্য; কারণ তাহারাও আদর্শের শ্রেষ্ঠতা বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়াছে, এবং এইরূপে কতকাংশে অপরের সফলতার কারণ। আমরা যেন কখনও আমাদের আদর্শ না ভুলি—কোন মতেই না ভুলি। এই-সব মুহূর্তে তিনি প্রতিপাদ্য ভাবটির সহিত সর্বতোভাবে এক হইয়া যাইতেন। এই সব কথাবার্তা যখন হয়, তখন আমরা ডালহ্রদ হইতে শ্রীনগরে ফিরিয়াছি। ডালহ্রদ দর্শনই আমাদের ৪ জুলাই-এর উৎসবের প্রকৃত আনন্দ-অনুষ্ঠান।

পরবর্তী রবিবার, ১০ জুলাই রাত্রে বিভিন্ন সূত্রে আমরা সংবাদ পাইলাম যে, আচার্যদেব সোনমার্গের রাস্তা দিয়া অমরনাথ গিয়াছেন, এবং অপর একটি পথ দিয়া ফিরিবেন। কপর্দকমাত্র না লইয়া তিনি যাত্রা করিয়াছিলেন, কিন্তু হিন্দুশাসিত দেশীয় রাজ্যে এই ব্যাপার তাঁহার বন্ধুবর্গের কোন উদ্বেগের কারণ হয় নাই।

১৫ জুলাই। শুক্রবার অপরাহ্ণে পাঁচটার সময় আমরা নদীর অনুকূল স্রোতে কিয়দ্দূর যাইবার জন্য সবেমাত্র নৌকা খুলিয়াছি, এমন সময় ভৃত্যগণ দূরে তাহাদের কয়েকজন বন্ধুকে চিনিতে পারিল, এবং আমাদের সংবাদ দিল যে, স্বামীজীর নৌকা আমাদের অভিমুখে আসিতেছে।

এক ঘণ্টা পরেই তিনি আমাদের সহিত মিলিত হইলেন এবং বলিলেন, ফিরিয়া আসিয়া তিনি আনন্দ অনুভব করিলেন। এবারকার গ্রীষ্ম ঋতুতে অস্বাভাবিক গরম পড়িয়াছিল, এবং কয়েকটি তুষারবর্ত্ম (glacier) ধসিয়া যাওয়ায় সোনমার্গ হইয়া অমরনাথ যাইবার রাস্তাটি দুর্গম হইয়া গিয়াছে। এই ঘটনায় তিনি ফিরিয়া আসেন।

কিন্তু আমাদের কাশ্মীরবাসের কয়েক মাসে আমরা স্বামীজীর যে তিনটি মহান্ দর্শন ও ইহার ফলে বিপুল আনন্দোপলব্ধির পরিচয় পাইয়াছিলাম, তাহার প্রথমটির সূত্রপাত এই সময় হইতেই। যেন আমরা স্বচক্ষে তাঁহার গুরুদেবের সেই উক্তির সত্যতা অনুভব করিতে পারিতেছিলামঃ

খানিকটা অজ্ঞান রহিয়াছে বটে। সেটুকু আমার ব্রহ্মময়ী মা-ই উহার মধ্যে রাখিয়া দিয়াছেন, তাঁহার কাজ হইবে বলিয়া। কিন্তু উহা ফিন-ফিনে কাগজের পর্দার মত, নিমিষের মধ্যে ছিঁড়িয়া ফেলা যায়।

স্থান—কাশ্মীর (পাণ্ড্রেন্থানের মন্দির)
কাল—১৬ হইতে ১৯ জুলাই

১৬ জুলাই। পর দিবস জনৈকা শিষ্যার স্বামীজীর সহিত একখানি ছোট নৌকা করিয়া নদীবক্ষে গমনের সুযোগ ঘটিয়াছিল। নৌকা স্রোতের অনুকূলে চলিতেছে, আর তিনিও রামপ্রসাদের গানগুলি একটির পর একটি গাহিয়া চলিয়াছেন, এবং মধ্যে মধ্যে একটু আধটু অনুবাদ করিয়া দিতেছেনঃ

‘ভূতলে আনিয়া মাগো করলি আমায় লোহা-পেটা,
(আমি) তবু কালী বলে ডাকি, মা, সাবাস আমার বুকের পাটা।’

অথবা,

‘মন কেন রে ভাবিস এত,
যেন মাতৃহীন বালকের মত’        ইত্যাদি।

তারপর শিশু কুপিত হইলে যেমন গর্ব ও অভিমানভরে বলিয়া থাকে, সেই ভাবের একটি গান গাহিলেন। তাহার শেষভাগটি এই—

‘আমি এমন মায়ের ছেলে নই যে,
বিমাতাকে মা বলিব।’

১৭ জুলাই। খুব সম্ভবতঃ ইহারই পরদিবস তিনি ধীরামাতার নৌকায় আসিয়া ভক্তি-প্রসঙ্গ করিতে থাকেন। প্রথমেই একাধারে হরগৌরীমিলনস্বরূপ সেই অদ্ভুত হিন্দুভাবটি কথিত হইল। তাহার কথাগুলি এখানে দেওয়া সহজ, কিন্তু সেই কণ্ঠস্বরের অভাবে কথাগুলি কিরূপ প্রাণহীন মনে হইতেছে। তাহা ছাড়া তখনকার চতুষ্পার্শ্বের দৃশ্য কি অপরূপ ছিল!—ছবিখানির মত শ্রীনগর, লম্বার্ডি-দেশসুলভ সমুন্নতশির পপলার গাছগুলি, এবং দূরে চির-তুষাররাশি! সেই নদীগর্ভ উপত্যকায় মহান্ পর্বতরাজির পাদমূল হইতে কিঞ্চিৎ দূরে তিনি আবৃত্তি করিলেনঃ

