০৫. বিশ্বজনীন ধর্মলাভের উপায়

[১৯০০ খ্রীঃ ২৮ জানুআরী ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনাস্থিত ইউনিভার্সালিষ্ট চার্চে প্রদত্ত]

যে-অনুসন্ধানের ফলে আমরা ভগবানের নিকট হইতে আলো পাই, মনুষ্য-হৃদয়ের নিকট তদপেক্ষা প্রিয়তর অনুসন্ধান আর নাই। কি অতীত কালে, কি বর্তমান কালে ‘আত্মা’ ‘ঈশ্বর’ ও ‘অদৃষ্ট’ সম্বন্ধে আলোচনায় মানুষ যত শক্তি নিয়োগ করিয়াছে, অন্য কোন আলোচনায় তত করে নাই। আমরা আমাদের দৈনিক কাজ-কর্ম, আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আমাদের কর্তব্য প্রভৃতি লইয়া যতই ডুবিয়া থাকি না কেন, আমাদের সর্বাপেক্ষা কঠোর জীবনসংগ্রামের মধ্যেও কখনও কখনও এমন একটি বিরাম-মুহূর্ত আসিয়া উপস্থিত হয়, যখন মন সহসা থামিয়া যায় এবং এই জগৎপ্রপঞ্চের পারে কি আছে, তাহা জানিতে চায়। কখনও কখনও সে অতীন্দ্রিয় রাজ্যের কিছু কিছু আভাস পায় এবং ফলে তাহা পাইবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে থাকে। সর্বকালে সর্বদেশে এইরূপ ঘটিয়াছে। মানুষ অতীন্দ্রিয় বস্তুর দর্শন লাভ করিতে চাহিয়াছে, নিজেকে বিস্তার করিতে চাহিয়াছে, এবং যাহা কিছু আমাদের নিকট উন্নতি বা ক্রমাভিব্যক্তি নামে পরিচিত, তাহা সর্বকালে মানবজীবনের চরম গতি—ঈশ্বরানুসন্ধানের তুলাদণ্ডে পরিমিত হইয়াছে।

আমাদের সামাজিক জীবনসংগ্রাম যেমন বিভিন্ন জাতির বিবিধ প্রকার সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে, তেমনি মানবের আধ্যাত্মিক জীবনসংগ্রামও বিভিন্ন ধর্ম-অবলম্বনে আত্মপ্রকাশ করে। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেরূপ সর্বদাই পরস্পরের সহিত কলহ ও সংগ্রাম করিতেছে, সেইরূপ এই ধর্মসম্প্রদায়গুলিও সর্বদা পরস্পরের সহিত কলহ ও সংগ্রামে রত। কোন এক বিশেষ সমাজ-সংস্থার অন্তর্ভুক্ত লোকেরা দাবী করে যে, একমাত্র তাহাদেরই বাঁচিয়া থাকিবার অধিকার আছে, এবং তাহারা যতক্ষণ পারে দুর্বলের উপর অত্যাচার করিয়া সেই অধিকার বজায় রাখিতে চায়। আমরা জানি, এইরূপ একটি ভীষণ সংগ্রাম বর্তমান সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলিতেছে। সেইরূপ প্রত্যেক ধর্মসম্প্রদায়ও এই প্রকার দাবী করিয়া আসিয়াছে যে, শুধু তাহারই বাঁচিয়া থাকিবার অধিকার আছে। তাই আমরা দেখিতে পাই, যদিও ধর্ম মানবজীবনে যতটা মঙ্গলবিধান করিয়াছে, অপর কিছুই তাহা পারে নাই, তথাপি ধর্ম আবার যেরূপ বিভীষিকা সৃষ্টি করিয়াছে, আর কিছুই এমন করে নাই। ধর্মই সর্বাপেক্ষা অধিক শান্তি ও প্রেম বিস্তার করিয়াছে, আবার ধর্মই সর্বাপেক্ষা ভীষণ ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করিয়াছে। ধর্মই মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক স্পষ্টরূপে ভ্রাতৃভাব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, আবার ধর্মই মানুষে মানুষে সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক শত্রুতা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করিয়াছে। ধর্মই মানুষের—এমন কি পশুর জন্য পর্যন্ত সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতি স্থাপন করিয়াছে, আবার ধর্মই পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা অধিক রক্তবন্যা প্রবাহিত করিয়াছে। আবার আমরা ইহাও জানি যে, সব সময়েই ফল্গুধারার ন্যায় আর একটা চিন্তাস্রোতও চলিয়াছে; সব সময়েই বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক আলোচনায় রত এমন অনেক তত্ত্বান্বেষী বা দার্শনিক রহিয়াছেন, যাঁহারা এই সকল পরস্পর-বিবদমান ও বিরুদ্ধ-মতাবলম্বী ধর্মসম্প্রদায়ের ভিতর শান্তি স্থাপন করিবার জন্য সর্বদা চেষ্টা করিয়াছেন এবং এখনও করিতেছেন। কোন কোন দেশে এই চেষ্টা সফল হইয়াছে, কিন্তু সমগ্র পৃথিবীর দিক্ হইতে দেখিতে গেলে উহা ব্যর্থ হইয়াছে।

অতি প্রাচীন কাল হইতে কতকগুলি ধর্ম প্রচলিত আছে, যেগুলির মধ্যে এই ভাবটি ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান যে, সকল সম্প্রদায়ই বাঁচিয়া থাকুক; কারণ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কোন একটি নিজস্ব তাৎপর্য, কোন একটি মহান্ ভাব আছে, কাজেই উহা জগতের কল্যাণের জন্য আবশ্যক এবং উহাকে পোষণ করা উচিত। বর্তমান কালেও এই ধারণাটি আধিপত্য লাভ করিতেছে এবং ইহাকে কার্যে পরিণত করিবার জন্য মধ্যে মধ্যে চেষ্টাও চলিতেছে। এই-সকল চেষ্টা সকল সময়ে আশানুরূপ ফলপ্রসূ হয় না, বা যোগ্যতা দেখাইতে পারে না। শুধু তাহাই নয়, বড়ই ক্ষোভের বিষয় যে, আমরা অনেক সময় দেখিতে পাই, আমরা আরও ঝগড়া বাড়াইয়া তুলিতেছি।

এক্ষণে ধর্মান্ধ মতবাদ-অবলম্বনে আলোচনা ছাড়িয়া বিষয়টি সম্বন্ধে সাধারণ বিচারবুদ্ধি অবলম্বন করিলে প্রথমেই দেখিতে পাই যে, পৃথিবীর যাবতীয় প্রধান প্রধান ধর্মে একটা প্রবল জীবনীশক্তি রহিয়াছে। কেহ কেহ হয়তো বলিবেন যে, তাঁহারা এ-বিষয়ে কিছু জানেন না, কিন্তু অজ্ঞতার কথা তুলিয়া নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। যদি কোন লোক বলে, ‘বহির্জগতে কি হইতেছে না হইতেছে, আমি কিছুই জানি না, অতএব বহির্জগতে যাহা কিছু ঘটিতেছে, সকলই মিথ্যা’; তাহা হইলে তাহাকে মার্জনা করা চলে না। এখন আপনাদের মধ্যে যাঁহারা সমগ্র জগতে অধ্যাত্মচিন্তার গতিবিধি লক্ষ্য করিয়াছেন, তাঁহারা সম্পূর্ণ অবগত আছেন যে, পৃথিবীর একটিও মুখ্য ধর্ম মরে নাই; শুধু তাহাই নয়, এগুলির প্রত্যেকটিই উন্নতির দিকে অগ্রসর হইতেছে। খ্রীষ্টানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতেছে, মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতেছে, হিন্দুরা বিস্তার লাভ করিতেছে এবং য়াহুদীগণও সংখ্যায় অধিক হইতেছে, এবং সংখ্যায় তাহারা দ্রুত বর্ধিত হইয়া সারা পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়ায় য়াহুদীধর্মের গণ্ডী দিন দিন বাড়িয়া চলিয়াছে।

