১০.
ভীমার কথা
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ব্যাবসা হল দেহব্যাবসা! আমার মা এক বেশ্যা ছিল, আর বাবার পরিচয় জানি না। সম্ভবত আমার মা-ও নিশ্চিত করে জানত না তার পরিচয়। আমার জন্ম হয় দক্ষিণ আর্যাবর্তের একটা রাজ্যের বেশ্যালয়ে। শিশুকালে কিছু বুঝতাম না এইসব। বুঝতাম না যে মা কেন আমায় রাতে অন্য শিশুদের মতো নিজের ঘরে থাকতে দিত না। কিন্তু বয়স একটু বাড়তেই সমাজ আমায় বাস্তবটা বুঝিয়ে দিল। জানতে পারলাম আমি পিতৃপরিচয়হীন জারজ সন্তান। বেশ্যার ছেলে। সমাজের সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণির প্রাণী। পাঠশালায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বেশ্যাপুত্রকে কোনো ব্রাহ্মণ তাঁর গুরুকুলে স্থান দেননি। তাই আমি সারাদিন একা একা খেলতাম। কারণ বেশ্যাপুত্রর সঙ্গে কেউ মেলামেশা করত না।
একদিন খুব তেষ্টা পাওয়ায় একটা কুয়োর থেকে জল পান করি। জানতাম না যে সেটা ব্রাহ্মণদের কুয়ো। একজন আমায় সেখান থেকে জল খেতে দেখে ফেলে আর গ্রামে খবর দেয়। ব্রাহ্মণরা এবং গ্রামের অন্য লোকেরা আমায় ধরে ফেলে। আমায় নগ্ন করে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে চাবকানো হয় সেই অপরাধে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল সারা শরীরে। আর হচ্ছিল প্রচণ্ড রাগ। না না, গ্রামের লোকেদের ওপর নয়। রাগ হচ্ছিল মায়ের ওপর। সবাই ঠিকই বলে। আমার মায়েরই সব দোষ। সব জেনে-শুনে আমায় জন্ম কেন দিল? কার বাচ্চা আমি সেটা পর্যন্ত সে জানে না। নির্লজ্জ, বেহায়া মহিলা! আজ তার বেশ্যাবৃত্তির জন্যই আমার এই অবস্থা। কেন আমায় সে নিজের জরায়ুতেই শেষ করে দিল না? কেন তারই নোংরা জরায়ুতে আমার জন্ম হল? সব ওই বেশ্যার দোষ!
রক্তাক্ত অবস্থায় আমি এক প্রহর ধরে সেদিন রোদে পড়ে ছিলাম। কেউ জল পর্যন্ত দেয়নি। আমি সেদিনই প্রতিটা আঘাত থেকে নির্গত রক্তবিন্দুর নামে শপথ করি যে আমার মাকে সাজা দেব আমি।
কয়েকদিন লাগল সুস্থ হতে। তারপর সুযোগের অপেক্ষায় থাকলাম। কয়েক মাস পর সুযোগ এসেও গেল। সুরার নেশায় চুর হয়ে আমার মা এক পুরুষের সঙ্গে নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিল। আমি একটা ছুরি সোজা বসিয়ে দিলাম আমার ঘুমন্ত মায়ের বুকে। শব্দ করারও সুযোগ পেল না। তারপর সেই ছুরি ধরিয়ে দিলাম নেশার ঘোরে পাশে ঘুমিয়ে থাকা লোকটার হাতে। এরপর নিজেই চিৎকার জুড়ে দিলাম। লোক ডাকলাম। ওই অচেনা লোকটা ঘুম ভেঙে আগের রাতের কথা কিছুই মনে করতে পারল না। তাই সবাই ধরেই নিল যে এটা নিশ্চয়ই নেশার ঘোরে তারই কীর্তি। লোকটাকে প্রহরীরা ধরে নিয়ে গেল বটে, তবে আমি জানি কয়েক দিন বাদেই সে ছাড়াও পেয়ে যাবে। আমার মায়ের মতো একটা সস্তা বেশ্যার জীবনের বিশেষ মূল্য নেই। এই হল বারো বছর বয়সে আমার প্রথম হত্যার ঘটনা।
.
হত্যা করে হাত কাঁপেনি বলেই বোধ হয় কয়েক বছর পর মাংস বিক্রেতার পেশা নিলাম। চলে এলাম রাজধানী পাটলিপুত্রতে। একটা মেয়েকে বিয়ে করলাম। অসম্ভব ভালোবেসে ফেলি মেয়েটাকে। কিন্তু হায়! বিয়ের পরই বুঝতে পারি, আমার স্ত্রীর চরিত্র ভালো না। আমায় দিয়ে তার শারীরিক খিদে তুষ্ট হয় না। এ ছাড়াও মূল্যবান জিনিস এবং গয়নার প্রতিও চরম লোভ। তবুও, আমি যতটা সম্ভব তাকে সুখী করার চেষ্টা করেছিলাম। তার প্রেমে অন্ধ ছিলাম।
কিন্তু আমার স্ত্রীর চরিত্র খুব তাড়াতাড়িই সবাই জানতে পেরে যায়। দুশ্চরিত্র লুকিয়ে রাখা বড়োই কঠিন। তবুও আমি লোকের কথায় কান দিতাম না। একদিন দোকানে একজন ব্যক্তি মাংসর ন্যায্য মূল্য দিতে অস্বীকার করায় আমার সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। সে কথায় কথায় আমায় ‘বেশ্যার স্বামী’ বলে সম্বোধন করে। আমার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। মাংস কাটার ছুরি দিয়ে তাকে কোপ মারি। যদিও ব্যক্তিটি বেঁচে যায়, কিন্তু আমার কয়েক মাসের কারাবাস হয়। মাঝে আমার স্ত্রী দেখতে আসত কারাগারে। আমার দুর্দশায় তাকে একটুও দুঃখিত মনে হত না।
কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েই জানতে পারি যে আমার স্ত্রী, আমার অবর্তমানে, বহু পুরুষসঙ্গী নিয়ে তুলেছে আমারই বাড়িতে। উন্মাদের মতো বাড়ি ফিরি। স্ত্রীকে চেপে ধরি। গলা চেপে মেরে ফেলতাম, কিন্তু তখনই স্ত্রী বলে সে নাকি সন্তানসম্ভবা। আমি তাকে ছেড়ে দিই। না না। তাকে ক্ষমা করিনি। বরং তার ওপর আমার অসম্ভব রাগ হয়। কারণ আমি জানি এই সন্তান আমার নয়। এ অন্য কারুর পাপ। ঠিক যেমন আমি নিজে ছিলাম। আমার মায়ের পাপের ফল। আমি তখনই ঠিক করে ফেলি এই সন্তানকে জন্মাতে দেব না। মরতে হবে তাকে এবং তার বেশ্যা মাকে।
সেই মুহূর্তে, আমার স্ত্রীর দিকে চোখ পড়তেই একটা জিনিস উপলব্ধি করি। কী আশ্চর্য! আমি এতদিন এটা খেয়াল করিনি? আমার স্ত্রীকে ঠিক আমার বেশ্যা মায়ের মতো দেখতে! সেই তামাটে রং, উচ্চতা এবং কোঁচকানো কালো চুল। তার মুখে আমি স্পষ্ট নিজের মায়ের মুখ দেখতে পাই।
সেই রাতেই আমার মাংস কাটার ছুরি দিয়ে স্ত্রীকে আমি হত্যা করি! সে আমায় সত্য বলেছিল নাকি পেটে সন্তান থাকার কথাটাও মিথ্যে, সেটা নিশ্চিত করতে তার জরায়ু কেটে দেখি। এইবার বেশ্যাটা আমায় সত্যিই বলেছিল। এরপর দেহটা টুকরো টুকরো করে রাতেই বাড়ির পেছনের উঠোনে পুঁতে ফেলি। শুধু ওই জরায়ুটা আলাদা করে রেখে দিয়েছিলাম। সেটার ওপর আমার ঘৃণাই আলাদা! ওটাকে আরও অনেক টুকরো করে তবে শান্তি পাই।
পরদিন সকালে সকলকে জানাই, আমার স্ত্রী অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়েছে। সবাই বিশ্বাস করল। কারণ একজন বেশ্যা স্ত্রীলোকের চরিত্র সবাই জানে। উলটে সবাই আমায় সহানুভূতি জানাল।
.
কিন্তু এরপর থেকেই আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়। আমার মধ্যে ঘুমন্ত পিশাচ জেগে ওঠে। কয়েক সপ্তাহ যেতে-না-যেতেই, মন অশান্ত হয়ে উঠল। প্রচণ্ড রাগ উঠল মাথায়, নিজের মায়ের ওপর, স্ত্রীর ওপর। মনে হল তাদের আরও একবার হত্যা করতে হবে। মাত্র একবার তাদের পাপের শাস্তি দেয়াই যথেষ্ট নয়। বার বার তাদের যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করতে হবে। আমি বড়ো ছুরিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম এক রাতে। ঘোড়ায় করে পৌঁছে গেলাম এক বেশ্যাপল্লিতে। খুঁজে পেলাম এক বেশ্যাকে, যাকে ঠিক আমার মায়ের মতোই দেখতে। রুপোর মুদ্রার লোভ দেখিয়ে তাকে নিয়ে এলাম নির্জন জায়গায়। তাকে হত্যা করলাম। ছুরি চালানোর সময়ে তার মুখটা হুবহু আমার মায়ের মতোই লাগছিল। তাতেও শান্তি পেলাম না। বের করে আনলাম তার জরায়ু। সঙ্গে করে নিয়ে এলাম সেটাকে। তারপর সময় নিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটলাম। নাহ্, এর গর্ভে কোনো পাপ নেই। আহ্, কী যে শান্তি পেলাম! তারপর যথারীতি সেই টুকরোগুলোর জায়গা হল আমার বাড়ির পেছনে।
কিন্তু এরপর থেকে, মাঝে মাঝেই আমার মন অশান্ত হয়ে ওঠে। তখন আমি খুঁজতে বের হই আমার মাকে। আমার স্ত্রীকে। তাদের সাজা দিই আমি বার বার। বড়ো শান্তি পাই! খুব শান্তি!
* * *
হন্তদন্ত হয়ে চাণক্যর বাড়িতে ঢুকলেন সেনাপতি কিথক।
—আচার্য! সুখবর আছে।
—হুমম। শান্ত হোন, মহাবীর। রাগ আর অতি উৎফুল্লতা, দুটোই মানুষের বুদ্ধিনাশ ঘটায়।
—আচার্য, আমার ধারণা আমরা অপরাধীর সন্ধান পেয়েছি। জীবসিদ্ধি মহাশয়ের লোকেরাই সেই খবর এনেছে। আপনার কথামতোই এই ব্যক্তি পেশায় সৌনিক, মাংস বিক্রি করে। কয়েক মাস আগে জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে বচসা হওয়ায়, রেগে গিয়ে তাকে আঘাত করে এই লোকটা। কয়েক মাস কারাবাসও করেছে এই কারণে। স্ত্রী তাকে ত্যাগ করে পরপুরুষের সঙ্গে নিখোঁজ হয়েছে। খোঁজ নিয়ে এও জেনেছি তার মা একজন গণিকা ছিল।
—হুমম। সাধু। আমার বিশ্বাস সাম্যর সন্দেহে ভুল হয়নি। বিনা প্রমাণে এই ব্যক্তিকে আটক করা যাবে না। আর তাই একে ধরতে হবে প্রমাণ সমেত। সেই কারণেই ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করতে হবে। যাতে শিকারি স্বয়ং এইবার শিকার হয়। এই নরপিশাচটা যোগ্য শাস্তি পেলে, তবেই ছায়া এবং পীতাম্বরীর আত্মা শান্তি লাভ করবে।
—কী? কাদের আত্মা?
