দেববাণী – ৩

শুক্রবার, ২৮ জুন

(অদ্য সকলেই স্বামীজীর সহিত বনভোজনে যাত্রা করিয়াছিলেন। যদিও স্বামীজী যেখানেই থাকিতেন, সেখানেই অবিরাম শিক্ষা দিতেন, অদ্যকার উপদেশের কোন প্রকার ‘নোট’ রাখা হয় নাই; তাই তিনি যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার কিছুই লিপিবদ্ধভাবে নাই। তবে বাহির হইবার পূর্বে প্রাতরাশের সময় তিনি এই কয়েকটি কথা বলিয়াছিলেনঃ)

সর্বপ্রকার অন্নের জন্য ভগবানের প্রতি কৃতজ্ঞ হও—অন্নই ব্রহ্মস্বরূপ। তাঁর সর্বব্যাপিনী শক্তিই আমাদের ব্যষ্টিশক্তিতে পরিণত হয়ে আমাদের সর্বপ্রকার কার্য করতে সাহায্য করে থাকে।

শনিবার, ২৯ জুন

(অদ্য স্বামীজী গীতা হাতে করিয়া উপস্থিত হইলেন।)

গীতায় ‘হৃষীকেশ’ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় বা (ইন্দ্রিয়যুক্ত) জীবাত্মাগণের ঈশ্বর কৃষ্ণ—‘গুড়াকেশ’কে অর্থাৎ নিদ্রার অধীশ্বর (অর্থাৎ নিদ্রাজয়ী) অর্জুনকে উপদেশ দিচ্ছেন। এই সংসারই ‘ধর্মক্ষেত্র’ কুরুক্ষেত্র। পঞ্চপাণ্ডব (অর্থাৎ ধর্ম) শত কৌরবের (আমরা যে-সকল বিষয়ে আসক্ত এবং যাদের সঙ্গে আমাদের সতত বিরোধ তাদের) সঙ্গে যুদ্ধ করছেন! পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বীর অর্জুন (অর্থাৎ প্রবুদ্ধ জীবাত্মা) সেনাপতি। আমাদের সবচেয়ে আসক্তির বস্তু—সমুদয় ইন্দ্রিয়সুখের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, তাদের মেরে ফেলতে হবে। আমাদের নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমরা ব্রহ্মস্বরূপ, আমাদের আর সমস্ত ভাবকে এইভাবে ডুবিয়ে দিতে হবে।

শ্রীকৃষ্ণ সব কাজই করেছিলেন, কিন্তু আসক্তিবর্জিত হয়ে। তিনি সংসারে ছিলেন বটে, কিন্তু কখনই সংসারের হয়ে যাননি। সকল কাজ কর, কিন্তু অনাসক্ত হয়ে কর; কাজের জন্যই কাজ কর, কখনও নিজের জন্য কর না।

* * *

নামরূপাত্মক কোন কিছু কখনই মুক্তস্বভাব হতে পারে না। মৃত্তিকা-রূপ আত্মা থেকে ঘটাদির মত আমরা হয়েছি: এ অবস্থায় আত্মা সীমাবদ্ধ—আর মুক্ত নন; আপেক্ষিক সত্তাকে কখনও মুক্ত বলা যেতে পারে না। ঘট যতক্ষণ ঘট থাকে, ততক্ষণ সে কখনই বলতে পারে না, ‘আমি মুক্ত’; যখনই সে নাম-রূপ ভুলে যায়, তখনই মুক্ত হয়। সমুদয় জগৎটাই আত্মস্বরূপ—বহুভাবে অভিব্যক্ত, যেন এক সুরের মধ্যেই নানা রঙপরং তোলা হয়েছে—তা না হলে একঘেয়ে হয়ে পড়ত। সময়ে সময়ে বেসুরো বাজে বটে, তাতে বরং পরবর্তী সুরের ঐকতান আরও মিষ্ট লাগে। মহান্ বিশ্বসঙ্গীতে তিনটি ভাবের বিশেষ প্রকাশ দেখা যায়—সাম্য, শক্তি ও মুক্তি।

যদি তোমার স্বাধীনতা অপরকে ক্ষুণ্ণ করে, তা হলে বুঝতে হবে—তুমি স্বাধীন নও। অপরের কোন প্রকার ক্ষতি কখনও কর না।

মিল্টন বলেছেন, ‘দুর্বলতাই দুঃখ।’ কর্ম ও ফলভোগ—এই দুটির অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ। অনেক সময়েই দেখা যায়, যে বেশী হাসে, তাকে কাঁদতেও হয় বেশী—যত হাসি তত কান্না। ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’—কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়।

* * *

জড়বাদের দৃষ্টিতে দেখলে কুচিন্তাগুলিকে রোগজীবাণু বলা যেতে পারে। আমাদের দেহ যেন লৌহপিণ্ডের মত আর আমাদের প্রত্যেক চিন্তা যেন তার উপর আস্তে আস্তে হাতুড়ির ঘা মারা—তাই দিয়ে আমরা দেহটাকে যেভাবে ইচ্ছা গঠন করি।

