।। ৫।।
চুপ করে শুয়ে থাকুন, সহযাত্রী বা বন্ধু ভাবতে দোষ কোথায়?
এই ঢাকাটা ভালো করে জড়িয়ে নিন। সম্ভবত এসিতে ঠাণ্ডা লেগেছে আপনার। ঘড়িতে এখন সবে রাত দুটো, অনেক রাত বাকি। একটু কষ্ট করে উঠুন, এই ওষুধটা খেয়ে নিন। আপনার গায়ে বেশ জ্বর।
দেবলীনা নিজের শুকনো তপ্ত ঠোঁট দুটো জিভ দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করে বললো, কি করে বুঝলেন আমার জ্বর এসেছে?
দিগন্ত ওর নিজস্ব ঢঙে বললো, ভুলভাল বকছিলেন ঘুমের ঘোরে, আর উঁহু, উঁহু আওয়াজ করে আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে আমার সোনা বেবীর কথা না শুনেই আপনার কপালে হাত ঠেকালাম, তখনই মনে হলো, যা গরম একটা সিগারেট ধরানো হয়ে যাবে।
শুনুন, এত বকবক না করে, আর আপনার ওই প্রাক্তন সৃজনকে ঘুমের ঘোরে না ডেকে, আপাতত ওষুধটা খেয়ে নিন। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আপনাকে নামিয়ে নিয়ে যাবো না। আমার পুচু যদি জানতে পারে, আমি আপনার সাথে এত রাতে গল্প করছি, তাহলে নিজের ব্রেকআপ তো নিশ্চিন্ত করেইছেন, আমারটাও অবধারিত হবে। তাই প্লিজ, মেডিসিনের কম্বিনেশনটা দেখে নিয়ে, দয়া করে খেয়ে ফেলুন।
মোবাইলের আলোয় দেবলীনা দেখলো, প্যারাসিটামল ৬০০-এর একটা ট্যাবলেট আর জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ অপরিচিত দিগন্ত নামের ছেলেটা।
মা, বাবা বারবার বলেছিল, ট্রেনে কেউ কিছু দিলে একদম খাবি না। আজকাল যা হচ্ছে!
দেবলীনার তপ্ত শরীর, শুকিয়ে আসা গলা আর ভেঙে যাওয়া মন এত যুক্তি তর্কের তোয়াক্কা না করেই হাতটা বাড়িয়ে দিল দিগন্তর দিকে, ফিসফিস করে বললো, আপনাদের ডিস্টার্ব করার জন্য সরি।
দিগন্ত মুচকি হেসে বললো, আরে ধুর মশাই, আমার পিসিমণির নাক ডাকার চোটে আমি প্রায় জেগেই ছিলাম। সঙ্গে যোগ হলো আপনার, ”সৃজন মুক্তি দিলাম তোমায়” টাইপের বাংলা সিরিয়ালের ডায়লগ। দুটো মিলিয়ে নিশ্চিত হলাম, আজ রাতে ধুম হবে ভারী, নিয়ে এসো কারণবারী। ধুর ধুর, ট্রেনে একটা সিগারেট খেতে পারছি না, কারণবারী তো কোন ছাড়।
দেবলীনা বললো, আপনি মদ খান?
দিগন্ত ওষুধ খাইয়ে জলের ঢাকাটা আটকে বললো, মাঝে মাঝে খাই, তবে খুব অল্প। আপনি হয়তো পাড়ার মনসা পুজোর মাতালদের মত ”মদ খান” টাইপের কোশ্চেন করলেন। তবে আমার উত্তর হলো, খাই তবে সেটা ভীষণ রকমের পরিমিত।
যাইহোক, আপনি এখন ঢাকাটা চাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমি কাল সকালে আমার পুচুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব, পরনারীর কপাল স্পর্শ করার জন্য। তবে কি বলুন তো, আমার পুচু সোনা কিন্তু অবুঝ নয়, অসুস্থ রোগী হলে সব দোষ স্খলন হয়ে যায়।
দেবলীনা ক্লান্ত জ্বোরো গলায় বলল, কাল আপনার পুচু সোনার গল্প শুনবো।
দিগন্ত একটু হেসে বললো, নিশ্চয়ই।
দিগন্তর দেওয়া মোটা উলের চাদরটা মাথা পর্যন্ত মুড়ি দিয়েও কাঁপছিল দেবলীনা। জ্বরটা বেশ ভালোই এসেছে ওর। কেন জ্বর এলো, ঠাণ্ডা তো তেমন লাগেনি, তাহলে বোধহয় অতিরিক্ত মানসিক প্রেশারেই এর আগমন ঘটেছে। একটু দুর্বলও লাগছে, গলাটা বেশ শুকিয়ে গেছে। ফিসফিস করে বললো, জল, নিজের মাথার কাছে হাতড়ে জলের বোতলটাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই দিগন্ত ওর সিট থেকেই বললো, জল খাবেন? দাঁড়ান দিচ্ছি।
মিডিল সিট থেকে নেমে এসে ওর হাতে জলের বোতলটা দিয়ে বললো, মাথাটা একটু তুলে খান, গলায় লেগে যাবে।
জলের বোতলটা দেবলীনার হাত থেকে নিয়ে বললো, একবার মাথায় হাত দিয়ে দেখবো, একটুও কমেছে কিনা? না হলে অন্য ওষুধ ট্রাই করতে হবে।
দেবলীনা নীরবে ঘাড় নাড়াতেই একটা শীতল হাত এসে স্পর্শ করলো ওর চুলে ঢাকা কপাল। চুলগুলোকে খুব শান্ত ভঙ্গিমায় সরিয়ে দিয়ে কপালের উষ্ণতা পরখ করে দিগন্ত বললো, এখনও পুরো কমেনি। তবে আগের মত অতটাও নেই, বুঝলেন?
দেবলীনা ক্লান্ত হেসে বললো, সিগারেট ধরানো যাবে না এখন, তাই তো?
দিগন্ত মুচকি হেসে বললো, এবারে একটু শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল একটা দারুণ সকাল অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। যে চলে যেতে চায়, তাকে জোর করে ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা যেমন করেন নি, তেমনই মন থেকেও তাকে সরিয়ে দিন একটু একটু করে। নিজের থেকে বেশি মূল্য কাউকে কখনো দেবেন না, তাহলেই দগ্ধ হবেন আজীবন। সবটুকু দিয়ে নিজেকে ভালোবাসুন, দেখবেন সুখ আর আনন্দ আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছেই না।
দেবলীনার জ্বোরো লালচে চোখ থেকে দুবিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে চিবুকে। নোনতা জলের বিন্দুদুটোর যেন কোনো তাড়া নেই, কষ্টগুলোকে শুষে নিয়ে ধীরে ধীরে নামছিল চিবুকের দিকে। আধোঅন্ধকারে সেদিকে তাকিয়ে দিগন্ত বললো, ওই বিন্দুদুটোকে আরেকটু সময় দিন, ওকে বলুন, স্মৃতি মুক্ত করুক আপনাকে।
দেবলীনা বললো, যান ঘুমিয়ে পড়ুন, আমি ভোরের নতুন সূর্য ঠিক দেখবো। ততক্ষণে অন্ধকার শুষে নেবে আমার দৃষ্টিপথ রোধ করা স্মৃতিগুলোকে।
দিগন্ত চলে গেল ওর সিটে। যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলে গেল, এত কি ভাবছেন বলুন তো, ঘুমিয়ে পড়ুন।
এত কি ভাবছেন বলুন তো, একবার তো বললাম আপনাকে আমরা মডেলকে এই পরিমাণ টাকাই প্রোভাইড করে থাকি। আপনার ক্ষেত্রে এক্সট্রা দিই নি। আমি তো ভাবলাম, আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরবেন বলে আপনি আজ এই ”নিরিবিলিতে” এলেন। যদিও এত লোকজন ভর্তি ক্যাফের নাম যে কেন ”নিরিবিলি” রেখেছেন মালিক সেটা উনিই বলতে পারবেন। সৃজনের বলার ধরনে একটু হেসে দেবলীনা বলেছিল, তাই বলে কয়েক ঘন্টার জন্য এতগুলো টাকা আমি নিতে পারবো না। চেকটা রিটার্ন করুন।
সৃজন অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিল, আমায় একটা চিমটি কাটবেন? আমি বুঝতে চাইছি আমি এখনো স্বজ্ঞানে মনুষ্য সমাজে বাস করছি কিনা!
গোটা পৃথিবী টাকার পিছনে ছুটছে, আর আপনি এসেছেন টাকা ফেরত দিতে? প্রবাদ আছে, সুন্দরী আর বুদ্ধিমত্তার নাকি দারুণ ঝগড়া, এদের কোথাও সহাবস্থান হয়না, কথাটা কি সত্যি?
মানে, কি মনে হয় আপনার?
সৃজনের কথা শুনে হেসে ফেলেছিলো দেবলীনা। বলেছিল, সে আপনি যাই বলুন, ওই সামান্য মডেলিংয়ের জন্য আমি এত টাকা নিতে পারবো না। আমি সুন্দরীও নই, বুদ্ধিমতীও নই।
সৃজন কফিতে চুমুক দিয়ে বলেছিল, এমন মিথ্যে তো আপনার শত্রুও বলতে পারবে না। আপনি সুন্দরী নন?
তাহলে তার সংজ্ঞা কি ম্যাডাম? এমন চকিত হরিণ নয়ন, গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট, দৃঢ় চিবুক, মরাল গ্রীবা একেও সুন্দরী বলবো না। আপনার মত কাউকে দেখেই স্বয়ং কালিদাসও কাব্য রচনা করেছিলেন। যদিও বাংলা আমার তেমন স্ট্রং নয়, তবুও পড়েছি মন দিয়েই।
দেবলীনা ছটফট করে উঠে বলেছিল, তাহলে চেকটা আমি কি করবো?
সৃজন বললো, এখনো জমা দেন নি? তাহলে হয়তো এক্সপায়ার করে গেছে। আমায় নতুন চেক করে দিতে হবে।
দেবলীনা বলেছিল, তাহলে প্লিজ অ্যামাউন্টটা কম করে লিখবেন।
সৃজন কথা না বলে, নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, বিজনেস ম্যানের ছেলে, তাই ডিল ছাড়া কাজ করি না। এই অর্বাচীনের বন্ধুত্ব স্বীকার করুন, তবেই মানবো আপনার কথা।
দেবলীনা আলতো করে ধরেছিল সৃজনের হাতটা, নরম গলায় বলেছিল, বেশ বন্ধু হলাম।
সৃজন ওয়েটারকে ডেকে বলেছিল, এতটুকু নিরিবিলি তো নেই আপনাদের ”নিরিবিলিতে”, গুড ফুড কি আছে বলুন?
দেবলীনা, প্লিজ বলো, এই বন্ধুত্বের মুহূর্তকে কি করে স্মরণীয় করে রাখি। অ্যাটলিস্ট ফিসফ্রাই খাও একটা।
দেবলীনা হেসে বলেছিল, বেশ তাই হোক। আপনার যা ইচ্ছে।
সৃজন অবাক হওয়ার ভান করে বলেছিল, তুমি বুঝি বন্ধুদের আপনি বলো?
