1 of 3

০১।১ প্রথম কাণ্ড : প্রথম অনুবাক

অথর্ববেদসংহিতাপ্রথম কাণ্ড । প্রথম অনুবাক
প্রথম সূক্ত : মেধাজননম
[ঋষি : অথর্বা দেবতা : বাচস্পতি ছন্দ : অনুষ্টুপ, বৃহতী]

প্রথম মন্ত্রঃ ওঁ যে ত্রিষপ্তাঃ পরিয়ন্তি বিশ্বা রূপাণি বিভ্রতঃ। বাচস্পতিবলা তেষাং তম্বো অদ্য দধাতু মে।

বঙ্গানুবাদ –যে লোকপ্রসিদ্ধ অনন্ত-ঐশ্বর্যশালী ত্রিসপ্ত–অশেষ রূপ পরিগ্রহ করে, নিখিল বিশ্বের মঙ্গল-সাধনে সর্বদা সর্বতোভাবে পরিভ্রমণ করছেন, বেদবিদ্যাধিষ্ঠাত্রী দেবতা হে বাচস্পতি! আপনি সেই ত্রিসপ্তের (নিখিল দেবস্বরূপের) আত্মশক্তি এক্ষণে আমার সম্বন্ধে বিধান করুন (যে প্রকারে আমি সেই শক্তি লাভ করতে পারি, সেই জ্ঞান আমাকে প্রদান করুন)

মন্ত্ৰাৰ্থ আলোচনা –অথর্ববেদের প্রথম মন্ত্র (যে ত্রিষপ্তা ইত্যাদি) মেধাজনন-প্রার্থনা-মূলক। কমমাত্রেই মেধা, বুদ্ধি বা জ্ঞান, প্রধান ও প্রথম প্রয়োজন। এই মন্ত্রে, কর্মারম্ভের প্রথমেই তাই জ্ঞানাধিপতি দেবতার (বাচস্পতির) নিকট ভগবদাত্মভূত শক্তি-সামর্থ্যের প্রার্থনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে,-হে জ্ঞানাধিপতি দেব, ভগবানের সম্বন্ধযুত শক্তি-সামর্থ্য-জ্ঞান আপনি আমাকে দান করুন। লক্ষ্য এই যে, তদাত্মশক্তিসম্পন্ন হলে শ্ৰেয়োলাভে আর কোনই বিঘ্ন ঘটবে না। সৎ-জ্ঞানের মধ্য দিয়েই সেই শক্তি লাভ হয়; তাই জ্ঞানাধিষ্ঠাতৃ দেবতার নিকট মেধাজনন জন্য প্রার্থনা জানান হচ্ছে। কি ভাবে, কি অবস্থায় এই মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়, ভাষ্যে তার আভাষ আছে। কর্মিগণ উপযুক্ত গুরুর সাহায্যে সেই কর্মে প্রবৃত্ত হতে পারবেন।

এই মন্ত্রটি অতি গভীর ভাবদ্যোতক। এর অন্তর্গত প্রথম শব্দ, যে। এই সর্বনাম পদ পূর্ববর্তী আকাঙ্ক্ষার দ্যোতনা করছে। তা থেকে বোঝা যাচ্ছে,–ঐ যে শব্দে সেই লোকপ্রসিদ্ধ সর্বেশ্বরের প্রতিই লক্ষ্য আসছে। তার পরত্রিষপ্তাঃ। এই পদ সম্বন্ধে ভাষ্যকার বহু গবেষণা করেছেন। তিন আর সাত (ত্রি ও ও ২ সপ্ত)–এই দুই-এর যত কিছু সম্বন্ধ থাকতে পারে, ঐ শব্দে তা-ই আমনন করা হয়েছে। পরিশেষে ঐ শব্দে যে সেই অনন্তরূপ পরমেশ্বরকেই বুঝিয়ে থাকে, ভাষ্যকারগণ তা-ই সিদ্ধান্ত করে গেছেন। ত্রি শব্দে এিকাল এবং সপ্ত শব্দে সপ্তলোক; তিন কাল (চিরকাল) সপ্তলোক (অখণ্ড বিশ্ব) ব্যেপে যিনি বিদ্যমান রয়েছেন, ঐ দুটি শব্দের প্রয়োগে তা-ই বোঝা যায়। সত্ত্বরজস্তমঃ–তিন গুণকে বা তিন গুণের আধারকে ত্রি শব্দে বোঝাতে পারে; ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ঐ ত্রি শব্দেই অভিব্যক্ত হন। সপ্তশব্দে সপ্তর্ষি, সপ্তগ্রহ, সপ্তমরুত্বর্গ, সপ্তলোক প্রভৃতি অর্থও এখানে ভাষ্যকার গ্রহণ করেছেন। ত্রিসপ্ত বলতে শেষে অনন্ত ভাব স্বীকৃত হয়েছে। ত্রিসপ্ত থেকে একবিংশ রূপ অর্থও গ্রহণ করা হয়। সেই অনুসারে, পঞ্চমহাভূত, পঞ্চপ্রাণ, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণসমন্বিত দেহ বা দেহীকে বুঝিয়ে থাকে। এইভাবে, নানা অর্থের মধ্য দিয়ে শেষে ঐ ত্রিষপ্তা শব্দে অনন্তরূপ পরমেশ্বরের প্রতিই লক্ষ্য আসে। তারপর ক্রিয়াপদ পরিয়ন্তি। প্রতি দিন, প্রতি কল্পে, প্রতি শরীরে, যথাবিধি পর্যাবর্তন করছেন অর্থাৎ জড় অজড় সকল পদার্থে সর্বদা বিদ্যমান রয়েছেন–এই ভাবে ঐ ক্রিয়াপদে প্রকাশ করছে। শ্রীভগবান্ যে সকলের মধ্যেই বিরাজমান থেকে ক্রিয়া করছেন, এখানে তা-ই বোঝা যায়। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশ–বিশ্বরূপাণি বিভ্ৰতঃ। ভাবার্থ এই, জগতের সকলের প্রতিই অনুগ্রহ-বিতরণের জন্য তিনি সকল রূপ সকল আকার পরিগ্রহ করে আছেন। তিনি চেতনাচেতনাত্মক সকল বস্তুকে অভিমত ফল প্রদান পূর্বক পোষণ করছেন। মন্ত্রের প্রার্থনা–সেই যে তিনি এিষপ্তা তিনি অদ্য তাঁর আত্মশক্তি আমাকে প্রদান করুন। মন্ত্রে আছে–তন্ব এবং বলা। ঐ দুই শব্দের (তদা, বলানি) সাধারণ অর্থ-শরীরের বল। সেই ত্রিষপ্তা আমাকে তাদের শরীরের বল দেন,– বাক্যার্থ এমন হলেও, তার ভাবার্থ এই যে,তদাত্মভূত শক্তি যেন আমরা পাই। কিন্তু তদাত্মভূত শক্তি বলতে কি বোঝায়? এখানে ভগবানের স্বরূপ স্মরণ করতে হয়। বহু ব্যষ্টিশক্তির সমষ্টিতে তিনি সমষ্টিভূত শক্তি; তাই তাকে ত্রিষপ্তাঃ অনন্ত-নামরূপধারী অনন্ত শক্তিসম্পন্ন বলা হয়েছে। তার যে শক্তি, সে শক্তি অবিমিশ্র সত্ত্বভাবাপন্ন। যত কিছু দেবশক্তি, সকলই তার সেই শক্তির অন্তর্নিহিত। এখানে তাই বলা হয়েছে–তদন্তৰ্গত দেবশক্তিসমূহ যেন আমি প্রাপ্ত হই। বাচস্পতি–জ্ঞানদাতা দেব। জ্ঞানের মধ্য দিয়েই সকল শক্তি–সকল সৎ-ভাবমূলক শক্তি প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাই জ্ঞানাধিপতি দেবতাকে প্রথমেই আহ্বান করা হয়েছে। জ্ঞানোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে-সৎ-বৃত্তি সৎ-ভাবের সমাবেশে ভগবানের স্বরূপ-শক্তি লাভ হয়। এখানকার প্রার্থনা,-হে দেব! আমায় সেই জ্ঞান দাও, যেন আমি সেই জগৎপতি জগন্নাথের স্বরূপ প্রাপ্ত হই।–এই মন্ত্রের ভাষ্যে ভাষ্যকার, দেবতত্ত্ব-বিষয়ে আলোচনা করেছেন। পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ রূপে, বাদ-প্রতিবাদ-সূত্রে ভাষ্যে দেবকর্তৃত্ব প্রতিপন্ন করা হয়েছে।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ পুনরেহি বাচস্পতে দেবেন মনসা সহ। বসোপতে নি রময় ময্যেবাস্তু ময়ি তং

বঙ্গানুবাদ –হে জ্ঞানাধিপতি! সত্ত্বগুণের দ্বারা (আমাকে) উদ্ভাসিত করে আমার মনের সাথে আপনি মিলিত হোন। (হে দেব! আপন জ্ঞানরূপ প্রকাশের দ্বারা আমার অন্তঃকরণকে সত্ত্বগুণযুক্ত করে, সেই অন্তঃকরণে আপনি বিরাজ করুন)। হে জ্ঞানরূপ ঐশ্বর্যের অধিপতি! আমার অন্তরে অধিষ্ঠিত থেকে, আমাকে মেধাসমৃদ্ধি প্রদানপূর্বক আনন্দিত করুন। আপনার প্রসাদে আমার জ্ঞান প্রমাদ-পরিশূন্য হোক।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্র পূর্ব-মন্ত্রোক্ত বাচস্পতির উদ্দেশ্যেই প্রযোজিত হয়েছে। মন্ত্রের প্রথম অংশে সাধকের আপন অন্তঃকরণে জ্ঞানাধিপতির মিলন, আগমন অর্থাৎ বিকাশ প্রার্থনা সূচিত রয়েছে।

এই অংশে মনসা পদের যে দেবেন বিশেষণ দৃষ্ট হয়, তা অতি গভীর ভাবোদ্দীপক। এস্থলে দেব শব্দের অর্থ-দীপ্তিযুক্ত। যখন অন্তঃকরণে বিশুদ্ধ জ্ঞান বিকাশ পায়, তখন তাতে রজঃ তমঃ গুণ থাকতে পারে না; কেবল সত্ত্বগুণ আশ্রয় করে; সেই সত্ত্বগুণের প্রভাবে মন (অন্তঃকরণ) স্বচ্ছ আলোক প্রাপ্ত হয়; এখানে তেমনই অন্তঃকরণ লক্ষ্য রয়েছে। যতক্ষণ সত্ত্বগুণ সম্পূর্ণভাবে অন্তঃকরণকে অধিকার না করে, ততক্ষণ মন কলুষিত বা মলিন ভাবাপন্ন হয়ে থাকে; সেই মলিনাবস্থায়, মলিন দর্পণে প্রতিবিম্বের ন্যায়, পরমেশ্বরের দর্শন পাওয়া যায় না। অতএব, মনের মালিন্য দূর করতে হলে, বিশুদ্ধ জ্ঞানপ্রবাহের আবশ্যক। তাই সাধক ডাকছেন,-হে জ্ঞানাধিপতি! আমার সত্ত্বগুণযুক্ত অন্তঃকরণের সাথে মিলিত হোন; আমার হৃদয়ের ৩মঃ ও রজঃ গুণ নাশ করে আমাতে পরিপূর্ণ সত্ত্বগুণের বিকাশ করুন।-মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের বসোপতে পদের দ্বারাও সেই জ্ঞানাধিপতিকেই আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু ভাষ্যকার বসু শব্দে গ্রামাদিরূপ সম্পওির অধিপতি অর্থ করে, পরে প্রাণাধিপতি অর্থ করেছেন। যাই হোক, আমরা বসু শব্দে মেধা-জ্ঞানরূপ সম্পত্তিকে ধরে, উক্ত শব্দে হে মেধা-জ্ঞানরূপ সমৃদ্ধিস্বামি অর্থ গ্রহণ করলাম। এ ক্ষেত্রে, প্রথম ময়ি পদে সামীপ্যার্থে সপ্তমী ও এব শব্দে দূর-ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। সুতরাং ঐ দুই পদে আমার নিকটেই–দূরে নয় এইরকম অর্থই প্রতীত হয়। দ্বিতীয় ময়ি পদে আধার (আশ্রয়) অর্থে সপ্তমী, সুতরাং আমার আশ্রিত এমন অর্থও হতে পারে। যিনি যে পদার্থের অধিস্বামী, প্রার্থীকে তিনি তা দান করতে পারেন। তাই সাধক তাকে ডাকছেন,–হে সমস্ত মেধা-জ্ঞান-সমৃদ্ধি-স্বামি ভগবন্! আপনি আমার মধ্যে প্রকটিত হয়ে, আমাকে মেধা ও জ্ঞানরূপ সম্পত্তি প্রদানের দ্বারা আনন্দিত করুন। ২৷৷

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ ইহৈবাভি বি তনূভে আত্নী-ইব জয়া। বাচস্পতির্নি যচ্ছতু ময্যেবাস্তু ময়ি তং ৩ ॥

বঙ্গানুবাদ –হে জ্ঞানাধিদেব! যেমন ধনুকে যোজিত গুণ (ছিলা) ধনুকের দুই অগ্রভাগকে শরক্ষেপকের অভিমুখে আকর্ষণ করে, সেই রকম আপনার উপাসক এই আমাকে ঐহিক ও পারত্রিক ফল-সাধক যে মেধা ও জ্ঞান–এই উভয়ের প্রতি সর্বতোভাবে আকর্ষণ করুন। হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমার-বিষয়িণী বেদরূপা বাণীকে নিয়মিত করুন; (যাতে আমার সমুদায় ব্যক্য পরমার্থের অনুসরণ করে, সেইরকম বিধান করুন)। আপনার অনুগ্রহে আমার শাস্ত্রজ্ঞান (গুরু গণের নিকট হতে যে সকল উপদেশ-বাক্য শ্রবণ করেছি, সেই সমুদায়) আমাতে সুস্থির হোক। (ভাবার্থ-হে দেব! আপনি বাক্যের অধিপতি, সুতরাং আপনিই বাক্যকে যথাযথ নিয়মিত করতে সমর্থ। অতএব, যেভাবে আমার বাণী (বাক্য) সত্য অর্থ প্রকাশ করতে সমর্থ হয়, সেই ভাবে তাকে নিয়মিত করুন। ৩।

