৫.
নির্দিষ্ট সময়ে, রাতের অন্ধকারে নিজের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে আঙুরী। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল অন্ধকার চোখে সয়ে যাওয়ার জন্যে। হ্যাঁ, এইবার সব কিছু আবছা দেখা যাচ্ছে বটে। রাজপথে পা রাখে আঙুরী। আকাশের এক ফালি চাঁদ সামান্য আলো দিচ্ছে। রাতের কীটপতঙ্গ এক সুরে শব্দ করে চলেছে। মনের কোনায় ভয় জাগে আঙুরীর। গত কয়েক মাস ধরে রাতের পাটলিপুত্র নগর আর তার মতো রূপজীবীদের জন্যে সুরক্ষিত নেই। কোনো এক অচেনা উন্মাদ হত্যাকারী একের-পর-এক গণিকাদের হত্যা করছে। দিন পনেরো আগেই একজনকে হত্যা করেছে সেই শয়তান। এই হত্যাকারীকে নিয়ে অনেক কাহিনি রটেছে ইতিমধ্যে। আঙুরী শুনেছে যে সে নাকি আসলে মানুষ নয়। সে সাক্ষাৎ রাক্ষস! অসুর শক্তির উপাসনায় বলি দেয় পতিতাদের জরায়ু। তার নিশ্বাসের সঙ্গে নাকি আগুনের শিখা নির্গত হয়। ভাবতেই কেঁপে ওঠে আঙুরী।
দু-দিন আগেই তো দু-জন সৈনিক তাদের পল্লির প্রতিটা বাড়িতে এসে সাবধান করে দিয়ে গেছে। রাতে যেন বাড়ি ছেড়ে তারা পথে না বেরোয়। কোনো অচেনা পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে যেন তার সঙ্গে রাতে না যায়। তবু আজ তাকে বেরোতেই হবে। অর্থের লোভ, বড়ো লোভ। লোভের কাছে ভয় হার মানে বরাবরই। আঙুরী শিক্ষিত, সুন্দরী এবং নিঃসন্দেহে অতি দুঃসাহসী। সে যা করতে পারে বা করেছে, তা করার মতো সাহস সবার থাকে না। আজই তার শেষ কাজ হবে। মনে মনে ভেবেই রেখেছে আঙুরী। এইবার কাজের জন্য বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা জুটে যাবে তার। এরপর সে অন্য প্রদেশে চলে যাবে। যে স্বপ্ন সে সারাজীবন দেখে এসেছে তা পূরণ হবে। তার স্বপ্ন বড়ো কিছু নয়। অতি সাধারণ। সে চায় তার নিজের সংসার। এই অতি সাধারণ স্বপ্নও তার মতো গণিকাদের কাছে অলীক। মগধ ছেড়ে সে অন্য প্রদেশে চলে যেতে চায়। বিয়ে করে সংসার পাতবে সে ওখানে, যেখানে কেউ তাকে চিনবে না। তার অতীত ঘেঁটে কেউ তাকে ‘বেশ্যা’ বলবে না। শুধু একজন ভালোবাসার মানুষ থাকবে তার সঙ্গে। ব্যস! এইটুকুই তার স্বপ্ন। আর এই স্বপ্ন বাস্তব করতেই অর্থ উপার্জন করে চলেছে সে। যে নারীকে রোজ রাতে আলাদা আলাদা পুরুষের ভালোবাসা পেতে হয়, সে-ই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার কাঙাল। কী অদ্ভুত নিয়ম এই সংসারের।
জনমানবশূন্য রাজপথ। শুধু মাঝে মাঝে পথের ধারে জ্বলতে থাকা মশাল কিছুটা করে জায়গা আলোকিত করে রেখেছে। আঙুরীর মনে সামান্য ভয় থাকলেও একটা কথা ভেবে মনে সাহস জাগছিল তার। এখনও অবধি এই রাজপথে অন্তত কোনো হত্যা হয়নি। যা ঘটেছে তা এই রাজপথ থেকে দূরের গলিপথে। আর তা ছাড়া তাকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে তার প্রাণ সংশয় হবে না। সে শুনেছে রাতপ্রহরীদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তবে এখনও অবধি কোনো প্রহরী তার নজরে পড়েনি। ভালোই হয়েছে। তার গোপন অভিসারের পথে যত কম মানুষ তাকে দেখে ততই ভালো।
চিন্তায় ডুবে ছিল আঙুরী। হঠাৎই মনে হল যেন তার পেছনে মৃদু পদধ্বনি শুনল। চলা থামিয়ে একবার পেছন ঘুরে দেখল। কাউকে দেখতে পেল না। কুয়াশা জমেছে পথে। দৃষ্টি বেশি দূর যায় না। নাহ্, নিশ্চয়ই তার মনের ভুল। এই ভেবে সে আবার সামনের পথ ধরে। কিন্তু এইবার স্পষ্ট এবং দ্রুত পদধ্বনি শুনতে পায় আঙুরী। প্রহরী হতে পারে ভেবে চলার গতি সে বাড়িয়ে দিল আরও। সৈনিকদের মুখোমুখি না পড়লেই ভালো হয়। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে, একটা দেয়ালের ধারে আঙুরী দম নিতে খানিক দাঁড়াল। নাহ্, আর কেউ আসছে না তার পিছু পিছু। আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তখনই আচমকা অন্ধকার আর কুয়াশার চাদর ভেদ করে একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। আঙুরী সতর্ক হওয়ার আগেই, সেই ছায়ামূর্তি তার মুখ চেপে ধরে তার তলপেটে একটা ধারালো অস্ত্র বসিয়ে দিল।
৬.
চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি বসে আছেন চাণক্যর কুটিরে। দু-জনের সামনেই অনেকগুলো ভূর্জপত্র মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। গত কয়েক দিনে, তিন মৃতা রমণীর সম্বন্ধে একত্রিত করা সমস্ত তথ্য এগুলোতে আছে।
জীবসিদ্ধি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকায় উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল। বলল,
—নাহ্। কোনো যোগসূত্র নেই এই তিন জনের মধ্যে। আমি সব তথ্য আগেই দেখেছি। কিছুই পাইনি I
চাণক্য হাতে ধরা ভূর্জপত্র থেকে চোখ না তুলে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন,
—হুম।
জীবসিদ্ধি ঘরময় পায়চারি করতে শুরু করল। বলল:
—তিন জনের জন্মস্থান আলাদা। পারিবারিক বা কর্মসূত্রে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, এরা প্রত্যেকেই গণিকা। কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা গণিকাপল্লিতে তাদের বাসস্থান। তাদের প্রত্যেকেরই কোনো একজন বিশেষ পুরুষসঙ্গী আছে, এমন কোনো প্রমাণও নেই। একবাক্যে বলা চলে, তাদের মধ্যে কোনো মিলই নেই। হত্যাকারীর শিকার চয়ন সম্পূর্ণ যথেচ্ছ এবং যোগসূত্রবিহীন।
—না।
হাঁটা থামিয়ে চাণক্যর দিকে চাইল জীবসিদ্ধি। প্রশ্ন করল,
—কী বললেন, আচার্য?
হাতের পত্রটা নামিয়ে রেখে মাথা তুললেন চাণক্য। বললেন,
—মৃতা গণিকারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন হলেও তাদের মাঝে একটা মিল কিন্তু খুব স্পষ্ট। অন্তত আমি তাই অনুমান করছি।
—কী মিল? কোন যোগসূত্র?
উত্তর না দিয়ে রহস্যময় একপেশে হাসি হাসলেন চাণক্য। জীবসিদ্ধি বুঝল, গুরুদেব উত্তর দেবেন না এ প্রশ্নের।
.
—আচার্য!! আচার্য!!
কুটিরের দরজায় সুসেনের গলা শোনা গেল। গলা শুনলেই বোঝা যায় সে উত্তেজিত। জীবসিদ্ধি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই সুসেন ভেতরে ঢুকল।
—আচার্য! আবার একটা হত্যা হয়েছে!
—সেকী? এর মধ্যেই আবার?
—হ্যাঁ, আচার্য। এবং এইবার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রাজপথের ওপর। রাজমহলের কাছেই। এভাবে তো নাগরিকদের মনে আমাদের প্রতি আস্থা তলানিতে এসে ঠেকবে, আচার্য। হত্যাকারীর দুঃসাহস বেড়ে গেছে। এবারও একইভাবে হত্যা করা হয়েছে। এবারও মৃতা একজন গণিকা। সেনাপতি কিথক ঘটনাস্থলে আছেন। আমায় পাঠালেন আপনাকে খবর দিতে।
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন চাণক্য। ওঁর কপালে ভ্রূকুটি। জীবসিদ্ধি জানে এটা চিন্তার লক্ষণ। আচার্য গভীরভাবে কিছু ভাবছেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রশ্ন করলেন,
—হুমম। তুমি দেখেছ মৃতদেহ??
—আজ্ঞে হ্যাঁ, আচার্য।
—মৃতা মেয়েটার গায়ের রং তামাটে। কোঁচকানো কালো চুল। মাঝারি উচ্চতা। জীবসিদ্ধি অবাক হয়ে তার আচার্যর দিকে তাকিয়ে থাকল। হঠাৎ এই কথার মানে কী? তবে কি সত্যিই কোনো সূত্র পেয়েছেন গুরুদেব?
কিন্তু আশার আলোটা পরক্ষণেই নিভে গেল যখন সুসেন কিছুটা অপ্রতিভভাবে উত্তর দিল,
—না। মৃতা মেয়েটা লম্বা। ফর্সা। চুল কালো বটে, তবে তা সোজা। কোঁচকানো নয় মোটেই।
উত্তর শুনে চাণক্য খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে মনে হল। আশাহত ভাব ফুটে উঠল তাঁর মুখে। জীবসিদ্ধি তার গুরুর এই অবস্থা দেখে মনে মনে কিছুটা দুঃখিত এবং সেইসঙ্গে কিছুটা কৌতুক বোধ না করে পারল না। সে তার গুরুকে খুব ভালো চেনে। আচার্য মুখে যতই বলুন, যে, তিনি সাধারণ ব্রাহ্মণ মাত্র, সেটা শুধুমাত্র ওঁর বিনয়ের বাক্য। আচার্যর নিজের মনে ওঁর নিজের বুদ্ধির প্রতি একটা সুপ্ত গর্ববোধ আছে। আচার্য চাণক্য নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম বিদ্বান এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি। কিন্তু ঠিক আর পাঁচজন অতি বুদ্ধিমান ব্যক্তির মতোই তিনিও নিজের সামনের ব্যক্তিকে মাঝে মাঝে চমক দিতে ভালোবাসেন। এই যেমন এখন তিনি সেই চেষ্টাটাই করলেন এবং বিফল হলেন। যদি ওঁর এই অদ্ভুত অনুমান মিলে যেত, তবে এই মুহূর্তে আচার্য তার দিকে চেয়ে, মিটিমিটি রহস্যময় হাসি হাসতেন। তাঁর অনুমান না মেলায় সেই সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন। তাই আচার্য এখন একটু দুঃখিত হয়েছেন।
সুসেন বলল :
—আচার্য, জীবসিদ্ধি মহাশয়? আপনারা কি আমার সঙ্গে আসবেন?
—অবশ্যই। আচার্য?
জীবসিদ্ধি কথাটা বলে চাণক্যর দিকে চাইল। কিন্তু চাণক্য কথা শুনেছেন বলে মনে হল না। তিনি অন্যমনস্কভাবে মেঝের দিকে চেয়ে আছেন। কপালে গভীর ভ্রূকুটি। জীবসিদ্ধি আরও একবার একটু জোরে বলল,
—আচার্য?? ঘটনাস্থলে আসছেন তো?
চিন্তার জাল ভেঙে বেরিয়ে এলেন চাণক্য।
—হুমম? হ্যাঁ। যাব তো বটেই। চলো। আমার ঝোলাটা দেখো তো। কোথায় রেখেছি…।
৭.
