ঋগ্বেদ ০৮।০৪৬

ঋগ্বেদ ০৮।০৪৬
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ৮ম মণ্ডল সূক্ত ৪৬
২১ হইতে ২৪ পর্যন্ত পৃথুশ্রবার পুত্র কনীতের দানস্তুতি দেবতা; ২৫ হইতে ২৮ পর্যন্ত এবং ৩২ ঋকটির বায়ু দেবতা; অবশিষ্টের ইন্দ্র দেবতা। অশ্বপুত্র বশ ঋষি।

১। হে বহুধনবান, কৰ্ম্মপূরক ইন্দ্র! তোমার সদৃশ লোকেরাই আমার আত্মীয়, তুমি হরিনামক অশ্বের অধিষ্ঠাতা।

২। হে ইন্দ্র! তোমায় নিশ্চয়ই অন্নদাতা বলিয়া জানি। ধনদাতা বলিয়া জানি।

৩। হে অপরিমিত রক্ষাযুক্ত শতক্রতু! তোমার মহিমা স্তোতাগন স্তুতিদ্বারা স্তুতি করে।

৪। দ্রোহ রহিত মরুৎগণ যাহাকে রক্ষা করেন, অৰ্য্যমা ও মিত্র যাহাকে রক্ষা করেন, সেই মনুষ্যই সুযোগ্য হয়।

৫। আদিত্যের অনুগৃহীত যজমান গোবিশিষ্ট, অশ্ববিশিষ্ট, সুন্দর বীৰ্য্যবিশিষ্ট পুত্র লাভ করিয়া সৰ্ব্বদা বর্ধিত হয়, বহুসংখ্যক স্পৃহনীয় ধনের দ্বারা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।

৬। বলপ্রয়োগকারী, ভয়রহিত, সকলের স্বামী, সেই প্রসিদ্ধ ইন্দ্রের নিকট ধন যাচ্ঞা করি।

৭। সর্বত্রগামী, ভয়রহিত, সমস্ত সহায়ভূত মরুতসেনা ইন্দ্রেরই। গমনশীল হরিগণ আনন্দার্থ বহুধনপ্রদ ইন্দ্রকে অভিযুত সোমের নিকট আনয়ন করুন।

৮। হে ইন্দ্র! তোমার যে হর্ষ বরণীয়, যাহাদ্বারা শত্রুদিগকে অতিশয় বধ কর, যাহাদ্বারা শত্রুর নিকট হইতে ধন গ্রহণ কর, সংগ্রামে যাহাকে পার হওয়া যায় না।

৯। হে সকলের বরণীয় ইন্দ্র! যুদ্ধে দুস্তর শত্ৰুগণের পারগ এবং সর্বত্র বিখ্যাত, হে সর্বাপেক্ষা বলবান বাসপ্রদ ইন্দ্র! তোমার সেই হর্ষের সহিত আমাদের যজ্ঞে আগমন কর, আমরা গোযুক্ত গোষ্ঠে গমন করিব।

১০। হে মহাধনবান ইন্দ্র! আমাদের গোলাভের ইচ্ছা হইলে, কিম্বা অশ্বলাভের ইচ্ছা হইলে, কিম্বা রথ লাভের ইচ্ছা হইলে, পুৰ্ব্বকালের ন্যায় দান কর।

১১। হে শূর ইন্দ্র! সত্যই আমি তোমার ধনের ইয়ত্তা জানি না, হে মঘবান, বজ্রবান ইন্দ্র! আমাদিগকে শীঘ্র ধন দান কর, অন্নের দ্বারা আমাদের কৰ্ম্ম রক্ষা কর।

১২। যে ইন্দ্র দর্শনীয়, ঋত্বিকগণ যাহার সখা, যিনি বহুলোকের স্তুত, তিনি সমস্ত জাতবস্তু অবগত আছেন, সমস্ত মনুষ্যগণ হব্য গ্রহণ করতঃ সৰ্ব্বকালে সেই বলবান ইন্দ্রকে আহ্বান করে।

১৩। সেই বহু ধনবান, মঘবান, বিত্রহা ইন্দ্র সংগ্রামে আমাদের রক্ষক এবং অগ্রবর্তী হউন।

১৪। হে স্তোতাগণ! তোমাদের জন্য সোমজনিত মত্ততা উৎপন্ন হইলে, বিশিষ্ট প্রজ্ঞাযুক্ত, সৰ্ব্বত্র বিখ্যাত, সামৰ্থবান শত্রুগণের অবনতিকর, বীর ইন্দ্রকে তোমাদের যেরূপ বাক্য স্ফুর্তি হয়, সেইরূপে মহতী স্তুতিদ্বারা স্তব কর।