একটিমাত্র ধর্ম—একটি প্রধান প্রাচীন ধর্ম ক্রমশঃ ক্ষয় পাইয়াছে। তাহা প্রাচীন পারসীকদিগের ধর্ম—জরাথুষ্ট্র-ধর্ম। মুসলমানদের পারস্যবিজয়কালে প্রায় এক লক্ষ পারস্যবাসী ভারতে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল এবং তাহাদের কেহ কেহ প্রাচীন পারস্যদেশেই থাকিয়া গিয়াছিল। যাহারা পারস্যে ছিল, তাহারা ক্রমাগত মুসলমানদিগের নির্যাতনের ফলে ক্ষয় পাইতে পাইতে এখন বড়জোর দশ হাজারে দাঁড়াইয়াছে। ভারতে তাহাদের সংখ্যা প্রায় আশি হাজার; কিন্তু তাহারা আর বাড়িতেছে না। অবশ্য গোড়াতেই তাহাদিগের একটি অসুবিধা রহিয়াছে—তাহারা অপর কাহাকেও নিজেদের ধর্মভুক্ত করে না। আবার ভারতে এই মুষ্টিমেয় সমাজেও স্বগোত্রীয় নিকট সম্পর্কীয়দের মধ্যে বিবাহরূপ ঘোরতর অনিষ্টকর প্রথা প্রচলিত থাকায় তাহারা বৃদ্ধি পাইতেছে না। এই একটিমাত্র ধর্ম ব্যতীত অপর সকল প্রধান প্রধান ধর্মই জীবিত রহিয়াছে এবং বিস্তার ও পুষ্টি-লাভ করিতেছে। আর আমাদের মনে রাখা উচিত যে, পৃথিবীর সকল প্রধান ধর্মই অতি পুরাতন, তাহাদের একটিও বর্তমান কালে গঠিত হয় নাই এবং পৃথিবীর প্রত্যেক ধর্মই গঙ্গা ও ইউফ্রেটিস নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে উৎপত্তি লাভ করিয়াছে। একটিও প্রধান ধর্ম ইওরোপ বা আমেরিকায় উদ্ভূত হয় নাই—একটিও নয়; প্রত্যেক ধর্মই এশিয়াসম্ভূত এবং তাহাও আবার পৃথিবীর ঐ অংশটুকুর মধ্যে। ‘যোগ্যতম ব্যক্তি বা বস্তুই বাঁচিয়া থাকিবে’—আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণের এই মত যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এই-সকল ধর্ম যে এখনও বাঁচিয়া রহিয়াছে, ইহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, এখনও তাহারা কতকগুলি লোকের পক্ষে উপযোগী; তাহারা যে কেন বাঁচিয়া থাকিবে, তাহার কারণ আছে—তাহারা বহু লোকের উপকার করিতেছে। মুসলমানদিগকে দেখ, তাহারা দক্ষিণ-এশিয়ার কতকগুলি স্থানে কেমন বিস্তারলাভ করিতেছে, এবং আফ্রিকায় আগুনের মত ছড়াইয়া পড়িতেছে। বৌদ্ধগণ মধ্য-এশিয়ায় বরাবর বিস্তারলাভ করিতেছে। য়াহুদীদের মত হিন্দুগণও অপরকে নিজধর্মে গ্রহণ করে না, তথাপি ধীরে ধীরে অন্যান্য জাতি হিন্দুধর্মের ভিতর আসিয়া পড়িতেছে এবং হিন্দুদের আচার-ব্যবহার গ্রহণ করিয়া তাহাদের সমশ্রেণীভুক্ত হইয়া যাইতেছে। খ্রীষ্টধর্মও যে বিস্তৃতি লাভ করিতেছে, তাহা আপনারা সকলেই জানেন; তবে আমার যেন মনে হয়, চেষ্টার অনুরূপ ফল হইতেছে না। খ্রীষ্টানদের প্রচারকার্যে একটি ভয়ানক দোষ আছে এবং পাশ্চাত্য প্রতিষ্ঠান মাত্রেই এই দোষ বিদ্যমান। শতকরা নব্বই ভাগ শক্তি প্রতিষ্ঠানযন্ত্রের পরিচালনাতেই ব্যয়িত হইয়া যায়, কারণ প্রতিষ্ঠানসুলভ বিধি-ব্যবস্থা বড় বেশী। প্রচারকার্যটা প্রাচ্য লোকেরাই বরাবর করিয়া আসিয়াছে। পাশ্চাত্য লোকেরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে কার্য, সামাজিক অনুষ্ঠান, যুদ্ধসজ্জা, রাজ্যশাসন প্রভৃতি অতি সুন্দররূপে করিবে, কিন্তু ধর্মপ্রচার-ক্ষেত্রে তাহারা প্রাচ্যদিগের কাছে ঘেঁষিতেও পারে না, কারণ ইহা বরাবর তাহাদেরই কাজ ছিল বলিয়া তাহারা ইহাতে বিশেষ অভিজ্ঞ এবং তাহারা অতিরিক্ত বিধিব্যবস্থার পক্ষপাতী নয়।

অতএব মনুষ্যজাতির বর্তমান ইতিহাসে ইহা একটি প্রত্যক্ষ ঘটনা যে, পূর্বোক্ত সকল প্রধান প্রধান ধর্মই বিদ্যমান রহিয়াছে এবং বিস্তার ও পুষ্টিলাভ করিতেছে। এই ঘটনার নিশ্চয়ই একটা অর্থ আছে, এবং সর্বজ্ঞ পরমকারুণিক সৃষ্টিকর্তার যদি ইহাই ইচ্ছা হইত যে, ইহাদের একটিমাত্র ধর্ম থাকুক এবং অবশিষ্ট সবগুলিই বিনষ্ট হউক, তাহা হইলে উহা বহু পূর্বেই সংসাধিত হইত। আর যদি এই-সকল ধর্মের মধ্যে একটিমাত্র ধর্মই সত্য এবং অপরগুলি মিথ্যা হইত, তাহা হইলে ঐ সত্য ধর্মই এতদিনে সমগ্র পৃথিবী পরিব্যাপ্ত করিত। কিন্তু বস্তুতঃ তাহা হয় নাই; উহাদের কোনটিই সমস্ত পৃথিবী অধিকার করে নাই। সকল ধর্মই এক সময়ে উন্নতির দিকে, আবার অন্য সময়ে অবনতির দিকে যায়। আর ইহাও ভাবিয়া দেখ, তোমাদের দেশে ছয় কোটি লোক আছে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে মাত্র দুই কোটি দশ লক্ষ কোন-না-কোন প্রকার ধর্মভুক্ত। সুতরাং সব সময়েই ধর্মের উন্নতি হয় না। সম্ভবতঃ সকল দেশেই—গণনা করিলে দেখিতে পাইবে, ধর্মগুলির কখনও উন্নতি আবার কখনও অবনতি হইতেছে। সম্প্রদায়ের সংখ্যাও সর্বদা বাড়িয়াই চলিয়াছে। ধর্মসম্প্রদায়বিশেষের এই দাবী যদি সত্য হইত যে, সমুদয় সত্য উহাতেই নিহিত এবং ঈশ্বর সেই নিখিল সত্য কোন গ্রন্থবিশেষে নিবদ্ধ করিয়া তাহাদিগকেই দিয়াছেন—তবে জগতে এত সম্প্রদায় হইল কিরূপে? পঞ্চাশ বৎসর যাইতে না যাইতে এই পুস্তককে ভিত্তি করিয়া কুড়িটি নূতন সম্প্রদায় গড়িয়া উঠে। ঈশ্বর যদি কয়েকখানি পুস্তকেই সমগ্র সত্য নিবদ্ধ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে ঝগড়া করিবার জন্য তিনি কখনই আমাদিগকে সেগুলি দেন নাই, কিন্তু বস্তুতঃ দাঁড়াইতেছে তাহাই। কেন এরূপ হয়? যদি ঈশ্বর বাস্তবিকই ধর্মবিষয়ক সমস্ত সত্য একখানি পুস্তকে নিবদ্ধ করিয়া আমাদিগকে দিতেন, তাহা হইলে কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইত না, কারণ কেহই সে গ্রন্থ বুঝিতে পারিত না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বাইবেল ও খ্রীষ্টানদিগের মধ্যে প্রচলিত যাবতীয় সম্প্রদায়ের কথা ধরুন; প্রত্যেক সম্প্রদায় ঐ একই গ্রন্থ তাহার নিজের মতানুযায়ী ব্যাখ্যা করিয়া বলিতেছে যে, কেবল সেই উহা ঠিক ঠিক বুঝিয়াছে আর অপর সকলে ভ্রান্ত। প্রত্যেক ধর্ম-সম্বন্ধেই এই কথা। মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে অনেক সম্প্রদায় আছে, হিন্দুদের মধ্যে তো শত শত। এখন আমি যে-সকল ঘটনা আপনাদের নিকট উপস্থাপিত করিতেছি, এগুলির উদ্দেশ্য—আমি দেখাইতে চাই যে, ধর্ম-বিষয়ে যতবারই সমুদয় মনুষ্যজাতিকে এক প্রকার চিন্তার মধ্য দিয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা করা হইয়াছে, ততবারই উহা বিফল হইয়াছে এবং ভবিষ্যতেও তাহাই হইবে। এমন কি, বর্তমান কালেও নূতন মত-প্রবর্তক মাত্রেই দেখিতে পান যে, তিনি তাঁহার অনুবর্তিগণের নিকট হইতে কুড়ি মাইল দূরে সরিয়া যাইতে না যাইতে তাহারা কুড়িটি দল গঠন করিয়া বসিয়াছে। আপনারা সব সময়েই এইরূপ ঘটিতে দেখিতে পান। ইহা ধ্রুব সত্য যে, সকল লোককে একই প্রকার ভাব গ্রহণ করান চলে না এবং আমি ইহার জন্য ভগবানকে ধন্যবাদ দিতেছি। আমি কোন সম্প্রদায়ের বিরোধী নই, বরং নানা সম্প্রদায় রহিয়াছে বলিয়া আমি খুশী এবং আমার বিশেষ ইচ্ছা—তাহাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়া যাক। ইহার কারণ কি? কারণ শুধু এই যে, যদি আপনি আমি এবং এখানে উপস্থিত অন্যান্য সকলে ঠিক একই প্রকার ভাবরাশি চিন্তা করি, তাহা হইলে আমাদের চিন্তা করিবার বিষয়ই থাকিবে না। দুই বা ততোধিক শক্তির সংঘর্ষ হইলেই গতি সম্ভব, ইহা সকলেই জানেন। সেইরূপ চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাত হইতেই—চিন্তার বৈচিত্র্য হইতেই নূতন চিন্তার উদ্ভব হয়। এখন আমরা সকলেই যদি একই প্রকার চিন্তা করিতাম, তাহা হইলে আমরা যাদুঘরের মিশরদেশীয় ‘মামি’তে (mummies) পরিণত হইয়া শুধু তাহাদেরই মত পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতাম—তাহা অপেক্ষা অধিক কিছুই হইত না। বেগবতী জীবন্ত নদীতেই ঘূর্ণাবর্ত থাকে, বদ্ধ ও স্রোতহীন জলে আবর্ত হয় না। যখন ধর্মগুলি বিনষ্ট হইয়া যাইবে, তখন আর সম্প্রদায়ও থাকিবে না; তখন শ্মশানের পূর্ণ শান্তি ও সাম্য বিরাজ করিবে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত মানুষ চিন্তা করিবে, ততদিন সম্প্রদায়ও থাকিবে। বৈষম্যই জীবনের চিহ্ন এবং বৈষম্য থাকিবেই। আমি প্রার্থনা করিতেছি যে, সম্প্রদায়ের সংখ্যা বাড়িতে বাড়িতে অবশেষে জগতে যত মানুষ আছে, ততগুলি সম্প্রদায় গঠিত হউক, যেন ধর্মরাজ্যে প্রত্যেকে তাহার নিজের পথে—তাহার ব্যক্তিগত চিন্তাপ্রণালী অনুসারে চলিতে পারে।