মন্ত্রাৰ্থআলোচনা— এই মন্ত্রও বাচস্পতিদেবের নিকট প্রার্থনা-মূলক। এই মন্ত্রের কয়েকটি পদ বিশেষ ভাবে আলোচ্য। ইহ এব এই স্কুলে ইদ শব্দ নিস্পাদিত ইহ শব্দে অতি নিকটস্থিত বস্তুকে বোঝায়। যিনি যে দেবতার উপাসনা করেন, তিনি ক্রমশঃ তার নিকটে অগ্রসর হতে থাকেন। মানস-দৃষ্টিতে বা অন্তরদৃষ্টিতে উপাস্যকে অতি নিকটেই দেখতে পাওয়া যায়।…এই স্থলে ইহ শব্দ উপাস্য-উপাসক ভাব-সম্বন্ধের দ্বারা বাচস্পতিদেবের ও সাধকের পরস্পর নিকটবর্তিত্ব সূচিত করছে। উভে এই পদস্থিত উভ শব্দ স্বভাবুতঃ দুটি বস্তুকে বোঝায়। ঐ পদে পূর্বপ্রার্থিত মেধা ও জ্ঞানকে বোঝাচ্ছে। উক্ত মেধা ও জ্ঞান–ঐহিক ও পারত্রিক এই উভয়বিধ শুভ ফলের জনক! …এই মন্ত্রে প্রার্থনাকারী আপন উপাস্যদেব ভগবান্ বাচস্পতির নিকট উক্ত দুরকম ফলজনক মেধা ও জ্ঞানের অসাধারণ বৃদ্ধি প্রার্থনা করছেন। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে যে বাচস্পতিঃ শব্দ আছে, ভাষ্যকারের মতে তার অর্থ বিধাতা। বাচঃ + পতিঃ এমন বিশ্লেষণের দ্বারা অর্থ করলেও লক্ষ্য স্থির হয়। পতি শব্দের অর্থ পালক বা রক্ষাকর্তা। সেই অনুসারে মেধা ইত্যাদির সমৃদ্ধির পালক সেই ভগবান্ বাচস্পতিই লক্ষ্যস্থল হন। তা হলে নিযচ্ছতু এই ক্রিয়ার সাথে অন্বয় করবার জন্য যুগ্মদর্থক ভবৎ (ভবান) শব্দ অধ্যাহার করার আবশ্যক হয়। এবং বাচঃ এই বিশ্লিষ্ট পদের অর্থ বেদরূপ ব্যাক্যসমূহ অথবা জ্ঞানপ্রযুক্ত ভাষা-স্বীকার করতে হয়। তাতে ভাবার্থ দাঁড়ায় এই যে,–যিনি প্রভু, তার অসাধ্য কি আছে! হে দেব! আপনি প্রভু; আপনি আমার এমপ্রমাদজড়িত বাক্যসমূহকে বিশুদ্ধ করে প্রকৃত পরমার্থপথে পরিচালিত করুন; আমি যেন আপনার প্রসাদে শাস্ত্রীয় গূঢ়ার্থ সম্পদ বাক্যসমূহ হৃদয়গত করতে পারি ॥ ৩

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ উপহূত বাচস্পতিরুপাম্মান বাচস্পতিয়তাং। সং শুতেন গমেমহি মা তেন বি রাধিষি ॥৪॥

বঙ্গানুবাদ –হে দেব! আপনি জ্ঞানাধিপতি ও ভক্তপ্রার্থনাপূরক। আমাদের অর্চনার দ্বারা আহুত হয়ে আপনি বেদজ্ঞানের নিমিত্ত আমাদের (আমাকে) মেধা ইত্যাদি শক্তি প্রদান করুন। যাতে (আমি) আমরা (যথাবিধি অধীত বেদ ইত্যাদি শাস্ত্রজনিত) জ্ঞানের সাথে মিলিত হতে পারি; এবং সেই জ্ঞানের সম্বন্ধ হতে কখনও যেন বিচ্ছিন্ন না হই। (প্রার্থনার ভাব এই যে,–যাতে কখনও আমি শাস্ত্রজ্ঞানচ্যুত না হই, সেই ভাবে আমার মেধা ও বল সম্পাদন করুন)

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের প্রথম অংশে বাচস্পতিঃ পদ দুবার উল্লিখিত হয়েছে। ভাষ্যকারের মতে–ঐ দুই পদেরই অর্থ এক। কিন্তু একই বিষয়ে একই অর্থে একই পদের পুনরূল্লেখ হওয়া সঙ্গত নয়। অতএব দ্বিতীয় বাচস্পতিঃ পদের বাচঃ + পতিঃ এইরকম পদ বিশ্লেষণের দ্বারা অর্থসঙ্গতি হবে। বাচঃ এই পদে বেদরূপ বাক্য বোঝাচ্ছে। ভাষ্যকারের মতে উপহুতঃ এই পদের অর্থ সমীপে আহুত। কিন্তু এখানে উপ শব্দের অর্থ পূজা। তাতে, পূজার্থ আহুত এইরকম অর্থ করা যেতে পারে। উপয়ং  এই পদের অনুজ্ঞা করুন–আদেশ করুন এইরকম অর্থ ভাষ্যকারও প্রকাশ করেছেন। যিনি বাক্য বা জ্ঞানের অধিপতি, তার প্রদও শক্তি ব্যতীত কি ভাবে জ্ঞানলাভ সম্ভবপর? অতএব, তারই নিকটে মেধা ইত্যাদি। লাভরূপ অনুকম্পা প্রার্থনা করা হয়েছে।-মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে সাধক প্রার্থনা করছেন–আপনার প্রসাদে প্রাপ্ত মেধা ইত্যাদির সমৃদ্ধির দ্বারা আমি যেন জ্ঞানের সাথে মিলিত হই; কখনও যেন জ্ঞান-সম্বন্ধ হতে বিচ্যুত না হই। জ্ঞান না হলে, মনুষ্য কখনই মনুষ্য হতে পারে না। এ জ্ঞান সাধারণ জ্ঞান নয়; যে

জ্ঞানালোকে পরম-পদার্থ দৃষ্ট হয়, সেই জ্ঞানই এখানকার প্রার্থনীয়। মেধা (ধারণাশক্তি) না থাকলে, শাস্ত্র গ ইত্যাদির উপদেশ বিস্মৃত হতে হয়। যা শুনলাম, তা যদি ভুলে গেলাম, তা হলে সে উপদেশ শ্রবণে ফল কি? অতএব, মেধাই এই সূক্তের প্রধান প্রার্থনীয় বস্তু।–জীব! যদি পরিত্রাণ পেতে চাও, তবে সাধনার মূলীভূত সামগ্রী সত্ত্বভাবকে মেধার সাহায্যে (ধৃতির বন্ধনে) হৃদয়ে আবদ্ধ করে রাখো। এটাই এই সূক্তের শিক্ষা।

.

দ্বিতীয় সূক্ত : রোগোপশমনম

 [ঋযি : অথর্বা দেবতা : পর্জন্য ছন্দ : অনুষ্টুপ, গায়ত্রী ]

প্রথম মন্ত্র: বিদ্মা শরস্য পিতরং পজ্জন্যং ভূরিধায়সং। বিদ্মো স্বস্য মাতরং পৃথিবীং ভূরিবর্পসং ॥১॥

বঙ্গানুবাদ –সাধকের অভীষ্টদায়ক, চরাচরাত্মক জগতের পোষণকর্তা, লোকহিতকারী ও অভিলষিত প্রদানের দ্বারা ভক্ত-বাঞ্ছাপূরক, এবস্তৃত পরমপুরুষকে আমরা রিপুহিংসক, অজ্ঞানরূপ ব্যুহভেদকারী শরের (যোগকর্মের) জনক বলে জানি; অর্থাৎ জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা দেখতে পাই। চরাচর জগতের আধারস্বরূপ, বিস্তীর্ণা পৃথিবীকে (প্রকৃতিকে) তার (শরের, যোগকর্মের) জননী-রূপে জানি। (ভাব এই যে,–জনকস্বরূপ পুরুষের জগৎপোষক গুণের প্রভাবে শরযোগকর্মও সেইরকম শক্তিসম্পন্ন বলে প্রতীত হয়। এইরকম জননীস্বরূপ প্রকৃতির বহুরূপাশ্ৰয়ত্বগুণের দ্বারা তার নানাবিধত্ব সপ্রমাণ হয়ে থাকে। ১।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সংগ্রাম-জয়ের প্রধান কারণ বাণের উৎপত্তি এবং তার জনক-জননীর বিষয় ভাষ্যকার আলোচনা করেছেন। এদিকে আবার, যুদ্ধজয় কার্য, জ্বরাতিসার প্রভৃতি রোগের শান্তি, অপরাজিতা নামক মহাশান্তি ও পুষ্পভিষেক কর্ম–এই সমস্ত বিষয়েও দ্বিতীয়সূক্তস্থিত মন্ত্ৰসকল প্রযুক্ত হয়,–এ-ও ভাষ্যকারই অনুক্রমণিকায় বলেছেন।…মন্ত্র নিত্য-সত্য। তার প্রয়োগ একাধিক কার্যে সুসিদ্ধ হয়। সংগ্রাম-জয়-বিষয়েও মন্ত্রের যেমন উপযোগিতা, রোগ ইত্যাদির শান্তি প্রভৃতির পক্ষেও তার সেইরকম আবশ্যকতা।-মন্ত্র সর্ব-জ্ঞানের আধার।…মন্ত্রের উদ্দেশ্য জীব সর্বদা সৎপথে সৎকর্মে নিরত হোক; আত্মজ্ঞান লাভ করে সংসার-বন্ধন থেকে মুক্ত থোক। এই মন্ত্রও সেই ভাবই প্রকাশ করছে। মন্ত্রের প্রথম অংশ বিঘা শরস্য। শরস্য এই পদে শর শব্দের অর্থ–যে হিংসা করে। যে শত্রুগণকে হিংসা বা নাশ করে, অথবা যার দ্বারা অজ্ঞানরূপ আবরণ বিদীর্ণ হয়, সেই পদার্থই শর শব্দের অভিধেয়। ভাষ্যকারও শর শব্দের ঐরকম ব্যুৎপত্তি করেছেন। কিন্তু তার ব্যাখ্যায় দাঁড়িয়েছে–শর শব্দের অর্থ বাণ। আমরা মনে করি, যে অন্তঃশত্ৰু কাম-ক্রোধ প্রভৃতি নাশ করে, সেই যোগই (সাধনাই) এখানে শর শব্দের লক্ষ্য। পর্জন্য পদে–যিনি তৃপ্তি দান করেন এবং যিনি সর্বজনের মঙ্গল করে থাকেন, তাকেই বুঝিয়ে থাকে। ভাষ্যেও ঐরকম অর্থই দেখা যায়।….ভূরিধায়সং পদ পরমপুরুষের গুণ প্রকাশ করছে। যিনি ভূরি অর্থাৎ বহুকে ধারণ বা পোষণ করেন, তিনিই ভূরিধায়স।… পিতরং পদের সাধারণতঃ যে জনক-রূপ অর্থ প্রচলিত আছে, এখানেও সেই অর্থ অব্যাহত মনে করি। যিনি বিশ্বজগতের জনক, যা থেকে এই চরাচর উৎপন্ন হয়েছে, তিনিই যে যোগ বা সাধনার জনক, তা বলাই বাহুল্য। এই সকল বিষয় বিবেচনা করলে, মন্ত্রের প্রথম অংশের ভাবার্থ হয় এই যে,-কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এই ছয় রিপু সর্বদা জীবাত্মার সাথে সংগ্রাম করছে। ঐ. অন্তঃশত্ৰুসকলের দমনকারী শর (যোগ-সাধনা) জীবন-যুদ্ধে জীবের একমাত্র সহায়। সর্বনিয়ন্তা, চরাচর জগতের হিতৈষী, সেই প্রমপুরুষই সেই শরের বা যোগের জনক, এটা আমরা জ্ঞান-চক্ষে দেখতে পাই।–মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের পৃথিবী এই পদের পৃথিবী শব্দে বিস্তীর্ণ ভূমিকে বোঝায়–এটাই ভাষ্যকারের মত। কিন্তু পৃক্ষু অর্থাৎ স্থূলবস্তু; তার-সম্বন্ধিনী এই অর্থেও পৃথিবী শব্দ নিষ্পন্ন হয়। তাতে স্থূলদেহ-সম্বন্ধিনী যে প্রকৃতি, তা-ই পৃথিবী শব্দ থেকে পাওয়া যায়। আমরা মনে করি, এখানে পৃথিবী শব্দের অর্থ প্রকৃতি। ভূরিবর্পসং শব্দ পৃথিবীর বিশেষণ। ভূরিবর্পস্ শব্দের অর্থ, যাতে ভূরিবর্পস অর্থাৎ বহুবিধ রূপ, চরাচরময় জগৎ বিদ্যমান আছে বা দৃষ্ট হয়ে থাকে। ভাষ্যে ঐরকম অর্থই দেখতে পাই। তাহলে, মন্ত্রের ভাবার্থ হয় এই যে,চরাচর জগতের আধারস্বরূপা স্থূলদেহসম্বন্ধিনী ত্রিগুণময়ী এই প্রকৃতিই যোগ বা সাধনার জননী। এই স্থূলদেহেই প্রথমে সাধনার অঙ্কুর উৎপন্ন হয়, পরে ক্রমশঃ সাধক সূক্ষ্ম পথে সম্মতত্ত্ব অবগত হয়ে, পরমাত্মায় যুক্ত (মিলিত) হতে পারেন। তাতে বিলীন হওয়াই সাধনার পরাকাষ্ঠা বা মুক্তি।–এই মন্ত্রে শরের এবং তার পিতা-মাতার উল্লেখ আছে দেখে, কোনও কোনও ব্যাখ্যাকার তৃণপর্যায়ভুক্ত শরকে লক্ষ্য করেছেন। পর্জন্য শব্দে মেঘ এবং ভূরিধারসং শব্দে প্রচুর বর্ষণশীল প্রভৃতি অর্থ করে, মেঘকেই শরের জনক বলে কল্পনা করা হয়েছে। পৃথিবীই তাদের উৎপত্তিস্থান–এইজন্য পৃথিবীকে তাদের মাতা রূপে গ্রহণ করা হয়েছে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ, প্রায় সকলেই এই মতেরই প্রতিধ্বনি করে থাকেন। সায়ণের ভাষ্যেও এই মত প্রচ্ছন্নভাবে বিদ্যমান রয়েছে। তবে এই সূত্রে, বেদের নিত্যত্ব অনিত্যত্ব, পৌরুষেয়ত্ব অপৌরুষেয়ত্ব প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করে, তিনি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তা বিশেষ অনুধাবনার বিষয়। শেষ পর্যন্ত তিনি বিচার করে দেখিয়েছেন–বেদ স্বতঃসিদ্ধ, প্রামাণ্য এবং পুরুষ প্রযত্ন বিরহিত বলে নিত্য ॥১॥

