০৬. আত্মা, ঈশ্বর ও ধর্ম

অতীতের সুদীর্ঘ ধারার মধ্য দিয়া শত শত যুগের একটি বাণী আমাদের নিকট ভাসিয়া আসিতেছে—সেই বাণী হিমালয় ও অরণ্যের মুনি-ঋষিদের বাণী; সেই বাণী সেমিটিক জাতিদের নিকটও আবির্ভূত হইয়াছিল, বুদ্ধদেব ও অন্যান্য ধর্মবীরগণের মধ্য দিয়া প্রকাশিত হইয়াছিল; সেই বাণী সেই-সব মানবের নিকট হইতে আসিতেছে, যাঁহারা এমন এক জ্ঞান-জ্যোতিতে উদ্ভাসিত ছিলেন, যাহা এই পৃথিবীর আরম্ভ হইতেই মানুষের সহচররূপে বিদ্যমান ছিল; মানুষ যেখানেই যাক, সেখানেই উহা প্রকাশ পায় এবং সর্বদা মানুষের সঙ্গে সঙ্গে থাকে; সেই বাণী এখনও আমাদের নিকট আসিতেছে। এই বাণী সেই-সব পর্বতনিঃসৃত ক্ষুদ্রকায়া স্রোতস্বিনীর মত, যেগুলি কখনও অদৃশ্য এবং কখনও আবার খরতরবেগে প্রবাহিত হইয়া পরিশেষে একটি বিশাল শক্তিশালী বন্যায় পরিণত হয়। জগতের সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের ঈশ্বরাদিষ্ট ও পবিত্রাত্মা নরনারীর মুখ হইতে যে বাণীসমূহ আমরা পাইতেছি, সেগুলি নিজ নিজ শক্তি সম্মিলিত করিয়া আমাদিগকে ভেরীনিনাদে অতীতের বাণীই শুনাইতেছে। আমাদের লব্ধ প্রথম বাণীঃ তোমাদের এবং সকল ধর্মের শান্তি হউক। ইহা প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাণী নয়, পরন্তু ঐক্যবদ্ধ ধর্মের কথা। আসুন আমরা প্রথমেই এই বাণীর তাৎপর্য আলোচনা করি।

বর্তমান যুগের প্রারম্ভে এইরূপ আশঙ্কা হইয়াছিল যে, ধর্মের ধ্বংস এবার অবশ্যম্ভাবী। বৈজ্ঞানিক গবেষণার তীব্র আঘাতে পুরাতন কুসংস্কারগুলি চীনামাটির বাসনের মত চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যাইতেছিল। যাহারা ধর্মকে কেবল মতবাদ ও অর্থশূন্য অনুষ্ঠান বলিয়া মনে করিত, তাহারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া গেল; ধরিয়া রাখার মত কিছুই তাহারা খুঁজিয়া পাইল না। এক সময়ে ইহা অনিবার্য বলিয়া বোধ হইল যে, জড়বাদ ও অজ্ঞেয়বাদের উত্তাল তরঙ্গ সম্মুখের সকল বস্তুকে দ্রুতবেগে ভাসাইয়া লইয়া যাইবে। তাহাদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করিতে সাহস করিল না। অনেকেই এ বিষয়ে নিরাশ হইল এবং ভাবিল যে, ধর্ম এবার চিরদিনের মত লোপ পাইল। কিন্তু স্রোত আবার ফিরিয়াছে এবং উহার উদ্ধারের উপায় আসিয়াছে।—সেটি কি? সে উপায়টি ধর্মসমূহের তুলনামূলক আলোচনা। বিভিন্ন ধর্মের অনুশীলনে আমরা দেখিতে পাই যে, সেগুলি মূলতঃ এক। বাল্যকালে এই নাস্তিকতার প্রভাব আমার উপরও পড়িয়াছিল এবং এক সময়ে এমন বোধ হইয়াছিল যে, আমাকেও ধর্মের সকল আশা ভরসা ত্যাগ করিতে হইবে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমি খ্রীষ্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্ম অধ্যয়ন করিলাম এবং আশ্চর্য হইলাম, আমাদের ধর্ম যে-সকল মূলতত্ত্ব শিক্ষা দেয়, অন্যান্য ধর্মও অবিকল সেইগুলিই শিক্ষা দেয়। ইহাতে আমার মনে এই প্রকার চিন্তার উদয় হইলঃ সত্য কী? এই জগৎ কি সত্য? উত্তর পাইলাম—হাঁ, সত্য। কেন সত্য?—কারণ আমি ইহা দেখিতেছি। যে-সব মনোহর সুললিত কণ্ঠস্বর ও যন্ত্রসঙ্গীত আমরা এইমাত্র শুনিলাম, সে-সব কি সত্য?—হাঁ সত্য; কারণ আমরা তাহা শুনিয়াছি। আমরা জানি যে, মানুষের একটি শরীর আছে, দুটি চক্ষু ও দুইটি কর্ণ আছে এবং তাহার একটি আধ্যাত্মিক প্রকৃতিও আছে, যাহা আমরা দেখিতে পাই না। এই আধ্যাত্মিক বৃত্তির সাহায্যেই সে বিভিন্ন ধর্মের অনুশীলনের ফলে বুঝিতে পারে যে, ভারতের অরণ্যে ও খ্রীষ্টানদের দেশে যত ধর্মমত প্রচারিত হইয়াছে, সেগুলি মূলতঃ এক। ইহার ফলে আমরা এই সত্যেই উপনীত হই যে, ধর্ম মানব-মনের একটি স্বভাবসিদ্ধ প্রয়োজন। কোন এক ধর্মকে সত্য বলিতে হইলে অপর ধর্মগুলিকেও সত্য বলিয়া মানিতে হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরুন, আমার ছয়টি আঙুল আছে, কিন্তু অন্য কাহারও ঐরূপ নাই; তাহা হইলে আপনারা বেশ বুঝিতে পারেন যে, ইহা অস্বাভাবিক। কেবল একটি ধর্ম সত্য আর অন্য ধর্মগুলি মিথ্যা—এই বিতণ্ডার সমাধানেও ঐ একই যুক্তি প্রদর্শিত হইতে পারে। জগতে মাত্র একটি ধর্ম সত্য বলিলে উহা ছয় আঙুল-বিশিষ্ট হাতের মত অস্বাভাবিকই হইবে। সুতরাং দেখা গেল যে, একটি ধর্ম সত্য হইলে অপরগুলিও অবশ্য সত্য হইবে। গৌণ অংশগুলি সম্বন্ধে পার্থক্য থাকিলেও মূলতঃ সেগুলি সব এক। যদি আমার পাঁচ আঙুল সত্য হয়, তবে তাহা দ্বারা প্রমাণিত হয়—তোমার পাঁচ আঙুলও সত্য।