কিন্তু এই ধারা চিরকালই বিদ্যমান রহিয়াছে। আমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাবে চিন্তা করে, কিন্তু এই স্বাভাবিক ধারা বরাবরই বাধা প্রাপ্ত হইয়াছে এবং এখনও হইতেছে। এইজন্য সাক্ষাৎভাবে তরবারি ব্যবহৃত না হইলেও অন্য উপায় গ্রহণ করা হইয়া থাকে। নিউ ইয়র্কের একজন শ্রেষ্ঠ প্রচারক কি বলিতেছেন, শুনুন—তিনি প্রচার করিতেছেন যে, ফিলিপাইনবাসীদিগকে যুদ্ধে জয় করিতে হইবে, কারণ তাহাদিগকে খ্রীষ্টধর্ম শিক্ষা দিবার উহাই একমাত্র উপায়! তাহারা ইতঃপূর্বেই ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়াছে, কিন্তু তিনি তাহাদিগকে প্রেসবিটেরিয়ান করিতে চান এবং ইহার জন্য তিনি রক্তপাতজনিত ঘোর পাপরাশি স্বজাতির স্কন্ধে চাপাইতে উদ্যত। কি ভয়ানক! আবার এই ব্যক্তিই তাঁহার দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মপ্রচারক এবং বিদ্যায় শীর্ষস্থানীয়। যখন এইরূপ একজন লোক সর্বসমক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া এই প্রকার কদর্য প্রলাপবাক্য বলিয়া যাইতে লজ্জাবোধ করে না, তখন জগতের অবস্থাটা একবার ভাবিয়া দেখুন, বিশেষতঃ যখন আবার তাহার শ্রোতৃবৃন্দ তাহাকে উৎসাহ দিতে থাকে, তখন ভাবিয়া দেখুন জগতের স্বরূপটা কি! ইহাই কি সভ্যতা? ইহা ব্যাঘ্র, নরখাদক ও অসভ্য বন্যজাতির সেই চিরাভ্যস্ত রক্তপিপাসা বৈ আর কিছুই নয়, শুধু আবার নূতন নামে ও নূতন অবস্থার মধ্যে প্রকাশিত হইতেছে মাত্র। এতদ্ব্যতীত উহা আর কি হইতে পারে? বর্তমান কালেই যদি ঘটনা এইরূপ হয়, তবে ভাবিয়া দেখুন, যখন প্রত্যেক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়গুলিকে টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিত, সেই প্রাচীনকালে জগৎকে কি ভয়ানক নরক-যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাইতে হইত! ইতিহাস ইহার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। আমাদের শাদূর্লসদৃশ মনোবৃত্তি সুপ্ত রহিয়াছে মাত্র—ঐ মনোবৃত্তি একেবারে মরে নাই। সুযোগ উপস্থিত হইলেই উহা লাফাইয়া উঠে এবং পূর্বের মত নিজ নখর ও বিষদন্ত ব্যবহার করে। তরবারি অপেক্ষাও—জড়পদার্থ নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র অপেক্ষাও ভীষণতর অস্ত্রশস্ত্র আছে; যাহারা ঠিক আমাদের মতাবলম্বী নয়, তাহাদের প্রতি এখন অবজ্ঞা, সামাজিক ঘৃণা ও সমাজ হইতে বহিষ্করণরূপ ভীষণ মর্মভেদী অস্ত্র-সকল প্রযুক্ত হইয়া থাকে। কিন্তু কেন সকলে যে ঠিক আমার মত চিন্তা করিবে?—আমি তো ইহার কোন কারণ দেখিতে পাই না। আমি যদি বিচারশীল মানুষ হই, তাহা হইলে সকলে যে ঠিক আমার ভাবে ভাবিত নয়, ইহাতে আমার আনন্দিতই হওয়া উচিত। আমি শ্মশানতুল্য দেশে বাস করিতে চাই না; আমি মানুষেরই মত থাকিতে চাই—মানুষেরই মধ্যে। চিন্তাশীল ব্যক্তি-মাত্রেরই মতভেদ থাকিবে; কারণ পার্থক্যই চিন্তার প্রথম লক্ষণ। আমি যদি চিন্তাশীল হই, তাহা হইলে আমার অবশ্যই এমন চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে বাস করিবার ইচ্ছা হওয়া উচিত, যেখানে মতের পার্থক্য থাকিবে।