—আহা। ওই মৃত স্ত্রীদের মধ্যে দু-জনের নাম। ছায়া এবং পীতাম্বরী। আপনার অবশ্য তাদের নাম জানার কথা না। স্বাভাবিক।
—ওহ, বেশ। তা আচার্য, এরপর আমাদের করণীয় কী?
—নজর রাখুন এই পুরুষটার ওপর। সে এখন একটা রক্তের স্বাদ পাওয়া শ্বাপদ। শিকার না করে বেশিদিন থাকতে পারবে না। প্রতিবার সে আলাদা আলাদা গণিকাপল্লি থেকে শিকার নিয়েছে। নগরের আর শুধুমাত্র একটাই গণিকালয় বাকি আছে। অনুমান করতে পারি সে তার পরবর্তী শিকারের সন্ধানে সেইখানেই আসবে। আমরা তৈরি থাকব তার জন্যে।
—বেশ। আর আপনার বিষকন্যা তৈরি তো?
—হ্যাঁ। আজ রাত থেকে সে রোজই তৈরি থাকবে। সুযোগ আসবেই। আচ্ছা, কতদিন আগে আঙুরীর হত্যা হয়েছে, সেনাপতি?
—তা প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল আঙুরীর হত্যার।
—হুমম।
চাণক্য আবার ভাবনায় ডুবে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন,
—আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, আমরা খুব তাড়াতাড়িই সুযোগ পাব। জীবসিদ্ধির গূঢ় পুরুষরা তার গতিবিধির ওপর নজর রাখবে আশা করি। কোনো রাতে তাকে অভিসারে বেরোতে দেখলেই যেন তক্ষুনি আমায় সেই খবর দেয়া হয়। আমিও উপস্থিত থাকতে চাই তাকে গ্রেফতার করার সময়ে। আপনি আসুন, আর্য। আপনার সাফল্য আর দোষীর সাজা কামনা করি।
১১.
গভীর রাত। আজ ভীমার চোখে ঘুম নেই। একটা প্রচণ্ড আক্রোশ… হতাশা…. দুঃখ তার ভেতরে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এই অদ্ভুত অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বোধ হয় একেই ‘রক্ততৃষ্ণা’ বলে। ভীমা জানে তাকে কী করতে হবে। চোখ খুলে দেখল তার বিছানার পাশেই তার মা আর স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। আগে মা একা আসত। আজকাল সঙ্গে আবার এই বেশ্যাটাকেও নিয়ে আসে। তাদের তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি দেখলেই ভীমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। আবার তাদের শাস্তি দেয়ার সময় এসেছে! তাদের আরও একবার মরতে হবে!
বিছানা ছেড়ে নেমে, চোখে-মুখে ঠান্ডা জল দিল ভীমা। বাড়ির সামনেই তার ছোট্ট দোকান। তালা খুলে সেখানে ঢুকল ভীমা এবং বেরিয়ে এল একটু পরেই। সঙ্গে একটা বস্তায় করে কাটা মাংস নিতে ভুলল না। কারণ ফেরার পথে সৈনিকরা তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখলে, এটা দেখিয়েই তাদের হাত থেকে রেহাই পায় সে। কালো ঘোড়াটা বের করে আনল। গায়ের কাপড় দিয়ে মুখের একাংশ সহ সারাশরীর ঢেকে নিল ভীমা। শুধু তার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে শ্বাপদ প্রাণীর মতো। ঘোড়ায় চড়ার সময়ে, গায়ের কাপড় সরে যেতে, চাঁদের আলোয় এক মুহূর্তের জন্য বঝলসে উঠল কোমরবন্ধে বাঁধা, তীব্র-ধার, বড়ো, ভারী মাংস কাটার ছুরিটা। কুয়াশা ভেদ করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল শিকারের সন্ধানে।
বেশ কিছুটা ঘোড়া ছুটিয়ে, ভীমা এসে পৌঁছোয় নির্দিষ্ট গণিকাপল্লিতে। বেশিরভাগ গণিকাই রাজ আদেশে আর রাতের বেলা পথে নামছে না। কিন্তু ভীমা লক্ষ করল, সংখ্যায় কম হলেও তিন-চারটি যুবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পথের ধারে লাগানো মশালের আলোয় বিশেষ একজনের ওপর তার নজর পড়তেই ভীমার দৃষ্টি জ্বলজ্বল করে উঠল। এই তো সে! যাকে সে খুঁজছিল। তার মা! তার স্ত্রী! নির্লজ্জ বেশ্যা! একটা রুপোর মুদ্রা বের করে সেই যুবতীকে দেখাল। তাকে ঘোড়ায় উঠে আসতে ইশারা করল। যুবতীর মধ্যে সামান্য ভয় এবং সংশয়ের ভাব দেখা গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এল যুবতী। মনে মনে হাসল ভীমা। এই মুদ্রাটা দেখিয়ে প্রতিবার সে কাজ হাসিল করেছে। কিন্তু মুদ্রাটা তাকে খরচা করতে হয়নি একবারও।
ঘোড়ায় উঠতে মেয়েটাকে সাহায্য করল ভীমা। মেয়েটাকে নিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর একটা অন্ধকার নির্জন জায়গায় দাঁড়াল। মেয়েটাকে নামতে বলল। মেয়েটা ইতস্তত করছিল। ভীমা মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে, মিষ্টি গলায় তাকে বলল :
—দেখ ছোড়ি। বাড়িতে স্ত্রী আছে। তাই তোকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব না। আর তোর এলাকায়, তোর ঘরে ঢুকতে কেউ দেখে নিক, সেটাও আমি চাই না। তাই এখানে আনলাম। চিন্তা করিস না। আমায় খুশ করতে পারলেই মুদ্রা তোর।
