গীতা—১

[১৯০০ খ্রীঃ ২৬ মে সান ফ্রান্সিস্কোতে প্রদত্ত বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত অনুলিপি]

গীতা বুঝিতে হইলে ইহার ঐতিহাসিক পটভূমি বোঝা প্রয়োজন। গীতা উপনিষদের ভাষ্য। উপনিষদ্‌ ভারতের একটি প্রধান ধর্মগ্রন্থ—খ্রীষ্টান জগতে নিউ টেষ্টামেণ্টের মত ভারতে ইহার স্থান। উপনিষদের সংখ্যা একশতেরও অধিক, কোনটি ছোট এবং কোনটি বড় হইলেও প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র গ্রন্থ। উপনিষদ্‌ কোন ঋষি বা আচার্যের জীবন-কাহিনী নয়, ইহার বিষয়বস্তু আত্মতত্ত্ব। উপনিষদের সূত্রসমূহ রাজাদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিদ্বৎসভায় আলোচনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। ‘উপনিষদ্‌’ শব্দের একটি অর্থ—(আচার্যের নিকট) উপবেশন। আপনাদের মধ্যে যাঁহারা উপনিষদ্‌ পাঠ করিয়াছেন, তাঁহারাই জানেন, ইহাদিগকে কেন সংক্ষিপ্ত সাঙ্কেতিক বিবরণ বলা হয়। দীর্ঘ আলোচনা সমাপ্ত হইবার পর সাধারণতঃ স্মরণ করিয়া এগুলি লিপিবদ্ধ করিয়া রাখা হইত। পূর্বাপর সম্বন্ধ বা পটভূমি নাই বলিলেই হয়। জ্ঞানগর্ভ বিষয়গুলি শুধু উল্লিখিত হইয়াছে।

প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার উৎপত্তি খ্রীষ্টের ৫০০০ বৎসর পূর্বে। উপনিষদগুলি ইহারও অন্তত দুই হাজার বৎসর আগেকার—ঠিক কখন ইহাদের উৎপত্তি হইয়াছে, কেহ বলিতে পারে না। উপনিষদের ভাবগুলিই গীতায় গৃহীত হইয়াছে—কোন কোন ক্ষেত্রে হুবহু শব্দ পর্যন্ত। সেগুলি এমনিভাবে গ্রথিত যে, সমগ্র উপনিষদের বিষয়বস্তুটি যেন সুসম্বন্ধ, সংক্ষিপ্ত ও ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপিত করা হইয়াছে।

হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ। এত বিরাট যে, যদি ইহার শ্লোকগুলি একত্র করা হয়, তবে এই বক্তৃতা-গৃহটিতে স্থান-সঙ্কুলান হইবে না। ইহা ছাড়া কিছু নষ্টও হইয়া গিয়াছে। বেদ বহু শাখায় বিভক্ত; এক একটি ঋষি-সম্প্রদায় ছিলেন এক একটি শাখার ধারক ও বাহক। ঋষিগণ স্মৃতিশক্তির সাহায্যে শাখাগুলিকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন। ভারতবর্ষে এখনও অনেকে আছেন, যাঁহারা উচ্চারণের কিছুমাত্র ভুল না করিয়া বেদের অধ্যায়ের পর অধ্যায় আবৃত্তি করিতে পারেন। বেদের বৃহত্তর অংশ এখন আর পাওয়া যায় না, কিন্তু যে অংশ পাওয়া যায়, তাহা লইয়াই একটি বৃহৎ গ্রন্থাগার হইতে পারে। বেদের প্রাচীনতম অংশে ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি পাওয়া যায়। বৈদিক রচনাবলীর পারম্পর্য-নির্ণয়ের জন্য আধুনিক গবেষকদের একটি ঝোঁক দেখা যায়—কিন্তু এ বিষয়ে গোঁড়া ও প্রাচীনপন্থীদের ধারণা অন্যরূপ, যেমন বাইবেল সম্বন্ধে প্রাচীন ধারণা আধুনিক গবেষকদের মত হইতে ভিন্ন। বেদকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়ঃ একটি দার্শনিক অংশ—উপনিষদ্‌, অন্যটি কর্মকাণ্ড।

কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে এখন একটি মোটামুটি ধারণা দেবার চেষ্টা করা যাক। অনুষ্ঠান-বিধি ও স্তবস্তুতি লইয়াই কর্মকাণ্ড; বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে বিভিন্ন স্তব। কর্মকাণ্ডের মধ্যে যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান-সম্পর্কিত বিধিসমূহ পাওয়া যায়—উহাদের কতকগুলি বিশদভাবে আলোচিত হইয়াছে। বহু হোতা ও পুরোহিতের আবশ্যক। যাগযজ্ঞের বিশদ অনুষ্ঠানের জন্য হোতা, ঋত্বিক প্রভৃতির কার্য একটি বিশেষ বিজ্ঞানে পরিণত হয়। ক্রমশঃ এইসব স্তব ও যাগযজ্ঞকে কেন্দ্র করিয়া সর্বসাধারণের মধ্যে একটা শ্রদ্ধার ভাব গড়িয়া উঠে। দেবতাগণ তখন অন্তর্হিত হন এবং যাগযজ্ঞই তাঁহাদের স্থান অধিকার করে। ভারতে ইহা এক অদ্ভুত ক্রমপরিণতি। গোঁড়া হিন্দু (মীমাংসক) দেবতায় বিশ্বাসী নন, যাঁহারা গোঁড়া নন, তাঁহারা দেবতায় বিশ্বাসী। নিষ্ঠাবান হিন্দুকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বেদে উল্লিখিত দেবতাগণের তাৎপর্য কি, তাহা হইলে তিনি ইহার সদুত্তর দিতে পারিবেন না। পুরোহিতরা মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক হোমাগ্নিতে আহুতি প্রদান করেন। গোঁড়া হিন্দুদিগকে ইহার তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করিলে বলেন, শব্দের এমন একটি শক্তি আছে, যাহা দ্বারা বিশেষ ফল উৎপন্ন হয়, এই পর্যন্ত। প্রাকৃতিক ও অতি-প্রাকৃতিক সমস্ত শক্তিই উহার মধ্যে আছে। অতএব বেদ হইল শব্দরাশি, যাহার উচ্চারণ নির্ভুল হইলে আশ্চর্য ফল উৎপন্ন হইতে পারে। একটি শব্দও ভুল উচ্চারণ হইলে চলিবে না। প্রত্যেকটি শব্দ বিধিমত উচ্চারণ হওয়া প্রয়োজন। এইরূপে অন্যান্য ধর্মে যাহাকে প্রার্থনা বলা হয়, তাহা অন্তর্হিত হইল এবং বেদই দেবতারূপে পরিণত হইল। কাজেই দেখা যাইতেছে, এ মতে বেদে শব্দরাশির উপর বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে। এগুলি হইল শাশ্বত শব্দরাশি, যাহা হইতে সমগ্র জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে। শব্দ ছাড়া কোন চিন্তার অভিব্যক্তি হয় না। এই পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে, তাহা চিন্তারই অভিব্যক্তি এবং চিন্তা ব্যক্ত হয় কেবলমাত্র শব্দের সাহায্যে। যে শব্দরাশি দ্বারা অব্যক্ত চিন্তা ব্যক্ত হয়, তাহাই বেদ। অতএব বলা যায়, প্রত্যেকটি বস্তুর বাহিরের যে অস্তিত্ব, তাহা নির্ভর করে বেদের উপর, কারণ শব্দ ছাড়া চিন্তার অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। যদি ‘অশ্ব’ শব্দটি না থাকিত, তবে কেহই অশ্ব সম্বন্ধে চিন্তা করিতে পারিত না। অতএব চিন্তা শব্দ ও বস্তুর মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকা চাই। প্রকৃতপক্ষে এই শব্দগুলি কি? এগুলি বেদ। হিন্দুরা এই ভাষাকে মোটেই সংস্কৃত বলেন না; ইহা বৈদিক বা দেবভাষা। সংস্কৃত তাহার একটি বিকৃত রূপ; অন্যান্য ভাষাগুলিও তাহাই। বৈদিক ভাষা হইতে প্রাচীনতর আর কোন ভাষা নাই। আপনারা প্রশ্ন করিতে পারেন—বেদসমূহের রচয়িতা কে? এগুলি কাহারও দ্বারা লিখিত হয় নাই। শব্দরাশিই বেদ। একটি শব্দই বেদ, যদি আমি ঠিকভাবে তাহা উচ্চারণ করিতে পারি। ঠিকভাবে উচ্চারিত হইলে তৎক্ষণাৎ উহা বাঞ্ছিত ফল প্রদান করিবে।

এই বেদরাশি অনাদিকাল হইতে বিদ্যমান এবং এই শব্দরাশি হইতে সমগ্র জগৎ অভিব্যক্ত। কল্পান্তে এই সব শক্তির প্রকাশ সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হইয়া প্রথমে কেবল শব্দে এবং পরে চিন্তায় লীন হইয়া যায়। পরবর্তী কল্পে চিন্তা প্রথমে শব্দরাশিতে ব্যক্ত হয় এবং পরে শব্দগুলি হইতে সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টি হইয়া থাকে। এইজন্য যাহা বেদে নাই, তাহার অস্তিত্ব অসম্ভব, তাহা ভ্রান্তিমাত্র। বেদের এই অপৌরুষেয়ত্ব প্রতিপাদনের জন্য বহু গ্রন্থ আছে। যদি আপনারা বলেন, বেদ মানুষের দ্বারা রচিত, তাহা হইলে এই সব গ্রন্থের রচয়িতাদের নিকট আপনারা হাস্যাপদ হইবেন। মানুষের দ্বারা বেদ প্রথমে সৃষ্ট হইয়াছিল—এ কথার উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। বুদ্ধদেবের কথা ধরা যাক, প্রবাদ আছে, তিনি বুদ্ধত্বলাভের পূর্বে বহুবার জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং বেদপাঠও করিয়াছিলেন। যদি খ্রীষ্টান বলে, ‘আমার ধর্ম ঐতিহাসিক ধর্ম এবং সে জন্যই উহা সত্য, আর তোমার ধর্ম মিথ্যা।’ মীমাংসক উত্তর দিবেন, ‘তোমার ধর্মের একটা ইতিহাস আছে এবং তুমি নিজেই স্বীকার করিতেছ, কোন মানুষ উনিশ শত বৎসর পূর্বে ইহা আবিষ্কার করিয়াছে।’ যাহা সত্য, তাহা অসীম ও সনাতন। ইহাই সত্যের একমাত্র লক্ষণ। সত্যের কখনও বিনাশ নাই—ইহা সর্বত্র একরূপ। তুমি স্বীকার করিতেছ, তোমার ধর্ম কোন-না-কোন ব্যক্তির দ্বারা সৃষ্ট হইয়াছিল। বেদ কিন্তু সেরূপ নয়; কোন অবতার বা মহাপুরুষ দ্বারা উহা সৃষ্ট নয়। বেদ অনন্ত শব্দরাশি—স্বভাবতঃ যে শব্দগুলি শাশ্বত ও সনাতন, সেগুলি হইতে এই বিশ্বের সৃষ্টি ও সেইগুলিতেই ইহার লয় হইতেছে। তত্ত্বের দিক্‌ দিয়া ইহা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। … সৃষ্টির আদিতে শব্দের তরঙ্গ। জীবনসৃষ্টির আদিতে জীবাণুর মত শব্দতরঙ্গেরও আদি-তরঙ্গ আছে। শব্দ ছাড়া কোন চিন্তা সম্ভব নয়।

