ঋগ্বেদ ০৬।৬১

ঋগ্বেদ ০৬। ৬১
ঋগ্বেদ সংহিতা । ৬ষ্ঠ মণ্ডল । সূক্ত ৬১
সরস্বতী দেবতা। ভরদ্বাজ ঋষি।

১। এই সরস্বতী দেবী হব্যদাতা বধ্র্যশ্বকে বেগসম্পন্ন ও ঋণমোচনকারী দিবোদাস নামক একটী পুত্র প্রদান করিয়াছেন। তিনি নিয়ত কেবল আত্মচিন্তনকারী দানবিমুখ পণি সংহার করিয়াছেন। হে স্বরস্বতী দেবি! ত্বদীয় এই সমস্ত দান অতি মহৎ।

২। এই নদীরূপী সরস্বতী মৃণালখননকারীর ন্যায় প্রবল ও বেগবান তরঙ্গসহকারে পর্বতসানু সকল ভগ্ন করিতেছেন। আমরা রক্ষার নিমিত্ত স্বতি ও যজ্ঞদ্বারা উভয় কুলনাশিনী সরস্বতীর পরিচর্য্যা করিতেছি।

৩। হে সরস্বতি! তুমি দেবনিন্দকগণকে বধ করিয়াছ এবং সর্বব্যাপী মায়াবী বৃসয়ের পু্ত্রকে সংহার করিয়াছ (১)। হে অন্নসম্পন্না সরস্বতী দেবি! তুমি মানবগণকে ভূমি প্ৰদান করিয়াছ, এবং তাহাদিগের জন্য বারিবর্ষণ করিয়াছ।

৪। দানশালনী, অন্নসম্পন্ন। স্তোতৃবর্গের রক্ষাকারিণী সরস্বতী যেন অন্নদ্বারা সম্যকরূপে আমাদিগের তৃপ্তি সাধন করেন।

৫। হে দেবি সরস্বতি! যে ব্যক্তি তোমাকে ইন্দ্রের ন্যায় স্তব করে, সেই ব্যক্তি যখন ধন লাভার্থ যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হয়, তাহাকে তুমি তখন রক্ষা করি ও।

৬। হে অন্নশালনী, দেবি সরস্বত! তুমি সংগ্রামে আমাদিগকে রক্ষা করিও এবং পুষার ন্যায় আমাদিগকে ভোগযোগ্য ধন প্ৰদান করিও।

৭। ভীষণা, হিরন্ময় রথে আরূঢ়া শত্রু ঘাতিনী সেই সরস্বতী যেন আমাদিগের মনোহর স্তোত্ৰ কামনা করেন।

৮। যাহার অপরিামত, অকুটিল দীপ্ত, অপ্ৰতিহতগতি, জলবর্ষী বেগ প্ৰচণ্ড শব্দ করিয়া বিচরণ করে।

৯। নিয়ত ভ্রমণকারী সূর্য্য যেরূপ দিন সকলকে আনয়ন করেন, তদ্রূপ সেই সরস্বতী যেন আমাদিগের সমস্ত শক্রকে পরাজিত করেন এবং সলিলময়ী নিজ অন্যান্য ভগিনীগণকে আমাদিগের নিকট আনয়ন করেন।

১০। সপ্ত নদীরূপ সপ্ত ভগিনী সম্পন্ন (২) প্রাচীন ঋষিগণ কর্তৃক সম্যকরূপে সেবিতা, আমাদিগের প্ৰিয়তমা সরস্বতী দেবী যেন নিয়ত আমাদিগের স্তুতি ভাজন হন।

১১। পৃথিবী ও স্বর্গের বিস্তীর্ণ প্রদেশ সকলকে যিনি নিজ দীপ্তিদ্বারা পূর্ণ করিয়াছেন, সেই সরস্বতী দেবী যেন নিন্দাক হইতে আমাদিগকে রক্ষা করেন।

১২। ত্ৰিলোকব্যাপিনী, সপ্তাবয়বা, পঞ্চশ্রেণীর(৩) সমৃদ্ধিবিধায়িনী সরস্বতী দেবী যেন প্ৰতিষুদ্ধে লোকের আহ্বানযোগ্য হন।