ঘটনাস্থলে নতুন করে দেখার মতো কিছু নেই। ঠিক যেন আগের তিনটে ঘটনার পুনরাবৃত্তি। চাণক্য খুব বেশি পরীক্ষা করলেন না মৃতদেহ। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে শুধু একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন মৃতদেহর দিকে। তাঁকে দেখে মনে হল না যে তিনি আদৌ কিছু দেখছেন। সম্ভবত অন্য কিছু নিয়ে ভাবছেন। কুটিরে ফেরার পথেও বেশি কথা বললেন না। শুধু জীবসিদ্ধিকে বললেন,
—ওহে জীবসিদ্ধি। আজ দিনের শেষে একবার এসো। আমি ততক্ষণ একটু ভাবি আজকের দিনটা।
.
সন্ধ্যার দিকে জীবসিদ্ধি চাণক্যর কুটিরে এসে হাজির হল। চাণক্য প্ৰদীপ জ্বেলে লেখালেখি করছিলেন। ঘরে ধুনি আর কপূরের সুবাস। তাকে আসন গ্রহণ করতে বললেন চাণক্য। নিজের জায়গায় বসে প্রশ্ন করল জীবসিদ্ধি,
—আচার্য, আজ আপনাকে বড্ড অন্যমনস্ক লাগল। কী হয়েছে?
খানিক হতাশার সুরে চাণক্য বললেন,
—আমি কয়েকটা সূত্র ধরে এগিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম কয়েক দিনের মধ্যেই অপরাধের কিনারা হবে। তা ছাড়া, তৃতীয় হত্যাকাণ্ডর পর সেনাপতি কিথক নিজে যেভাবে পাহারা সাজিয়েছেন, তাতে আমি ধারণা করেছিলাম হত্যাকারী এত সহজে আর হত্যা করতে পারবে না। বা, করতে গেলে নিঃসন্দেহে ধরা পড়বে। কিন্তু আজকের হত্যাটা আমায় নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
জীবসিদ্ধি কোনো কথা বলল না। খানিকক্ষণ দু-জনেই নিশ্চুপ থাকলেন। তারপর চাণক্য নিজেই আবার বললেন,
—এই ধারাবাহিক হত্যাকারীর সম্বন্ধে আমি নিজের মনে একটা ধারণা তৈরি করতে পেরেছি বলেই আমার বিশ্বাস। এই ধরনের অপরাধীকে ধরতে গেলে তার চিন্তাধারাটা বোঝার প্রয়োজন। নিজেকে তার জায়গায় রেখে বিচার করতে হবে। তবেই তার পরবর্তী পদক্ষেপ অনুমান করা সম্ভব হয়।
—আপনি তা করতে পেরেছেন?
—হুমম। কালকে তোমার দুটো কাজ। প্রথমত সুসেনকে সকালে আমার কুটিরে আসতে বলবে। আশা করি সে আজকের মৃতা মেয়েটার পরিচয় ইতিমধ্যে পেয়েছে।
—বেশ। আমি তবে কাল সকালে, সুসেনকে সঙ্গে নিয়েই আপনার এখানে আসব। আর দ্বিতীয় কাজ?
—না। তুমি তাকে নিয়ে আসবে না। তুমি কাল সকালে অন্য একটা জরুরি কাজ করবে। কাল তুমি রাজভবন যাবে। সেখান থেকে পাটলিপুত্র নগরীর সম্পূর্ণ নকশা আমার জন্যে নিয়ে আসবে। ওটা বিশেষ প্রয়োজন।
—বেশ।
* * *
পরের দিন সকাল। চাণক্যের সঙ্গে সুসেন পথ চলেছে। সুসেন বলে উঠল,
—আচার্য, বলছিলাম কী, আর একবার বিবেচনা করে দেখুন। ওইখানে আপনার যাওয়াটা কি একান্তই জরুরি??
—হ্যাঁ, সুসেন। আমার মন বলছে, জরুরি।
—কিন্তু, কী খুঁজে পাওয়ার আশায় মৃতা গণিকার বাড়িতে যাচ্ছেন; আচার্য?? আমি বলতে চাইছি, আপনার মতো এক ব্রাহ্মণের কি ওই জায়গায় পা দেয়া উচিত?? হাজার হোক, সেটা পতিতাপল্লি।
কথাটা শুনে মাঝপথে চাণক্য হাঁটা থামালেন। পেছন ঘুরে সুসেনের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। বললেন,
—কেন?? পতিতালয়ে পা দিলে আমি ধর্মভ্রষ্ট হব?
—না। মানে…
—ধর্ম কি এতটাই ঠুনকো? মানুষের ধর্ম তার কাজ দিয়ে নির্ধারিত হয়।
একজন ব্রাহ্মণ, ধর্মভ্রষ্ট তখনই হয় যখন সে সজ্ঞানে উচিত কাজ করা থেকে বিরত থাকে। মন্দিরে পুজো করলে সে পূজারি হয়, ব্রাহ্মণ নয়। যে গোটা মানুস জাতিকে ঠিক পথে চালনা করে, সে-ই প্রকৃত ব্রাহ্মণ। মনের এই সংকীর্ণতা দূর করো, সুসেন। না হলে এই সংকীর্ণতাই ভবিষ্যতে এই দেশের ধ্বংস ডেকে আনবে।
লজ্জিত ভঙ্গিতে সুসেন বলল:
—ক্ষমা করবেন, গুরুদেব। আমি সেরকম বলতে চাইনি। বেশ। আমার মনের ভুল দূর হল। কিন্তু একটা কথা বলুন, আপনি ওই আঙুরী নামে রূপজীবী মেয়েটার কুটিরে কী খুঁজতে যাচ্ছেন??