যেখানে কোন বোধ চেতনা বা অনুভূতি আছে, সেখানে শব্দ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু যখন বলা হয়, চারখানি গ্রন্থই কেবল বেদ, তখন ভুল বলা হয়। তখন বৌদ্ধরা বলিবেন, ‘আমাদের শাস্ত্রগুলিই বেদ, সেগুলি পরবর্তীকালে আমাদের নিকট প্রকাশিত হইয়াছে।’ তাহা সম্ভব নহে, প্রকৃতি এইভাবে কার্য করে না। প্রকৃতির নিয়মগুলি একটু একটু করিয়া প্রকাশিত হয় না। মাধ্যাকর্ষণ-নিয়মের খানিকটা আজ ও খানিকটা কাল প্রকাশিত হইবে, এরূপ হয় না। প্রত্যেকটি নিয়ম পরিপূর্ণ। নিয়মের ক্রমবিবর্তন মোটেই নাই। যাহা হইবার তাহা একেবারেই প্রকাশিত হইবে। ‘নূতন ধর্ম’, ‘মহত্তর প্রেরণা’ প্রভৃতি শব্দ নিতান্ত অর্থহীন। প্রকৃতির শতসহস্র নিয়ম থাকিতে পারে, মানুষ আজ পর্যন্ত তাহার অতি অল্পই হয়তো জানিয়াছে। তত্ত্বগুলি আছে, আমরা সেগুলি আবিষ্কার করি—এই মাত্র। প্রাচীন পুরোহিতকুল এই শব্দরাশির উচ্চারণ-বিধি অধিগত করিয়া দেবতাদের স্থানচ্যুত করিয়াছেন এবং তাহাদের স্থলে নিজদিগকে বসাইয়াছেন। তাঁহারা বলিলেনঃ শব্দের কি অদ্ভুত শক্তি, তাহা তোমরা জান না! ঐগুলি কিভাবে ব্যবহার করা যায়, আমরা জানি! এই পৃথিবীতে আমরাই জীবন্ত দেবতা। আমাদের অর্থ দাও। অর্থের বিনিময়ে আমরা বেদের শব্দরাশিকে এমন কাজে লাগাইব, যাহাতে তোমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে। তোমরা কি নিজেরা বেদমন্ত্র যথাযথ উচ্চারণ করিতে পার? পার না; সাবধান, যদি একটিও ভুল কর, তবে ফল বিপরীত হইবে। তোমরা কি ধনবান্, ধীমান্ ও দীর্ঘাযু হইতে চাও এবং মনোনীত পতি বা পত্নী লাভ করিতে চাও? তাহা হইলে পুরোহিতদের অর্থ দাও এবং চুপ করিয়া থাক।

আর একটি দিক্‌ আছে। বেদের প্রথম অংশের আদর্শ অপর অংশ উপনিষদের আদর্শ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্‌। প্রথম অংশের যে আদর্শ, তাহার সহিত এক বেদান্ত ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের আদর্শের মিল আছে। ইহলোক ও পরলোকে ভোগই ইহার মূল কথা—স্বামী-স্ত্রী পুত্র কন্যা। অর্থ দাও, পুরোহিতরা তোমাকে ছাড়পত্র দিবেন—পরকালে স্বর্গে তুমি সুখে থাকিবে। সেখানেও তুমি সব আত্মীয়-স্বজনকে পাইবে এবং অনন্তকাল আমোদ-প্রমোদ উপভোগ করিবে। অশ্রু নাই, দুঃখ নাই—শুধু হাসি আর আনন্দ। পেটের বেদনা নাই—যত পার খাও। মাথা-ব্যথা নাই, যত পার ভোজসভায় যোগদান কর। পুরোহিতদের মতে ইহাই মানব-জীবনের মহত্তম উদ্দেশ্য।

এই জীবন-দর্শনের অন্তর্ভুক্ত আর একটি বিষয়ের সহিত আধুনিক ভাবধারার অনেকখানি মিল আছে। মানুষ প্রকৃতির দাস এবং চিরকালই সে এইরূপ থাকিবে। আমরা ইহাকে ‘কর্ম’ বলি। কর্ম একটি নিয়ম; ইহা সর্বত্র প্রযোজ্য। পুরোহিতদের মতে সকলেই কর্মের অধীন। তবে কি কর্মের প্রভাব হইতে মুক্ত হইবার উপায় নাই? তাঁহারা বলেন, ‘না। অনন্তকাল প্রকৃতির কৃতদাসরূপে থাকিতে হইবে—তবে সে দাসত্ব সুখের! যদি আমাদের উপযুক্ত দক্ষিণা দাও, তবে শব্দগুলি এমনভাবে ব্যবহার করিব, যাহাতে তোমরা পরকালে কেবল ভালটুকু পাইবে, মন্দটুকু নয়।’—মীমাংসকেরা এরূপ বলেন। যুগ যুগ ধরিয়া এইরূপ আদর্শই সাধারণের নিকট প্রিয় হইয়া আছে। জনসাধারণ কখনও চিন্তা করে না। যদি কেহ কখনও স্বাধীন ভাবে চিন্তা করিতে চেষ্টা করে, তখন তাহাদের উপর কুসংস্কারের প্রচণ্ড চাপ পড়ে। এই দুর্বলতার জন্য বাইরের একটু আঘাত তাহাদের মেরুদণ্ড ভাঙিয়া টুকরো টুকরো হইয়া যায়। প্রলোভন ও শাস্তির ভয় দ্বারা তাহারা চলিতে পারে না। সাধারণ লোককে ভীত ও সন্ত্রস্ত করিয়া রাখিতে হইবে; চিরকাল ক্রীতদাস হইয়া তাহারা থাকিবে। পুরোহিতদের দক্ষিণা দেওয়া এবং তাহাদের মানিয়া চলা ছাড়া আর কোন কর্তব্য নাই—বাকী যাহা করণীয়, তাহা যেন পুরোহিতরাই করিয়া দিবেন। ধর্ম এইভাবে কতখানি সহজ হইয়া যায়! কারণ আপনাদের কিছুই করিবার নাই—বাড়ী গিয়া নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকুন। নিজেদের মুক্তিসাধনার সবই অপরে করিয়া দিবে। হায়, হতভাগ্য মানুষ!