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ জ্যাকে পরি-ণো নমাম্মানং তন্বং কৃধি। বীদুর্বরীয়োহরাতীরপ দ্বেষাংস্যা কৃধি ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –হে সর্বজগতের বিলয়ভূমি প্রকৃতি! তুমি আমার সম্বন্ধে সত্ত্বগুণরূপে পরিণত হও; (তুমি সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণস্বরূপা হলেও আমার অন্তরে কেবল সত্ত্বগুণস্বরূপা হয়েই বিরাজ করো)। আমার শরীরকে পাষাণের ন্যায় কঠিন করো, অর্থাৎ আমাকে সাধনায় সক্ষম করো। (প্রথমে প্রকৃতিকে প্রার্থনা করে সাধক পরে জীবনসংগ্রামে একমাত্র সহায় সেই ভগবানের নিকট প্রার্থনা করছেন) হে অনন্তশক্তিশালিন্ সর্বশ্রেষ্ঠ দেব! অন্তঃশত্ৰু কাম ইত্যাদির সহকারী মোহ-মায়া প্রভৃতির স্তম্ভনকর্তা আপনি আমার বহিঃশত্রু ও কাম ইত্যাদি অন্তঃশত্রু এবং তাদের কৃত অপকার সকলকে দূর করুন; তারা যেন আর আমাকে উদ্বিগ্ন (আক্রমণ) করতে না পারে। (ভাবার্থ-হে ভগবন্! আপনার কৃপায় কাম ইত্যাদি শত্রুভয়ে যেন আমাকে ভীত হতে হয় না)। ২।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রে প্রকৃতির ও পুরুষের নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে। মন্ত্রের প্রথম পদদ্বয়–জ্যাকে পরি। জ্যাকে এই পদটি জ্যাকা শব্দের সম্বোধনে নিষ্পন্ন। জ্যা শব্দে সাধারণতঃ, ধনুকের ছিলাকে বোঝায়। কুৎসিত জ্যা এই অর্থে জ্যাকা শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে; এমন অর্থই ভাষ্যে লিখিত আছে। কিন্তু আমরা বলি,-যাতে চরাচর জীর্ণ হয় এই ব্যুৎপত্তি থেকে জ্যা শব্দে প্রকৃতিকে পাচ্ছি; এবং ঐ জ্যা শব্দের উত্তর বিহিত কন্ (ক) প্রত্যয়ে সেই প্রকৃতির স্বভাব অতি দুবোধ এমন অর্থ প্রকাশ করছে।…পরিণম এই ক্রিয়াটির দ্বারা সাধক নিজের সম্বন্ধে প্রকৃতির পরিণতি অর্থাৎ স্থিতি প্রার্থনা করছেন। কিন্তু প্রকৃতির পরিণম বা স্থিতি কি ভাব প্রকাশ করে? এই চরাচরের স্থিতি ও লয়, যথাক্রমে রজঃ, সত্ত্ব ও তমঃ এই গুণত্রয়ের দ্বারা সংসাধিত হয়ে থাকে; এবং এই ত্রিগুণময়ী প্রকৃতি হতেই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় সাধিত হয়। সত্ত্বভাবই স্থিতি বা পরিণাম। প্রকৃতি সত্ত্বগুণময়ী হোক–এটাই এখানে সাধকের প্রার্থনা। দ্বিতীয় প্রার্থনার বিষয়–তন্বং অশ্মানং (তনুং অশ্মসদৃশীং) অর্থাৎ আমার শরীরকে পাষাণের ন্যায় কঠিন করো।-সাধনার পথে অনেক অন্তরায়, বহু বিঘ্ন। মায়া, মমতা, স্নেহ, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ইত্যাদি বহু উপসর্গ এসে মনকে বিচলিত করে নিয়ে যায়, এবং শরীরকে নানারকম ক্লেশ দান করে বিপথে বিভ্রান্ত করে। সেই আশঙ্কায় সাধক, প্রকৃতিদেবীর সমীপে শরীরের (স্কুল ও সূক্ষ্ম দেহের) প্রস্তরের ন্যায় কঠিনতা প্রার্থনা করছেন।–অতঃপর মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের একটি বিশিষ্ট পদ–বীডুর্বরীয়ঃ। এই অংশে বরীয়ঃ পদটি বরীয় শব্দের সম্বোধনে নিষ্পন্ন। ঐ পদের দ্বারা কোন শ্রেষ্ঠ পুরুষকে সম্বোধন করা হয়েছে বোঝা যায়। সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অদ্বিতীয়–কে তিনি? বোঝা যায়, এখানে সেই পরম পুরুষকেই আহ্বান করা হয়েছে। বীডুঃ পদের অর্থ–যিনি লজ্জিত করেন। কিন্তু ভাষ্যে স্তম্ভনকারী এমন অর্থ দেখতে পাই। যে সহসা লজ্জা প্রাপ্ত হয়,সেই স্তম্ভিত হয়ে থাকে, এটি স্বতঃসিদ্ধ। এখানে ঐ পদে কাম ইত্যাদি রিপুগণের স্তম্ভনের ভাবই অধ্যাহৃত হচ্ছে। অরাতীঃ ও দ্বেষাংসি এই দুটি পদের অর্থ সাধারণতঃ শত্রু ও তকৃত অপকার, কিন্তু এটা কেবল বহিঃশত্রুকে ও বাহিরের অপকারকে বোঝাচ্ছে না। এর দ্বারা অন্তর-শত্ৰু কামক্রোধ প্রভৃতি এবং তাদের কৃত অনিষ্ট–এই উভয়কেও বোঝাচ্ছে। এইরকম আলোচনায়, মন্ত্রের ভাবার্থ হয় এই যে, হে মায়ামোহ ইত্যাদি-রহিত অলৌকিক-শক্তিসম্পন্ন দেব! আপনি আমার কাম ইত্যাদি অন্তঃশত্রুদের এবং তাদের সহচর মায়ামোহ প্রভৃতিকে স্তম্ভিত করুন। আমার অন্তঃশত্ৰু কাম ইত্যাদি ও নানারকম বহিঃশত্রুসকলকে এবং তাদের কৃত অপকারকে (অনিয়মকে) আপনি নাশ করুন। তারা আমার যেন কোনও অনিষ্ট না করতে পারে। হে দেব! আমার দেহ যেন পাষাণের ন্যায় দৃঢ় হয়, আমার অন্তর যেন সাত্ত্বিকভাবে পবিত্র হয়। আমি যেন সৎ-ভাবসম্পন্ন হয়ে আপনাকে প্রাপ্ত হই–এই আমার প্রার্থনা।–এটাই এই মন্ত্রের স্বরূপ ॥ ২॥

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ বৃক্ষং যাবঃ পরিষস্বজানা অনুস্ফুরং শরমচ্চন্ত্যভুং। শরুমম্মদাবয় দিমিন্দ্র ॥ ৩॥

বঙ্গানুবাদ –মৌর্বী (ধনুগুণ) যেমন ধনুষ্কোটিতে আরোপিত হয়ে ধনুর্দণ্ডকে অনুসঞ্চালন পূর্বক শাণিত শরকে (শত্রুর অভিমুখে) প্রেরণ করে, সেইরকম হে ইন্দ্রদেব! বজ্রবৎ প্রকাশমান হিংসাকারী শত্রুশরকে আমাদের নিকট হতে (সঞ্চালিত করে) দূরে অপসারিত করুন। (ভাবার্থ– প্রক্ষেপ-বলের দ্বারা উৎক্ষিপ্ত স্বসংশ্লিষ্ট বাণ ধনুগুণ যেমন অন্যত্র প্রেরণ করে থাকে; তেমনি, হে ভগবন্! আপনার শক্তির প্রভাবে আমি আমার অন্তরস্থিত রিপুশত্রুদের দমন করতে বা দূরে। নিক্ষেপ করতে সমর্থ হবো) ৷৷ ৩৷৷

অথবা, আমাদের জ্ঞানসমূহ, সৎ-ভাবসংশ্লিষ্ট হয়ে, মূলস্বরূপ দেবকে আপন প্রকাশ জ্ঞানে, যাতে অনাবিল। যোগ-সাধনা (ভগবৎ-সান্নিধ্য) প্রাপ্ত হয়, তা করুন; আরও, হে ভগব! বজ্রবৎ কঠোর হিংস্র কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুশত্রুদের আমাদের নিকট হতে দূরে অপসারিত করুন। (ভাবার্থ-আমাদের জ্ঞান ভগবৎ-সম্বন্ধযুত হোক। হে ভগবন্! আপনি আমাদের রিপুশত্রু বিমর্দিত করুন) ॥ ৩

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের আমরা দুরকম অর্থ নিষ্কাষিত করলাম। এক রকম অর্থ প্রায়শই ভাষ্যের অনুসারী; অন্য অর্থ–ভাবমূলক। ভাষ্যকারও মন্ত্রটির ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে নানারকম অর্থ কল্পনা করেছেন। আমরা মন্ত্রের প্রথম যে অর্থ নিষ্কাষণ করলাম, দ্বিতীয় অর্থের সাথে তার ভাবসঙ্গতি রক্ষার চেষ্টা আছে। দুই দিকের দুই অর্থই একই ভাব ব্যক্ত করছে। অথচ শব্দার্থ দুই দিকেই বিভিন্ন প্রকার। প্রথম ব্যাখ্যায়, শব্দার্থ বিষয়ে সায়ণেরই অনুসরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যায়, শব্দের ভাব মাত্র পরিগৃহীত। প্রথম ব্যাখ্যায়, আমরা মনে করি, একটি উপমা প্রকাশ পেয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই, উভয় প্রকার ব্যাখ্যার মধ্যেই, একজন কর্তার প্রতি লক্ষ্য আসছে। ধনুকে জ্যা যোজনা করলে শর যেমন ধনুদণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অপরের (শত্রুর) প্রতি ধাবমান হয়, অর্থাৎ ধনুকের সাথে যেমন শরের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; হে ভগবন! আমার সাথে শত্রুর সম্বন্ধ সেইরকমভাবে বিচ্ছিন্ন করে দাও। আমার দেহরূপ ধনুষ্কোটিতে কাম-ক্রোধ। ইত্যাদি রূপ হিংস্র শর সংলগ্ন হয়ে আছে; সে শর যার প্রতি প্রযুক্ত হবে, তারই মর্মস্থান ভেদ করবে। তাই প্রার্থনা–আমা হতে তাদের বিচ্ছিন্ন ও বিচ্যুত করুন। আমার সঙ্গে তাদের সংযোগ থাকলে, তারা কারও-না-কারও কোনও-না-কোনও অনিষ্টসাধন করবেই করবে।–এটা অবশ্য স্থূলতঃ প্রার্থনা।–সূক্ষ্ম ভাবে দেখলে উপমার একটা সার্থকতা লক্ষ্য করা যায়। শর শত্রুর প্রতি সাধারণতঃ নিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। আমার সাথে সম্বন্ধযুত শরকে আমা হতে অপসৃত করুন; অথবা, আমার শত্রুর প্রতি তা বিক্ষিপ্ত হোক, এরকম উক্তিতে কি ভাব মনে আসে? কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুবর্গকে যদি একবার শর ও একবার শত্রু পর্যায়ে গ্রহণ করা যায়, তাহলে পূর্বরূপ উক্তির সার্থকতা সুন্দরভাবে প্রতিপন্ন হয়। ঐ যে রিপুশত্রুগণ, তারা আবার পরস্পর পরস্পরেরই বিরুদ্ধাচারী। এ ক্ষেত্রে কণ্টকেনৈব কন্টকং নীতির অনুসরণে; আমার এক অসৎ-বৃত্তির দ্বারা অন্য অসৎ-বৃত্তিকে পর্যুদস্ত করুন–এটাই এ পক্ষে এ মন্ত্রের প্রার্থনা বলা যেতে পারে। দুই ব্যাখ্যাতেই এই একই ভাব আসে। জ্ঞান যদি সৎ-ভাবসংশ্লিষ্ট হয়, চিত্তবৃত্তি যদি মূলাধার ভগবানকে স্বপ্ৰকাশ বলে বুঝতে পারে, তাহলেই ভগবানের সাথে সাধকের মিলনরূপ যোগসাধন আরম্ভ হয়। আর, সে যোগ-সাধনার ফলে, কামক্রোধ ইত্যাদি রিপুবর্গকে ভগবান্ দূরে অপসারিত করেন। এ মন্ত্রের এমন মর্মই আমরা পরিগ্রহ করলাম ৷ ৩৷৷

.

চতুর্থ মন্ত্র: যথা দ্যাং চ পৃথিবীং চান্তস্তিষ্ঠতি তেজনং। এবা রোগং চাম্রাবং চান্তস্তিষ্ঠ মুঞ্জ ইৎ ॥ ৪

বঙ্গানুবাদ –যে প্রকারে দ্যুলোকের ও পৃথ্বীলোকের মধ্যে (উন্নত হয়ে, অর্থাৎ দ্যুলোককে ও পৃথীলোককে অবোদেশে রেখে) বংশদণ্ড অবস্থান করে; সেইরকম, সাধারণ রোগের ও।  মূত্রাতিসারের (প্রকোপের) মধ্যে মুঞ্জমেখলা অবস্থান করুক। (এই মন্ত্র পাঠ করে মুঞ্জমেখলা প্রভৃতি ধারণ করলে মূত্রাতিসার ইত্যাদি বহু রকম রোগের শান্তি হয়–মন্ত্র এই ভাব দ্যোতন করে)

অথবা,

স্বর্গলোকের এবং পৃথিবীর (প্রলোভন-সমূহের) মধ্যে যে প্রকারে ভগবান্ তেজোরূপে অবস্থান করছেন, অর্থাৎ সাধকের হৃদয়ে জ্ঞানরূপে প্রতিষ্ঠিত থেকে তাকে রক্ষা করে আসছেন, সেইরকম, এই পার্থিব ব্যাধি-বিপত্তির মধ্যে এবং পারলৌকিক ইষ্টনাশের মধ্যে মুঞ্জমেখলার ন্যায় যোগসাধনা অবস্থান করুক; অর্থাৎ, যোগ-সাধনার দ্বারা মনুষ্য ঐহিক-পারত্রিক বিপ্ন ও বিপত্তি হতে উদ্ধার লাভ করুক (ভাব এই যে,–দ্যাবাপৃথিবী সম্বন্ধি বিবিধ প্রলোভন হতে ভগবান যেমন সাধককে রক্ষা করেন, সেইরকম যোগ মানুষকে ঐহিকামুষ্মিক (ইহকাল ও পরকালের) বিবিধ বিপদ হতে উদ্ধার করুক)

মন্ত্ৰার্থআলোচনা এ মন্ত্রেরও আমরা দুরকম অর্থই প্রকাশ করলাম। প্রথম ব্যাখ্যা ভায্যের অনুসারী; দ্বিতীয় ব্যাখ্যা–ভাবার্থমূলক। ভাষ্যে প্রকাশ–দ্বিতীয় সূক্তের চারটি মন্ত্র বহু বিধু দূরীকরণে এবং রোগনাশপক্ষে প্রযুক্ত হয়। তার মধ্যে এই চতুর্থ মন্ত্রটি মূত্রাভিসার রোগ নাশের পক্ষে আমোঘ অস্ত্র-স্বরূপ প্রযুক্ত হতে পারে। মুঞ্জমেখলা ধারণে এবং এই মন্ত্র উচ্চারণে, মূত্র নিঃসরণ হয়, ব্যাধি দূরে পলায়ন করে। কিন্তু সেইপক্ষে কি ভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয় এবং কিভাবে মুঞ্জমেখলা ধারণ করার বিধি আছে, ভাষ্যের অনুসরণে তা বোধগম্য হয় না। আপাততঃ আমরা মন্ত্রের ঐ মর্মার্থ প্রকাশ করেই নিরস্ত হলাম। আমরা মনে করি এই মন্ত্রে পরম যোগতত্ত্বের আভাষ প্রদত্ত হয়েছে। কি দ্যুলোক, কি ভূলোক–সর্ব লোকই সেই জ্ঞানস্বরূপ জগদীশ্বরের জ্ঞানের সাথে সম্বন্ধবিশিষ্ট হয়ে অবস্থান করছে। তিনি তেজোরূপে সর্বত্র ওতঃপ্রোত বিস্তৃত রয়েছেন। তার সম্বন্ধ না থাকলে কিছুরই অস্তিত্ব থাকে না। তাঁর সেই সম্বন্ধেরই নামান্তর যোগ। সেই যোগ-সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হলে, সৃষ্টির অস্তিত্ব একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এইজন্যই তাঁর এক নাম–অযুত। সৃষ্টির মধ্যে সমষ্টিভাবে তার যেমন সম্বন্ধ (সংযোগ) আছে, সাধকের হৃদয়ে জ্ঞানরূপে তার তেমনই প্রতিষ্ঠা আছে। সাধক যে আধি-ব্যাধি শোকৃতাপে বিজড়িত নন, তার হৃদয় যে সদা আনন্দময়, তার কারণই এই যে, তার অন্তরে ভগবানের ধারণা প্রস্ফুট রয়েছে।সেই ভগবানের সাথে সম্বন্ধ স্থাপিত হয়, মন্ত্রের সেটাই শিক্ষা। মন্ত্র বলছেন-রোগ হোক শোক হোক, ইষ্টনাশের শত আশঙ্কার মধ্যেও, মুঞ্জমেখলার বন্ধনরূপ যোগের দ্বারা, ভগবানকে চিত্তের সাথে সংযুক্ত করে রাখো। এটাই যোগ-সাধনা। ৪

.