মানুষ যেখানেই থাকুক, তাহার একটি ধর্মবিশ্বাস থাকিবেই, সে তাহার ধর্মভাবের পরিপুষ্টি করিবেই। জগতের বিভিন্ন ধর্ম আলোচনা করিয়া আর একটি সত্য দেখিতে পাওয়া যায় যে, আত্মা ও ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণার তিনটি বিভিন্ন স্তর আছে। প্রথমতঃ সকল ধর্মই স্বীকার করে, এই নশ্বর শরীর ছাড়া (মানুষের) আর একটি অংশ বা অন্য কিছু আছে, যাহা শরীরের মত পরিবর্তিত হয় না; তাহা নির্বিকার, শাশ্বত ও অমৃত। কিন্তু পরবর্তী কয়েকটি ধর্মের মতে—যদিও ইহা সত্য যে, আমাদের একটা অংশ অমর, তথাপি কোন-না-কোন সময়ে ইহার আরম্ভ হইয়াছে। কিন্তু যাহার আরম্ভ আছে, তাহার নাশ অবশ্য আছে। আমাদের অর্থাৎ আমাদের মূল সত্তার কখনও আরম্ভ হয় নাই, কখনই অন্তও হইবে না। আমাদের সকলের উপরে—এই অনন্ত সত্তারও উপরে ‘ঈশ্বর’-পদবাচ্য আর একজন অনাদি পুরুষ আছেন, যাঁহার অন্ত নাই। লোকে জগতের সৃষ্টি ও মানবের আরম্ভের কথা বলিয়া থাকে, কিন্তু জগতের ‘আরম্ভ’ কথাটির অর্থ শুধু একটি কল্পের আরম্ভ। ইহা দ্বারা কোথাও সমগ্র বিশ্বজগতের আরম্ভ বুঝায় না। সৃষ্টির যে আরম্ভ থাকিতে পারে—ইহা অসম্ভব। আদিকাল বলিয়া কোন কিছুর ধারণা আপনাদের মধ্যে কেহই করিতে পারেন না। যাহার আরম্ভ আছে, তাহার শেষ আছেই। ভগবদ্গীতা বলেনঃ

ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্ ॥

অর্থাৎ পূর্বে যে আমি ছিলাম না, এমন নয়; তুমি যে ছিলে না, এমন নয়; এই নৃপতিগণ যে ছিলেন না, তাহাও নয় এবং আমরা সকলে যে পরে থাকিব না, তাহাও নয়। যেখানেই সৃষ্টির প্রারম্ভের কথার উল্লেখ আছে, সেখানে কল্পারম্ভই বুঝিতে হইবে। দেহের মৃত্যু আছে, কিন্তু আত্মা চির অমর।

আত্মার এই ধারণার সহিত ইহার পূর্ণতা সম্বন্ধে আরও কতকগুলি ধারণা আমরা দেখিতে পাই। আত্মা স্বয়ং পূর্ণ। য়াহুদীদের ধর্মগ্রন্থ এ-কথা স্বীকার করে যে, মানুষ প্রথমে পবিত্র ছিল। মানুষ নিজের কর্মের দ্বারা নিজেকে অশুদ্ধ করিয়াছে, তাহাকে তাহার সেই পুরাতন প্রকৃতি অর্থাৎ পবিত্র স্বভাবকে আবার পাইতে হইবে। কেহ কেহ এই-সকল কথা রূপকাকারে, গল্পচ্ছলে ও প্রতীক-অবলম্বনে বর্ণনা করিয়া থাকেন। কিন্তু আমরা এই কথাগুলিকে বিশ্লেষণ করিলে দেখিতে পাই, উঁহাদের সকলেরই এই এক উপদেশ—আত্মা স্বভাবতঃ পূর্ণ এবং মানুষকে তাহার সেই মৌলিক শুদ্ধ স্বভাব পুনরায় লাভ করিতেই হইবে। কি উপায়ে?—ঈশ্বরানুভূতির দ্বারা; ঠিক যেমন য়াহুদীদের বাইবেল বলে, ‘ঈশ্বরের পুত্রের মধ্য দিয়া না হইলে কেহই তাঁহাকে দেখিতে পাইবে না।’ ইহা হইতে কি বুঝা যায়? ঈশ্বরদর্শনই সকল মানব-জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। পিতার সহিত এক হইবার পূর্বে পুত্রত্ব অবশ্য আসিবে। মনে রাখিতে হইবে, মানুষ তাহার নিজ কর্মদোষে তাহার শুদ্ধ ভাব হারাইয়াছে। আমরা যে কষ্ট পাই, তাহা আমাদের নিজেদের কর্মফলে। ইহার জন্য ভগবান্ দোষী নন। এই সব ধারণার সহিত পুনর্জন্মবাদের সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য। পাশ্চাত্যগণের হস্তে অঙ্গহানি হওয়ার পূর্বে এই মতবাদটি সর্বজনীন ছিল।