নাকি আমায় দেখে তোমার আঙ্কেলের বয়েসী মনে হচ্ছে, কোনটা! যেটাই হোক সত্যি বলো প্লিজ।
তাহলে আমায় আরেকটু মেইনটেইন করতে হবে। এখন থেকেই যদি সুন্দরীরা কাকু আর আপনি বলতে শুরু করে, তাহলে সম্মানহানির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
সৃজনের মত উচ্ছল ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে ভেসে গিয়েছিল দেবলীনার ছদ্ম গাম্ভীর্য।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই দেবলীনা নিজের অস্বস্তি কাটিয়ে সৃজনকে বন্ধু বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
ওই ”নিরিবিলি” ক্যাফের কফি আর ফিসফ্রাই খাওয়া বন্ধুত্ব কবে যে ভালোবাসার পথে পাড়ি দিয়েছিল, সেটা অবশ্য দেবলীনা নিজেও বুঝতে পারেনি। ওর রুটিন মাফিক জীবনে কখন কিভাবে যেন সৃজন নামক অনুভূতির অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে এবং সে ওর গোটা মন জুড়ে বেশ ভালোই আধিপত্য বিস্তারও করেছে।
ক্যাফেতে সৃজনকে দেখেই প্রথম চমক লেগেছিল, ও পরেছিলো দেবলীনার পছন্দের জলপাই রঙের একটা শার্ট। এই রংটা ওর একান্ত নিজের, ভীষণ পছন্দের একটা রং। খুব বেশি জাঁকজমক নয়, কিন্তু একটু আলাদা। আর চাকচিক্য কম বলেই হয়তো মানুষ একে একটু ব্রাত্য করেই রেখেছে, কিন্তু এর নরম স্নিগ্ধতাটাই আকর্ষণ করে ওকে। সৃজনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, অলিভ? আপনার ফেভারিট বুঝি?
সৃজন মুচকি হেসে বলেছিল, না আপনার ফেভারিট, তাই সদ্য কিনে পরলাম। আমার ওয়াড্রবে তো আসমানী নীলের আধিক্য, যেটা আপনার পরণে আছে।
আমি তো আপনার বান্ধবী স্বর্ণালীর কাছ থেকে জানলাম আপনার পছন্দের রং, আপনার ভালোলাগার খবরগুলো। আপনাকে ইমপ্রেসড করতে পরে চলে এলাম। কিন্তু আপনি কোথা থেকে জানলেন আমার পছন্দের খবর? আর আমায় ইম্প্রেসড করার কোনোরকম সদিচ্ছা যে আপনার নেই, সেটা আমি ভালোই বুঝেছি।
দেবলীনা একটু হেসে বলেছিল, ইম্প্রেসড না করতে চেয়েও ভিকটিম যখন হয়েই গেলাম তখন আর কার্যকারণ খুঁজে লাভ কি!
সৃজনের পছন্দ, অপছন্দের সাথে কোনোদিনই মিল ছিল না দেবলীনার। তবুও ওদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা গড়েই উঠেছিলো। কিন্তু বছর খানেক পেরোতেই একটা জিনিস দেবলীনা ভীষণ ভাবে অনুভব করছিল, সৃজন হারতে জানে না, না শুনতে পছন্দ করে না, নিজের মতামতগুলোই অন্যের ওপরে জোর করে প্রয়োগ করেই ওর তৃপ্তি। প্রথম প্রথম ভালোবাসার টানে দেবলীনাও মেনে নিতো ওর অন্যায্য আব্দারগুলো, কিন্তু ধীরে ধীরে বড্ড একপেশে লাগছিলো বিষয়টা। আবারও গুলিয়ে যাচ্ছিল ভালোবাসা আর মানিয়ে নেওয়ার সংজ্ঞাটা। সৃজনের বিরোধিতা করতে গেলেই ও বলতো, তুমি না আমায় ভালোবাসো, তাহলে কেন এটুকু করতে পারছো না আমার জন্য! দেবলীনার বলা হয়ে ওঠেনি, সৃজন তুমিও তো আমায় ভালোবাসো, ইম্প্রেসড করার জন্য প্রথম দিন আমার পছন্দের রং পরে গিয়েছিলে, তাহলে কেন তোমার কাছে আমার কোনো পছন্দেরই মূল্য রইলো না! এমন অনেক প্রশ্ন ছিল ওকে করার, কিন্তু হয়ে ওঠেনি কখনো। হয়তো সৃজনকে হারিয়ে ফেলার ভয়েই ওর সব কিছুকে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিচ্ছিলো দেবলীনা। মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন মনের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াতো, উত্তর খুঁজে বেড়াতো অনবরত।
সৃজন কি আদৌ দেবলীনাকে ভালোবাসে? নাকি সুন্দরী, শিক্ষিতা,বাধ্য গার্লফ্রেন্ড বলেই মেনে নিয়েছে ওকে! আচ্ছা যদি হঠাৎ অবাধ্য হয়ে যায় ও সৃজনের, তাহলেও কি ভালবাসবে সৃজন? নাকি ওর ইচ্ছেগুলো দেবলীনার ওপরে চাপিয়ে দিতে দিতে আসল দেবলীনাকে এভাবেই বদলে ফেলবে ও! দেবলীনা একদিন বলেছিল, সৃজন তুমি এভাবে একটু একটু করে আমায় বদলে ফেলতে চাইছো কেন?
সৃজন বেশ ক্যাজুয়ালি বলেছিল, কারণ সৃজন চৌধুরীর পাশে তোমাকে মানানসই করতে এটুকু বদল দরকার।
মনে মনে হেসেছিল দেবলীনা। বুঝেছিলো, গড়ে পিঠে একটা ঠিকমত জীবনসঙ্গী চায় সৃজন, দেবলীনাকে নয়। গাধাকে পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ঘোড়াকে রেশে নামানো সহজ হবে ভেবেছিল বলেই বোধহয় দেবলীনা ওর পছন্দের তালিকায় প্রথমে ছিল।
সৃজনও মাঝে মাঝেই বিরক্ত হয়ে বলছিলো, প্লিজ দেবলীনা নিজেকে বদলাও। কেন যে তুমি তোমার মিডিলক্লাস মেন্টালিটি নিয়ে বসে থাকো কে জানে! এত নামি দামি রেস্টুরেন্টে, ডিস্কে নিয়ে গিয়েও তোমার মেন্টালিটির কোনো পরিবর্তন হলো না। এখনো তোমায় কোথায় হানিমুনে যেতে চাও জিজ্ঞেস করলে, তুমি আমার পজিশনের কথা না ভেবেই বলে বসবে, মানালি। কেন, সুইজারল্যান্ড বলতে সমস্যা কোথায়? ভাবনা চিন্তাগুলোর আপগ্রেডেশন দরকার, বুঝলে! এত দামি দামি ড্রেসগুলো গিফট করি তোমায়, সেগুলোর লেন্থ, স্টাইল নিয়ে প্রবলেম হয় তোমার। সবকিছুই যদি তোমার অপছন্দ হয় তাহলে তুমি মিসেস সৃজন চৌধুরী হবে কি করে লীনা?
সজোরে ধাক্কাটা সেদিন লেগেছিল দেবলীনার। ওর পরিচয় শুধুই মিস্টার সৃজন চৌধুরীর ওয়াইফ?
ওর স্কুলের ক্লাসরুম, প্রেয়ার লাইনের জাতীয় সংগীত, টিচার্স রুম, ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বেস্ট টিচারের তকমা… সব কিছুকে মিথ্যে করে দিয়ে, দেবলীনার সমস্ত সত্তাকে ভুলে গিয়ে শুধুই মিসেস চৌধুরী হওয়ার জন্য লড়াই করতে হবে ওকে! ভালোবাসা বুঝি এতটাই স্বার্থপর হয়?
মিসেস চৌধুরী হয়ে ওঠার লড়াইয়ে ও সেদিন থেকেই একটু একটু করে অসহযোগিতা শুরু করেছিল। স্বর্ণালী বলেছিল, সৃজন কিন্তু তোকে ভালোবাসে, হয়তো প্রসেসটা একটু আলাদা। ঐখানেই তো দ্বন্দ্ব চলছিল দেবলীনার, এত শর্তসাপেক্ষে হয় নাকি ভালোবাসা! এমন হলে তো ওই ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ডের মিষ্টতাই নষ্ট হয়ে যাবে! টানাপোড়েনের দড়ি টানাটানি খেলায় হারিয়ে যাবে অনুভূতিগুলো। অবশ্য শেষ রক্ষা হলোও না। শেষপর্যন্ত ওদের প্রায় তিনবছরের সম্পর্কটা চিড়ফাট থেকে বড় ফাটল ধরলো, আর এন্ড অফ দ্য রিলেশনের রেজাল্ট দাঁড়ালো ব্রেকআপ। ব্রেকআপটা ওরা দুজনেই চাইছিলো বলেই হয়তো ছাড়াটা সহজ হয়েছিল।
তবুও তিনবছরের স্মৃতি তো কিছু কম নেই। দৃষ্টিপথকে ঝাপসা করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সৃজনের সাথে প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকে শেষ দেখা পর্যন্ত, মাঝের মেঘলা বিকেল, তারা জ্বলা সন্ধে, ঘুঘু ডাকা ছুটির দুপুর, প্রায় মধ্যরাতের ডিস্কোর উদ্দামতা সব কিছু মিলিয়ে স্মৃতির ডায়রির শেষ পাতা পর্যন্ত ভর্তি হয়ে গেছে। সেসব দুদিনে ভোলা বোধহয় সত্যিই কষ্টকর। তবুও দেবলীনা জানে ওকে এসব ভুলে এগোতে হবে। আর সেই চেষ্টাতেই নিজের সাথে একান্তে কিছুক্ষণ কাটতেই ওর এই একা একা বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
ভীষণ ঘাম হচ্ছে, বোধহয় জ্বরটা ছাড়ছে।
আস্তে আস্তে দিগন্তর দেওয়া ঢাকাটা গা থেকে সরিয়ে বসলো দেবলীনা।
তাকিয়ে দেখলো দিগন্ত ঘুমাচ্ছে। প্যাসেজের লাইটটা জ্বলছে, সম্ভবত কিছু প্যাসেঞ্জার সামনেই নামবে, ওদের ফিসফাস শোনা যাচ্ছে। একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার। কিন্তু ট্রেনের ওয়াশরুমগুলোতে যেতে হবে ভাবলেই কান্না পায় দেবলীনার। যতই এসি কামরার ওয়াশরুম হোক, কমন তো।
তবুও বাধ্য হয়েই সিটের নিচে থেকে নিজের চপ্পল দুটো খুঁজে বের করলো মোবাইলটা জ্বেলে। চারটে বেজে গেছে। আরেকটু পরেই ভোরের আলো ফুটবে। দিগন্ত যেন কি বলছিলো ওকে, ওর জন্য নাকি অপেক্ষা করে আছে একটা নতুন সকাল। কি দেবে ওকে নতুন সকালটা? আবার মানুষের প্রতি বিশ্বাস জাগাবে? আবার ভালোবাসা নামক শব্দের প্রতি মোহ তৈরি করতে পারবে? নাকি নতুন সূর্যও বলবে সেই একই কথা, ভেঙে গেছে পুরোনো বিশ্বাস, হারিয়ে গেছে সেই দেবলীনা। ওর কজন ছাত্রী সেদিন হঠাৎই ক্লাসে ওকে প্রশ্ন করেছিল, ম্যাম, আপনি আর হাসেন না কেন আগের মত। আমাদের একদম ভালোলাগে না। বড্ড গম্ভীর থাকেন আজকাল, কি হয়েছে ম্যাম? ওদের নিষ্পাপ গলায় আন্তরিকতার ছোঁয়া পেয়েছিলো দেবলীনা, তবুও অকারণে কঠিন হয়ে বলেছিল, তোমাদের পড়াশোনার কি ক্ষতি হচ্ছে? আমি কি তোমাদের ভালো করে পড়াচ্ছি না?