পাশাপাশি আর একটি দার্শনিক চিন্তাধারাও ছিল। উপনিষদ্‌ কর্মকাণ্ডের সকল সিদ্ধান্তের একেবারে বিপরীত। প্রথমতঃ উপনিষদ্ বিশ্বাস করেন, এই বিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন—তিনি ঈশ্বর, সমস্ত বিশ্বের নিয়ামক। কালে তিনি কল্যাণময় ভাগ্যবিধাতায় পরিণত হন। এই ধারণা পূর্বের ধারণা হইতে সম্পূর্ণ বিপরীত। পুরোহিতরাও এ কথা বলেন, তবে এখানে ঈশ্বরের যে ধারণা, তাহা অতি সূক্ষ্ম। বহু দেবতার স্থলে এখানে এক ঈশ্বরের কথা বলা হইয়াছে।

দ্বিতীয়তঃ উপনিষদও স্বীকার করেন, কর্মের নিয়মে সকলে আবদ্ধ; কিন্তু নিয়মের হাত হইতে মুক্তিপথের সন্ধানও তাঁহারা দিয়াছেন। মানব জীবনের উদ্দেশ্য নিয়মের পারে যাওয়া। ভোগ কখনও জীবনের উদ্দেশ্য হইতে পারে না, কারণ ভোগ কেবল প্রকৃতির মধ্যেই সম্ভব।

তৃতীয়তঃ উপনিষদ্ যাগযজ্ঞের বিরোধী এবং উহাকে নিতান্ত হাস্যকর অনুষ্ঠান বলিয়া মনে করেন। যাগযজ্ঞের দ্বারা সকল ঈপ্সিত বস্তু লাভ হইতে পারে, কিন্তু ইহা মানুষের চরম কাম্য হইতে পারে না; কারণ মানুষ যতই পায় ততই চাই। ফলে মানব হাসি কান্নার অন্তহীন গোলকধাঁধায় চিরকাল ঘুরিতে থাকে—কখনও লক্ষ্যে পৌঁছিতে পারে না, অনন্ত সুখ কোথাও কখনও সম্ভব নহে, ইহা বালকের কল্পনা মাত্র। একই শক্তি সুখ ও দুঃখরূপে পরিণত হয়।

আজ আমার মনুষত্ব খানিকটা পরিবর্তন করিয়াছি। একটি অত্যন্ত অদ্ভুত সত্য আবিষ্কার করিয়াছি। অনেক সময় আমাদের মনে অনেক ভাব জাগে, যেগুলি আমরা চাই না; আমরা অন্য বিষয়ের চিন্তা দ্বারা ঐগুলি সম্পূর্ণভাবে চাপা দিতে চাই। সেই ভাবটা কি? দেখিতে পাই পনর মিনিটের মধ্যেই তাহা আবার মনে উদিত হয়। সেই ভাবটি এত প্রবল ও ভীষণভাবে আসিয়া মনে আঘাত করে যে, নিজেকে পাগল বলিয়াই মনে হয় এবং যখন এই ভাব প্রশমিত হয়, তখন দেখা যায় যে, পূর্বের ভাবটিকে শুধু চাপিয়া রাখা হইয়াছিল। মনে কী প্রকাশিত হইয়াছিল?—আমার নিজেরই যে খারাপ সংস্কারগুলি কার্যে পরিণত হইবার অপেক্ষায় ভিতরে সঞ্চিত ছিল, সেয়গুলিই। ‘প্রাণিগণ নিজ নিজ প্রকৃতিকে অনুসরণ করে। ইন্দ্রিয় নিগ্রহ কি করিতে পারে?’ গীতায় এইরূপ ভীষণ কথাই বলা হইয়াছে। কাজেই আমাদের সমস্ত সংগ্রাম—সমস্ত চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ বলিয়া মনে হয়। মনের মধ্যে সহস্র প্রেরণা একই সময়ে প্রতিযোগিতা করিতেছে; তাহাদিগকে চাপিয়া রাখা যাইতে পারে, কিন্তু যখনই বাধা অপসারিত হয়, তখনই সমস্ত চিন্তাগুলি প্রকট হইয়া উঠে।

কিন্তু আশা আছে। যদি ক্ষমতা থাকে, তবে মনঃশক্তিকে একই সঙ্গে বহু অংশে বিভক্ত করা যাইতে পারে। আমার চিন্তাধারা পরিবর্তন করিতেছি। মন ক্রমশঃ বিকশিত হয়—যোগীগণ এই কথাই বলেন। মনের একটি আবেগ আর একটি আবেগকে জাগ্রত করে, তখন প্রথমটি নষ্ট হইয়া যায়। যদি তুমি ক্রুদ্ধ হইবার পর মুহূর্তে সুখী হইতে পার, তবে পূর্বের ক্রোধ চলিয়া যাইবে। ক্রোধের মধ্য হইতে তোমার পরবর্তী অবস্থার উদ্ভব হইতেছে। মনের এই অবস্থাগুলি সর্বদাই পরিবর্তন-সাপেক্ষ। চিরস্থায়ী সুখ ও চিরস্থায়ী দুঃখ শিশুর স্বপ্নমাত্র। উপনিষদ্‌ বলেন, মানব-জীবনের উদ্দেশ্য দুঃখ নয়, সুখও নয়; কিন্তু যাহা হইতে এই সুখ ও দুঃখের উদ্ভব হইতেছে, তাহাকে বশীভূত করা। একেবারে গোড়াতেই যেন অবস্থাকে আমাদের আয়ত্তে আনিতে হইবে।