আপনাদের মধ্যে কেহ কেহ পুনর্জন্মবাদ সম্বন্ধে শুনিয়াছেন, কিন্তু ইহাকে স্বীকার করেন নাই। ‘মানবাত্মা অনাদি অনন্ত’—এই অপর মতবাদটির সহিত জন্মান্তরবাদের ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে চলিয়া আসিতেছে। যাহা কোনখানে আসিয়া শেষ হয়, তাহা অনাদি হইতে পারে না এবং যাহা কোন স্থান হইতে আরম্ভ হয়, তাহাও অনন্ত হইতে পারে না। মানবাত্মার উৎপত্তিরূপ ভয়াবহ অসম্ভব ব্যাপার আমরা বিশ্বাস করিতে পারি না। জন্মান্তরবাদে আত্মার স্বাধীনতার কথা বিঘোষিত হয়। মনে করুন, ইহা সুনিশ্চিতরূপে স্বীকৃত হইল যে, আদি বলিয়া একটা জিনিষ আছে। তাহা হইলে মানুষের মধ্যে যত অপবিত্রতা আছে, তাহার দায়িত্ব ভগবানের উপর আসিয়া পড়ে। অসীম করূণাময় জগৎ-পিতা তাহা হইলে সংসারের সমুদয় পাপের জন্য দায়ী! পাপ যদি এইভাবেই আসিয়া থাকে, তাহা হইলে একজন অন্যের অপেক্ষা অধিক দুঃখ ভোগ করিবে কেন? যদি অসীম করুণাময় ঈশ্বরের নিকট হইতেই যাহা কিছু সব আসিয়া থাকে, তবে এত পক্ষপাত কেন? কেনই বা লক্ষ লক্ষ লোক পদদলিত হয়? দুর্ভিক্ষ-সৃষ্টির জন্য যাহারা দায়ী নয়, তাহারা কেন অনাহারে মরে? ইহার জন্য দায়ী কে? ইহাতে মানুষের কোন হাত না থাকিলে ভগবানকেই নিশ্চিতরূপে দায়ী করিতে হয়। সুতরাং ইহার উৎকৃষ্টতর ব্যাখ্যা এই যে, কাহারও ভাগ্যে যে-সকল দুঃখভোগ হয়, তাহার জন্য সে-ই দায়ী। কোন চক্রকে যদি আমি গতিশীল করি, তাহার ফলের জন্য আমিই দায়ী এবং আমি যখন আমার দুঃখ উৎপন্ন করিতে পারি, তখন তাহার নিবৃত্তিও আমিই করিতে পারি। অতএব এই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, আমরা স্বাধীন। অদৃষ্ট বলিয়া কোন কিছু নাই। আমাদিগকে বাধ্য করিবার কিছুই নাই। আমরা নিজেরা যাহা করিয়াছি, আমরা তাহার নিবৃত্তিও করিতে পারি।

এই মতবাদের সম্পর্কে একটি যুক্তি আমি দিতেছি; ইহা কিছু জটিল বলিয়া আপনা-দিগকে একটু ধৈর্য অবলম্বনপূর্বক শুনিতে অনুরোধ করি। অভিজ্ঞতা হইতেই আমরা সর্বপ্রকার জ্ঞান লাভ করিয়া থাকি—ইহাই একমাত্র উপায়। যাহাকে আমরা অভিজ্ঞতা বলি, তাহা আমাদের চিত্তের জ্ঞানভূমিতে ঘটিয়া থাকে। উদাহরণস্বরূপ দেখুন—একটি লোক পিয়ানো বাজাইতেছে, সে জ্ঞাতসারে প্রত্যেক সুরের চাবির উপর তাহার প্রতিটি আঙুল রাখিতেছে। এই প্রক্রিয়াটি সে বার বার করিতে থাকে, যতক্ষণ না ঐ অঙ্গুলি-সঞ্চালন ব্যাপারটি অভ্যাসে পরিণত হয়। পরে সে প্রত্যেক চাবির দিকে বিশেষ দৃষ্টি না দিয়াও একটি সুর বাজাইতে পারে। সেইরূপে আমাদের নিজেদের সম্বন্ধেও আমরা দেখিতে পাই যে, অতীতে আমরা সজ্ঞানে যে-সব কাজ করিয়াছি, তাহারই ফলে আমাদের বর্তমান সংস্কারসমূহ রচিত হইয়াছে। প্রত্যেক শিশু কতকগুলি সংস্কার লইয়া জন্মায়। সেগুলি কোথা হইতে আসিল? জন্ম হইতে কোন শিশু একেবারে সংস্কারশূন্য মন লইয়া আসে না, অর্থাৎ তাহার মন লেখাজোখাহীন সাদা কাগজের মত থাকে না। পূর্ব হইতেই সে-কাগজের উপর লেখা হইয়া গিয়াছে। প্রাচীন গ্রীস ও মিশরের দার্শনিকগণ বলেন, কোন শিশু শূন্য মন লইয়া জন্মায় না। শিশুমাত্রই অতীতে সজ্ঞানকৃত শত শত কর্মের সংস্কার লইয়া জগতে আসে। এগুলি সে এ-জন্মে অর্জন করে নাই এবং আমরা স্বীকার করিতে বাধ্য যে, সেগুলি সে পূর্ব পূর্ব জন্মে অর্জন করিয়াছিল। ঘোরতর জড়বাদীকেও স্বীকার করিতে হইয়াছে যে, এই সংস্কারসমূহ পূর্ব পূর্ব জন্মের কর্মসমূহের ফলে উৎপন্ন হয়। তাঁহারা কেবল এইটুকু বেশী বলেন, উহা বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হইয়া থাকে; আমাদের পিতা-মাতা, পিতামহ, পিতামহী, প্রপিতামহ, প্রপিতামহীগণ বংশানুক্রমিক নিয়মানুসারে আমাদের মধ্যে বাস করিতেছেন। কেবল বংশপরম্পরা স্বীকার করিলেই যদি এ-সকল বিষয়ের ব্যাখ্যা হইয়া যায়, তাহা হইলে আর আত্মায় বিশ্বাস করিবার কোনই প্রয়োজন নাই। কারণ শরীর-অবলম্বনেই আজকাল সব ব্যাখ্যা হইতে পারে। জড়বাদ ও অধ্যাত্মবাদের বিভিন্ন বিচার ও আলোচনার খুঁটিনাটির মধ্যে যাইবার এখন আমাদের প্রয়োজন নাই।—যাঁহারা ব্যষ্টি-আত্মায় বিশ্বাস করেন, তাঁহাদের জন্য এতদূর পর্যন্ত অর্থ বেশ পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে।