তারপর প্রশ্ন উঠিবে, এই-সকল বৈচিত্র্য কি করিয়া সত্য হইতে পারে? কোন বস্তু সত্য হইলে তাহার বিপরীত বস্তুটা মিথ্যা হইবে। একই সময়ে দুইটি বিরুদ্ধ মত কি করিয়া সত্য হইতে পারে? আমি এই প্রশ্নেরই উত্তর দিতে চাই। কিন্তু আমি প্রথমে আপনাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, পৃথিবীর ধর্মগুলি কি বাস্তবিকই একান্ত বিরোধী? যে-সকল বাহ্য আচারে বড় বড় চিন্তাগুলি আবৃত থাকে, আমি সে-সকলের কথা বলিতেছি না। নানা ধর্মে যে-সকল বিবিধ মন্দির, ভাষা, ক্রিয়াকাণ্ড, শাস্ত্র প্রভৃতির ব্যবহার হইয়া থাকে, আমি তাহাদের কথা বলিতেছি না; আমি প্রত্যেক ধর্মের ভিতরকার প্রাণবস্তুর কথাই বলিতেছি। প্রত্যেক ধর্মের পশ্চাতে একটি করিয়া সারবস্তু বা ‘আত্মা’ আছে; এবং এক ধর্মের আত্মা অন্য ধর্মের আত্মা হইতে পৃথক্‌ হইতে পারে; কিন্তু তাই বলিয়া তাহারা কি একান্ত বিরোধী? তাহারা পরস্পরকে খণ্ডন করে, না একে অপরের পূর্ণতা সম্পাদন করে?—ইহাই প্রশ্ন। আমি যখন নিতান্ত বালক ছিলাম, তখন হইতে এই প্রশ্নটির আলোচনা আরম্ভ করিয়াছি এবং সারা জীবন ধরিয়া উহারই আলোচনা করিতেছি। আমার সিদ্ধান্ত হয়তো আপনাদের কোন উপকারে আসিতে পারে, এই মনে করিয়া উহা আপনাদের নিকট ব্যক্ত করিতেছি। আমার বিশ্বাস, তাহারা পরস্পরের বিরোধী নয়, পরস্পরের পরিপূরক। প্রত্যেক ধর্ম যেন মহান্ সার্বভৌম সত্যের এক-একটি অংশ লইয়া তাহাকে বাস্তব রূপ প্রদান করিতে এবং আদর্শে পরিণত করিতে উহার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করিতেছে। সুতরাং ইহা মিলনের ব্যাপার—বর্জনের নয়, ইহাই বুঝিতে হইবে। এক-একটি বড় ভাব লইয়া সম্প্রদায়ের পর সম্প্রদায় গড়িয়া উঠিতেছে, এবং আদর্শগুলিকে পরস্পর সংযুক্ত করিতে হইবে। এইরূপেই মানবজাতি উন্নতির দিকে অগ্রসর হইয়া থাকে। মানুষ কখনও ভ্রম হইতে সত্যে উপনীত হয় না, পরন্তু সত্য হইতেই সত্যে গমন করিয়া থাকে, নিম্নতর সত্য হইতে উচ্চতর সত্যে আরূঢ় হইয়া থাকে—কিন্তু কখনও ভ্রম হইতে সত্যে নয়। পুত্র হয়তো পিতা অপেক্ষা সমধিক গুণশালী হইয়াছে, কিন্তু তাই বলিয়া পিতা যে কিছু নন, তাহা তো নয়। পুত্রের মধ্যে পিতা তো আছেনই, অধিকন্তু আরও কিছু আছে। আপনার বর্তমান জ্ঞান যদি আপনার বাল্যাবস্থার জ্ঞান হইতে অনেক বেশী হয়, তাহা হইলে কি আপনি এখন সেই বাল্যাবস্থাকে ঘৃণার চক্ষে দেখিবেন? আপনি কি সেই অতীত অবস্থার দিকে তাকাইয়া উহাকে অকিঞ্চিৎকর বলিয়া উড়াইয়া দিবেন? বুঝিতেছেন না, আপনার সেই বাল্যকালের জ্ঞানই আরও কিছু অভিজ্ঞতা দ্বারা পুষ্ট হইয়া বর্তমান অবস্থায় পরিণত হইয়াছে।

আবার ইহা তো সকলেই জানেন যে, একই জিনিষকে বিভিন্ন দিক্ হইতে দেখিয়া প্রায় বিরুদ্ধ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাইতে পারে, কিন্তু সকল সিদ্ধান্ত একই বস্তুর আভাস দিয়া থাকে। মনে করুন, এক ব্যক্তি সূর্যের দিকে গমন করিতেছে এবং সে যেমন অগ্রসর হইতেছে, অমনি বিভিন্ন স্থান হইতে সূর্যের এক একটি ফটোগ্রাফ লইতেছে। যখন সে ব্যক্তি ফিরিয়া আসিবে, তখন সূর্যের অনেকগুলি ফটো আনিয়া আমাদের সম্মুখে রাখিবে। আমরা দেখিতে পাইব তাহাদের কোন দুইখানি ঠিক এক রকমের নয়, কিন্তু এ-কথা কে অস্বীকার করিবে যে, এগুলি একই সূর্যের ফটো—শুধু ভিন্ন ভিন্ন দিক্ হইতে গৃহীত? বিভিন্ন কোণ হইতে এই গীর্জাটির চারিখানি ফটো লইয়া দেখুন, তাহারা কত পৃথক্ দেখাইবে; অথচ তাহারা এই গীর্জার প্রতিকৃতি। এইরূপে আমরা একই সত্যকে এমন সব দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিতেছি, যাহা আমাদের জন্ম, শিক্ষা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রভৃতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হইয়া থাকে। আমরা সত্যকেই দেখিতেছি, তবে এই-সমুদয় অবস্থার মধ্য দিয়া সেই সত্যের যতটা দর্শন পাওয়া সম্ভব, ততটাই পাইতেছি—তাহাকে আমাদের নিজ নিজ হৃদয়ের রঙে রঞ্জিত করিতেছি, আমাদের নিজ নিজ বুদ্ধি দ্বারা বুঝিতেছি এবং নিজ নিজ মন দ্বারা ধারণা করিতেছি। আমরা সত্যের শুধু সেইটুকুই বুঝিতে পারি, যেটুকুর সহিত আমাদের সম্বন্ধ আছে বা যতটুকু গ্রহণের ক্ষমতা আমাদের আছে। এই হেতুই মানুষে মানুষে প্রভেদ হয়; এমন কি, কখনও কখনও সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ মতেরও সৃষ্টি হইয়া থাকে; অথচ আমরা সকলেই সেই এক সর্বজনীন সত্যের অন্তর্ভুক্ত।

অতএব আমার ধারণা এই যে, ভগবানের বিধানে এই-সকল ধর্ম বিবিধ শক্তিরূপে বিকশিত হইয়া মানবের কল্যাণ-সাধনে নিরত রহিয়াছে; তাহাদের একটিও মরিতে পারে না—একটিকেও বিনষ্ট করিতে পারা যায় না। যেমন কোন প্রাকৃতিক শক্তিকে বিনষ্ট করা যায় না, সেইরূপ এই আধ্যাত্মিক শক্তিনিচয়ের কোন একটিরও বিনাশ সাধন করিতে পারা যায় না। আপনারা দেখিয়াছেন, প্রত্যেক ধর্মই জীবিত রহিয়াছে। সময়ে সময়ে ইহা হয়তো উন্নতি বা অবনতির দিকে অগ্রসর হইতে পারে। কোন সময়ে হয়তো ইহার সাজসজ্জার অনেকটা হ্রাস পাইতে পারে, কখনও উহা রাশীকৃত সাজসজ্জায় মণ্ডিত হইতে পারে; কিন্তু তথাপি উহার প্রাণবস্তু সর্বদাই অব্যাহত রহিয়াছে; উহা কখনই বিনষ্ট হইতে পারে না। প্রত্যেক ধর্মের সেটি অন্তর্নিহিত আদর্শ, তাহা কখনই নষ্ট হয় না; সুতরাং প্রত্যেক ধর্মই সজ্ঞানে অগ্রগতির পথে চলিয়াছে।