তৃতীয় সূক্ত : মূত্রমোচনম

 [ঋষি : অথর্বা দেবতা : পর্জন্য ইত্যাদি ছন্দ : পংক্তি, অনুষ্টুপ]

প্রথম মন্ত্রঃ বিদ্মা শরস্য পিতরং পর্জন্যং শতবৃষ্ণং। তেনা তে তন্বেত শং করং পৃথিব্যাং তে নিষেচনং বহিষ্টে অস্তু বালিতি ॥ ১ :

বঙ্গানুবাদ –যোগসাধনার জনকস্থানীয়, অশেষ কামনা-পূর্ণকারী, অভীষ্টবর্ষী পর্জন্যদেবকে জানা একান্ত কর্তব্য; যোগের প্রভাবে (যোগজনক দেবতার সাথে মিলনের দ্বারা) তোমার দেহের মঙ্গলবিধান কর্তব্য; তোমার শক্তি এবং প্রাণের নিমিত্ত তোমার অন্তরস্থিত ক্লেদরাশি ইহসংসার হতে অপসারিত হোক। (ভাবার্থ-ভগবানই যোগের জনক বা উৎপত্তি-স্থানীয়। যোগের প্রভাবে তোমার ক্লেদরাশি দূরীভূত হোক; এবং তাতে তোমার অশেষ মঙ্গল সাধন হোক)। ১।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— মন্ত্রে তৃণজাতীয় শরকেই লক্ষ্য করা হয়েছে, ভাষ্যানুসারে তা বুঝতে পারা যায়। পর্জন্য (মেঘ) হতে বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টির দ্বারা তৃণ-পর্যায়ভুক্ত শর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। সেইজন্যই পর্জন্যকে শরের পিতা বলে অভিহিত করা হচ্ছে।…ভাষ্যানুসারে মন্ত্রের প্রথম অংশের অর্থ–অপরিমত বীর্যশালী (বৃষ্টিপ্রদ) যে পন্যদেব, তিনি শরের পিতা, তাকে আমরা জানি। ভাষ্যানুসারে মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণের যে অর্থ অধ্যাহৃত হয়, অতঃপর তার একটু আভাষ দিচ্ছি–সেই যে শর, যার পিতাকে আমরা জানি, সে মূত্রনিরোধ ইত্যাদি ব্যাধিগ্রস্ত জনের শরীরের রোগ নাশ করে। কি প্রকারে? নিষেচনং ও বহিষ্টে পদে তা-ই প্রকাশিত হয়েছে। ঐ শরের প্রভাবে মূত্র নিঃসারণ হয়ে থাকে। সেইজন্যই ঐ দুই পদের সার্থকতা। প্রসঙ্গতঃ একটি শব্দ উচ্চারণের বিষয়ও তাতে খ্যাপিত হয়; বলা হয়ে থাকে যে, বালিতি শব্দ উচ্চারণ করতে করতে রোগীর শরীর হতে বদ্ধমূত্র ভূমিতে পতিত হয়। মন্ত্র কিভাবে উচ্চারণ করতে হয়, তার ক্রিয়াপদ্ধতির বিষয় একমাত্র অভিজ্ঞ জনই বলতে পারবেন। তাছাড়া, এই সূক্তের অনুক্রমণিকায় দেখতে পাই,–মূত্র পূরিষ নিরোধের অবস্থায় এই সূক্তের মন্ত্র কয়েকটি উচ্চারণ পূর্বক রোগীর শরীরে হরিতকী ও কর্পূর বন্ধ করা হয়ে থাকে। ঐ এবং আরও কয়েকটি দ্রব্যের ব্যবহার-বিষয় ঐ অনুক্রমণিকায় থাকলেও সেগুলির বিশেষরূপ ব্যাবহার-বিধি ভাষ্যের মধ্যে বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না। ভাষ্যে যে অর্থই প্রকাশ থাকুক না কেন, আমরা কিন্তু মন্ত্রের মধ্যে এক সর্বজনীন অর্থ লক্ষ্য করলাম। আমাদের মনে হয়, এই মন্ত্রও যোগসাধনার নিমিত্ত জীবকে উদ্বুদ্ধ করছে। ব্যাধিপ্রতিষেধের বিষয় ভাবতে গেলেও বলতে পারি, যোগসাধনাই ব্যাধিনিবৃত্তির প্রকৃষ্ট উপায়। তোমার ঔষধ-পথ্যে কতটুকু কি করতে পারে? যদি যোগের প্রভাবে ভগবানের সাথে মিলিত হতে পারো, ব্যাধি-বিপত্তি তখন আপনিই দূর হয়ে যাবে। বলা হয়েছে, যিনি যোগের জনক, তিনি শতবৃষ্ণ্য (অশেষ কামনাপূরক); তার নাম পন্যদেব। বারিবর্ষণে তিনি ধরণীতে শান্তি-শীতলতা আনয়ন করেন; তার স্নেহাভিষেচনে শুষ্ক বীজ স্নেহভাব প্রাপ্ত হয়। প্রথমেই পর্জন্য-দেবতার সেই স্নেহ ভাবের সম্বন্ধ সূচনা করা হলো; তাৎপর্য এই যে,–তোমার নীরস শুষ্ক হৃদয়ে যদি শুদ্ধসত্ত্ববীজের অঙ্কুরোদ্গম আশা করো, তাঁকে অভীষ্টবর্ষণকারী পর্জন্যদেব বলে হৃদয়ে ধারণা করতে অভ্যস্ত হও। সেই তো এক যোগ। সেই যোগের দ্বারা মন্ত্র বলছেন-দেহের মঙ্গলসাধন হবে, তোমার শক্তি প্রাণ প্রতিষ্ঠার অন্তরায়ভূত অন্তরস্থিত ক্লেদরাশি ইহলোক হতে অপসারিত হবে। এ মন্ত্রে এইরকম আধ্যাত্মিক ভাব আমরা পরিস্ফুট দেখতে পাই ॥ ১

.

 দ্বিতীয় মন্ত্র: বিদ্যা শস্য পিতরং মিত্রং শতবৃষ্ণং। তেনা তে তম্বে ও শং করং পৃথিব্যাং তে নিষেচনং বহিষ্টে অস্তু বালিতি ॥ ২॥

 বঙ্গানুবাদ –যোগসাধনার জনকস্থানীয়, অশেষ-কামনা-পূর্ণকারী, মিত্রবৎ স্নিগ্ধতেজঃসম্পন্ন মিত্রদেবকে জানা একান্ত কর্তব্য; যোগের প্রভাবে (যোগজনক দেবতার সাথে মিলনের দ্বারা) তোমার দেহের মঙ্গলবিধান কর্তব্য; তোমার শক্তি এবং প্রাণের নিমিত্ত তোমার অন্তরস্থিত ক্লেদরাশি ইহসংসার হতে অপসারিত হোক। ॥ ২॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –সায়ণভাষ্যানুসারে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা, মূত্রনিরোধ ইত্যাদি ব্যাধিগ্রস্তের মুএনিঃসারণ সম্বন্ধসূচক। এই পক্ষে, এই সূক্তের ১ম মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা উল্লিখিত হয়েছে, এ মন্ত্রেও সেই ব্যাখ্যা প্রযোজ্য। কেবল, পর্জন্য স্থলে মিত্র (স্নিগ্ধালোকরশ্মি) প্রভৃতি রূপ পরিবর্তন হবে।–সূক্তের প্রথম মন্ত্রের সাথে এই দ্বিতীয় মন্ত্রের পার্থক্য–কেবল একটি মাত্র পদের প্রয়োগ-বিষয়ে। প্রথম মন্ত্রে পিতরং পদের পর পর্জন্য পদ ছিল; এখানে তার পরিবর্তে মিত্রং পদ প্রযুক্ত দেখতে পাই। এইরকম পরপর পাঁচটি মন্ত্র একই ছন্দে একই রূপ শব্দসমষ্টিতে সংগ্রথিত; কেবল, এক একটি মাত্র পদের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। কেন এমন হলো? কোনও ভাষ্যকার কেউই এ পর্যন্ত এ বিষয়ে আলোকপাত করেননি। আমরা মনে করি, যদিও শব্দের পার্থক্য একটি পদ-মাত্র; কিন্তু ভাবের পার্থক্য–নিগূঢ় তত্ত্বমূলক।–প্রথম মন্ত্রে দেখলাম–যোগসাধনার ক্ষেত্রে পর্জন্যদেব এসে জলসেচন করলেন। বীজ অভিষিক্ত হলো। কিন্তু কেবল জলাভিষেকে বীজে অঙ্কুর উদ্গত হয় না তো! সুতরাং স্নিগ্ধরশ্মিসম্পাতের প্রয়োজন হলো। তখন মিত্র-ভাবে মিত্রদেব এসে সহায় হলেন। প্রথম মন্ত্রে পর্জন্যদেবকে আহ্বানের পর, দ্বিতীয় মন্ত্রে তাই মিত্রদেবকে আহ্বান করা হলো। এ পক্ষে এই মন্ত্র যোগ-সাধনার দ্বিতীয় স্তর। পর্যায়ক্রমে দুই মন্ত্রে ভগবানকে হৃদয়ে দুই ভাবে ধারণা করা হলো। ২

.

তৃতীয় মন্ত্র: বিদ্যা শরস্য পিতরং বরুণং শতবৃষ্ণং। তেনা তে তম্বে ৩ শং করং পৃথিব্যাং তে নিষেচনং বহিষ্টে অস্তু বালিতি ॥ ৩

বঙ্গানুবাদ –যোগসাধনার জনকস্থানীয়, অশেষ-কামনা-পূর্ণকারী, ছায়াদানে পরিবৃদ্ধিকারক বরুণদেবকে জানা একান্ত কর্তব্য; যোগপ্রভাবে (যোগজনক দেবতার সাথে মিলনের দ্বারা) তোমার দেহের মঙ্গলবিধান কর্তব্য; তোমার শক্তি এবং প্রাণের নিমিত্ত তোমার অন্তরস্থিত ক্লেদরাশি ইহসংসার হতে অপসারিত হোক। ৩

মন্ত্রাৰ্থআলোচনা –এই মন্ত্রে পুনরায় মিত্রং পদের পরিবর্তন। এখানে তার পরিবর্তে বরুণং। এটা যেন অঙ্কুরোদ্গমের তৃতীয় স্তর। বর্ষণের পর কেবল স্নিগ্ধ উত্তাপ পেলেও অঙ্কুর উদ্গত হয় না। সেই পক্ষে স্নিগ্ধচ্ছায়ার প্রয়োজন। মৃদুমধুর শিশির-সম্পাত আবশ্যক। তাই, মিত্রদেবতার পর বরুণদেবতার অর্চনার আবশ্যক হলো–হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবের বিকাশের পক্ষে তিনটি মন্ত্রে পর পর তিনটি বিষয় বিবৃত রয়েছে। যোগসাধনায় প্রবৃত্ত হয়ে সাধক, প্রথমে ভগবানের পর্জন্যদেব-রূপ বিভূতি প্রত্যক্ষ করলেন। তার পর তার মিত্রদেব-রূপ বিভূতি হৃদয়ঙ্গম হলো। তারপর তিনি আবার স্নিগ্ধ বরুণদেব-রূপ বিভূতিতে সাধকের হৃদয়ে প্রতিভাত হলেন। বীজ, অঙ্কুরোদ্গমের অবস্থা প্রাপ্ত হলো।সায়ণভাষ্যানুসারে এই সূক্তের এ মন্ত্রের ব্যাখ্যাও মূত্রনিরোধ ইত্যাদি ব্যাধিগ্রস্তের মূত্রনিঃসারণ সম্বন্ধসূচক। প্রথম মন্ত্রের পর্জন্য স্থলে এখানে বরুণ  (স্নিগ্ধছায়াদানকারী) প্রভৃতি-রূপ পরিবর্তন হবে ॥ ৩॥

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ বিদ্যা শরস্য পিতরং চন্দ্রং শতবৃষ্ণং। তেনা তে তন্বে ৩ শং করং পৃথিব্যাং তে নিষেচনং বহিষ্টে অস্ত্র বালিতি। ৪

বঙ্গানুবাদ –যোগসাধনার জনকস্থানীয়, অশেষ-কামনা-পূৰ্ণকারী, বিকাশ-উন্মেষক চন্দ্রদেবকে জানা একান্ত কর্তব্য; যোগের প্রভাবে (যোগজনক দেবতার সাথে মিলনের দ্বারা) তোমার দেহের মঙ্গলবিধান কর্তব্য; তোমার শক্তি এবং প্রাণের নিমিত্ত তোমার অন্তরস্থায়ী ক্লেদরাশি ইহসংসার হতে অপসারিত হোক। ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –সায়ণভাষ্যানুসারে এ মন্ত্রের ব্যাখ্যা, মূত্রনিরোধ ইত্যাদি ব্যাধিগ্রস্তের মূত্রনিঃসারণ সম্বন্ধসূচক। এ পক্ষে এই সূক্তের প্রথম মন্ত্রের ব্যাখ্যায় যা বলা হয়েছে, এখানে সেই ব্যাখ্যাই প্রযোজ্য। কেবল, পর্জন্য স্থলে চন্দ্র (বিকাশ-উন্মেষক) প্রভৃতি-রূপ পরিবর্তন হবে। আমরা মনে করি, এই মন্ত্র অঙ্কুরের উগম-ভাব-দ্যোতক। এই মন্ত্রে পুনরায় পদ-পরিবর্তন ঘটেছে। এখানে পূর্ববর্তী মন্ত্রের পর্জন্য বা মিত্র বা বরুণ পদ চন্দ্রং পদে পর্যবসিত। চন্দ্রদেবই অঙ্কুরের উন্মেষক। প্রকৃতি যে মুকুল-মুঞ্জরায় বিভূষিত হয়, তাতে চন্দ্রদেবেরই প্রভাব প্রকটিত হয়ে থাকে। প্রথম মন্ত্রে বীজে জলসেক, দ্বিতীয় মন্ত্রে স্নিগ্ধ উত্তাপ, তৃতীয় মন্ত্রে মৃদুমন্দ ছায়া, তারপরে এই চতুর্থ মন্ত্রে বীজে অঙ্কুরোদ্গম-ক্রিয়া।-ভগবান, চন্দ্রদেব-রূপ দিনী মূর্তিতে, সাধকের হৃদয়ক্ষেত্রে শুদ্ধসত্ত্বভাবের বীজকে অঙ্কুরিত ও মুকুলিত করলেন। চন্দ্রদেবরূপ ভগবৎ-বিভূতির ধারণায় সেই অবস্থায় উপনীত হওয়া যায়। এ মন্ত্রকে সেই পক্ষে যোগ-সাধনার চতুর্থ স্তর বলে মনে করতে পারি। এই চারটি মন্ত্রে চার স্তরে সাধকের হৃদয় কন্দর হতে প্রতিধ্বনি উঠছে–এস দেব!–এস! তুমি. পর্জন্য-রূপে এস। আমার এ বিশুষ্ক হৃদয়-মরুভূমি তোমার করুণারূপ সুধাঁধারায় অভিষিঞ্চিত হোক। শুদ্ধসত্ত্ব-ভাবের যে বীজটুকু এই হৃদয়-মরুভূমির এক প্রান্তে শুষ্ক হয়ে পড়ে আছে, তাকে আর্দ্র করো। এস, দেব! এস সখে! স্নিগ্ধকিরণরূপে মিত্রদেব হয়ে এস! সে আদ্রবীজ, একটু জীবনী-শক্তি প্রাপ্ত হোক। এস দেব!–এস তুমি! স্নিগ্ধচ্ছায়ারূপে বরুণদেব হয়ে এস; বীজ নবভাব প্রাপ্ত : হোক। অবশেষে, এস দেব! এস তুমি, চন্দ্ররূপে এসে সে বীজ মুকুলিত মুঞ্জরিত করে দাও। পর পর মন্ত্র-চারটিতে এই চার স্তরের প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। ৪

.