মেয়েগুলো অপ্রস্তুত গলায় বলেছিল, না না ম্যাম, সেটা নয়। আপনি তো সব থেকে ভালো করে পড়ান। আমাদের সব থেকে পছন্দের টিচার আপনি।
তবে বেশ কিছুদিন ধরে আপনাকে একটু মনমরা লাগছিলো, তাই জিজ্ঞেস করলাম, সরি ম্যাম।
মেয়েগুলো ধীর পায়ে চলে গিয়েছিল নিজেদের বেঞ্চে। নিজের ওপরেই রাগ হয়েছিল দেবলীনার। এভাবে ওর প্রতি মনযোগ দেওয়া মানুষগুলোকে ও দূরে ঠেলে দিচ্ছে কেন! একটা নির্জন দ্বীপে বাস করতে চায় কি ও?
বাবা, মাকেও কথায় কথায় এমন সব উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছে, যে তারাও এখন মেয়েকে ভয় পেতে শুরু করেছে। সেদিন ডাইনিং টেবিলে মা খুব ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলো, তুই ব্রেকফাস্ট করবি তো? নুডলস বানিয়ে দেব?
মায়ের গলার স্বর শুনে দেবলীনার নিজেরই কষ্ট হচ্ছিল। মা জানে লীনার পছন্দের খাবার নুডলস, তারপরেও মায়ের চোখে শঙ্কিত একটা চাউনি। বাবাও লীনার হাত থেকে দৈনিক কাগজটা চাওয়ার সময় একটু অপ্রস্তুত গলাতেই বলেছিল, তোর পড়া হয়ে গেলে আমায় একটু দিস তো।
এসবের কারণ তো লীনা নিজেই। বাড়ির সকলকে বলেছে, লিভ মি অ্যালোন। বাড়িতে আমি কি একটু প্রাইভেসি পেতে পারি না? দিনরাত তোমাদের এই বেশি বেশি যত্ন, আমি জাস্ট নিতে পারছি না। প্লিজ, আমাকে একটু একা থাকতে দাও। মায়ের অবশ্য তাতেও শান্তি নেই, মেয়ের ঠিক কি হয়েছে সেই দুশ্চিন্তায় রয়েছে মা। বাবা নিজেকে একটু গুটিয়ে নিয়েছে লীনার থেকে। কাকু, কাকিমারাও যেন একটু এড়িয়েই যাচ্ছে ওকে।
ওর চারপাশের ওকে নিয়ে ভাবা মানুষগুলোকে ও দূরে ঠেলে দিয়েছে ইচ্ছে করেই। পালাতে চাইছিলো সকলের আড়ালে, নাহলে ঠিক ধরা পড়ে যেত ওর মুখের যন্ত্রণার অভিব্যক্তিগুলো। সৃজনের সাথে যেদিন থেকে রাকার ঘনিষ্ট ছবিটা দেখেছিলো, সেদিন থেকে বুকের মধ্যে একটা ঝড় তোলপাড় করছিল ওকে। সেই ঝড়টা কালবৈশাখী হয়ে নেমেছিল যখন সৃজন পরিষ্কার ভাবে বলেছিল, হ্যাঁ রাকাকে আমি পছন্দ করি। ওর আর আমার মধ্যে ভীষণ মিল। অ্যাডজাস্ট করতে হয় না, মিলগুলো এমনিই হয়ে যায়। রাকার সাথে মেশার পর আমি বুঝেছিলাম, মুহূর্তের ভালোলাগা বা সাময়িক ভালোবাসার সম্পর্কের বাইরেও আরেকটা জিনিস খুব দরকার হয় জীবন কাটাতে গেলে, সেটা হলো দুজনের মনের মিল, পছন্দের মিল। যেটা তিনবছর চেষ্টা করেও তোমার আমার মধ্যে হয়নি, আর ভবিষ্যতেও হবে না। জানো দেবলীনা, রাকা যেন আমার সব পছন্দের খবর রাখে, অথবা আমার ভালোলাগা গুলোই ওর পছন্দ। দেবলীনা, আই নিড ব্রেকআপ।
দেবলীনার গলা ধরে এসেছিল, বুকের মধ্যে কালবৈশাখীর তোলপাড়, দুচোখ ছাপিয়ে বৃষ্টি নামতে চেয়েছিল, সব কিছুকে কঠিন হাতে শাসন করে অনুভূতিহীন গলায় ও বলেছিল, ইয়েস সৃজন। উই নিড ব্রেকআপ। ইনফ্যাক্ট আমিও ভাবছিলাম এই কথাটাই তোমাকে বলবো। উত্তরমেরু আর দক্ষিণমেরুকে জোর করে মেলানোর চেষ্টা করেছিলাম আমরা। দুজনেই হয়তো ক্লান্ত। এবারে ফ্রিডম খুঁজছে আমাদের দুজনেরই মন, তাই না সৃজন?
একটু বোধহয় চমকেছিলো সৃজন। ওর এতটা ঠাণ্ডা গলা শুনবে বুঝতে পারেনি। দেবলীনা যে সৃজনকে বড্ড বেশিই ভালোবাসতো সেটা বোধহয় বুঝেছিলো ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ও। তাই লীনার এতটা নিরুদ্বিগ্ন গলা শুনে একটু থেমে সৃজন বলেছিল, কষ্ট হবে না তোমার?
দেবীলনার দুচোখে তখন ঘন মেঘ, থরথর করে কাঁপছিল ঠোঁট দুটো। তবুও কাটা কাটা গলায় বলেছিল, কষ্ট হতো, যদি আমরা জোর করে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করতাম সম্পর্কটাকে, হয়তো বসন্ত বাতাস হয়ে উঠত অত্যন্ত রুক্ষ। তার থেকে এই মিউচ্যুয়াল ব্রেকআপটা ঢের ভালো। আমরা দুজনেই এনাফ ম্যাচিওরড, এখন কি আর ঝগড়া ঝাঁটি, কান্নাকাটি শোভা পায়! তাছাড়া গত একবছর ধরে আমাদের সম্পর্কটা মধুরতা হারিয়ে হোঁচট খেতে খেতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। মানিয়ে নিতে নিতে আমিও খুব ক্লান্ত বোধ করছিলাম সৃজন। তাই এই বেশ ভালো হলো। সৃজন আলগা স্বরে বলেছিল, তবে তুমি যদি থাকতে চাও, থাকতে পারো আমার জীবনে, কিন্তু রাকাকে তোমায় মেনে নিতে হবে।
দেবলীনা তিক্ত স্বরে বলেছিল, না সৃজন, আমি চাই না। তবে এসব বলে নিজেকে আর আমার চোখে ছোট করো না। লজ্জা করবে আমার, মনে হবে আমি এতদিন এমন একজনকে ভালবাসতাম, যার ভাবনা, চিন্তাটাই স্বচ্ছ নয়। এক্স বলে, আমি তোমায় ঘৃণা করতে চাই না।
সৃজন ফোনটা রাখার সময় বলেছিল, আমিও চাই তোমার জীবনেও তোমার পছন্দের কেউ আসুক।
ফোনটা রেখে দিতেই মনের ভিতরের দামাল কালবৈশাখীর ঘন মেঘটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছিল দেবলীনার দুচোখ দিয়ে। গাল থেকে চিবুক বেয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিল বুকের কাছের চুড়িদারের অংশটাকে। নোনতা জলের ধারাকে মোছার চেষ্টাও করেনি লীনা, ভিজিয়ে দিক ওকে, হৃদয়তন্ত্রীর প্রতিটা সুর কঁকিয়ে উঠে গেয়েছিল ভাঙনের গান। ”একলা চল রে” সুরের মধ্যেই ধ্বনিত হয়েছিল ওর ভালোবাসা হারিয়ে একা হয়ে যাওয়ার গল্পটা। সৃজনকে ওরও বিরক্ত লাগছিলো ঠিকই, কিন্তু হারিয়ে ফেলার পরের শূন্যতাটা যে এতটা কষ্ট দেবে ওকে তখন বোঝেনি ও। যদিও ধীরে ধীরে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে দেবলীনা। তবে বাবা, মাকে এখনো বলা বাকি। যতবার ওরা বিয়ের কথা বলেছে, ততবার দেবলীনা বলেছে, চিন্তা করো না, আমার পছন্দের মানুষকে তোমাদেরও পছন্দ হবে। তবে বিয়েটা এখুনি নয়, এখুনি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাইনা, আর কিছুদিন পরে।
বাবা, মা সৃজনের কথা জানতো, ওদের যে কিভাবে ফেস করবে দেবলীনা সেটাই চিন্তার বিষয়।
তবে ওদের ফেস করার থেকেও নিজের ভালো থাকাটা সত্যিই প্রয়োজন, সৃজনের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে বোধহয় সেটা ভুলেই গিয়েছিল দেবলীনা। দার্জিলিং থেকে ফিরে এসে মুখোমুখি হবে বাবা-মায়ের, বলে দেবে সব সত্যিটুকু।
সিট থেকে উঠতে গিয়েই মাথাটা ঘুরে গেল দেবলীনার।
আরেকটু হলেই ঠোক্কর খাচ্ছিল, তখনই দিগন্ত একটা হাত দিয়ে ধরে ফেললো ওকে। সিটে বসিয়ে দিয়ে বললো, আচ্ছা মানুষ তো আপনি, একটু ঘুমিয়েছি এই সুযোগে আমার নামে কেস দেওয়ার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন। আরে মশাই, একবার ডাকতে কি হয়েছিল? কি মনে হয় আপনার আমাকে? সত্যিই এই পিসিমণির ভাইপো মনে হয় নাকি! কানের কাছে ঢাক বাজালেও নাক ডাকার বিরতি পড়বে না মনে হয়?
তাহলে ডাকলেন না কেন? নেহাত মোবাইলটার আলো চোখে পড়লো আর অন্য প্যাসেঞ্জারদের ফিসফাস কথায় ঘুমটা ভাঙলো তাই, নাহলে তো রীতিমত জেল হয়ে যেত আমার। আরে জ্বরটা হয়তো সবে ছেড়েছে, এখুনি একা ওঠার কি দরকার ছিল বলুন তো!
দেবলীনা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, বড্ড জ্বালাচ্ছি আপনাকে, সরি। কিন্তু হঠাৎ আপনাকে কে জেলে পাঠাবে বলুন তো?
দিগন্ত ওর নিজস্ব ঢঙে হেসে বললো, রেলকর্তৃপক্ষ পাঠাবে। সামনের সিটে একজন সবল পুরুষমানুষ বসে থাকতেও সহযাত্রী মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে, আর সে এতটুকু কেয়ারিং নয়, এই তথ্য যদি তাদের কাছে যায় তো অমানুষ হবার দায়ে জেলে যাবো, বুঝলেন!