আর সেই সার্বভৌম ধর্ম, যাহার সম্বন্ধে সকল দেশের দার্শনিকগণ ও অন্যান্য ব্যক্তি কত কল্পনা করিয়াছেন, তাহা পূর্ব হইতেই বিদ্যমান রহিয়াছে। ইহা এখানেই রহিয়াছে। সর্বজনীন ভ্রাতৃভাব যেমন পূর্ব হইতেই রহিয়াছে, সেইরূপ সার্বভৌম ধর্মও রহিয়াছে। আপনাদের মধ্যে যাঁহারা নানা দেশ পর্যটন করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে কে প্রত্যেক জাতির মধ্যেই নিজেদের ভাই-বোনের পরিচয় পান নাই? আমি তো পৃথিবীর সর্বত্রই তাঁহাদিগকে পাইয়াছি। ভ্রাতৃভাব পূর্ব হইতেই বিদ্যমান রহিয়াছে। কেবল এমন কতকগুলি লোক আছে, যাহারা ইহা দেখিতে না পাইয়া নূতন-ভাবে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চীৎকার করিয়া বিশৃঙ্খলা আনয়ন করে। সার্বভৌম ধর্মও বর্তমান রহিয়াছে। পুরোহিতকুল এবং অন্যান্য যে-সব লোক বিভিন্ন ধর্ম প্রচার করিবার ভাব স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ঘাড়ে লইয়াছেন, তাঁহারা যদি দয়া করিয়া একবার কিছুক্ষণের জন্য প্রচারকার্য বন্ধ রাখেন, তাহা হইলে আমরা দেখিতে পাইব, ঐ সার্বভৌম ধর্ম পূর্ব হইতেই রহিয়াছে। তাঁহারা বরাবরই উহাকে প্রতিহত করিতেছেন, কারণ উহাতেই তাঁহাদের লাভ। আপনারা দেখিতে পান, সকল দেশের পুরোহিতরাই অতিশয় গোঁড়া। ইহার কারণ কি? খুব কম পুরোহিতই আছেন, যাঁহারা জনসাধারণকে পরিচালিত করেন; তাঁহাদের অধিকাংশই জনসাধারণ দ্বারা চালিত হন এবং তাহাদের ভৃত্য ও ক্রীতদাস হইয়া পড়েন। যদি কেহ বলে, ‘ইহা শুষ্ক’, তাঁহারাও বলিবেন, ‘হাঁ শুষ্ক’, যদি কেহ বলে, ‘ইহা কালো’, তাঁহারাও বলিবেন, ‘হাঁ, ইহা কালো।’ যদি জনসাধারণ উন্নত হয়, তাহা হইলে পুরোহিতরাও উন্নত হইতে বাধ্য। তাঁহারা পিছাইয়া থাকিতে পারেন না। সুতরাং পুরোহিতদিগকে গালি দিবার পূর্বে—পুরোহিতগণকে গালি দেওয়া আজকাল একটা রীতি হইয়া দাঁড়াইয়াছে—আপনাদের নিজেদেরই গালি দেওয়া উচিত। আপনারা শুধু তেমন জিনিষই পাইতে পারেন, যাহার জন্য আপনারা যোগ্য। যদি কোন পুরোহিত নূতন নূতন উন্নত ভাব শিখাইয়া আপনাদিগকে উন্নতির পথে অগ্রসর করাইতে চান, তাহা হইলে তাঁহার দশা কি হইবে? হয়তো তাঁহার পুত্রকন্যা অনাহারে মারা যাইবে এবং তাঁহাকে ছিন্ন বস্ত্র পরিধান করিয়া থাকিতে হইবে। আপনাদিগকে যে-সকল জাগতিক বিধি মানিতে হয়, তাঁহাকেও তাহাই করিতে হয়। তিনি বলেন, ‘আপনারা যদি চলেন, তাহা হইলে চলুন, চলাই যাক।’ অবশ্য এমন বিরল দুই চারি জন উচ্চ ভাবের মানুষ আছেন, যাঁহারা লোকমতকে ভয় করেন না। তাঁহারা সত্য অনুভব করেন এবং একমাত্র সত্যকেই সার জ্ঞান করেন। সত্য তাঁহাদিগকে পাইয়া বসিয়াছে—যেন তাঁহাদিগকে অধিকার করিয়া লইয়াছে এবং তাঁহাদের অগ্রসর হওয়া ভিন্ন আর গত্যন্তর নাই। তাঁহারা কখনও পিছনে ফিরিয়া চাহেন না এবং লোকমত গ্রাহ্যও করেন না। তাঁহাদের নিকট একমাত্র ভগবানই সত্য; তিনিই তাঁহাদের পথ-প্রদর্শক জ্যোতি এবং তাঁহারা সেই জ্যোতিরই অনুসরণ করেন।

এদেশে (আমেরিকায়) আমার জনৈক মর্মন (Mormon) ভদ্রলোকের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তিনি আমাকে তাঁহার মতে লইয়া যাইবার জন্য বিশেষ পীড়াপীড়ি করিয়াছিলেন। আমি বলিয়াছিলাম, ‘আপনার মতের উপর আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে আমরা একমত নই। আমি সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ভুক্ত এবং আপনি বহুবিবাহের পক্ষপাতী। ভাল কথা, আপনি ভারতে আপনার মত প্রচার করিতে যান না কেন?’ ইহাতে তিনি বিস্মিত হইয়া বলিলেন, ‘কি রকম, আপনি বিবাহের আদৌ পক্ষপাতী নন, আর আমি বহুবিবাহের পক্ষপাতী; তথাপি আপনি আমাকে আপনার দেশে যাইতে বলিতেছেন!’ আমি বলিলাম, ‘হাঁ, আমার দেশবাসীরা সকল প্রকার ধর্মমতই শুনিয়া থাকেন—তাহা যে-দেশ হইতেই আসুক না কেন। আমার ইচ্ছা আপনি ভারতে যান; কারণ প্রথমতঃ আমি সম্প্রদায়সমূহের উপকারিতায় বিশ্বাস করি। দ্বিতীয়তঃ সেখানে এমন অনেক লোক আছেন, যাঁহারা বর্তমান সম্প্রদায়গুলির উপর আদৌ সন্তুষ্ট নন, এবং এই হেতু তাঁহারা ধর্মের কোন ধারই ধারে না; হয়তো তাঁহাদের কেহ কেহ আপনার মত গ্রহণ করিতে পারেন।’ সম্প্রদায়ের সংখ্যা যতই অধিক হইবে, লোকের ধর্মলাভ করিবার সম্ভাবনা ততই বেশী হইবে। যে হোটেলে সব রকম খাবার পাওয়া যায়, সেখানে সকলেরই ক্ষুধাতৃপ্তির সম্ভাবনা আছে। সুতরাং আমার ইচ্ছা, সকল দেশে সম্প্রদায়ের সংখ্যা বাড়িয়া যাক, যাহাতে আরও বেশী লোক ধর্মজীবনলাভের সুবিধা পাইতে পারে। এইরূপ মনে করিবেন না যে, লোকে ধর্ম চায় না। আমি তাহা বিশ্বাস করি না। তাহাদের যাহা প্রয়োজন, প্রচারকেরা ঠিক তাহা দিতে পারে না। যে লোক নাস্তিক, জড়বাদী বা ঐ-রকম একটা কিছু বলিয়া ছাপমারা হইয়া গিয়াছে, তাহারও যদি এমন কোন লোকের সহিত সাক্ষাৎ হয়, যিনি তাহাকে ঠিক তাহার মনের মত আদর্শটি দেখাইয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে সে হয়তো সমাজের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক অনুভূতিসম্পন্ন লোক হইয়া উঠিবে। আমরা বরাবর যেভাবে খাইতে অভ্যস্ত, সেভাবেই খাইতে পারি। দেখুন না, আমরা হিন্দুরা—হাত দিয়া খাইয়া থাকি, আপনাদের অপেক্ষা আমাদের আঙুল বেশী তৎপর, আপনারা ঠিক ঐ-ভাবে আঙুল নাড়িতে পারেন না। শুধু খাবার দিলেই হইল না, আপনাকে উহা নিজের ভাবে গ্রহণ করিতে হইবে। আপনাকে শুধু কতকগুলি আধ্যাত্মিক ভাব দিলেই চলিবে না, আপনার পরিচিত ধারায় সেগুলি আপনার নিকট আসা চাই। সেগুলি যদি আপনার নিজের ভাষায় আপনার প্রাণের ভাষায় ব্যক্ত করা হয়, তবেই আপনার সন্তোষ হইবে। এমন কেহ যখন আসেন, যিনি আমার ভাষায় কথা বলেন এবং আমার ভাষায় উপদেশ দেন, আমি তখনই উহা বুঝিতে পারি এবং চিরকালের মত স্বীকার করিয়া লই। ইহা একটা মস্ত বড় বাস্তব সত্য।