—এইটা একটা যথার্থ প্রশ্ন করেছ। কিন্তু উত্তরটা এই মুহূর্তে আমার নিজেরও জানা নেই। কিন্তু আমার স্বজ্ঞা আমায় ওখানে যেতে বলছে। এটা আমার একটা অনুভূতিমাত্র।
—বুঝলাম না।
—আমিও বুঝিনি। সেখানে পৌঁছে বুঝব আশা করি।
কথা বলতে বলতে তারা পতিতাপল্লিতে ঢুকে পড়ল। সুসেনের কিছুটা অস্বস্তিকর লাগছিল। যদিও তার সামনে আচার্য চাণক্য বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে এগিয়ে চলছিলেন। গতকালই সুসেন কুটিরের ঠিকানা জেনেছে। কালকে ন্যায়রক্ষী বাহিনীরা কুটির তালা দিয়ে আটকে দিয়ে গিয়েছিল। চাবি বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক হিসেবে সুসেনের কাছেই আছে। সেই অনুমান করেই চাণক্য তাকে নিজের উদ্দেশ্য জানিয়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে আসতে বলেন। বাড়ি খুঁজে পেয়ে চাণক্য সুসেনকে দরজাটা খুলতে ইশারা করলেন। ভেতরে ঢুকে চাণক্য প্রথমেই চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন ভেতরে। এক এক করে এক একটা আসবাবপত্রর কাছে গিয়ে প্রতিটা খুলে পরীক্ষা করতে লাগলেন। ওঁর প্রতিটা পদক্ষেপ ধীর অথচ দৃঢ়। প্রতিটা সামান্য জিনিসও একবার অন্তত দেখলেন তিনি। কাগজপত্র, দোয়াত কলম, পোশাক-আশাক ইত্যাদি সমস্ত কিছু। গুছিয়ে রাখা পোশাক কয়েকটা বের করে এনে তিনি সুসেনের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন,
—ওহে সুসেন, মেয়েটার পোশাকগুলো এবং গয়না দেখো। কিছু অনুমান করতে পারছ? নারীদের কাপড় ও গয়নার দাম সম্বন্ধে আন্দাজ আছে?
—যা মনে হচ্ছে, সবই কমদামি। শুধু দু-তিনটে ছাড়া।
—হুম। এবং মূল্যবান যে ক-টা কাপড় ও গয়না দেখা যাচ্ছে, সেগুলো বেশ নতুন। এর থেকে কী অনুধাবন করা যায়??
—কী??
—বুদ্ধি ব্যবহার করো হে, সুসেন। সহজেই অনুমেয় যে মেয়েটা হঠাৎ কয়েক মাস ধরে অর্থ হাতে পেয়েছিল। সম্ভবত কোনো নতুন পুরুষসঙ্গীর দেয়া উপহার এগুলো। অথবা হঠাৎ বেশি রোজগারের অর্থে এগুলো সে কিনেছে।
—কোনো বড়োলোক খদ্দের?
—হুমম।
দেরাজ খুলে তার ভেতর থেকে এক থলি রুপোর মুদ্রা বেরোল।
—এই দেখো। এই হল আমার অনুমানের সত্যতার প্রমাণ।
—সে বুঝলাম, আচার্য। কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের হত্যাকাণ্ডের কী সম্পর্ক? তার এই নতুন পৃষ্ঠপোষকই যে হত্যাকারী এরকম আপনার কেন মনে হল? আর তা ছাড়া অন্যান্য গণিকাদের বাড়িতে কিন্তু এরকম কিছুই আমরা খুঁজে পাইনি। তাদের বাড়িতেও আমি নিজে উপস্থিত থেকে তল্লাশি চালিয়েছি।
—একথা আমি কখন বললাম যে এই পুরুষটিই হত্যাকারী?
—তবে?
উত্তর না দিয়ে আচার্য আবার আশেপাশে খুঁজতে শুরু করলেন। চারপায়ার ওপর রাখা একটা ছোটো বাক্সর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সেটার দিকে। সুসেন এগিয়ে গিয়ে দেখল তাতে অনেকগুলো মাদুলি রাখা। তবে সেগুলোর ভেতর ফাঁপা। অর্থাৎ তাতে আশীর্বাদি ফুল ভরে, মোম দিয়ে একদিকের মুখ আটকে, সেগুলো তাবিজ বানানো হয়নি এখনও। সবকটা ফাঁপা মাদুলির সঙ্গে ছোটো ছোটো সুতলি বাঁধা 1
সুসেন লক্ষ করল আচার্যর ভুরু কুঁচকে আছে। তিনি কিছু একটা ভাবছেন। ওঁর চিন্তার সাহায্যে এগিয়ে এসে সুসেন বলল:
—এগুলো তো হাতে পরার মাদুলি মনে হয়। সঙ্গে বাঁধার সুতো কিন্তু ছোটো। গলায় পরার জন্য এগুলো নয়। বোধ হয় নিয়মিত পরিবর্তন করতে হয় এরকম কোনো তাবিজ পরত এই মেয়েটা। মাস গেলে বদলাতে হয়। তাই একসঙ্গে অনেকগুলো কিনে রাখা।
—হুমম। অথচ মৃতদেহতে কিন্তু সেরকম কোনো তাবিজ চোখে পড়েনি আমার।
অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চাণক্য জানলার কাছে গেলেন। উদাসভাবে আকাশের দিকে চেয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন। কিছু একটা বিষয় নিয়ে গম্ভীর চিন্তায় মগ্ন তিনি।
৮.
রাতের প্রথম প্রহর। সন্ধ্যার সময়। জীবসিদ্ধি এবং সুসেন বসে আছে আচার্য চাণক্যর কুটিরে। চাণক্য সন্ধ্যা আহ্নিক সারছেন। পুজো শেষ করে, ধুপ-ধুনো জ্বালিয়ে, আচার্য এক বাটি ফল নিয়ে এসে বসলেন তাদের সামনে।
—খাও, খাও।
—আপনিও নিন, আচার্য।
—হুমম। ওই সেনাপতি এলেন বোধ হয়।
বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ কুটিরের সামনে এসে থামল। কয়েক মুহূর্ত বাদেই দরজা খুলে সেনাপতি কিথক ঢুকলেন। চাণক্য আজ সন্ধ্যায় তাঁদের প্রত্যেককে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ করেছেন।
চাণক্য কিথককে প্রশ্ন করলেন,
—কোনো নতুন খবর আছে, আর্য?
সেনাপতি হতাশা সূচক মাথা নেড়ে বললেন,
—না, আচার্য। রাতের পাহারারত সৈনিকরা কয়েকজন সন্দেহজনক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করলেও, তাদের মধ্যে কেউই প্রকৃত হত্যাকারী বলে মনে হয় না। বেশিরভাগই মদ্যপ বা ছোটো অপরাধী।
সুসেন বলে উঠল,
—তবে আচার্য, সবচেয়ে শেষে যে গণিকার হত্যা হয়েছে তার জরায়ুর সন্ধান পাওয়া গেছে।
—সে কী? কোথায়?
