১.
‘ওঁ জবাকুসুম সংকাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং।
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।।
নমঃ সূৰ্য্যায় নম।’
সূর্যপ্রণাম সেরে সবে নিজের কুটিরের দিকে এগিয়েছেন আচার্য বিষ্ণুগুপ্ত। পরনে সাদা গেরুয়া কাপড়, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে ত্রিবলি টিকা, ন্যাড়া মাথায় লম্বা টিকি এবং বুকের পইতে তাঁর ব্রাহ্মণত্বের পরিচয়। আর পাঁচজন ব্রাহ্মণের থেকে তাঁকে আলাদা করে তাঁর চোখ। চোখের তারায় তাঁর বুদ্ধির দীপ্তি বিদ্যুৎ খেলে যায়। অন্তরভেদী সেই দৃষ্টি থেকে যেন জগতের কোনো রহস্যই গোপন থাকতে পারে না। অতি সাধারণ দর্শন এই ব্রাহ্মণকে সামনে দেখলে কেউ অনুমানও করতে পারবে না যে এই ব্যক্তি স্বয়ং বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্ব। অনেকের মতে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি স্বয়ং সম্রাটের চেয়েও বেশি। দেখলেন একটু দূরে দু-জন ব্যক্তি সম্পূর্ণ সামরিক সাজে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে অসুবিধা হল না। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটি মগধ সেনাপতি কিথক। দ্বিতীয় ব্যক্তি যুবক এবং অপরিচিত।
—কী ব্যাপার সেনাপতি কিথক? এত ভোরে ঘুম ছেড়ে আমার দরজায় কেন?
ভক্তি ভরে ব্রাহ্মণকে প্রণাম করেন সেনাপতি এবং তাঁর সঙ্গী। সেনাপতি কিথক উত্তর দিলেন,
—আচার্য, এই ভোরে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আপনার পূজা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করছি। আপনি আপনার কাজ সেরে নিন। আমার সকালের পূজা শেষ হয়েছে, আর্য। আমার কুটিরে আসুন। আর আপনার সঙ্গীকে তো চিনলাম না।
—ধন্যবাদ, আচার্য। এ হল সুসেন। রক্ষীবাহিনীর নতুন আধিকারিক।
—হুম। বেশ, বেশ। তা এত সকালে আপনাদের আমার কাছে আসার কারণ?
—আচার্য, আপনি নিশ্চয়ই নগরের বুকে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলোর কথা শুনেছেন?? আপনার না জানার কথা নয়। কারণ এই পাটলিপুত্রের প্রতিটি মানুষ জানে যে মগধে একটা পায়রাও মহামান্য চাণক্যর অজ্ঞাতে ডানা ঝাপটায় না।
সেনাপতি এবং তাঁর সঙ্গীকে নিজের কুটিরের উঠোনে আসন গ্রহণ করতে বলে চাণক্য নিজেও মুখোমুখি একটা আসনে বসলেন।
—ওহে বীর কিথক, আপনি আমার ক্ষমতার একটু বেশিই অনুমান করে ফেলছেন। আমি এখন রাজকার্য থেকে সম্পূর্ণ অবসর নিয়ে আমার জীবনের সকল অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা লিখিত রূপে ‘অর্থ-শাস্ত্র’-তে একত্রিত করার কাজে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেছি। সম্রাট, রাজ্য সব আসে যায়, শুধু জ্ঞান চিরস্থায়ী হয়।
খানিক চুপ থেকে আবার চাণক্য বললেন,
—তবে, আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলি, হ্যাঁ, আমি রূপজীবী রমণীদের হত্যার ঘটনা শুনেছি। ইতিমধ্যে দু-জন রমণীকে রাতের অন্ধকারে হত্যা করেছে এক অজানা আততায়ী। সে-সংবাদ আমার কানে এসেছে।
এইবার সুসেন নামের যুবকটি বলল:
—আচার্য, কাল রাতে আরও একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
—সেকী! আবার? এত পাহারার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও??