পঞ্চম মন্ত্র: বিদ্যা শরস্য পিতরং সূর্যং শতবৃষ্ণং। তেনা তে তম্বে ত শং করং পৃথিব্যাং তে। নিষেচনং বহিষ্টে অস্তু বালিতি ॥ ৫৷৷

বঙ্গানুবাদ –যোগসাধনার জনকস্থানীয়, অশেষ-কামনা পূর্ণকারী, পূর্ণরূপে প্রকাশক সূর্যদেবকে জানা একান্ত কর্তব্য; যোগের প্রভাবে (যোগজনক দেবতার সাথে মিলনের দ্বারা) তোমার দেহের মঙ্গলবিধান কর্তব্য; তোমার শক্তি এবং প্রাণের নিমিত্ত তোমার অন্তরস্থিত ক্লেদরাশি ইহসংসার হতে অপসারিত হোক ॥ ৫৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –সায়ণভাষ্যানুসারে এই মন্ত্র মূত্রনিরোধ ব্যাধিগ্রস্তের মূত্রনিঃসারণ সম্বন্ধসূচক। এ পক্ষে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা পূর্বের চারটি মন্ত্রের মতোই। কেবল, পর্জন্য ইত্যাদির স্থলে সূর্য (পূর্ণ-প্রকাশক) রূপ পরিবর্তন হবে। আমরা দেখছি, পূর্ব মন্ত্রে ছিল চন্দ্রং, এবার হলো সূর্যং। বীজ অঙ্কুরিত মুকুলিত হয়েছিল; এবার প্রস্ফুটিত ফুলফলসমন্বিত পরিপক্ক হলো। প্রকৃতির লীলাক্ষেত্রে বীজের উন্মেষ-অভিব্যক্তি সম্বন্ধে যে প্রক্রিয়া-পদ্ধতি বিধাতা বিধান করে রেখেছেন, সাধনার ক্ষেত্রে ভক্তের হৃদয়ের মধ্যেও সেই প্রক্রিয়া-পদ্ধতি অব্যাহত রয়েছে। পরিদৃশ্যমান পৃথিবীর-বিধিবিধানের উপমার দ্বারাই ধ্যানধারণার সামগ্রীকে আয়ত্তীকৃত করবার প্রয়াস হয়েছে।…যদি জ্ঞানলাভের অভিলাষী হও, স্তরে স্তরে অগ্রসর হতে আরম্ভ করো। তখন সেই পূর্ণ জ্যোতিষ্মন্ ভগবান, সূর্যরূপে প্রকাশমান হয়ে, তোমার চির অন্ধ-তমসাচ্ছন্ন হৃদয়াকাশ আলোকিত পুলকিত করবেন। পর পর পাঁচটি মন্ত্র, যোগসাধনার এই পরম পন্থা প্রদর্শন করছে ॥ ৫॥

.

ষষ্ঠ মন্ত্রঃ যদান্ত্রে গবীনন্যার্ঘস্তাবধি সংশ্ৰিতং।এবা তে মূত্রং মুচ্যতাং বহির্বালিতি সর্বকং ॥ ৬৷৷

বঙ্গানুবাদ –তোমার শক্তি ও প্রাণের নিমিত্ত, (তোমার) অন্ত্রমধ্যগত যে পাপ, এবং (তোমার) দেহস্থিত যে পাপ, তোমাতে সংশিত হয়ে আছে, সেই সমস্ত পাপ, মূত্রাশয়স্থিত নাড়ীদ্বয় হতে মূত্র নিঃসরণের ন্যায়, বহির্দেশে বিনির্গত হোক ৷৬৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের সংশ্ৰিতং স্থলে সংশ্রুতং পাঠ দেখা যায়। সায়ণ-ভাষ্যে সংশ্ৰিতং পাঠেরই পোষকতা দেখা যায়। আমরা সেই পাঠই গ্রহণ করেছি।–এ মন্ত্রটি বিষম সমস্যাপূর্ণ। সূঞানুক্রমণিকা এবং মন্ত্রভাষ্য অনুসরণ করলে প্রতীত হয়, মূত্রকৃচ্ছরোগীর মূত্রনিঃসারণ-বিষয়ে সহায়তার জন্য এই সূক্তের অপর সকল মন্ত্রের মতোই প্রযুক্ত হয়। তবে, বলা বাহুল্য, কোন্ পদ্ধতি-প্রক্রিয়া-অনুসারে মন্ত্র প্রয়োগ করলে সেই ভীষণ ব্যাধি হতে মুক্তিলাভ করা যায়, তার কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। এই মন্ত্রটির মধ্যে আন্ত্র, গবিনী, বস্তি প্রভৃতি যে সকল শব্দ পরিদৃষ্ট হয়, তার দ্বারা শারীরতত্ত্বাভিজ্ঞতার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় বটে। মূত্রাশয়ের সঙ্গে ভাষ্য-লিখিত উদরান্তৰ্গত পুরীতসুর (নাড়ি-ভুড়ির) ও গবিনী নাড়ি দুটির কী সম্বন্ধ, শারীরতত্ত্ববিদ বৈজ্ঞানিক ভিন্ন অন্যে তা অবগত নন। মূত্রের মূত্রাশয়-প্রাপ্তির সাধনের পক্ষে গবিনী নাড়ীদ্বয় অবস্থিত থাকে। বস্তি বলতে ধনুরাকারে অবস্থিত মূত্রাশয়কে বুঝিয়ে থাকে। মূএনিঃসরণের শব্দকে বালিতি বলে অভিহিত করা হয়। এ সকল বিষয় পর্যালোচনা করলে এবং পরবর্তী মন্ত্রগুলির সাথে এই মন্ত্রের সম্বন্ধের বিষয় ঐ দৃষ্টিতে লক্ষীভূত হলে, সেই কঠিন মূত্রকৃচ্ছব্যাধির প্রতিকারের উপায়ই মন্ত্রের লক্ষ্যস্থল বলে প্রতীতি জন্মে। পক্ষান্তরে দেখতে পাই, এ মন্ত্রে যোগ-সাধনার ॥ সাফল্যের বিষয়ই পরিকীর্তিত হয়েছে। পর, মূত্রকৃচ্ছব্যাধি-শান্তির উপমার–অতি সমীচীনতাই প্রতিপন্ন হয়। মূত্রকৃচ্ছব্যাধি-মহাপাতকের ফল। মুত্র-অবরোধের কারণে এই ব্যাধির যন্ত্রণা–অতীব অসহনীয়।… সর্বাপেক্ষা ক্লেশপ্রদ এই ব্যাধি এবং এর শীঘ্র উপশমের উপমা, অশেষপাপতাপক্লিষ্ট জনগণকে ভগবৎ আরাধনায়যোগসাধনায় প্রলুব্ধ করছে। মন্ত্র যেন বলছেন, তোমার যতরকম পাপ আছে; অন্তরের পাপ, বাহিবের পাপ, সকল প্রকার পাপ, যোগ-সাধনার প্রভাবে বিধৌত হয়ে যাবে। ভগবানের স্বরূপ-তত্ত্ব অবগত হলে–তার প্রতি একান্তে ন্যস্তচিত্ত হতে পারলে, মূত্রকৃচ্ছরোগীর মূত্র-নিঃসারণের ন্যায়, তোমার সর্ববিধ পাপ ঝটিতি দূরীভূত হবে। রোগী যেমন শান্তিলাভ করে তখন তুমিও সেইরকম শান্তি লাভ করবে।

মন্ত্রটিতে উপমার ছলে পরম তত্ত্বে মনকে আকৃষ্ট করা হয়েছে। যিনি যে দৃষ্টিতে দেখতে চাইবেন; তিনি সেই দৃষ্টিতেই মন্ত্রার্থের অনুসরণ করুন। যে জন মূত্রকৃচ্ছরোগাক্রান্ত, সে জন মন্ত্রনির্দিষ্ট মুঞ্জমেখলা ধারণপূর্বক মন্ত্রের অনুধ্যান করুন। আর যে জন ভীষণ ভবব্যাধিগ্রস্ত, সে জন, মন্ত্রকথিত আধ্যাত্মিক ভাব আপন হৃদয়-প্রদেশে স্তরে স্তরে সজ্জিত করে রাখুক ॥ ৬

.

সপ্তম মন্ত্রঃ প্র তে ভিনন্নি মেহনং বৰ্ত্তং বেশ্যা ইব। এবা তে মূত্রং মুচ্যতাং বহির্বালিতি সর্বকং ॥ ৭৷

 বঙ্গানুবাদ –তোমার শক্তি ও প্রাণ প্রাপ্তির নিমিত্ত, পলস্থিত জলের ন্যায় ক্লেদপুরিত তোমার পাপের আধারকে সম্যরূপে বিদীর্ণ করছি। তোমার পাপসমূহ, মূত্র-নিঃসরণের ন্যায়, বহির্দেশে বিনির্গত হোক ॥৭॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্র ও এর ভাষ্য পাঠ করলে, মনে হয়, যেন কোন মূত্রকৃচ্ছ-রোগীর মূত্রনালীতে লৌহশলাকা প্রবেশ করানো হচ্ছে। আর, ঋত্বিক বা ভিষ অস্ত্রপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এই মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। মেহনং প্রভৃতি কয়েকটি পদ, ঐ রকম অর্থের দ্যোতনা করে। আমরা মনে করি, এই মন্ত্রের উচ্চারণ-কালে সাধক, যোগ-সাধনার একটু উন্নত স্তরে আরূঢ় হয়েছেন। এখন তিনি স্পর্ধা করে বলতে পারছেন,এইবার আমি আমার পাপের আধারকে উদ্ভিন্ন করছি। অন্তরের মধ্যে পাপের যে ক্লেদরাশি সঞ্চিত হয়, সেই সমুদায়কে নিঃসারিত করার ক্ষমতা যখন আসে, তখনই মানুষ এই কথা বলতে পারে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য–হৃদয়ের মধ্যে বিদ্যমান এই রিপুবর্গ একে একে যখন বিদায় প্রাপ্ত হয়েছে, তখনই সাধক বলতে পারেন–হে পাপ! তব বৰ্ত্তং প্রতিনদ্মি। এটাই এ মন্ত্রের শিক্ষা ॥৭॥।

.

অষ্টম মন্ত্রঃ বিষিতং তে বস্তিবিলং সমুদ্রস্যোদধেরিব। এবা তে মূত্রং মুচ্যতাং বহির্বালিতি সর্বকং ॥ ৮৷

বঙ্গানুবাদ –শক্তি ও প্রাণ প্রাপ্তির নিমিত্ত, তোমার দেহাভ্যন্তরস্থ স্নিগ্ধভাবকে অনন্ত সিন্ধুর ন্যায় (ভগবৎ-বিভূতির মতো) বিমুক্ত (সম্প্রসারিত) করো; তোমার পাপসমূহ, মূত্র-নিঃসরণের। (প্রস্রাবের) ন্যায় বহির্দেশে নির্গত হোক। ৮।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রকে পূর্বমন্ত্রেরই পরিপোষক বলে মনে করতে পারি। দুদিকের দুরকম অর্থেই সে পরিপোষণের ভাব প্রকাশ পায়। মূত্রকৃচ্ছরোগীর পক্ষে মূত্রবর্ক্স-বিমুক্তির ভাব আসে। আধ্যাত্মিক পক্ষে অন্তরস্থায়ী সৎ-ভাবসমূহের বিস্তৃতিকরণ অর্থ প্রতিভাত হয়।–এস্থলে আধ্যাত্মিক অর্থেই উপমান উপমেয় সম্যক্ শোভনীয় হয়েছে। সমুদ্রস্য উদধেরিব বাক্য অনন্ত ভাবজ্ঞাপক। তাতে ভগবানের অনন্তত্বের বিষয় মনে আসে।…জ্ঞান ইত্যাদি যড়ৈশ্বর্য নিয়ে ভগবানের ভগবত্ত্ব। ভগবানের ভগবত্ব বলাও যা, সমুদ্রের উদধি বলাও তা-ই। অন্যপক্ষে এর সাদৃশ্য বস্তিবিলং শব্দে প্রত্যক্ষ করা যায়। দেহের অভ্যওরে মনুষ্যজীবনে স্নেহভাবই সার সম্পৎ নয় কি? দয়াদাক্ষিণ্য-সত্য-সরলতা-ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি সৎ-গুণরাশিই মানুষকে পশু হতে পৃথক করেছে। দেহের বিল–সেই স্নিগ্ধসত্ত্বভাবের দ্যোতনা করছে। সেই বিল যখন বিমুক্ত হয়, সত্ত্বভাবসমূহ যখন বিস্তৃতি লাভ করে, তখন অনন্তের সাথেই তার সাদৃশ্য এসে পড়ে।

.

নবম মন্ত্রঃ যথেষুকা পরাপদবসৃষ্টাধি ধন্বনঃ। এবা তে মূত্রং মুচ্যতাং বহির্বালিতি সর্বকং ॥ ৯।

বঙ্গানুবাদ –যেমন হস্তস্খলিত বাণ, ধনুর নিকট হতে আপনা-আপনি বিমুক্ত হয়ে যায়, এবং মূত্র যেমন মূত্রনাল হতে নির্গত হয়; সেইরকম, তোমার শক্তি ও প্রাণ প্রাপ্তির নিমিত্ত, (তোমার) পাপসমূহ বহির্দেশে বিনির্গত হোক। (তোমাতে যেন পাপের সম্বন্ধমাত্র না থাকে)। ৯।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— এই মন্ত্রের অন্তর্গত ইষুকা পদটি বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য। বাণার্থক ই শব্দের উত্তর অজ্ঞাতার্থে ক প্রত্যয় করে উক্ত ইযুকা পদটি নিষ্পন্ন হয়েছে। তাতে অর্থ হয়, অজ্ঞাত বাণ। কিন্তু এতে কি বোঝায়? আমরা মনে করি, এর দ্বারা লক্ষ্যহীন অর্থ সূচিত হয়েছে। ধনুষ্মন্ যখন বাণ পরিত্যাগ করে, তখন কোনও প্রাণী বা পদার্থের প্রতি লক্ষ্য থাকে; বাণ সেই প্রাণী বা পদার্থকে বিদ্ধ করে। তাতে ধানুকির হিংসার ভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু এখানে ইষুকা বলতে লক্ষ্যহীন–অর্থাৎ কাউকেও হিংসা করা উদ্দেশ্য নয়–এই ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। আমার দেহ হতে পাপদে বিদূরিত হোক; কিন্তু তার দ্বারা অপর কেউ যেন কলুষিত না হয়। মন্ত্রে এমন মহান্ অভিপ্রায় পরিস্ফুট দেখি।–সে পাপ মূত্রকৃচ্ছরোগীর মূত্রনিঃসরণের ন্যায় নির্গত হবে। চারটি মন্ত্রে পর পর পাপ নির্গমনের পক্ষে এই একই উপমা বিনিযুক্ত হয়েছে। এ উপমার বিশেষ লক্ষ্য আছে বলে আমরা মনে করি। প্রথম লক্ষ্য-পরম শাপ্তিলাভ। মূত্ররূপ ক্লেদ দেহে অবরুদ্ধ থাকলে, মূত্রকৃচ্ছরোগীর যন্ত্রণার অবধি থাকে না। সেই মূত্র বহির্দেশে নির্গত হলেই রোগী শান্তি লাভ করে। এখানেও সেই ভাব পরিব্যক্ত। শরীরের (বা অন্তরের) : মধ্যে পাপ অবরুদ্ধ হয়ে থাকলে কষ্টের অবধি থাকে না। সে পাপ নির্গত হয়ে গেলে, পাপের সাথে সকল সম্বন্ধ বিচ্যুত হলে পরম শান্তি লাভ করা যায়। এক পক্ষে উপমায় এই ভাব প্রকাশ করে। অন্যপক্ষে, ত্যাগের পর মূত্র যেমন হেয় অপরিগ্রহীতব্য হয়, পাপও যেন সেইরকম হেয় ও অগ্রহীতব্য হয়,–এটাই নিগূঢ় তাৎপর্য। মন্ত্রের প্রথম পাদের সার্থকতা এ দৃষ্টিতে বিশেষভাবে প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। সে পাপ এমনভাবে পরিত্যক্ত উপেক্ষিত হোক–সে যেন কাউকেও আর স্পর্শ না করে, কারও সাথে সে পাপ যেন কখাও আর সম্বন্ধবিশিষ্ট না হয়–এটাই মর্মার্থ ॥ ৯৷৷

.