কস্তূরিকাচন্দনলেপনায়ৈ, শ্মশানভস্মাঙ্গবিলেপনায়। সৎকুণ্ডলায়ৈ ফণিকুণ্ডলায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥
মন্দারমালাপরিশোভিতায়ৈ, কপালমালাপরিশোভিতায়।
দিব্যাম্বরায়ৈ চ দিগম্বরায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥
* * *
সদা শিবানাং পরিভূষণায়ৈ সদাঽশিবানাং পরিভূষণায়।
শিবান্বিতায়ৈ চ শিবান্বিতায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥

এবং পরক্ষণেই সেই ভাবেরই আর একরূপ—অপর ভাবে মগ্ন হইয়া তিনি আবৃত্তি করিলেনঃ

কিশোরীর প্রেম নিবি আয়, প্রেমের জোয়ার বয়ে যায়;
বইছে রে প্রেম শতধারে, যে যত চায় তত পায়।
প্রেমের কিশোরী—প্রেম বিলাচ্ছেন সাধ করি,
রাধার প্রেমে বল্ রে হরি॥
প্রেমে প্রাণ মত্ত করে, প্রেমতরঙ্গে প্রাণ মাতায়,
রাধার প্রেমে হরি বলে আয়, আয়, আয়।

তিনি এত তন্ময় হইয়া গিয়াছিলেন যে, তাঁহার প্রাতরাশ প্রস্তুত হইয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত পড়িয়া রহিল, এবং অবশেষে ‘যখন এই-সব ভক্তির প্রসঙ্গ চলিতেছে, তখন আর খাবারের কি দরকার?’—এই বলিয়া তিনি অনিচ্ছাপূর্বক উঠিয়া গেলেন এবং অতি সত্বরই ফিরিয়া আসিয়া সেই বিষয়ের পুনরালোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন।

কিন্তু—হয় এই সময়েই, না হয় অপর কোন সময়ে তিনি বলিয়াছিলেন যে, যাহার নিকট হইতে তিনি বড় বড় কার্যের প্রত্যাশা রাখেন, তাহার নিকট তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন না। কঠোর এবং আগ্রহবান্ কর্মীর জনক শিব, এবং কর্মীর পক্ষে তাঁহারই পদে উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত।

পরদিন তিনি আমাদিগকে শ্রীরামকৃষ্ণের একটি চমৎকার উপদেশ শুনাইলেন, তাহাতে অপরের সমালোচককে মৌমাছি বা মাছির সহিত তুলনা করা হইয়াছে। যাহারা মধু অন্বেষণ করে, তাহারাই মৌমাছি; আর যাহারা বাছিয়া বাছিয়া ঘায়ে বসে, তাহারাই মাছি।

পরে আমরা ইসলামাবাদ অভিমুখে যাত্রা করিলাম। ঘটনাচক্রে ইহাই বাস্তবিক অমরনাথ-যাত্রা হইয়া দাঁড়াইল।

১৯ জুলাই। প্রথম অপরাহ্নটিতে বিতস্তা নদীতীরে এক জঙ্গলের মধ্যে আমরা চির-অন্বেষিত পাণ্ড্রেন্থান মন্দির আবিষ্কার করিলাম। (পাণ্ড্রেন্থান কি পাণ্ড্রেস্থান—পাণ্ডবগণের স্থান?) …

স্বামীজীর চক্ষে স্থানটি ইতিহাসের অতি মধুর স্মৃতিবিজড়িত। ইহা বৌদ্ধধর্মের প্রত্যক্ষ নিদর্শনস্বরূপ এবং ইতঃপূর্বে তিনি কাশ্মীরের ইতিহাসকে যে চারিটি ধর্মযুগে বিভক্ত করিয়াছিলেন, ইহা সেগুলিরই অন্যতম।

(১) বৃক্ষ ও সর্পপূজার যুগ—এই সময় হইতেই নাগ-শব্দান্ত কুণ্ডনামগুলির প্রচলন, যথা বেরনাগ ইত্যাদি (২) বৌদ্ধধর্মের যুগ (৩) সৌরোপাসনার আকারে প্রচলিত হিন্দুধর্মের যুগ এবং (৪) মুসলমান-ধর্মের যুগ। তিনি বলিলেন, ভাস্কর্যই বৌদ্ধধর্মের বিশেষ শিল্প, এবং সূর্যচিহ্নিত চক্র অথবা পদ্ম ইহার খুব মামুলি কারুকার্যস্থানীয়। সর্পসম্বলিত মূর্তিগুলিতে বৌদ্ধধর্মের পূর্বেকার যুগের আভাস। কিন্তু সৌরোপাসনার কালে ভাস্কর্যের যথেষ্ট অবনতি হইয়াছিল, এই নিমিত্ত সূর্যমূর্তিটি নৈপুণ্য-বর্জিত।