১৩। যিনি মাহাত্ম্য ও কীৰ্ত্তিদ্বারা ইহাদিগের মধ্যে সুপ্ৰসিদ্ধ; যিনি নদীসমূহের মধ্যে সমধিক বেগবতী; যিনি শ্রেষ্ঠত হেতু নিরতিশয় গুণশালিনী হইয়াছেন, সেই সরস্বতী জ্ঞানী স্তোতার স্তুতিভাজন হয়েন।

১৪। হে সরস্বতি! তুমি আমাদিগকে প্রশস্ত ধনে লইয়া যাও। তুমি আমাদিগকে হীন করিও না। অধিক জলদ্বারা আমাদিগকে উৎপীড়িত করিও না। তুমি আমাদিগের বন্ধুত্ব ও গৃহ স্বীকার কর। আমরা যেন তোমার নিকট হইতে অপকৃষ্টস্থানে গমন না করি (৪)।

————-

(১) সায়ণ বলেন বৃসয় ত্বষ্টার একটী নাম এবং তাহার পুত্র বৃত্র, যে বৃত্রকে ইন্দ্র বধ করেন। সায়ণ আরও বলেন যে ইন্দ্র ত্বষ্টার বিশ্বরূপ নামে এক পুত্রকে হনন করিলে পরে ত্বষ্টা একটী সোম যজ্ঞ করেন। ইন্দ্র আহূত না হইলেও তথায় আসিয়া সোম পান করিয়া যান। তাহাতে ত্বষ্টা আরও ক্রুদ্ধ হইয়া “ইন্দ্র ঘাতক” এক পুত্র পাইবার জন্য যজ্ঞ করেন। উচ্চারণ দোষে “ইন্দ্র ঘাতক” শব্দ ষষ্ঠীতৎপুরুষ সমাযে গৃহীত না হইয়া বহুব্রীহি সমাসে গৃহীত হইল, সুতরাং ত্বষ্টার বৃত্র নামে যে দ্বিতীয় পুত্র হইল, ইন্দ্র তাহারও ঘাতক হইলেন।
ইন্দ্র ত্বষ্টার এক পুত্র বিশ্বরূপকে হনন করিয়াছিলেন, ঋগ্বেদে তাহা স্থানে স্থানে দেখিতে পাওয়া যায়। ২।১১।১৯ ঋক ও টীকা দেখ; কিন্তু বৃত্র যে ত্বষ্টার দ্বিতীয় সন্তান তাহার কোনও উল্লেখ আমি ঋগ্বেদে পাই নাই এবং মন্ত্রের উচ্চারণ দষে সেই বৃত্র ইন্দ্রের ঘাতক না হইয়া ইন্দ্র তাহার ঘাতক হইয়াছিলেন, এই মন্ত্রোচ্চারণ স্পর্শী পুরোহিত কল্পিত বালকোচিত উপন্যাস ঋগ্বেদের সময়ের নহে, অনেক পরে পুরোহিত প্রাধান্যের সময় সৃষ্ট হইয়াছে।
যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ পণিকর্তৃক গাভী অপহরণের কথা এবং গ্রীক ভাষায় ইলিয়দের গল্প একই মনে করেন, তাঁহারা বৃসয় ও Briseisকেও এক মনে করেন।
“In the Iliad, Briseis, the doughter of Brises, is one of the first catives taken by the advancing army of the West. In the Veda, before the bright powers reconquer the light that had been stolen by Pani, they are said to have conquered the offspring of Brisaya,”-Max Muller’s Science of Language (1882), vol. II, p. 515. ১।৬।৫ ঋকের টীকা দেখ।
(২) এখানেও সপ্ত নদীর উল্লেখ আছে।
(৩) এখানে “পঞ্চ জাতী” অর্থে সায়ণ চারি জাতি ও নিষাদ করিয়াছেন।
(৪) অর্থাৎ সরস্বতী নদীতীরবাসী আর্য্যগণ তথায়ই চিরকাল বাস করিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছেন।