০১. স্বামী-শিষ্য-সংবাদ ১-৫

স্থান — কলিকাতা, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের বাটী, বাগবাজার
কাল — ফেব্রুআরি (শেষ সপ্তাহ), ১৮৯৭

প্রথমবার বিলাত হইতে ভারতে ফিরিবার পর তিন চারিদিন হইল স্বামীজী কলিকাতায় পদার্পণ করিয়াছেন। আজ মধ্যাহ্নে বাগবাজারের রাজবল্লভপাড়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্ত শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে স্বামীজীর নিমন্ত্রণ। সংবাদ পাইয়া বহু ভক্ত আজ তাঁহার বাড়িতে সমাগত হইতেছেন। শিষ্যও লোকমুখে সংবাদ পাইয়া মুখুয্যে মহাশয়ের বাড়িতে বেলা প্রায় ২ টার সময় উপস্থিত হইল। স্বামীজীর সঙ্গে শিষ্যের এখনও আলাপ হয় নাই। শিষ্যের জীবনে স্বামীজীর দর্শনলাভ এই প্রথম।

শিষ্য উপস্থিত হইবামাত্র স্বামী তুরীয়ানন্দ তাহাকে স্বামীজীর নিকটে লইয়া যাইয়া পরিচয় করাইয়া দিলেন। স্বামীজী মঠে আসিয়া শিষ্যরচিত একটি ‘শ্রীরামকৃষ্ণস্তোত্র’ পাঠ করিয়া ইতঃপূর্বেই তাহার বিষয় শুনিয়াছিলেন; শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্তগরিষ্ঠ নাগ-মহাশয়ের১ কাছে তাহার যে যাতায়াত আছে — ইহাও স্বামীজী জানিয়াছিলেন।

শিষ্য স্বামীজীকে প্রণাম করিয়া উপবেশন করিলে স্বামীজী তাহাকে সংস্কৃতে সম্ভাষণ করিয়া নাগ-মহাশয়ের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলে এবং তাঁহার অমানুষিক ত্যাগ, উদ্দাম ভগবদনুরাগ ও দীনতার বিষয় উল্লেখ করিতে করিতে বলিলেন — ‘বয়ং তত্ত্বান্বেষাদ্ হতাঃ মধুকর ত্বং খলু কৃতী’২। কথাগুলি নাগ-মহাশয়কে লিখিয়া জানাইতে শিষ্যকে আদেশ করিলেন। পরে বহু লোকের ভিড়ে আলাপ করিবার সুবিধা হইতেছে না দেখিয়া, তাহাকে ও স্বামী তুরীয়ানন্দকে পশ্চিমের ছোট ঘরে লইয়া গিয়া শিষ্যকে ‘বিবেকচূড়ামণি’র এই কথাগুলি বলিতে লাগিলেনঃ

মা ভৈষ্ট বিদ্বন্ তব নাস্ত্যপায়াঃ
সংসারসিন্ধোস্তরণেহস্ত্যুপায়ঃ।
যেনৈব যাতা যতয়োহস্য পারং
তমেব মার্গং তব নির্দিশামি॥৩

এবং তাহাকে আচার্য শঙ্করের ‘বিবেকচূড়ামণি’ নামক গ্রন্থখানি পাঠ করিতে আদেশ করিলেন।

নানা প্রসঙ্গ চলিতেছে এমন সময় একজন আসিয়া সংবাদ দিল যে, ‘মিরর’৪- সম্পাদক শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ সেন স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছেন। স্বামীজী বলিলেন, ‘তাঁকে এখানে নিয়ে এসো।’ নরেন্দ্রবাবু ছোট ঘরে আসিয়া বসিলেন এবং আমেরিকা ও ইংলণ্ড সম্বন্ধে স্বামীজীকে নানা প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। উত্তরে স্বামীজী বললেনঃ

আমেরিকাবাসীর মতো এমন সহৃদয়, উদারচিত্ত, অতিথিসেবাপরায়ণ, নব নব ভাবগ্রহণে একান্ত সমুৎসুক জাতি জগতে আর দ্বিতীয় দেখা যায় না। আমেরিকায় যা কিছু কাজ হয়েছে, তা আমার শক্তিতে হয়নি; আমেরিকার লোক এত সহৃদয় বলেই তাঁরা বেদান্তভাব গ্রহণ করেছেন।

ইংলণ্ডের কথায় বলিলেনঃ ইংরেজের মতো conservative (প্রাচীন রীতিনীতির পক্ষপাতী) জাতি জগতে আর দ্বিতীয় নেই। তারা কোন নূতন ভাব সহজে গ্রহণ করতে চায় না, কিন্তু অধ্যবসায়ের সহিত যদি তাদের একবার কোন ভাব বুঝিয়ে দেওয়া যায়, তবে তারা কিছুতেই তা আর ছাড়ে না। এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞা অন্য কোন জাতিতে মেলে না। সেইজন্য তারা সভ্যতায় ও শক্তি-সঞ্চয়ে জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছে।

উপযুক্ত প্রচারক পাইলে আমেরিকা অপেক্ষা ইংলণ্ডেই বেদান্ত-প্রচারকার্য স্থায়ী হইবার অধিকতর সম্ভাবনা, ইহা জানাইয়া স্বামীজী বলিলেনঃ

আমি কেবল কাজের পত্তন মাত্র ক’রে এসেছি। পরবর্তী প্রচারকগণ ঐ পন্থা অনুসরণ করলে কালে অনেক কাজ হবে।

নরেন্দ্রবাবু — এইরূপ ধর্মপ্রচার দ্বারা ভবিষ্যতে আমাদের কি আশা আছে?

স্বামীজী — আমাদের দেশে আছে মাত্র এই বেদান্তধর্ম। পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনায় আমাদের এখন আর কিছু নেই বললেই হয়। কিন্তু এই সার্বভৌম বেদান্তবাদ — যা সকল মতের, সকল পথের লোককেই ধর্মলাভে সমান অধিকার প্রদান করে — এর প্রচারের দ্বারা পাশ্চাত্য সভ্য জগৎ জানতে পারবে, ভারতবর্ষে এক সময়ে কি আশ্চর্য ধর্ম-ভাবের স্ফুরণ হয়েছিল এবং এখনও রয়েছে। এই মতের চর্চায় পাশ্চাত্য জাতির আমাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি হবে — অনেকটা এখনই হয়েছে। এইরূপে যথার্থ শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি লাভ করতে পারলে আমরা তাদের নিকট ঐহিক জীবনের বিজ্ঞানাদি শিক্ষা করে জীবন-সংগ্রামে অধিকতর পটু হবো। পক্ষান্তরে তারা আমাদের নিকট এই বেদান্তমত শিক্ষা করে পারমার্থিক কল্যানলাভে সমর্থ হবে।

নরেন্দ্রবাবু — এই আদান-প্রদানে আমাদের রাজনৈতিক কোন উন্নতির আশা আছে কি?

স্বামীজী — ওরা (পাশ্চাত্যেরা) মহাপরাক্রান্ত বিরোচনের৫ সন্তান; ওদের শক্তিতে পঞ্চভূত ক্রীড়াপুত্তলিকার মতো কাজ করছে; আপনারা যদি মনে করেন, আমরা এদের সঙ্গে সংঘর্ষে ঐ স্থূল পাঞ্চভৌমিক শক্তি-প্রয়োগ করেই একদিন স্বাধীন হবো, তবে আপনারা নেহাত ভুল বুঝছেন। হিমালয়ের সামনে সামান্য উপলখণ্ড যেমন, ওদের ও আমাদের ঐ শক্তি- প্রয়োগকুশলতায় তেমন প্রভেদ। আমার মত কি জানেন? আমরা এইরূপ বেদান্তোক্ত ধর্মের গূঢ় রহস্য পাশ্চাত্য জগতে প্রচার করে, ঐ মহাশক্তিধরগণের শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি আকর্ষণ ক’রে ধর্মবিষয়ে চিরদিন ওদের গুরুস্থানীয় থাকব এবং ওরা ইহলৌকিক অন্যান্য বিষয়ে আমাদের গুরু থাকবে। ধর্ম জিনিসটা ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ভারতবাসী যেদিন পাশ্চাত্যের পদতলে ধর্ম শিখতে বসবে, সেইদিন এ অধঃপতিত জাতির জাতিত্ব একেবারে ঘুচে যাবে। দিনরাত চীৎকার করে ওদের — ‘এ দেও, ও দেও’ বললে কিছু হবে না। আদান-প্রদানরূপ কাজের দ্বারা যখন উভয়পক্ষের ভিতর শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির একটা টান দাঁড়াবে, তখন আর চেঁচামেচি করতে হবে না। ওরা আপনা হতেই সব করবে। আমার বিশ্বাস — এইরূপে, ধর্মের চর্চায় ও বেদান্তধর্মের বহুল প্রচারে এদেশ ও পাশ্চাত্য দেশ — উভয়েরই বিশেষ লাভ। রাজনীতিচর্চা এর তুলনায় আমার কাছে গৌণ (secondary) উপায় বলে বোধ হয়। আমি এই বিশ্বাস কাজে পরিণত করতে জীবনক্ষয় করব। আপনারা ভারতের কল্যাণ অন্যভাবে সাধিত হবে বুঝে থাকেন তো অন্যভাবে কাজ করে যান।

নরেন্দ্রবাবু স্বামীজীর কথায় সম্মতি প্রকাশ করিয়া কিছুক্ষণ বাদে উঠিয়া গেলেন। শিষ্য স্বামীজীর পূর্বোক্ত কথাগুলি শুনিয়া অবাক হইয়া তাঁহার দীপ্ত মূর্তির দিকে অনিমেষ নয়নে চাহিয়া রহিল।

নরেন্দ্রবাবু চলিয়া গেলে পর, গোরক্ষিণী সভার জনৈক উদ্যোগী প্রচারক স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করিতে উপস্থিত হইলেন। পুরা না হইলেও ইঁহার বেশভূষা অনেকটা সন্ন্যাসীর মতো — মাথায় গেরুয়া রঙের পাগড়ি বাঁধা, দেখিলেই বুঝা যায় ইনি হিন্দুস্থানী। গোরক্ষা-প্রচারকের আগমন-বার্তা পাইয়া স্বামীজী বাহিরের ঘরে আসিলেন। প্রচারক স্বামীজীকে অভিবাদন করিয়া গোমাতার একখানি ছবি তাঁহাকে উপহার দিলেন। স্বামীজী উহা হাতে লইয়া নিকটবর্তী অপর এক ব্যক্তির হাতে দিয়া তাঁহার সহিত নিম্নলিখিত আলাপ করিয়াছিলেনঃ

স্বামীজী — আপনাদের সভার উদ্দ্যেশ্য কি?

প্রচারক — আমরা দেশের গোমাতাগণকে কসাইয়ের হাত হইতে রক্ষা করিয়া থাকি। স্থানে স্থানে পিঁজরাপোল স্থাপন করা হইয়াছে। সেখানে রুগ্ন, অকর্মণ্য এবং কসাইয়ের হাত হইতে ক্রীত গোমাতাগণ প্রতিপালিত হণ।

স্বামীজী — এ অতি উত্তম কথা। আপনাদের আয়ের পন্থা কি?

প্রচারক — দয়াপরাবশ হইয়া আপনাদের ন্যায় মহাপুরুষ যাহা কিছু দেন, তাহা দ্বারাই সভার ঐ কার্য নির্বাহ হয়।

স্বামীজী — আপনাদের গচ্ছিত কত টাকা আছে?