আমরা দেখিয়াছি যে, কোন যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হইলে আমাদিগকে অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে, আমাদের পূর্বজন্ম ছিল। পুরাতন ও আধুনিক বিখ্যাত দার্শনিক ও সাধুমহাপুরুষদের ইহাই বিশ্বাস। য়াহুদীরাও এরূপ মত বিশ্বাস করিত। ভগবান্ যীশুও ইহাতে বিশ্বাসী ছিলেন। বাইবেলে তিনি বলিতেছেন, ‘আব্রাহামের পূর্বেও আমি বর্তমান ছিলাম।’ এবং অন্যত্র পাওয়া যায়—‘ইনিই সেই ইলিয়াস, যাঁহার আগমনের কথা ছিল।’

যে বিভিন্ন ধর্মসমূহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অবস্থা ও আবেষ্টনীর মধ্যে উদ্ভূত হইয়াছিল, সেগুলির আদি উৎপত্তিস্থল এশিয়া মহাদেশ এবং এশিয়াবাসীরাই সেগুলি বেশ ভালরূপে বুঝিতে পারে। ঐ ধর্মসমূহ যখন উৎপত্তিস্থলের বাহিরে প্রচারিত হইল, তখন সেগুলি অনেক ভ্রান্ত মতের সহিত মিশ্রিত হইয়া পড়িল। খ্রীষ্টান ধর্মের অতি গভীর ও উদার-ভাব ইওরোপ কখনও ধরিতে পারে নাই। কারণ বাইবেল-প্রণেতাগণের ব্যবহৃত ভাব, চিন্তাধারা ও রূপকসমূহের সহিত তাহারা সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। ম্যাডোনার প্রতিকৃতিটিকে উদাহরণস্বরূপ ধরুন। প্রত্যেক শিল্পী ম্যাডোনাকে স্বীয় হৃদয়গত পূর্বধারণানুযায়ী চিত্রিত করিয়াছেন। আমি যীশুখ্রীষ্টের শেষ নৈশভোজনের শত শত ছবি দেখিয়াছি; প্রত্যেকটিতে তাঁহাকে একটি টেবিলে খাইতে বসান হইয়াছে, কিন্তু তিনি কখনও টেবিলে খাইতে বসিতেন না। তিনি সকলের সঙ্গে আসনপিঁড়ি হইয়া বসিতেন, আর একটি বাটিতে রুটি ডুবাইয়া উহা খাইতেন। আপনারা যে রুটি এখন খান, উহা তাহার মত নয়। এক জাতির পক্ষে অপর জাতির বহু শতাব্দী যাবৎ অপরিচিত প্রথা-সকল বুঝিতে পারা বড় কঠিন। গ্রীক, রোমান ও অন্যান্য জাতির দ্বারা সংসাধিত পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের পর য়াহুদী প্রথাসমূহ বুঝিতে পারা ইওরোপবাসীদের নিকট কতই না শক্ত ব্যাপার! যে-সকল অলৌকিক ব্যাপার ও পৌরাণিক আখ্যায়িকা দ্বারা যীশুর ধর্ম পরিবৃত রহিয়াছে, সেগুলির মধ্য হইতে লোকে যে ঐ সুন্দর ধর্মের অতি সামান্যমাত্র ধর্ম হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছে এবং উহাকে কালে একটি দোকানদারের ধর্মে পরিণত করিয়াছে, তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই।