এই কথায় মেয়েটা নেমে পড়ল। ভীমা নেমে এসে মেয়েটাকে নিয়ে অন্ধকারের একটু ভেতরের দিকে এগিয়ে গেল। আড়াল হতেই মেয়েটাকে দেয়ালে ঠেসে ধরল। কিছু করার আগেই, গায়ের জোরে মেয়েটার মুখ চেপে ধরল। তারপর দ্রুত নিজের কোমর থেকে টেনে বের করে আনল ছুরিটা। সেই মুহূর্তে ভীমা টের পেল, মেয়েটার মুখ চেপে ধরা হাতে মেয়েটা মৃদু কামড় বসিয়েছে। অতি সামান্য কামড়, কিন্তু হঠাৎ জ্বলে উঠল জায়গাটা। ছুরি ধরা হাতটা যেন হঠাৎই ভারী হয়ে আসছে। ধরে রাখতে অসুবিধে হচ্ছে। মাথার ভেতরটা পাক দিচ্ছে আর চোখের দৃষ্টিও যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। যুবতীটাকে চেপে ধরে থাকা হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এল। পরক্ষণেই মেয়েটা মল্লযুদ্ধের মোক্ষম একটা প্যাঁচে ভীমার ভারী শরীরটাকে মাটিতে চিত করে আছড়ে ফেলল। তরুণী চড়ে বসল ভীমার বুকের ওপর। হাত মুঠো করে একটা আঘাতে নাকটা থেঁতলে দিল ভীমার। ভীমার প্রায় অসাড় শরীরটার দিকে চেয়ে হেসে উঠল তরুণী। উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের কাপড়ের ভাঁজ থেকে করে আনল ছোটো একটা বাঁশের টুকরো। সেটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে তিন বার ‘ফুঁ’ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ বের করল। মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত। তারপরেই অন্ধকার আর কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে এল পাঁচ-ছ-জন সৈনিক। হাতে খোলা তলোয়ার নিয়ে ঘিরে ধরল ধরাশায়ী ভীমাকে। এদের মধ্যে একজন সেনাপতি কিথক। প্রহরীদের পেছন থেকে এতক্ষণে এগিয়ে এলেন আরও দু-জন। তাঁদের দেখে বাকি প্রত্যেকে করজোড়ে প্রণাম করল। জীবসিদ্ধির হাতে মশাল এবং তার সামনের জন স্বয়ং আচার্য চাণক্য। গণিকারূপী উল্লুপির সামনে এসে প্রশংসার সুরে আচার্য বললেন,
—সাধু মা! সাধু! এই অসম্ভব সাহসিকতার জন্যে মগধ তোমার কাছে চিরঋণী থাকবে।
চাণক্য দৃষ্টি ঘোরালেন ধরাশায়ী ব্যক্তিটির দিকে। নিজের মনেই বললেন,
— এ-ই তবে আমাদের হত্যাকারী। হুমম। উল্লুপি, বেশি গভীরে কামড়াওনি তো? বেশি বিষে মৃত্যু হবে না আশা করি?
—না, গুরুদেব। ঠিক যেমন আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা অবশ হয়ে থাকবে শরীর।
—হুমম। বেশ, বেশ।
১২.
সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর রাজসভা। আজ সেখানে সব মন্ত্রী ও গণ্যমান্য রাজপুরুষ উপস্থিত। পাটলিপুত্রের দুঃস্বপ্নের ইতি হয়েছে। কয়েক মাস ধরে ঘটতে থাকা হত্যাকাণ্ডর মূল অভিযুক্ত এই মুহূর্তে কারাগারে। বিষকন্যা উল্লুপি, সেনাপতি কিথক এবং সুসেন আজ সভার প্রধান অতিথি! আরও একজন আজ আমন্ত্রিত এই রাজসভায় সন্মানীয় অতিথি হিসেবে। মহামতি আচার্য বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য, যাঁর বিচক্ষণতা আর অনুধাবন শক্তি ছাড়া কোনোভাবেই হত্যাকারীকে ধরা সম্ভব ছিল না। তবে তিনি এখনও আসেননি। অন্য কেউ বিষয়টা বিশেষ প্রাধান্য না দিলেও, সম্রাট নিজে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত। কারণ তিনি গুরুদেবের স্বভাবের সঙ্গে বহু বছর ধরে পরিচিত। এই মানুষটা কোনোদিন, কোনো কাজে দেরি করেন না। চাণক্য নিজের শিষ্যদের বাল্যকাল থেকেই শিখিয়েছেন, ‘যে সময়কে মাহাত্ম্য দেয়, ইতিহাস তাকেই মাহাত্ম্য দেয়। জীবসিদ্ধিও এসে পৌঁছোয়নি। তারই প্রতীক্ষায় রয়েছে সবাই।
সম্রাটের ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই সভাঘরে ঢুকলেন চাণক্য এবং সঙ্গে অবশ্যই ছায়াসঙ্গী জীবসিদ্ধি। যথারীতি তাঁকে দেখেই প্রত্যেক সভাসদ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং সম্রাট নিজে সিংহাসন ছেড়ে নেমে এসে আচার্যকে প্রণাম জানালেন। সসম্মানে নিজের ডান পাশের খালি আসনে বসতে বললেন। জীবসিদ্ধিও নিজের নির্দিষ্ট আসনে বসল। চাণক্যর অনুমতি নিয়ে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে ইশারা করলেন। সভার সূচনা ঘোষণা করে বললেন,
—আপনারা সকলেই জানেন যে গত কয়েক মাস ধরে এই নগরের বেশ কিছু গণিকাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সুখবর এটাই যে, গতকাল রাতে সেই উন্মাদ হত্যাকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই কাজ সম্ভব হয়েছে যেসব মানুষের সাহায্যে, সেই সন্মানীয় অতিথিরা আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন। কোন উপায়ে এই উন্মাদ হত্যাকারীকে তাঁরা গ্রেফতার করলেন, আমি জানি সেই কাহিনি বিশদে শুনতে আমারই মতো আপনারা সকালেই ব্যগ্র। তাই আমরা তাঁদের মুখ থেকেই ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ শুনতে ইচ্ছুক। সভাসদরা সম্মতিক্রমে মাথা নাড়ালেন। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যর দিকে চাইলেন। চাণক্য সেনাপতি কিথকের দিকে ইশারা করে বললেন,