কিথক উত্তর দিল,
—সেটাই আশ্চর্যের বিষয়, আচার্য। সেই কারণেই আপনার কাছে আসা। এইবারের ঘটনা ঘটেছে নগরের উত্তরে।
—হুম। আমি যদিও আগের দুটো ঘটনার কথা শুনেছি। তবু আপনার থেকে আরও একবার শুনতে চাই আগের দুটো হত্যার বিষয়ে আপনার তদন্তে কী কী তথ্য উঠে এসেছে।
—সুসেন বলুক। আমি এবং সুসেন, দু-জনেই এর তদন্তভার নিয়েছি। সুসেন গুছিয়ে বলুক প্রথম থেকে।
একটু গুছিয়ে নিয়ে সুসেন শুরু করে,
—প্রথম ঘটনাটা দু-মাস আগে ঘটে। সকালে জনৈক নাগরিক একজন নারীর রক্তাক্ত মৃতদেহ একটা কানাগলিতে পড়ে থাকতে দেখে। সে প্রহরীদের খবর দেয়। খবর পেয়ে আমি নিজেও গিয়েছিলাম। তলপেটে ছুরির আঘাতে মৃত্যু হয়েছে বোঝা যায়। কিন্তু ভয়ংকর হল নৃশংসতা। প্রথমে সেই দৃশ্য দেখে ভেবেছিলাম হয়তো কোনো শেয়ালের কাজ। পেটের ভেতরের অস্ত্রাদি বাইরে শরীরের পাশে ছড়িয়ে ছিল। আমি মৃতদেহ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা করলাম এবং সেই থেকেই জানতে পারি যে মৃতা রমণী একজন গণিকা। তার সঙ্গী অন্যান্য গণিকাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি যে আগের দিন রাতে একজন মুখ ঢাকা ব্যক্তি এই গণিকাকে নিজের ঘোড়ায় করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই অজানা ব্যক্তির মুখ তারা দেখেনি। এই অবধি ঘটনাটা আমার কাছে সাধারণ হত্যাই মনে হয়েছিল। কিন্তু বৈদ্য দেহ পরীক্ষা করে যখন জানালেন যে মৃত মেয়েটির শরীরে জরায় নেই,
হত্যাকারী হত্যার পরে তার শরীর থেকে জরায়ু ছিন্ন করেছে এবং সেটার আর খোঁজ মেলেনি, বিষয়টা খুব অদ্ভুত লেগেছিল আমার। সেনাপতিকে তখনই আমি ঘটনাটা জানাই। কিন্তু আমি ভাবিনি যে পরের মাসে, আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। দ্বিতীয়বারের মৃতা স্ত্রীলোকটিও একজন গণিকা। যদিও অন্য গণিকালয়ের। কিন্তু একই হত্যা পদ্ধতি আর এবারও জরায়ু নেই শরীরে। পাহারা বাড়ানো হয়েছে যতটা সম্ভব। সৈনিকরা রাতে টহল দিচ্ছে পথে পথে। তারপরেও আজ, খানিক আগেই দু-জন টহলদার প্রহরী আরও একটা মৃতদেহ আবিষ্কার করেছে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,
—হুমম। সম্রাট জানেন এই বিষয়ে?
—কাল রাতের ঘটনা তিনি জানেন না এখনও। কিন্তু তাঁকে বলেই-বা কী লাভ?? আপনি তো সবই বোঝেন, আচার্য। বেশ্যাদের জীবনের দাম কেউ দেয় না। সম্রাট বা ওঁর মন্ত্রীরা এই হত্যাগুলো নিয়ে সভার কোনো সময় ব্যয় করতেই রাজি নয়। সম্রাট নিজে কিছুটা আগ্রহ প্রকাশ করলেও, মন্ত্রীরা এইসব উড়িয়ে দেয়। আমি বহুবার দরবার করেও ফিরে এসেছি।
—হুমম। আচ্ছা, এবারও কি একইভাবে…?
—হ্যাঁ, আচার্য। পেটে ছুরি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই মৃতদেহতেও জরায়ু নেই। খুবই বীভৎস!
—হুমম। আগের দুটো মৃতদেহ আমি দেখেছি। চলুন, আর্য। আমিও যাই। দেখে আসি মৃতদেহ।
উঠে দাঁড়ালেন চাণক্য। তাঁর দেখাদেখি অন্য দু-জনও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিথক বললেন,
—আপনি স্বচক্ষে মৃতদেহ দেখতে চাইবেন অনুমান করেই আমি সঙ্গে আপনার জন্যে একটা ঘোড়া এনেছি।
—আপনি বিচক্ষণ সেনাপতি। ধন্যবাদ। একটু অপেক্ষা করুন।
চাণক্য কুটিরে ঢুকলেন এবং খানিক বাদেই কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে এলেন।
—চলুন। যাওয়া যাক।
২.