১৫। হে ইন্দ্র! তুমি আমার শরীরের জন্য এখনই ধনের দাতা হও। সংগ্রামে অন্নবান ধনের দাতা হও। হে পুরুহূত! পুত্রদিগকে ধন দান কর।

১৬। সমস্ত ধনের ঈশ্বর এবং বাধাপ্রদ, যুদ্ধকল্পনাকারী শত্রুর অভিভবকর ইন্দ্রকে স্তব করিতেছে। তিনি শীঘ্র ধন দান করিবেন।

১৭। হে ইন্দ্র! তুমি মহান, আনি তোমার আগমন ইচ্ছা করি, তুমি গমনশীল, সংপূৰ্ণগামী ও সেচক, তোমায় যজ্ঞ ও স্তুতি দ্বারা স্তব করি, তুমি মরুতগণের নেতা, সকল মনুষ্যের ঈশ্বর, নমস্কার ও স্তুতিদ্বারা তোমার গুন গান করি।

১৮। যাহারা মেঘের পতনশীল জলের সহিত গমন করে, সেই প্রভূত ধ্বনিযুক্ত মরুৎগণের উদ্দেশে যজ্ঞ করিব এবং সেই যজ্ঞে মহাধ্বনিযুক্ত মরুৎগণ যে সুখ দিতে পারেন, তাহা প্ৰাপ্ত হইব।

১৯। তুমি দুৰ্ম্মতিগণের বিনাশক, তোমার নিকট যাচঞা করি, হে অত্যন্ত বলবান ইন্দ্র! আমাদের জন্য উপযুক্ত ধন আহরণ কর। তোমার বুদ্ধি সর্বদা ধনপ্রেরণ তৎপর। হে দেব! উৎকৃষ্ট ধন আহরণ কর।

২০। হে দাতা, উগ্র, বিচিত্র, প্রিয়সত্যভাষী, শত্রু পরাভবকারী সকলের স্বামী ইন্দ্র! শত্রু পরাভব কর, ভোগযোগ্য প্রবৃদ্ধ ধন যুদ্ধে আমাদিগকে প্রদান কর।

২১। যেহেতু অশ্বের পুত্র বশ (১) কন্যার পুত্র পৃথুশ্রবা রাজার নিকট প্ৰাতঃকালে ধন গ্রহণ করিয়াছেন, অতএব যে দেবশূন্য মনুষ্য পূর্ণধন গ্রহণ করিয়াছে, সে আগমন করুক।

২২। আমি ষষ্টিসহস্র অযুত অশ্ব লাভ করিয়াছি। বিংশতিশত উষ্ট্র লাভ করিয়াছি, কৃষ্ণবর্ণ দশশত বড়বা লাভ করিয়াছি। তিন স্থানে শুভ্রবর্ণযুক্ত দশসহস্র গো লাভ করিয়াছি(২)।

২৩। দশটী কৃষ্ণবর্ণ অশ্ব রথ নেমি প্রবৰ্ত্তিত করিতেছে। তাহারা অত্যন্ত বেগবান, বলবান মন্থনকারী।

২৪। উৎকৃষ্ট ধনযুক্ত কন্যাপুত্র পৃথুশ্রবার দান এই—তিনি হিরন্ময় রথ দিয়াছেন, তিনি অতিশয় দাতা ও প্রাজ্ঞ। তিনি অত্যন্ত প্রবৃদ্ধ কীর্তি লাভ করিয়াছেন।

২৫। হে বায়ু! তুমি মহাধনাৰ্থ এবং পূজনীয় বলাৰ্থ আমাদের নিকট আগমন কর। তুমি প্রভুত ধন দাতা, তোমার স্তুতি করিতেছি, তুমি মহা ধনদাতা, এখনই তোমার স্তুতি করি।

২৬। হে সোমপায়ী, দীপ্ত ও পূত সোমের পানকৰ্ত্তা বায়ু! যিনি অশ্বে গমন করেন, গৃহে বাস করেন, ত্রিগুণিত সপ্ততিসংখ্যক গাভীর সাহায্যে গমন করেন, তিনিই তোমায় সোম প্রদানার্থ সোমযুক্ত হইয়াছেন ও অভিষবকারিগণের সহিত মিলিত হইয়াছেন।