ইহা হইতে দেখা যাইতেছে, কত বিভিন্ন স্তর এবং প্রকৃতির মানব-মন রহিয়াছে এবং ধর্মগুলির উপরেও কি গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত রহিয়াছে। কেহ হয়তো দুই তিনটি মতবাদ বাহির করিয়া বলিয়া বসিবেন যে, তাঁহার ধর্ম সকল লোকের উপযোগী হইয়া উচিত। তিনি একটি ছোট খাঁচা হাতে লইয়া ভগবানের এই জগদ্রূপ চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করিয়া বলেন, ‘ঈশ্বর, হস্তী এবং অপর সকলকেই ইহার মধ্যে প্রবেশ করিতে হইবে। প্রয়োজন হইলে হস্তীটিকে টুকরা টুকরা করিয়া কাটিয়াও ইহার মধ্যে ঢুকাইতে হইবে।’ আবার হয়তো এমন কোন সম্প্রদায় আছে, যাহাদের মধ্যে কতকগুলি ভাল ভাল ভাব আছে। তাঁহারা বলেন, ‘সকলকেই আমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত হইতে হইবে!’ ‘কিন্তু সকলের তো স্থান নাই!’ ‘কুছ পরোয়া নেই! তাহাদিগকে কাটিয়া ছাঁটিয়া যেমন করিয়া পার ঢোকাও। কারণ তাহারা যদি না আসে, তাহারা নিশ্চয়ই উৎসন্ন যাইবে।’ আমি এমন কোন প্রচারকদল বা সম্প্রদায় কোথাও দেখিলাম না, যাঁহারা স্থির হইয়া ভাবিয়া দেখেন, ‘আচ্ছা, লোকে যে আমাদের কথা শোনে না, ইহার কারণ কি?’ এরূপ না করিয়া তাঁহারা কেবল লোকদের অভিশাপ দেন আর বলেন, ‘লোকগুলো ভারি পাজী।’ তাঁহারা একবারও জিজ্ঞাসা করেন না, ‘কেন লোকে আমার কথায় কর্ণপাত করিতেছে না? কেন আমি তাহাদিগকে সত্য দেখাইতে পারিতেছি না? কেন আমি তাহাদের বুঝিবার মত ভাষায় কথা বলিতে পারি না? কেন আমি তাহাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করিতে পারি না?’ প্রকৃতপক্ষে তাঁহাদের আরও সুবিবেচক হওয়া আবশ্যক। এবং যখন তাঁহারা দেখেন যে, লোকে তাঁহাদের কথায় কর্ণপাত করে না, তখন যদি কাহাকেও গালাগালি দিতে হয় তো তাঁহাদের নিজেদের গালাগালি দেওয়া উচিত। কিন্তু সব সময়ে লোকেরই যত দোষ! তাঁহারা কখনও নিজেদের সম্প্রদায়কে প্রসারিত করিয়া সকল লোকের উপযোগী করিবার চেষ্টা করেন না। অতএব অংশ নিজেকে পূর্ণ বলিয়া সর্বদা দাবী করা-রূপ, ক্ষুদ্র সসীম বস্তু নিজেকে অসীম বলিয়া সর্বদা জাহির করা-রূপ এত সঙ্কীর্ণতা জগতে কেন চলিয়া আসিতেছে, তাহার কারণ আমরা অতি সহজেই দেখিতে পাই। একবার সেই-সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়গুলির কথা ভাবিয়া দেখুন, যেগুলি মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে ভ্রান্ত মানব-মস্তিষ্ক হইতে জাত হইয়াছে, অথচ ভগবানের অনন্ত সত্যের সমস্ত জানিয়া ফেলিয়াছে বলিয়া উদ্ধত স্পর্ধা করে। কতদূর প্রগল্‌ভতা একবার দেখুন! ইহা হইতে আর কিছু না হউক, এইটুকু বোঝা যায় যে, মানুষ কত আত্মম্ভরী! আর এই প্রকার দাবী যে বরাবরই ব্যর্থ হইয়াছে, তাহা কিছুই আশ্চর্য নয় এবং প্রভুর কৃপায় উহা চিরকালই ব্যর্থ হইতে বাধ্য। এই বিষয়ে মুসলমানেরা সকলকে ছাড়াইয়া গিয়াছিল। তাহারা তরবারির সাহায্যে প্রত্যেক পদ অগ্রসর হইয়াছিল—তাহাদের এক হস্তে ছিল কোরান, অপর হস্তে তরবারি; ‘হয় কোরান গ্রহণ কর, নতুবা মৃত্যু আলিঙ্গন কর। আর অন্য উপায় নাই!’ ইতিহাস-পাঠক মাত্রেই জানেন, তাহাদের অভূতপূর্ব সাফল্য হইয়াছিল। ছয়শত বৎসর ধরিয়া কেহই তাহাদের গতিরোধ করিতে পারে নাই; কিন্তু পরে এমন এক সময় আসিল, যখন তাহাদিগকে অভিযান থামাইতে হইল। অপর কোন ধর্ম যদি ঐরূপ পন্থা অনুসরণ করে, তবে তাহারও একই দশা হইবে। আমরা এই প্রকার শিশুই বটে! আমরা মানব-প্রকৃতির কথা সর্বদাই ভুলিয়া যাই। আমাদের জীবন-প্রভাতে আমরা মনে করি যে, আমাদের অদৃষ্ট একটা কিছু অসাধারণ রকমের হইবে এবং কিছুতেই এ-বিষয়ে আমাদের অবিশ্বাস আসে না। কিন্তু জীবনসন্ধায় আমাদের চিন্তা অন্যরূপ দাঁড়ায়। ধর্ম সম্বন্ধেও ঠিক এই কথা। প্রথমাবস্থায় যখন ধর্মসম্প্রদায়গুলি একটু বিস্তৃতি লাভ করে, তখন ঐগুলি মনে করে, কয়েক বৎসরেই সমগ্র মানবজাতির মন বদলাইয়া দিবে এবং বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করিবার জন্য শত সহস্র লোকের প্রাণ বধ করিতে থাকে। পরে যখন অকৃতকার্য হয়, তখন ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের চক্ষু খুলিতে থাকে। দেখা যায়, ঐগুলি যে উদ্দেশ্য লইয়া কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিল, তাহা ব্যর্থ হইয়াছে, আর ইহাই জগতের পক্ষে অশেষ কল্যাণজনক। একবার ভাবিয়া দেখুন, যদি এই গোঁড়া সম্প্রদায়সমূহের কোন একটি সমগ্র পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়িত, তাহা হইলে আজ মানুষের কি দশা হইত! ভগবানকে ধন্যবাদ যে, তাহারা কৃতকার্য হয় নাই। তথাপি প্রত্যেক সম্প্রদায় এক একটি মহান্ সত্যের প্রতিনিধি; প্রত্যেক ধর্মই কোন একটি বিশেষ উচ্চাদর্শের প্রতিভূ—উহাই তাহার প্রাণবস্তু। একটি পুরাতন গল্প মনে পড়িতেছেঃ কতকগুলি রাক্ষসী ছিল; তাহারা মানুষ মারিত এবং নানাপ্রকার অনিষ্টসাধন করিত। কিন্তু তাহাদিগকে কেহই মারিতে পারিত না। অবশেষে একজন খুঁজিয়া বাহির করিল যে, তাহাদের প্রাণ কতকগুলি পাখীর মধ্যে রহিয়াছে এবং যতক্ষণ ঐ পাখীগুলি বাঁচিয়া থাকিবে, ততক্ষণ কেহই রাক্ষসীদের মারিতে পারিবে না। আমাদের প্রত্যেকেরও যেন এইরূপ এক-একটি প্রাণ-পক্ষী আছে, উহার মধ্যেই আমাদের প্রাণবস্তুটি রহিয়াছে। আমাদের প্রত্যেকের একটি আদর্শ—একটি উদ্দেশ্য রহিয়াছে, যেটি জীবনে কার্যে পরিণত করিতে হইবে। প্রত্যেক মানুষই এইরূপ এক-একটি আদর্শ, এইরূপ এক-একটি উদ্দেশ্যের প্রতিমূর্তি। আর যাহাই নষ্ট হউক না কেন, যতক্ষণ সেই আদর্শটি ঠিক আছে, যতক্ষণ সেই উদ্দেশ্য অটুট রহিয়াছে, ততক্ষণ কিছুতেই আপনার বিনাশ নাই। সম্পদ আসিতে বা যাইতে পারে, বিপদ পর্বতপ্রমাণ হইয়া উঠিতে পারে, কিন্তু আপনি যদি সেই লক্ষ্য অটুট রাখিয়া থাকেন, কিছুই আপনার বিনাশসাধন করিতে পারে না। আপনি বৃদ্ধ হইতে পারেন, এমন কি শতায়ু হইতে পারেন, কিন্তু যদি সেই উদ্দেশ্য আপনার মনে উজ্জ্বল এবং সতেজ থাকে, তাহা হইলে কে আপনাকে বধ করিতে সমর্থ? কিন্তু যখন সেই আদর্শ হারাইয়া যাইবে এবং সেই উদ্দেশ্য বিকৃত হইবে, তখন আর কিছুতেই আপনার রক্ষা নাই, পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ, সমস্ত শক্তি মিলিয়াও আপনাকে রক্ষা করিতে পারিবে না। জাতি আর কি—ব্যষ্টির সমষ্টি বৈ তো নয়? সুতরাং প্রত্যেক জাতির একটি নিজস্ব উদ্দেশ্য আছে, যেটি বিভিন্ন জাতিসমূহের সুশৃঙ্খল অবস্থিতির পক্ষে বিশেষ দরকার, এবং যতদিন উক্ত জাতি সেই আদর্শকে ধরিয়া থাকিবে, ততদিন কিছুতেই তাহার বিনাশ নাই। কিন্তু যদি ঐ জাতি উক্ত আদর্শ পরিত্যাগ করিয়া অপর কোন লক্ষ্যের প্রতি ধাবিত হয়, তাহা হইলে তাহার জীবন ক্ষীণ হইয়া আসে এবং ইহা অচিরেই অন্তর্হিত হয়।