এখন বলুন তো, কোথায় যাচ্ছিলেন কোথায়? নিউজলপাইগুড়ি তো অনেকটা দেরি আছে।
দেবলীনা বাধ্য হয়ে বলল, একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছিলাম।
নিজেকেই দোষারোপ দেবার ঢঙে দিগন্ত বললো, ওহ, সরি, চলুন আমি যাচ্ছি সঙ্গে।
দেবলীনা অস্বস্তি নিয়েই বললো, আমি পারবো যেতে।
দিগন্ত হাসি মুখে বললো, আমার মা বলতো, আমি নাকি ছোট থেকেই বিকট টাইপের অবাধ্য, তাই ভদ্রলোকের কথা কোনোকালেই তেমন শুনি না। চলুন চলুন…
আর কথা না বাড়িয়ে দিগন্তর হাতটা ধরলো দেবলীনা। বহুদিন পরে যেন একটা ভরসা করার মত হাত ধরলো ও। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আবারও ওকে বার্তা পাঠালো, মানুষটা মোটেই খারাপ নয়। তবে একটু অদ্ভুত টাইপের, ওর দেখা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা।
ওয়াশরুমের বাইরে অপেক্ষা করছি, বলেই দিগন্ত বললো, এত সংকুচিত হবেন না। বন্ধু না ভাবলেও চলবে, শুধু সহযাত্রী ভাবলেই হবে। মানুষ এটুকু মানুষের জন্যই করে। আমি অসুস্থ হলেও স্থির বিশ্বাস করি, আপনি হেল্পের হাত বাড়াতেন। আমরা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে, মেয়ে তো, তাই ছোট থেকেই একটা মূল্যবোধ নিয়ে বড় হয়েছি। আমার মা বলেন, সুখে না পাশে থাকতে পারলেও, দুঃখে থাকবো। দেবলীনা খুশি হয়ে বলল, এটা তো আমার মায়েরও কথা। দিগন্ত ঘাড় নেড়ে বললো, মা কখনো আলাদা হয় নাকি!
।। ৬।।
নিজের সিটে সোজা হয়ে বসতেই দিগন্ত বললো, এখন শরীর ফিট? নাকি দুর্বল লাগছে? আপনি একা কিভাবে ঘুরবেন বলুন তো? মহা চিন্তায় ফেললেন তো।
দেবলীনা নিরাসক্ত গলায় বলল, কোনো চিন্তা নেই, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে আপনি আপনার পথ ধরবেন, আমি আমার। এমনিতেই আমি যথেষ্ট সাহায্য নিয়েছি আপনার, আর নয়। প্লিজ, টেনশন করবেন না, আমি পারবো।
দিগন্তর ভ্রূর ভাঁজে তবুও দুশ্চিন্তার মেঘের আনাগোনা দেখে অবাক লাগছিলো দেবলীনার। কয়েকঘন্টা আগেই মাত্র পরিচয় হয়েছে দিগন্তর সাথে, ওকে ভালো করে চেনেও না, তাতেও ওকে নিয়ে চিন্তা করছে মানুষটা। আর গত তিনবছর যাকে উজাড় করে ভালোবাসল, সে শুধুমাত্র এক্স হয়ে গেছে বলে আর খোঁজটুকুও নিলো না। প্রেজেন্ট আর পাস্টের মধ্যে কত পার্থক্য, এই কয়েকদিন আগে যে মানুষটা ফোন রিসিভ না করলে দুশ্চিন্তা করতো, মেসেজের পর মেসেজ করতো সে এখন নিশ্চিন্তে রয়েছে ওর কোনো খবর না নিয়েই। দেবলীনা জানে সকাল নটার আগে সৃজন ঘুম থেকেই ওঠে না। কিন্তু উঠেই ওকে গুড মর্নিং মেসেজ পাঠাতে ভুলত না আগে। আগে বলতে যতদিন রাকা আসেনি ওর জীবনে।
এই যে ম্যাডাম, এত কি আকাশ পাতাল ভাবছেন বলুন তো? আর দু ঘন্টার মধ্যে ট্রেন এন জি পি ঢুকবে। কি করবেন ভেবেছেন?
অন্য কোনো ট্রেনের টিকিট দেখবো, বা ফ্লাইটের ব্যবস্থা করবো? বাড়ি ফিরে যাওয়াই তো ভালো মনে হয়। এই জ্বর নিয়ে ঠান্ডার জায়গায় যাওয়া কি ঠিক?
দেবলীনার চোখে একটু বিরক্তি ফুটে উঠলো। ইদানিং একটুতেই বিরক্ত হয়ে মেজাজ হারানোটা ওর রোগ হয়ে গেছে যেন। ও কিছু বলার আগেই দিগন্ত বললো, বিরক্ত হচ্ছেন? ভাবছেন তো, পাড়া-পড়শীর কেন ঘুম নেই?
আসলে লোকে বলে একসাথে সাত পা চললেই নাকি বন্ধু হয়, আর আমরা তো কয়েকশো কিলোমিটার একসাথে এলাম, তাই চিন্তা হচ্ছিল আর কি।
বিরক্ত যখন হচ্ছেন তখন আর কিছু বলবো না। এমনিতেই আমার পুচু সোনা রাগ করবে আপনার সাথে এত কথা বলছি জানলে।
দিগন্তর বলার ভঙ্গিমায় সব ভুলে বহুদিন পরে হো হো হেসে উঠলো দেবলীনা।
দিগন্ত সেদিকে অপলক তাকিয়ে বললো, হাসলে কিন্তু আপনাকে বেশ লাগে, নির্মল, প্রশান্ত, ভারহীনভাবে হাসুন। এই যে আপনারা মুখে দিনরাত হাবিজাবি মেখেই চলেছেন, স্কিনের ঔজ্বল্য বাড়াতে, সেসব না মেখে মন খুলে হাসুন দেখি, এমনিই স্কিন গ্লো করবে।
আমার হাসির আওয়াজে বোধহয় আপনার পিসিমণির ঘুম ভেঙে গেল। ওই দেখুন, উনি তাকাচ্ছেন।
দিগন্ত ফিসফিস করে বললো, আপনার হাসির আওয়াজে নয়, মানুষ ন ঘন্টার বেশি ঘুমানো পাপ বলে এবারে উনি উঠবেন ভাবছেন। ট্রেনে ন ঘন্টা নিশ্চিন্তে ঘুমানোর মত পাপ তো আর হয়ই না। দেবলীনা হাসতে হাসতেই বললো, বন্ধু না হোক, সহযাত্রী যখন হলাম, তখন আপনার পুচু সোনার নামটা জানতে পারি কি?
দিগন্ত একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, রাই বিশ্বাস। যদিও আমি ওকে রাই বিশ্বাসঘাতক বলি। ও খুব রেগে যায় বুঝলেন এটা শুনলে।
দেবলীনার খুব ভালো লাগছিলো একটা সহজ সরল প্রেমের গল্প শুনতে। ভালোবাসা শব্দের ম্যাজিক যেন নিঃশেষ হয়ে না যায় পৃথিবী থেকে, তাহলেই মানুষ বিশ্বাস হারাবে।
দিগন্তর চোখে একটা লাজুক দৃষ্টির আনাগোনা। ঠোঁটের কোণে মায়াময় হাসির দিকে তাকিয়ে দেবলীনা মনে মনে বললো, রাই তুমি লাকি। ভীষণ লাকি, যে তুমি একটা প্রকৃত পুরুষ মানুষকে পেয়েছো জীবনসঙ্গী হিসেবে।
যেটা এই সমাজে সত্যিই বিরল।
কি হলো নতুন বউয়ের মত লজ্জা কেন পাচ্ছেন? বলুন আপনার রাইয়ের কথা। তার সাথে আপনার আলাপ কোথায়? কলেজে না অন্য কোথাও? দিগন্ত একজন চাওয়ালাকে বললো, দুটো লিকার দিন। মুচকি হেসে বললো, আমার পিসিমণি যে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
কিসানগঞ্জ তো ঢুকে গেলো, আর কিন্তু বেশিক্ষণ নেই।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, কলেজ স্কুল এসব তো মানুষ জন্মেই যায় না? কিন্তু আমার রাইয়ের সাথে আমার দেখা হয়েছিল জন্ম মুহূর্তেই।
চোখগুলো বড় বড় করে দেবলীনা বললো, ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইনটারেস্টিং। প্লিজ কন্টিনিউ…
আমার মা আর রাইয়ের মা একই সাথে একই নার্সিংহোমের একই কেবিনে ভর্তি হয়েছিল। আমি জন্মানোর মাত্র দুঘন্টা পরে উনি জন্মেছিলেন। আপনারা মহিলারাই ভালো বলতে পারবেন, কিভাবে লেবার পেন নিয়েও গল্প করা যায়, রীতিমত সই পাতানোও যায়। আমার মা আর তাপসী আন্টি ওই বাইশ বছর বয়সে দুজনে দুজনের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু হয়ে উঠলো। স্বাভাবিকভাবেই দুই বাড়িতে যাতায়াত শুরু হলো ঘন ঘন। রাইদের বাড়ি খুব বেশি দুরেও নয় আমাদের বাড়ি থেকে। আমার মায়ের নাকি ইচ্ছে ছিল একটা মেয়ে হোক। তো ওই রাই সুন্দরী জন্মেই মায়ের সেই ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব নিয়ে নিল, আর আমায় জাস্ট ব্যাকফুটে ঠেলে দিলো। ওই মেয়ে জন্মে থেকে শুরু করলো তীব্র প্রতিবাদ। কেঁদে কেঁদে এমন অবস্থা করেছিল কেবিনের, যে আমার মাও নাকি আমায় পাশে শুইয়ে দিয়ে রাই সুন্দরীকে ভোলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এটা যদিও আমার শোনা কথা। ওই অসভ্য মেয়ে ছোট্ট থেকে যেদিন আমাদের বাড়িতে আসতো, ইচ্ছে করে আমার পছন্দের কোনো একটা খেলনা নিয়ে যাবার জন্য বায়না ধরতো। আর আমার মা তো ওকেই বেশি ভালোবাসতো, তাই প্রতিবারই বলতো, ওকে দিয়ে দে দিগন্ত, আমি তোকে কিনে দেব। আমিও মায়ের কথা বিশ্বাস করে ওই ইতর মেয়েকে প্রিয় খেলনাটা দিয়ে দিতাম। মাকে দ্বিতীয়বার কিনে দেবার কথা বললেই বলতো, তুই এত হিংসুটে কেন রে? ও ছোট, আব্দার করে নিয়ে গেছে, তাতে এত ঝামেলা কেন করছিস?