চতুর্থ সূক্ত : অপাং ভেষজম

 [ঋষি : সিন্ধুদ্বীপ, কৃতিৰ্বা দেবতা : আপঃ ছন্দ : গায়ত্রী, বৃহতী ]

প্রথম মন্ত্রঃ অন্বয়ো যন্ত্যধ্বভিৰ্জাময়ো অধ্বরীয়ং। পৃঞ্চতীৰ্মধুনা পয়ঃ ॥১॥

বঙ্গানুবাদ –দেবারাধনায় ইচ্ছুক আমাদের হিতকরী মাতৃস্থানীয় জল (জলাধিষ্ঠাত্রী দেবতা), মাধুর্যরসের দ্বারা অমৃত (প্রাণশক্তি সঞ্চার করতে করতে, দেব্যজন-পথে বাহিত হয়ে (দৈবকার্যের সঙ্গে সঙ্গে) ভগবৎসমীপে উপস্থিত হয়। ১।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— ভাষ্যকারের মতে–এই সূক্তের মন্ত্র কয়েকটির প্রয়োগে সর্বপ্রকার রোগে শান্তি লাভ, লাভালাভ ও জয় পরাজয় বিষয়ে অভিজ্ঞতা, অর্থপ্রাপ্তি, বিঘ্ননাশ প্রভৃতি ঘটে থাকে। গো-জাতির রোগ উপশমন ও পুষ্টি-সংজনন পক্ষে এ সূক্তের মন্ত্র-কয়টি অশেষ ফলোপধায়ক বলে অভিহিত হয়। অন্বয়ে যন্তি প্রভৃতি মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক লবণযুক্ত জল বা কেবলমাত্র জল গোজাতিকে পান করালে, তাদের সকলরকম ব্যাধিনাশ ও পুষ্টি সংসাধিত হয়ে থাকে। জলপড়ার দ্বারা এবং মন্ত্রের দ্বারা রোগনাশের চেষ্টা অধুনাও আমাদের দেশে পরিদৃষ্ট হয়।– সে ক্ষেত্রে, অথর্ববেদের মন্ত্র যদি যথোপযুক্ত হয়, তাহলে, কি সুফল প্রাপ্ত হওয়া যায়–তা সহজেই অনুমেয়।–আধ্যাত্মিক ভাবেও এই মন্ত্রে গুরুত্ব রয়েছে। এই মন্ত্রে এবং এর পরবর্তী দুটি মন্ত্রে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবতার উপাসনা আছে। এ মন্ত্রে বলা হচ্ছে, যাঁরা দেবতার উদ্দেশে যজ্ঞ ইত্যাদি সৎ-কর্মের অনুষ্ঠান করে থাকেন, জলদেবতা তাদের মাতৃস্থানীয় এবং পরমহিতকারিণী। জননী যেমন স্তন্যদানে সন্তানের শক্তি-বর্ধন করে সন্তানকে জীবন পথে পরিচালিত করেন, মাতৃস্বরূপিণী জলদেবতাও সেইরকম অমৃতবৎ প্রাণশক্তি দানে সক্কর্মের কর্তাকে ভগবৎসমীপে সংবাহিত করে নিয়ে যান। এখানকার প্রার্থনার ভাব এই যে, সেই মাতৃস্বরূপিণী জলদেবতা আমাদের জীবনী শক্তি দানে ভগবৎসমীপে নিয়ে চলুন। এ মন্ত্রের অন্তর্গত অন্বয়ঃ, মধুনা ও পয়ঃ–এই তিনটি শব্দ উপমায় বহুভাব প্রকাশ করছে। জলের স্নেহভাব, দেবতার মাতৃত্বের সূচনা করছে। পয়ঃ শব্দে দুগ্ধ ও অমৃত–দুই ভাবই আনয়ন করে। জননী যেমন দুগ্ধদানে সন্তানকে পালন করেন, জলাধিষ্ঠাত্রী দেবী সেইরকম জননীর স্নেহে সন্তানকে জ্ঞানামৃত দান করেন। এখানে উপমায় সেই উদার উচ্চ ভাব ব্যক্ত রয়েছে। ভাষ্যকার, মন্ত্রস্থিত অধ্বর পদের অর্থ লিখেছেন-যাতে হিংসা নেই, তা-ই অধ্বর। কিন্তু শ্রুতিবাক্যে যখন আছে–যজ্ঞে পশুহনন করবে; তখন, যজ্ঞকে কি করে হিংসারহিত বলতে পারি? এর উত্তরে তিনি বলেছেন,–সাধারণ-বিধি বিশেষ-বিধির দ্বারা বাধিত হয়। কিন্তু এ সম্বন্ধে একটি নিগূঢ় তত্ত্ব বোঝবার ও ভাববার আছে। সায়ণ বলেন,–এস্থলে হিংসার অভাব বলছি না, প্রত্যবায়ের অভাব বলছি। অর্থাৎ, তার মতে, যজ্ঞে পশুবলিতে হিংসা হয় বটে; কিন্তু পাপ হয় না। আমরা মানি, সাধারণ পশু-হত্যা ও যজ্ঞে পশুবলি এক নয়। যজ্ঞের পশুবলি হলো শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে যজ্ঞকারীর যজ্ঞকার্য। যাজ্ঞিক হিংসার ভাব নিয়ে যজ্ঞ করেন না, সুতরাং যজ্ঞ হিংসারহিত অধ্বর বলে অভিহিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, হিংসা অন্তরের ভাব; হনন-দৈহিক কার্য। অন্তরে হিংসারূপ পাপপ্রবৃত্তির অস্তিত্ব না থাকলেও হননকার্য সংসাধিত হতে পারে। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্র: অমূর‍ উপ সূর্যে যাভিৰা সূর্যঃ সহ। তা নো হিন্বধ্বরং ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –সেই যে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবীগণ, তারা জ্ঞানস্বরূপ সূর্যদেবের সাথে সামীপ্য সম্বন্ধ-যুক্ত অথবা জ্ঞানময় সূর্যদেবই তাদের সাথে ওতঃপ্রোতঃ অবস্থিত। সেই জলাধিষ্ঠাত্রী দেবীগণ আমাদের যাগ ইত্যাদি সৎকর্মনিবহ সর্বতোভাবে সুসিদ্ধ করুন। ২।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা মন্ত্রে ভগবানের সাথে দেবতার-ব্যষ্টিগত দেববিভূতির সাথে সমষ্টিগত দেবতার সম্বন্ধসূত্রের আভাষ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে এক দেবতার সাথে অন্য দেবতার সম্বন্ধের বিষয়ও এ মন্ত্রে সূচিত হয়েছে, মনে করা যেতে পারে।-সূর্যদেব বলতে জ্ঞানরূপ জ্ঞানাধার ভগবানকেও বোঝাতে পারে, আবার ভগবৎ-বিভূতি জ্ঞানমাত্রকে লক্ষ্য হয়েছে, তা-ও বলতে পারি।…ফলতঃ, ভগবান্ হতে ভগবৎ-বিভূতি যে পৃথক নয়; অপিচ দেববিভূতিগুলির পরস্পরের মধ্যে যে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ,-এ মন্ত্রের তা-ই মুখ্য লক্ষ্য।–হে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবতা, জ্ঞানের সাথে আপনার সম্বন্ধ অবিচ্ছিন্ন। আপনি আমাদের যজ্ঞ ইত্যাদি কর্ম সুসম্পন্ন করে দিন। স্নেহ-করুণা ইত্যাদি স্নিগ্ধভাবের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানের ঔজ্জ্বল্যে আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হোক। আমরা যেন স্বরূপ অবগত হই।–মন্ত্রের এটাই প্রার্থনা ॥ ২॥

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ অপো দেবীরুপ হয়ে যত্র গাবঃ পিবন্তি নঃ। সিন্দুভ্যঃ কর্তৃং হবিঃ ৷৷ ৩৷৷

 বঙ্গানুবাদ –জলাধিষ্ঠাত্রী (সেই) দেবতাকে সমীপে আহ্বান করছি। যে জলদেবতার অভ্যন্তরে আমাদের জ্ঞানসমূহ, (অমৃত) পান করে থাকে; অথবা, জলাধিষ্ঠাত্রী দেবতা সমীবর্তিনী হলে জ্ঞান-সমূহ আমাদের অধিকার করে (অর্থাৎ, আমাদের হৃদয় জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হয়); সেই জলদেবতার উদ্দেশে পূজা-অর্চনা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য ॥ ৩॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা এই মন্ত্রের অন্তর্গত যত্র গাবঃ পিবন্তি নঃ বাক্যের অর্থ নিয়ে নানারকম। জল্পনা-কল্পনা চলেছে। প্রধানতঃ সকলেই অর্থ করে গেছেন, আমাদের গরুসকল যে জল পান করে। সেই অনুসারে মন্ত্রের ভাবার্থ দাঁড়িয়েছে এই যেআমাদের গাভীরা যে জল পান করে–সেই জলদেবীকে আমরা আহ্বান করি। প্রবহমান নদীকে আমাদের হবিদান করা কর্তব্য।-হায়, গরুতে জল পান করে, অতএব সেই জল দেবী এবং আরাধ্যা,–এমন অর্থ কল্পনা করতেও সঙ্কোচ বোধ হয়। অল্প-মাত্র চিন্তা করলেই বোঝা যায়, এ মন্ত্রে পূর্বোক্ত ভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবই ব্যক্ত আছে। বেদের যে যে স্থলে গো শব্দের ব্যবহার আছে, সর্বত্র সামঞ্জস্য রক্ষা করতে গেলে, গো শব্দে গরু না বুঝিয়ে, কিরণ, জ্যোতিঃ, জ্ঞান প্রভৃতি অর্থই সঙ্গত বলে প্রতিপন্ন হয়। এখানে এ মন্ত্রে, গাবঃ শব্দে জ্ঞানসমূহকেই বোঝাচ্ছে। নানা বিষয়ে নানারকম জ্ঞান সঞ্জাত হলে, জ্ঞানের পূর্ণতা সাধিত হয়। এখানে গাবঃ পদ, সেই বহুবিষয়ক জ্ঞানের ভাব ব্যক্ত করছে। আমাদের বিবিধ-বিষয়ক জ্ঞানের দ্বারা আমরা যে অমৃত পান করতে সমর্থ হই, এখানে সেই কথাই বলা হয়েছে।-জ্ঞানের সাহায্যে দেবতত্ত্ব অবগত হতে পারলে, অমৃতত্ত্ব প্রাপ্তি ঘটে, এটাই এ মন্ত্রের প্রার্থনা ॥ ৩॥

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ অস্বন্তরমৃতমষ্ণু ভেষজং। অপামুত প্রশস্তিভিরশ্বা ভবথ বাজিনো গাবো ভবথ বাজিনীঃ ॥ ৪৷৷

 বঙ্গানুবাদ— জলাধিষ্ঠাত্রী দেবতার মধ্যে সুধা এবং ঔষধ বর্তমান আছে (অর্থাৎ, জলদেবতার অনুগ্রহে আমরা ব্যাধিশূন্য ও অমর হতে পারি)। অতএব, (তা লাভ করবার জন্য) হে আমার অন্তর্নিহিত দেবভাব ও জ্ঞাননিবহ! তোমরা জলাধিষ্ঠাত্রী দেবতাদের স্তোত্রবিষয়ে (উপাসনায়) ত্বরান্বিত হও ৷ ৪৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এ মন্ত্রে সাধারণ দৃষ্টিতে জলের এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবতার অর্চনার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। জল যে অমৃতস্বরূপ, ব্যাধিনাশক, জলপক্ষেও তা প্রতিপন্ন হয়। আবার, জলদেবতার উপাসনার মধ্য দিয়েও যে পরম জ্ঞান লাভ হয়, এই প্রসঙ্গে তা-ও বুঝতে পারা যায়। এখানে দুদিকে দুভাবই ব্যক্ত হয়েছে, মনে করতে পারি।…একপক্ষে, জলকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করতে করতে, জলের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার প্রতি লক্ষ্য পড়বে; অন্য পক্ষে, যাঁরা সাধনার একটু উচ্চস্তরে আরোহণ করেছেন, তারা জলের মধ্যেই নারায়ণকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন–জলদেবতার স্বরূপ-জ্ঞানে, আমরা যে নীরোগ ব্যাধিশূন্য হতে পারি, এবং ক্রমশঃ অমরত্ব-লাভে সমর্থ হই,–এ মন্ত্রে সেই দুই তত্ত্ব জ্ঞাপিত হচ্ছে। এখানে, জল-চিকিৎসার বিষয় (Hydropathy) ব্যক্ত আছে মনে করা যায়; আবার, জলরূপে ভগবান, জীব-জীবনের শান্তিবিধান করছেন–প্রতীত হয়।

কিন্তু ভাষ্যের আভাষে বোঝা যায়, মন্ত্রে যেন অশ্বকে এবং গরুকে মন্ত্রপূত জল পানের নিমিত্ত আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সে ভাব আদৌ সঙ্গত বলে মনে করি না। অন্তরস্থ দেবভাবসমূহকে ও জ্ঞানকে সাধক এখানে অশ্বাঃ এবং গাবঃ পক্ষে সম্বোধন করছেন। তিনি যখন দেবতত্ব-জলদেবতার মাহাত্ম-অবগত হতে পেরেছেন; তখনই তিনি আপন অন্তরস্থিত দেবভাবসমূহকে এবং শুদ্ধসত্ত্বজ্ঞানকে জাগ্ৰৎ করে তুলছেন। দৈবতত্ত্ব অবগত হতে পারলেই, দেবতা বিষয়ে সত্যজ্ঞান সঞ্জাত হলেই, দেবারাধনায় মানুষের প্রবৃত্তি আসে। এ মন্ত্রে সেই সনাতন সত্য-তত্ত্ব পরিব্যক্ত রয়েছে। ৪।

.