মতপার্থক্যের অন্য বিষয়টি এইঃ উপনিষদ্ আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মগুলির—বিশেষতঃ পশুবলির সহিত সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানগুলির নিন্দা করেন। উপনিষদ্ বলেন, এই সব নিতান্তই নিরর্থক। প্রাচীন দার্শনিকদের এক সম্প্রদায় (মীমাংসকেরা) বলেন, কোন বিশেষ ফল পাইতে হইলে একটি বিশেষ সময়ে বিশেষ কোন পশুকে বলি দিতে হইবে। উত্তরে বলা যায়, ‘পশুটির প্রাণ লইবার জন্য তো পাপ হইতে পারে এবং তার জন্য শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।’ ঐ দার্শনিকরা বলেন, এসব বাজে কথা! কোন‍্‍টা পাপ কোন‍্‍টা পুণ্য—তাহা তুমি কি করিয়া জানিলে? তোমার মন বলিতেছে? তোমার মন কি বলে না বলে, তাহাতে অপরের কি আসে যায়? তোমার এ সকল কথার কোন অর্থ নাই—কারণ তুমি শাস্ত্রের বিরুদ্ধে চিন্তা করিতেছ। যদি তোমার মন এক কথা বলে এবং বেদ অন্য কথা বলেন, তবে তোমার মন সংযত করিয়া বেদের নির্দেশ শিরোধার্য কর। যদি বেদ বলেন, নরহত্যা ঠিক, তবে তাহাই ঠিক। যদি তুমি বল, ‘না, আমার বিবেক অন্যরূপ বলে’—এ কথা বলা চলিবে না।

যে মুহূর্তে কোন গ্রন্থকে বিশেষ পবিত্র ও চিরন্তন বলিয়া বিশ্বাস করিলেন, তখন আর উহাকে সন্দেহ করিতে পারিবেন না। আমি বুঝিতে পারি না, এদেশের লোকেরা বাইবেলে পরম বিশ্বাসী হইয়াও কি করিয়া বলে—‘উপদেশগুলি কত সুন্দর, ন্যায়সঙ্গত ও কল্যাণকর!’ কারণ বাইবেল স্বয়ং ঈশ্বরের বাণী—এই বিশ্বাস যদি পাকা হয়, তবে তাহার ভালমন্দ বিচারের অধিকার—আপনাদের মোটেই নাই। যখন বিচার করিতে বসেন, তখন আপনারা ভাবেন—আপনারা বাইবেল অপেক্ষা বড়। সেক্ষেত্রে বাইবেলের প্রয়োজন কি? পুরোহিতেরা বলেন, ‘বাইবেল বা অন্য কাহারও সহিত তুলনা করিতে আমরা নারাজ। তুলনার কোন প্রয়োজন নাই। কারণ, কোন্‌টি প্রামাণিক? এই শেষ কথা। যদি কোন কিছুর সত্যতা সম্বন্ধে তোমার মনে সন্দেহ জাগে, তবে বেদের অনুশাসন অনুযায়ী তাহার যাথার্থ্য নির্ণয় করিয়া লও।’

উপনিষদ্ ইহা বিশ্বাস করেন, তবে সেখানে একটি উচ্চতর মানও আছে। একদিকে যেমন বেদের কর্মকাণ্ড তাহারা অস্বীকার করে না, তেমনি আবার অন্যদিকে তাহাদের দৃঢ় মত এই যে, পশুবলি এবং অপরের অর্থের প্রতি পুরোহিতকুলের লোভ অত্যন্ত অসঙ্গত। মনোবিজ্ঞানের দিক্‌ দিয়া উভয়ের ভিতরে অনেক মিল আছে বটে, তবে আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে দার্শনিক মতানৈক্য বিদ্যমান। আত্মার কি দেহ ও মন আছে? মন কি কতকগুলি ক্রিয়াশীল ও সংজ্ঞাবহ স্নায়ুর সমষ্টি? সকলেই মানিয়া লয়, মনোবিজ্ঞান একটি নিখুঁত বিজ্ঞান; এ বিষয়ে কোন মতভেদ নাই। কিন্তু আত্মা ও ঈশ্বর প্রভৃতি ব্যাপারে দার্শনিক তত্ত্ব লইয়া উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব রহিয়াছে।

পুরোহিতকুল এবং উপনিষদের মধ্যে আর একটি বড় পার্থক্য আছে। উপনিষদ্‌ বলেন—ত্যাগ কর। ত্যাগই সব কিছুর কষ্টিপাথর। সব কিছু ত্যাগ কর। সৃষ্টি প্রক্রিয়া হইতেই সংসারের যাহা কিছু বন্ধন। মন সুস্থ হয় তখনই, যখন সে শান্ত। যে-মুহূর্তে মনকে শান্ত করিতে পারিবে, সেই মুহূর্তেই সত্যকে জানিতে পারিবে। মন যে এত চঞ্চল, তাহার কারণ কি? কল্পনা ও সৃজনী প্রবৃত্তিই ইহার কারণ। সৃষ্টি বন্ধ কর, সত্য জানিতে পারিবে। সৃষ্টির সমস্ত শক্তি বন্ধ হইলেই সত্য জানা যায়।