এখন আসল কথায় আসা যাক। আমরা দেখিলাম—সকল ধর্মই আত্মার অমরত্বের কথা বলে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইহাও শিক্ষা দেয় যে, আত্মার পূর্ব জ্যোতি হ্রাস পাইয়াছে এবং ঈশ্বরানুভূতি দ্বারা উহার সেই আদি বিশুদ্ধ স্বভাবের পুনরুদ্ধার করিতে হইবে। এখন এই-সকল ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে ঈশ্বরের ধারণা কিরূপ? সর্বপ্রথমে ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা অতি অস্পষ্টই ছিল। অতি প্রাচীন জাতিরা বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসনা করিত—সূর্য, পৃথিবী, অগ্নি, জল (বরুণ) ইত্যাদি। প্রাচীন য়াহুদী ধর্মে আমরা দেখিতে পাই, এইরূপ অসংখ্য দেবতা নৃশংসভাবে পরস্পর যুদ্ধ করিতেছেন। তারপর পাই ইলোহিম দেবতাকে, যাঁহাকে য়াহুদী ও ব্যাবিলনবাসী উভয়েই পূজা করিত। পরে ইহাও দেখিতে পাওয়া যায় যে, একজন ভগবানকে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানা হইতেছে, কিন্তু বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন ধারণানুযায়ী ঈশ্বরের ধারণাও বিভিন্ন ছিল। প্রত্যেকেই তাহাদের দেবতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া দাবী করিত এবং যুদ্ধ করিয়া তাহা প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিত। তাহাদের মধ্যে যে জাতি যুদ্ধে শ্রেষ্ঠ হইত, সে ঐ ভাবেই নিজ দেবতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করিত। সেই-সব জাতি প্রায়শঃ অসভ্য ছিল। কিন্তু ক্রমশঃ উচ্চতর ধারণাসমূহ প্রাচীন ধারণার স্থান অধিকার করিল। এখন সেই-সব পুরাতন ধারণা আর নাই, যেটুকু বা আছে, তাহা অসার বলিয়া পরিত্যক্ত হইতেছে। পূর্বোক্ত সকল ধর্মই শত শত বর্ষের ক্রমবিকাশের ফল, কোনটিই আকাশ হইতে পড়ে নাই। প্রত্যেককে একটু একটু করিয়া অগ্রসর হইতে হইয়াছিল। তারপর একেশ্বরবাদের ধারণা আসিল, ঐ মতে ঈশ্বর এক এবং তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান্, তিনি বিশ্বের বাহিরে স্বর্গে বাস করেন। তিনি প্রাচীন উদ্ভাবকগণের স্থূলবুদ্ধি অনুযায়ী এইরূপেই বর্ণিত হইলেন, যথাঃ ‘তাঁহার দক্ষিণ ও বাম পার্শ্বদ্বয় আছে, তাঁহার হস্তে একটি পাখী আছে’—ইত্যাদি। কিন্তু একটি বিষয়ে আমরা স্পষ্ট দেখিতে পাই যে, গোষ্ঠী-দেবতারা চিরকালের জন্য লুপ্ত হইয়াছেন এবং তাঁহাদের স্থানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক অদ্বিতীয় ঈশ্বর স্বীকৃত হইয়াছেন। তিনি সর্বদেবেশ্বর। এই স্তরেও তিনি বিশ্বাতীত, তিনি দুরভিগম্য, কেহ তাঁহার নিকটে যাইতে পারে না। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ধারণাটিও পরিবর্তিত হইয়া গেল এবং ঠিক তার পরের স্তরে আমরা দেখিতে পাই এমন এক ঈশ্বর, যিনি সর্বত্র ওতপ্রোত রহিয়াছেন।

নিউ টেষ্টামেণ্টে আছে, ‘হে আমাদের স্বর্গবাসী পিতা’; এখানেও এক ভগবানের কথা, যিনি মনুষ্য হইতে দূরে স্বর্গে বাস করেন। আমরা পৃথিবীতে বাস করিতেছি এবং তিনি স্বর্গে বাস করিতেছেন। আরও অগ্রসর হইয়া আমরা এরূপ শিক্ষা দেখিতে পাই যে, ঈশ্বর চরাচর প্রকৃতিতে ওতপ্রোতভাবে আছেন। তিনি যে কেবল স্বর্গের ঈশ্বর তাহা নয়, তিনি পৃথিবীরও ঈশ্বর। তিনি আমাদের অন্তর্যামী ভগবান্। হিন্দু দর্শনশাস্ত্রেরও একটি স্তরে ভগবানকে ঠিক এইভাবেই আমাদের অতি নিকটবর্তী বলা হইয়াছে। হিন্দু দর্শন এই পর্যন্ত গিয়া শেষ হইয়া যায় নাই; ইহার পরেও অদ্বৈতের একটি স্তর আছে। এই অবস্থায় মানুষ উপলব্ধি করিতে পারে, যে ঈশ্বরকে—যে ভগবানকে সে এতদিন উপাসনা করিয়া আসিতেছে, তিনি কেবলমাত্র স্বর্গ ও পৃথিবীস্থ পিতা নন, পরন্তু ‘আমি ও আমার পিতা এক’; আত্মস্থ হইয়া যে ইহা উপলব্ধি করে, সে স্বয়ং ঈশ্বর; কেবল প্রভেদ এই যে, সে তাঁহার একটি নিম্নতর প্রকাশ। আমার মধ্যে যাহা কিছু যথার্থ বস্তু, তাহাই তিনি এবং তাঁহার মধ্যে যাহা সত্য, তাহাই আমি। এইরূপেই ঈশ্বর ও মানবের মধ্যবর্তী পার্থক্য দূরীভূত হয়। এই প্রকারে আমরা বুঝিতে পারিলাম, কিরূপে ঈশ্বরকে জানিলে স্বর্গরাজ্য আমাদের অন্তরে আবির্ভূত হয়।

প্রথম অর্থাৎ দ্বৈতাবস্থায় মানুষ বোধ করে, সে জন, জেমস্ বা টম ইত্যাদি নামধেয় একটি ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আত্মা এবং সে বলে, সে অনন্তকাল ধরিয়া ঐ জন, জেমস্ ও টমই থাকিয়া যাইবে, কখনই অন্য কিছু হইবে না। কোন খুনী আসামী যদি বলে, ‘আমি চিরকাল খুনীই থাকিয়া যাইব’, ইহাও যেন ঠিক সেইরূপ বলা হইল। কিন্তু কালের পরিবর্তনে টম অদৃশ্য হইয়া সেই খাঁটি আদি মানব আদমেই ফিরিয়া যায়।