পঞ্চম সূক্ত : অপাং ভেষজম

[ঋষি : সিন্ধুদ্বীপ, কৃতিৰ্বা দেবতা : আপঃ ছন্দ : গায়ত্রী ]

প্রথম মন্ত্রঃ আপ হি ষ্ঠা ময়োভুবস্তা ন ঊর্জে দধাতন। মহে রণায় চক্ষসে। ১।

বঙ্গানুবাদ –হে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবীগণ! আপনারা স্বতঃই সুখদায়িনী! (প্রার্থনা করি। আমাদের বলপ্রাণের অধিকারী করুন; এবং আমরা যাতে সেই মহৎ পরব্রহ্মের সাথে মিলিত হতে পরি, সেই অবস্থায় আমাদের উপনীত করুন। ১

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— এ মন্ত্রের প্রার্থনা, সাধারণ সরলভাবে প্রযুক্ত। জলদেবতা স্বতঃই সুখদায়িকা। তিনি শক্তি ও প্রাণ প্রদান করুন, তার মধ্য দিয়ে পরব্রহ্মের প্রতি দৃষ্টি ন্যস্ত হোক। তার মধ্য দিয়েই যেন পরব্রহ্মের সম্বন্ধ লাভে সমর্থ হই। এটাই এ মন্ত্রের প্রার্থনা।–জল–স্নেহ-ভাবাপন্ন। তাই ভগবৎ-বিভূতি সেখানে দেবীরূপে পরিকল্পিত। স্নেহের ভাব দেবীর মধ্যে সর্বতঃ অভিব্যক্ত হয়। স্নেহভাব নানা দিক দিয়ে প্রাণে শান্তিশীতলতা সিঞ্চন করে। তাই বহুবচনান্ত অপ শব্দে দেবীকে আহ্বান করা হয়েছে।-মন্ত্রের উজে পদে সায়ণ বলকরায় অন্নায় অর্থ লিখেছেন। ভাব এই যে,জলসেচনের ফলে অন্নমূল ধান্য ইত্যাদি পরিপুষ্ট হয় এবং সেই পুষ্ট অন্ন ইত্যাদির দ্বারা জীব পরিপুষ্টি লাভ করে। কিন্তু উর্জে পদে বল ও প্রাণ দুই-ই বোঝায়। জলকে সাধারণ জলভাবে দেখলে, হৃদয়ে স্নেহকারুণ্য-রূপ, সলিল-সেচনে সভাপরিবৃদ্ধিকর অন্নবল প্রাপ্ত হওয়া যায়। ঐ শব্দে দুই দৃষ্টিতে দুই ভাবই প্রকাশ পায়। মহে রণায় চক্ষসে বাক্যে সায়ণ নানারকম ভাব গ্রহণ করেছেন। পূজনীয় রমণীয় বস্তুকে দেখবার প্রার্থনা তাতে প্রকাশ পেয়েছে। অপিচ, ঋগ্বেদের ভায্যে তিনি এই মন্ত্রের যে অর্থ লিখেছেন, অথর্ববেদের ভাষ্যে সে অর্থের কিছু ব্যত্যয় দেখা যায়। সেখানকার ভাব যেন জলকে আহ্বান করে বলা হয়েছে,-হে জল! তুমি অতি চমৎকার বৃষ্টি দান করো। কিন্তু রণায় পদে রমণীয় পূজনীয় হতে পরব্রহ্মের প্রতি লক্ষ্য আসে। সায়ণ, অথর্ববেদের ভাষ্যে, উপসংহারে, সেই ভাবই ব্যক্ত করেছেন। ফলতঃ, ভগবৎ-বিভূতি দেবীরূপে স্নেহকারুণ্য ইত্যাদি গুলোপেত হয়ে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন এবং তার ফলে আত্মদর্শন-লাভ হোক, ব্রহ্মসাক্ষাৎকার-লাভ ঘটুক, –এ মন্ত্র, এইরকমই প্রার্থনার ভাব ব্যক্ত করছে।। ১।

.

 দ্বিতীয় মন্ত্রঃ যোবঃ শিবতমো রসস্তস্য ভাজয়তেহ নঃ। উশতীরিব মাতরঃ। ২

বঙ্গানুবাদ –হে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবীগণ! আপনাদের মধ্যে অশেষকল্যাণ-স্বরূপ যে সারভূত রস (পরমার্থতত্ত্ব) বিদ্যমান আছে, কল্যাণকামী স্নেহময়ী জননীর (স্তন্যদানের) ন্যায়, সেই রস। ইহলোকে আমাদের প্রদান করে পোষণ করুন। ২৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –পূর্ব মন্ত্রে বল-প্রাণ প্রাপ্তির জন্য এবং পরব্রহ্মের সাথে সম্বন্ধ স্থাপনের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছিল। এখানে আর একটু ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ সূচিত হলো। এখানে, সন্তান হয়ে জননীর স্নেহ-করুণা পাবার জন্য প্রার্থনা জানানো হয়েছে।–জননী যেমন স্তন্যদানে সন্তানকে পোষণ করেন, স্নেইকরুণার আধার হে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবীগণ! আপনারা আমাদের পরমার্থতত্ত্বরূপ সুধারস প্রদান করে আমাদের পরম মঙ্গল করুন। সম্বন্ধ যখন ঘনিষ্ট হয়, যখন জননীর ক্রোড়ে আশ্রয় নেবার অধিকার জন্মে, ৩খনই এমন প্রার্থনা করবার সামর্থ্য আসে,তখনই সাধক মাতৃ-সম্বোধনে তাকে সম্বুদ্ধ করেন ॥ ২.

.

তৃতীয় মন্ত্র: তস্মা অরং গমাম বো যস্য ক্ষয়ায় জিম্বথ। আপো জনয়থা চ নঃ। ৩

বঙ্গানুবাদ— হে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবীগণ! সেই ব্রহ্মতত্ত্বরূপ পরমরস দান করে আপনারা আমাদের তৃপ্তি-সাধন করুন। আপনারা যে রসের দ্বারা সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে প্রাণশক্তিসম্পন্ন করে রেখেছেন, সেই রস আমাদের সম্বন্ধে পরিবৃদ্ধি হোক ৷ ৩৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের নানারকম ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। ক্ষয়ায়, জিম্বথ, জনয়থ আর গমাম-মন্ত্রের এই পদ-কয়েকটির বিশ্লেষণ উপলক্ষে সেই অর্থান্তর সংসূচিত হয়ে থাকে।য়ায় পদের, কেউ অর্থ করেছেন,-পাপের ক্ষয়ের নিমিত্ত, কেউ অর্থ করেছেন,–অভিবৃদ্ধির নিমিত্ত; আমরা অর্থ করলাম,-এই ক্ষয়শীল ধ্বংসুশীল জগতের নিমিত্ত। গমাম পদের, কেউ অর্থ করেছেন,–প্রস্তুত আছ, কেউ অর্থ করেছেন,-প্রাপ্ত হও; আমরা অর্থ করলাম,-তৃপ্ত করছ। জিম্বথ পদের অর্থ কেউ বলেছেন, –জলদানে শস্য ইত্যাদির পুষ্টিসাধন করো, কেউ বলেছেন,-মস্তকে জল নিক্ষেপ করো; আমরা অর্থ করলাম,প্রাণশক্তিদানে পরিতৃপ্ত করো। জনয়থ পদের অর্থ কেউ করলেন, বংশবৃদ্ধি করো, কেউ অর্থ করলেন,–আমাদের পুত্র ইত্যাদিরূপে উৎপন্ন করো। আমরা অর্থ করলাম,পরমার্থতত্ত্বদানে পরিবৃদ্ধ করো। এতে, বিভিন্ন দিক থেকে মন্ত্রের অর্থ বিভিন্ন রকম দাঁড়িয়ে গেছে। এক অর্থে যেন জলকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে,-হে জল! পাপক্ষয়ের জন্য তোমাকে মস্তকের উপর ছিটাচ্ছি। তোমরা আমাদের বংশবৃদ্ধি করো। আর এক মতে অর্থ দাঁড়াচ্ছে,-হে জল! তোমরা অন্নের পরিবৃদ্ধিকারক; তোমাদের বর্ষণে শস্য উৎপন্ন হয়; আমাদের বংশবৃদ্ধি হোক। ইত্যাদি।–এই মন্ত্রটি এবং এর পূর্বের দুটি মন্ত্র ব্রাহ্মণের ত্রিসন্ধ্যায় নিত্যব্যবহার্য। অথচ, এর অর্থ সম্বন্ধে এমনই মতান্তর দেখা যায়। আমরা বলি, বিভিন্ন শ্রেণীর উপাসকের পক্ষে এ মন্ত্র এমনই বিভিন্ন অর্থই দ্যোতনা করে বটে। যে জন অন্নের জন্য লালায়িত, তার অভীষ্ট-পূরণের পক্ষে এ মন্ত্রে অনুবৃদ্ধিরই প্রার্থনা প্রকাশ পাচ্ছে। তেমনি, যার পুত্র পৌত্রাদির কামনা, তার পক্ষে এ মন্ত্রের অর্থে সেই প্রার্থনাই প্রকাশ পাচ্ছে। আবার যাঁরা পরব্রহ্মের সাথে সম্বন্ধ-স্থাপনকেই চরম প্রার্থনা বলে মনে করেন, তাঁদের প্রার্থনাও ঐ মন্ত্রে প্রকাশমান রয়েছে। আমরা সেই অর্থই সম্যক সমীচীন টি বলে মনে করি। কেননা, ধনজনপুত্ৰবিত্ত-সকল প্রার্থনার সার প্রার্থনাই যখন মন্ত্রের মধ্যে পাচ্ছি; তখন আর এক এক করে প্রার্থনা করবার কি প্রয়োজন? আমায় এটা দাও, সেটা দাও ইত্যাদি না বলে, যদি বলি,–আমায় সব দাও; তাতে যে ভাব প্রকাশ পায়, মন্ত্র সেই ভাবই হৃদয়ে ধারণ করে আছে ॥ ৩

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ ঈশানা বাৰ্যানাং ক্ষয়ন্তীৰ্ষণীনাং। অপো যাচামি ভেষজং। ৪।

বঙ্গানুবাদ –শ্রেষ্ঠ-ধনের নিয়ন্ত্ৰী হে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবীগণ! আপনারা মনুষ্যগণের (আত্মোৎকর্ষসাধনসম্পন্ন জনগণের) আশ্রয়স্থানভূতা। আমি আপনাদের নিকট শান্তিপ্রদ অমৃতের প্রার্থনা করছি। ৪।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রটির তিনরকম অর্থ আমনন করা যেতে পারে। দুরকম অর্থ প্রচলিত দেখি। শেষোক্ত প্রকারের আধ্যাত্মিক-ভাবমূলক অর্থই আমরা পরিগ্রহ করলাম।–প্রথম প্রকার অর্থে, –চর্যণীনাং পদ দৃষ্টে, কৃষকগণের ইষ্টসাধন-পক্ষে মন্ত্রটির প্রয়োগ হয়েছে বলে স্বীকার করা হয়। ভাব এই যে, কৃষকেরা যেন বৃষ্টির প্রার্থনা করছে। তাতে বার্যানাং ঈশানাঃ পদ দুটি বারিরাশির-সলিল সমূহের অধিকারিণী-রূপ ভাব পরিগৃহীত হয়। হে দেবীগণ! আপনারা সেই কৃষকগণের ক্ষয়ন্তী অর্থাৎ আশ্রয়স্থানস্বরূপ হন।–অন্য পক্ষে,–অভিলষিত বস্তুর অধীশ্বর জলেরাই আছেন। মনুষ্যগণকে তারাই বাস করিয়ে থাকেন; সেই জলবৰ্গকে আমি ঔষধের জন্য প্রার্থনা করি। এই রকমে মন্ত্রের অনুবাদ করা হয়। অতঃপর আমাদের পরিগৃহীত ভাবের কথা বলি। চর্ষণীনাং পদে আমরা আত্মোৎকর্ষসাধনসম্পন্ন জনগণের অর্থ গ্রহণ করি। ঈশানাঃ ষড়ৈশ্বর্যশালিনী দেবগণ যে সাধকের আশ্রয়স্থান হন, সাধনার প্রভাবে মনুষ্য যে মুক্তির পর্যন্ত অধিকারী হয়, এখানে সেই ভাবই পরিব্যক্ত। ক্ষয়ন্তীঃ পদের সার্থকতা সেই অর্থেই অধিক সঙ্গত হয়। ক্ষী ধাতু ক্ষীণ হওয়ার বা ক্ষয়প্রাপ্তির ভাব প্রকাশ করে। অতএব ক্ষয়ন্তীঃ পদে যে নিবাস-স্থানকে বোঝায়, তাকে কর্মক্ষয়মূলক মোক্ষরূপ নিবাসস্থানই বলতে পারি। আমায় অমৃতত্ব দাও, আমি যেন মোক্ষলাভে সমর্থ হই,–এটাই এ মন্ত্রের নিগূঢ় তাৎপর্য। ৪।

.

ষষ্ঠ সূক্ত : অপাং ভেষজম

[ঋষি : সিন্ধুদ্বীপ দেবতা : আপঃ ছন্দ : গায়ত্রী ]

প্রথম মন্ত্রঃ শং নো দেবীরভিষ্টয়ে আপো ভবন্তু পীতয়ে। শং যোরভি বন্তু নঃ ॥ ১৷

বঙ্গানুবাদ –দীপ্তিদানাদিগুণবিশিষ্টা স্নেহকরুণারূপা জলাধিষ্ঠাত্রী দেবীগণ! আমাদের। ১) অভীষ্টসাধনের জন্য এবং তৃষ্ণা নিবারণের জন্য, আমাদের মঙ্গলবিধান করুন। সুখসম্বন্ধযুতা হে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবীগণ! আমাদের প্রতি আপনাদের করুণাধারা বর্ষিত হোক। ১।

মন্ত্রাৰ্থআলোচনা –এ মন্ত্রে পানের নিমিত্ত জলের প্রার্থনা অথবা যজ্ঞকার্যের জন্য সুখবিধানের আকাঙ্ক্ষা,ভাষ্যাভাষে প্রকাশ দেখি। যজ্ঞের জন্য সুখের বিধান করুন–পানের উপযোগী হোন, মঙ্গলবিধান ও অমঙ্গল-নিবারণ করুন, আমাদের মস্তকে ক্ষরিত হোন, মন্ত্রের এইরকম অর্থই প্রধানতঃ প্রচলিত আছে। আমরা বুঝছি, এখানে আপঃ সম্বোধনে মাত্র জলকে আহ্বান করা হয়নি। দেবীর পদের দ্বারা–জলের-অতীত ধারণার-বিষয়ীভূত সামগ্রীকেই বোঝাচ্ছে। অভিষ্টয়ে পদে যজ্ঞের জন্য অর্থ গ্রহণ না করে, ঐ শব্দে যজ্ঞফল অভীষ্টসিদ্ধিরূপ কামনা প্রকাশ পেয়েছে বলে আমরা মনে করি। তাতে, অভীষ্টসিদ্ধির জন্য বলতে, নানা ভাব মনে আসে। কেবল যদি জলপান উদ্দেশ্য হতো, তাহলে পীতয়ে পদেই সে ভাব ব্যক্ত হতো; যদি কেবল বারিবর্ষণের ভাবই ব্যক্ত করার অভিপ্রায় থাকত, তাহলে সুব পদে সে ভাব প্রকাশ পেত। কিন্তু ঐ দুই পদের উপরেও অভিষ্টয়ে পদ আছে। সুতরাং কেবল জলের প্রার্থনা ভিন্ন তার মধ্যে অন্য প্রার্থনা নিশ্চয়ই প্রকাশ পেয়েছে। সর্বাপেক্ষা উচ্চ অভীষ্ট-সিদ্ধি হয়– পরমার্থ-লাভে। ঐ শব্দে সেই চরম আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ পেয়েছে। পীতয়ে পদ সে পক্ষে বিশেষ অর্থ প্রকাশ। করে। তৃষ্ণার জ্বালায় ছটফট করবার সময় পানীয়ের প্রার্থনা আবশ্যক হয়। সংসারের পাপের জ্বালায় মানুষ যখন জ্বলে মরে, তখন সে পুণ্যসমুদ্ভূত শান্তিবারির প্রার্থনা জ্ঞাপন করে। আমার অভীষ্ট পূরণ করো, আমার তৃষ্ণা নিবারণ করো,–এইরকম উক্তিতে অশান্তি দূর করে আমাকে শান্তিধামে নিয়ে যাও, এমন আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ পায়। আমার সুখের বা আমার মঙ্গলের বিধান করো, আমার প্রতি করুণাধারা বর্ষণ করো, আমি শান্তি-শীতলতা প্রাপ্ত হই,–এখানে মন্ত্রের তাৎপর্য এইরকম প্রার্থনা-মূলক বলে আমরা মনে করি। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ অসু মে সোমো অব্রবীদন্তবিশ্বানি ভেষজা। অগ্নিং চ বিশ্বসম্ভবং। ২।