অন্যদিকে পুরোহিতকুল সৃষ্টির পক্ষপাতী। এমন জীবের কল্পনা কর, যাহার মধ্যে সৃষ্টির কোন ক্রিয়াকলাপ নাই। এরকম অবস্থা চিন্তা করা যায় না। স্থায়ী সমাজ-বিবর্তনের জন্য মানুষকে একটি পরিকল্পনা করিতে হইয়াছিল। এইজন্য (বিবাহে) কঠোর নির্বাচন-প্রথা অবলম্বন করিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অন্ধ ও খঞ্জের বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। ফলে ভারতবর্ষে বিকলাঙ্গ লোকের সংখ্যা পৃথিবীর অন্য যে-কোন দেশ অপেক্ষা কম। মৃগীরোগী এবং পাগলের সংখ্যাও সেখানে কম। ইহার কারণ—প্রত্যক্ষ যৌন-নির্বাচন। পুরোহিতদের বিধান হইল—বিকলাঙ্গেরা সন্ন্যাসী হউক। অপরদিকে উপনিষদ্ বলেনঃ না, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে তাজা ও সুন্দর ফুলই পূজার বেদীতে অর্পণ করা কর্তব্য। আশিষ্ঠ দ্রঢ়িষ্ঠ বলিষ্ঠ মেধাবী ও সুস্থতম ব্যক্তিরাই সত্যলাভের চেষ্টা করিবে।

এই সব মত-পার্থক্য সত্ত্বেও পুরোহিতরা নিজেদের একটি পৃথক্‌ জাতি-গোষ্ঠীতে (ব্রাহ্মণ) পরিণত করিয়াছে, এ কথা আমি আপনাদের আগেই বলিয়াছি। দ্বিতীয় হইল রাজপুরুষের জাতি (ক্ষত্রিয়)। উপনিষদের দর্শন রাজাদের মস্তিষ্ক হইতে প্রসূত, পুরোহিতদের মস্তিষ্ক হইতে নয়। প্রত্যেক ধর্মীয় আন্দোলনের মধ্য দিয়া একটি অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব চলিয়াছে। মানুষ নামক জীবের উপর ধর্মের কিছু প্রভাব আছে বটে, কিন্তু অর্থনীতির দ্বারাই সে পরিচালিত হয়। ব্যষ্টির জীবনের উপর অন্য কিছুর প্রভাব থাকিতে পারে, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে মানুষের ভিতর যখনই কোন অভ্যুত্থান আসিয়াছে, তখনই দেখা গিয়াছে, আর্থিক সম্পর্ক ব্যতীত মানুষ কখনও সাড়া দেয় নাই। আপনি যে ধর্মমত প্রচার করিতেছেন, তাহা সর্বাঙ্গসুন্দর না হইতে পারে, কিন্তু যদি তাহার পশ্চাতে অর্থনৈতিক পটভূমি থাকে এবং কিছু সংখ্যক উৎসাহী সমর্থক ইহার প্রচারের জন্য বদ্ধপরিকর হয়, তবে আপনি একটি গোটা দেশকে আপনার ধর্মমতে আনিতে পারিবেন।

যখনই কোন ধর্মমত সফল হয়, তখন (বুঝিতে হইবে) অবশ্যই তাহার আর্থিক মূল্য আছে। একই ধরনের সহস্র সহস্র সম্প্রদায় ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম করিলেও যে-সম্প্রদায় আর্থিক সমস্যার সমাধান করিতে পারে, তাহাই প্রাধান্য লাভ করিবে। পেটের চিন্তা—অন্নের চিন্তা মানুষের প্রথম। অন্নের ব্যবস্থা প্রথমে, তারপর মস্তিষ্কের। মানুষ যখন হাঁটে, তখন তাহার পেট চলে আগে, মাথা চলে পরে। ইহা কি লক্ষ্য করেন নাই? মস্তিষ্কের অগ্রগতির জন্য এখনও কয়েক যুগ লাগিবে। ৬০ বৎসর হইলে মানুষ সংসার হইতে বিদায় লয়। সমগ্র জীবন একটা ভ্রান্তি। বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ বুঝিবার মত বয়স হইতে না হইতে মৃত্যু আসিয়া উপস্থিত হয়। যতদিন পাকস্থলী সবল ছিল, ততদিন সব ঠিক ছিল। যখন বালসুলভ স্বপ্ন বিলীন হইয়া বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ দেখিবার সময় আসিল, তখন মস্তিষ্কের গতি শুরু হয়; এবং যখন মস্তিষ্কের ক্রিয়া প্রাধান্য লাভ করিল, তখন সংসার হইতে চলিয়া যাইতে হয়। তাই উপনিষদের ধর্মকে জনসাধারণের হৃদয়গ্রাহী করা বড় দুরূহ ব্যাপার। অর্থগত লাভ সেখানে খুব অল্প, কিন্তু পরার্থপরতা সেখানে প্রচুর।

উপনিষদের ধর্ম যদিও প্রভূত রাজশক্তির অধিকারী রাজন্যবর্গের দ্বারা আবিষ্কৃত হইয়াছে, তবু ইহার রাজ্য বিস্তৃতি ছিল না। তাই সংগ্রাম প্রবল হইতে প্রবলতর হইয়াছিল। প্রায় দুই হাজার বছর পরে বৌদ্ধধর্মের বিস্তারের সময় ইহা চূড়ান্ত অবস্থায় উপনীত হয়। বৌদ্ধধর্মের বীজ ছিল এই রাজা ও পুরোহিতের সাধারণ দ্বন্দ্বের মধ্যে। এই প্রতিযোগিতায় ধর্মের অবনতি হয়। একদল এই ধর্মকে ত্যাগ করিতে চাহিল, অন্যদল বৈদিক দেবতা, যজ্ঞ প্রভৃতিকে আঁকড়াইয়া থাকিতে চাহিল। কালক্রমে বৌদ্ধধর্ম জনসাধারণের শৃঙ্খল মোচন করিল। এক মুহূর্তে সকল জাতি ও সম্প্রদায় সমান হইয়া গেল। ধর্মের মহান্ তত্ত্বগুলি ভারতে এখনও বর্তমান, কিন্তু সেগুলি প্রচার করার কাজ এখনও বাকী আছে, অন্যথা সেই তত্ত্বগুলি দ্বারা কোন উপকার হইবে না।