তখন সূর্যাস্তের সময়—কি অপরূপ সূর্যাস্ত! পশ্চিম দিকের পর্বতগুলি গাঢ় লাল রঙে ঝক্‌ঝক্ করিতেছে। আরও উত্তরে বরফ ও মেঘে সেগুলি নীল দেখাইতেছিল। আকাশ হরিৎ এবং পীত, তাহার সহিত ঈষৎ লাল—উজ্জ্বল অগ্নিশিখার রঙের এবং ড্যাফোডিল ফুলের মত হরিদ্রাবর্ণ; তাহার পিছনেই নীল এবং ওপলের মত সাদা পটভূমি। আমরা দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলাম; তারপরেই ‘সুলেমানের সিংহাসন’ (যাহা ইতোমধ্যেই আমাদের প্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল, সেই ক্ষুদ্র তখ‍্‍ৎ) নজরে পড়িবামাত্র আচার্যদেব বলিয়া উঠিলেন, ‘মন্দির স্থাপনে হিন্দু কি প্রতিভারই বিকাশ দেখায়! যেখানে চমৎকার দৃশ্য, হিন্দু সেই স্থানটি বাছিয়া লয়! দেখ, এই তখ্‌ৎ হইতে সমগ্র কাশ্মীরটি দেখিতে পাওয়া যায়। নীল জলরাশির মধ্য হইতে লোহিতাভ হরিপর্বত উঠিয়াছে, যেন মুকুট পরিয়া একটি সিংহ অর্ধশায়িতভাবে অবস্থান করিতেছে আর মার্তণ্ড-মন্দিরের পাদমূলে একটি উপত্যকা রহিয়াছে!’

আমাদের নৌকাগুলিকে বনপ্রান্ত হইতে অনতিদূরে নঙ্গর করা হইয়াছিল, এবং আমরা দেখিতে পাইলাম—আমাদিগের সদ্য-আবিষ্কৃত নিস্তব্ধ দেবালয় এবং বুদ্ধমূর্তিটি স্বামীজীর মনে গভীর ভাবের উদ্রেক করিয়াছে। সেই দিন সন্ধ্যার সময় আমরা ধীরামাতার বজরায় একত্র হইলাম, এবং তত্রত্য কথোপকথনের কিয়দংশ এখানে লিপিবদ্ধ হইল।

ঈশাহি ধর্মের ক্রিয়াকাণ্ড বৌদ্ধধর্মের ক্রিয়াকাণ্ড হইতেই উদ্ভূত, আচার্যদেব এই মর্মে বলিতেছিলেন, কিন্তু আমাদের একজন এই মতটি আদৌ মানিতে চাহেন না।

উক্ত নারী॥ বৌদ্ধ কর্মকাণ্ডই বা কোথা হইতে আসিল?

স্বামীজী॥ বৈদিক কর্মকাণ্ড হইতে।

প্রশ্নকর্ত্রী॥ অথবা ইহা দক্ষিণ ইওরোপেও প্রচলিত ছিল বলিয়া এইরূপ সিদ্ধান্ত করাই ভাল নয় কি যে, বৌদ্ধ ঈশাহি এবং বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ড সবই এক সাধারণ ভূমি হতে উদ্ভূত?

স্বামীজী॥ না, তাহা হইতেই পারে না! তুমি ভুলিয়া যাইতেছ যে, বৌদ্ধধর্ম সম্পূর্ণভাবে হিন্দুধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল! এমন কি, জাতি-বিভাগের বিরুদ্ধে পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম কিছু বলে নাই! অবশ্য জাতিবিভাগ তখনও কোন নির্দিষ্ট রূপ লাভ করে নাই, এবং বুদ্ধদেব আদর্শটিকে পুনঃস্থাপন করিতে প্রয়াসী হইয়াছিলেন মাত্র। মনু বলিতেছেন, যিনি এই জীবনেই ভগবৎ-সাক্ষাৎকার করেন, তিনিই ব্রাহ্মণ। বুদ্ধদেব সাধ্যমত এইটি কার্যে পরিণত করিতে চাহিয়াছিলেন মাত্র।

প্রশ্ন॥ কিন্তু ঈশাহি এবং বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে কি সম্বন্ধ? তাহারা এক—ইহা কখনও সম্ভব হইতে পারে? এমন কি, আমাদের পূজাপদ্ধতির যাহা মেরুদণ্ডস্বরূপ, আপনাদের ধর্মে তাহার নামগন্ধও নাই!

স্বামীজী॥ নিশ্চয়ই আছে! বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডেও ম্যাস (Mass) আছে, তাহাই দেবতার উদ্দেশে ভোগ নিবেদন করা, আর তোমাদের Blessed Sacramentআমাদের ‘প্রসাদ’ স্থানীয়। শুধু গ্রীষ্মপ্রধান দেশের প্রথানুযায়ী উহা হাঁটু না গাড়িয়া, বসিয়া বসিয়া নিবেদন করা হয়। তিব্বতের লোক হাঁটু গাড়িয়া থাকে। এতদ্ভিন্ন বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডেও ধূপদীপ দান এবং গীতবাদ্যের প্রথা আছে।

প্রশ্ন॥ কিন্তু ঈশাহি-ধর্মের মত ইহাতে কোন প্রার্থনা আছে কি?

কেহ এইভাবে আপত্তি তুলিলে স্বামীজী বরাবর তদুত্তরে কোন নির্ভীক আপাত- বিরুদ্ধ—কিন্তু অভ্রান্ত মত প্রয়োগ করিতেন, এবং তাহার মধ্যে কোন অভিনব এবং অচিন্তিতপূর্ব সামান্যীকরণ নিহিত থাকিত।

স্বামীজী॥ না; আর ঈশাহি-ধর্মেও কোনকালে ছিল না। এ তো ছাঁকা প্রোটেষ্টাণ্ট ধর্ম, এবং প্রোটেষ্টাণ্ট ধর্ম মুসলমানের নিকট হইতে—সম্ভবতঃ মূর জাতির প্রভাবের মধ্য দিয়া ইহা গ্রহণ করিয়াছিল।