প্রচারক — মারোয়াড়ী বণিকসম্প্রদায় এ কার্যের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক। তাঁহারা এই সৎকার্যে বহু অর্থ দিয়াছেন।

স্বামীজী — মধ্য-ভারতে এবার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়েছে। ভারত গর্ভনমেন্ট নয় লক্ষ লোকের অনশনে মৃত্যুর তালিকা প্রকাশ করেছেন। আপনাদের সভা এই দুর্ভিক্ষকালে কোন সাহায্যদানের আয়োজন করেছে কি?

প্রচারক — আমরা দুর্ভিক্ষাদিতে সাহায্য করি না। কেবলমাত্র গোমাতাগণের রক্ষাকল্পেই এই সভা স্থাপিত।

স্বামীজী — যে দুর্ভিক্ষে আপনাদের জাতভাই লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হল, সামর্থ্য সত্ত্বেও আপনারা এই ভীষণ দুর্দিনে তাদের অন্ন দিয়ে সাহায্য করা উচিত মনে করেননি?

প্রচারক — না। লোকের কর্মফলে-পাপে এই দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল; ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ হইয়াছে।

প্রচারকের কথা শুনিয়া স্বামীজীর বিশাল নয়নপ্রান্তে যেন অগ্নিকণা স্ফুরিত হইতে লাগিল, মুখ আরক্তিম হইল; কিন্তু মনের ভাব চাপিয়া বলিলেনঃ

যে সভা-সমিতি মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে না নিজের ভাই অনশনে মরছে দেখেও তার প্রাণরক্ষার জন্য এক মুষ্টি অন্ন না দিয়ে পশুপক্ষিরক্ষার জন্য রাশি রাশি অন্ন বিতরণ করে, তার সঙ্গে আমার কিছুমাত্র সহানুভূতি নেই; তার দ্বারা সমাজের বিশেষ কিছু উপকার হয় ব’লে আমার বিশ্বাস নেই। কর্মফলে মানুষ মরছে — এরূপে কর্মের দোহাই দিলে জগতে কোন বিষয়ের জন্য চেষ্টাচরিত্র করাটাই একেবারে বিফল বলে সাব্যস্ত হয়। আপনাদের পশুরক্ষার কাজটাও বাদ যায় না। ঐ কাজ সম্বন্ধেও বলা যেতে পারে — গোমাতারা নিজ নিজ কর্মফলেই কসাইদের হাতে যাচ্ছেন ও মরছেন, আমাদের ওতে কিছু করবার প্রয়োজন নেই।

প্রচারক — (একটু অপ্রতিভ হইয়া) হাঁ, আপনি যাহা বলিয়াছেন, তাহা সত্য; কিন্তু শাস্ত্র বলে — গরু আমাদের মাতা।

স্বামীজী — (হাসিতে হাসিতে) হাঁ গরু আমাদের যে মা, তা আমি বিলক্ষণ বুঝেছি — তা না হলে এমন সব কৃতী সন্তান আর কে প্রসব করিবেন?

হিন্দুস্থানী প্রচারক ঐ বিষয়ে আর কিছু না বলিয়া (বোধ হয় স্বামীজীর বিষম বিদ্রূপ তিনি বুঝিতেই পারিলেন না) স্বামীজীকে বলিলেন যে, সেই সমিতির উদ্দেশ্যে তিনি তাঁহার কাছে কিছু ভিক্ষাপ্রার্থী।

স্বামীজী — আমি তো সন্ন্যাসী ফকির লোক। আমি কোথায় অর্থ পাবো, যাতে আপনাদের সাহায্য করব? তবে আমার হাতে যদি কখনও অর্থ হয়, আগে মানুষের সেবায় ব্যয় করব; মানুষকে আগে বাঁচাতে হবে — অন্নদান, বিদ্যাদান, ধর্মদান করতে হবে। এ-সব ক’রে যদি অর্থ বাকী থাকে, তবে আপনাদের সমিতিতে কিছু দেওয়া যাবে।

কথা শুনিয়া প্রচারক মহাশয় স্বামীজীকে অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন। তখন স্বামীজী আমাদিগকে বলিতে লাগিলেনঃ

কি কথা বললে! বলে কিনা — কর্মফলে মানুষ মরছে, তাদের দয়া করে কি হবে? দেশটা যে অধঃপাতে গেছে, এই তার চূড়ান্ত প্রমাণ। তোদের হিন্দুধর্মের কর্মবাদ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে দেখলি? মানুষ হয়ে মানুষের জন্যে যাদের প্রাণ না কাঁদে, তাদের কি আবার মানুষ?

এই কথা বলিতে বলিতে স্বামীজীর সর্বাঙ্গ যেন ক্ষোভে দুঃখে শিহরিয়া উঠিল। পরে স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেনঃ

আবার আমার সঙ্গে দেখা করো।

শিষ্য — আপনি কোথায় থাকিবেন? হয়তো কোন বড় মানুষের বাড়িতে থাকিবেন। আমাকে তথায় যাইতে দিবে তো?

স্বামীজী — সম্প্রতি আমি কখন আলমবাজার মঠে, কখন কাশীপুরে গোপাললাল শীলের বাগানবাড়িতে থাকব। তুমি সেখানে যেও।

শিষ্য — মহাশয়, আপনার সঙ্গে নির্জনে কথা কহিতে বড় ইচ্ছা হয়।

স্বামীজী — তাই হবে — একদিন রাত্রিতে যেও। খুব বেদান্তের কথা হবে।

শিষ্য — মহাশয়, আপনার সঙ্গে কথকগুলি ইংরেজ ও আমেরিকান আসিয়াছে শুনিয়াছি, তাহারা আমার বেশভূষা ও কথাবার্তার রুষ্ট হইবে না তো?

স্বামীজী — তারাও সব মানুষ-বিশেষতঃ বেদান্তধর্মনিষ্ট। তোমার সঙ্গে আলাপ করে তারা খুশী হবে।

শিষ্য — মহাশয়, বেদান্ত অধিকারীর যে-সব লক্ষণ আছে, তাহা আপনার পাশ্চাত্য শিষ্যদের ভিতরে কিরূপে আসিল? শাস্ত্রে বলে — অতীতবেদ-বেদান্ত, কৃতপ্রায়শ্চিত্ত, নিত্যনৈমিত্তিক কর্মানুষ্ঠানকারী, আহার-বিহারে পরম সংযত, বিশেষতঃ চতুঃসাধনসম্পন্ন না হইলে বেদান্তের অধিকারী হয় না। আপনার পাশ্চাত্য শিষ্যেরা একে অব্রাহ্মণ, তাহাতে অশন-বসনে অনাচারী; তাহারা বেদান্তবাদ বুঝিল কি করিয়া?

স্বামীজী — তাদের সঙ্গে আলাপ করেই বুঝতে পারবে, তারা বেদান্ত বুঝেছে কি না।

অনন্তর স্বামীজী কয়েকজন ভক্তপরিবেষ্টিত হইয়া বাগবাজারের শ্রীযুক্ত বলরাম বসু মহাশয়ের বাটীতে গেলেন। শিষ্য বটতলায় একখানা ‘বিবেক-চূড়ামণি’ গ্রন্থ ক্রয় করিয়া দরজীপাড়ায় নিজ বাসার দিকে অগ্রসর হইল।

১ শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী-ভক্ত দুর্গাচরণ নাগ।
২ অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ — কালিদাস।
৩ ‘হে বিদ্বন! ভয় পাইও না, তোমার বিনাশ নাই; সংসার-সাগর পার হইবার উপায় আছে। যে পথ অবলম্বন করিয়া শুদ্ধসত্ত্ব যোগিগণ সংসার-সাগর পার হইয়াছেন, সেই পথ আমি তোমায় নির্দেশ করিয়া দিতেছি।’ — বিবেকচূড়ামণি, ৪৩
৪ ‘Indian Mirror’ পত্রিকা
৫ অসুর দেহাত্মবাদী, ভোগবাদী। দ্রষ্টব্য: ইন্দ্র-বিরোচন-সংবাদ, ছান্দোগ্য উপ., ৮।৭-৮

স্থান — কলিকাতা হইতে কাশীপুর যাইবার পথে ও
গোপাললাল শীলের বাগানে
কাল — ফেব্রুআরী বা মার্চ, ১৮৯৭

স্বামীজী আজ শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ১ মহাশয়ের বাটীতে মধ্যাহ্নে বিশ্রাম করিতেছিলেন। শিষ্য সেখানে আসিয়া প্রণাম করিয়া দেখিল, স্বামীজী তখন গোপাললাল শীলের বাগানবাড়ীতে যাইবার জন্য প্রস্তুত। গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে। শিষ্যকে বলিলেন, ‘চল্ আমার সঙ্গে।’ শিষ্য সম্মত হইলে স্বামীজী তাহাকে সঙ্গে লইয়া গাড়ীতে উঠিলেন; গাড়ী ছাড়িল। চিৎপুরের রাস্তায় আসিয়া গঙ্গাদর্শন হইবামাত্র স্বামীজী আপন মনে সুর করিয়া আবৃত্তি করিতে লাগিলেন, ‘গঙ্গা-তরঙ্গ-রমণীয়-জটা-কলাপং’২ ইত্যাদি। শিষ্য মুগ্ধ হইয়া সে অদ্ভুত স্বরলহরী নিঃশব্দে শুনিতে লাগিল। কিছুক্ষণ এইরূপে গত হইলে একখানা রেলের ইঞ্জিন চিৎপুর ‘হাইড্রলিক ব্রিজের’ দিকে যাইতেছে দেখিয়া স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেন, ‘দেখ দেখি কেমন সিঙ্গির মত যাচ্ছে।’ শিষ্য বলিলঃ

ইহা তো জড়। ইহার পশ্চাতে মানুষের চেতনশক্তি ক্রিয়া করিতেছে, তবে তো ইহা চলিতেছে। ঐরূপে চলায় ইহার নিজের বাহাদুরি আর কি আছে?

স্বামীজী — বল্ দেখি চেতনের লক্ষণ কি?

শিষ্য — কেন মহাশয়, যাহাতে বুদ্ধিপূর্বক ক্রিয়া দেখা যায়, তাহাই চেতন।

স্বামীজী — যা nature-এর against-এ rebel (প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ) করে, তাই চেতন; তাতেই চৈতন্যের বিকাশ রয়েছে। দেখ্ না, একটা সামান্য পিঁপড়েকে মারতে যা, সেও জীবনরক্ষার জন্য একবার rebel (লড়াই) করবে। যেখানে struggle (চেষ্টা বা পুরুষকার), যেখানে rebellion (বিদ্রোহ), সেখানেই জীবনের চিহ্ন — সেখানেই চৈতন্যের বিকাশ।

শিষ্য — মানুষের ও মনুষ্যজাতিসমূহের সম্বন্ধেও কি ঐ নিয়ম খাটে?