 বঙ্গানুবাদ –জলদেবতার মধ্যে সর্বপ্রকার ভেষজ এবং সর্বসুখকর জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব বিদ্যমান আছেন। সোম (অন্তরস্থায়ী শুদ্ধসত্ত্বভাব, ভক্তিভাব, পরাজ্ঞান) আমাদের তা বলেছেন। ২।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এ মন্ত্রে অনেকগুলি বিষয় লক্ষ্য করবার আছে। বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে সাধারণ জলের বিশেষণ-মূলক উক্তি এ মন্ত্রে দৃষ্ট হয়। জল ভেষজ ইত্যাদি গুণসম্পন্ন, জল সর্বব্যাধিবিনাশক ইত্যাদি উক্তিতে, বর্তমান কালের জল-চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব এর অন্তর্নিহিত আছে, বুঝতে পারা যায়। জলের মধ্যেও যে অগ্নি বিদ্যমান–এ মন্ত্রে সেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অবগত হওয়া যায়; আবার অন্যপক্ষে, সকল মঙ্গলনিলয় জ্ঞানের এবং সর্বব্যাধি-শান্তিকারক ভেষজের সন্ধান–জলদেবতার অর্চনায় যে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তা-ও জানতে পারি।–এ মন্ত্রে আর একটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার বিষয়–সোমঃ শব্দ। বেদের সোম যে সোমলতা নয়,–এ মন্ত্রে তা সপ্রমাণ হয়। সোমঃ অব্রবীৎ অর্থাৎ সোম বলেছিল–এতেই সোমের লতা-ভাব দূর হচ্ছে। সোমলতা, সোমলতার রস, মাদকদ্রব্য প্রভৃতি সম্বন্ধে যারা উচ্চ চীৎকার ১) করেন, যাঁদের গবেষণার প্রভাবে পূতিকা পর্যন্ত ঐ সোম-পর্যায়ে গণ্য হয়, তারা এইবার বুঝুন-সোম কি? সোম বলেছিল বলতে, পুইগাছ বলেছিল–বলা যাবে কি? এখানেই বোঝা যায়–সোম শব্দে আমরা যে অর্থ গ্রহণ করে এসেছি, শুদ্ধসত্ত্বভাব ভক্তিভাব–এখানে সেই অর্থেরই সার্থকতা প্রতিপন্ন হচ্ছে। –আমার হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বভাব আমাকে বলেছিল, আমার সৎ-বৃত্তি সমূহের সাহায্যে আমি জেনেছিলাম, আমার বিবেক-বুদ্ধি আমাকে জ্ঞাপন করেছিল–সোমঃ অব্রবীৎ বাক্যে সেই ভাবই ব্যক্ত করছে।…হৃদয়ে জ্ঞানের সঞ্চার হলে, অন্তর আপনিই বলে দেয়,দেবতা কেমন বা কি ভাবে অবস্থিত আছেন! এখানে এ মন্ত্রে, সেই বিষয়ই ব্যক্ত রয়েছে। সায়ণকেও এখানে সোম শব্দে সোমলতা অর্থ পরিহার করতে হয়েছে। অন্তর্বর্তমানং সোমঃ–এই বাক্য তাঁর ভায্যেই প্রকাশ পেয়েছে। জলদেবতা যে সর্বপ্রকার, ভেষজগুণসম্পন্ন, তাঁকে প্রাপ্ত হলে যে আধি-ব্যাধি-শোক-সন্তাপ দূরীভূত হয়, আবার তারই মধ্যে যে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব বিদ্যমান রয়েছেন,–অন্তর ভক্তিযুত হলে, হৃদয় সৎ-ভাবপূর্ণ হলে, আপনা-আপনিই মানুষ তা জানতে পারে,-সোমরূপ শুদ্ধসত্ত্বভাবই সে তত্ত্বে বিজ্ঞাপিত হয়।…প্রার্থনা পক্ষে এই মন্ত্রের মর্মার্থ এই যে, সোমস্বরূপ আমার অন্তর্নিহিত হে সৎ-বৃত্তি বা সৎ-ভাব, আমাকে জলদেবতার স্বরূপ-তত্ত্ব জ্ঞাপন করুন। সে ৩ অবগত হয়ে, আমি যেন সর্ববিধ ব্যাধিশূন্য হই এবং সর্বজ্ঞানে জ্ঞানান্বিত হয়ে পরম-মঙ্গল লাভ করি।–বস্তুতঃ এর অপেক্ষা উচিৎ প্রার্থনা আর কিছুই হতে পারে না। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ আপঃ পৃণীত ভেষজং বরূথং তুন্বেত মম। জ্যোক্‌ চ সূর্যং দৃশে ॥ ৩॥

 বঙ্গানুবাদ –হে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবতা! প্রার্থনাকারী আমার শরীরের নিমিত্ত আপনি রোগনাশক ঔযধ প্রেরণ (পূরণ) করুন। তাতে আমরা নীরোগ হয়ে চিরকাল জ্ঞান-স্বরূপ জ্যোতির্ময় আপনাকে (সর্বত্র) দর্শন করতে সমর্থ হই। ৩

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— এ মন্ত্রের অর্থ সরল ও সুবোধ্য। দেহ ব্যাধিগ্রস্ত হলে ভগবানের আরাধনায় বিঘ্ন ঘটে। এখানকার প্রার্থনা তাই,–হে জলাধিষ্ঠাত্রী দেবতা! আপনি রোগ-নিবারক ঔষধ প্রদান করুন; আমি যেন তার দ্বারা সুস্থ ও নীরোগ থেকে একাগ্রচিত্তে আপনার অর্চনা করতে সমর্থ হই। অর্থাৎ, যে কর্মের প্রভাবে নীরোগ ও সুস্থদেহ হয়ে সৎস্বরূপ জ্ঞান-লাভের অধিকারী হই, হে দেবতা! আপনি আমার পক্ষে তা-ই বিহিত করুন। এই মন্ত্রের অন্তর্গত সূর্যং শব্দে জ্যোতির্ময় জ্ঞানময় ভগবানের প্রতি লক্ষ্য আসে।…এ ঋকের অন্তর্গত বরূথং পদে এক নূতন ভাব পরিগ্রহ করা যায়। শত্রু থেকে দূরে গুপ্ত-স্থানে অবস্থিতি রূপ নিরাপদ অবস্থা বরূথং পদের দ্যোতক হয় ॥ ৩

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ শং ন আপো ধন্বন্যাতঃ শমু সপ্যা। শং নঃ খনিত্রিমা আপঃ শমু যাঃ কুম্ভ আভৃতাঃ শিবা নঃ সন্তু বার্ষিকীঃ ৪৷

বঙ্গানুবাদ –মরুদেশসস্তৃতা হে জলসকল (অথবা, আমার মরুসদৃশ হৃদয়-দেশে ক্ষীণাকারে। বিদ্যমানা স্নেহকারুণ্যরূপিণী জলাধিষ্ঠাত্রী হে দেবীগণ)! আপনারা আমাদের মঙ্গলপ্রদায়িনী হোন; হে প্রভূতজলপ্রদেশস্থা আপ (অথবা, প্রবলস্নেহ-কারুণ্যপূর্ণ হৃদয়স্থিত ভগবৎ-বিভূতিনিচয়)! আপনারা সর্বতোভাবে আমাদের মঙ্গলপ্রদায়িনী হোন; খনন দ্বারা উদ্ভূতা জল (অথবা, অতীব প্রয়াসের দ্বারা অধিগতা হে দেববাবলি!), আপনারা আমাদের সুখকারী হোন; কুম্ভে (অথবা, ঘটান্তর হতে) সংগৃহীত যে জল (অথবা, স্নেহভাবাবলি) এবং বর্ষণহেতু যে জল (অথবা, ভগবৎকৃপায় প্রাপ্ত যে স্নেহভাবাবলি!), আপনারা আমাদের মঙ্গলপ্রদ হোন। ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা দুভাবে এই মন্ত্রের দুরকম অর্থ অধ্যাহার করা যায়। এক অর্থে, নানারকম জলকে সম্বোধন করে মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে বলতে পারি; অন্যরকম অর্থে, ভগবানের স্নেহ-কারুণ্য ইত্যাদি বিভূতিকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়াস দেখতে পাই। বলা বাহুল্য, প্রথম প্রকারের অর্থই সাধারণ্যে প্রচারিত আছে। শেষোক্ত প্রকারের অর্থ মন্ত্রের অভ্যন্তরে চিরলুক্কায়িত রয়েছে। প্রথম প্রকার অর্থে মনে হয়, প্রার্থনাকারী যেন বলছেন,–হে মরুদেশের জল! তোমরা আমাদের মঙ্গল করো; হে জলপূর্ণদেশের জল! তোমরা আমাদের সুখী করো; হে খননের দ্বারা উৎপন্ন জল (অর্থাৎ কূপ ইত্যাদির জল)! তোমরা আমাদের সুখবিধান করো; হে কুম্ভস্থিত জল অথবা বৃষ্টির জল! তোমরা আমাদের পক্ষে সুখকারী হও। বলা বাহুল্য, এ অর্থে বুঝতে পারা যায় না যে, কোনও জলশূন্যদেশের প্রার্থী, জলের নিকট এমন প্রার্থনা করছেন। জনপদের অধিবাসীরা, কূপপাদক ভিন্ন গত্যন্তর নেই যাদের, কুম্ভে জল রক্ষাকারী কিংবা বৃষ্টির জলের জন্য যারা অপেক্ষা করে থাকে–তারা এমন প্রার্থনা জানাতে পারে। কিন্তু তাতে কি ইষ্ট সাধিত হয়, তা বোধগম্য হয় না। পরন্তু এই প্রার্থনার মধ্যে যদি সর্বজনীন ভাব লক্ষ্য করবার প্রয়াস পাই, তাহলে বুঝতে পারি,-এ মন্ত্র সকল দেশের সকল লোকের সকল অবস্থার উপযোগী। বুঝতে পারি,–এ মন্ত্র এক পরম পবিত্র প্রার্থনা বক্ষে ধারণ করে আছে।–মন্ত্রের এক একটি শব্দের বিষয় অনুধ্যান করলেই, সে মর্মার্থ আপনিই হৃদয়গত হবে। ধন্বন্যাঃ আপঃ বলতে কি ভাব মনে আসে? আমাদের মরুসদৃশ এই হৃদয় কখনও সেহকরুণার সুধারসে আর্দ্র হলো না। কখনও লোকহিতকর কোনও বৃত্তি তার মধ্য থেকে জেগে উঠলো না।.. ভগবৎ-প্রেরিতা যে ক্ষীণা স্রোতঃস্বতী (দয়াদাক্ষিণ্য ইত্যাদি) অন্তঃশীলা বইছে, সংসারের বিষম পাপতাপের মধ্যে পড়ে সেটুকুও বিশুষ্ক হতে চললো! তাই প্রার্থনা–আমার মরুসদৃশ হৃদয়ের মধ্যে ক্ষীণাকারে যে স্নেহ-করুণার ধারা প্রবাহিত হচ্ছিল, তারা আবার জেগে উঠুক,–প্রবলভাবে বর্ষার প্লাবনের মতো প্রবাহিত হয়ে বিশুষ্ক হৃদয়-ভূমিকে রসগুণে আর্দ্র করুক।..মন্ত্রের প্রথমাংশ (শং নো আপো ধম্বন্যাঃ) সেই প্রার্থনার ভাব প্রকাশ করছে। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশ (শমুসন্তপ্যাঃ ) এক পক্ষে সাবধানতা-সূচক, অন্য পক্ষে প্রাচুর্যতিবজ্ঞাপক। প্রবল করুণা-স্নেহের বশে বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ অনেক সময় অনেক অপকর্ম করে বসে। এক পক্ষে এ মন্ত্রের প্রার্থনার বিষয় তাই মনে হয়,–হে আমার হৃদয়স্থ প্রবল স্নেহ-করুণা! তোমরা আমাদের পক্ষে মঙ্গলপ্রদ হও; অর্থাৎ, যেখানে যেভাবে স্নেহ-কারুণ্য বিতরণ করা কর্তব্য, আমরা যেন সেখানে সেইভাবে তোমাদের বিতরণ করতে সমর্থ হই। অন্য পক্ষে, ভগবৎ-বিভূতি-রূপে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রচুর সৎ-গুণাবলি যেন প্রাচুর্য লাভ করে আমাদের মঙ্গল-বিধানে সমর্থ হয়। অতঃপর মন্ত্রের দ্বিতীয় পংক্তির খনিত্রিমা পদে–খননের দ্বারা–কষ্টের দ্বারা অতি প্রয়াসের দ্বারা যে দেবভাব হৃদয়ে সঞ্জাত হয়, তাই লক্ষ্য হয়। কোনওরকমে, অপরের দৃষ্টান্ত অনুসারে, হৃদয়ে যে একটু সত্ত্বভাবের সঞ্চার হয়, অথবা ভগবানের কৃপায় যে একটু সত্ত্বভাবের অধিকারী হওয়া যায়, উপসংহারে সেই দুই ভাবের প্রতিষ্ঠাকল্পে পরিবৃদ্ধির বিষয়ে, প্রার্থনা করা হচ্ছে। অতঃপর কুম্ভে ও বার্ষিকীঃ পদ দুটির সার্থকতা উপলব্ধি করুন।… এ বলা হচ্ছে, যদি কোনও রকমে হৃদয়ে একটু সত্ত্বভাবের উদয় হয়, যদি কদাচিৎ ভগবানের অনুকম্পায় একটু সত্ত্বভাবের অধিকারী হই, হে দেবীগণ! সেই ভাবের বিকাশের পক্ষে আপনারা আমায় অনুগ্রহ করুন। সর্বরূপে প্রাপ্ত স্নেহ-করুণা ইত্যাদি দেব-বিভূতি-সমূহ আমাদের মঙ্গলপ্রদ ও সুখের হেতুভূত হোক। স্থূলতঃ, এটাই মন্ত্রের প্রার্থনা ॥৪॥

8 Comments
Collapse Comments

please, more update.

I’m finding ATHARBA BED Bengali PDF for TANTRA SADHANA

Dhirendranath Pandey January 22, 2020 at 7:23 pm

অথর্ব বেদের আর খন্ডগুলি নেই কেন?

Bangla Library (Administrator) January 25, 2020 at 12:11 pm

চুরি গেছে। আবার নতুন করে কিনে কাজ শুরু করতে হবে।

free sources paoa jayni naki ?

Bangla Library (Administrator) December 26, 2020 at 3:08 pm

বই সংগ্রহ করতে পারা গেছে। কাজটা অনেক বড় এবং ঝামেলার, তাই দিতে দেরি হচ্ছে।

দেখুন যত তাড়াতাড়ি দিতে পারেন?

বাংলা লাইব্রেরি (Administrator) April 18, 2024 at 12:51 pm

এখন কি বাকিগুলো দেখতে পাচ্ছেন না?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *