০৭. অজানা দেবতা

অজানা দেবতা

অন্ধকার নিরাশার বিসর্পিল পথে ক্লান্ত পদে
এ নির্মম নিরানন্দ জীবনের ভারনত
চলেছে পথিক।
হৃদয়ের মননের কোন প্রান্ত হতে
কোথাও মেলে না প্রাণে
নিমেষের প্রেরণা-স্পন্দন।
অবশেষে একদা যখন
লুপ্তপ্রায় সীমারেখা
ভালমন্দ সুখদুঃখ জন্মমরণের—
অকস্মাৎ উদ্ভাসিল পুণ্যরজনীতে
অপরূপ জ্যোতিরেখা হৃদয়েতে তার।
কোন্ উৎস হতে এল অচেনা এ আলো—
কিছুই তো জানে না সে।
তবুও জানাল
আলোক-ঈশ্বরে তার প্রাণের প্রণাম।
অজানা আশার বাণী
ব্যাপ্ত হল সমগ্র সত্তায়,
স্বপ্নাতীত মহিমায়
পূর্ণ করে দিল তার সমস্ত ভুবন,
সে ভুবন পার হয়ে আভাসিল আর এক জগৎ।
বলিলেন মৃদু হেসে পণ্ডিতের দল—
‘অন্ধ এ বিশ্বাস।’
সে আলোর দীপ্ত শান্তি অনুভব করি’
বলিল সে নম্র প্রত্যুত্তরে,
‘ধন্য মানি এ অন্ধবিশ্বাস।’

স্বাস্থ্য, শক্তি, সম্পদের সুরামত্ত
আর এক পথিক,
জীবনের ঘূর্ণাবর্তে ছুটে চলে
উন্মাদের মত,
অবশেষে একদা যখন
এ পৃথিবী মনে হয় বিলাস-কানন
খেলার পুতুল যত কীটসম মানুষের দল,
নিয়তচঞ্চল যত বিলাসের বিচ্ছুরিত আলো
দৃষ্টিরে আচ্ছন্ন করে, ইন্দ্রিয় অবশ,
সুখদুঃখ একাকার, অনুভূতিহীন;
প্রমোদমদিরামত্ত মহামূল্য এ দেহচেতনা
শবসম লগ্ন হয়ে থাকে তার দুই বাহুপাশে,
যত সে ছাড়াতে চায়,
তত তার বক্ষ জুড়ে আসে;
উন্মাদ-কল্পনা-ভরে বহুরূপে মৃত্যুরে সে চায়,
ফিরে আসে আরবার মুগ্ধ আকর্ষণে।
তারপর একদিন
দুর্ভাগ্যের দাহ এল নেমে—
হৃতশক্তি, সম্পদবিহীন,
বেদনায়, অশ্রুধারে, মর্মযন্ত্রণায়—
আত্মীয়তা ফিরে পেল সারা নিখিলের।
বন্ধুজন করে পরিহাস।
কৃতজ্ঞ হৃদয় তার করে উচ্চারণঃ
‘ধন্য দুঃখ; ধন্য এ বেদনা।’

সুন্দর সুঠাম দেহ,
শুধু মন তার শক্তিহীন
দুর্বার গভীর কোন আবেগ-সংযমে,
অমোঘ-প্রবৃত্তি-স্রোত
রুদ্ধ করা অসাধ্য তাহার।
সংসারে সবাই তারে—
সদাশয়, ভাল—বলে জানে।
পরম নিশ্চিন্ত ছিল আপনারে নিয়ে।
দূর হতে দেখেছে সে চেয়ে—
সংসার-তরঙ্গসাথে বৃথা যুদ্ধে রত
নরনারী যত।
দেখিতে দেখিতে মন, মক্ষিকার মত
কেবলি ক্লেদাক্ত দেখে সকল সংসার,
সব গ্লানিময়।
তারপর একদা কখন,
সহসা সৌভাগ্যসূর্য দেখা দিল হেসে,
তারি সঙ্গে ঘটে গেল নির্মম পতন।
সেই তার দৃষ্টি-উন্মোচন।
বুঝিল সেঃ নিয়ম ভাঙে না কভু
তরু ও প্রস্তর,
তবু তারা প্রস্তর ও তরু হয়ে থাকে।
নিয়মবন্ধন হতে ঊর্ধ্বে এসে
সংগ্রামসাধনা দিয়ে
ভাগ্যেরে সে করে নেবে জয়—
এ পরম অধিকার মানুষেরই তরে।
চিত্তের জড়তা ঘুচি নবীন জীবন
হল মুক্ত, প্রসারিত—
সংগ্রাম-সমুদ্রপারে যে অনন্ত শান্তি বিরাজিত
তাহারি আলোক-রশ্মি
উদ্ভাসিল জীবনের দিগন্ত-রেখায়।
পশ্চাতে রয়েছে পড়ি’
অতীতের
অকৃতার্থ নিষ্ফল জীবন,
তরু ও প্রস্তর সম চেতনাবিহীন,
আর একদিকে তার স্খলনপতন,
যার লাগি’ বর্জন করেছে তারে সমস্ত সংসার।
সানন্দ-অন্তরে তবু
ধন্য মানি এ অধঃপতন
ঘোষিল সেঃ ‘ধন্য এই পাপ।’