স্বামীজী — খাটে কিনা একবার জগতের ইতিহাসটা পড়ে দেখ্ না। দেখবি, তোরা ছাড়া আর সব জাতি সম্বন্ধেই ঐ কথা খাটে। তোরাই কেবল জগতে আজকাল জড়বৎ পড়ে আছিস। তোদের hypnotise (বিমোহিত) করে ফেলেছে। বহু প্রাচীনকাল থেকে অন্যে বলেছে — তোরা হীন, তোদের কোন শক্তি নেই। তোরাও তাই শুনে আজ হাজার বচ্ছর হতে চলল, ভাবছিস — আমরা হীন, সব বিষয়ে অকর্মণ্য! ভেবে ভেবে তাই হয়ে পড়েছিস। (নিজের শরীর দেখাইয়া) এ দেহও তো তোদের দেশের মাটি থেকেই জন্মেছে। আমি কিন্তু কখনও ওরূপ ভাবিনি। তাই দেখ্ না, তাঁর (ঈশ্বরের) ইচ্ছায়, যারা আমাদের চিরকাল হীন মনে করে, তারাই আমাকে দেবতার মত খাতির করেছে ও করছে। তোরাও যদি ঐরূপ ভাবতে পারিস — ‘আমাদের ভিতর অনন্ত শক্তি, অপার জ্ঞান, অদম্য উৎসাহ আছে’ এবং অনন্তের ঐ শক্তি জাগাতে পারিস তো তোরাও আমার মত হতে পারিস।

শিষ্য — ঐরূপ ভাবিবার শক্তি কোথায়, মহাশয়? বাল্যকাল হইতেই ঐ কথা শোনায় ও বুঝাইয়া দেয়, এমন শিক্ষক বা উপদেষ্টাই বা কোথায়? লেখাপড়া করা আজকাল কেবল চাকরিলাভের জন্য — এই কথাই আমরা সকলের নিকট হইতে শুনিয়াছি ও শিখিয়াছি।

স্বামীজী — তাই তো আমরা এসেছি অন্যরূপ শেখাতে ও দেখাতে। তোরা আমাদের কাছ থেকে ঐ তত্ত্ব শেখ্, বোঝ্, অনুভূতি কর্ — তারপর নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে, পল্লীতে পল্লীতে ঐ ভাব ছড়িয়ে দে। সকলকে গিয়ে বল্ — ‘ওঠ, জাগো, আর ঘুমিও না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচবার শক্তি তোমাদের নিজের ভিতর রয়েছে, এ কথা বিশ্বাস কর, তা হলেই ঐ শক্তি জেগে উঠবে।’ ঐ কথা সকলকে বল্ এবং সেই সঙ্গে সাদা কথায় বিজ্ঞান দর্শন ভূগোল ও ইতিহাসের মূল কথাগুলি mass-এর (সাধারণের) ভেতর ছড়িয়ে দে। আমি অবিবাহিত যুবকদের নিয়ে একটি centre (শিক্ষাকেন্দ্র) তৈয়ার করব — প্রথমে তাদের শেখাব, তারপর তাদের দিয়ে এই কাজ করাব, মতলব করেছি।

শিষ্য — কিন্তু মহাশয়, ঐরূপ করা তো অনেক অর্থসাপেক্ষ। টাকা কোথায় পাইবেন?

স্বামীজী — তুই কি বলছিস? মানুষেই তো টাকা করে। টাকায় মানুষ করে, এ কথা কবে কোথায় শুনেছিস? তুই যদি মন মুখ এক করতে পারিস, কথায় ও কাজে এক হতে পারিস তো জলের মত টাকা আপনা-আপনি তোর পায়ে এসে পড়বে।

শিষ্য — আচ্ছা মহাশয়, না হয় স্বীকারই করিলাম যে, টাকা আসিল এবং আপনি ঐরূপে সৎকার্যের অনুষ্ঠান করিলেন। তাহাতেই বা কি? ইতঃপূর্বেও কত মহাপুরুষ কত ভাল ভাল কাজ করিয়া গিয়াছেন। সে-সকল এখন কোথায়? আপনার প্রতিষ্ঠিত কার্যেরও সময়ে ঐরূপ দশা হইবে নিশ্চয়। তবে ঐরূপ উদ্যমের আবশ্যকতা কি?

স্বামীজী — পরে কি হবে সর্বদা এ কথাই যে ভাবে, তার দ্বারা কোন কাজই হতে পারে না। যা সত্য বলে বুঝেছিস, তা এখনি করে ফেল্; পরে কি হবে না হবে, সে কথা ভাববার দরকার কি? এতটুকু তো জীবন — তার ভিতর অত ফলাফল খতালে কি কোন কাজ হতে পারে? ফলাফলদাতা একমাত্র তিনি (ঈশ্বর), যা হয় করবেন। সে কথায় তোর কাজ কি? তুই ওদিকে না দেখে কেবল কাজ করে যা।

বলিতে বলিতে গাড়ী বাগানবাড়ীতে পঁহুছিল। কলিকাতা হইতে অনেক লোক স্বামীজীকে দর্শন করিতে সেদিন বাগানে আসিয়াছেন। স্বামীজী গাড়ী হইতে নামিয়া ঘরের ভিতর যাইয়া বসিলেন এবং তাঁহাদিগের সকলের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন; স্বামীজীর বিলাতী শিষ্য গুডউইন সাহেব সাক্ষাৎ ‘সেবা’র মত অনতিদূরে দাঁড়াইয়া ছিলেন; ইতঃপূর্বে তাঁহার সহিত পরিচয় হওয়ায় শিষ্য তাঁহারই নিকট উপস্থিত হইল এবং উভয়ে মিলিয়া স্বামীজী সম্বন্ধে নানাপ্রকার কথোপকথনে নিযুক্ত হইল।

সন্ধ্যার পর স্বামীজী শিষ্যকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘তুই কি কঠোপনিষদ্‌ কণ্ঠস্থ করেছিস?

শিষ্য — না মহাশয়, শাঙ্করভাষ্যসমেত উহা পড়িয়াছি মাত্র।

স্বামীজী — উপনিষদের মধ্যে এমন সুন্দর গ্রন্থ আর দেখা যায় না। ইচ্ছা হয় তোরা এখানা কণ্ঠে করে রাখিস। নচিকেতার মত শ্রদ্ধা সাহস বিচার ও বৈরাগ্য জীবনে আনবার চেষ্টা কর্। শুধু পড়লে কি হবে?

শিষ্য — কৃপা করুন, যাহাতে দাসের ঐ সকল অনুভূতি হয়।

স্বামীজী — ঠাকুরের কথা শুনেছিস তো? তিনি বলতেন, ‘কৃপা-বাতাস তো বইছেই, তুই পাল তুল দে না।’ কেউ কাকেও কিছু করে দিতে পারে কি রে বাপ? নিজের নিয়তি নিজের হাতে — গুরু এইটুকু কেবল বুঝিয়ে দেন মাত্র। বীজের শক্তিতেই গাছ হয়, জল ও বায়ু কেবল তার সহায়ক মাত্র।

শিষ্য — বাহিরের সহায়তারও কি আবশ্যক আছে, মহাশয়?

স্বামীজী — তা আছে। তবে কি জানিস — ভেতরে পদার্থ না থাকলে শত সহায়তায়ও কিছু হয় না। তবে সকলের আত্মানুভূতির একটা সময় আসে, কারণ সকলেই ব্রহ্ম। উচ্চনীচ-প্রভেদ করাটা কেবল ঐ ব্রহ্মবিকাশের তারতম্য। সময়ে সকলেরই পূর্ণ বিকাশ হয়। তাই শাস্ত্র বলেছেন, ‘কালেনাত্মনি বিন্দতি।’

শিষ্য — কবে আর ঐরূপ হইবে, মহাশয়? শাস্ত্রমুখে শুনি, কত জন্ম আমরা অজ্ঞানতায় কাটাইয়াছি!

স্বামীজী — ভয় কি? এবার যখন এখানে এসে পড়েছিস, তখন এবারেই হয়ে যাবে। মুক্তি, সমাধি — এ সব কেবল ব্রহ্মপ্রকাশের পথের প্রতিবন্ধগুলি দূর করে দেওয়া। নতুবা আত্মা সূর্যের মত সর্বদা জ্বলছেন। অজ্ঞানমেঘ তাঁকে ঢেকেছে মাত্র। সেই মেঘকেও সরিয়ে দেওয়া আর সূর্যেরও প্রকাশ হওয়া। তখনি ‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থি’৩ ইত্যাদি অবস্থা হওয়া; যত পথ দেখেছিস, সবই এ পথের প্রতিবন্ধ দূর করতে উপদেশ দিচ্ছে। যে যে-ভাবে আত্মানুভব করেছে, সে সেইভাবে উপদেশ দিয়ে গিয়েছে। উদ্দেশ্য সকলেরই কিন্তু আত্মজ্ঞান — আত্মদর্শন। এতে সর্ব জাতি — সর্ব জীবনের সমান অধিকার। এটাই সর্ববাদিসম্মত মত।

শিষ্য — মহাশয়, শাস্ত্রের ঐ কথা যখন পড়ি বা শুনি, তখন আজও আত্মবস্তুর প্রত্যক্ষ হইল না ভাবিয়া প্রাণ যেন ছটফট করে।

স্বামীজী — এরই নাম ব্যাকুলতা। ঐটে যত বেড়ে যাবে, ততই প্রতিবন্ধরূপ মেঘ কেটে যাবে, ততই শ্রদ্ধা দৃঢ়তর হবে। ক্রমে আত্মা ‘করতলামলকবৎ’ প্রত্যক্ষ হবেন। অনুভূতিই ধর্মের প্রাণ। কতকগুলি আচার-নিয়ম সকলেই মেনে চলতে পারে, কতকগুলি বিধি-নিষেধ সকলেই পালন করতে পারে; কিন্তু অনুভূতির জন্য ক-জন লোক ব্যাকুল হয়? ব্যাকুলতা — ঈশ্বরলাভ বা আত্মজ্ঞানের জন্য উন্মাদ হওয়াই যথার্থ ধর্মপ্রাণতা। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের জন্য গোপীদের যেমন উদ্দাম উন্মত্ততা ছিল, আত্মদর্শনের জন্যও সেইরূপ ব্যাকুলতা চাই। গোপীদের মনেও একটু একটু পুরুষ-মেয়ে ভেদ ছিল। ঠিক ঠিক আত্মজ্ঞানে ঐ ভেদ একেবারেই নেই।

(‘গীতগোবিন্দ’ সম্বন্ধে কথা তুলিয়া বলিতে লাগিলেনঃ)

জয়দেবই সংস্কৃত ভাষার শেষ কবি। তবে জয়দেব ভাবাপেক্ষা অনেক স্থলে jingling of words (শ্রুতিমধুর বাক্যবিন্যাসের) দিকে বেশী নজর রেখেছেন। দেখ্ দেখি গীতগোবিন্দের ‘পততি পতত্রে’৪ ইত্যাদি শ্লোকে অনুরাগ-ব্যাকুলতার কি culmination (পরাকাষ্ঠা) কবি দেখিয়েছেন! আত্মদর্শনের জন্য ঐরূপ অনুরাগ হওয়া চাই, প্রাণের ভেতরটা ছটফট করা চাই। আবার বৃন্দাবনলীলার কথা ছেড়ে কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ কেমন হৃদয়গ্রাহী — তাও দেখ্! অমন ভয়ানক যুদ্ধকোলাহলেও কৃষ্ণ কেমন স্থির, গম্ভীর, শান্ত! যুদ্ধক্ষেত্রেই অর্জুনকে ‘গীতা’ বলছেন, ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম — যুদ্ধ করতে লাগিয়ে দিচ্ছেন! এই ভয়ানক যুদ্ধের প্রবর্তক হয়েও নিজে শ্রীকৃষ্ণ কেমন কর্মহীন — অস্ত্র ধরলেন না! যে দিকে চাইবি, দেখবি শ্রীকৃষ্ণ-চরিত্র perfect (সর্বাঙ্গ-সম্পূর্ণ)। জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি, যোগ — তিনি যেন সকলেরই মূর্তিমান্ বিগ্রহ! শ্রীকৃষ্ণের এই ভাবটিরই আজকাল বিশেষভাবে আলোচনা চাই। এখন বৃন্দাবনের বাঁশী বাজান কৃষ্ণকেই কেবল দেখলেই চলবে না, তাতে জীবের উদ্ধার হবে না। এখন চাই গীতারূপ সিংহনাদকারী শ্রীকৃষ্ণের পূজা; ধনুর্ধারী রাম, মহাবীর, মা-কালী — এঁদের পূজা। তবে তো লোকে মহা উদ্যমে কর্মে লেগে শক্তিমান্ হয়ে উঠবে। আমি বেশ করে বুঝে দেখেছি, এদেশে এখন যারা ধর্ম ধর্ম করে, তাদের অনেকেই full of morbidity — cracked brains অথবা fanatic (মজ্জাগত দুর্বলতা-সম্পন্ন, বিকৃত মস্তিষ্ক অথবা বিচারশূন্য ধর্মোন্মাদ)। মহা রজোগুণের উদ্দীপনা ভিন্ন এখন তোদের না আছে ইহকাল, না আছে পরকাল। দেশ ঘোর তমো-তে ছেয়ে ফেলেছে। ফলও তাই হচ্ছে — ইহজীবনে দাসত্ব, পরলোকে নরক।

শিষ্য — পাশ্চাত্যদেশীয়দের রজোভাব দেখিয়ে আপনার কি আশা হয়, তাহারা ক্রমে সাত্ত্বিক হইবে?