—এই হত্যাকাণ্ডর তদন্তে যিনি অগ্রপুরুষ, সেই সেনাপতি কিথক নিজেই ঘটনাক্রম আপনাদের সামনে উপস্থাপন করুক।
কিথক মৃদু হেসে, আচার্যকে করজোড়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন। জোর গলায় বলতে শুরু করলেন পুরো ঘটনা। প্রথম হত্যা থেকে শুরু করে, চাণক্যর তদন্ত কৌশল, উল্লুপির সাহসিকতা এবং সবশেষে হত্যাকারী ধরা পড়ার পুরো ঘটনা বিশদে ব্যাখ্যা করলেন। অতি মনোগ্রাহী ভঙ্গিতে তিনি সম্পূর্ণ কাহিনি উপস্থাপন করলেন। কথার শেষে সভায় উপস্থিত প্রত্যেকে সাধুবাদ দিয়ে উঠলেন তাঁদের উদ্দেশে।
কিথক নিজের আসনে ফিরে আসতে, সম্রাট আবার উঠে দাঁড়িয়ে আজকের সভার ইতি এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করতেই যাচ্ছিলেন। সেই মুহূর্তে চাণক্য নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন সভার সামনে। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে চাণক্য মুখ খুললেন,
—আপনাদের সকলের থেকে আরও খানিকটা সময় আমি চেয়ে নেব। দয়া করে একটু ধৈর্য সহকারে শুনবেন। আপনাদের একটা কাহিনি বলব। বাল্যকালে, আমাদের কুটিরের পাশে একটা বট গাছের তলায় এক উন্মাদ থাকত। সারাদিন নিজের মনেই কথা বলত এবং আমার মায়ের দানের অন্ন খেয়েই বেঁচে থাকত। সেই মানুষটা প্রতিদিন সকালে নদীর পাড় থেকে একটা করে জবা ফুল নিয়ে আসত। কিন্তু তা দিয়ে নিজে কিছুই করত না। ফেলে দিত জঙ্গলে। এটা তার নিত্যদিনের স্বভাব ছিল। আমার মনে আছে, একদিন রাত থেকেই মারাত্মক ঝড়-ঝঞ্ঝা চলছিল। ঝড়-বৃষ্টির দাপট থেকে বাঁচতে উন্মাদ নিজেও আমাদের আস্তাবলে আশ্রয় নিয়েছিল। সকালে উঠে আমি এবং বাবা বুঝলাম আজ আর কোনোমতেই বাড়ির বাইরে পা দেয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতির এইরকম রুদ্র রূপ সচরাচর প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু তখনই দেখতে পেলাম, সেই উন্মাদ মানুষটা নদীর পথে হাঁটা দিয়েছে। এই তীব্র দুর্যোগ উপেক্ষা করে সে চলেছে, তার নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় একটা নিয়ম রক্ষা করতে। সেইদিন একটা কথা আমি বুঝেছিলাম। উন্মাদ ব্যক্তিরা তাদের নিয়মের ব্যতিক্রম করে না। তাদের স্বরচিত নিয়ম তাদের কাছে সর্বোচ্চ। প্রলয় এসে উপস্থিত হলেও তারা সেই কাজটা করবেই।
এইটুকু বলে থামলেন আচার্য। প্রত্যেকের মুখে হতভম্ব ভাব। এই কাহিনি এই মুহূর্তে সবাইকে শোনানোর কী প্রয়োজন থাকতে পারে, সেটা কেউই আন্দাজ করতে পারছে না। শুধু সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর কপালে ভ্রূকুটি। তিনি জানেন যে আচার্য অর্বাচীন নন। ওঁর প্রতিটা কথার গুরুত্ব থাকে। চাণক্য আবার শুরু করলেন।
—এই গণিকাদের হত্যাকারী, ভীমা নামের ব্যক্তিটি, একজন উন্মাদ ব্যক্তি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তা সহজেই বোঝা যায়। নিজের বাল্যকালের আক্রোশ সে অন্যের ওপর চরিতার্থ করে। সম্পূর্ণভাবে বিকারগ্রস্ত সে। আর পাঁচটা উন্মাদের মতোই তারও শিকার নির্বাচনের এবং হত্যার ভঙ্গিতে কিছু বিশেষ নিয়ম ছিল। কিন্তু একটা ক্ষেত্রে সে তার নিয়ম কেন ভাঙল?
চন্দ্রগুপ্ত প্রশ্ন করলেন,
—আচার্য, কোন নিয়ম? দয়া করে বিশদে ব্যাখ্যা করুন।
—হুমম। সেনাপতি কিথকের মুখেই আপনারা শুনলেন যে হত্যাকারী ভীমা স্বীকার করেছে যে, সে সেই গণিকাদেরই হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে সে নিজের মা এবং স্ত্রীর ছায়া দেখত। তার মা এবং স্ত্রী, দু-জনেরই গায়ের রং ছিল তামাটে, কোঁচকানো কালো চুল এবং মাঝারি উচ্চতা। এই কারণে ভীমা বেছে বেছে অনেকটা সেইরকম দেখতে গণিকাদেরই হত্যা করত। প্রথম তিন জন গণিকার মৃতদেহ দেখেই প্রত্যেকের চেহারায় এই সাদৃশ্যগুলো আমার নজরে পড়েছিল। বিষকন্যাদের মধ্যে থেকে উল্লুপিকে নির্বাচন করার কারণও সেটাই। তার চেহারার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু, হত্যাকারীর শেষ অর্থাৎ চতুর্থ শিকার গণিকাটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারার। আঙুরী নামের সেই মৃতা মেয়েটা ছিল দীর্ঘাঙ্গী, চুল কোঁচকানো নয় এবং ফর্সা। অতএব আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে হঠাৎ এই ক্ষেত্রে হত্যাকারী তার চিরাচরিত, স্বনির্মিত নিয়মের বিপরীতে গেল কেন? বিষয়টা কি রহস্যময় নয়?
১৩.
মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়েছে শ্রোতাদের মধ্যে। কী বলতে চাইছেন মহামতি চাণক্য? সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত হাত তুলে সবাইকে মৌন হওয়ার ইশারা করলেন গুঞ্জন থামতে, চাণক্য আবার বললেন,
—হুমম। আমি প্রথম তিনটে মৃতদেহই দেখেছিলাম। তাই চতুর্থ হত্যার খবর যখন সুসেন আমায় দিল, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এবারেও একই চেহারাগত বৈশিষ্ট্য থাকবে মৃতার। আমার শিষ্য জীবসিদ্ধি এবং সুসেন অবশ্য আমার অত্যন্ত যুক্তিশীল প্রশ্নটাকে, আমার বার্ধক্যের চমক দেয়ার বৃথা চেষ্টা ভেবে নিয়েছিল। কিন্তু যখন সুসেনের মুখে শুনলাম এবং স্বচক্ষে দেখলাম যে এইবার হত্যা হওয়া গণিকা সম্পূর্ণ আলাদা দেখতে, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে আরও একটা মারাত্মক ব্যতিক্রম হয়। আঙুরীর জরায়ু হত্যাকারী নিজের সঙ্গে নিয়ে যায়নি। কাছের একটা জলাশয়ে ফেলে দেয় সেটা। এখানে তর্ক করা যেতে পারে যে, এই ক্ষেত্রে হয়তো কোনো প্রহরী এসে পড়েছিল হত্যাকারীর কাছে। তাই সেটা ফেলে দিয়েছিল ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। কিন্তু আমরা জেনেছি, যে ভীমা নিজে একজন মাংস বিক্রেতা হওয়ার কারণে সহজেই রক্তাক্ত পোশাক এবং জরায়ু সঙ্গে নিয়ে পালাতে পারত। সে সঙ্গে একটা পশু- মাংস বোঝাই ঝোলা রাখত। তাতেই সেই জরায়ুটাও লুকিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেত। অতএব ভয় পেয়ে জরায়ু ফেলে দিয়েছে, এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কথা থামাতেই সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত সেই প্রশ্নটা করে ফেললেন যা এতক্ষণ সবার মনেই জেগেছে,
—আচার্য, আপনি বলতে চাইছেন চতুর্থ হত্যা অন্য কেউ করেছে?
সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে চাণক্য বললেন,
—একদম ঠিক ধরেছেন, সম্রাট। যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ করলেই অনুমান করা যায় যে চতুর্থ গণিকার হত্যাকারী কোনো এক ভিন্ন ব্যক্তি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কে? কে সেই ব্যক্তি? এই প্রশ্নর উত্তরও যুক্তি দিয়ে ভাবলে সহজেই অনুমান করা সম্ভব। প্রথমত একটা প্রশ্ন থেকে যায়, যে আঙুরী কী কারণে সেই রাতে বের হল? সে জানত বিপদের কথা, তবুও কার আশ্বাসে সে নির্ভয় ছিল? নিঃসন্দেহে সে কোনো সামরিক পদের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি।
আরও একটা ভাবনার বিষয় আছে। পর পর তিনটে হত্যা হওয়ার কারণে পাহারা ব্যবস্থা বাড়িয়ে দেয়া হয়। প্রহর ও জায়গা ভাগাভাগি করে পাহারার ব্যবস্থা করা হয় স্বয়ং সম্রাটের নির্দেশে। অথচ তার মধ্যেও চতুর্থ হত্যা করতে হত্যাকারী সফল হয়। এটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। যদি না… যদি না প্রহর ভিত্তিক এবং এলাকাভিত্তিক পাহারা-সূচি আগেই হত্যাকারীর জানা থাকে। অর্থাৎ, হত্যাকারী আগে থেকেই জানত যে রাতের কোন সময়ে, কোন জায়গায় কোনো প্রহরী উপস্থিত থাকবে না। কিন্তু সেটা তো অত্যন্ত গোপন খবর। প্রতি রাতের আলাদা পাহারা-সূচি তো সেনাপতি নিজে নির্ধারণ করেন প্রতি রাতে। সেটা সেনাপতি কিথক ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। আমার যুক্তি কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে, সেনাপতি কিথক?
সভাকক্ষে উপস্থিত প্রতিটা দৃষ্টি এই মুহূর্তে কিথকের ওপর নিবদ্ধ। কিথকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠলেও, তিনি এখনও শান্ত বসে আছেন। ঠোঁটে জোর করে হাসি এনে তিনি বললেন,
—ক্ষমা করবেন, আচার্য। আপনি সম্রাটের পরমপূজ্য গুরু হতে পারেন, কিন্তু আমার মনে হয় আপনি এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে অতিরিক্ত ভেবে ফেলেছেন। নিজের কাল্পনিক কাহিনির ওপর নির্ভর করে আপনি কি আমায় হত্যাকারী প্রমাণ করতে চাইছেন? একটা বেশ্যাকে হত্যা করার, আমার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? আর তা ছাড়া, আপনার হয়তো মনে নেই, যে, এই হত্যাকাণ্ডর তদন্তে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে আপনার দরজায় স্বয়ং আমিই উপস্থিত হয়েছিলাম।
কঠিন স্বরে চাণক্য উত্তর দিলেন,
