ঋগ্বেদ ০৭।১০৪

ঋগ্বেদ ০৭।১০৪
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ৭ম মণ্ডল  সূক্ত ১০৪
নবম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশের সোম দেবতা; একাদশের দেব দেবতা; অষ্টম ও ষোড়শের ইন্দ্র দেবতা; সপ্তদশের গ্রাবা দেবতা; অষ্টাদশের মরুৎ দেবতা; দশম ও চতুর্দশের অগ্নি দেবতা, প্রবত্তর ইত্যাদি পাঁচটির ইন্দ্র দেবতা; ত্রয়োবিংশের পূর্বার্ধ বসিষ্ঠের প্রার্থণা, অপরার্ধের পৃথিবী ও অন্তরিক্ষ দেবতা; অবশিষ্টের দেবতা রক্ষোবিনাশক ইন্দ্র ও সোম। বসিষ্ঠ ঋষি।

১। হে ইন্দ্র ও সোম! তোমরা রাক্ষসগণকে সন্তাপ প্রদান কর ও হিংসা কর। হে কামবর্ষিদ্বয়! তোমরা অন্ধকার দ্বারা বর্ধমান রাক্ষসদিগকে নীচ করিয়া দেও। জ্ঞানরহিত রাক্ষসদিগকে পরাঙ্মুখ করিয়া হিংসা কর, দগ্ধ কর, মারিয়া ফেল, দূর করিয়া দেও। ভক্ষক রাক্ষসগণকে কৃশ করিয়া ফেল।

২। হে ইন্দ্র ও সোম! অনৰ্থবাদী, আক্রমণকারী শত্রুকে একেবারেই অভিভব কর, তাপপ্রাপ্ত রাক্ষস অগ্নিতে প্রক্ষিপ্ত চরুর ন্যায় বিলুপ্ত হউক। ব্রহ্মদ্বেষী ক্রব্যাদ ঘোরদর্শন ক্রূরবুদ্ধির প্রতি যাহাতে নিরন্তর দ্বেষ থাকে তাহা কর।

৩। হে ইন্দ্র ও সোম! দুষ্কর্মকারীকে আবরণ কর, মধ্যস্থলে অবলম্বন রহিত অন্ধকার মধ্যে ফেলিয়া তাড়ন কর, যে ইহাদের মধ্যে একজনও উহার মধ্য হইতে পুনরায় উদগত হইতে না পারে। তোমাদের সেই প্রসিদ্ধ ক্ৰোধবিশিষ্ট বল অভিভবাৰ্থ সমর্থ হউক।

৪। হে ইন্দ্র ও সোম! অন্তরিক্ষ হইতে বধ কর, আয়ুধ উৎপাদন কর। অনর্থ উৎপাদকের জন্য পৃথিবী হইতে নাশ কর, আয়ুধ উৎপাদন কর। মেঘ হইতে উপতাপপ্রদ অশনি উৎপাদন কর, যদ্দ্বারা প্রবৃদ্ধ রাক্ষসকে বিনাশ করিয়াছ।

৫। হে ইন্দ্র ও সোম! অন্তরিক্ষ হইতে চারিদিকে আয়ুধসমূহ প্রেরণ কর। তোমরা অগ্নিদ্বারা সন্তপ্ত, তাপপ্রদ, প্রহারযুক্ত, জরারহিত প্রস্তর বিকারভূত অস্ত্রদ্বারা রাক্ষসগণকে পার্শ্বস্থানে বিদ্ধ কর। তাহারা নিঃশব্দে নির্গত হউক।

৬। হে ইন্দ্র ও সোম! কক্ষ বন্ধনরজ্জু যেমন অশ্বকে বেষ্টন করে, সেইরূপ এই মনোহর স্তুতি তোমাদিগকে প্ৰাপ্ত হউক। তোমরা বলবান; আমরা মেধা বলে এই স্তোত্র প্রেরণ করিতেছি। নৃপতির ন্যায় তোমরা এই স্তোত্র সকলকে ফলযুক্ত কর।

৭। হে ইন্দ্র ও সোম! ত্বরমান অশ্বের সাহায্যে অভিগমন কর। দ্রোহশীল ভঞ্জনকারী রাক্ষসদিগকে নিধন কর। পাপকারী রাক্ষসের যেন সুখ না হয়। কারণ সে দ্রোহযুক্ত হইয়া আমাদিগকে কখন না কখন হনন করিতে পারে।