পৌরোহিত্যের ভাব একেবারে ভূমিসাৎ করিয়া দেওয়া, সেটা একমাত্র মুসলমান ধর্মই করিয়াছে। যিনি অগ্রণী হইয়া প্রার্থনা পাঠ করেন, তিনি শ্রোতৃবর্গের দিকে পিছন ফিরিয়া দাঁড়ান এবং শুধু কোরান-পাঠই বেদী হইতে চলিতে পারে। প্রোটেষ্টাণ্ট ধর্ম এই ভাবটিই আনিতে চেষ্টা করিয়াছে।

এমন কি, ‘tonsure’ পর্যন্ত ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, উহাই আমাদের মুণ্ডন। জাস্টিনিয়ান দুইজন সন্ন্যাসীর নিকট হইতে মুসার যুগে প্রচলিত বিধি-নিষেধ গ্রহণ করিতেছেন, এইরূপ একখানি চিত্র আমি দেখিয়াছি। তাহাতে সাধুদ্বয়ের মস্তক সম্পূর্ণ মুণ্ডিত। বৌদ্ধযুগের প্রাক্‌কালীন হিন্দুধর্মে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী দুই-ই বর্তমান ছিল। ইওরোপ নিজ ধর্মসম্প্রদায়গুলি ‘থিবেইড’১৭ হইতে পাইয়াছে।

প্রশ্ন॥ এই হিসাবে তাহা হইলে আপনি ক্যাথলিক ধর্মের ক্রিয়াকাণ্ডকে আর্য ক্রিয়াকাণ্ড বলিয়া স্বীকার করেন?

স্বামীজী॥ হাঁ। প্রায় সমগ্র ঈশাহি-ধর্মই আর্যধর্ম বলিয়া আমার বিশ্বাস। আমার মনে হয়, খ্রীষ্ট বলিয়া কখনও কেহ ছিল না। ক্রীট দ্বীপের অদূরে সেই স্বপ্ন১৮ দেখা অবধি আমার বরাবর এই সন্দেহ! আলেকজান্দ্রিয়ায় ভারতীয় এবং মিসরীয় ভাবের সংমিশ্রণ হয়; এবং উহাই য়াহুদী ও যাবনিক (গ্রীক) ধর্মের দ্বারা অনুরঞ্জিত হইয়া জগতে ঈশাহি-ধর্ম নামে প্রচারিত হইয়াছে।

জানই তো যে, ‘কার্যকলাপ’ এবং ‘পত্রাবলী’ (Acts and Epistles) ‘জীবনীচতুষ্টয়’ (Four Gospels) হইতে প্রাচীনতর, এবং সেণ্ট জন্ একটা কল্পনা। মাত্র একজন লোক সম্বন্ধে আমরা নিঃসন্দেহ—তিনি সেণ্ট পল। তিনিও আবার স্বচক্ষে ঘটনাগুলি দেখেন নাই। না! ধর্মাচার্যগণের মধ্যে কেবল মাত্র বুদ্ধ এবং মহম্মদই স্পষ্ট ঐতিহাসিক সত্তারূপে দণ্ডায়মান; কারণ সৌভাগ্যক্রমে তাঁহারা জীবদ্দশাতেই শত্রু-মিত্র—দুই-ই লাভ করিয়াছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে; যোগী, গোপ এবং পরাক্রান্ত নরপতি—এই-সব একত্র হইয়া গীতাহস্তে একখানি নয়নাভিরাম মূর্তির সৃষ্টি করিয়াছে।

রেনার (Rener) ঈশাজীবনী তো শুধু ফেনা। ইহা স্ট্রসের (Strauss) কাছে ঘেঁষিতে পারে না, স্ট্রসই সাচ্চা প্রত্নতত্ত্ববিৎ। ঈশার জীবনে দুইটি জিনিষ জীবন্ত ব্যক্তিগত লক্ষণে ভূষিত—সাহিত্যের সর্বাপেক্ষা সুন্দর উপাখ্যান, ব্যভিচার-অপরাধে ধৃতা সেই রমণী এবং কূপ-পার্শ্ববর্তিনী সেই নারী।

এই শেষোক্ত ঘটনাটির ভারতীয় জীবনের সহিত কি অদ্ভুত সঙ্গতি! একটি স্ত্রীলোক জল তুলিতে আসিয়া দেখিল, কূপের ধারে বসিয়া একজন পীতবাস সাধু তাহার নিকট জল চাহিলেন। তারপর তিনি তাহাকে উপদেশ দিলেন এবং তাহার মনের গোটাকয়েক কথা বলিয়া দিলেন। … শুধু ভারতীয় গল্পে উপসংহারটা এইরূপ হইবে যে, যখন উক্ত নারী গ্রামবাসিগণকে সাধু দেখিতে এবং সাধুর কথা শুনিবার জন্য ডাকিতে গেল, সেই অবসরে সাধুটি সুযোগ বুঝিয়া পলাইয়া বনমধ্যে আশ্রয় লইলেন।

মোটের উপর আমার মনে হয়, জ্ঞানবৃদ্ধ হিলেলই (Rabbi Hillel) ঈশার উপদেশাবলীর উদ্ভবকর্তা, আর ন্যাজারীন নামে এক বহু প্রাচীন, কিন্তু অখ্যাত য়াহুদী সম্প্রদায় ছিল, উহাই সহসা সেণ্ট পল (St. Paul) কর্তৃক যেন বৈদ্যুতিক শক্তিতে অনুপ্রাণিত হইয়া এক পৌরাণিক ব্যক্তিকে আরাধনার কেন্দ্ররূপে জোগাইয়া দিয়াছে।