—শরীর থেকে জরায়ু কেটে, হত্যার জায়গা থেকে একটু দূরেই একটা পুরোনো জলাশয়ে ফেলে দিয়েছিল হত্যাকারী। একটা পুঁটুলিতে ভরে। জল কম থাকায় সেটা ভেসে কিনারে আসে। একটা শেয়াল সেটা মুখে করে টেনে আনে। জায়গাটাতে পাহারারত সৈনিকরা সেই শেয়ালটাকে একটা রক্তমাখা কাপড়ের পুঁটুলি মুখে নিয়ে টানাটানি করতে দেখে সন্দেহ করে। তার থেকেই এক মানবীর জরায়ু খুঁজে পাওয়া যায়।
—হুমম। তা সুসেন, ওই জলাশয়ে জাল ফেলে দেখো। বাকি মৃতদেহ থেকে চুরি যাওয়া জরায়ু পাওয়া যায় কি না।
সেনাপতি কিথক ততক্ষণে আসন গ্রহণ করেছেন জীবসিদ্ধির পাশে। উত্তরটা তিনিই দিলেন,
—সেটা ইতিমধ্যে করা হয়েছে, আচার্য। সুসেন আমায় এই জরায়ু খুঁজে পাওয়ার খবর দিতেই আমি তাকে জলাশয়ে জাল ফেলতে বলি। তবে কিছুই পাওয়া যায়নি।
সুসেন সেনাপতির সমর্থনে মাথা নাড়ে।
—হুমম। আপনি সত্যিই এক সুদক্ষ সেনাপতি, আর্য।
—ধন্যবাদ, আচার্য। আপনি আজ আমাদের সকলকে যখন একত্রিত করেছেন, তখন আমার ধারণা আপনি কোনো সূত্র পেয়েছেন। আমি কি ভুল অনুমান করলাম, আচার্য?
মৃদু হেসে চাণক্য বললেন,
—হুমম। গভীর রহস্যর অন্ধকারে আমি কিছুটা আলো দেখতে পেয়েছি। পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে আজ আমি আপনাদের ডেকেছি।
এক পাত্র মধু ঢেলে তিনি বসলেন। অন্য অতিথিদের মধু বাড়িয়ে দিতে তাঁরা প্রত্যাখ্যান করলেন। এই প্রচণ্ড মিষ্টত্ব সম্ভবত চাণক্য ছাড়া কেউই জিভে ঠেকাতে পারে না। অথচ চাণক্যর এটা প্রায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। বাকি দু-জন চাণক্যর এই মিষ্টত্ব প্রীতির সঙ্গে পরিচিত হলেও, সুসেন অবাক হয়ে দেখছিল তাঁকে। এক চুমুক মধু পান করে চাণক্য বললেন,
—প্রথম থেকে শুরু করা যাক। এই সবকটা হত্যাকাণ্ডর সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়টা হল যে হত্যাকারী এতগুলো হত্যার পরেও কারুর নজরে পড়েনি। হত্যাগুলো অন্ধকার, জনমানবশূন্য জায়গায় হয়েছে। ঠিক কথা। কিন্তু হত্যার পদ্ধতি আর নৃশংসতা দেখেই বোঝা যায় যে হত্যাকারীর শরীরে ও পরনের জামাকাপড়ে নিঃসন্দেহে রক্তের দাগ লেগেছে। রক্তাক্ত বস্ত্রে, ঘোড়ায় চড়ে, সে নগরীর পথ ধরে পালাচ্ছে। অথচ সে রক্তস্নাত অবস্থায় কোনো প্রহরী বা সাধারণ নাগরিকের চোখে পড়েনি। এটা অবিশ্বাস্য। গভীর রাতে পথে-ঘাটে বেশি লোক না থাকলেও, প্রহরী বা কিছু মানুষ থাকেই। পাটলিপুত্র এক ব্যস্ত নগর। প্রথমবার বা দ্বিতীয়বার যদি-বা দৈবাৎ সে সকলের নজর এড়িয়ে যেতে সক্ষমও হয়, তবুও সেই কাজ চার বার করতে পারাটা অসম্ভব।
খানিক বিরতি নিয়ে চাণক্য আবার বলা শুরু করলেন,
—যুক্তিনির্ভর চিন্তা করলে এর একটাই উত্তর পাওয়া যায়। যুক্তি বলে, নিঃসন্দেহে তাকে এক বা একাধিক লোক দেখেছে। একটা রক্তাক্ত মানুষকে রাতে রাস্তায় দেখেও প্রহরী বা অন্যান্য ব্যক্তি কোনো এক বিশেষ কারণে সন্দেহ করেনি। অর্থাৎ হত্যাকারী এমন একজন ব্যক্তি, যাকে মাঝে মাঝেই রক্তাক্ত পোশাকে দেখা যায়। সঙ্গে একটা রক্তাক্ত বড়ো, ধারালো অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও কারুর মনে তা সন্দেহর উদ্রেক করেনি। সম্ভবত পেশাগত কারণে তাকে সেই রূপে দেখতে পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বলতে পারো কী সেই ব্যক্তির পেশা?
জীবসিদ্ধি উত্তর দিল,
—সৈনিক!
—অসম্ভব।
সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেন সেনাপতি। বললেন,
—কোনো সৈনিক রাতের রাস্তায় অকারণ রক্তাক্ত অবস্থায় টহল দিয়ে বেড়ালেও সেই দৃশ্য বড়োই অসম্ভব। যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া কোনো সৈনিক অকারণ রক্তাক্ত তলোয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না।
সেনাপতির কথার সমর্থনে চাণক্য বললেন,
—হুমম। একদম যথাযথ যুক্তি, সেনাপতি। না। হত্যাকারী কোনো সৈনিক নয়। সে এমন একটা পেশার সঙ্গে যুক্ত, যেখানে তাকে নিত্যদিনই রক্তের দাগ লাগা পোশাকে মানুষ দেখে অভ্যস্ত। তাই আলাদা করে চোখে পড়ে না।
আচার্যর সামনে বসা তিন জনেই, উত্তেজিত ভঙ্গিতে সমস্বরে উত্তর দিল,
—সৌনিক *!