আমরা জগতের সমুদয় শুভচিন্তারাশির উত্তরাধিকারী, অবশ্য যদি সেগুলিকে আমাদের মধ্যে অবাধে আসতে দিই।

শাস্ত্র তো সবসময় আমাদের মধ্যেই রয়েছে। মূর্খ, শুনতে পাচ্ছ না কি, তোমার নিজ হৃদয়ে দিবারাত্র সেই অনন্ত সঙ্গীত ধ্বনিত হচ্ছে—‘সচ্চিনানন্দঃ সচ্চিদানন্দঃ, সোঽহং সোঽহম্।’

আমাদের প্রত্যেকের ভিতর—কি ক্ষুদ্র পিপীলিকা, কি স্বর্গের দেবতা—সকলেরই ভিতর অনন্ত জ্ঞানের প্রস্রবণ রয়েছে। প্রকৃত ধর্ম একটিই। আমরা তার বিভিন্ন রূপ নিয়ে, বিভিন্ন প্রতীক নিয়ে—তার বিভিন্ন প্রকাশ নিয়ে ঝগড়া করে মরি। যারা খুঁজতে জানে, তাদের কাছে সত্যযুগ তো এখনই রয়েছে। আমরা নিজেরাই নষ্ট হয়েছি, আর মনে করছি—জগৎ সংসার গোল্লায় গেছে।

এ জগতে পূর্ণশক্তির কোন কার্য থাকে না। তাকে কেবল ‘অস্তি’ বা ‘সৎ’ মাত্র বলা যায়, তার দ্বারা কোন কাজ হয় না।

যথার্থ সিদ্ধিলাভ এক বটে, তবে আপেক্ষিক সিদ্ধি নানাবিধ হতে পারে।

রবিবার, ৩০ জুন

একটা কিছু কল্পনা আশ্রয় না করে চিন্তা করবার চেষ্টা আর অসম্ভবকে সম্ভব করবার চেষ্টা—এক কথা। আমরা কোন একটি বিশেষ জীবকে অবলম্বন না করে স্তন্যপায়ী কোন জীবের ধারণা করতে পারি না। ঈশ্বরের ধারণাসম্বন্ধেও ঐ কথা।

জগতে যতপ্রকার ভাব বা ধারণা আছে, তার যে সূক্ষ্ম সারনিষ্কর্ষ, তাকেই আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি।

প্রত্যেক চিন্তার দুটি ভাগ আছে—একটি হচ্ছে ভাব, আর দ্বিতীয়টি ঐ ভাবদ্যোতক ‘শব্দ’; আমাদের ঐ দুটিকেই নিতে হবে। কি বিজ্ঞানবাদী (Idealist), কি জড়বাদী (Materialist), কারও মত খাঁটি সত্য নয়। ভাব ও তার প্রকাশ দুই-ই আমাদের নিতে হবে।

আমরা আরশিতেই আমাদের মুখ দেখতে পাই—সমুদয় জ্ঞানও সেইরকম প্রতিবিম্বিত বস্তুরই জ্ঞান। কেউ কখনও তার নিজের আত্মা বা ঈশ্বরকে জানতে পারবে না, কিন্তু আমরা স্বয়ংই সেই আত্মা, আমরাই ঈশ্বর বা পরমাত্মা।

তখনই তোমার নির্বাণ-অবস্থা লাভ হবে, যখন তোমার ‘তুমিত্ব’ থাকবে না। বুদ্ধ বলেছিলেনঃ যখন ‘তুমি’ থাকবে না, তখনই তোমার যথার্থ অবস্থা—তখনই তোমার সর্বোচ্চ অবস্থা অর্থাৎ যখন ক্ষুদ্র বা কাঁচা আমিটা চলে যাবে।

অধিকাংশ ব্যক্তির মধ্যে সেই অভ্যন্তরীণ দিব্য জ্যোতিঃ আবৃত ও অস্পষ্ট হয়ে রয়েছে; যেন একটা লোহার পিপের ভিতর একটা আলো রয়েছে, ঐ আলোর একটি রশ্মিও বাইরে আসতে পারছে না। একটু একটু করে পবিত্রতা ও নিঃস্বার্থতা অভ্যাস করতে করতে আমরা ঐ মাঝের আড়ালটাকে ক্রমশঃ পাতলা করে ফেলতে পারি। অবশেষে সেটা কাচের মত স্বচ্ছ হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণে যেন ঐ লোহার পিপে কাচে পরিণত হয়েছে। তার মধ্য দিয়ে সেই অভ্যন্তরীণ জ্যোতিঃ যথার্থরূপে দেখা যাচ্ছে। আমরা সকলেই এইরূপ কাচের পিপে হবার পথে চলেছি—এমন-কি, এর চেয়েও উচ্চতর বিকাশের আধার হব। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আদৌ কোন পিপে রয়েছে, ততদিন আমাদের জড় উপায়ের সাহায্যেই চিন্তা করতে হবে। অসহিষ্ণু ব্যক্তি কোন কালে সিদ্ধ হতে পারে না।