পুনরুত্থান (Resurrection) জিনিষটা তো বসন্ত-দাহ (Spring cremation) প্রথারই রূপান্তর মাত্র। যাহাই হউক না কেন, দাহপ্রথা শুধু ধনী যবন (গ্রীক) ও রোমকগণের মধ্যেই প্রচলিত ছিল, আর সূর্যঘটিত নব উপাখ্যানটি সেই অল্পসংখ্যক লোকের মধ্যেই উহাকে সীমাবদ্ধ করিয়া থাকিবে।

কিন্তু বুদ্ধ! পৃথিবীতে যত লোক জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তন্মধ্যে তিনিই যে সর্বশ্রেষ্ঠ, এ বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। তিনি নিজের জন্য একটিবারও নিঃশ্বাস লন নাই! সর্বোপরি, তিনি কখনও পূজা আকাঙ্ক্ষা করেন নাই। তিনি বলিয়াছিলেনঃ বুদ্ধ কোন ব্যক্তি নহেন, উহা একটি অবস্থাবিশেষ। আমি দ্বার খুঁজিয়া পাইয়াছি। এস, তোমরা সকলেই প্রবেশ কর!

তিনি ‘পতিতা’ অম্বাপালীর নিমন্ত্রণে গিয়াছিলেন। প্রাণনাশ হইবে জানিয়াও তিনি অন্ত্যজের গৃহে ভোজন করিয়াছিলেন এবং মৃত্যুকালে অতিথিসৎকারককে এই মহামুক্তি-দানের জন্য ধন্যবাদ দিয়া তাঁহার নিকট লোক পাঠান। সত্যলাভের পূর্বেই একটি ক্ষুদ্র ছাগ-শিশুর জন্য ভালবাসা ও দয়ায় কাতর! তোমাদের স্মরণ আছে, কিরূপে রাজপুত্র এবং সন্ন্যাসী হইয়াও তিনি নিজ মস্তক পর্যন্ত দিতে চাহিয়াছিলেন, যদি রাজা শুধু যে ছাগশিশুটিকে বলি দিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, সেটিকে মুক্তি দেন; এবং কিরূপে সেই রাজা তাঁহার অনুকম্পার নিদর্শনে মুগ্ধ হইয়া উক্ত ছাগশিশুটির প্রাণ দান করেন। জ্ঞানবিচার এবং সহৃদয়তার এমন অপূর্ব সংমিশ্রণ আর কোথাও দেখা যায় না! নিশ্চয়ই তাঁহার মত আর কেহ জন্মগ্রহণ করেন নাই, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই।

স্থান—কাশ্মীর (বিতস্তাতীরে)
কাল—২০ হইতে ২৯ জুলাই

২০ জুলাই। সে দিন প্রাতঃকালে নদী প্রশস্ত, অগভীর এবং নির্মল ছিল। আমাদের দুইজন স্বামীজীর সহিত নদীর ধারে ধারে ক্ষেতের উপর দিয়া প্রায় তিন মাইল বেড়াইয়াছিলেন। স্বামীজী প্রথমে পাপবোধ-সম্বন্ধে আরম্ভ করিলেনঃ কিরূপে উহা মিশর, শেম-বংশাধিষ্ঠিত জনপদসমূহ এবং আর্যভূমি—এই তিনেরই সহিত সংশ্লিষ্ট। বেদে ইহার নিদর্শন পাওয়া যায়, কিন্তু অতি অল্পক্ষণের জন্য। বেদে শয়তানকে ক্রোধের অধীশ্বর বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। পরে বৌদ্ধদের মধ্যে উহা কামের অধীশ্বর ‘মার’ নামে পরিচিত, এবং ভগবান্ বুদ্ধের একটি সর্বজনপ্রিয় নাম ‘মারজিৎ’।১৯ কিন্তু শয়তান যেন বাইবেলের হ্যামলেট, হিন্দুশাস্ত্রে ক্রোধের অধীশ্বর কখনও সেরূপে সৃষ্টিকে দুই ভাগ করিয়া ফেলে না। সে সর্বদাই মলিনতার (defilement) উদাহরণস্থল, কখনও দ্বৈতসত্তার নহে।

জরথুষ্ট্র কোন প্রাচীনতর ধর্মের সংস্কারক ছিলেন। তাঁহার মতে অর্মাজ্‌দ এবং আহ্রিমান্ পর্যন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ দেবের বিকাশমাত্র। সেই প্রাচীনতর ধর্ম বৈদান্তিক না হইয়া যায় না। সুতরাং মিশরীয়গণ এবং শেম-বংশধরগণ পাপবাদ আঁকড়াইয়া থাকে, আর আর্যগণ—যথা ভারতবাসী এবং গ্রীক যবনগণ—শীঘ্রই উহা পরিত্যাগ করে। ভারতবর্ষে পুণ্য ও পাপ বিদ্যা ও অবিদ্যায় পরিণত হইল, উভয়কেই ছাড়াইয়া যাইতে হইবে। আর্যগণের মধ্যে পারসিক এবং ইওরোপীয়গণ ধর্মচিন্তায় শেম-বংশধরগণের লক্ষণাক্রান্ত হইল; এই হেতুই তাহাদের মধ্যে পাপবোধ।