গলিপথের মুখে সাধারণ নাগরিকরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রহরীরা তাদের মূল ঘটনাস্থল থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করছে। তিনটে ঘোড়া এসে সেখানে থামল। তাদের দেখেই দু-জন সৈনিক ভিড় সরিয়ে জায়গা করে দিতে এগিয়ে গেল। সেনাপতি কিথক, সুসেন এবং চাণক্য ঘোড়া থেকে নামলেন। তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য লোকে জায়গা করে দিল। সৈনিকদের সঙ্গে তাঁরা দু-জন গলির দিকে এগিয়ে গেলেন।
অন্ধগলির শেষ মাথায় এক স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পড়ে আছে। চারিদিকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আড়াআড়িভাবে মেয়েটার পেট চেরা হয়েছে ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে। শরীরের অভ্যন্তরীণ কিছু অংশ বাইরে বেরিয়ে আছে। বোঝা যায় কেউ ক্ষতর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কিছু খুঁজেছে। ভেতরের অস্ত্রবাইরে বেরিয়ে আছে। খুব নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটার দেহে সস্তা গয়না আর রঙিন পোশাক। উগ্র সাজ চোখে পড়ে মেয়েটার মুখে ও শরীরে। অনুমান করা যায় এই মেয়েটাও একজন রূপোপজীবিনী।
চাণক্য মৃতদেহর সামনে ঝুঁকে পড়লেন। পরীক্ষা করতে লাগলেন মৃতদেহ। একবার মৃতদেহর একটা হাত নাড়িয়ে দেখলেন। উঠে দাঁড়িয়ে চাণক্য বললেন,
—মৃতার মুখের ওপর চাপ দেয়ার দাগ স্পষ্ট। আততায়ী তার মুখ চেপে ধরেছিল, যাতে চিৎকার না করতে পারে।
একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে আবার বললেন,
—এইখানে কারুর কিছু শুনতে বা দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হত্যা করার উপযুক্ত জায়গাই বটে। মৃতদেহ যতটা শক্ত হয়েছে আর রক্তপাতের পরিমাণ থেকে অনুমান করতে পারি রাত দ্বিতীয় প্রহর নাগাদ হত্যা করা হয়েছে। সাজপোশাক থেকে অনুমান করা যায়, আগের দুই অভাগিনীর মতোই এই মেয়েটিও গণিকা। কিন্তু সবকটা হত্যাকাণ্ডেই একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
কিথক প্রশ্ন করলেন,
—কী বিষয়, আচার্য?
—মৃতার শরীরে একনজরে কোনো বলপূর্বক আঘাতের চিহ্ন নেই এবং শরীরে পোশাক প্রায় নিখুঁত আছে। অর্থাৎ, অনুমান করা যায় এই রমণীনিটিকেও ধর্ষণ করা হয়নি। আগের দুটো ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার লক্ষ করা গেছে। বৈদ্য নিশ্চিতভাবেই জানিয়েছে যে মৃত্যুর আগে, মৃতাদের সঙ্গে কোনোরকম শারীরিক সঙ্গম করা হয়নি। তাই নয় কি?
—হ্যাঁ। আগের হত্যাগুলোর ক্ষেত্রেও এই জিনিস লক্ষ করেছি আমি। এক্ষেত্রেও তাই মনে হচ্ছে।
—এইটা কিন্তু সত্যিই একটা জরুরি বিষয়।
—কেন আচার্য?
প্রশ্নটা সুসেন করল। চাণক্য মৃতদেহর থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিলেন,
—এটা থেকে হত্যাকারীর মনস্তত্ত্বর একটা দিক উঠে আসে। এর অর্থ, হত্যাকারী শুধুমাত্র হত্যা করতেই এই মেয়েদের নিয়ে আসে। সাধারণ অপরাধীর মনস্তত্ত্ব কিন্তু তা হয় না। সাধারণত এরকম অপরাধের ক্ষেত্রে এটাই লক্ষ করা যায় যে, কোনো নারীকে হত্যার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়ে থাকে। এখানে আমরা তার ব্যতিক্রম দেখেছি।
—এর কারণ কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়, আচার্য?
একটু চিন্তিতভাবে চাণক্য বললেন,
—হত্যাকারী পুরুষটি কোনো মানসিক কারণে এটা করে না। কী সে কারণ তা আমার জানা নেই। হয়তো সে অক্ষম। অথবা…
—অথবা?
—অথবা সে একজন নারী।
চমকে ওঠেন সুসেন ও কিথক। কিথক অবিশ্বাসের সুরে বলেন,
—এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড একজন নারীর পক্ষে ঘটানো সম্ভব, আচার্য? আমার কিন্তু মনে হয় না।
—নারীদের পক্ষে কী কী সম্ভব তা স্বয়ং বিষ্ণুও অনুমান করতে পারে না, আর্য। তদন্তর ক্ষেত্রে সব ধরনের সম্ভাবনার কথা ভেবে এগোনোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে এটাও সত্যি যে নারীদের অস্ত্র হল ‘বিষ’। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া নারীরা রক্তাক্ত পদ্ধতি সাধারণত বেছে নেয় না।
—এর থেকে আপনি কি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন, আচার্য?