মাত্র দুঘন্টা ছোট হবার বেনিফিট তুলেছিল রাই। তখন থেকেই ঠিক করেছিলাম এমন জব্দ করবো ওই মেয়েকে, যে কেঁদে কুল করতে পারবে না।
আমিও ওদের বাড়ি গিয়ে ওর প্রিয় পুতুলগুলো আনতে শুরু করলাম। রাইয়ের বাবা, মা দুজনেই আমাকে খুব ভালোবাসতো। বাসবে নাই বা কেন বলুন, অমন বায়নাধারী মেয়ের পাশে আমি তো সোনার টুকরো। ওর বাবা মানে জয়ন্ত আঙ্কেল প্রায় বলতো, দিগন্তকে দেখে শেখ, কোনো রকম বায়না নেই, বাধ্য ছেলে আর তোর শুধু দিনরাত আব্দার। না পেলেই পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি।
সেই শুনে ওই মেয়ে বলেছিল, ওকেই আমার পছন্দ, আমার পুতুলের সাথে বিয়ে দেব দিগন্তর। একদিন ওদের বাড়ি থেকে ওকেই তুলে নিয়ে চলে আসবো।
হতে পারি ছোট, কিন্তু মেল ইগোতে মারাত্মক ধাক্কা লেগেছিল মশাই। শেষ পর্যন্ত আমার একটা জীবন্ত বউও জুটবে না, বিয়ে হবে কিনা একটা গোলাপি রঙের ফ্রক পরা সোনালী চুলের চোখ পিটপিট করা মেয়ের সাথে! ভেবেই রাগে জ্বলে গিয়েছিলাম। এমন শান্ত আমিও রাইয়ের চুল ধরে টেনে বলেছিলাম, কখনো না। তোর পুতুলকে আমি কোনদিন বিয়ে করবো না।
রাই ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ ছল ছল করে কেঁদে উঠেছিলো। ওই মুহূর্তে কি যে হয়েগিয়েছিলো আমার, ওই ছিঁচ কাঁদুনে, বায়নাকুটে মেয়েটাকেই মায়া হয়েছিল। বুঝলেন দেবলীনা ম্যাডাম, মায়া দয়া হলো বড় বিষম বস্তু। ওই যে বছর ছয়েকের দিগন্তর মায়া হয়ে গেল রাইয়ের প্রতি, অমনি মেয়ে সুযোগ নিয়ে আমার ঘাড়ে উঠে নাচতে শুরু করলো। এখনও নামার নাম নেই। এই ঘাড়টাই ওর পার্মানেন্ট সিংহাসন হয়ে গেছে।
দেবলীনা বললো, বিয়ে করছেন না কেন? এবারে শুভ কাজ সেরে ফেলুন। বিয়েতে কিন্তু আমায় নিমন্ত্রণ করবেন।
দিগন্ত ফিসফিস করে বললো, যতদিন বিয়ে না করে থাকা যায় আরকি। দেখছেন তো দূর থেকেও কেমন কন্ট্রোলে রাখে আমায়। কাছে এলে আর রক্ষা থাকবে না। দিগন্তর ঠোঁটের কোণে প্রশ্রয়ের হাসি। সেদিকে তাকিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল দেবলীনার।
আচমকা প্রশ্ন করে বসলো, আচ্ছা আপনার সাথে তো নিশ্চয়ই রাইয়ের মানসিকতার, পছন্দের বেশ কিছু পার্থক্য আছে। আপনি কখনো চেষ্টা করেছেন, রাইকে নিজের মত করে তুলতে?
দিগন্ত অবাক হয়ে বলল, পাল্টে ফেলতে চাইবো মানে? তাহলে তো আমার রাই বদলে যাবে। আমি তো রাইয়ের ওই ছটফটে, প্রাণোচ্ছল স্বভাবটার জন্যই ওকে ভালোবেসেছিলাম। রাই আমার মত শান্ত নয়, বুঝদার তো নয়ই, বড্ড অবুঝ টাইপের, ঐজন্যই তো ও রাই আর আমি দিগন্ত।
সামনের ভদ্রমহিলাকে কেউ একজন ডাকতে এসেছিল, মহিলা উঠে বসেই বললেন, ট্রেনে একদম ঘুম হয় না আমার, সারারাত প্রায় জেগে ছিলাম। তোমরা দুটিতে তো বেশ ভালোই ঘুমালে দেখলাম।
দিগন্ত এক মুখ হেসে বললো, পিসিমণি, আপনি জেগে ছিলেন বলেই তো আমরা ব্যাগপত্রর চিন্তা না করে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পেরেছি।
দেবলীনার পেটের মধ্যে হাসির দমক উসখুস করছিল, অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করলো। একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলো ও, দিগন্তের সঙ্গে গল্প করলে মনখারাপি বাতাসটা ঘেঁষতে পারছে না ওর ধারে কাছে। মন ভালো করার একটা ওষুধ বোধহয় দিগন্তের কাছে আছে। নির্ঘুম রাত কাটানো দিগন্তর পাতানো পিসিমণি চলে গেল নিজের সিটে।
দিগন্ত নিজের ব্যাগপত্র সিটের নিচে থেকে বের করার সময় দেবলীনার ট্রলি ব্যাগটাও বের করে দিলো সামনে। এবারে রেডি হয়ে নিন, মিনিট দশেকের মধ্যেই নামতে হবে।
দেবলীনার হঠাৎ কেমন ভয় ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল একজন কেউ ছিল ওর সঙ্গে, এবারে ও একদম একা হয়ে যাবে অপরিচিত একটা পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে। কিন্তু ও তো একা একা সময় কাটাবে বলেই এসেছিল এখানে, ইনফ্যাক্ট স্বর্ণালীকেও সঙ্গে নিতে ইচ্ছে করেনি, সৃজনের কথা ঘুরে ফিরে আসবে বলেই। তাহলে এখন একা হতে এত ভয় করছে কেন?
হ্যান্ড ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে চুলটা একটু ঠিক করে নিলো ও। ঠোঁটে লিপগার্ড লাগলো। কপালের টিপটাকে জায়গা মত বসিয়ে নিতেই দিগন্ত বললো, কেউ আপনাকে কখনো বলেনি, বিনা সাজগোজেও আপনাকে বেশ লাগে। শহুরে জাঁকজমকের বাইরের সবুজ প্রকৃতির কোলে নিকোনো মাটির ঘরের মত। পরিপাটি অথচ সাজসজ্জা বিহীন, একেবারে অকৃত্রিম।
আপনার মধ্যে আমার সব থেকে বেশি ভাললেগেছে কোন জিনিসটা জানেন?
দেবলীনা বললো, বলে ফেলুন, নিজের প্রশংসা তো ভগবানও পছন্দ করেন, আমি তো নিতান্ত মনুষ্য।
পজেটিভিটি, সব থেকে আকর্ষণ করেছে আপনার পজেটিভ মনোভাব। সাধারণত বাঙালী মধ্যবিত্ত মেয়েদের দেখা যায়, প্রেমে ব্রেকআপ ঘটে গেলে জীবন যেন থমকে যায়। তাকে ছাড়া আর কিছুই যেন করার নেই। এই যে আপনি নিজের মনের খোঁজ করতে, নিজের সাথে নিজে সময় কাটাতে একা একা বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছেন, এটার জন্যই আপনাকে আমি একশোর মধ্যে আশি দিয়ে দিয়েছি। আর কুড়ি দিয়েছি আপনার রিয়ালাইজেশনের জন্য, সম্পর্ককে জোর করে ধরে রাখতে নেই, তাতে তার মাধুর্য হারায়, এটাই বলছিলেন না আপনি আপনার বন্ধুকে! এটার জন্য কুড়ি দিয়ে দিলাম।
দেবলীনা হাসিমুখে বললো, বলেন কি, আপনি তো বেশ দরাজ হস্ত আছেন। ভাগ্যিস স্কুল টিচার নন। তাহলে তো কিছু ছাত্র একশো তে একশো দশ পেত। আমি কিন্তু বেশ কড়া শিক্ষিকা। আমার হাতে এইটটি পেলে, সে বোর্ডের পরীক্ষায় অবশ্যই নাইনটি ফাইভ পাবেই। কিছু নম্বর আমি হাতে রেখেই দিই। তবে আপনাকে একটু বেশি নম্বরই দিয়ে ফেলেছি, এতটা দরাজ হওয়া হয়তো ঠিক হলো না।
দিগন্ত হেসে বললো, তাড়াতাড়ি বলুন, কত পেলাম। এবারে নামতে হবে। আপনার ব্যাগটা আমি নামিয়ে দিচ্ছি। সাবধানে নামবেন, মনে রাখবেন সারারাত আপনার ভালো জ্বর ছিল, জ্বর ছাড়লেও শরীরটা কিন্তু দুর্বল আছে। তাই বেড়াতে গিয়েও সাবধানে থাকবেন প্লিজ। বেশি দৌড়ঝাঁপ করবেন না।
দেবলীনা ফিসফিস করে বললো, আপনাকে নাইনটি দিয়ে ফেলেছি নিজের অজান্তেই।
দিগন্ত ব্যাগগুলো ট্রেনের দরজার সামনে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ওই দেখুন, রাইকে ফোন করতে ভুলে গেছি, আজ হয়তো আমার কপালে দুঃখ আছে।
দেবলীনা চমকে উঠলো একটু। মনে পড়ে গেলো, দিগন্ত শুধুই রাইয়ের। ওকে নম্বর দেওয়ার অধিকার একমাত্র রাইয়ের আছে।
ট্রেন থেকে ট্রলিটা নামিয়ে দিয়ে দিগন্ত বললো, একটু দাঁড়ান, আমি কলটা করে নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে গাড়ি অবধি পৌঁছে দেবো।
দেবলীনা উদাস চোখে দেখছিলো দিগন্তকে। সৃজনও তো বহুবার বাইরে ট্যুরে গেছে, পৌঁছে, নিজের কাজ মিটিয়ে একটা মেসেজ করেছে—পৌঁছালাম। এভাবে কল করার জন্য তো কখনো উদগ্রীব হয়নি! মনে মনে আবার বললো দেবলীনা, রাই তোমায় যেন হিংসে না করে ফেলি আমি। ভেবেছিলাম দিগন্তর কাছে তোমার ছবি দেখবো, না থাক, তুমি থাকো তোমার দিগন্তর চোখে অনন্যা হয়ে। আমার কুনজর তোমার ওপরে না পড়াই ভালো। ভালো থেকো রাই, তোমার দিগন্তকে এভাবেই সামলে রেখো।
আবার ভাবনার জগতে চলে গেলেন? এই জন্যই আপনাকে কবিনী বলেছিলাম ম্যাডাম।
দিগন্ত ওর ট্রলিটা নিতে যেতেই দেবলীনা বললো, কাল থেকে আপনার ওপরে অনেক অত্যাচার করেছি, আর নয়। এবারে আমি চললাম আমার গন্তব্যে। আপনি যান আনন্দে ঘুরুন, আর আপনার পুচু সোনাকে কল করুন। নিজের ব্যাগটা টেনে নিয়ে দেবলীনা বললো, এই ট্রিপটা আমি সারাজীবন মনে রাখবো। মনে রাখবো এমন একজন সহযাত্রী পেয়েছিলাম, যে নিঃস্বার্থ ভাবে আমার উপকার করেছিল। ধন্যবাদের মত ফর্মাল শব্দ ব্যবহার করে আপনার উপকারকে ছোট করবো না।
এলাম দিগন্ত, ভালো থাকবেন আপনি আর আপনার রাই। নিজের ব্যাগটা নিয়ে হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো দেবলীনা। কয়েকঘন্টার পরিচয়ে দিগন্ত যে ওর মনের ওপরে বেশ ভালোই প্রভাব ফেলেছে, সেটা ও উপলব্ধি করতে পারছে। তাই পিছন ফিরে আর তাকাতে চাইছে না, ওর কোনোরকম দুর্বলতা যেন কিছুতেই প্রকাশ না পায় দিগন্তর সামনে।
দেবলীনার আকস্মিক ব্যবহারে হয়তো দিগন্ত কিছুটা বিহ্বল হয়েই বললো, বেশ আসুন, বেস্ট অফ লাক। এনজয় ইয়োর ট্রিপ।
