১৫
ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো প্রান্তিক।
জোরে জোরে বেলের শব্দে চমকে উঠে পড়লো। বাইরে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে ভুমিশ্রী ক্লাব থেকে। সঙ্গে ঢাকের আওয়াজে ষষ্ঠীর সকালের সূচনা হচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, দশটা বেজে গেছে। ধড়ফড় করে উঠে দরজা খুললো, নিশ্চয়ই শেফালীদি বার দুয়েক ফিরে গিয়ে এখন আবার এসেছে। দরজাটা খুলতেই দেখলো, ঈশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ওকে দেখেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করলো। ফুঁপিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। ঘুমের ঘোরে ব্যাপারটা কি হচ্ছে না বুঝেই প্রান্তিক বললো, কি হয়েছে কাঁদছো কেন?
ঈশা জড়ানো গলায় বললো, তুমি কাল রাতে মেসেজের অ্যানসার দাওনি। আজ ভোরে গুড মর্নিং পাঠাওনি। আমি ফোন করে যাচ্ছি, তোমার ফোন সুইচড অফ বলছে। আমি সকাল সাতটায় এসে বার কয়েক বেল বাজিয়ে ফিরে গেছি। শেফালীদি আমায় ফোনে বললো, তুমি নাকি দরজা খোলোনি। আমি ভাবলাম হয়তো বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ। আজ ছুটি নিয়েছ জানি। কিন্তু এখন এত বেলায় যখন দরজা খুলছ না, ফোনও বন্ধ তখন আমি ভেবেছি…আমি বোধহয় তোমায় হারিয়ে ফেললাম, যেমন একদিন হারিয়ে ফেলেছিলাম আমার বেস্টফ্রেন্ড অনুভবকে ঠিক তেমনই। আমি কোনোদিন তোমার কাছে অনুভব নামটা উচ্চারণ করিনি, যদি ওই নামের প্রভাবে তোমার কোনো ক্ষতি হয়ে যায় তাই। আজ কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমার সবটা শেষ হয়ে গেল প্রান্তিক।
গতকাল রাতের হাইরাইজের ছাদ থেকে লাফ মারার পরিকল্পনাটা মনে পড়ে গেলো প্রান্তিকের। ঈশার জলে ভরা গালদুটো দেখে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।
ছি, এই মেয়েটাকে ওর মত অবিবেচককে ডিজার্ভ করে না। নিজেকেই মনে মনে ধিক্কার জানালো প্রান্তিক। নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাইল ঈশার নরম শরীরটাকে। কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, এবারের মত ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আর কখনো এমন হবে না। কোনোদিনও না।
ঈশা ঘাড় নেড়ে বললো, ঘুমিয়ে গিয়েছিলে, তো সরি বলছো কেন? ইটস ওকে। শোনো না, একটা দারুণ নিউজ আছে। দিদিভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তোমায় কোনোদিন বলতে পারিনি দিদিভাইয়ের ঘটনাটা। আসলে অনেকেই খারাপ নজরে দেখে ওদের ভালোবাসাটা। তাই আমি বা মা কাউকে কোনোদিন বলিনি। তোমাকেও না। কিন্তু ইভান, মানে সমুদ্রবাবুর ছেলে ওই সব ঠিক করে দিয়েছে। দিদিভাই হ্যাপি হলে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।
প্রান্তিক বললো, সুফল আঙ্কেলকে বলো না, যদি একই ডেটে দুই মেয়ের শুভকাজটা করে দেন তাহলে এই অর্বাচীনের প্রতি একটু দয়া দেখানো হয় আরকি। তাছাড়া, হবু শ্বশুরের খরচাও বাঁচে।
ঈশা প্রান্তিককে ঠেলে দিয়ে বললো, ভাগো। এনিওয়ে তুমি এখুনি রেডি হয়ে চলো আমাদের ফ্ল্যাটে। সমুদ্রবাবু আর ইভান আছে, তোমার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দেব।
একটা সোফায় ইভান আর সমুদ্র চৌধুরী বসে আছে। অন্য সোফায় সুফল আঙ্কেল আর শ্রেয়াআন্টি। বিদিশাদিকে এত খুশি প্রান্তিক এর আগে কখনো দেখেনি। চোখে মুখে প্রাপ্তির হাসি। ইভানের মাথায় হাত বুলিয়ে বিদিশাদি বললো, প্রান্তিক তুমি এবাড়ির জামাই হবে, তাই তোমার কাছে আমরা কিছুই লুকাতে চাই না, এই যে এ হলো ইভান। আমার সন্তান।
প্রান্তিকের ইচ্ছে করছিল উঠে গিয়ে বিদিশাদিকে একটা প্রণাম করে আসতে। এমন ভাবেও মানুষ ভালোবাসতে পারে! পরকীয়া শব্দটাতে ভালোবাসার থেকে নোংরামি মিশে আছে বেশি, তাই শব্দটা শুনলেই নাক কুঁচকে যায়। কিন্তু কিছু সম্পর্কে পরকীয়ার অবৈধতাকে ছাপিয়ে যায় শুদ্ধতার সুবাস। বিদিশা আর সমুদ্রের সম্পর্কটাও যেন এমনই পবিত্র। বড্ড কৃচ্ছসাধন করেছে মানুষদুটো, শুধু ভালোবাসার অপরাধে।
বিদিশা আবার বললো, আমার সন্তান ইভান। আমার বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে ওর সইয়ের গুরুত্ব হয়তো থাকবে না, কারণ ও মাইনর, তবুও উইটনেশ হিসাবে ওর সাইন থাকবে সবার ওপরে। কারণ শুধু ও চেয়েছে বলেই আমরা এক হতে পারছি। সমুদ্র বললো, ইভান আমাকে ভালো রাখতে চায়, তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা ও মুখে না বললেও আমি বুঝেছি।
প্রান্তিক হেসে বললো, হ্যালো ইভান। আই মিন সৌগত চৌধুরী। না না, আমি ক্লাস এইট শুনে তোমাকে একটুও ইমম্যাচিওর্ড ভাবার ভুল করছি না।
ঈশা বললো, তুমি ওকে চেনো নাকি প্রান্তিক?
ইভান হেসে বললো, সিক্রেট।
আমিও তোমাকে একেবারেই বড় ভাবার মত বড় ভুল করছি না প্রান্তিক আঙ্কেল। তুমি এখনও বড্ড ছোট।
ইভানের কথা শুনে হেসে উঠলো সকলে। বিদিশা ইভানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, আন্টি নয়, মা বলবি তো আমায়?
ইভান অস্ফুটে বললো, মা! আই লাভ ইউ। প্লিজ স্বর্গপুরীতে নয়, আমার কাছেই থেকো তুমি, সারাজীবন। বিদিশা বললো, কোথায় যাবো তোকে ছেড়ে? কোথাও না। সমুদ্র চৌধুরীর ঠোঁটের কোনে প্রশান্তির হাসিটা নজর এড়ালো না ঈশা বা প্রান্তিক কারোরই।
কমপ্লেক্সের ভিতরের পুজো মণ্ডপ থেকে গান ভেসে আসছে….
‘অবুঝ চোখের তারায়
অন্ধ কাজল হারায়
এক ফালি হাত বাড়ায়
শান্ত চরাচরে।’