—না। কিছুই না। তবে সবচেয়ে কাছের গণিকাপল্লিতে খবর দিন। সম্ভবত মেয়েটা সেখানকারই বাসিন্দা। তাদের মধ্যে কেউ এসে শনাক্ত করতে পারবে আশা রাখি।
কিথক বললেন,
—আগেই খবর পাঠানো হয়েছে, আচার্য। আমিও অনুমান করেছিলাম যে সম্ভবত কাছের গণিকালয়েরই গণিকা। তাই সৈনিক পাঠিয়েছি, সেখান থেকে কয়েকজনকে এখানে নিয়ে আসবে।
—হুম। বেশ।
—কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যান, আচার্য। সৈনিকরা চলেই আসবে এখুনি।
.
বাক্য শেষ করতে-না-করতেই কিথকের কথার সত্যতা প্রমাণিত হল দু-জন সৈনিকের ভিড় সরিয়ে তিন জন নারী এগিয়ে আসার পথ করছে দেখা গেল। তিন জন দ্রুত এগিয়ে আসছিল, কিন্তু মৃতদেহর দিকে নজর পড়তেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। তাদের মধ্যে একজন আতঙ্কে চোখ ঢাকল আর দ্বিতীজন সেই রক্তাক্ত, বীভৎস দৃশ্য সইতে না পেরে বমি করতে শুরু করল। তৃতীয়জন শুধু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল মৃতদেহর দিকে। তাদের কিছুক্ষণ সামলে নেয়ার সময় দিয়ে, সুসেন এগিয়ে গেল তাদের দিকে। মৃতদেহ থেকে খানিক দূরে নিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল,
—মৃতা কি তোমাদের পরিচিত?
তৃতীয় মেয়েটি উত্তর দিল,
—হ্যাঁ।
—নাম? কৃতিকা।
—কাল শেষ কখন দেখেছিলে তাকে? মনে আছে?
—আমিই শেষ দেখেছিলাম। কাল রাতে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম রাস্তার ধারে। একজন ঘোড়সওয়ার আসে আর ওকে সঙ্গে নিয়ে যায়।
—ঘোড়সওয়ার? তাকে দেখেছ?
—না, মহাশয়। তার মুখ ঢাকা ছিল। গায়েও কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিল।
—ঘোড়ার রং কী ছিল? দেখেছিলে নিশ্চয়ই?
—এইবারের প্রশ্নটা চাণক্য করলেন। উত্তর এল,
—হ্যাঁ, ব্রাহ্মণদেব। কালো ঘোড়া ছিল।
—অশ্বারোহীর উচ্চতা বা দেহের গঠন কিছু দেখেছিলে?
বলিষ্ঠ চেহারা। ঘোড়া থেকে সে নামেনি। তাই উচ্চতা ঠিক বলতে পারি না। গভীর কুয়াশার কারণে কোনো কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না কাল রাতে।
—হুমম।
সুসেন এবং কিথক আরও কিছু প্রশ্ন করল তিন জনকেই। তবে বিশেষ কোনো নতুন তথ্য পাওয়া গেল না। তাদের বিদায় দিয়ে চাণক্যর দিকে ফিরলেন কিথক।
—আচার্য, আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?
খানিক ভেবে চাণক্য বললেন,
—তিনটে হত্যা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। তিন ক্ষেত্রেই মৃতা একজন নারী এবং গণিকা। একইভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং এই ক্ষেত্রেও সম্ভবত জরায়ু কেটে বের করে নেয়া হয়েছে। এর বিহিত হওয়া দরকার। পাহারা ব্যবস্থা দ্বিগুণ করুন। আপনি নিজে এই বিষয়টা দেখুন, সেনাপতি কিথক।
—যথা আজ্ঞা, আচার্য। আপনার কী অভিমত? এই তিনটে হত্যা একই ব্যক্তি করেছে?
—তাই তো অনুমান, সেনাপতি।
—আমারও তাই মনে হয়। সম্ভবত কোনো উন্মাদ হত্যাকারী।
—হুম। অথবা কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য নিয়ে চলা ব্যক্তি। সবই সম্ভব। এই তিন মৃতা গণিকার বিষয়ে সমস্ত খবর আমার চাই। আমি এই বিষয়টা দেখছি। ইতিমধ্যে আপনি এই মেয়েটার মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করুন।
কিছুক্ষণ থেমে মৃতদেহর প্রতি করজোড়ে প্রার্থনা করলেন চাণক্য। বললেন,
—জীবদ্দশায় মানুষ যেভাবেই জীবন নির্বাহ করে থাকুক না কেন, মৃত্যুতে সব মানুষ সমান হয়ে যায়। তাই সেনাপতি, আপনি খেয়াল রাখবেন যেন মৃতর প্রতি কোনোরকম অসম্মান দেখানো না হয়।
৩.