দুইটি কারণে প্রত্যেক দেশেই পুরোহিতগণ গোঁড়া ও প্রাচীনপন্থী হয়। একটি কারণ—তাহাদের জীবিকা, অন্যটি—তাহাদিগকে জনসাধারণের সঙ্গে চলিতে হয়। তাহা ছাড়া পুরোহিতদের মন সবল নয়। যদি জনসাধারণ বলে, ‘দুই হাজার দেবতার কথা প্রচার কর’, পুরোহিতরা তাহাই করিবে। যে জনমণ্ডলী তাহাদের টাকা দেয়, পুরোহিতরা তাহাদের আজ্ঞাবহ ভৃত্যমাত্র, ভগবান্‌ তো টাকা দেন না; কাজেই পুরোহিতদের দোষ দেওয়ার পূর্বে নিজেদেরই দোষ দিন। আপনারা যেরূপ শাসন, ধর্ম ও পুরোহিতকুল পাইবার উপযুক্ত, সেইরূপই পাইবেন। ইহা অপেক্ষা ভাল কিছু পাওয়া আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

এই সংঘর্ষ ভারতবর্ষেও আরম্ভ হইয়াছিল এবং ইহার একটি চূড়ান্ত অবস্থা দেখা গেল গীতাতে। যখন সমগ্র ভারতবর্ষ দুইটি বিদ্যমান দলে বিভক্ত হইবার আশঙ্কা দেখা দিল—তখন এই বিরাট পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। তিনি গীতার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপ এবং পুরোহিত ও জনসাধারণের ধর্মমতের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করেন। আপনারা যীশুখ্রীষ্টকে যেমন শ্রদ্ধা ও পূজা করেন, শ্রীকৃষ্ণকেও তেমনি ভারতবর্ষের লোক শ্রদ্ধা ও পূজা করেন। শুধু যুগের ব্যবধান মাত্র। আপনাদের দেশে ক্রীস‍্‍মাসের মত হিন্দুরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি (জন্মাষ্টমী) পালন করেন। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে। তাঁহার জীবনে বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়াছে; সেগুলির কিছু কিছু যীশুখ্রীষ্টের জীবনীর সহিত মিলিয়া যায়। কারাগারেই শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হইয়াছিল। পিতা শিশুকে লইয়া পলায়ন করেন এবং গোপগোপীদের নিকট তাঁহার পালনের ভার অর্পণ করেন। সেই বৎসরে যত শিশু জন্মিয়াছিল, সকলকেই হত্যা করার আদেশ দেওয়া হইয়াছিল এবং জীবনের শেষভাগে তাঁহাকে অপরের হাতে প্রাণ দিতে হইয়াছিল—ইহাই নিয়তি।

শ্রীকৃষ্ণ বিবাহ করিয়াছিলেন। তাঁহাকে অবলম্বন করিয়া অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। সেগুলি সম্বন্ধে আমরা তত আগ্রহ নাই। অতিরঞ্জন-দোষ হিন্দুদেরও আছে। খ্রীষ্টান মিশনরীরা যদি বাইবেলের একটি গল্প বলে, হিন্দুরা বিশটি গল্প বলিবে। আপনারা যদি বলেন, তিমিমাছ জোনা-কে গলাধঃকরণ করিয়াছিল—হিন্দুরা বলিবেন, তাহাদের কেহ না কেহ একটি হাতীকে গিলিয়াছিল। … বাল্যকাল হইতে আমি শ্রীকৃষ্ণের জীবন সম্পর্কে অনেক কথা শুনিয়াছি। আমি ধরিয়া লইতেছি, শ্রীকৃষ্ণ বলিয়া কেহ একজন ছিলেন এবং গীতা তাঁহার অপূর্ব গ্রন্থ। এ কথা অনস্বীকার্য যে, গল্প বা উপকথাগুলি বিশ্লেষণ করিলে এই ব্যক্তিত্বের সম্বন্ধে একটা ধারণা হয়। উপকথাগুলি অলঙ্কারের কাজ করে। স্বভাবতই সেগুলি যতটা সম্ভব সুশোভন করা হয় এবং আলোচ্য ব্যক্তির চরিত্রের সহিত খাপ খাওয়াইয়া লওয়া হয়। বুদ্ধদেবের কথা ধরা যাক—ত্যাগই কেন্দ্রগত ভাব; হাজার হাজার উপকথা রচিত হইয়াছে এবং প্রত্যেকটিতে ঐ ত্যাগের মাহাত্ম্য ফুটাইয়া তোলা হইয়াছে। লিঙ্কনের মহান্ জীবনের এক-একটি ঘটনা লইয়া বহু গল্প রচিত হইয়াছে। গল্পগুলি বিশ্লেষণ করিলে একটি সাধারণ ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। উহার মধ্যে ঐ ব্যক্তির চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যকে ফুটাইয়া তোলা হইয়াছে। শ্রীকৃষ্ণের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হইল অনাসক্তি। তাঁহার কোন ব্যক্তিগত প্রয়োজন নাই, কোন অভাবও তাঁহার নাই। কর্মের জন্যই তিনি কর্ম করেন। ‘কর্মের জন্যই কর্ম কর। পূজার জন্য পূজা কর। পরোপকার কর—কারণ, পরোপকার মহৎ কাজ; এর বেশী কিছু চাহিও না।’ ইহাই শ্রীকৃষ্ণের চরিত্র। অন্যথা এই উপকথাগুলিকে সেই অনাসক্তির আদর্শের সঙ্গে খাপ খাওয়ান যায় না। গীতা তাঁহার একমাত্র উপদেশ নয়।