* * *

বড় বড় সাধুপুরুষেরা আদর্শ তত্ত্বের (Principle) দৃষ্টান্তস্বরূপ; কিন্তু শিষ্যেরা ব্যক্তিকেই আদর্শ বা তত্ত্ব করে তোলে, আর ব্যক্তিকে নাড়াচাড়া করতে করতে তত্ত্বটা ভুলে যায়।

বুদ্ধ সগুণ ঈশ্বর-ভাবকে ক্রমাগত আক্রমণ করেছিলেন বলেই ভারতে প্রতিমাপূজার সূত্রপাত হল! বৈদিক যুগে প্রতিমার অস্তিত্বই ছিল না, তখন লোকে সর্বত্র ঈশ্বর দর্শন করত। কিন্তু বুদ্ধের প্রচারের ফলে আমরা জগৎস্রষ্টা ও ‘আমাদের সখা’ ঈশ্বরকে হারালাম, আর তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ প্রতিমাপূজার উৎপত্তি হল। লোকে বুদ্ধের মূর্তি গড়ে পূজা করতে আরম্ভ করলে। যীশুখ্রীষ্ট-সম্বন্ধেও তাই হয়েছে। কাঠ-পাথরের পূজা থেকে যীশু-বুদ্ধের পূজা পর্যন্ত—সবই প্রতিমাপূজা, কিন্তু কোন-না-কোনরূপ মূর্তি ব্যতীত আমাদের চলতে পারে না।

* * *

জোর করে সংস্কারের চেষ্টার ফল এই যে, তাতে সংস্কার বা উন্নতির গতিরোধ হয়। কাউকে বল না—‘তুমি মন্দ’, বরং তাকে বল—‘তুমি ভালই আছ, আরও ভাল হও।’

পুরুতরা সব দেশেই অনিষ্ট করে থাকে; কারণ তারা লোককে গাল দেয় ও তাদের সমালোচনা করে। তারা একটা দড়ি ধরে টান দেয়, মনে করে—সেটাকে ঠিক করবে, কিন্তু তার ফলে আর দু-তিনটা দড়ি স্থানভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। প্রেমে কখনও কেউ গাল-মন্দ করে না, শুধু প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাতেই মানুষ ঐ রকম করে থাকে। ‘ন্যায়সঙ্গত রাগ’ বলে কোন জিনিষ নেই।

যদি তুমি কাউকে সিংহ হতে না দাও, তা হলে সে ধূর্ত শৃগাল হয়ে দাঁড়াবে। স্ত্রীজাতি শক্তিস্বরূপিণী, কিন্তু এখন ঐ শক্তি কেবল মন্দ বিষয়ে প্রযুক্ত হচ্ছে। তার কারণ, পুরুষ তার উপর অত্যাচার করছে। এখন সে শৃগালীর মত; কিন্তু যখন তার উপর আর অত্যাচার হবে না, তখন সে সিংহী হয়ে দাঁড়াবে।

সাধারণতঃ ধর্মভাবকে বিচার-বুদ্ধি দ্বারা নিয়মিত করা উচিত। তা না হলে ঐ ভাবের অবনতি হয়ে ওটা ভাবুকতা-মাত্রে পরিণত হতে পারে।

* * *

আস্তিকমাত্রেই স্বীকার করেন যে, এই পরিণামী জগতের পশ্চাতে একটা অপরিণামী বস্তু আছে—যদিও সেই চরম পদার্থের ধারণা-সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে মতভেদ আছে। বুদ্ধ এটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘ব্রহ্ম বা আত্মা বলে কিছু নেই।’

চরিত্র-হিসাবে জগতের মধ্যে বুদ্ধ সকলের চেয়ে বড়; তারপর খ্রীষ্ট। কিন্তু গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যা বলে গেছেন, তার মত মহান্ উপদেশ জগতে আর নেই। যিনি সেই অদ্ভুত কাব্য রচনা করেছিলেন, তিনি সেই-সব বিরল মহাত্মাদের মধ্যে একজন, যাঁদের জীবন দ্বারা সমগ্র জগতে এক এক নবজীবনের স্রোত বয়ে যায়। যিনি গীতা লিখেছেন, তাঁর মত আশ্চর্য মাথা মনুষ্যজাতি আর কখনও দেখতে পাবে না!

জগতে একটামাত্র শক্তিই রয়েছে—সেইটেই কখনও মন্দ, কখনও বা ভালভাবে অভিব্যক্ত হচ্ছে। ঈশ্বর আর শয়তান একই নদী—কেবল স্রোতটা পরস্পরের বিপরীত-গামী।