নিজের কুটিরে বসে লেখালেখিতে ব্যস্ত ছিলেন চাণক্য। এমন সময় কুটিরের বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ পেলেন। আর তারপরেই অতি পরিচিত কণ্ঠের ডাক ভেসে এল,
—আচার্য।
—এসো হে, জীবসিদ্ধি।
শিষ্যর গলা শুনে তিনি মনে মনে প্রসন্ন হলেন। তিনি অনুমান করেছিলেন আজ জীবসিদ্ধি নির্ধারিত সময়ের আগেই আসবে। জীবসিদ্ধিকে তিনি সেই সময় থেকে চেনেন, যখন তিনি তক্ষশিলার আচার্য ছিলেন। ওঁর প্রিয় ছয় ছাত্রর মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত ও জীবসিদ্ধি অন্যতম। চন্দ্রগুপ্তকে সিংহাসনে বসিয়ে চাণক্য কিছুকাল নিজে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন ছিলেন। এরপর সাম্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা হলে তিনি অন্যান্য মন্ত্রী ও অমাত্যদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে রাজকার্য থেকে অবসর নেন। রাজমহল ছেড়ে অদূরেই এক নিরিবিলি জায়গায় কুটির বানিয়ে বসবাস শুরু করেন। বাকি শিষ্যরা বিভিন্ন প্রদেশে আলাদা আলাদা দায়িত্বে বহাল হলেও, জীবসিদ্ধি চাণক্যর থেকে দূরে যেতে রাজি হল না। অবসর জীবনে এই শিষ্যই তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়েছে। তাতে সম্ভবত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তরও কিছুটা ইন্ধন ছিল। তাঁরা কেউই চাননি তাঁদের গুরু একলা নীরবে জীবনযাপন করুন। জীবসিদ্ধি রোজই একবার অন্তত আসে কারণে-অকারণে। গুরুদেবের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে আসার দায়িত্ব সে-ই পালন করে স্ব-ইচ্ছায়।
ভেতরে ঢুকতেই চাণক্য বললেন,
—জানতাম আজ তুমি আসবেই। সন্ধ্যার আগেই আসবে। ধারণা করতে পারি যে সেনাপতি কিথক যে আমার কাছে সকালে এসেছিল সে-সংবাদ তোমার কানে পৌঁছে গেছে ইতিমধ্যে? পুরোনো প্রবৃত্তি এখনও ছাড়তে পারলে না দেখছি।
চাণক্যর কৌতুকের ইঙ্গিত জীবসিদ্ধির অতীতের জীবন। নন্দ সাম্রাজ্যকালে জীবসিদ্ধি ছিল এই পাটলিপুত্রে চাণক্যর গুপ্তচর। শত্রুশিবিরের হৃদয় থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে গুরুর কাছে পাচার করত সে। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার খবর সে রাখত সেই থেকেই। তাই গুরুর মৃদু কৌতুকের উত্তরে জীবসিদ্ধি হেসে উত্তর দিল,
—সেনাপতি কিথকের সঙ্গে একটু আগেই আমার দেখা হয়েছে। তিনিই বলেছেন।
—হুমম।
আসন গ্রহণ করল জীবসিদ্ধি। কাঁধ থেকে কাপড়ের ঝোলা নামিয়ে সেটা থেকে নতুন দোয়াতের কালি বের করে চাণক্যর চারপায়ার ওপর নামিয়ে রাখল। প্রসন্ন মনে চাণক্য বললেন,
—বেশ, বেশ। ভুলে যাওনি তবে। আজ এটা না পেলে কাল সকালে আর লেখা হত না।
জীবসিদ্ধি ঝোলা থেকে তালপাতায় মোড়া একটা বড়ো জিনিস বের করল। সেটা খুলে এগিয়ে দিল চাণক্যর দিকে। গুড়। মিষ্টি খাবারদাবারের প্রতি তার গুরুদেবের আকর্ষণের কথা তার অজানা নয়।
দ্বিগুণ প্রসন্ন হয়ে এক টুকরো গুড় তুলে নিজের মুখে ফেলে, চাণক্য প্ৰশ্ন করলেন,
—চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে দেখা হল?
চমকে উঠে জীবসিদ্ধি উত্তর দিল,
—হ্যাঁ। গিয়েছিলাম।
—কী খবর ওদিকে?
—সম্রাট ব্যস্ত ছিলেন। বেশি কথা হয়নি। কোনো এক গুপ্তচর, রাজ্যের গোপন তথ্য নাকি শত্রুদের পাঠাচ্ছে। তাকে ধরার নাকি কিছু সূত্র পাওয়া গেছে। তাই নিয়েই মন্ত্রী-অমাত্যরা সম্রাটের সঙ্গে গভীর আলোচনায় লিপ্ত ছিলেন।
—হুমম।
—আপনি বলুন। এই পর পর হত্যাকাণ্ডর বিষয়ে কী ভাবলেন?