—ঠিক! যথার্থ আন্দাজ করেছ। আমি নিশ্চিত যে আমাদের এই হত্যাকারী পেশায় একজন মাংস বিক্রেতা!! আমাদের রাজধানীতে মাংস বিক্রেতারা, সময় বাঁচাতে, পশু জবাই করে রাতেই তৈরি রাখে যাতে পরদিন সকালে তা বিক্রি করে দেয়া যায়। তাই রাতে কোনো সৌনিককে রক্ত মাখা ছুরি আর পোশাকে দেখলেও, ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হবে। আমার ধারণা সৈনিকরা এই ব্যক্তিকে তার জীবিকার প্রমাণ পেয়ে রাতে ধরেও ছেড়ে দিয়েছে। অনেক কাটা মাংসর মাঝে এক মানবীর জরায়ু লুকিয়ে সহজেই সে চলাচল করে ঘোড়া চালিয়ে। প্রহরীরা আটকালে সে তার পরিচয়পত্র দেখায় আর নিজের সঙ্গে থাকা মাংসর ঝুলি দেখিয়ে প্রমাণ দেয় যে এগুলো সবই পশুর মাংস। অতএব, তার শরীরে লেগে থাকা রক্তও পশুর রক্ত। আমার আন্দাজ কি আপনাদের কাছে যুক্তিসংগত ও গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?
তিন জনই সম্মতিতে মাথা নাড়ে। চাণক্য আরও এক চুমুক মধু গলাধঃকরণ করলেন। তারপর বললেন,
—হুমম। এই যুক্তিনির্ভর আন্দাজ ব্যাপারটা ভারি চমৎকার। এর সাহায্যে, বহু ক্ষেত্রেই বাস্তব ঘটনাস্থলে না গিয়েও, শুধু যুক্তির ওপর যুক্তি সাজিয়ে, নিজের জায়গায় বসেই রহস্যর সমাধান করা যায়। এইক্ষেত্রেও আমি তাই করেছি। আমি শুধু নিজেকে এই হত্যাকারীর জায়গায় রেখে তার মনস্তত্ত্বর গভীরে ঢোকার চেষ্টা করেছি। পরবর্তী বিশ্লেষণ পুরোটাই অপরাধীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে। প্রথমেই আসা যাক কয়েকটা প্রশ্নে। প্রথমত, হত্যাকারী শুধুমাত্র গণিকাদেরই নিজের শিকার বানাচ্ছে কেন? তার কি কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ আছে তাদের ওপর! আমার ধারণা, নিশ্চয়ই তাই। এই হিংস্রতা এবং নৃশংসতা, কোনো সাধারণ সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে করা প্রায় অসম্ভব। এটা কোনো এক উন্মাদ ব্যক্তির কাজ এবং পতিতাদের সে অতিমাত্রায় ঘৃণা করে। তার অতীতে, এমন কিছু ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে যা তার মনে এই বিকার সৃষ্টি করেছে। হঠাৎ ঘটা কোনো ঘটনায় কিন্তু এতটা প্রভাব ফেলা সম্ভব নয়। সম্ভবত এই ঘৃণার সূত্রপাত অনেক আগে। বাল্যকালে প্রাপ্ত মানসিক আঘাতে শিশুমনে গভীর রেখাপাত করে থাকে। তার থেকে এই গভীর ঘৃণা আর আক্রোশের জন্ম হওয়া সম্ভব।
একটু বিরতি নিয়ে পুনরায় নিজের বিশ্লেষণ শুরু করলেন চাণক্য,
—এইবার আসি আমার দ্বিতীয় প্রশ্নে। হত্যার পর কোন আক্রোশে হত্যাকারী মৃতার
শরীর থেকে জরায়ু ছিন্ন করে সঙ্গে নিয়ে যায়? শুধুমাত্র জরায়ুই কেন? মানব শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ নয় কেন? এর উত্তরও একটু যুক্তি দিয়ে ভাবলে অনুমান করা সম্ভব। মানুষের চোখের সঙ্গে সৌন্দর্যর সম্পর্ক করি আমরা। উদাহরণ হিসেবে মনে করে দেখুন, কয়েক বছর আগে পাটলিপুত্রে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। পরস্ত্রীর দিকে তাকানোর অপরাধে সেই রমণীর স্বামী এক ব্যক্তির চোখ উপড়ে নিয়েছিল। ঘটনাটা নিশ্চয়ই মনে আছে আশা করি?
ঘটনাটা কয়েক বছর আগেই নগরে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাই সকলেরই মনে আছে। আচার্য বললেন,
—হুমম। ঠিক সেইরকমভাবেই, হৃদয়কে আমরা প্রেম বা ভালোবাসার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে থাকি। যোনিদেশ হল যৌনতার প্রতীক এবং জরায়ু হল জন্ম বা মাতৃত্বর প্রতীক। অর্থাৎ, হত্যাকারীর সমস্ত আক্রোশের উৎস তার বা অন্য কারুর জন্ম অথবা মাতৃত্ব সম্পর্কিত কোনো ঘটনা থেকে হয়েছে। আরও একটা আশ্চর্য বিষয় ভাবো। হত্যাকারী যে ক-জন নারীকে হত্যা করেছে, তাদের কারুর সঙ্গে হত্যার আগে শারীরিকভাবে লিপ্ত হয়নি। কারণ আততায়ীর মনে প্রচণ্ড ঘৃণা আছে পতিতাদের প্রতি। সে তাদের সঙ্গে সেই কারণে শারীরিকভাবে মিলিত হতেও চরম বিতৃষ্ণা বোধ করে। অথবা আরও একটা সম্ভাবনা। সে গণিকাদের মধ্যে তার মায়ের ছায়া দেখে। তাই তাকে ধর্ষণ করা থেকে বিরত থাকে বরাবরই।
অতএব, সব তথ্য ও বিশ্লেষণ মিলিয়ে আমরা কী কী আন্দাজ করতে পারি? আমাদের উন্মাদ হত্যাকারী এই নগরীর একজন মাংস বিক্রেতা, যার নিজের মা সম্ভবত রূপজীবী ছিল। অতীতের কোনো ঘটনায় তার মনে পতিতাদের প্রতি চরম ঘৃণা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক মাস আগে থেকেই। অর্থাৎ সেই সময়ের আশেপাশে এমন কিছু হত্যাকারীর জীবনে আবার ঘটেছে যার ফলে তার অতীতের আক্রোশ বর্তমানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাকে কোনো এক বা একাধিক নারী চরম আঘাত করেছে এবং সেই প্রতিহিংসা সে অন্য নারীদের ওপর নিচ্ছে।
সেনাপতি কিথক মনোযোগ দিয়ে চাণক্যর বিশ্লেষণ শুনছিলেন। এইবার আর উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলেন,
—সাধু! সাধু! অসাধারণ আপনার অনুধাবন ক্ষমতা, আচার্য। আমি স্তম্ভিত!
চাণক্য কিছুক্ষণ তাঁর দিকে চেয়ে থাকলেন। মনে হল তিনি সেনাপতির এই আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখে বেশ কৌতুক বোধ করছেন। চাণক্যর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে গেল। তাঁর চোখে চোখ পড়তে সেনাপতি কিছুটা লজ্জিত হলেন। বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন,
—ক্ষমা করবেন, আচার্য। আমি বোধ হয় একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। কিন্তু আপনার অনুধাবন ক্ষমতা দেখে আমি বিস্মিত। আমি জানতাম যে আপনিই পারবেন। আমি সুসেনকে বলেছিলাম যে এই সমস্যার সমাধান একমাত্র মহামতি বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যই করতে পারেন।
—ওহে, সেনাপতি। উত্তেজনা প্রশমিত করুন। অতি উত্তেজনা স্বাস্থ্য ও বিচারশক্তি, দুটোর ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর। এইবার তবে আপনাকে আমি বলি যে আপনার পরবর্তী কর্তব্য কী।
—হ্যাঁ। অবশ্যই। বলুন, আচার্য।
—হুমম। সেনাপতি এবং সুসেন, আপনাদের পরবর্তী কাজে সাহায্য করবে স্বয়ং জীবসিদ্ধি। জীবসিদ্ধি, নগরে তোমার পুরোনো গুপ্তচর চক্রর গূঢ় পুরুষরা কি এখনও আছে? প্রয়োজনে কি তাদের আবার কাজে লাগানো যেতে পারে?
মৃদু হেসে জীবসিদ্ধি উত্তর দিল,
—কয়েকজন তো আছেই। আপনি বললেই আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।
—অতি উত্তম। তাই করো। তারা চেষ্টা করলে এবং সঙ্গে সৈনিকরা সাহায্য করলে আমার ধারণা এই নগরের বুকে এরকম একজন মাংস বিক্রেতাকে খুব সহজেই খুঁজে পাবে। তার সঙ্গে বা পারিবারিক সূত্রে পতিতাদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, গূঢ় পুরুষরা সেই খোঁজ নিক। হাট-বাজারের উড়তে থাকা জনশ্রুতিতে তারা কান পাতুক। কয়েক মাস আগে কোনো এক নারী এই ব্যক্তিকে আঘাত দিয়েছে। সম্ভবত প্রেমে আঘাত এবং এই সৌনিক ব্যক্তির অবশ্যই একটা কালো ঘোড়া আছে। আসুন, আপনাদের জন্যে বিষয়টা আরও একটু সহজ করে দিই। জীবসিদ্ধি, তুমি কি একটু কষ্ট করে আমায় নকশাটা এনে দেবে? ওই যে, ওখানে রাখা।
উঠে গিয়ে জীবসিদ্ধি পাশের চারপায়ার ওপর রাখা একটা বড়ো আকারের ভূর্জপত্র নিয়ে এল। সেটার ভাঁজ খুলে সকলের সামনে মেঝেতে মেলে ধরলেন চাণক্য। এটা পাটলিপুত্র নগরের একটা অংশের হাতে আঁকা নকশা। এতে প্রতিটা পথ-ঘাট, দফতর ইত্যাদি চিহ্নিত করা আছে। চাণক্য বললেন,
—আমি জীবসিদ্ধিকে রাজপ্রসাদ থেকে দিয়ে নগরের একটা বিশেষ অংশর এই নকশাটা আনিয়েছি। জীবসিদ্ধির সাহায্যে এতে আমি প্রতিটা হত্যার জায়গা কালি দিয়ে আগেই চিহ্নিত করে রেখেছি। প্রতিটা হত্যাই নগরের এই অংশে হয়েছে। এইবার একটা ঘোড়ার গতি হিসেব করে অনুমান করা যায় যে এক প্রহরে কতটা পথ অতিক্রম করা সম্ভব। সেই অনুযায়ী আপনারা নগরীর কয়েক যোজন জায়গা সহজেই চিহ্নিত করতে পারবেন। পরবর্তী পদক্ষেপ হল, নগরের এই অংশে ব্যাবসা চালায় এরকম প্রতিটা মাংস বিক্রেতার ওপর নজরদারি চালানো। তাদের অতীত সম্বন্ধে তথ্য একত্রিত করুন। জানতে হবে এদের মধ্যে কারুর আগে, অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কি না। কারণ আমরা যাকে খুঁজছি, আমি নিশ্চিত সে এদের মধ্যেই একজন। আমার বিশ্বাস এই উপায়ে আমরা, সেই উন্মাদ হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে পারব। আর তার পর আমরা ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করব।
—ফাঁদ? কীরকম ফাঁদ, আচার্য?
জীবসিদ্ধির এই প্রশ্নে রহস্যময় হাসি হাসলেন চাণক্য। মধুর পাত্রে একটা চুমুক দিয়ে উত্তর দিলেন,
—বিষকন্যা!
—
* সৌনিক- মাংস বিক্রেতা / কসাই।
৯.