পবিত্রাত্মারাই ধন্য, কারণ তাঁহারাই ঈশ্বরকে দর্শন করিবেন। আমরা কি ঈশ্বরকে দর্শন করিতে পারি? অবশ্যই পারি না। আমরা কি ঈশ্বরকে জানিতে পারি? নিশ্চয়ই নয়। ঈশ্বর যদি জ্ঞাতই হন, তাহা হইলে তিনি আর ঈশ্বরই থাকিবেন না। জানা মানেই সীমাবদ্ধ করা। কিন্তু ‘আমি ও আমার পিতা এক।’ আত্মাতেই আমি আমার বাস্তব পরিচয় পাই। কোন কোন ধর্মে এই-সকল ভাব প্রকাশিত হইয়াছে। কোন কোন ধর্মে ইহার ইঙ্গিত-মাত্র আছে। আবার কোনটিতে ইহা একেবারে বর্জিত হইয়াছে। খ্রীষ্টের ধর্ম এখন এদেশে খুব কম লোকের বোধগম্য; আমাকে ক্ষমা করিবেন—আমি বলিতে চাই, তাঁহার উপদেশ এদেশে কোনকালেই উত্তমরূপে বোধগম্য হয় নাই।

পবিত্রতা ও পূর্ণতাপ্রাপ্তির জন্য ক্রমোন্নতির বিভিন্ন সোপানের সবগুলিই অত্যাবশ্যক। ধর্মের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি মূলে একই রূপ ধারণা বা ভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত। যীশু বলিতেছেনঃ ‘স্বর্গরাজ্য তোমাদের অন্তরে বিদ্যমান’, আবার বলিতেছেন, ‘আমাদের স্বর্গস্থ পিতা।’ আপনারা কিরূপে এই উপদেশ দুইটির সামঞ্জস্য করিবেন? কেবল নিম্নোক্তরূপে ইহার সামঞ্জস্য করিতে পারেন। তিনি অশিক্ষিত জনসাধারণের নিকট অর্থাৎ ধর্মবিষয়ে অজ্ঞ লোকদের শেষোক্ত উপদেশ দিয়াছেন। তাহাদিগকে তাহাদের ভাষাতেই উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সাধারণ লোক চায় কতগুলি সহজবোধ্য ধারণা—এমন কিছু, যাহা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করা যায়। কেহ হয়তো জগতে শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হইতে পারেন, কিন্তু তথাপি ধর্ম-বিষয়ে তিনি হয়তো শিশুমাত্র। মানব যখন উচ্চ আধ্যাত্মিক অবস্থা লাভ করে, তখন বুঝিতে পারে যে, স্বর্গরাজ্য তাঁহার অন্তরেই রহিয়াছে। তাহাই যথার্থ মনোরাজ্য—স্বর্গরাজ্য। এইরূপে আমরা দেখিতে পাই যে, প্রত্যেক ধর্মে যে-সকল আপাতবিরোধ ও জটিলতা প্রতীত হয়, তাহা শুধু তাহার ক্রমোন্নতির বিভিন্ন স্তরের সূচনা করে। সেই হেতু ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে কাহাকেও নিন্দা করিবার অধিকার আমাদের নাই। ধর্মের ক্রমবিকাশের পথে এমন সব স্তর আছে, যাহাতে মূর্তি ও প্রতীক আবশ্যক হইয়া থাকে। জীব ঐ অবস্থায় ঐরূপ ভাষা বুঝিতেই সমর্থ।

আর একটি কথা আপনাদিগকে জানাইতে চাই—ধর্ম-অর্থে কোন মন-গড়া মত বা সিদ্ধান্ত নয়। আপনারা কি অধ্যয়ন করেন অথবা কি মতবাদ বিশ্বাস করেন, তাহাই প্রধান বিচার্য বিষয় নয়, বরং আপনি কি উপলব্ধি করেন, তাহাই জ্ঞাতব্য। ‘পবিত্রাত্মারাই ধন্য, কারণ তাঁহাদের ঈশ্বর-দর্শন হইবে।’—ঠিক কথা, এই জীবনেই দর্শন হইবে; আর ইহাই তো মুক্তি। এমন সম্প্রদায় আছে, যাহাদের মতে শাস্ত্রবাক্য জপ করিলেই মুক্তি পাওয়া যাইবে। কিন্তু কোন মহাপুরুষ এরূপ শিক্ষা দেন নাই যে, বাহ্য আচার-অনুষ্ঠানগুলি মুক্তিলাভের পক্ষে অত্যাবশ্যক। মুক্ত হওয়ার শক্তি আমাদের মধ্যেই আছে। আমরা ব্রহ্মেই অবস্থিত এবং ব্রহ্মেরই মধ্যে আমাদের সব ক্রিয়াদি চলিতেছে।