—সবে তো ভাবনা শুরু করলাম হে। বরং এই বিষয়ে তোমার ধারণাগুলো একটু শুনি।
—আমি নিশ্চিত এগুলো একই লোকের কাজ। পাটলিপুত্রর রাতের রাস্তায় কোনো এক অজানা উন্মাদ হত্যাকারী ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা ভাবলেই অস্বস্তি হয়, আচার্য।
—হুমম। কাল রাতে আরও এক গণিকাকে হত্যা করা হয়েছে তা নিশ্চয়ই শুনেছ?
—সারা পাটলিপুত্র জানে। তবে সাধারণ গণিকাদের হত্যা করা হচ্ছে বলে কেউই বিশেষ ভাবিত নয়।
—সেটাই সমস্যা। হত্যার পদ্ধতিটা এতটা নৃশংস না হলে সম্ভবত কেউ জানতেই পারত না। সৈনিকরাও মাথা ঘামাত না। কিন্তু হত্যা করে, পেট কেটে কারুর জরায়ু বের করে নেয়া হয়েছে বলে এটা চিন্তার বিষয়।
—ওহো। বলতে ভুলে গেছি। সেনাপতি কিথক জানালেন যে গতকালের হত্যার ক্ষেত্রেও একইভাবে জরায়ু বের করে নেয়া হয়েছে। মৃতদেহ পরীক্ষা করে বৈদ্য সেটা নিশ্চিত করেছে।
—হুমম।
—আচার্য? এরপর কি আরও হত্যা হবে? আপনার কী মনে হয়?
—হত্যাকারী ধরা না পড়া অবধি সে থামবে না, জীবসিদ্ধি। তাকে আটকাতেই হবে। হতে পারে হত্যাগুলো যতটা যথেচ্ছ ও লক্ষ্যহীন মনে হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে, হয়তো বাস্তবে তা নয়। এই মৃতা তিন জনের মধ্যে কোনো অদৃশ্য যোগসূত্র থাকতে পারে। সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
চুপ করে খানিক ভাবলেন চাণক্য। বললেন,
—এই তিন জন মৃতা গণিকাদের সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য আমায় এনে দাও, জীবসিদ্ধি। সেনাপতি কিথক বা নবীন ন্যায়রক্ষী অধ্যক্ষ সুসেনের সাহায্যে তা জোগাড় করো।
—কী ধরনের তথ্য আপনি চাইছেন, আচার্য?
—কোন কোন গণিকালয়ে তাদের আসা-যাওয়া ছিল। গত তিন মাসে তাদের গতিবিধি এবং সবচেয়ে জরুরি তথ্য, তাদের সাম্প্রতিক পুরুষ সঙ্গীদের নাম। এদের মধ্যে কোনো একজন বিশেষ পুরুষের নাম যদি থাকে, তবে সেটাই হবে এই রহস্যর প্রথম সূত্র।
—বেশ, আচার্য। আমি এই তথ্য এনে দেব আপনাকে। আমায় কয়েক দিন সময় দিন।
আর একটা গুড়ের টুকরো মুখে দিয়ে চাণক্য বললেন,
—হুমম।
৪.
সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর রাজসভা। সিংহাসনে আসীন স্বয়ং সম্রাট। অমাত্য পরিষদের সঙ্গে ওঁর বিশেষ জরুরি বৈঠক চলছে। তখনই একজন প্রহরী ঢুকে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল সম্রাটকে। চন্দ্রগুপ্তর নির্দেশ ছিল যেন জরুরি বৈঠকের মাঝে কেউ তাঁদের বিরক্ত না করে। তারপরেও এই প্রহরী প্রবেশ করায় সম্রাট খানিক অসন্তুষ্ট হলেন। তাঁর অসন্তোষ টের পেয়েই, সম্রাটের ক্ষোভ থেকে রক্ষা পেতে সৈনিক দ্রুত বলল,
—ক্ষমা করবেন, সম্রাট। আচার্য চাণক্য আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। তাই আসতেই হল। আমি দুঃখিত।
—আহ! তা ওঁকে বাইরে কেন অপেক্ষা করিয়ে রেখেছ? বলেছি না, আচার্য যখনই আসবেন তখনই যেন তাঁকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়? আমার আদেশের অপেক্ষা করবে না।
—ক্ষমা করবেন, সম্রাট।
প্রহরী সভা ত্যাগ করার কয়েক মুহূর্ত পরেই সব আওয়াজ ছাপিয়ে বাইরে থেকে খড়মের আওয়াজ শোনা গেল। সভায় প্রবেশ করলেন চাণক্য। তাঁর পেছনে একটু দূরত্বে জীবসিদ্ধি। আচার্যকে দেখেই সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এবং অন্যান্য সভাসদরা নিজের নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। চাণক্য এগিয়ে এসে সভাঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশে অভিবাদন জানালেন এবং তারপর চন্দ্রগুপ্তর দিকে চেয়ে বললেন,
—সম্রাট। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
সম্রাট হাত তুলে নির্দেশ দিলেন- ‘একান্ত!’