স্বামীজী — নিশ্চয়। মহারজোগুণসম্পন্ন তারা এখন ভোগের শেষ সীমায় উঠেছে। তাদের যোগ হবে না তো কি পেটের দায়ে লালায়িত তোদের হবে? তাদের উৎকৃষ্ট ভোগ দেখে আমার ‘মেঘদূতে’র ‘বিদ্যুদ্বন্তং ললিতবসনাঃ’৫ ইত্যাদি চিত্র মনে পড়ত। আর তোদের ভোগের ভেতর হচ্ছে কিনা — স্যাঁতসেঁতে ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে বছরে বছরে শোরের মত বংশবৃদ্ধি—begetting a band of famished beggars and slaves (একপাল ক্ষুধাতুর ভিক্ষুক ও ক্রীতদাসের জন্ম দেওয়া)! তাই বলছি এখন মানুষকে রজোগুণে উদ্দীপিত করে কর্মপ্রাণ করতে হবে। কর্ম—কর্ম—কর্ম। এখন ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়’ — এ ছাড়া উদ্ধারের আর অন্য পথ নেই।

শিষ্য — মহাশয়, আমাদের পূর্বপুরুষগণ কি রজোগুণসম্পন্ন ছিলেন?

স্বামীজী — ছিলেন না? এই তো ইতিহাস বলছে, তাঁরা কত দেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছেন — তিব্বত, চীন, সুমাত্রা, সুদূর জাপানে পর্যন্ত ধর্মপ্রচারক পাঠিয়েছেন। রজোগুণের ভেতর দিয়ে না গেলে উন্নতি হবার যো আছে কি?

কথায় কথায় রাত্রি হইল। এমন সময় মিস মূলার (Miss Muller) আসিয়া পঁহুছিলেন। ইনি একজন ইংরেজ মহিলা, স্বামীজীর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাসম্পন্না। স্বামীজী ইঁহার সহিত শিষ্যের পরিচয় করাইয়া দিলেন। অল্পক্ষণ বাক্যালাপের পরেই মিস মূলার উপরে চলিয়া গেলেন।

স্বামীজী — দেখেছিস কেমন বীরের জাত এরা! কোথায় বাড়ী-ঘর, বড় মানুষের মেয়ে, তবু ধর্মলাভের আশায় কোথায় এসে পড়েছে!

শিষ্য — হাঁ মহাশয়, আপনার ক্রিয়াকলাপ কিন্তু আরও অদ্ভুত। কত সাহেব-মেম আপনার সেবার জন্য সর্বদা প্রস্তুত! একালে এটা বড়ই আশ্চর্যের কথা।

স্বামীজী — (নিজের দেহ দেখাইয়া) শরীর যদি থাকে, তবে আরও কত দেখবি; উৎসাহী ও অনুরাগী কতকগুলি যুবক পেলে আমি দেশটাকে তোলপাড় করে দেব। মা্দ্রাজে জন-কতক আছে। কিন্তু বাঙলায় আমার আশা বেশী। এমন পরিষ্কার মাথা অন্য কোথাও প্রায় জন্মে না। কিন্তু এদের muscles-এ (মাংসপেশীতে) শক্তি নেই। Brain ও muscles (মস্তিষ্ক ও মাংসপেশী) সমানভাবে developed (সুগঠিত, পরিপুষ্ট) হওয়া চাই। Iron nerves with a well intelligent brain and the whole world is at your feet (লোহার মত শক্ত স্নায়ু ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি থাকলে সমগ্র জগৎ পদানত হয়)।

সংবাদ আসিল, স্বামীজীর খাবার প্রস্তুত হইয়াছে। স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেন, ‘চল্, আমার খাওয়া দেখবি।’ আহার করিতে করিতে তিনি বলিতে লাগিলেন, ‘মেলাই তেল-চর্বি খাওয়া ভাল না। লুচি হতে রুটি ভাল। লুচি রোগীর আহার। মাছ, মাংস, fresh vegetables (তাজা তরিতরকারী) খাবি, মিষ্টি কম।’ বলিতে বলিতে প্রশ্ন করিলেন, ‘হাঁরে, ক-খানা রুটি খেয়েছি? আর কি খেতে হবে?’ কত খাইয়াছেন তাহা স্বামীজীর স্মরণ নাই। ক্ষুধা আছে কিনা তাহাও বুঝিতে পারিতেছেন না!

আরও কিছু খাইয়া স্বামীজী আহার শেষ করিলেন। শিষ্যও বিদায় গ্রহণ করিয়া কলিকাতায় ফিরিল। গাড়ী না পাওয়ায় পদব্রজে চলিল; চলিতে চলিতে ভাবিতে লাগিল, কাল আবার কখন স্বামীজীকে দর্শন করিতে আসিবে।

———

১ বিখ্যাত নট ও নাট্যকার শ্রীরামকৃষ্ণ – ভক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ
২ ব্যাসকৃত ‘বিশ্বনাথস্তবঃ’
৩ মুণ্ডক উপনিষদ্‌ ২।২।৮
৪ পততি পতত্রে বিচলতি পত্রে শঙ্কিতভবদুপযানম্।
   রচয়তি শয়নং সচকিতনয়নং পশ্যতি তব পন্থানম্॥
৫ বিদ্যুদ্বন্তং ললিতবসনাঃ সেন্দ্রচাপং সচিত্রাঃ
   সঙ্গীতায় প্রহতমুরজাঃ স্নিগ্ধগম্ভীরঘোষম্। — কালিদাস

স্থান — কাশীপুর, গোপাললাল শীলের বাগান
কাল — মার্চ, ১৮৯৭

প্রথমবার বিলাত হইতে ফিরিয়া স্বামীজী কয়েক দিন কাশীপুরে ৺গোপাললাল শীলের বাগানে অবস্থান করিতেছিলেন, শিষ্য তখন প্রতিদিন সেখানে যাতায়াত করিত। স্বামীজীর দর্শনমানসে তখন বহু উৎসাহী যুবকের সেখানে ভিড় হইত। কেহ ঔৎসুক্যের বশবর্তী হইয়া, কেহ তত্ত্বান্বেষী হইয়া, কেহ বা স্বামীজীর জ্ঞান-গরিমা পরীক্ষা করিবার জন্য তখন স্বামীজীকে দর্শন করিতে আসিত। প্রশ্নকর্তারা স্বামীজীর শাস্ত্রব্যাখ্যা শুনিয়া মুগ্ধ হইয়া যাইত; স্বামীজীর কণ্ঠে বীণাপাণি যেন সর্বদা অবস্থান করিতেন।

কলিকাতা বড়বাজারে বহু পণ্ডিতের বাস। ধনী মারোয়াড়ী বণিকগণের অন্নেই ইঁহারা প্রতিপালিত। স্বামীজীর সুনাম অবগত হইয়া কয়েকজন বিশিষ্ট পণ্ডিত স্বামীজীর সঙ্গে তর্ক করিবার জন্য একদিন এই বাগানে উপস্থিত হন। শিষ্য সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল।

আগন্তুক পণ্ডিতগণের সকলেই সংস্কৃতভাষায় অনর্গল কথাবার্তা বলিতে পারিতেন। তাঁহারা আসিয়াই মণ্ডলীপরিবেষ্টিত স্বামীজীকে সম্ভাষণ করিয়া সংস্কৃতভাষায় কথাবার্তা আরম্ভ করিলেন। স্বামীজীও সংস্কৃতেই তাঁহাদিগকে উত্তর দিতে লাগিলেন। পণ্ডিতেরা সকলেই প্রায় এক সঙ্গে চীৎকার করিয়া সংস্কৃতে স্বামীজীকে দার্শনিক কূট প্রশ্নসমূহ করিতেছিলেন এবং স্বামীজী প্রশান্ত গম্ভীরভাবে ধীরে ধীরে তাঁহাদিগকে ঐ-বিষয়ক নিজ মীমাংসাদ্যোতক সিদ্ধান্তগুলি বলিতেছিলেন। ইহাও বেশ মনে আছে যে, স্বামীজীর সংস্কৃতভাষা পণ্ডিতগণের ভাষা অপেক্ষা শ্রুতিমধুর ও সুললিত হইতেছিল। পণ্ডিতগণও ঐ কথা পরে স্বীকার করিয়াছিলেন।

সংস্কৃতভাষায় স্বামীজীকে ঐরূপে অনর্গল কথাবার্তা বলিতে দেখিয়া তাঁহার গুরুভ্রাতৃগণও সেদিন স্তম্ভিত হইয়াছিলেন। কারণ, গত ছয় বৎসর কাল ইওরোপ ও আমেরিকায় অবস্থানকালে স্বামীজী যে সংস্কৃত-আলোচনার তেমন সুবিধা পান নাই, তাহা সকলেরই জানা ছিল। শাস্ত্রদর্শী এই সকল পণ্ডিতের সঙ্গে ঐরূপ তর্কালাপে সেদিন সকলেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, স্বামীজীর মধ্যে অদ্ভুত শক্তির স্ফুরণ হইয়াছে। সেদিন ঐ সভায় রামকৃষ্ণানন্দ, শিবানন্দ, যোগানন্দ, তুরীয়ানন্দ ও নির্মলানন্দ মহারাজগণ উপস্থিত ছিলেন।

বাদে স্বামীজী সিদ্ধান্তপক্ষ এবং পণ্ডিতগণ পূর্বপক্ষ অবলম্বন করিয়াছিলেন। শিষ্যের মনে পড়ে, বিচারকালে স্বামীজী এক স্থলে ‘অস্তি’স্থলে ‘স্বস্তি’ প্রয়োগ করায় পণ্ডিতগণ হাসিয়া উঠেন; তাহাতে স্বামীজী তৎক্ষণাৎ বলেন, ‘পণ্ডিতানাং দাসোঽহং ক্ষন্তব্যমেতৎ স্খলনম্’। পণ্ডিতেরাও স্বামীজীর এইরূপ দীন ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া যান। অনেকক্ষণ বাদানুবাদের পর সিদ্ধান্তপক্ষের মীমাংসা পর্যাপ্ত বলিয়া পণ্ডিতগণ স্বীকার করিলেন এবং প্রীতিসম্ভাষণ করিয়া গমনোদ্যত হইলেন। দুই-চারি জন আগন্তুক ভদ্রলোক ঐ সময় তাঁহাদিগকে পশ্চাৎ গমন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মহাশয়গণ, স্বামীজীকে কিরূপ বোধ হইল?’ তদুত্তরে বয়োজ্যেষ্ঠ পণ্ডিত বলিলেন, ‘ব্যাকরণে গভীর ব্যুৎপত্তি না থাকিলেও স্বামীজী শাস্ত্রের গূঢ়ার্থদ্রষ্টা, মীমাংসা করিতে অদ্বিতীয় এবং স্বীয় প্রতিভাবলে বাদখণ্ডনে অদ্ভুত পাণ্ডিত্য দেখাইয়াছেন।