ধর্ম সম্বন্ধেও ঠিক এই কথা। এই-সকল পুরাতন ধর্ম যে আজিও বাঁচিয়া রহিয়াছে, ইহা হইতেই প্রমাণিত হইতেছে যে, এগুলি নিশ্চয়ই সেই উদ্দেশ্য অটুট রাখিয়াছে। ধর্মগুলির সমুদয় ভুলভ্রান্তি, বাধাবিঘ্ন, বিবাদ-বিসংবাদ সত্ত্বেও সেগুলির উপর নানাবিধ অনুষ্ঠান ও নির্দিষ্ট প্রণালীর আবর্জনাস্তূপ সঞ্চিত হইলেও প্রত্যেকের প্রাণকেন্দ্র ঠিক আছে, উহা জীবন্ত হৃৎপিণ্ডের ন্যায় স্পন্দিত হইতেছে—ধুক্ ধুক্ করিতেছে। ঐ ধর্মগুলির মধ্যে কোন ধর্মই, যে মহান্ উদ্দেশ্য লইয়া আসিয়াছে, তাহা হারাইয়া ফেলে নাই। আর সেই উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আলোচনা করা চমকপ্রদ। দৃষ্টান্তস্বরূপ মুসলমান ধর্মের কথাই ধরুন। খ্রীষ্টধর্মাবলম্বিগণ মুসলমান ধর্মকে যত বেশী ঘৃণা করে, এরূপ আর কোন ধর্মকেই করে না। তাহারা মনে করে, এরূপ নিকৃষ্ট ধর্ম আর কখনও হয় নাই। কিন্তু দেখুন, যখনই একজন লোক মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিল, অমনি সমগ্র ইসলামী সমাজ তাহাকে জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে ভ্রাতা বলিয়া বক্ষে ধারণ করিল। এরূপ আর কোন ধর্ম করে না। এদেশীয় একজন রেড ইণ্ডিয়ান যদি মুসলমান হয়, তাহা হইলে তুরস্কের সুলতানও তাহার সহিত একত্র ভোজন করিতে কুণ্ঠিত হইবেন না এবং সে বুদ্ধিমান হইলে যে-কোন উচ্চপদ-লাভে বঞ্চিত হইবে না। কিন্তু এদেশে আমি এ পর্যন্ত এমন একটিও গীর্জা দেখি নাই, যেখানে শ্বেতকায় ব্যক্তি ও নিগ্রো পাশাপাশি নতজানু হইয়া প্রার্থনা করিতে পারে। এই কথাটি একবার ভাবিয়া দেখুন। ইসলাম ধর্ম তদন্তর্গত সকল ব্যক্তিকে সমান চক্ষে দেখিয়া থাকে। সুতরাং আপনারা দেখিতেছেন এইখানেই মুসলমান ধর্মের নিজস্ব বিশেষ মহত্ত্ব। কোরানের অনেকস্থলে মানবজীবন সম্বন্ধে নিছক ইহলৌকিক কথা দেখিতে পাইবেন; তাহাতে ক্ষতি নাই। মুসলমান ধর্ম জগতে যে বার্তা প্রচার করিতে আসিয়াছে, তাহা সকল মুসলমান-ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কার্যে পরিণত এই ভ্রাতৃভাব, ইহাই মুসলমান ধর্মের অত্যাবশ্যক সারাংশ, এবং স্বর্গ, জীবন প্রভৃতি অন্যান্য বস্তু সম্বন্ধে যে সমস্ত ধারণা, সেগুলি মুসলমান ধর্মের সারাংশ নয়, অন্য ধর্ম হইতে উহাতে ঢুকিয়াছে।

হিন্দুদিগের মধ্যে একটি জাতীয় ভাব দেখিতে পাইবেন—তাহা আধ্যাত্মিকতা। অন্য কোন ধর্মে—পৃথিবীর অপর কোন ধর্মপুস্তকে ঈশ্বরের স্বরূপ নির্ণয় করিতে এত অধিক শক্তিক্ষয় করিয়াছে, ইহা দেখিতে পাইবেন না। তাঁহারা এভাবে আত্মার স্বরূপ নির্দেশ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন, যাহাতে কোন পার্থিব সংস্পর্শই ইহাকে কলুষিত করিতে না পারে। অধ্যাত্ম-তত্ত্ব ভগবৎ সত্তারই সমতুল, এবং আত্মাকে আত্মারূপে বুঝিতে হইলে উহাকে কখনও মানবত্বে পরিণত করা চলে না।

সেই একত্বের ধারণা এবং সর্বব্যাপী ঈশ্বরের উপলব্ধিই সর্বদা সর্বত্র প্রচারিত হইয়াছে। তিনি স্বর্গে বাস করেন ইত্যাদি কথা হিন্দুদের নিকট অসার উক্তি বৈ আর কিছুই নহে—উহা মনুষ্য কর্তৃক ভগবানে মনুষ্যোচিত গুণাবলীর আরোপ মাত্র। যদি স্বর্গ বলিয়া কিছু থাকে, তবে তাহা এখনই এবং এইখানেই বর্তমান। অনন্তকালের মধ্যবর্তী যে-কোন মুহূর্ত অপর যে-কোন মুহূর্তেরই মত ভাল। যিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী, তিনি এখনই তাঁহার দর্শন লাভ করিতে পারেন। আমাদের মতে একটা কিছু প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হইতেই ধর্মের আরম্ভ হয়; কতকগুলি মতে বিশ্বাসী হওয়া কিংবা বুদ্ধি দ্বারা উহা স্বীকার করা, অথবা প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করাকে ধর্ম বলে না। ভগবান্ যদি থাকেন, তবে আপনি তাঁহাকে দেখিয়াছেন কি? যদি বলেন, ‘না’, তবে আপনার তাঁহাতে বিশ্বাস করিবার কি অধিকার আছে? আর যদি আপনার ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ থাকে, তবে তাঁহাকে দেখিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করুন না কেন? কেন আপনি সংসার ত্যাগ করিয়া এই এক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সমস্ত জীবন অতিবাহিত করেন না? ত্যাগ এবং আধ্যাত্মিকতা—এই দুইটিই ভারতের মহান্ আদর্শ এবং এ দুইটি ধরিয়া আছে বলিয়াই ভারতের এত ভুলভ্রান্তিতেও বিশেষ কিছু যায় আসে না।

খ্রীষ্টানদিগের প্রচারিত মূল ভাবটিও এইঃ ‘অবহিত হইয়া প্রার্থনা কর, কারণ ভগবানের রাজ্য অতি নিকটে।’ অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধি করিয়া প্রস্তুত হও। আর এই ভাব কখনও নষ্ট হইতে পারে না। আপনাদের বোধ হয় মনে আছে যে, খ্রীষ্টানগণ ঘোর অন্ধকার-যুগেও অতি কুসংস্কারগ্রস্ত খ্রীষ্টান দেশসমূহেও অপরকে সাহায্য করা, হাসপাতাল নির্মাণ করা প্রভৃতি সৎকার্যের দ্বারা সর্বদা নিজেদের পবিত্র করিবার চেষ্টা করিয়া প্রভুর আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন। যতদিন পর্যন্ত তাঁহারা এই লক্ষ্যে স্থির থাকিবেন, ততদিন তাঁহাদের ধর্ম সজীব থাকিবে।

সম্প্রতি আমার মনে একটা আদর্শের ছবি জাগিয়া উঠিয়াছে। হয়তো ইহা স্বপ্নমাত্র। জানি না ইহা কখনও জগতে কার্যে পরিণত হইবে কিনা। কিন্তু কঠোর বাস্তবে থাকিয়া মরা অপেক্ষা কখনও কখনও স্বপ্ন দেখাও ভাল। স্বপ্নের মধ্যে প্রকাশিত হইলেও মহান্ সত্যগুলি অতি উত্তম, নিকৃষ্ট বাস্তব অপেক্ষা তাহারা শ্রেষ্ঠ। অতএব একটা স্বপ্নই দেখা যাক না কেন!