দেবলীনা এগিয়ে এসেছে গাড়ি স্ট্যান্ডের দিকে। শরীরটা অল্প দুর্বল লাগছে, কিন্তু মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি। সৃজনের সাথে ব্রেকআপের সময়েও বোধহয় এমন অনুভূতি হয়নি ওর। এই নতুন অনুভূতির সাথে দেবলীনা পরিচিত নয়। তবে মনে হচ্ছে খুব নিকট কাউকে হারিয়ে ফেললো ও। আরেকবার কি ছুটে যাবে ওদিকে? খুঁজে দেখবে দিগন্তকে, কোথায় চলে গেল ছেলেটা। এখন একা একা দার্জিলিংয়ে কোথায় যাবে ও। ম্যালের ওপরে হোটেল নেবে ঠিক করেছিল, অনলাইনে দেখেও রেখেছিলো, যদিও বুক করেনি। গিয়ে ঘর দেখে বুক করবে। এটা অফ-সিজন, তাই রুম পেতে অসুবিধা হবে না ভেবেই বুক করে নি। সবই তো চলছিল প্ল্যান অনুযায়ী, হঠাৎ দিগন্ত নামক নরম, মিষ্টি বাতাসটা এসে দেবলীনার সবকিছু কেমন এলোমেলো করে দিয়ে গেল যেন।
গাড়ির ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো, ম্যাডাম, কোথায় যাবেন? দার্জিলিঙের কোন হোটেল? অ্যাড্রেসটা দিন ম্যাডাম।
দেবলীনা অস্ফুটে বললো, দাঁড়ান, আমি আসছি।
।। ৭।।
দেবলীনাকে একা ছাড়াটা বোধহয় ঠিক হলো না। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই ভাবছিলো, হলেই বা ও রাইয়ের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তাই বলে অসুস্থ একজন মহিলাকে এভাবে অপরিচিত জায়গায় একা ছেড়ে দেওয়াটা বোধহয় অন্যায়। তাছাড়া মেয়েটাকে বড্ড ক্লান্ত লাগছিলো। রাতে যখনই ঘুম ভেঙেছে ওর, তখনই দেখেছে দেবলীনা এপাশ-ওপাশ করছিল। তাছাড়া ওর মনটাও বেশ বিষণ্ণ হয়েই রয়েছে, সম্ভবত এর প্রধান কারণ ব্রেকআপ। যদিও দিগন্ত ব্রেকআপ কথাটাতে খুব একটা কম্ফোর্টেবল নয়। ওই ছোট্ট অনুভূতিহীন শব্দ দিয়ে হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণা অনুভব করা সম্ভব নয়। ভালোবাসা হারানোর কষ্টটা তো নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার মত বেদনাদায়ক। তাকে ওই ঠুনকো ব্রেকআপ নামের প্রচণ্ড চলতি কথার ঘেরাটোপে রাখতে রাজি নয় দিগন্ত। ওর তো মনে হয় এ কষ্ট যে পেয়েছে একমাত্র সেই বোঝে। প্রাক্তনের সব স্মৃতি বয়ে নতুনের দিকে হাত বাড়াতে হয়। কারণ জীবন তো থেমে থাকে না, খুঁড়িয়ে হলেও এগোয়।
আর ওই চলন্ত জীবনের কাঁধে থাকে একটা পুরোনো ডায়রির ভার, যার পাতার রং হলুদ হয়ে গেলেও স্মৃতিগুলো ভীষণ রকমের জীবন্ত। তাই ভালোবাসা ভাঙার কষ্টের পর নিজেকে আবার জীবন স্রোতে ফিরিয়ে আনতে গেলে যে লড়াইটা করতে হয় সেটা সত্যিই দুঃসাধ্য। দেবলীনা এখন সেই লড়াইয়ে নেমেছে। কাল অবধি যে ছিল ওর মনের মণিকোঠায়, আজ তাকেই ভুলতে হবে পণ করতে হয়েছে ওকে। এই মনেপড়ে যাওয়া আর ভোলার আপ্রাণ চেষ্টাতে ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছে মেয়েটা। এই অবস্থায় ওকে অমন ভাবে একলা ছেড়ে দেওয়াটা বোধহয় অত্যন্ত অমানবিক একটা কাজ হলো। রাই জানতে পারলেও হয়তো কোমরে হাত দিয়ে বকবে দিগন্তকে। বলবে, আর কবে বড় হবে তুমি? মিনিমাম আক্কেল জ্ঞান নেই তোমার। ওর রাইয়ের বকুনিটা বড্ড মিষ্টি, যেন কোনো পাক্কা গিন্নী কোমর বেঁধে শাসন করছে তার বোকা-সোকা স্বামীকে। রাইয়ের কাছ থেকে পরে পারমিশন নিয়ে নিলেই চলবে।
আপাতত দেবলীনাকে খোঁজা দরকার, বেরিয়ে গেল নাকি গাড়ি নিয়ে! একাই গাড়ি বুক করলো নাকি শেয়ার গাড়ি নিলো? হন্তদন্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো দিগন্ত। বড্ড বোকার মত কাজ করে ফেলেছে, এত গল্প করলো মেয়েটার সাথে অথচ ওর ফোন নম্বরটাই নিতে ভুলে গেছে। দেবলীনা বোধহয় চেয়ে নিয়েছিল দিগন্তর নম্বর। কিন্তু দেবলীনারটা নেওয়া হয়নি। এই কারণেই ও সেই ছোট্ট থেকে বকুনি খেয়ে আসছে রাইয়ের কাছে। তবুও কোনো পরিবর্তন হলো না দিগন্তর স্বভাবের। আজও একইরকম অগোছালো থেকে গেল। ব্যাগপত্র নিয়ে খোঁজাও তো মুস্কিলের কাজ। তাছাড়া দেবলীনা যদি গাড়ি বুক করে বেরিয়ে যায়, তাহলে তো হয়েই গেল।
বিরক্ত মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো দিগন্ত।
হঠাৎই পিঠে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো।
সঙ্গে পরিচিত গলায় কেউ বলে উঠলো, আমায় খুঁজছিলেন বুঝি? দিগন্ত ঘুরেই দেখলো, দেবলীনা রীতিমত হাঁপাচ্ছে। ওর চোখ দুটো টকটকে লাল, দৃষ্টিতে একটা চোরা ভয় নিয়েই ঠোঁটের কোণে ফিরে পাওয়ার হাসি। হাঁপাতে হাঁপাতেই বললো, আমি তো ভাবলাম আপনাকে হারিয়েই ফেললাম বোধহয়। ফোনেও ট্রাই করলাম, পেলাম না। দিগন্ত জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো, জল খান, হাঁপাচ্ছেন কেন? আর আমাকেই বা খুঁজছিলেন কেন? সেটার উত্তর জল খেয়ে নিয়ে দেবেন। দেবলীনার যেন খুব পিপাসা পেয়েছিলো, অথচ জল খেতে ভুলে গিয়েছিল, এভাবেই ঢকঢক করে প্রায় শেষ করে ফেললো জলের বোতলের জলটুকু।
তারপর শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বললো, আমায় নিয়ে চলুন প্লিজ। আমার একা একা ভয় করছে। না ঠিক ভয় নয়, ভালো লাগছে না।
দিগন্ত একটু চিন্তিত মুখে বললো, কিন্তু আমি তো দার্জিলিং যাবো না। আমি যাব রা-বাংলা। ওখান থেকে ট্রেকিং করে যাবো অজানা কোনো পাহাড়ে।
দেবলীনা নিজের জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেশ সাহসের সাথে বললো, আমিও ট্রেকিংয়ে যাবো। আমারও কখনো যাওয়া হয়নি ট্রেকিংয়ে, তবে বন্ধুদের মুখে শুনেছি দারুণ থ্রিলিং একটা ব্যাপার।
দিগন্ত হেসে বললো, বুঝলাম। একা একা ঘোরার ভয়েই আপনি আমায় পাকড়াও করেছেন, তাই তো? দেবলীনা ঘাড় নেড়ে বললো, একদম ঠিক ধরেছেন। ভেবে দেখলাম, এক যাত্রায় পৃথক ফল করে লাভ নেই। চলুন, চলুন আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে, আগে ব্রেকফাস্ট করে নিই, তারপর যাবো ওসব ট্রেকিংয়ে। না খেয়ে খালি পেটে কি যাওয়া যায়?
দিগন্ত দেখছিল দেবলীনাকে, কালকের গম্ভীর টাইপ, বিষণ্ণ মেয়েটা যেন কেমন পাল্টে গেছে সূর্যের কমলা রঙে। মুখটা একটু ক্লান্ত হলেও হাসিতে ঝলমল করছে। মেয়েটা এত হাসতে পারে বুঝি, কাল তো বোঝেনি দিগন্ত। দেবলীনা আবার বললো, বোঝো কাণ্ড, আমার কবি কবি ভাবটা দেখছি আপনার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে, সংক্রামক নাকি? খালি পেটে দাঁড়িয়ে কি এত ভাবছেন বলুন তো? আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে দোকান আবিষ্কার করে ফেলেছি। ওই ডানদিকে, এক বৌদি দারুণ কচুরি আর ঘুগনি বানাচ্ছে, গন্ধে আমার ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিল, নেহাত আপনাকে খোঁজার তাড়া ছিল বলে খেতে পারিনি। চলুন আপনাকে আজ দেশি ব্রেকফাস্ট করাবো। ধুর মশাই, আসুন না, সাতপাঁচ ভাবার কিছু নেই। আমি আপনার প্রেমে পড়িনি, বন্ধুত্ব চেয়েছি শুধু। আপনার পুচু সোনা বকবে না আপনাকে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি ফোনে বলে দেব রাইকে, যে সারারাত আপনি আমার মাথার কাছে বসে ছিলেন, আমার জ্বর বাড়ছে কিনা দেখার জন্য। আপনি বড্ড ভালো মানুষ।
দিগন্ত থমকে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি তো মশাই মারাত্মক মহিলা। নিজের ব্রেকআপ করে শান্তি হয়নি, আমারটাও করিয়ে ছাড়বেন! আপনি দার্জিলিং যাবেন, না কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদতলে বসবেন, তা আপনি বুঝুন, আমি চললাম। দেবলীনা হো হো করে হেসে বললো, আপনি দেখছি রাই সুন্দরীকে বেশ ভয় টয় পান। সে যাবেন ক্ষণ, আগে আপনার বৌদিভাইয়ের দোকানের কচুরিটা তো খেয়ে যান। দিগন্ত অবাক হয়ে বলল, আমার বৌদিভাই মানে? আমি তো তাকে চিনিই না।
না চিনলে কি আপন হয় না? কাল রাতের মহিলা যদি আপনার পিসিমণি হতে পারে, তাহলে এও আপনারই বৌদিভাই। আপনি সম্পর্ক দারুণ পাতাতে পারেন।
দিগন্ত মুচকি হেসে বললো, আপনি ঠিক রাইয়ের মত। রাইও এমন সরল ভাবে কথা বলে। আর সব সময় আমার লেগপুল করে।
দেবলীনা বললো, এক্সট্রা চার্জ লাগবে। এই যে রাইয়ের অনুপস্থিতিতে আপনি রাইয়ের ফ্লেভার পাচ্ছেন, তাই ওকে একটু কম কম মিস করেছেন, এ জন্য পুরো ক্রেডিট আমার। এইজন্য এক্সট্রা চার্জ লাগবে আমার।
দিগন্তর বেশ লাগছিলো এই সহজ শর্তবিহীন বন্ধুত্ব। কালকের অপরিচিত মেয়েটা যেন ওর কত চেনা।
বলে ফেলুন ম্যাডাম, কত ফিজ আপনার?
দেবলীনা বললো, প্রথমত আমায় ট্রেকিং করা শেখাতে হবে, দ্বিতীয়ত আমায় তুমি বলতে হবে, তৃতীয়ত এই ট্রিপের যাবতীয় খাবার খরচ আমার। ঘোরানোর দায়িত্ব আপনার।
দিগন্ত বললো, ওহ তার মানে আমার বৌদিভাইয়ের কচুরি খাইয়েই আপনি আমাকে রেহাই দেবেন না? গোটা ট্রিপটার চোদ্দটা বাজানোর জন্য পুরো প্ল্যান ছকে ফেলেছেন?