পণ্ডিতগণ চলিয়া গেলে স্বামীজী শিষ্যকে বলেন যে, পূর্বপক্ষকারী উক্ত পণ্ডিতগণ পূর্বমীমাংসা-শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। স্বামীজী উত্তরমীমাংসা-পক্ষ অবলম্বনে তাঁহাদিগকে নিকট জ্ঞানকাণ্ডের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদন করিয়াছিলেন এবং পণ্ডিতগণও তাঁহার সিদ্ধান্ত মানিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

ব্যাকরণগত একটি ভুল ধরিয়া পণ্ডিতগণ যে বিদ্রূপ করিয়াছিলেন, তাহাতে স্বামীজী বলেন যে, অনেক বৎসর যাবৎ সংস্কৃতে কথাবার্তা না বলায় তাঁহার ঐরূপ ভ্রম হইয়াছিল। পণ্ডিতগণের উপর সেজন্য তিনি কিছুমাত্র দোষারোপ করেন নাই। ঐ বিষয়ে স্বামীজী ইহাই কিন্তু বলিয়াছিলেনঃ

পাশ্চাত্যদেশে বাদের মূল বিষয় ছেড়ে ঐভাবে ভাষার সামান্য ভুল ধরা প্রতিপক্ষের পক্ষে মহা অসৌজন্য। সভ্যসমাজ ঐরূপ স্থলে ভাবটাই নেয় — ভাষার দিকে লক্ষ্য করে না। তোদের দেশে কিন্তু খোসা নিয়েই মারামারি চলছে — ভেতরকার শস্যের সন্ধান কেউ করে না।

পরে স্বামীজী শিষ্যের সঙ্গে সেদিন সংস্কৃতে আলাপ করিতে আরম্ভ করিলেন। শিষ্যও ভাঙা ভাঙা সংস্কৃতে জবাব দিতে লাগিল, তিনি তাহাকে উৎসাহিত করবার জন্য প্রশংসা করিতে লাগিলেন। ঐদিন হইতে শিষ্য স্বামীজীর অনুরোধে তাঁহার সঙ্গে প্রায়ই মধ্যে মধ্যে দেবভাষায় কথাবার্তা কহিত।

‘সভ্যতা’ কাহাকে বলে, ইহার উত্তরে সেদিন স্বামীজী বলেনঃ

যে সমাজ বা যে জাতি আধ্যাত্মিক ভাবে যত অগ্রসর, সে সমাজ ও সে জাতি তত সভ্য। নানা কল-কারখানা করে ঐহিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করতে পারলেই যে জাতিবিশেষ সভ্য হয়েছে, তা বলা চলে না। বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা লোকের হাহাকার ও অভাবই দিন দিন বৃদ্ধি করে দিচ্ছে, পরন্ত ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতা সর্বসাধারণকে আধ্যাত্মিক উন্নতির পন্থা প্রদর্শন করে লোকের ঐহিক অভাব এককালে দূর করতে না পারলেও নিঃসন্দেহে অনেকটা কমাতে সমর্থ হয়েছিল। ইদানীন্তন কালে ঐ উভয় সভ্যতার একত্র সংযোগ করতেই ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণদেব জন্মগ্রহণ করেছেন। একালে একদিকে যেমন লোককে কর্মতৎপর হতে হবে, অপরদিকে তাদের তেমনি গভীর অধ্যাত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। এরূপে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্যান্য-সংমিশ্রণে জগতে এক নবযুগের অভ্যুদয় হবে।

এ-কথা স্বামীজী সেদিন বিশেষভাবে বুঝাইয়া দেন; ঐ কথা বুঝাইতে বুঝাইতে একস্থলে বলিয়াছিলেনঃ

আর এক কথা — ওদেশের লোকেরা ভাবে, যে যত ধর্মপরায়ণ হবে, সে বাইরের চালচলনে তত গম্ভীর হবে, মুখে অন্য কথাটি থাকবে না। একদিকে আমার মুখে উদার ধর্মকথা শুনে ওদেশের ধর্মযাজকেরা যেমন অবাক হয়ে যেত, বক্তৃতার শেষে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে দেখে আবার তেমনি অবাক হয়ে যেত। মুখের উপর কখনও কখনও বলেও ফেলত, ‘স্বামীজী’, আপনি একজন ধর্মযাজক; সাধারণ লোকের মত এরূপ হাসি-তামাসা করা আপনার উচিত নয়। আপনার ও-রকম চপলতা শোভা পায় না।’ তার উত্তরে আমি বলতাম, We are children of bliss — why should we look morose and sombre (আমরা আনন্দের সন্তান, বিরস মুখে থাকব কেন?) ঐ কথা শুনে তারা মর্ম গ্রহণ করিতে পারত কিনা সন্দেহ।

সেদিন স্বামীজী ভাবসমাধি ও নির্বিকল্পসমাধি সম্বন্ধেও বলিয়াছিলেনঃ

মনে কর, একজন হনুমানের মত ভক্তিভাবে ঈশ্বরের সাধনা করছে। ভাবের যত গাঢ়তা হতে থাকবে, ঐ সাধকের চলন-বলন ভাবভঙ্গী এমন কি শারীরিক গঠনাদিও ঐরূপ হয়ে আসবে। ‘জাত্যন্তরপরিণাম’১ — ঐরূপেই হয়। ঐরূপ একটা ভাব নিয়ে সাধক ক্রমে ‘তদাকারাকারিত’ হয়ে যায়। কোন প্রকার ভাবের চরমাবস্থার নামই ভাবসমাধি। আর আমি দেহ নই, মন নই, বুদ্ধি নই — এইরূপে ‘নেতি, নেতি’ করতে করতে জ্ঞানী সাধক চিন্মাত্রসত্তায় অবস্থিত হলে নির্বিকল্প-সমাধিলাভ হয়। এক একটা ভাব নিয়েই সিদ্ধ হতে বা ঐ ভাবের চরমাবস্থায় পৌঁছতে কত জন্মের চেষ্টা লাগে! ভাবরাজ্যের রাজা আমাদের ঠাকুর কিন্তু আঠারটি ভাবে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ভাবমুখে না থাকলে তাঁর শরীর থাকত না — এ-কথাও ঠাকুর বলতেন।

কথায় কথায় শিষ্য ঐদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘মহাশয়, ঐদেশে কিরূপ আহরাদি করিতেন?’ উত্তরে স্বামীজী বলিলেন, ‘ওদেশের মতই খেতাম। আমরা সন্ন্যাসী, আমাদের কিছুতেই জাত যায় না।’

এদেশে কি প্রণালীতে কার্য করিবেন, সে সম্বন্ধে স্বামীজী ঐদিন বলেনঃ

মা্দ্রাজ ও কলিকাতায় দুইটি কেন্দ্র করে সর্ববিধ লোক-কল্যাণের জন্য নূতন ধরনের সাধুসন্ন্যাসী তৈরী করতে হবে। Destruction (ধ্বংস) দ্বারা বা প্রাচীন রীতিগুলি অযথা ভেঙে সমাজ বা দেশের উন্নতি করা যায় না। সর্বকালে সর্বদিকে উন্নতিলাভ constructive process-এর (গঠনমূলক প্রণালী) দ্বারা অর্থাৎ প্রাচীন রীতিগুলিকে নূতনভাবে পরিবর্তিত করেই গড়া হয়েছে। ভারতবর্ষের ধর্মপ্রচারক মাত্রই পূর্ব পূর্ব যুগে ঐভাবে কাজ করে গেছেন। একমাত্র বুদ্ধদেবের ধর্ম destructive (ধ্বংসমূলক) ছিল। সেজন্য ঐ ধর্ম ভারত থেকে নির্মূল হয়ে গিয়েছে।

স্বামীজী ঐভাবে কথা কহিতে কহিতে বলিতে লাগিলেনঃ

একটি জীবের মধ্যে ব্রহ্মবিকাশ হলে হাজার হাজার লোক সেই আলোকে পথ পেয়ে অগ্রসর হয়। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষেরাই একমাত্র লোকগুরু — এ কথা সর্বশাস্ত্র ও যুক্তি দ্বারা সমর্থিত হয়। অবৈদিক অশাস্ত্রীয় কুলগুরুপ্রথা স্বার্থপর ব্রাহ্মণেরাই এদেশে প্রচলন করেছে। সেজন্য সাধন করেও লোক এখন সিদ্ধ বা ব্রহ্মজ্ঞ হতে পারছে না। ধর্মের এ-সকল গ্লানি দূর করতেই ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণ-শরীর ধারণ করে বর্তমান যুগে জগতে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁর প্রদর্শিত সার্বভৌম মত জগতে প্রচারিত হলে জগতের এবং জীবের মঙ্গল হবে। এমন অদ্ভুত মহাসমন্বয়াচার্য বহুশতাব্দী যাবৎ ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেননি।

স্বামীজীর একজন গুরুভ্রাতা এই সময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি ওদেশে সর্বদা সর্বসমক্ষে ঠাকুরকে অবতার বলিয়া প্রচার করিলে না কেন?’

স্বামীজী — ওরা দর্শন-বিজ্ঞানের বড় বড়াই করে। তাই যুক্তিতর্ক-দর্শন-বিজ্ঞান দিয়ে ওদের জ্ঞানগরিমা চূর্ণ করে দিতে না পারলে কোন কিছু করা যায় না। তর্কে খেই হারিয়ে যারা যথার্থ তত্ত্বান্বেষী হয়ে আমার কাছে আসত, তাদের কাছে ঠাকুরের কথা কইতুম। নতুবা একেবারে অবতারবাদের কথা বললে ওরা বলত, ‘ও আর তুমি নূতন কি বলছ? আমাদের প্রভু ঈশাই তো রয়েছেন।’

তিনি-চারি ঘণ্টা কাল ঐরূপে মহানন্দে অতিবাহিত করিয়া শিষ্য সেদিন অন্যান্য আগন্তুকদের সহিত কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়াছিল।

১ দ্রষ্টব্যঃ যোগসূত্র — ৪।২

স্থান — দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ী ও আলমবাজার মঠ
কাল — মার্চ (১ম সপ্তাহ), ১৮৯৭