তারপরে এ-সকল কথা ছাড়িয়া বিষয়ান্তরের—ভারতবর্ষ ও তাহার ভবিষ্যতের—প্রসঙ্গ উঠিল। এরূপ প্রায়ই ঘটিত। কোন জাতিতে বল সঞ্চার করিতে হইলে উহাকে কিরূপ ভাব দেওয়া উচিত? তাহার নিজের উন্নতির গতি একদিকে চলিতেছে, তাহাকে ‘ক’ বলা যাউক। যে নূতন বল সঞ্চারিত হইবে তাহা কি সঙ্গে সঙ্গে উহার কিঞ্চিৎ হ্রাসও করিবে, যেমন ‘খ’? ইহার ফলে এতদুভয়ের মধ্যপথবর্তী এক পরিণতি হইবে, যেমন ‘গ’। ইহা তো জ্যামিতিক পরিবর্তনমাত্র। এরূপ তো চলিবে না। জাতীয় জীবন জৈবিক শক্তির ব্যাপার। আমাদিগকে সেই জীবনস্রোতটিতেই বলাধান করিতে হইবে, অবশিষ্ট কার্য উহা নিজে নিজেই করিয়া লইবে। বুদ্ধ ‘ত্যাগ’ প্রচার করিলেন এবং ভারত উহা শুনিল; এবং এক সহস্র বৎসর মধ্যে ভারত জাতীয় সম্পদের উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিল। ত্যাগই ভারতের জাতীয় জীবনের উৎস। সেবা ও মুক্তি তাহার শ্রেষ্ঠ আদর্শ। হিন্দুজননী সকলের শেষে আহার করেন। বিবাহ ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে, উহা জাতি ও বর্ণের কল্যাণের নিমিত্ত। নব্য সংস্কারকগণের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি সমস্যা-পূরণের অনুপযোগী এক পরীক্ষায় হস্তক্ষেপ করিয়া জীবন আহুতি দিয়াছেন, আর সমস্ত জাতি তাঁহাদের উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছে।

তারপরে আবার কথাবার্তার ভাব বদলাইয়া গেল, এবং কেবল হাসিঠাট্টা, কৌতুক এবং গল্পগুজব চলিতে লাগিল। আমরা শুনিতে শুনিতে হাসিয়া অধীর হইতেছিলাম। এমন সময় নৌকা আসিয়া পৌঁছিল এবং সেদিনের মত কথাবার্তা শেষ হইল।

সেদিনকার সমস্ত বৈকাল এবং রাত্রি স্বামীজী পীড়িত হইয়া নিজ নৌকায় শুইয়াছিলেন। কিন্তু পরদিন যখন আমরা—বিজবেহার মন্দিরে অবতরণ করিলাম—ইতোমধ্যেই সেখানে অমরনাথযাত্রীর ভিড় লাগিয়া গিয়াছে—তখন তিনি আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য মিলিত হইতে সক্ষম হইয়াছিলেন। ‘শীঘ্র সারিয়া উঠা এবং শীঘ্র অসুখে পড়া’—চিরকালই তাঁহার বিশেষত্ব ছিল, এ-কথা তিনিও নিজের সম্বন্ধে বলিতেন। উহার পর, দিবসের অধিকাংশ সময়ই তিনি আমাদের সহিত ছিলেন, এবং অপরাহ্নে আমরা ইসলামাবাদ পৌঁছিলাম।

সেইদিন বৈকালে গোধূলির সময় আচার্যদেব ধীরামাতা ও জয়াকে নিজের সম্বন্ধে বলিতেছিলেন। তিনি দুই টুকরা পাথর হাতে লইয়া বলিতেছিলেন, ‘সুস্থ অবস্থায় আমার মন এটা ওটা সেটা লইয়া থাকিতে পারে, অথবা আমার সঙ্কল্পের জোর কমিয়া গিয়াছে মনে হইতে পারে, কিন্তু এতটুকু যন্ত্রণা বা পীড়া আসুক দেখি, ক্ষণিকের জন্যও আমি মৃত্যুর সামনা-সামনি হই দেখি, অমনি আমি এই রকম শক্ত হইয়া যাই’—বলিয়া পাথর দুখানিকে পরস্পর ঠুকিলেন—‘কারণ আমি ঈশ্বরের পাদপদ্ম স্পর্শ করিয়াছি।’

গাছগুলির নীচে ঘাসের উপর বসিয়া আমরা নানা কথা কহিতে লাগিলাম, এবং দু-এক ঘণ্টা আধা-হাল্কা আধা-গম্ভীর কথাবার্তা চলিল। বৃন্দাবনে বানরগুলা কিরূপ দুষ্টামি করিতে পারে, তাহার অনেক বর্ণনা শুনিলাম। এবং আমরা নানা প্রশ্ন করিয়া জানিতে পারিলাম যে, পরিব্রাজক-জীবনে দুইটি বিভিন্ন ঘটনায় বিপদে যে সাহায্য আসিতেছে, স্বামীজী তাহা পূর্ব হইতে জানিতে পারিয়াছিলেন, এবং ভবিষ্যৎ-দর্শন সত্য হইয়াছিল। একবার তিনি কয়েক দিন ধরিয়া কিছু খাইতে পান নাই, এক রেল ষ্টেশনে ক্লান্তিতে মৃতকল্প হইয়া পড়িয়াছিলেন; এমন সময় সহসা তাঁহার মনে হইল যে, তাঁহাকে উঠিয়া কোন একটি রাস্তা দিয়া যাইতে হইবে, আর সেখানে তিনি একজন লোকের দেখা পাইবেন, যে তাঁহাকে সাহায্য করিবে। তিনি তদনুসারে কার্য করিলেন এবং এক থালা খাবার হাতে একজন লোকের দেখা পাইলেন। এই ব্যক্তি তাঁহার নিকটে আসিয়া তাঁহাকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল এবং জিজ্ঞাসা করিল, ‘যাঁহার নিকট আমি প্রেরিত হইয়াছি, আপনিই কি তিনি?’