সম্রাটের নির্দেশ পেতেই সভা ছেড়ে অমাত্যরা একে একে বেরিয়ে গেল। চাণক্য অপেক্ষা করলেন যতক্ষণ না সভাকক্ষে তিন জন মাত্র অবশিষ্ট রইল। চন্দ্রগুপ্ত, জীবসিদ্ধি এবং তিনি স্বয়ং। দরবার খালি হতে চন্দ্রগুপ্ত নিজের সিংহাসন বেদি ছেড়ে নেমে এলেন। প্রথমেই নিজের গুরুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। চাণক্য আশীর্বাদী মুদ্রায় বললেন,
—উৎকৃষ্ট ভারতম্। সদা সুমতি ভবঃ।
গুরুর আশীর্বাদ পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চন্দ্রগুপ্ত জীবসিদ্ধিকে আলিঙ্গন করল। জনসমক্ষে তারা রাজা এবং সাধারণ প্রজা হলেও, একান্তে তারা আজও গুরুভ্রাতা। তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা দু-জনেই চাণক্যর আশ্রমের সহপাঠী ছিল একসময়। তারা পরম সুহৃদ এবং আজও চাণক্যর দেয়া বিশেষ বালা বাহুতে ধারণ করে আছে। এই বালা তাদের গুরুভ্রাতা হওয়ার চিহ্ন যা শুধুমাত্র চাণক্যর বিশেষ ছাত্রদের কাছে আছে। এটা তাদের গৌরবের চিহ্ন।
চন্দ্রগুপ্ত নিজের গুরুর দিকে ফিরে মৃদু হেসে বললেন,
—গুরুদেব আপনার সঙ্গে অনেকদিন দেখা করার সুযোগ হয়নি বলে আমি জানি আপনি মনঃক্ষুণ্ণ। কিন্তু গত এক মাস ধরে, রাজ্যপাটের এমন একটা সমস্যা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে আছি যে…
কথার মাঝেই বাধা দিয়ে চাণক্য বললেন,
—আমি মোটেই ক্ষুণ্ন নই, চন্দ্রগুপ্ত। ধন্য সেই রাজ্য আর তার প্রজা, যাদের রাজা ব্যক্তিগত কাজ এবং বিশ্রামকে উপেক্ষা করে দেশের কাজকে প্রাধান্য দেয়। রাজ্যপাটই তোমার প্রথম এবং প্রধান ধর্ম, সম্রাট।
—ধন্যবাদ, আচার্য। তবে আপনি কোন বিষয় নিয়ে ক্ষুণ্ণ তা অনুমান করতে পারি। আমি জানি আজকে আপনার এখানে আসার কারণ কী। আপনি রাজধানীতে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে চিন্তিত।
—হুম। ঠিক অনুমান করেছ। আমি জানতে চাই যে তুমি এই বিষয়ে কী ভেবেছ? কেন সভায় এই নিয়ে কোনোরকম আলোচনা গত কয়েক মাস ধরে হয়নি?