আপনারা জানেন যে, মনের নানা স্তর আছে। আপনি হয়তো সহজজ্ঞানে আস্থাবান্ একজন বস্তুতান্ত্রিক যুক্তিবাদী; আপনি আচার-অনুষ্ঠানের ধার ধারেন না। আপনি চান এমন সব প্রত্যক্ষ ও অকাট্য সত্য, যাহা যুক্তি দ্বারা সমর্থিত এবং কেবল উহাতেই আপনি সন্তোষলাভ করিতে পারেন। আবার পিউরিটান ও মুসলমানগণ আছেন যাঁহারা তাঁহাদের উপাসনাস্থলে কোন প্রকার ছবি বা মূর্তি রাখিতে দিবেন না। বেশ কথা! কিন্তু আর এক প্রকার লোক আছেন, যিনি একটু বেশী শিল্পকলাপ্রিয়; ঈশ্বরলাভের সহায়রূপে তাঁহার অনেকটা শিল্পকলার প্রয়োজন হয়; তিনি চান সুন্দর সুঠাম নানা সরল ও বক্ররেখা এবং বর্ণ ও রূপ, আর চান ধূপ, দীপ, অন্যান্য প্রতীক ও বাহ্যোপকরণ। আপনি যেমন ঈশ্বরকে যুক্তি-বিচারের মধ্য দিয়া বুঝিতে পারেন, তিনিও তেমনি তাঁহাকে ঐ-সকল প্রতীকের মধ্য দিয়া বুঝিতে পারেন। আর এক প্রকার ভক্তিপ্রবণ লোক আছেন, যাঁহাদের প্রাণ ভগবানের জন্য ব্যাকুল। ভগবানের পূজা এবং স্তবস্তুতি করা ছাড়া তাঁহাদের অন্য কোন চিন্তা নাই। তারপর আছেন দার্শনিক, যিনি এই-সকলের বাহিরে দাঁড়াইয়া তাঁহাদিগকে বিদ্রূপ করেন; তিনি মনে করেন, কি সব ব্যর্থ প্রয়াস! ঈশ্বর সম্বন্ধে কি সব অদ্ভুত ধারণা!

তাঁহারা পরস্পরকে উপহাস করিতে পারেন, কিন্তু এই জগতে প্রত্যেকেরই একটা স্থান আছে। এই-সকল বিভিন্ন মন, এই-সকল বিচিত্র ভাবাদর্শের প্রয়োজন আছে, যদি কখনও কোন আদর্শ ধর্ম প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা থাকে, তবে উহাকে এরূপ উদার এবং প্রশস্তহৃদয় হইতে হইবে, যাহাতে উহা এই সকল বিভিন্ন মনের উপযোগী খাদ্য যোগাইতে পারে। ঐ ধর্ম জ্ঞানীর হৃদয়ে দর্শন-সুলভ দৃঢ়তা আনিয়া দিবে, এবং ভক্তের হৃদয় ভক্তিতে আপ্লুত করিবে। আনুষ্ঠানিককে ঐ ধর্ম উচ্চতম প্রতীকোপাসনালভ্য সমুদয় ভাবরাশিদ্বারা চরিতার্থ করিবে, এবং কবি যতখানি হৃদয়োচ্ছ্বাস ধারণ করিতে পারে, কিংবা আর যাহা কিছু গুণরাশি আছে, তাহার দ্বারা সে কবিকে পূর্ণ করিবে। এইরূপ উদার ধর্মের সৃষ্টি করিতে হইলে আমাদিগকে ধর্মসমূহের অভ্যুদয়কালে ফিরিয়া যাইতে হইবে এবং ঐগুলি সবই গ্রহণ করিতে হইবে।

অতএব গ্রহণই আমাদের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত—বর্জন নয়। কেবল পরমতসহিষ্ণুতা নয়—উহা অনেক সময়ে ঈশ্বর-নিন্দারই নামান্তর মাত্র; সুতরাং আমি উহাতে বিশ্বাস করি না। আমি ‘গ্রহণ’-এ বিশ্বাসী। আমি কেন পরধর্মসহিষ্ণু হইতে যাইব? পরধর্মসহিষ্ণুতার মানে এই যে, আমার মতে আপনি অন্যায় করিতেছেন, কিন্তু আমি আপনাকে বাঁচিয়া থাকিতে বাধা দিতেছি না। তোমার আমার মত লোক কাহাকেও দয়া করিয়া বাঁচিতে দিতেছে, এইরূপ মনে করা কি ভগবদ্বিধানে দোষারোপ করা নয়? অতীতে যত ধর্মসম্প্রদায় ছিল, আমি সবগুলিই সত্য বলিয়া মানি এবং তাহাদের সকলের সহিতই উপাসনায় যোগদান করি। প্রত্যেক সম্প্রদায় যে-ভাবে ঈশ্বরের আরাধনা করে, আমি তাহাদের প্রত্যেকের সহিত ঠিক সেই ভাবে তাঁহার আরাধনা করি। আমি মুসলমানদিগের মসজিদে যাইব, খ্রীষ্টানদিগের গীর্জায় প্রবেশ করিয়া ক্রুশবিদ্ধ ঈশার সম্মুখে নতজানু হইব, বৌদ্ধদিগের বিহারে প্রবেশ করিয়া বুদ্ধের ও তাঁহার ধর্মের শরণ লইব, এবং অরণ্যে গমন করিয়া সেই-সব হিন্দুর পার্শ্বে ধ্যানে মগ্ন হইব, যাঁহারা সকলের হৃদয়-কন্দর-উদ্ভাসনকারী জ্যোতির দর্শনে সচেষ্ট।

শুধু তাহাই নয়, ভবিষ্যতে যে-সকল ধর্ম আসিতে পারে তাহাদের জন্যও আমার হৃদয় উন্মুক্ত রাখিব। ঈশ্বরের বিধিশাস্ত্র কি শেষ হইয়া গিয়াছে, অথবা উহা চিরকালব্যাপী অভিব্যক্তিরূপে আজও আত্মপ্রকাশ করিয়া চলিয়াছে? জগতের আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তিসমূহের এই যে লিপি, ইহা এক অদ্ভুত পুস্তক। বাইবেল, বেদ ও কোরান এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থসমূহ যেন ঐ পুস্তকের এক-একখানি পত্র এবং উহার অসংখ্য পত্র এখনও অপ্রকাশিত রহিয়াছে। সেই-সব অভিব্যক্তির জন্য আমি এ-পুস্তক খুলিয়াই রাখিব। আমরা বর্তমানে দাঁড়াইয়া ভবিষ্যতের অনন্ত ভাবরাশি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকিব। অতীতে যাহা কিছু ঘটিয়াছে, সে-সবই আমরা গ্রহণ করিব, বর্তমানে জ্ঞানালোক উপভোগ করিব এবং ভবিষ্যতেও যাহা উপস্থিত হইবে, তাহা গ্রহণ করিবার জন্য হৃদয়ের সকল বাতায়ন উন্মুক্ত রাখিব। অতীতের ঋষিকুলকে প্রণাম, বর্তমানের মহাপুরুষদিগকে প্রণাম এবং যাঁহারা ভবিষ্যতে আসিবেন, তাঁহাদের সকলকে প্রণাম।