তারপরে একটি শিশু আমাদের নিকট আনীত হইল, তাহার হাত খুব কাটিয়া গিয়াছে। স্বামীজীও বৃদ্ধামহলে প্রচলিত একটি ঔষধ প্রয়োগ করিলেন। ক্ষতস্থানটি তিনি জল দিয়া ধুইয়া, রক্ত পড়া বন্ধ করিবার জন্য এক টুকরা কাপড় পুড়াইয়া তাহার ছাই উক্তস্থানে চাপাইয়া দিলেন। গ্রামবাসিগণ আশ্বস্ত হইয়া শান্ত হইল, এবং সেই রাত্রির মত আমাদের গল্পগুজব বন্ধ হইল।

২৩ জুলাই। পরদিন প্রাতঃকালে হরেক রকমের একদল কুলি আমাদিগকে মার্তণ্ডের ধ্বংসাবশেষ দেখাইতে লইয়া যাইবার জন্য আপেল গাছগুলির নীচে একত্র হইয়াছিল। মার্তণ্ড মন্দির এক অদ্ভুত প্রাচীন সৌধ। উহাতে স্পষ্টই মন্দিরের অপেক্ষা মঠের লক্ষণ অধিক। উহা এক অপূর্ব স্থানে অবস্থিত এবং যে-সকল বিভিন্ন যুগের মধ্য দিয়া উহা শ্রীবৃদ্ধি লাভ করিয়াছিল, ঐগুলির বিভিন্ন নির্মাণ পদ্ধতির স্পষ্ট একত্র সমাবেশ-বশতই উহা আকর্ষণীয় হইয়াছিল। … সূর্যাস্তের আলোয় অশ্বপৃষ্ঠে প্রত্যাবর্তন অতি রমণীয় হয়। পূর্ব এবং পরদিনের এই সমস্ত সময়ের মধ্যে যে-সকল কথোপকথন হইয়াছিল, সেগুলির কিছু কিছু অংশ এখনও মনে পড়িতেছেঃ

‘কোন জাতিই, তা যবনই (Greek) হউন বা অন্য কোন জাতিই হউন, কোন কালে জাপানীদের ন্যায় স্বদেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া যান নাই। তাঁহারা কথা লইয়া থাকেন না, তাঁহারা কাজে করেন—দেশের জন্য সর্বস্ব বিসর্জন দেন। আজকাল জাপানে এমন সব জমিদার আছেন—যাঁহারা সাম্রাজ্যের একত্ব-বিধানকল্পে বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁহাদের জমিদারী ছাড়িয়া দিয়া কৃষিজীবী হইয়াছেন।২০ আর জাপানযুদ্ধে একটিও বিশ্বাসঘাতক পাওয়া যায় নাই। একবার সেটা ভাবিয়া দেখ!’

আবার কতকগুলি লোক ভাবপ্রকাশে অক্ষম—এই প্রসঙ্গে স্বামীজী বলিলেন, ‘আমি বরাবর লক্ষ্য করিয়াছি যে, লাজুক ও চাপা লোকেরা উত্তেজিত হইলে সবচেয়ে বেশী আসুরিক-ভাবাপন্ন হইয়া থাকে।’

আর একবার সন্ন্যাস-জীবনের ও ব্রহ্মচর্যের বিধিনিষেধ-প্রসঙ্গ স্পষ্টই বলিয়াছিলেন, ‘যস্মাদ্ভিক্ষুর্হিরণ্যং রসেন গ্রাহ্যং চ স আত্মহা ভবেৎ’—যে সন্ন্যাসী সকামভাবে সুবর্ণ গ্রহণ করে, সে আত্মঘাতী ইত্যাদি।

২৪ জুলাই। অন্ধকার রাত্রি এবং অরণ্যানী, দ্রুমরাজিতলে পাইন কাষ্ঠের এক বৃহৎ অগ্নিকুণ্ড, দুই তিনটি তাঁবু অন্ধকারের মধ্যে সাদা হইয়া দণ্ডায়মান, দূরে অগ্নিকুণ্ডপার্শ্বে উপবিষ্ট ভৃত্যগণের আকৃতি ও কণ্ঠস্বর এবং তিনটি শিষ্যসহ আচার্যদেব—পরবর্তী চিত্রটি এইরূপই। সহসা আচার্যদেব আমাদের মধ্যে একজনের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘কই, তুমি তো আজকাল তোমার ইস্কুলের কোন কথা বল না, তুমি কি মাঝে মাঝে উহার কথা ভুলিয়া যাও?’ পরে বলিতে লাগিলেন, ‘দেখ, আমার ভাবিবার ঢের জিনিষ আছে। একদিন আমি মান্দ্রাজের দিকে মন দিই, আর সেখানকার কাজের কথা ভাবি। আর একদিন আমি সব মনটা আমেরিকা বা ইংলণ্ড বা সিংহল অথবা কলিকাতায় দিই। এক্ষণে আমি তোমার ইস্কুলের কথা ভাবিতেছি।’

পরীক্ষা করিয়া দেখিবার নিমিত্ত একটি অস্থায়ী কার্য-প্রণালী যে অনেক চিন্তার পর স্থির হইয়াছে, উহার প্রারম্ভ যে সামান্য হইবে, শেষ পর্যন্ত সর্বগ্রাহী প্রসারতার ভাব বাতিল করিবার ঝোঁক এবং সমগ্র শিক্ষাদান-চেষ্টাটিকে যে ধর্মজীবনের উপর এবং শ্রীরামকৃষ্ণ-পূজার উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়াছে—এই সমস্ত কথা তিনি মনোযোগের সহিত শুনিয়া বলিলেনঃ

তুমি সেই উৎসাহ বজায় রাখিবার জন্যই সাম্প্রদায়িক ভাব আশ্রয় করিবে, নয় কি? সমস্ত সম্প্রদায়ের পারে চলিয়া যাইবার জন্য তুমি একটি সম্প্রদায় সৃষ্টি করিবে। হাঁ, আমি বুঝিতে পারিয়াছি।