দেবলীনা ঘাড় দুলিয়ে হাসি মুখে বললো, সহযাত্রী হয়ে অসহায়, অবলা মহিলাকে আপনি এভাবে ফেলে দেবেন বলুন? আপনার পুচু সোনাও কিন্তু একজন নারী। ভেবে দেখুন, নারীর অবমাননা সে কিছুতেই মেনে নেবে না। পজেসিভনেস তখন ফেমিনিজিনমে বদলে যাবে। আপনার বিরুদ্ধে তৈরি হবে কড়া আইন।
দিগন্ত হেসে বললো, কবে থেকে করেন, স্কুল লাইফ থেকে, নাকি কলেজ লাইফে শুরু করেছেন?
দেবলীনা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলল, কি করি?
ড্রামা কবে থেকে শিখছেন? সেটাই জানতে চাইলাম। আর আপনার আবিষ্কৃত বৌদিভাইয়ের দোকানটা কি জলপাইগুড়ির মধ্যেই, নাকি বাইরে?
আর শুনুন, কাল রাত অবধি অবলা শব্দটা আপনার পাশে বসলে আমি নিমরাজি হয়ে মেনে নিতাম, কিন্তু এখন কোনোভাবেই মানতে পারবো না। আপনারা মহিলারা যদি নিজেদের অবলা বলেন, তাহলে তো আমাদেরকে মুক, বধির বলতে হয়।
দেবলীনা মুচকি হেসে বললো, ওই যে উনিই ঠাকুরপোকে ডাকছেন। চলুন, চলুন ভিতরে বেঞ্চে গিয়ে বসি।
দিগন্ত কচুরিতে কামড় দিয়েই বললো, বৌদিভাই, আপনার কতদিনের দোকান? এটা কি আপনি একাই সামলান?
দেবলীনা দেখছিল মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষটাকে। সাবলীল ভাবে মিশে যেতে পারে সকলের সাথে। বয়েসের পার্থক্য, ফ্যামিলি স্ট্যান্ডার্ড এসব যেন বড় তুচ্ছ ওর কাছে। মানুষ কত সাধারণভাবেও আনন্দ পেতে পারে, সেটা যেন শিখিয়ে দিয়ে যায় দিগন্তর জীবনবোধ। দেবলীনা যে কেন বারবার সৃজনের সাথে তুলনা করে ফেলছে দিগন্তর, সেটা ও নিজেও জানে না। সৃজনকে ও ছেড়ে এসেছে বা ভেঙে গেছে ওদের সম্পর্কটা, যেখানে আর ফিরতে চায় না ও। আর দিগন্ত শুধুই রাইয়ের। তাই দুজনের কেউই যখন ওর হবে না, তখন কেন বারবার এদের মধ্যে তুলনা টানছে কে জানে! কেন মনে হচ্ছে, সৃজনের পরিবর্তে যদি দিগন্তর সাথে দেখা হতো ওর, তাহলে হয়তো ভালোবাসা শব্দের অর্থ অন্যরকম হতো ওর কাছে। হয়তো দেবলীনাও রাইয়ের মত আগলে রাখতে চাইতো মানুষটাকে। যার কাছে ভালোবাসা মানে ডিস্কো ঠেক, ওয়েস্টার্ন ড্রেস আর আভিজাত্যের অহংকার নয়। এমন মানুষটাকে কেন দেবলীনা পেলো না!
কি হলো, খাচ্ছেন না কেন? আপনি কি ডিরেক্ট নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেকিং করবেন ভেবেছেন? এখান থেকে গাড়িতে যেতেই তো মিনিমাম ঘন্টা পাঁচেক। কচুরি হাতে বসে না থেকে তাড়াতাড়ি করুন।
দেবলীনা শান্ত গলায় বলল, আপনাকে বেশ বিপদে ফেললাম, তাই না?
দিগন্ত সবজে রঙের প্লাসটিকের জগের জলে হাতটা ধুয়ে বললো, এবারে পড়েছি ভীষণ বিপদে, একটু আগেই বন্ধুত্বের শর্তে রাজি হলাম, এখন আবার নানা রকম ফরম্যালিটিস করছেন! খাওয়ানোর দায়িত্ব যখন আপনার তখন বৌদিভাইকে পেমেন্ট আপনিই করুন। আমি একটা গাড়ি বুক করি…দিগন্ত দু পা এগোতেই দেবলীনা বললো, দাঁড়ান একসাথেই যাবো।
দিগন্ত মুচকি হেসে বললো, চিন্তা নেই, আপনাকে কলকাতার বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়েই বন্ধুত্বের শর্তপূরণ করবো। তার আগে পালাবো না।
রা-বাংলা অবধি একটা গাড়ি বুক করতেই দেবলীনা বললো, এটা কিন্তু দুজনে শেয়ারে দেব। দিগন্ত জানালার বাইরের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে বলল, বেশি হিসেবে করবেন না। যারাই বেশি হিসেব করে জীবন চালাবে ভাবে, তাদের জীবনটাই বড্ড এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে যায়। তাই মুহূর্তগুলোকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করুন। দেখবেন, জীবনটা অনেক সহজ। মান-সম্মান, ইগোর লড়াই, ঐতিহ্য, আভিজাত্যের দম্ভ সব কিছুর সীমানা ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসে দেখুন, একটা স্ট্রেইট লাইন অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য। যেখানে কোনো জটিলতা নেই। বন্ধুত্বের সংজ্ঞা সেখানে টিফিন বেলার ঘন্টা পড়ার মতোই স্বাভাবিক।
দেবলীনা বহুদিন পরে আবার প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলো। মাকে কল করে বললো, খুব ভালো আছি, একদম টেনশন করো না। যখন ফিরবো তোমার আগেকার লীনা হয়েই ফিরবো।
ওর কথা শেষ হতেই দিগন্ত বললো, পাল্টে গিয়েছিলেন বুঝি? তো এই কদিন নতুন বন্ধুত্বের খাতিরে আগেকার লীনাকে কি দেখার সৌভাগ্য হবে আমার?
দেবলীনা হাসি মুখে বললো, ঘাড় থেকে যখন নামাতে পারেন নি, তখন আমার সব বদভ্যেস দেখবেন বৈকি।
দিগন্ত জোর করে নিজেকে শাসন করে মনে মনে বললো, উঁহু এই মেয়েটার প্রতি দুর্বল হলে কিছুতেই চলবে না। রাইয়ের কাছে মিথ্যেবাদী প্রতিপন্ন হয়ে যাবে তাহলে। কেন কে জানে, কাল থেকেই দেবলীনাকে যতবার দেখছে, ততবার মনে হচ্ছে ঠিক যেন রাই। এত মিল ওর সাথে রাইয়ের স্বভাবের, যে মিশিয়ে ফেলছে দিগন্ত। ফিসফিস করে নিজের মনেই বললো, রাই, দিগন্ত শুধুই তোমার থাকবে।
।। ৮।।
তারপর বলুন দেখি এত উদাস হয়ে কি ভাবছিলেন? অবশ্য বিশাল পাহাড়ের সামনে মানুষ যে ঠিক কতটা নগণ্য, সেটা ভাবতে গেলে উদাস হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
রা-বাংলার ছোট্ট ব্যালকনির মত ছাদের বেতের চেয়ারে বসেছিলো দেবলীনা। ওর ঘরের লাগোয়া এই ব্যালকনিটা। যদিও এটা এদের হোটেলের তিনতলার কমন ব্যালকনি, তবুও অফ সিজন বলেই হয়তো লোকজন তেমন নেই হোটেলে। দিগন্ত অনেক চেষ্টা করেও পাশাপাশি দুটো রুম বুক করতে পারেনি। কারণ ওর রুম বুক করাই ছিল। তাই দুটো রুম পরে দেবলীনার রুমটা পাওয়া গেছে। একই ফ্লোরে তাই অসুবিধা কিছুই নেই। ও এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, পাশের রুমের বোর্ডারদের দেখলেন নাকি? আমি কাল থেকে ওদিকের একটা কাপেল ছাড়া আর কাউকেই দেখিনি। দেবলীনা ঘাড় নেড়ে বললো, এরা বোধহয় আজ আসবে। সকালে ঘর দুটো ওয়াশ হচ্ছিল দেখলাম।
বললেন না তো, সৃজনের সাথে কি ভাবে আলাপ হয়েছিল? দিগন্ত চায়ের কাপ হাতে সামনের চেয়ারে বসে পড়লো। দেবলীনা বললো, বলতে পারেন সিনেমার মত করেই পরিচয় হয়েছিল আমার সাথে সৃজনের। মডেলিং করেছিলাম ওদের গোল্ড এমপরিয়াম কোম্পানির হয়ে।
তখনই আমায় দেখে নাকি সৃজন প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। প্রথম দর্শনেই প্রেম বুঝলেন।
দিগন্ত হেসে বললো, এতে আমি সৃজনবাবুর তেমন দোষ দেখি না। প্রথম দর্শনে প্রেমে আমিও বিশ্বাসী। কি বলুন তো, যাকে দেখে মনের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার হবে, মনে হবে এরকম অনুভূতি তো আগে কখনো হয় নি, ইন্দ্রিয়রাও বিদ্রোহ করে বলবে, এই সে। তখনই বোধহয় ঘটে লাভ অ্যাট ফার্স সাইট।
দেবলীনা নরম গলায় বলল, আর কিছুদিন পরেই যখন বুঝবেন দুজনের মানসিকতায় বিস্তর ফারাক, তখন কি করবেন? যখন বুঝবেন ভালোবাসাটা ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়ে লোকদেখানো ভদ্রতা বা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায়ে পরিণত হয়েছে, তখন কি করবেন?
দিগন্ত বললো, শান্ত ভাবে বেরিয়ে আসবো অর্ধমৃত সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে।
দেবলীনা করুণ হেসে বললো, সেটাই তো করলাম আমরা। মিউচ্যুয়াল ব্রেকআপ বলতে পারেন, মিউচ্যুয়াল ডিভোর্সের মতই। দুজনের সম্পূর্ণ মত নিয়ে বিচ্ছিন্ন হলাম। কিন্তু মুশকিল কি বলুন তো, কিছুতেই ভুলতে পারছি না ফেলে আসা মুহূর্তগুলোকে। তাই নিজের সাথে চলছে অহরহ দ্বন্দ্ব। যন্ত্রণাগুলো কিছুতেই জমাট বাঁধছে না যে, এখনও তরল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রক্তবাহী শিরা, উপশিরা দিয়ে।
দিগন্ত হালকা গলায় বলল, জোর করে ভুলে থাকার চেষ্টাই বা করছেন কেন? কে বলেছে, প্রাক্তন মানেই তার সবটা খারাপ, তাকে ভুলতে হবে? ছোটবেলার সব স্মৃতি কি ভুলে গেছেন? স্কুলের বেস্টফ্রেন্ডকে একেবারেই ভুলে গেছেন কি?