স্বামীজী যখন দেশে ফিরিয়া আসেন, মঠ তখন আলমবাজারে ছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মোৎসব। দক্ষিণেশ্বরে রাণী রাসমণির কালীবাড়ীতে এবার উৎসবের বিপুল আয়োজন হইয়াছে। স্বামীজী তাঁহার কয়েকজন গুরুভ্রাতাসহ বেলা ৯টা-১০টা আন্দাজ সেখানে উপস্থিত হইয়াছেন। তাঁহার নগ্ন পদ, শীর্ষে গৈরিকবর্ণের উষ্ণীষ। জনসঙ্ঘ তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া ইতস্ততঃ ধাবিত হইতেছে — তাঁহার সেই অনিন্দ্যসুন্দর রূপ দর্শন করিবে, পাদপদ্ম স্পর্শ করিবে এবং শ্রীমুখের সেই জ্বলন্ত অগ্নিশিখাসম বাণী শুনিয়া ধন্য হইবে বলিয়া। স্বামীজী শ্রীশ্রীজগন্মাতাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলে সঙ্গে সঙ্গে সহস্র সহস্র শির অবনত হইল। পরে ৺রাধাকান্তকে প্রণাম করিয়া তিনি এইবার ঠাকুরের গৃহে আগমন করিলেন। সে প্রকোষ্ঠে এখন আর তিলমাত্র স্থান নাই। ‘জয় রামকৃষ্ণ’ ধ্বনিতে কালীবাড়ীর চতুর্দিক মুখরিত হইতেছে। শত সহস্র দর্শক লইয়া কলিকাতা হইতে হোরমিলার কোম্পানীর জাহাজ বার বার যাতায়াত করিতেছে। নহবতের তানতরঙ্গে সুরধুনী নৃত্য করিতেছেন। উৎসাহ, আকাঙ্ক্ষা, ধর্মপিপাসা ও অনুরাগ মূর্তিমান্ হইয়া শ্রীরামকৃষ্ণপার্ষদগণরূপে ইতস্ততঃ বিরাজ করিতেছে।

স্বামীজীর সহিত আগত দুইটি ইংরেজ মহিলাও উৎসবে আসিয়াছেন। স্বামীজী তাঁহাদের সঙ্গে করিয়া পবিত্র পঞ্চবটী ও বিল্বমূল দর্শন করাইতেছেন। শিষ্য উৎসব সম্বন্ধীয় স্বরচিত একটি সংস্কৃত স্তব স্বামীজীর হস্তে প্রদান করিল। স্বামীজীও উহা পড়িতে পড়িতে পঞ্চবটীর দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। যাইতে যাইতে শিষ্যের দিকে একবার তাকাইয়া বলিলেন, ‘বেশ হয়েছে, আরও লিখবে।’

পঞ্চবটির একপার্শ্বে ঠাকুরের গৃহী ভক্তগণের সমাবেশ হইয়াছিল। গিরিশবাবু১ পঞ্চবটীর উত্তরে গঙ্গার দিকে মুখ করিয়া বসিয়াছেলেন এবং তাঁহাকে ঘিরিয়া অন্যান্য বহু লোকের সঙ্গে স্বামীজী গিরিশবাবুর নিকট উপস্থিত হইয়া এই যে ঘোষজ! বলিয়া গিরিশবাবুকে প্রণাম করিলেন। গিরিশবাবুও তাঁহাকে করজোড়ে প্রতিনমস্কার করিলেন। গিরিশবাবুকে পূর্ব কথা স্মরণ করাইয়া স্বামীজী বলিলেন, ঘোষজ, সেই একদিন আর এই একদিন। গিরিশবাবুও স্বামীজীর কথায় সম্মতি জানাইয়া বলিলেন, তা বটে, তবু এখনও সাধ যায় আরও দেখি। এইরূপে উভয়ের মধ্যে যে-সকল কথা হইল, তাহার মর্ম বাহিরের লোকের অনেকেই গ্রহণ করিতে সমর্থ হইলেন না। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর স্বামীজী পঞ্চবটীর উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত বিল্ববৃক্ষের অভিমুখে অগ্রসর হইলেন।

সেদিন দক্ষিণেশ্বর ঠাকুরবাড়ীর সর্বত্রই একটা দিব্যভাবের বন্যা ঐরূপে বহিয়া যাইতেছিল। এইবার সেই বিরাট জনসঙ্ঘ স্বামীজীর বক্তৃতা শুনিতে উদগ্রীব হইয়া দণ্ডায়মান হইল। কিন্তু বহু চেষ্টা করিয়াও স্বামীজী লোকের কলরবের অপেক্ষা উচ্চৈঃস্বরে বক্তৃতা করিতে পারিলেন না। অগত্যা বক্তৃতার চেষ্টা পরিত্যাগ করিয়া তিনি আবার ইংরেজ মহিলা দুইটিকে সঙ্গে লইয়া ঠাকুরের সাধনস্থান দেখাইতে এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশিষ্ট ভক্ত ও অন্তরঙ্গগণের সঙ্গে আলাপ করাইয়া দিতে লাগিলেন।

বেলা তিনটের পর স্বামীজী শিষ্যকে বলিলেন, ‘একখানা গাড়ী দেখ্ — মঠে যেতে হবে।’ অনন্তর আলমবাজার পর্যন্ত যাইবার ভাড়া দুই আনা ঠিক করিয়া শিষ্য গাড়ী লইয়া উপস্থিত হইলে স্বামীজী স্বয়ং গাড়ীর একদিকে বসিয়া এবং স্বামী নিরঞ্জনানন্দ ও শিষ্যকে অন্যদিকে বসাইয়া আলমবাজার মঠের দিকে আনন্দে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। যাইতে যাইতে শিষ্যকে বলিতে লাগিলেনঃ

কেবল abstract idea (শুদ্ধ ভাব মাত্র) নিয়ে পড়ে থাকলে কি হবে? এ-সব উৎসব প্রভৃতিরও দরকার; তবে তো mass (জনসাধারণ)-এর ভেতর এ-সকল ভাব ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়বে। এই যে হিন্দুদের বার মাসে তের পার্বণ — এর মানেই হচ্ছে ধর্মের বড় বড় ভাবগুলি ক্রমশঃ লোকের ভেতর প্রবেশ করিয়া দেওয়া। ওর একটা দোষও আছে। সাধারণ লোকে ঐ সকলের প্রকৃত ভাব না বুঝে ঐ সকলে মত্ত হয়ে যায়, আর ঐ উৎসব-আমোদ থেমে গেলেই আবার যা, তাই হয়। সেজন্য ওগুলি ধর্মের বহিরাবরণ — প্রকৃত ধর্ম ও আত্মজ্ঞানকে ঢেকে রেখে দেয়, এ কথা সত্য।

কিন্তু যারা ধর্ম কি, আত্মা কি — এ-সব কিছুমাত্র বুঝতে পারে না, তারা ঐ উৎসব-আমোদের মধ্য দিয়ে ক্রমে ধর্ম বুঝতে চেষ্টা করে। মনে কর্, এই যে আজ ঠাকুরের জন্মোৎসব হয়ে গেল, এর মধ্যে যারা সব এসেছে, তারা ঠাকুরের বিষয় একবারও ভাববে। যাঁর নামে এত লোক একত্র হয়েছিল, তিনি কে, তাঁর নামেই বা এত লোক এল কেন — এ কথা তাদের মনে উদিত হবে। যাদের তাও না হবে, তারাও এই কীর্তন দেখতে ও প্রসাদ পেতেও অন্ততঃ বছরে একবার আসবে আর ঠাকুরের ভক্তদের দেখে যাবে। তাতে তাদের উপকার বৈ অপকার হবে না।

শিষ্য — কিন্তু মহাশয়, ঐ উৎসব-কীর্তনই যদি সার বলিয়া কেহ বুঝিয়া লয়, তবে সে আর অধিক অগ্রসর হইতে পারে কি? আমাদের দেশে ষষ্ঠীপূজা, মঙ্গলচণ্ডীর পূজা প্রভৃতি যেমন নিত্যনৈমিত্তিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে, ইহাও সেইরূপ একটা হইয়া দাঁড়াইবে। মরণ পর্যন্ত লোকে ঐসব করিয়া যাইতেছে, কিন্তু কই এমন লোক তো দেখিলাম না, যে ঐসকল পূজা করিতে করিতে ব্রহ্মজ্ঞ হইয়া উঠিল!

স্বামীজী — কেন? এই যে ভারতে এত ধর্মবীর জন্মেছিলেন, তাঁরা তো সকলে ঐগুলিকে ধরে উঠেছেন এবং অত বড় হয়েছেন। ঐগুলিকে ধরে সাধন করতে করতে যখন আত্মার দর্শনলাভ হয়, তখন আর ঐ-সকলে আঁট থাকে না। তবু লোকসংগ্রহের জন্য অবতারকল্প মহাপুরুষেরাও ঐগুলি মেনে চলেন।

শিষ্য — লোক-দেখান মানিতে পারেন — কিন্তু আত্মজ্ঞের কাছে যখন এ সংসারই ইন্দ্রজালবৎ অলীক বোধ হয়, তখন তাঁহাদের কি আবার ঐ-সকল বাহ্য লোক ব্যবহারকে সত্য বলিয়া মনে হইতে পারে?

স্বামীজী — কেন পারবে না? সত্য বলতে আমরা যা বুঝি তাও তো relative (আপেক্ষিক) — দেশকালপাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন। অতএব সকল ব্যবহারেরই প্রয়োজন আছে অধিকারিভেদে। ঠাকুর যেমন বলতেন, মা কোন ছেলেকে পোলাও-কালিয়া রেঁধে দেন, কোন ছেলেকে বা সাগুপথ্য দেন, সেইরূপ।

দেখিতে দেখিতে গাড়ী আলমবাজার মঠে উপস্থিত হইল। শিষ্য গাড়ীভাড়া দিয়া স্বামীজীর সঙ্গে মঠের ভিতর চলিল এবং স্বামীজীর পিপাসা পাওয়ায় জল আনিয়া দিল। স্বামীজী জল পান করিয়া জামা খুলিয়া ফেলিলেন এবং মেজেতে পাতা শতরঞ্চির উপর অর্ধশায়িত হইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। স্বামী নিরঞ্জনানন্দ পার্শ্বে বসিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘এমন ভিড় উৎসবে আর কখনও হয়নি। যেন কলিকাতাটা ভেঙে এসেছিল!’

স্বামীজী — তা হবে না? এর পর আরও কত কি হবে!

শিষ্য — মহাশয়, প্রত্যেক ধর্মসম্প্রদায়েই দেখা যায় — কোন-না-কোন বাহ্য উৎসব-আমোদ আছেই। কিন্তু কাহার সঙ্গে কাহারও মিল নাই। এমন যে উদার মহম্মদের ধর্ম, তাহার মধ্যেও ঢাকা শহরে দেখিয়াছি শিয়া-সুন্নিতে লাঠালাঠি হয়!

স্বামীজী — সম্প্রদায় হলেই ওটা অল্পাধিক হবে। তবে এখানকার ভাব কি জানিস? — সম্প্রদায়বিহীনতা। আমাদের ঠাকুর ঐটেই দেখাতে জন্মেছিলেন। তিনি সব মানতেন — আবার বলতেন, ব্রহ্মজ্ঞানের দিক্ দিয়ে দেখলে ও-সকলই মিথ্যা মায়ামাত্র।

শিষ্য — মহাশয়, আপনার কথা বুঝিতে পারিতেছি না; মধ্যে মধ্যে আমার মনে হয়, আপনারও এইরূপে উৎসব-প্রচারাদি করিয়া ঠাকুরের নামে আর একটা সম্প্রদায়ের সূত্রপাত করিতেছেন। আমি নাগ-মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি, ঠাকুর কোন দলভুক্ত ছিলেন না। শাক্ত, বৈষ্ণব, ব্রহ্মজ্ঞানী, মুসলমান, খ্রীষ্টান সকলের ধর্মকেই তিনি বহুমান দিতেন।

স্বামীজী — তুই কি করে জানলি, আমরা সকলে ধর্মমতকে ঐরূপে বহুমান দিই না? এই বলিয়া স্বামীজী নিরঞ্জন মহারাজকে হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ‘ওরে, এ বাঙাল বলে কি?’