—কোনো কিছুই আমার বিস্মরণ হয়নি, সেনাপতি। আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আঙুরী নামের গণিকার হত্যার পেছনে কোনো গভীর রহস্য আছে। কিন্তু কী সেই রহস্য তা আন্দাজ করতে পারছিলাম না। সেই উত্তর খুঁজতেই আমি নিজে যাই আঙুরীর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে তার কিছু নতুন পোশাক, গয়না এবং রুপোর মুদ্রা দেখে আন্দাজ করতে পারি যে, হঠাৎই কয়েক মাস ধরে তার অর্থলাভ হয়েছে। আর সেই অর্থর পরিমাণ অনেকটাই বেশি। পতিতাবৃত্তি করে সমপরিমাণ অর্থ উপার্জন প্রায় অসম্ভব। আরও একটা বিষয় দেখে অবাক হই। এই মেয়েটার ঘরে দোয়াত-কলম রাখা। অর্থাৎ সে শিক্ষিত। সাধারণত রূপজীবীদের ক্ষেত্রে এটা অতি বিরল। সমস্ত রহস্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় বিশেষ একটা জিনিসের দিকে আমার নজর পড়তেই। তার বাড়িতে আমি অনেকগুলো ফাঁপা মাদুলি পাই! সেইসময়ে আমার সঙ্গে উপস্থিত সুসেন সেগুলো দেখে একটা ঠিক মন্তব্য করেছিল যে, এই মাদুলিগুলোর সঙ্গে বাঁধা সুতোগুলো অত্যন্ত ছোটো। গলায় বাঁধার উপযুক্ত নয়। সম্ভবত হাতে বাঁধার। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সুসেন একটা ভুল করে। সেই সুতোগুলো অনেকটাই বেশি ছোটো ছিল। হাতের মাপেরও ছোটো। এই যে। একটা আমি সঙ্গে এনেছি। অন্যরা এই জিনিস না জানলেও আমি নিশ্চিত যে সম্রাট এবং জীবসিদ্ধি, দু-জনেই এটা সহজেই চিনতে পারবে। গুপ্তচরবৃত্তিতে এই জিনিস বহু ব্যবহৃত। জীবসিদ্ধি, তুমি একবার সকলের জানার জন্যে বলে দাও দেখি এটা কোন কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
জীবসিদ্ধি উত্তর দিল,
—পায়রার গলায় বাঁধতে! মাদুলির মধ্যে গুপ্তসংবাদ ভরে, মোম গলিয়ে মুখ আটকে দেয়া হয়। তারপর প্রশিক্ষিত পাখির গলায় বেঁধে উড়িয়ে দেয়া হয়। আমরা নিজেরাও এইভাবে গুপ্তচিঠি পাঠিয়ে থাকি।
—হুমম। ঠিক তাই। কয়েক সপ্তাহ আগেই সম্রাটের সভায় এসে জানতে পেরেছিলাম, যে, রাজ্যের গোপন সামরিক তথ্য কোনো এক উচ্চপদস্থ ব্যক্তির দ্বারা পাচার হচ্ছে। এই মাদুলি দেখেই সত্যটা অনুমান করতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। আমার অনুমানে ভুল হলে সেনাপতি কিথক শুধরে দেবেন আশা করি। আঙুরী কোনো সাধারণ গণিকা ছিল না। সে ছিল শত্রু দেশের গুপ্তচর। আমাদের সেনাপতি কিথককে আঙুরী ফাঁসায় নিজের রূপ ও যৌবনের জালে। তার বাড়িতে গোপনে সেনাপতি কিথকের যাতায়াত শুরু হয়। সুরা ও যৌনতার নেশায় সেনাপতি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য এই মেয়েটাকে দিতে থাকে। মেয়েটা প্রশিক্ষিত পায়রা ব্যবহার করে সেই তথ্য শত্রুর কাছে পৌঁছে দিত কিন্তু সাম্রাজ্যের গুপ্তচররা জানতে পারল যে খবর পাচার হচ্ছে। সম্রাটের কানে সেই খবর এসে পৌঁছোতেই সম্রাট আদেশ দিলেন বিশ্বাসঘাতককে খুঁজে বের করতে। সেনাপতি কিথক বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর সময় আসন্ন। আমাদের গুপ্তচররা আঙুরীর খোঁজ পাবেই। আর তারপরই, কান টানলেই মাথা আসবে। অতএব নিজেকে বাঁচাতে হলে, আঙুরীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়াটা সেনাপতির জন্যে জরুরি হয়ে পড়েছিল।
এইটুকু বলে চাণক্য আবার সেনাপতির দিকে ফিরলেন। এইবার আর তিনি কোনো প্রতিবাদ করলেন না। কাঠ হয়ে বসে আছেন তিনি নিজের আসনে। তাঁর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চাণক্য আবার কথা শুরু করলেন,
—কাকতালীয়ভাবে, ঠিক এই সময়েই, পাটলিপুত্ৰতে দেখা দিল আর এক সমস্যা। একজন উন্মাদ হত্যাকারী যে কিনা খুঁজে খুঁজে পতিতাদেরই হত্যা করে। কিথক হাতে চাঁদ পেল। এই তো সুযোগ। হত্যাকারীর পদ্ধতি অনুসরণ করে যদি আঙুরিকেও হত্যা করে দেয়া যায়, তবে দোষ পড়বে উন্মাদ হত্যাকারীর ওপর। সেনাপতির ওপর সন্দেহ যাওয়ার প্রশ্নই নেই। আর যদি সেই হত্যাকারী তারপর ধরা পড়ে যায়, তবে তো সব সমস্যার সমাধান। তাকে ফাঁসিতে চড়িয়ে সম্পূর্ন ঘটনার ইতি টেনে দেয়া হবে। সেনাপতির নাগাল কেউ কোনোদিন পাবে না। যে অপরাধের সমাধান হয়ে গেছে এবং অপরাধী শাস্তি পেয়ে গেছে, সেই অপরাধ নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামাবে না। তাই এই হত্যাকারীকে ধরতে কিথক নিজে আসে আমার কাছে। কারণ হত্যাকারী ধরা পড়লেই তাঁর সুবিধা। সে তিনটে করেছে না চারটে, সেটা একজন অপরাধীর কথায় কেউ বিশ্বাস করবে না। আর এই ক্ষেত্রে তো আরওই অনুকূল পরিস্থিতি, যেখানে অপরাধী নিজেই উন্মাদ। অতএব নিজের অপরাধটা অতি সহজে উন্মাদ হত্যাকারীর ওপর দিয়ে দেয়া যাবে।
কিন্তু আমি তবু নিশ্চিত হতে চাইছিলাম যে আমার সন্দেহ ঠিক। তাই ফাঁদ পাতলাম সেনাপতির জন্য। ভীমার খোঁজ পাওয়ার পরে সেনাপতি যখন আমার কুটিরে আসেন তাঁর সামনে অবহেলা ভরে, কথার ছলে, আমি ‘ছায়া’ এবং ‘পীতাম্বরি’ নাম দুটো উচ্চারণ করি। এগুলো প্রথম দু-জন মৃতা গণিকার নাম। যথারীতি সেনাপতি নাম দুটো চিনতে পারেন না। সেটাই স্বাভাবিক। মৃতা গণিকাদের নাম স্বয়ং সেনাপতির মনে না থাকারই কথা। কিন্তু তারপরেই নিতান্ত কথার ছলে আমি ‘আঙুরী’ নামটা উচ্চারণ করি। সেনাপতি অসাবধানতার বশে, আমার ফাঁদে পা দিলেন। এবং এই ক্ষেত্রে সেনাপতি কিন্তু নামটা চিনতে পারলেন। এটা প্রমাণ করে যে এই চতুর্থ গণিকা কিথকের পূর্বপরিচিতা ছিল। কি সেনাপতি? এখনও অস্বীকার করবেন?