মতবাদ ও সম্প্রদায় প্রভৃতির প্রয়োজন আছে, কিন্তু সে-সব শিশুদের জন্য। উহাদের প্রয়োজন সাময়িক। শাস্ত্র কখনও আধ্যাত্মিকতার জন্ম দেন নাই, বরং আধ্যাত্মিকতাই শাস্ত্র সৃষ্টি করিয়াছে—এ-কথা যেন আমরা না ভুলি। এ-পর্যন্ত কোন ধর্মপুস্তক ঈশ্বরকে সৃষ্টি করিতে পারে নাই, কিন্তু ঈশ্বরই সকল উচ্চতম শাস্ত্রের উদ্দীপক। আর এ-পর্যন্ত কোন ধর্মপুস্তক আত্মাকে সৃষ্টি করে নাই—এ-কথাও যেন ভুলিয়া না যাই। সকল ধর্মের শেষ লক্ষ্য—আত্মাতেই ঈশ্বর দর্শন করা। ইহাই একমাত্র সর্বজনীন ধর্ম। ধর্মমতসমূহের মধ্যে সর্বজনীন বলিয়া যদি কিছু থাকে, তাহা হইলে এই ঈশ্বরানুভূতিকে আমি এখানে উহার স্থলাভিষিক্ত করিতে চাই। আদর্শ ও রীতিনীতি ভিন্ন হইতে পারে, কিন্তু এই ঈশ্বরানুভূতিই কেন্দ্র-বিন্দুস্বরূপ। সহস্র ব্যাসার্ধ থাকিতে পারে, কিন্তু উহারা এক কেন্দ্রে মিলিত হয় এবং উহাই ঈশ্বরদর্শন; ইহা এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের অতীত বস্তু—ইহা চিরকাল পান, ভোজন, বৃথা বাক্যব্যয় এবং এই ছায়াবৎ মিথ্যা ও স্বার্থপূর্ণ জগতের বাহিরে। এই সমুদয় গ্রন্থ, ধর্মবিশ্বাস ও জগতের সকল প্রকারের অসার আড়ম্বরের ঊর্ধ্বে ঐ এক বস্তু রহিয়াছে, আর উহাই হইল তোমার অন্তরে ঈশ্বরানুভূতি। একজন লোক পৃথিবীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মতবাদে বিশ্বাসী হইতে পারে, এ-পর্যন্ত যত প্রকার ধর্মপুস্তক প্রণীত হইয়াছে, তাহা সব স্মরণ রাখিতে পারে, এবং পৃথিবীতে সকল নদীর পূতবারিতে নিজেকে অভিষিক্ত করিতে পারে, কিন্তু যদি তাহার ঈশ্বরানুভূতি না হয়, তবে তাহাকে আমি ঘোর নাস্তিক বলিয়াই গণ্য করিব। অপর একজন যদি কখনও কোন গীর্জা বা মসজিদে প্রবেশ না করিয়া থাকেন, কোন ধর্মানুষ্ঠান না করিয়া থাকেন, অথচ অন্তরে ঈশ্বরকে অনুভব করিয়া থাকেন এবং তদ্দ্বারা এই জগতের অসার আড়ম্বরের ঊর্ধ্বে উত্থিত হইয়া থাকেন, তবে তিনিই মহাত্মা, তিনিই সাধু—বা যে-কোন নামে ইচ্ছা তাঁহাকে অভিহিত করিতে পার। যখন দেখিবে—কেহ বলিতেছে, ‘কেবলমাত্র আমিই ঠিক, আমার সম্প্রদায়ই যথার্থ পথ ধরিয়াছে এবং অপর সকলে ভুল করিতেছে’, তখন জানিবে তাহারই সব ভুল। সে জানে না যে, অপর মতসমূহের প্রামাণ্যের উপর তাহার মতের সত্যতা নির্ভর করিতেছে। সমুদয় মানবজাতির প্রতি প্রেম ও সেবাই ঠিক ঠিক ধার্মিকতার প্রমাণ। লোকে ভাবের উচ্ছ্বাসে যে বলিয়া থাকে, ‘সকল মানুষই আমার ভাই’, আমি তাহা লক্ষ্য করিয়া এ-কথা বলিতেছি না; কিন্তু ইহাই বলিতে চাই যে, সমস্ত মানবজীবনের একত্বানুভূতি হওয়া আবশ্যক। সকল সম্প্রদায় ও ধর্মবিশ্বাসই ততক্ষণ অতি সুন্দর, এবং আমি সেগুলিকে আমার বলিতে স্বীকার করিতে রাজী আছি, যতক্ষণ তাহারা অপরকে অস্বীকার না করে, যতক্ষণ তাহারা সকল মানবসমাজকে যথার্থ ধর্মের দিকেই পরিচালিত করিতেছে। আমি আরও বলিতে চাই যে, কোন সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করা ভাল, কিন্তু উহারই গণ্ডীর মধ্যে মরা ভাল নয়। শিশু হইয়া জন্মগ্রহণ করা ভাল বটে, কিন্তু আমরণ শিশু থাকিয়া যাওয়া ভাল নয়। ধর্মসম্প্রদায়, আচার-অনুষ্ঠান, প্রতীকাদি শিশুদের জন্য ভাল, কিন্তু শিশু যখন বয়ঃপ্রাপ্ত হইবে, তখনই তাহাকে হয় ঐ গণ্ডিসমূহের বা নিজের শিশুত্বের সম্পূর্ণ বাহিরে চলিয়া যাইতে হইবে। চিরকাল শিশু থাকা আমাদের কোনক্রমেই ভাল নয়। ইহা যেন বিভিন্ন বয়সের ও আকারের শরীরে একটি মাপের জামা পরাইবার চেষ্টার মত। আমি জগতে সম্প্রদায় থাকার নিন্দা করিতেছি না। ঈশ্বর করুন—আরও দুই-কোটি সম্প্রদায় হউক, তাহা হইলে পছন্দমত আপন আপন উপযোগী ধর্মমত নির্বাচনের অধিক সুবিধা থাকিবে। কিন্তু একটি-মাত্র ধর্মকে যখন কেহ সকলের পক্ষে খাটাইতে চায়, তখনই আমার আপত্তি। যদিও সকল ধর্ম পরমার্থতঃ এক, তথাপি বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন অবস্থায় সঞ্জাত বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান থাকিবেই। আমাদের প্রত্যেকেরই একটি ব্যক্তিগত ধর্ম, অর্থাৎ বাহ্য প্রকাশের দৃষ্টিতে একটি নিজস্ব ধর্ম থাকা আবশ্যক।