শিষ্য — মহাশয়, কৃপা করিয়া ঐ কথা আমায় বুঝাইয়া দিন।

স্বামীজী — তুই তো আমার বক্তৃতা পড়েছিস। কই, কোথায় ঠাকুরের নাম করেছি? খাঁটি উপনিষদের ধর্ম তো জগতে বলে বেড়িয়েছি।

শিষ্য — তা বটে। কিন্তু আপনার সঙ্গে পরিচিত হইয়া দেখিতেছি, আপনার রামকৃষ্ণগত প্রাণ। যদি ঠাকুরকে ভগবান্ বলিয়াই জানিয়া থাকেন, তবে কেন সর্বসাধারণকে তাহা একেবারে বলিয়া দিন না।

স্বামীজী — আমি যা বুঝেছি তা বলছি। তুই যদি বেদান্তের অদ্বৈতমতটিকে ঠিক ধর্ম বলে থাকিস, তাহলে লোককে তা বুঝিয়ে দে না কেন?

শিষ্য — আগে অনুভব করিব, তবে তো বুঝাইব। ঐ মত আমি পড়িয়াছি মাত্র।

স্বামীজী — তবে আগে অনুভূতি কর্। তারপর লোককে বুঝিয়ে দিবি। এখন লোকে প্রত্যেকে যে এক একটা মতে বিশ্বাস করে চলেছে, তাতে তোর তো বলবার কিছু অধিকার নেই। কারণ তুইও এখন তাদের মত একটা ধর্মমতে বিশ্বাস করে চলেছিস বৈ তো নয়।

শিষ্য — হাঁ, আমিও একটা বিশ্বাস করিয়া চলিয়াছি বটে; কিন্তু আমার প্রমাণ — শাস্ত্র। আমি শাস্ত্রের বিরোধী মত মানি না।

স্বামীজী — শাস্ত্র মানে কি? উপনিষদ্ প্রমাণ হলে বাইবেল জেন্দাবেস্তাই বা প্রমাণ হবে না কেন?

শিষ্য — এই সকল গ্রন্থের প্রামাণ্য স্বীকার করিলেও বেদের মত উহারা তো আর প্রাচীন গ্রন্থ নয়। আবার আত্মতত্ত্ব-সমাধান বেদে যেমন আছে, এমন তো আর কোথাও নাই।

স্বামীজী — বেশ, তোর কথা না হয় মেনেই নিলুম। কিন্তু বেদ ভিন্ন আর কোথাও যে সত্য নেই, এ কথা বলবার তোর কি অধিকার?

শিষ্য — বেদ ভিন্ন অন্য সকল ধর্মগ্রন্থে সত্য থাকিতে পারে, তদ্বিষয়ের বিরুদ্ধে আমি কিছু বলিতেছি না; কিন্তু আমি উপনিষদের মতই মানিয়া যাইব। আমার ইহাতে খুব বিশ্বাস।

স্বামীজী — তা কর্, তবে আর কারও যদি ঐরূপ কোন মতে খুব বিশ্বাস হয়, তবে তাকেও ঐ বিশ্বাসে চলে যেতে দিস। দেখবি — পরে তুই ও সে একই জায়গায় পৌঁছবি। মহিম্নস্তবে পড়িসনি? — ‘ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।’২

১ মহাকবি গিরিশচন্দ্র ঘোষ
২ ত্রয়ী সাংখ্যং পশুপতিমতং বৈষ্ণমিতি
প্রভিন্নে প্রস্থানে পরমিদদঃ পখ্যমিতি চ।
রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিল নানাপথজুষাং
নৃণামেকো গম্যত্বমসি পয়াসামর্ণব ইব॥
— শিবমহিম্নঃ স্তোত্রম্


স্থান—কলিকাতা, বাগবাজার
কাল—মার্চ, ১৮৯৭

স্বামীজী কয়েকদিন যাবৎ কলিকাতাতেই অবস্থান করিতেছেন। বাগবাজারের বলরাম বসু মহাশয়ের বাড়ীতেই রহিয়াছেন। মধ্যে মধ্যে পরিচিত ব্যক্তিদিগের বাটীতেও ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। আজ প্রাতে শিষ্য স্বামীজীর কাছে আসিয়া দেখিল, স্বামীজী ঐরূপে বাহিরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন। শিষ্যকে বলিলেন, ‘চল্, আমার সঙ্গে যাবি’। বলিতে বলিতে স্বামীজী নীচে নামিতে লাগিলেন; শিষ্যও পিছু পিছু চলিল। একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ীতে তিনি শিষ্যের সঙ্গে উঠিলেন; গাড়ী দক্ষিণমুখে চলিল।

শিষ্য॥ মহাশয়, কোথায় যাওয়া হইবে?

স্বামীজী॥ চল্ না, দেখবি এখন।

এইরূপে কোথায় যাইতেছেন সে বিষয়ে শিষ্যকে কিছুই না বলিয়া গাড়ী বিডন ষ্ট্রীটে উপস্থিত হইলে—কথাচ্ছলে বলিতে লাগিলেন, ‘তোদের দেশের মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার জন্য কিছু মাত্র চেষ্টা দেখা যায় না। তোরা লেখাপড়া করে মানুষ হচ্ছিস, কিন্তু যারা তোদের সুখদুঃখের ভাগী—সকল সময়ে প্রাণ দিয়ে সেবা করে, তাদের শিক্ষা দিতে—তাদের উন্নত করতে তোরা কি করছিস?’

শিষ্য॥ কেন মহাশয়, আজকাল মেয়েদের জন্য কত স্কুল-কলেজ হইয়াছে। কত স্ত্রীলোক এম.এ, বি.এ পাস করিতেছে।

স্বামীজী॥ ও তো বিলাতী ঢঙে হচ্ছে। তোদের ধর্মশাস্ত্রানুশাসনে, তোদের দেশের মত চালে কোথায় কটা স্কুল হয়েছে? দেশে পুরুষদের মধ্যেও তেমন শিক্ষার বিস্তার নেই, তা আবার মেয়েদের ভেতর! গবর্ণমেণ্টের statistic-এ (সংখ্যাসূচক তালিকায়) দেখা যায়, ভারতবর্ষেশতকরা ১০।১২ জন মাত্র শিক্ষিত, তা বোধ হয় মেয়েদের মধ্যে one per cent (শতকরা একজন)-ও হবে না, তা না হলে কি দেশের এমন দুর্দশা হয়? শিক্ষার বিস্তার—জ্ঞানের উন্মেষ—এ-সব না হলে দেশের উন্নতি কি করে হবে? তোরা দেশে যে কয়জন লেখাপড়া শিখেছিস—দেশের ভাবী আশার স্থল—সেই কয়জনের ভেতরেও ঐ বিষয়ে কোন চেষ্টা উদ্যম দেখতে পাই না। কিন্তু জানিস, সাধারণের ভেতর আর মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার না হলে কিছু হবার যো নেই। সেজন্য আমার ইচ্ছা, কতকগুলি ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মচারিণী তৈরী করব। ব্রহ্মচারীরা কালে সন্ন্যাস গ্রহণ করে দেশে দেশে গাঁয়ে গাঁয়ে গিয়ে mass-এর (জনসাধারণের) মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে যত্নপর হবে। আর ব্রহ্মচারিণীরা মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করবে। কিন্তু দেশী ধরনে ঐ কাজ করতে হবে। পুরুষদের জন্য যেমন কতকগুলি centre (শিক্ষাকেন্দ্র) করতে হবে, মেয়েদের শিক্ষা দিতেও সেইরূপ কতকগুলি কেন্দ্র করতে হবে। শিক্ষিতা ও সচ্চরিত্রা ব্রহ্মচারিণীরা ঐ সকল কেন্দ্রে মেয়েদের শিক্ষার ভার নেবে। পুরাণ, ইতিহাস, গৃহকার্য, শিল্প, ঘরকন্নার নিয়ম ও আদর্শ চরিত্র গঠনের সহায়ক নীতিগুলি বর্তমান বিজ্ঞানের সহায়তায় শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্রীদের ধর্মপরায়ণ ও নীতিপরায়ণ করতে হবে; কালে যাতে তারা ভাল গিন্নী তৈরী হয়, তাই করতে হবে। এই সকল মেয়েদের সন্তানসন্ততিগণ পরে ঐসকল বিষয়ে আরও উন্নতি লাভ করতে পারবে। যাদের মা শিক্ষিতা ও নীতিপরায়ণা হন, তাঁদের ঘরেই বড় লোক জন্মায়। মেয়েদের তোরা এখন যেন কতকগুলি manufacturing machine (উৎপাদন-যন্ত্র) করে তুলেছিস। রাম রাম! এই কি তোদের শিক্ষার ফল হল? মেয়েদের আগে তুলতে হবে, mass-কে (জনসাধারণকে) জাগাতে হবে; তবে তো দেশের কল্যাণ—ভারতের কল্যাণ।

গাড়ী এইবার কর্ণওয়ালিস্ ষ্ট্রীটের ব্রাহ্মসমাজ ছাড়াইয়া অগ্রসর হইতেছে দেখিয়া গাড়োয়ানকে বলিলেন, ‘চোরবাগানের রাস্তায় চল্।’ গাড়ী যখন ঐ রাস্তায় প্রবেশ করিল, তখন স্বামীজী শিষ্যের নিকট প্রকাশ করিলেন, ‘মহাকালী পাঠশালা’র স্থাপয়িত্রী তপস্বিনী মাতা তাঁহার পাঠশালা দর্শন করিতে আহ্বান করিয়া তাঁহাকে চিঠি লিখিয়াছেন। ঐ পাঠশালা তখন চোরবাগানে একটা দোতলা ভাড়াটিয়া বাড়ীতে ছিল। গাড়ী থামিলে দুই-চারিজন ভদ্রলোক তাঁহাকে প্রমাণ করিয়া উপরে লইয়া গেলেন এবং তপস্বিনী মাতা দাঁড়াইয়া স্বামীজীকে অভ্যর্থনা করিলেন। অল্পক্ষণ পরেই তপস্বিনী মাতা স্বামীজীকে সঙ্গে করিয়া একটি ক্লাসে লইয়া গেলেন। কুমারীরা দাঁড়াইয়া স্বামীজীকে অভ্যর্থনা করিল এবং মাতাজীর আদেশে প্রথমতঃ ‘শিবের ধ্যান’ সুর করিয়া আবৃত্তি করিতে লাগিল। কিরূপ প্রণালীতে পাঠশালায় পূজাদি শিক্ষা দেওয়া হয়, মাতাজীর আদেশে কুমারীগণ পরে তাহাই করিয়া দেখাইতে লাগিল। স্বামীজীও উৎফুল্ল-মনে ঐ সকল দর্শন করিয়া অন্য এক শ্রেণীর ছাত্রীদিগকে দেখিতে চলিলেন। বৃদ্ধা মাতাজী স্বামীজীর সঙ্গে সকল ক্লাস ঘুরিতে পারিলেন না বলিয়া স্কুলের দুই-তিনটি শিক্ষককে আহ্বান করিয়া সকল ক্লাস ভাল করিয়া স্বামীজীকে দেখাইবার জন্য বলিয়া দিলেন। অনন্তর স্বামীজী সকল ক্লাস ঘুরিয়া পুনরায় মাতাজীর নিকটে ফিরিয়া আসিলে মাতাজী একজন কুমারীকে তখন ডাকিয়া আনিলেন এবং ‘রঘুবংশে’র তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকটির ব্যাখ্যা করিতে বলিলেন। ছাত্রীটিও উহার সংস্কৃতে ব্যাখ্যা করিয়া স্বামীজীকে শুনাইল। স্বামীজী শুনিয়া সন্তোষ প্রকাশ করিলেন এবং স্ত্রীশিক্ষা-প্রচারকল্পে মাতাজীর অধ্যবসায় ও যত্নপরতার এতদূর সাফল্য দর্শন করিয়া তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন। মাতাজী তাহাতে বিনীতভাবে বলিলেন, ‘আমি ভগবতী-জ্ঞানে ছাত্রীদের সেবা করিয়া থাকি, নতুবা বিদ্যালয় করিয়া যশোলাভ করিবার বা অপর কোন উদ্দেশ্য নাই।’