মনে নিশ্চয়ই আছে, দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে, তাই ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে গেছে তার স্মৃতি, তাই না? যখন অন্য স্কুলে চলে গেলেন, তখন কি জোর করে তাকে ভুলতে চেয়েছিলেন? বরং মনখারাপ হয়েছিলো, তারপর আস্তে আস্তে স্মৃতির পাতাগুলো ধূসর হয়ে গিয়েছিল। জোর করে ভুলতে চাইবেন না, তাহলে আরও বেশি করে মনে পড়বে তাকে। সময় দিন, ধূসর হতে একটু সময় তো লাগবেই।
দেবলীনা দিগন্তর হাতটা নরম করে ধরে বলল, থ্যাংক ইউ বলবো না, শুধু বলবো, সঠিক সময়ে এভাবে পাশে দাঁড়ালেন, এর জন্য আপনাকে দিলাম ওই দূরের পাহাড় চূড়ার মাথায় জমে থাকা একমুঠো সোনালী বরফ। দেখুন, সূর্যের আলো পড়ে বরফটা কেমন সোনার মত লাগছে। দিগন্ত দেবলীনার হাত থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললো, এবারে কিন্তু সত্যি আমার পুচু সোনা রাগ করবে। আমি একজন সুন্দরী মহিলার হাত ধরে বসে আছি জানলে রেগে আগুন হবে। দেবলীনা হেসে বললো, জানি, আপনি শুধুই রাইয়ের। কিন্তু ওই যে বললেন, মুহূর্তটুকুকে নিয়ে বাঁচতে, তাই স্পর্ধা দেখিয়ে ফেলেছিলাম।
আরে কি মুশকিল, আপনি কথায় কথায় এত সিরিয়াস কেন হয়ে যাচ্ছেন বলবেন? চলুন, রেডি হয়ে নিন। আমি পাহাড়ে চরবো, এখানের লোকাল ট্রেকিং সেন্টারের সাথে কথা বলে রেখেছি। ওরা হেল্প করবে। আপনি নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন। দেবলীনা মুখ ভেঙচে বললো, কেন আমি কি ভীতু না বাচ্চা, যে আমি নিচে দাঁড়িয়ে থাকবো? আমিও চরবো পাহাড়ে।
দিগন্ত একটু হেসে বললো, ও ম্যাডাম, এটা পাহাড়ে ওঠার কথা হচ্ছে, আপনার ফ্ল্যাটের লিফট দিয়ে পাঁচ তলায় ওঠার কথা হচ্ছে না।
দেবলীনা আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো, আমি ট্রেকিং করার মত ড্রেস পরে রেডি হয়ে নিচ্ছি। বাই দ্য ওয়ে, আমরা কোন পাহাড়ে উঠবো?
দিগন্ত ওর অ্যাটিটিউড দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, সত্যিই যাবেন নাকি? কি যন্ত্রণা, আর পাহাড়ের নাম জেনে কি করবেন, ফেসবুকে আপডেট দেবেন?
দেবলীনা ঘাড় বেঁকিয়ে বললো, ওয়েট, আমি রেডি হয়ে আসছি।
।। ৯।।
গাড়িটা এসে থামলো রঙ্গীত নদীর ধারে। দিগন্ত বললো, জানেন এখানে জানুয়ারি-ফ্রেব্রুয়ারী মাসে এলে গরম জলের ধারা দেখা যায়। আর আগস্টে এলে এদের স্থানীয় উৎসবে সামিল হওয়া যায়। পাহাড় আমায় বড্ড টানে, তাই মাঝে মাঝেই ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি পাহাড়ের খোঁজে। পাহাড়ের একটা অদ্ভুত রহস্যময়তা আছে, একটু আগেও বোঝা যায়না পরের বাঁকে আপনার জন্য কি অপেক্ষা করছে। এদিকে হয়তো কুয়াশা রানী তার ঘন আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে কোলের সন্তানকে, আবার ওদিকে দামাল বাচ্চারা সূর্যের প্রখর রোদে লাফালাফি করে খেলছে। তাই সবটাই বড্ড রহস্যে মোড়া।
দেবলীনা রঙ্গীত নদীর স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার আরেকটা শর্ত আপনি কেন মানলেন না, সেটাই তো আমার কাছে রহস্য। বলেছিলাম, আমায় তুমি বলুন, সেই আপনিতেই রয়ে গেলেন।
দিগন্ত হাসি মুখে বললো, সম্বোধনে কি আসে যায়! আমি রাইকে ছোটবেলায় তুই বলতাম। তারপর যখন ওর প্রেমে পড়লাম, তখন ওর আব্দারে ওকে তুমি বলা অভ্যেস করতে হয়েছে অনেক কষ্টে।
দেবলীনা একটু বিরক্ত হয়েই বললো, প্রতি মুহূর্তে রাইকে উদাহরণ হিসেবে না টানলেও আমি বুঝতে পারি আপনার সব কথাই। চলুন, আমিও পাহাড়ে উঠবো।
আমরা কোন পাহাড়ে উঠবো? দিগন্ত বললো, কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু, পান্ডিম হলো এই শহরের প্রতিবেশী পর্বত শৃঙ্গ। এদের চূড়াগুলো বরফে ঢাকা থাকে। পান্ডিমের কিছুটা ওপরে আমরা উঠবো ঠিক করেছি, সবটা সম্ভব নয়। কিন্তু আমার মনে হয়, আপনার না ওঠাই ভালো। দেবলীনা গম্ভীর ভাবে বললো, কেন রাই কখনো আপনার সাথে ট্রেকিং করেনি বলেই কি চাইছেন না, যে এই অভিজ্ঞতা আপনার সাথে আমার প্রথম হোক?
দিগন্ত বেশ বুঝতে পারছিল দেবলীনা ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিল। মনে মনে বললো, না কিছুতেই না, দেবলীনাকে কিছুতেই আর কাছে আস্তে দেওয়া যাবে না।
মেয়েটা সবে মাত্র কষ্টগুলো থেকে রিলিফ পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, হয়তো দিগন্তকে সামনে পেয়ে খড় কুটোর মত অঁকড়ে ধরতে চাইছে, কিন্তু মেয়েটাকে আর যন্ত্রণা পেতে দিতে পারে না ও। দেবলীনা সত্যিই বড্ড ভালো মেয়ে। পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে যদি ওকে কেউ জিজ্ঞেস করে, পাহাড়কে সাক্ষী রেখে সত্যি করে বলতো, দেবলীনাকে এক মুহূর্তের জন্যও তোমার ভালো লাগে নি? তাহলে অস্বীকার করার মত মনের জোর ওর অবশিষ্ট নেই। দেবলীনা ভালোলাগার মতই মেয়ে। আর সেই জন্যই চিন্তা হচ্ছে ওকে নিয়ে, কিছুতেই যেন মেয়েটা ওর কাছ থেকে কোনোরকম দুঃখ না পায়।
দিগন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে মজার ছলেই বললো, দেখবেন, পাহাড়ে চড়তে গিয়ে পা ভেঙে বাড়ি যাবেন না যেন, তাহলে আপনার বাবা আমার নামে কেস করবে।
দেবলীনা বললো, চিন্তা করবেন না, যা করবো নিজের দায়িত্বে করবো। দিগন্ত বেশ বুঝতে পারছিল, দেবলীনা ওর ইগনোরেন্সটাকে মেনে নিতে পারছে না, কিন্তু দিগন্ত নেহাতই নিরুপায়।
দেবলীনা কথা না বলে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। গাড়িতে বসেও বেশি কথা বলছিল না ও। দিগন্ত চেষ্টা করছিল পরিবেশটাকে সহজ করার, কিন্তু ও কিছুতেই আর সহজ ভাবে হাসতে পারছিল না। দিগন্তর বলা অনেক কথার উত্তরে দু একটা হুঁ, হ্যাঁ ছাড়া চার ঘন্টার পথে তেমন কথাই হলো না ওদের।
বোরং থেকে পান্ডিমের পাদতলের দিকে চলেছে ওরা। পান্ডিমের সামনেই হয়েছে ট্রেকিং ক্যাম্প। সারাবছরই এখানে ট্রেকিংয়ের ভিড় থাকে। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বাঙালির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। গাড়ি থেকে নামার সময় দিগন্ত দেখলো, দেবলীনা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর কপালের ওপরে এক গুচ্ছ চুল এসে পড়েছে। আড়াল করে রেখেছে ওর দুই ভ্রূর মাঝের ছোট্ট কালো টিপটাকে। নাকের হিরের ফুলটা সকালের রোদ পড়ে ঝিকমিক করে উঠলো। দিগন্ত সব ভুলে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। দেবলীনার থুতনির ভাঁজে একটা অদ্ভুত দৃঢ় অথচ আদুরে ভঙ্গিমা আছে। যখন ও গম্ভীর হয়ে যায় তখন থুতনির ভাঁজের দৃঢ়তা বলে দেয়, মেয়েটা প্রয়োজনে কঠিন হতে জানে। আবার যখন আব্দার করে কিছু চায়, তখন ওই কঠিন হওয়া ভাঁজটাই আদুরে ভঙ্গিমায় একমুঠো আদর চায় যেন। ট্রাকসুট টাইপের ডার্ক ব্লু একটা সেট পরেছে দেবলীনা। বোধহয় ট্রেকিং করবে বলেই। দিগন্ত মুচকি হেসে বললো, থাক ঘুমুক, ডেকে কাজ নেই। মাথার পোকাটা নড়লেই মুশকিল। শেষে হাত, পা ভেঙে পড়ে থাকবে। দিগন্ত পিছন ঘুরতেই গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়লো দেবলীনা, আলতো করে বললো, ঘুমন্ত আমার দিকে তাকালে বুঝি আপনার রাই কিছু বলবে না? তা আমায় না ডেকে চলে যাচ্ছিলেন যে বড়?
দিগন্ত একটু লজ্জা পেয়ে বললো, আপনি একটু ওয়েট করুন, আমি রাইকে একটা কল করে উঠবো পাহাড়ে। এতক্ষণ ফোন সুইচ অফ থাকলে ও টেনশন করবে। দেবলীনাকে আবার যেন সজোরে পাথুরে মাটিতে আছড়ে ফেললো দিগন্ত। বুঝিয়ে দিলো, ওর ওপরে শুধুই রাইয়ের অধিকার। দেবলীনাও চায়না দিগন্তর জীবনে ওর জন্য কোনোরকম ঝড় নেমে আসুক। দিগন্ত ওর দিকে যে ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তারপর ওর দ্বারা কোনো ক্ষতি হলে, নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না দেবলীনা। সব জানা সত্ত্বেও অবুঝ মনটা কেন যে বারবার দিগন্তকে আপন করে পেতে চাইছে, সেটা ও নিজেও জানে না। কেন যে অদেখা রাইকে মনে মনে হিংসে করছে সেটাও বুঝতে পারছে না। সৃজনের সাথে ওর প্রায় তিনবছরের সম্পর্ক ছিল, কখনো তো এমন অনুভূতির সম্মুখীন হয়নি ও। এমন তোলপাড় করা ঝড় কোনোদিন তো ওঠেনি ওর মনের অন্দরে। দিগন্তকে পিছনে ফেলেই ও এগিয়ে গেলো ক্যাম্পের দিকে। জীবনে কোনোদিন ভাবে নি ও ট্রেকিং করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা অদ্ভুত জেদ কাজ করছে ওর মধ্যে। ও দিগন্তকে দেখিয়ে দেবে, রাই যা পারেনি, ও সেটা পেরেছে। কারণ ছাড়াই এ ভ্রান্ত লড়াইয়ে সামিল হয়ে গেছে দেবলীনা। ট্রেকিংয়ের জিনিসপত্র বুঝে নিচ্ছিলো দেবলীনা। তখনই দিগন্ত এসে বেশ গম্ভীর গলায় বলল, একা আগে আগে উঠবেন না, ঠিক আমার পিছনে থাকবেন। আপনার পিছনে থাকবে ওই ব্লু জ্যাকেটের ছেলেটি। কোনো সমস্যা হলেই আমাদের দুজনকে ডাকবেন, অবাধ্য হবেন না প্লিজ। দেবলীনা অল্প হেসে বললো, বাধ্য আর হতে পারলাম কোথায়, চিরকালের অবাধ্য হয়েই যে রয়ে গেলাম।