২৭। যে পৃথুশ্রবা আপনি আমাকে এই বিচিত্র ধন দান করিব মনে করিয়া হৃষ্ট হইয়াছিলেন, তিনি আপনার কাৰ্য্যাধ্যক্ষ অরদ্ব, অক্ষ, নহুষ ও সুকৃত্ত্বকে আজ্ঞা করিলেন।

২৮। হে বায়ু! যিনি উচথ্য ও বপু নামক রাজার অপেক্ষাও অধিক বলবান, সেই ঘৃতবৎ শুদ্ধ রাজা যে অন্ন, অশ্ব, উষ্ট্র ও কুকুর পৃষ্ঠে প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহা এই (৩), ইহা তোমারই অনুগ্রহ।

২৯। এক্ষণে ধনাদির প্রেরক সেই রাজার অনুগ্রহে সেচক অশ্বের ন্যায় ষষ্টিসহস্র সংখ্যক প্রিয় গাভীও লাভ করিলাম।

৩০। গাভী সমূহ যেমন যূথে গমন করে, সেইরূপ বলীবর্দ সকল আমার নিকট আগমন করিতেছে। বলীবর্দ সকল আমার নিকট আগমন করিতেছে।

৩১। উষ্ট্রগণ যখন বনাভিমুখে প্রেরিত হইয়াছিল, তখন শত উষ্ট্র আমার জন্য ডাকাইয়া আনিলেন। শ্বেতবর্ণ গাভীর মধ্যে বিংশতিশত গাভী আনিলেন।

৩২। আমি বিপ্র, আমি গো ও অশ্বের রক্ষক, বল্বথ নামক দাসের নিকট শত গো ও অশ্ব গ্রহণ করিলাম (৪)। হে বায়ু! এই লোক সকল তোমার, ইহারা ইন্দ্র কর্তৃক ও দেবগণকর্তৃক রক্ষিত হইয়া আনন্দিত হন।

৩৩। এক্ষণে তাহারা স্বৰ্ণাভরণবিশিষ্ট, পূজনীয় কন্যাকে (৫) অশ্বের পুত্র বশের অভিমুখে আনয়ন করিতেছেন।
————

(১) পৃথুশ্রবা অশ্বের পুত্র বশকে যে ধন প্রদান করিয়াছিলেন, এই চারটি শ্লোকে তাহারই প্রশংসা করা হইয়াছে। অবিবাহিতা কন্যার পুত্র হইলে সেই পুত্রকে “কানীত” (কন্যাপুত্র) বলে।

(২) এ ঋকে যে অশ্ব ও উষ্ট্র ও কৃষ্ণবর্ণ বড়বা ও শুভ্রবর্ণযুক্ত গোর সংখ্যা দেওয়া হইয়াছে, তাহা অনেক বাড়ান, তাহার সন্দেহ নাই। এত পশু কোনও এক জনের থাকাও অসম্ভব এবং কেহ কাহাকে দান করাও অসম্ভব।

(৩) অশ্ব ও উষ্ট্র পৃষ্ঠে দ্রব্য প্রেরণ করার প্রথা এখনও আছে, কিন্তু কুকুর কি কখনও দ্রব্য বহন করিত? গাভী ও বলীবর্দের উল্লেখ পরের ঋকে দেখ।

(৪) “Professor Roth conjectures that the correct reading is Satam Dasan, I received a hundred slaves.”—Muir’s Sanscrit Texts, vol. V, p. 461.

(৫) মূলে “যোযনা” আছে। বহুপশুর সহিত স্বর্ণাভরণবিশিষ্টা কন্যা বা দাসী ও রাজাদ্বারা দান করা হইয়াছিল। এই অষ্টম মন্ডলে অনেক স্থানে রাজাদিগের প্রভূত দানের উল্লেখ আছে, ঋগ্বেদের প্রথম অংশে এরূপ দেখা যায় নাই। তাৎকালিক সমাজে সকলেই নিজ নিজ ক্ষুদ্র যজ্ঞ সম্পাদন করিতে সমর্থ ছিল, কেবল ধনবানগণ ঋত্বিক ডাকাইয়া আড়ম্বরের সহিত বড় বড় যজ্ঞ করিতেন। ক্রমে এইরূপ ধনবান ও রাজাদিগের সংখ্যা বাড়িতে লাগিল, যজ্ঞের আড়ম্বর বাড়িতে লাগিল, ঋত্বিকগণের ক্ষমতা বাড়িতে লাগিল এবং লাভও বাড়িতে লাগিল, তাহার পরিচয় আমরা পাইতেছি।