৮। আমি শুদ্ধমনে ব্রত আচরণ করি। যে অনৃত বাক্যদ্বারা আমার অপবাদ দেয়; হে ইন্দ্র! মুষ্টিতে গৃহীত জলের ন্যায় সেই অসত্যবাদী অস্তিত্ব শূন্য হউক।

৯। আমি পরিপক্ক বাক্যযুক্ত, যাহারা আপনার স্বার্থের জন্য আমার পরিবাদ করে, আমি কল্যাণবৃত্তি, যাহারা বলযুক্ত হইয়া আমার দোষ দেয়, সোম তাহাদিগকে সর্পের উপর পাতিত করুণ, অথবা নিঋতির উৎসঙ্গে অৰ্পণ করুন।

১০। হে অগ্নি! যে আমাদের অন্নের সার নষ্ট করিতে ইচ্ছা করে, যে অশ্বগণের, গোসকলের ও সন্তানগণের সার নষ্ট করিতে ইচ্ছা করে, শত্রু, চোর ও ধনাপহারী সেই ব্যক্তি হিংসা প্ৰাপ্ত হউক, সে আপনার শরীর ও তনয়ের সহিত নিহত হউক।

১১। সে তনু ও তনয় হইতে বিযুক্ত হউক, ব্যাপ্ত তিন পৃথিবীর অধোদেশে গমন করুক। যে দিনরাত্রি আমাদিগকে হিংসা করিতে ইচ্ছা করে, হে দেবগণ! তাহার যশঃ পরিশুষ্ক হউক।

১২। বিদ্বানগণের বিদিত হউক, যে সত্য এবং অসত্যরূপ ৰাক্যদ্বয় পরস্পর স্পৰ্দ্ধা করে; তাহদের মধ্যে যাহা সত্য এবং যাহা ঋজুতম, সোম তাহাকেই পালন করেন, অসত্যকে হিংসা করেন।

১৩। সোমদেব পাপকারীকে প্রবর্তিত করেন না; বলযুক্ত, মিথ্যাবাদী পুরুষকেও প্রবর্তিত করেন না। তিনি রাক্ষসকে হনন করেন, অসত্যবাদীকে হনন করেন, সে হত হইয়া ইন্দ্রের বন্ধনে বাস করে(১)।

১৪। যদি আমার দেবতাগণ অসভ্যস্বরূপ হইত, অথবা যদি আমি বৃথা দেবগণের নিকট গমন করিতাম, তাহা হইলে হে জাতবেদা অগ্নি! তুমি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হইতে। মিথ্যাবাদিগণ তোমার হিংসা বিশেষরূপে লাভ করুক।

১৫। যদি আমি যাতুধান হই, অথবা যদি কোনও পুরুষের আয়ুঃ নাশ করিয়া থাকি, তাহা হইলে আমি যেন এখনই মরিয়া যাই। যে আমাকে মিথ্যাজপে যাতুধান বলিয়া সম্বোধন করিতেছে, সে যেন তাহার দশ জন বীর বন্ধু হইতে বিযুক্ত হয় (২)।

১৬। যে আমাকে মিথ্যারূপে যাতুধান সম্বোধন করিতেছে, যে আমাকে শুচি রাক্ষস বলিতেছে, ইন্দ্র মহা আয়ুধদ্বারা তাঁহাকে বিনাশ করুন, সে সকল জন্তুর অধম হইয়া পতিত হউক।

১৭। যে রাক্ষসী রাত্রি কালে দ্রোহযুক্তা হইয়া উলূকীর ন্যায় আপনার শরীর লুক্কায়িত করতঃ গমন করে, সে অবাঙ্মুখ হইয়া অনন্তগর্ভে পতিত হউক। প্রস্তর সকল অভিষবণ শব্দদ্বারা রাক্ষসদিগকে বিনাশ করুক।

১৮। হে মরুৎগণ! তোমরা প্রজাদের মধ্যে বিবিধ প্রকারে বাস কর। যাহারা পক্ষী হইয়া রাত্ৰিতে আগমন করে, অথবা যাহারা দীপ্ত যজ্ঞে হিংসা ধারণ করে, সেই রাক্ষসদিগকে ইচ্ছা কর, গ্রহণ কর ও চূর্ণ কর।

১৯। হে ইন্দ্র! অন্তরিক্ষ হইতে অশনি প্রবৰ্ত্তিত কর, হে মঘবন! সোমদ্বারা তীক্ষ্মীকৃত যজমানকে সংস্কৃত কর, পৰ্ব্বযুক্ত বজ্রদ্বারা পূর্বদিক হইতে, পশ্চিম দিক হইতে, দক্ষিণ দিক হইতে ও উত্তর দিক হইতে রাক্ষসদিগকে বিনাশ কর।

২০। ইহারা কুকুরের দ্বারা হিংসা করতঃ আগমন করে। যাহারা জিঘাংসু হইয়া অহিংসনীয় ইন্দ্রকে হিংসা করিতে ইচ্ছা করে, সেই কপটগণকে হিংসা করিবার জন্য ইন্দ্র অশনি তীক্ষ্ণ করিতেছেন। তিনি শীঘ্র যাতুধানদিগের উদ্দেশে অশনি নিক্ষেপ করুন।

২১। ইন্দ্র হিংসকদিগের হিংসক, পরশু যেরূপ বন ছেদ করে, মুদ্গর পাত্রসমূহকে যেরূপ ভেদ করে, ইন্দ্র সেইরূপ হব্য মন্থনকারী ও অভিমুখে আগমনকারী পূজকদিগের জন্য রাক্ষস সকল বিনাশ করতঃ আগমন করিতেছেন।

২২। হে ইন্দ্র! যাহারা ক্ষুদ্র উলূকরূপে হিংসা করে, তাহাদিগকে বিনাশ কর; যাহারা কুকুররূপে, যাহারা চক্রবাকরূপে, যাহারা শ্যেনপক্ষীরূপে, যাহারা গৃধ্নরূপে বিনাশ করে, পাষাণের ন্যায় বজ্রের দ্বারা সেই সকল রাক্ষসকে মারিয়া ফেল।

২৩। রাক্ষস আমাদিগকে যেন ব্যাপ্ত করিতে না পারে, যন্ত্রণাদায়ী রাক্ষসগণের মিথুন সকল অপগত হউক। এই রাক্ষসেরা “একি একি” বলিয়া বেড়ায়। পৃথিবী আমাদিগকে অন্তরিক্ষভব পাপ হইতে রক্ষা করুন, অন্তরিক্ষ আমাদের স্বৰ্গীয় পাপ হইতে রক্ষা করুন।

২৪। হে ইন্দ্র! রাক্ষসপুরুষকে বিনাশ কর এবং যে রাক্ষসী স্ত্রী বঞ্চনাদ্বারা হিংসা করে, তাহাকেও বিনাশ কর। আঘাত করাই যে সকল রক্ষসের ক্রীড়া,তাহারা ছিন্নগ্ৰীব হইয়া বিনাশ প্ৰাপ্ত হউক। তাহারা যেন উদয়শীল সূৰ্য্যকে দেখিতে না পায়।

২৫। হে সোম! তুমি ও ইন্দ্র তোমরা প্রত্যেকে দর্শন কর, বিবিধ প্রকারে দর্শন কর, জাগরিত হও, যাতুধান রাক্ষসদিগের উদ্দেশ্যে অশনিরূপ আয়ুধ ক্ষেপ কর (৩)।

————
(১) বিশ্বামিত্র ৩।৫৩।২৩ ও ২৪ ঋকে বসিষ্ঠ সম্বন্ধে যে কটূক্তি করিয়াছিইলেন, বসিষ্ঠ এই সূক্তের ১৩ হইতে ১৬ ঋকে তাহার উত্তর প্রদান করিলেন।

(২) মূলে “অধা স বীরৈ দশভির্বিযুযাঃ” আছে। অর্থ যেন তাহার দশটি পুত্র মারা যায়; অথবা বিশ্বামিত্র যে দশ জন রাজার সহিত সুদাসকে আক্রমণ করিয়াছিলেন, সেই দশ জন যেন হত হয়।

(৩) এই সূক্তের শেষ ঋক গুলি “ওঝার মন্ত্র”। এখন যেমন লোকে ভূতের ভয় করে, সেকালে “যাতুধান ও রক্ষ” ভয়ের বিষয় ছিল। সেই রূপ ভয় হইতে রক্ষা পাওয়াই এই সপ্তম মন্ডলের শেষ সূক্তের শেষ ঋকগুলির উদ্দেশ্য। প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ডলের শেষ সূক্তের শেষ ঋকগুলিও এইরূপ “ওঝার মন্ত্র”।