মৌর্য সাম্রাজ্যর নিজস্ব বহু আততায়ী দল আছে, যারা রাজনির্দেশে গুপ্তহত্যা করে থাকে। তাদের মধ্যে ভয়ংকরতম গুপ্ত-আততায়ী হল ‘বিষকন্যা’রা। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে যেসব মেয়েদের জন্ম শুক্লপক্ষর দ্বিতীয়া তিথিতে হয় এবং যদি চন্দ্র অশ্লেষ, শতভিষা অথবা কৃতিকা নক্ষত্রে অবস্থান করে, তবে সেই মেয়ের গ্রহদোষ দেখা দেয়। এর সঙ্গে যদি তার জন্মমুহূর্তে সূর্য পঞ্চমভাবে এবং মঙ্গল নবমভাবে অবস্থান করে থাকে, তবে তাদের বিষকন্যা আখ্যা দেয়া হয়। বলা হয়, এরকম দোষযুক্ত কোনো নারীর সঙ্গে যে পুরুষের বিয়ে হবে, তার মৃত্যু নিশ্চিত। অতএব বলা বাহুল্য যে এই মেয়েদের বিয়ে দেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ এদের সম্পূর্ণ ত্যাগ করে, তাদের মা-বাবা স্বয়ং তাদের অভিশাপ বলেই গণ্য করে।
আচার্য চাণক্য বহু বছর আগেই এইরকম বহু মেয়েকে সারা দেশ থেকে খুঁজে খুঁজে একত্র করেছিলেন। একটা গোপন জায়গায় তাদের রাখা হয় এবং প্রশিক্ষিত করা হয়। বালিকা বয়স থেকেই, নিয়মিত তাদের খাবারের সঙ্গে সীমিত পরিমাণ বিষ মিশিয়ে দেয়া হয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে, খাবারে সেই বিষের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এর ফলে এই মেয়েরা যুবতী হয়ে ওঠার আগেই তাদের শরীরে বিষের মাত্রা এতটাই হয়ে যায় যে তাদের একটা সামান্য চুম্বন বা কামড়ে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের তক্ষুনি মৃত্যু পর্যন্ত হওয়া সম্ভব। এই বিষকন্যাদের দলটা চাণক্য গোপনে নিজের তত্ত্বাবধানে তৈরি করেন। এরা সম্ভবত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গুপ্ত হত্যাকারীদের দল। চাণক্য যে সময় চন্দ্রগুপ্তকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন ভবিষ্যৎ সম্রাট হওয়ার, একই সময়ে, একটা গুপ্ত আশ্রমে সমাজের থেকে বহিষ্কৃত, অনাথ, দুস্থ, অথবা বহু ক্ষেত্রে ক্রীতদাসী হিসেবে অত্যাচারিত মেয়েদের উদ্ধার করে নিয়ে আসতেন। শুধুই যে নিয়মিত তাদের খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেয়া হত তা নয়। সঙ্গে এই মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধকৌশলের ও অস্ত্র চালানোরও প্রশিক্ষণ দেয়া হত। অখণ্ড আর্যাবর্ত গড়ে তোলা ছাড়া, আচার্য এই বিষকন্যাদের সাহায্যে বহু গুপ্তহত্যা করিয়েছেন। চাণক্যর নির্দেশে এই যুবতীরা বহু রাজপুরুষ ও সামরিক উচ্চপদাধিকারিকে নিজেদের রূপে মোহিত করেছে। তাদের জালে শত্রুরা সহজেই ধরা দিয়েছে। চুম্বন বা সংগমের ফলে সেই শিকারদের অনিবার্য মৃত্যু হয়েছে।
এইরকমই এক বিষকন্যা, উল্লুপি, এখন আচার্য চাণক্যর দরজায় অপেক্ষারত। গায়ের রং তামাটে, কোঁচকানো এলো চুল, গায়ে সোনার গয়না। কাজল টানা চোখে মায়াবী মোহময়ী দৃষ্টি। এই যুবতীকে দেখে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না তার আসল পরিচয়। সে একজন প্রশিক্ষিত গুপ্ত আততায়ী। তার এক কামড়ে আছে নিশ্চিত মৃত্যু।
.
—গুরুদেব!
কুটিরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন চাণক্য। বাইরে অপেক্ষারত যুবতীকে দেখে হাসি খেলে গেল ওঁর মুখে। বললেন,
—উল্লুপি! এসো মা, এসো।
উল্লুপি মাটিতে বসে চাণক্যর পায়ে মাথা ঠেকাল। তাকে আশীর্বাদ করে চাণক্য বললেন,
—আয়ুষ্মান ভবঃ। উৎকৃষ্ট বীরাঙ্গনা।
কুটিরে ঢুকল যুবতী। তাকে আসন গ্রহণ করতে বলে নিজেও মুখোমুখি বসলেন চাণক্য। উল্লপি প্রশ্ন করল,
—জীবসিদ্ধি ভাই বলল আপনি আমায় স্মরণ করেছেন।
—হ্যাঁ, মা। মগধের তোমায় আবার প্রয়োজন। আমার একটা বিশেষ কাজ তোমায় করতে হবে। আর এই কাজ একমাত্র তুমিই পারবে।
—আদেশ করুন, আচার্য। দেশের কোন সেবা আমি করতে পারি? আপনাকে আমরা বিষকন্যারা বাবার জায়গা দিয়েছি। মাত্র দশ বছর বয়সে যখন কুলক্ষণা হওয়ার দোষে আমার নিজের বাবা আমায় দাস ব্যবসায়ীর হাতে বিক্রি করে দিয়েছিল, তখন আপনি আমায় উদ্ধার করেন। নতুন জীবন দান করেন। যে ‘বিষকন্যা’ নামে আমার লজ্জা ছিল, আজ সেটাই আমার গর্বের উপাধি। আমি বিষকন্যা উল্লুপি আপনার আদেশে প্রাণ দিতে এবং প্রাণ নিতে সদা প্রস্তুত। আপনি আদেশ করুন, বাবা।
—না, না। প্রাণ দিতেও হবে না এবং আশা রাখি প্রাণ নিতেও হবে না। রাজধানীতে ঘটে যাওয়া পর পর হত্যাগুলোর জন্য দায়ী ব্যক্তিকে গ্রেফতারে তোমার সাহায্য চাই। তুমি এ কাজের উপযুক্ত। এতে তোমার জীবন সংশয়ের সম্ভাবনা আছে, উল্লুপি। তবে আমার বিশ্বাস এর চেয়ে অনেক বেশি বিপদেও নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম তুমি। মগধ তোমার কাছে চিরঋণী থাকবে।
—আপনি নির্দ্বিধায় বলুন আপনার পরিকল্পনা। আমি প্রস্তুত।