কথা শেষ হতেই কিথক হিংস্র হয়ে উঠলেন। তাঁর মিথ্যা শীতলতার মুখোশ খসে পড়ল। অশ্রাব্য কটু শব্দ বলে, কোমর থেকে তলোয়ার বের করে চাণক্যকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু তিনি খেয়ালই করেননি যে বহু পূর্বেই ওঁর দু-পাশে, দু-জন সৈনিক এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তলোয়ার পর্যন্ত হাত পৌঁছোনোর আগেই তাঁকে চেপে ধরল দু-জন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও দু-জন সৈনিক তাঁকে কাবু করল।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত উঠে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিলেন,
—রাজদ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতা এবং হত্যার অপরাধে আপনাকে গ্রেফতার করা হল, সেনাপতি। সৈনিকরা, নিয়ে যাও একে এবং বন্দি করো কারাগারে।
কিথককে নিয়ে চলে যাওয়ার পর চাণক্য সম্রাটের দিকে ফিরলেন। বললেন,
—সম্রাট, আমাদের দায়িত্ব কিন্তু শেষ হয়নি। যাতে ভবিষ্যতে আরও একটা ভীমার জন্ম না হয় তার দায়িত্ব আমাদের। রূপজীবীদের সন্তানদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে সমাজের এই নারীরাও মাথা উঁচু করে সসম্মানে বাঁচতে পারে। সমাজের বুকে যেন আরও একটা বিকৃত, প্রতিহিংসাপরায়ণ ভীমার জন্ম না হয়, সম্রাট। ভীমা আমার ব্যর্থতা, আপনার ব্যর্থতা, এই সমাজ ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতীক।
করজোড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে চন্দ্রগুপ্ত প্রণাম জানালেন আচার্যকে। বললেন,
—আপনার দেখানো পথেই এই দেশের উন্নতি সাধন হবে, গুরুদেব।
উপসংহার:
জীবসিদ্ধি আর চাণক্য বসে আছেন নিজের কুটিরে। জীবসিদ্ধি অনেকক্ষণ থেকে কৌতূহল দমন করে আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছেন আচার্য। শিষ্যর এনে দেয়া নতুন মধুর পাত্রর ঢাকনা খুলতে খুলতে বললেন তিনি,
—জীবসিদ্ধি, মনে যা প্রশ্ন আসছে, তা করে ফেলো।
খানিক চুপ থেকে জীবসিদ্ধি বলল,
—গুরুদেব, আজ রাজমহলে গিয়েছিলাম সম্রাটের কুশল জানতে। কথাপ্রসঙ্গে জানতে চাইলাম হত্যাকারী ভীমার কী হল। সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে সকলে এতটাই স্তম্ভিত যে ভীমার ব্যাপারটা সভাসদ ভুলে গেছে। প্রশ্ন করতেই চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘ভাই, অন্য কেউ হলে বলতাম তার মৃত্যুদণ্ড সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু তোমায় মিথ্যা বলব না। ভীমার বিষয়ে কোনো কথা বলার অনুমতি আমার নেই।’
—হুমম। তো?
—আচার্য, সমগ্র আর্যাবর্তর সম্রাটকে অনুমতি দেয়ার মতো একজনই ব্যক্তি এই মাটিতে আছে। এইটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আমার আছে। আপনাকেই তাই সরাসরি জিজ্ঞাসা করছি, ভীমার কী হল?
গম্ভীর মুখে চাণক্য উত্তর দিলেন,
—একটা দেশ শাসন করতে দু-ধরনের নীতির প্রয়োজন হয়। সাধারণ নীতি, যা সবার সামনে বলা হয়। আর দ্বিতীয় হল গুপ্তনীতি। দ্বিতীয় নীতিগুলোর কথা মুষ্টিমেয় ব্যক্তি জানে। কারণ সবসময় সেই নীতি সুখকর হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা অনৈতিক হয়ে থাকে। আমার আদেশে ভীমাকে জীবিত রাখা হয়েছে। তাকে এক গোপন জায়গায় প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তার বিকার, তার ক্রোধকে ঠিক উপায়ে ব্যবহার করলে আমাদের রাজ্য এক অসাধারণ হিংস্র অস্ত্র পাবে। গুপ্তহত্যার কাজে সে হবে অপরিহার্য। জীবসিদ্ধি অবাক দৃষ্টিতে তার আচার্যর দিকে চেয়ে রইল। আচার্য উত্তর দিলেন,
—অবাক হোয়ো না। মনে রেখো আমি শুধুই চাণক পুত্র চাণক্য নই। আমায় আরও একটা নামে সম্বোধন করা হয়ে থাকে, ‘কৌটিল্য’।
***
References:
1.Vishkanya : The Poisonous Celibate, prof (Dr) Veenus Jain, CASIRJ, Volume-৪, Issue-4, 2017.
2. What is Vishkanya, himalayavedicworld.com