কতকগুলি বাধা স্পষ্টতঃ থাকিবেই থাকিবে। নানা কারণে প্রস্তাবিত আয়তনে হয়তো অনুষ্ঠানটি প্রায় অসম্ভব শুনায়। কিন্তু এই মুহূর্তে শুধু এইটুকু লক্ষ্য রাখিতে হইবে যেন অনুষ্ঠানটি ঠিক ঠিক ভাবে সঙ্কল্প করা হয়, এবং কার্য-প্রণালী নির্দোষ হইলে উপায় উপকরণাদি জুটিবেই জুটিবে।—সব শুনিয়া তিনি একটু চুপ করিয়া রহিলেন, পরে বলিলেনঃ

তুমি আমাকে ইহার সমালোচনা করিতে বলিতেছ, কিন্তু তাহা আমি করিতে পারিব না। কারণ, আমি তোমাকে ঐশী শক্তিতে অনুপ্রাণিত—আমি যতটা অনুপ্রাণিত ঠিক ততটা অনুপ্রাণিত বলিয়া মনে করি। অন্যান্য ধর্মে এবং আমাদের ধর্মে এইটুকুই প্রভেদ। অন্যান্য ধর্মাবলম্বিগণ বিশ্বাস করেন যে, ঐ-সকল ধর্মের সংস্থাপকগণ ঐশী শক্তিতে অনুপ্রাণিত, আমরাও ঐরূপ বিশ্বাস করিয়া থাকি। কিন্তু আমিও তো তাঁহারই মত অনুপ্রাণিত আর তুমিও আমারই মত, আবার তোমার পরে তোমার বালিকারা এবং তাহাদের শিষ্যগণও সেইরূপ হইবে। সুতরাং তুমি যাহা সর্বাপেক্ষা ভাল বলিয়া বিবেচনা করিতেছ, আমি তাহাই করিতে তোমাকে সাহায্য করিব।

তারপর ধীরামাতা এবং জয়ার দিকে ফিরিয়া বলিতে লাগিলেন, যে শিষ্যাটি নারীদের উন্নতি-বিধানের প্রতিনিধিরূপে দাঁড়াইবেন, তাঁহার উপর তিনি পাশ্চাত্যদেশে গমনকালে যে কি মহান্ দায়িত্ব অর্পণ করিয়া যাইবেন! উহা যে পুরুষগণের জন্য যে-কার্য অনুষ্ঠিত হইবে তদপেক্ষা গুরুতর দায়িত্বপূর্ণ হইবে তাহাও বলিলেন। আমাদের মধ্যে উক্ত সেবিকাটির (worker) দিকে ফিরিয়া আরও বলিলেন, ‘হাঁ, তোমার বিশ্বাস আছে, কিন্তু যে জ্বলন্ত উৎসাহ দরকার—তাহা তোমার নাই। তোমাকে ‘দগ্ধেন্ধনমিবানলম্‌’ হইতে হইবে। শিব! শিব!’—এই বলিয়া মহাদেবের আশীর্বাদ প্রার্থনা করিয়া তিনি আমাদিগের নিকট হইতে রাত্রির মত বিদায় লইলেন এবং আমরাও অনতিবিলম্বে শয়ন করিলাম।

২৫ জুলাই। পরদিন প্রাতঃকালে আমরা তাঁবুগুলির মধ্যে একটিতে সকাল সকাল প্রাতরাশ সম্পন্ন করিয়া অচ্ছাবল পর্যন্ত চলিলাম। আমাদের মধ্যে একজন স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন—কতকগুলি পুরাতন রত্ন হারাইয়া গিয়াছিল, পুনরায় পাওয়া গিয়াছে, সেগুলি সবই উজ্জ্বল ও নূতন হইয়া গিয়াছে। কিন্তু স্বামীজী ঈষৎ হাস্য করিয়া এই গল্প বলা বন্ধ করিয়া দিলেন এবং বলিলেন, ‘অমন ভাল স্বপ্নের কথা বলিতে নাই!’

অচ্ছাবলে আমরা জাহাঙ্গীরের আরও অনেক বাগান দেখিতে পাইলাম। আমরা বাগানগুলির চারিধারে বেড়াইলাম এবং একটি স্থির জলাশয়ে স্নান করিলাম। পরে আমরা প্রথম বাগানটিতে মধ্যাহ্নের পূর্বের জলযোগ সম্পন্ন করিলাম, এবং বৈকালে অশ্বপৃষ্ঠে ইসলামাবাদে নামিয়া আসিলাম।

উক্ত জলযোগ-কালে যখন সকলে বসিয়াছিলাম, তখন স্বামীজী তাঁহার কন্যাকে তাঁহার সঙ্গে অমরনাথ-গুহায় যাত্রা করিবার এবং তথায় মহাদেবের চরণে নিবেদিত হওয়ার জন্য আহ্বান করিলেন। ধীরামাতা সহাস্যে অনুমতি দিলেন, এবং পরবর্তী অর্ধঘণ্টা উল্লাস ও আনন্দ-জ্ঞাপনে অতীত হইল। ইতঃপূর্বেই বন্দোবস্ত হইয়াছিল যে, আমরা সকলেই পহলগাম পর্যন্ত যাইব এবং সেখান স্বামীজীর তীর্থযাত্রা হইতে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত অপেক্ষা করিব। সুতরাং আমরা সেইদিন সন্ধ্যার সময় নৌকায় পৌঁছিয়া জিনিষপত্র গুছাইয়া লইলাম এবং পত্রাদি লিখিলাম। পরদিন বৈকালে বওয়ান যাত্রা করিলাম।