বিদ্যালয়-সম্বন্ধীয় কথাবার্তা সমাপন করিয়া স্বামীজী বিদায় লইতে উদ্যোগ করিলে মাতাজী স্কুল সম্বন্ধে মতামত লিপিবদ্ধ করিতে দর্শকদিগের জন্য নির্দিষ্ট খাতায় (Visitors’ Book) স্বামীজীকে মতামত লিখিতে বলিলেন। স্বামীজীও ঐ পরিদর্শক-পুস্তকে নিজ মত বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করিলেন। লিখিত বিষয়ের শেষ ছত্রটি শিষ্যের এখনও মনে আছে—‘The movement is in the right direction’ (স্ত্রীশিক্ষার প্রচেষ্টাটি ঠিক পথে চলেছে)।

অনন্তর মাতাজীকে অভিবাদন করিয়া স্বামীজী পুনরায় গাড়ীতে উঠিলেন এবং শিষ্যের সহিত স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে নিম্নলিখিতভাবে কথোপকথন করিতে করিতে বাগবাজার অভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেনঃ

স্বামীজী॥ এঁর (মাতাজীর) কোথায় জন্ম! সর্বস্ব-ত্যাগী—তবু লোকহিতের জন্য কেমন যত্নবতী! স্ত্রীলোক না হলে কি ছাত্রীদের এমন করে শিক্ষা দিতে পারে? সবই ভাল দেখলুম; কিন্তু ঐ যে কতকগুলি গৃহী পুরুষ মাষ্টার রয়েছে—ঐটে ভাল বোধ হল না। শিক্ষিতা বিধবা ও ব্রহ্মচারিণীগণের ওপরই স্কুলের শিক্ষার ভার সর্বথা রাখা উচিত। এদেশে স্ত্রীবিদ্যালয়ে পুরুষ-সংস্রব একেবারে না রাখাই ভাল।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, গার্গী খনা লীলাবতীর মত গুণবতী শিক্ষিতা স্ত্রীলোক দেশে এখন পাওয়া যায় কই?

স্বামীজী॥ দেশে কি এখনও ঐরূপ স্ত্রীলোক নেই? এ সীতা সাবিত্রীর দেশ, পুণ্যক্ষেত্র ভারতে এখনও মেয়েদের যেমন চরিত্র সেবাভাব, স্নেহ, দয়া, তুষ্টি ও ভক্তি দেখা যায়, পৃথিবীর কোথাও তেমন দেখলুম না। ওদেশে (পাশ্চাত্যে) মেয়েদের দেখে আমার অনেক সময় স্ত্রীলোক বলেই বোধ হত না—ঠিক যেন পুরুষ মানুষ! গাড়ী চালাচ্ছে, অফিসে বেরুচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে, প্রফেসরি করছে! একমাত্র ভারতবর্ষেই মেয়েদের লজ্জা, বিনয় প্রভৃতি দেখে চক্ষু জুড়ায়। এমন সব আধার পেয়েও তোরা এদের উন্নতি করতে পারলিনি। এদের ভেতরে জ্ঞানালোক দিতে চেষ্টা করলিনে। ঠিক ঠিক শিক্ষা পেলে এরা ideal (আদর্শ) স্ত্রীলোক হতে পারে।

শিষ্য॥ মহাশয়, মাতাজী ছাত্রীদিগকে যেভাবে শিক্ষা দিতেছেন, তাহাতে কি ঐরূপ ফল হইবে? এই সকল ছাত্রীরা বড় হইয়া বিবাহ করিবে, এবং উহার অল্পকাল পরেই অন্য সকল স্ত্রীলোকের মত হইয়া যাইবে। মনে হয়, ইহাদিগকে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করাইতে পারিলে ইহারা সমাজের এবং দেশের উন্নতিকল্পে জীবনোৎসর্গ করিতে এবং শাস্ত্রোক্ত উচ্চ আদর্শ লাভ করিতে পারিত। স্বামীজী॥ ক্রমে সব হবে। দেশে এমন শিক্ষিত লোক এখনও জন্মায়নি, যারা সমাজ-শাসনের ভয়ে ভীত না হয়ে নিজের মেয়েদের অবিবাহিতা রাখতে পারে। এই দেখ্ না—এখনও মেয়ে বার-তের বৎসর পেরুতে না পেরুতে লোকভয়ে—সমাজভয়ে বে দিয়ে ফেলে। এই সেদিন consent (সম্মতিসূচক) আইন করবার সময় সমাজের নেতারা লাখো লোক জড়ো করে চেঁচাতে লাগল ‘আমরা আইন চাই না’। অন্য দেশ হলে সভা করে চেঁচান দূরে থাকুক, লজ্জায় মাথা গুঁজে লোক ঘরে বসে থাকত ও ভাবত আমাদের সমাজে এখনও এ-হেন কলঙ্ক রয়েছে!

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, সংহিতাকারগণ একটা কিছু না ভাবিয়া চিন্তিয়া কি আর বাল্যবিবাহের অনুমোদন করিয়াছিলেন? নিশ্চয় উহার ভিতর একটা গূঢ় রহস্য আছে।

স্বামীজী॥ কি রহস্যটা আছে?

শিষ্য॥ এই দেখুন, অল্প বয়সে মেয়েদের বিবাহ দিলে তাহারা স্বামিগৃহে আসিয়া কুলধর্মগুলি বাল্যকাল হইতে শিখিতে পারিবে। শ্বশুর-শাশুড়ীর আশ্রয়ে থাকিয়া গৃহকর্ম-নিপুণা হইতে পারিবে। আবার পিতৃগৃহে বয়স্থা কন্যার উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা; বাল্যকালে বিবাহ দিলে তাহার আর উচ্ছৃঙ্খল হইবার সম্ভাবনা থাকে না; অধিকন্তু লজ্জা, নম্রতা, সহিষ্ণুতা ও শ্রমশীলতা প্রভৃতি ললনা-সুলভ গুণগুলি তাহাতে বিকশিত হইয়া উঠে।

স্বামীজী॥ অন্যপক্ষে আবার বলা যেতে পারে যে, বাল্যবিবাহে মেয়েরা অকালে সন্তান প্রসব করে অধিকাংশ মৃত্যুমুখে পতিত হয়; তাদের সন্তান-সন্ততিগণও ক্ষীণজীবী হয়ে দেশে ভিখারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে। কারণ, পিতামাতার শরীর সম্পূর্ণ সমর্থ ও সবল না হলে সবল ও নীরোগ সন্তান জন্মাবে কেমন করে? লেখাপড়া শিখিয়ে একটু বয়স হলে বে দিলে সে- মেয়েদের যে সন্তান-সন্ততি জন্মাবে, তাদের দ্বারা দেশের কল্যাণ হবে। তোদের যে ঘরে ঘরে এত বিধবা তার কারণ হচ্ছে—এই বাল্য-বিবাহ। বাল্য বিবাহ কমে গেলে বিধবার সংখ্যাও কমে যাবে।

শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, আমার মনে হয়, অধিক বয়সে বিবাহ দিলে মেয়েরা গৃহকার্যে তেমন মনোযোগী হয় না। শুনিয়াছি, কলিকাতার অনেক স্থানে শাশুড়ীরা রাঁধে ও শিক্ষিতা বধূরা পায়ে আলতা পরিয়া বসিয়া থাকে। আমাদের বাঙাল দেশে ঐরূপ কখনও হইতে পায় না।

স্বামীজী॥ ভাল মন্দ সব দেশেই আছে। আমার মতে সমাজ সকল দেশেই আপনা-আপনি গড়ে। অতএব বাল্যবিবাহ তুলে দেওয়া, বিধবাদের পুনরায় বে দেওয়া প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। আমাদের কাজ হচ্ছে স্ত্রী পুরুষ—সমাজের সকলকে শিক্ষা দেওয়া। সেই শিক্ষার ফলে তারা নিজেরাই কোন‍্‍টি ভাল, কোন‍্‍টি মন্দ সব বুঝতে পারবে এবং নিজেরা মন্দটা করা ছেড়ে দেবে। তখন আর জোর করে সমাজের কোন বিষয় ভাঙতে গড়তে হবে না।

শিষ্য॥ মেয়েদের এখন কিরূপ শিক্ষার প্রয়োজন?

স্বামীজী॥ ধর্ম, শিল্প, বিজ্ঞান, ঘরকন্না, রন্ধন, সেলাই, শরীরপালন—এ-সব বিষয়ের স্থূল মর্মগুলিই মেয়েদের শেখান উচিত। নভেল-নাটক ছুঁতে দেওয়া উচিত নয়। মহাকালী পাঠশালাটি অনেকটা ঠিক পথে চলছে; তবে কেবল পূজাপদ্ধতি শেখালেই হবে না; সব বিষয়ে চোখ ফুটিয়ে দিতে হবে। আদর্শ নারীচরিত্রগুলি ছাত্রীদের সামনে সর্বদা ধরে উচ্চ ত্যাগরূপ ব্রতে তাদের অনুরাগ জন্মে দিতে হবে। সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, লীলাবতী, খনা, মীরা—এঁদের জীবনচরিত্র মেয়েদের বুঝিয়ে দিয়ে তাদের নিজেদের জীবন ঐরূপে গঠিত করতে হবে।

গাড়ী এইবার বাগবাজারে বলরাম বসু মহাশয়ের বাড়ীতে পৌঁছিল। স্বামীজী অবতরণ করিয়া উপরে উঠিলেন এবং তাঁহার দর্শনাভিলাষী হইয়া যাঁহার তথায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদের সকলকে মহাকালী পাঠশালার বৃতান্ত আদ্যোপান্ত বলিতে লাগিলেন।

পরে ‘রামকৃষ্ণ মিশনের’ সভ্যদের কি কি কাজ করা কর্তব্য, তদ্বিষয়ে আলোচনা করিতে করিতে বিদ্যাদান ও জ্ঞানদানের শ্রেষ্ঠত্ব বহুধা প্রতিপাদন করিতে লাগিলেন। শিষ্যকে লক্ষ্য করিয়া স্বামীজী বলিলেন, ‘Educate, educate (শিক্ষা দে, শিক্ষা দে), নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায় (এ ছাড়া অন্য পথ নেই)। শিক্ষাদানের বিরোধী দলের প্রতি কটাক্ষ করিয়া বলিলেন, ‘যেন পেহ্লাদের দলে যাসনি।’ ঐ কথার অর্থ জিজ্ঞাসা করায় স্বামীজী বলিলেন, ‘শুনিসনি? ক-অক্ষর দেখেই প্রহ্লাদের চোখে জল এসেছিল—তা আর পড়াশুনো কি করে হবে? অবশ্য প্রহ্লাদের চোখে প্রেমে জল এসেছিল, আর মূর্খদের চোখে জল ভয়ে এসে থাকে। ভক্তদের ভেতরেও অনেকে ঐ রকমের আছে।’ সকলে ঐকথা শুনিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন। স্বামী যোগানন্দ ঐ কথা শুনিয়া বলিলেন, ‘তোমার যখন যে দিকে ঝোঁক উঠবে—তার একটা হেস্তনেস্ত না হলে তো আর শান্তি নেই। এখন যা হচ্ছে, তাই হবে।’