আমি যত মানুষের কথা জানি, তাহাদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ সর্বাঙ্গসুন্দর। তাঁহার মধ্যে মস্তিষ্কের উৎকর্ষতা, হৃদয়বত্তা ও কর্মনৈপুণ্য সমভাবে বিকশিত হইয়াছিল। তাঁহার জীবনের প্রতি মুহূর্ত নাগরিক, যোদ্ধা, মন্ত্রী অথবা অন্য কোন দায়িত্বশীল পুরুষের কর্মপ্রবণতায় প্রাণবন্ত। বিদ্যাবত্তা, কবি-প্রতিভা, ভদ্র ব্যবহার—সব দিক্‌ দিয়াই তিনি ছিলেন মহান্। গীতা ও অন্যান্য গ্রন্থে এই সর্বাঙ্গীণ ও বিস্ময়কর কর্মশীলতা এবং মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের অপূর্ব সমন্বয়ের কথা ব্যাখ্যাত হইয়াছে। গীতায় যে হৃদয়বত্তা ও ভাষার মাধুর্য ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহা অপূর্ব ও অনবদ্য। এই মহান্‌ ব্যক্তির প্রচণ্ড কর্মক্ষমতার পরিচয় এখনও দেখা যায়। পাঁচ হাজার বৎসর অতিবাহিত হইয়াছে—আজও কোটি কোটি লোক তাঁহার বাণীতে অনুপ্রাণিত হইতেছে। চিন্তা করুন—আপনারা তাঁহাকে জানুন বা না জানুন—সমগ্র জগতে তাঁহার চরিত্রের প্রভাব কত গভীর! তাঁহার পূর্ণাঙ্গ প্রজ্ঞাকে আমি পরম শ্রদ্ধা করি। কোন প্রকার জটিলতা, কোন প্রকার কুসংস্কার সেই চরিত্রে দৃষ্ট হয় না। জগতের প্রত্যেক বস্তুর একটি নিজস্ব স্থান আছে, এবং তিনি তাহার যোগ্য মর্যাদা দিতে জানিতেন। যাহারা কেবল তর্ক করে এবং বেদের মহিমা সম্বন্ধে সন্দেহ করে, তাহারা সত্যকে জানিতে পারে না; তাহারা ভণ্ড ব্যতীত আর কিছুই নয়। কুসংস্কার এবং অজ্ঞতারও স্থান বেদে আছে। প্রত্যেক বস্তুর যথাযথ স্থান নির্ণয় করাই প্রকৃত রহস্য।

তারপর হৃদয়বত্তা! বুদ্ধদেবেরও পূর্ববর্তী শ্রীকৃষ্ণই সকল সম্প্রদায়ের নিকট ধর্মের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করিয়াছিলেন। মনঃশক্তি এবং প্রচণ্ড কর্মপ্রবণতার কী অপূর্ব বিকাশ! বুদ্ধদেবের কর্মক্ষমতা একটি বিশেষ স্তরে পরিচালিত হইত—উহা আচার্যের স্তর। তিনি স্ত্রী-পুত্র পরিত্যাগ করিলেন, নতুবা আচার্যের কাজ করা সম্ভব নহে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া উপদেশ দিতেছেন! যিনি প্রবল কর্মব্যস্ততার মধ্যে নিজেকে একান্তভাবে শান্ত রাখেন এবং যিনি গভীর শান্তির মধ্যে কর্মপ্রবণতা দেখান, তিনিই শ্রেষ্ঠ যোগী ও জ্ঞানী। যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্রশস্ত্র এই মহাপুরুষ ভ্রূক্ষেপ করেন না। সংগ্রামের মধ্যেও তিনি ধীর স্থিরভাবে জীবন ও মৃত্যুর সমস্যাসমূহ আলোচনা করেন। প্রত্যেক অবতারই তাঁহার উপদেশের জীবন্ত উদাহরণ। নিউ টেষ্টামেণ্টের উপদেশের তাৎপর্য জানিবার জন্য আপনারা কাহারও না কাহারও নিকট যাইয়া থাকেন। তাহার পরিবর্তে নিজেরা উহা বার বার পড়ুন এবং খ্রীষ্টের অপূর্ব জীবনালোকে উহা বুঝিতে চেষ্টা করুন।

মনীষীরা চিন্তা করেন এবং আমরাও চিন্তা করি। কিন্তু তাহার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাদের মন যাহা চিন্তা করে, শরীর তাহা অনুসরণ করে না। আমাদের কার্য ও চিন্তার মধ্যে সামঞ্জস্য নাই। যে শক্তির বলে ‘শব্দ’ বেদ হয়, আমাদের কথায় সে শক্তি নাই। কিন্তু ঋষি বা মনীষীরা যাহা চিন্তা করেন, তাহা অবশ্যই কর্মে পরিণত হয়। যদি তাঁহারা বলেন, ‘আমি ইহা করিব’ তবে তাঁহাদের শরীর সেই কাজ করিবেই। পরিপূর্ণ আজ্ঞাবহতা—ইহাই লক্ষ্য। আপনি এক মুহূর্তে নিজেকে ঈশ্বর কল্পনা করিতে পারেন, কিন্তু আপনি ঈশ্বর হইতে পারেন না—বিপদ এখানেই। মনীষীরা যাহা চিন্তা করেন, তাহাই হন—আমাদের চিন্তাকে কার্যে পরিণত করিতে অনেক সময় প্রয়োজন।

আমরা এতক্ষণ শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁহার সমসাময়িক যুগের কথা আলোচনা করিলাম। পরবর্তী বক্তৃতায় ‘গীতা’ সম্বন্ধে আরও অনেক কথা জানিতে পারিব।