—আচার্য, বিশ্বাস করুন, আমি নিজেও যথেষ্ট ভাবিত এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু গত কয়েক মাস একটা গভীর সমস্যা নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। আমার অমাত্যরাও সেদিকেই পুরো মনোযোগ দিয়েছে। আগের দিন ভাই জীবসিদ্ধিকে তো জানিয়েছিলাম। আপনাকে নিশ্চয় সেই কথা ভাই জানিয়েছে।
—হুমম। গুপ্তচরের বিষয়টা আমি জানি
—হ্যাঁ, আচার্য। আমাদের সামরিক কিছু গূঢ় তথ্য শত্রু দেশের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু তা কীভাবে অথবা কার দ্বারা পাচার হচ্ছে তা আমরা এখনও নিশ্চিত নই। কিন্তু সন্দেহ করা যায় যে আমাদের উচ্চ পদের কোনো মন্ত্রী বা আধিকারিক গুপ্তচরবৃত্তিতে লিপ্ত।
—হুমম। সমস্যা গম্ভীর। কিন্তু সম্রাট, তুমি কি সব প্রজার রাজা নও?? একজন আদর্শ সম্রাট অনেকটা তার প্রজাদের বাবার মতো। বাবা কখনো নিজের সন্তানদের মধ্যে প্রভেদ করে না, চন্দ্রগুপ্ত। গণিকাপল্লির সেই রমণীরাও কিন্তু তোমারই প্রজা। তাদের সুরক্ষার ভারও তোমারই।
—আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত, আচার্য। আমি সেই কারণেই রাতের পাহারা দ্বিগুণ করে দিয়েছি। পাটলিপুত্রর সমস্ত গণিকার বাড়িতে আমি সৈনিক পাঠিয়ে তাদের নির্দেশ দিয়েছি যে রাতের প্রথম প্রহরের পরে কেউ যেন নিজের বাড়ি ছেড়ে পথে না বের হয়। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। স্বয়ং সেনাপতি কিথককে আমি এই তদন্ত ভার দিয়েছি। নিজের কাজে সে যথেষ্ট দায়িত্বশীল। আমি তাকে নির্দেশ দিয়েছি যে সে যেন নিজে রাতপাহারার এলাকাভিত্তিক প্রহরীদের তালিকা বানায়। পুরো নগরীতে একইসঙ্গে সব জায়গায় প্রহরী দেয়া সম্ভব না হলেও, প্রহরবিশেষে, এলাকা ভাগ ভাগ করে পাহারার ব্যবস্থা করেছে সেনাপতি ইতিমধ্যেই। আমি নিজের তরফে চেষ্টার ত্রুটি করছি না, গুরুদেব।
অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে চন্দ্রগুপ্তর চোখে চোখ রাখলেন চাণক্য। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সম্রাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
—আপনি বিচক্ষণ, আচার্য। সাধারণ মানুষ আর অমাত্যদের মনোভাব আপনার অজানা নয়। অতএব আশা করি আমার সমস্যাটা আপনি অনুমান করতেই পারছেন। বেশ্যাদের প্রতি আমাদের সমাজের মনোভাব মোটেই সুখকর নয়। আমার মন্ত্রীরা বেশ্যা সম্পর্কিত কোনো কিছুতে থাকতে নারাজ। তারা মনে করে পতিতাদের জীবনের কোনো দামই নেই। তারা পাপী, পাপের সাজা পাচ্ছে। এদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করাটা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। আমি তাই নিজের মতো তদন্ত চালাতে বলেছি। কিন্তু আমি নিজেও এই তথ্য পাচারের সমস্যাটার কারণে, এইদিকে মনোযোগ দিতে পারছি না।
—হুমম। বুঝেছি। প্রদীপের তলাতেই সবচেয়ে বেশি অন্ধকার থাকে। তোমার যে চরিত্রবান অমাত্যরা রূপজীবী নারীদের পাপী বলে, রাতের অন্ধকারে তারাই কিন্তু এদের কেনে।
—সবই বুঝি, আচার্য। আমি এর বিহিত করবই। কিন্তু আমায় কিছুটা সময় দিন। এই গুপ্তচরের বিষয়ে একটা সূত্র হাতে এসেছে। আমি আশা করছি এই সূত্র ধরে দ্রুত সেই তথ্য পাচারকারী ধরা পড়বে। তারপরেই আমি এই হত্যাকাণ্ডর তদন্তে মনোযোগ দেব।
অসম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন চাণক্য। বললেন,
—ততদিন সময় নেই, সম্রাট। ততদিনে আরও হত্যা হবে। ইতিমধ্যেই তিন তিনটে হত্যা হয়ে গেছে। পাটলিপুত্রে আজকাল রাতে সাধারণ মানুষও বেরোতে ভয় পেতে শুরু করেছে। তাদের মনে আতঙ্ক ঢুকছে। রাজধানীতেই যদি মানুষ সুরক্ষিত বোধ না করে তবে যে তারা সাম্রাজ্যের ন্যায় রক্ষা ব্যবস্থার ওপর ক্রমে আস্থা হারাবে। তা আমি হতে দিতে পারি না।
জীবসিদ্ধি এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল। এইবার বলল :
—কিন্তু আচার্য, চন্দ্রগুপ্তর কথাও ঠিক। তার হাতের সমস্যাটার দ্রুত সমাধান হওয়াটাও জরুরি। রাজধানী থেকে গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়াটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমার-আপনার চেয়ে ভালো কেই-বা জানবে।
—হুমম।
একটু চিন্তিত মনে হল চাণক্যকে। কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
—বেশ। তবে গোপন তথ্য ফাঁসের বিষয়টা তুমি তোমার মতো করে সমাধান কোরে।। আর এই হত্যাকাণ্ডর বিষয়টা আমি দেখছি। এই ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডর সমাধান করতেই হবে আমায়।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত আচার্য চাণক্যকে প্রণাম করে বললেন,
—তাই হোক, আচার্য।