বহু বৎসর পূর্বে আমি আমার জন্মভূমিতে অতীব শুদ্ধস্বভাব এক সাধু মহাত্মাকে দর্শন করিতে গিয়াছিলাম। আমরা আমাদের স্বয়ম্ভু বেদ, আপনাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল, কোরান এবং সকল প্রকার স্বপ্রকাশ ধর্মগ্রন্থ সম্বন্ধে আলোচনা করিলাম। আমাদের আলোচনার শেষে সেই সাধুটি আমাকে টেবিল হইতে একখানি পুস্তক আনিতে আজ্ঞা করিলেন। এই পুস্তকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সেই বৎসরের বর্ষণ-ফলাফলের উল্লেখ ছিল। সাধুটি আমাকে উহা পাঠ করিতে বলিলেন এবং আমি উহা হইতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণটি তাঁহাকে পড়িয়া শুনাইলাম। তখন তিনি বলিলেন—‘এখন তুমি পুস্তকটি একবার নিঙড়াইয়া দেখ তো!’ তাঁহার কথামত আমি ঐরূপ করিলাম। তিনি বলিলেন—‘কই বৎস! একফোঁটা জলও যে পড়িতেছে না! যতক্ষণ পর্যন্ত না জল বাহির হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত উহা পুস্তকমাত্র; সেইরূপ যতদিন পর্যন্ত তোমার ধর্ম তোমাকে ঈশ্বর উপলব্ধি না করায়, ততদিন উহা বৃথা। যিনি ধর্মের জন্য কেবল গ্রন্থ পাঠ করেন, তাঁহার অবস্থা ঠিক যেন একটি গর্দভের মত, যাহার পিঠে চিনির বোঝা আছে, কিন্তু সে উহার মিষ্টত্বের কোন খবর রাখে না।’

মানুষকে কি এই উপদেশ দেওয়া উচিত যে, সে হাঁটু গাড়িয়া কাঁদিতে বসুক আর বলুক, ‘আমি অতি হতভাগ্য ও পাপী?’ না, তাহা না করিয়া বরং তাহার দেবত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া উচিত। আমি একটি গল্প বলিতেছি। শিকার-অন্বেষণে আসিয়া এক সিংহী একপাল মেষ আক্রমণ করিল। শিকার ধরিবার জন্য লাফ দিতে গিয়া সে একটি শাবক প্রসব করিয়া সেখানেই মৃত্যুমুখে পতিত হইল। সিংহশাবকটি মেষপালের সহিত বর্ধিত হইতে লাগিল। সে ঘাস খাইত এবং মেষের মত ডাকিত। সে মোটেই জানিত না যে, সে সিংহ। একদিন এক সিংহ সবিস্ময়ে দেখিল যে, মেষপালের মধ্যে একটি প্রকাণ্ড সিংহ ঘাস খাইতেছে এবং মেষের মত ডাকিতেছে। ঐ সিংহকে দেখিয়া মেষের পাল এবং সেই সঙ্গে ঐ সিংহটিও পলায়ন করিল। কিন্তু সিংহটি সুযোগ খুঁজিতে লাগিল, এবং একদিন মেষ-সিংহটিকে নিদ্রিত দেখিয়া তাহাকে জাগাইয়া বলিল—‘তুমি সিংহ।’ সে বলিল, ‘না’, এই বলিয়া মেষের মত ডাকিতে লাগিল। কিন্তু আগন্তুক সিংহটি তাহাকে একটি হ্রদের ধারে লইয়া গিয়া জলের মধ্যে তাহাদের নিজ নিজ প্রতিবিম্ব দেখাইয়া বলিল, ‘দেখ তো, তোমার আকৃতি আমার মত কিনা!’ সে তাহার প্রতিবিম্ব দেখিয়া স্বীকার করিল যে, তাহার আকৃতি সিংহের মত। তারপর সিংহটি গর্জন করিয়া দেখাইল এবং তাহাকেও সেইরূপ করিতে বলিল। মেষ-সিংহটিও সেইরূপ চেষ্টা করিতে লাগিল এবং শীঘ্রই তাহার মত গম্ভীর গর্জন করিতে পারিল। এখন সে আর মেষ নয়, সিংহ। বন্ধুগণ, আমি আপনাদের সকলকে বলিতে চাই যে, আপনারা সকলে সিংহের মত পরাক্রমশালী। যদি আপনাদের গৃহ অন্ধকারাবৃত থাকে, তাহা হইলে কি আপনারা বুক চাপড়াইয়া ‘অন্ধকার অন্ধকার’ বলিয়া কাঁদিতে থাকিবেন? তাহা নয়। আলো পাইবার একমাত্র উপায় আলো জ্বালা, তবেই অন্ধকার চলিয়া যাইবে। ঊর্ধ্বের আলো পাইবার একমাত্র উপায় অন্তরের মধ্যে আধ্যাত্মিক আলো জ্বালা। তবেই পাপ ও অপবিত্রতারূপ অন্ধকার দূরীভূত হইবে। তোমরা উচ্চ প্রকৃতির বিষয় চিন্তা কর; হীনতার কথা ভাবিও না।