৫.
চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি দুর্গ পরিক্রমা করছেন। স্বয়ং রাজমাতা কুন্তী দেবী আজ অতিথিদের দুর্গ পরিক্রমায় তাঁদের সঙ্গী হয়েছেন। গতকালই চাণক্য অমাত্যকে দুর্গ পরিভ্রমণ করার ইচ্ছা জানিয়েছিলেন। আজ কুন্তী দেবী নিজেই এসে জানিয়েছেন যে যুবরাজ ও অমাত্য, দু-জনেই আজ খুব ব্যস্ত থাকায় তিনিই এসেছেন।
দুর্গর বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বর্ণনা করে যাচ্ছিলেন,
—এই দুর্গর দুটো মহল। উত্তর ও দক্ষিণ। এই উত্তর মহলের পাঁচতলায় থাকতেন মহারাজ মহিপাল স্বয়ং। তার ওপরের তলা ফাঁকা। কারণ রাজার জায়গা সবচেয়ে ওপরে হওয়াই নিয়ম। বলদেব থাকে উত্তরেরই চারতলায় এবং প্রধান-অমাত্য মহাশয় দোতলায়। আপনাদের অতিথি কক্ষ দুটো উত্তর মহলের তিনতলায়। বাসিন্দাদের নিজস্ব দাস-দাসী থাকে একদম নীচের তলায়।
দুর্গর বারান্দা থেকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছেন কুন্তী দেবী।
—আপনি এবং আপনার ছেলে?
—আমরা থাকি দক্ষিণ মহলে আপনার মুখোমুখি। অর্থাৎ তিনতলায়। আমি এবং অন্যান্য কিছু দাসী থাকতাম এই তলায়। তবে বৈধব্য জীবন পালন করতে আমি তাদের স্থানান্তরিত করেছি। বর্তমানে আমি একাই পুরো তলাটা জুড়ে থাকি। ছেলে রবিনাথ অবশ্য আমার ওপরের তলাতেই, অর্থাৎ চারতলাতেই এতদিন থেকে এসেছে। তবে আজ থেকেই অমাত্যর পরামর্শে তাকে উত্তরের মহলে, মহারাজের ঘরে স্থানান্তরিত করা হবে। দোতলায় থাকেন রানি কৌশল্যা আর তাঁর ছেলে রাজকুমার বিরাট। দক্ষিণ মহলের সবার ওপরের দুটো তলা ফাঁকা। কেউই বসবাস করে না। একসময়ে রাজবংশের প্রচুর সদস্য ছিল বলে শুনেছি। সেই সময়ে এই সবকটা ঘরই ব্যবহার হত। এখন সেই বড়ো পরিবার অথবা এত দাস-দাসী পালন করার সামর্থ্য ও প্রয়োজন কোনোটাই নেই।
চাণক্য প্রশ্ন করলেন,
—বেশ, বেশ। রাজকুমার বলদেব কেমন আছেন এখন?
ঠোঁট একবার চেপে রাজমাতা বললেন,
—সেই সন্ধের পর থেকে সে নিজের ঘর থেকে বিশেষ বের হয়নি শুনেছি। আপনারা কি তার সঙ্গে দেখা করতে চান?
—অবশ্যই। তাঁকে কিছু প্রশ্ন করার আছে।
এই কথায় চকিতে পায়চারি থামিয়ে দেন কুন্তী দেবী। চাণক্যর দিকে ঘুরে দাঁড়ান মুখোমুখি। বললেন,
—আচার্য, রবিনাথ আপনাদের কী বলেছে আমি গতকাল তারই মুখে তা শুনেছি। আপনি পণ্ডিত মানুষ। আমার ছেলের এই কল্পকথায় আপনি প্রভাবিত হবেন না দয়া করে। তার মনে একটা ভয়ংকর সন্দেহ উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু এ অসত্য এবং অমূলক। মহারাজের মৃত্যু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
—হুমম। কিন্তু এক সন্ন্যাসীর প্রেতমূর্তি শুনেছি মহারাজ দেখতে পেতেন? আপনি কি কখনো সেই অবয়ব চাক্ষুষ করেছেন?
—না। কখনোই নয়। ওটা মহারাজের কল্পনামাত্র।
কথা বলতে বলতেই রাজকুমার বলদেবের ঘরের কাছে এসে হাজির হয়েছেন তাঁরা। রাজকুমার দু-দিন আগেই যুবরাজের পদ থেকে স্খলিত হয়েছেন। অতএব তাঁর যে মাথার ঠিক থাকবে না তা অনুমান করেই চাণক্য তাঁর তরফ থেকে যেকোনো দুর্ব্যবহারের জন্যেই প্রস্তুত হয়ে নিলেন। মৃদু করাঘাত করতেই ভেতর থেকে এক অল্পবয়সি রমণী এসে দরজা খুলে দিল। রমণীর পরনের স্বল্প পোশাক এবং উগ্র সাজ দেখেই অনুমান করা যায় যে এই নারী একজন নর্তকী। রাজপুরুষদের চিত্ত বিনোদনের জন্যে এদের অন্তঃপুরে স্থান দেয়া হয়। ভেতরে আরও দুই নারীর মাঝখানে রাজকুমার বলদেব বসে আছেন। একজন তাঁর মুখে পানপাত্রে সুরা তুলে দিচ্ছে এবং অন্যজন তাঁর শরীরের ওপর শরীর এলিয়ে বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁদের দেখেই ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠল,
—আরে, আরে। এ যে স্বয়ং রাজমাতা! কী সৌভাগ্য আমার। ওরে তোরা কে কোথায় আছিস? শাঁখ বাজা! পুষ্পবৃষ্টি কর। হা-হা-হা। দাসী যে রাজমাতা হয়েছে। কী আনন্দ! কী আনন্দ!
লজ্জায় কুন্তী দেবীর মুখ লাল হয়ে উঠল। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। গোটা ঘর সুরা এবং সুগন্ধি আতরের গন্ধে ম-ম করছে। এই দু-দিন রাজকুমার বলদেব যে খাবারের চেয়ে পানীয় সেবন বেশি করেছেন তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। চাণক্য এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে,
—আপনাকে কি কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?
—আমার থেকে অনুমতি চাইছেন নাকি? অনুমতি দেয়ার আমি কে? রাজমাতার থেকে অনুমতি নিন। হে হে। রা-জ-মা-তা!
তাঁর ব্যঙ্গোক্তি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,
—বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার কী ধারণা?
—অভিশাপ।
—আপনি বিশ্বাস করেন উনি প্রেতের হাতে খুন হয়েছেন?
—অবশ্যই। আমি নিজে দেখেছি ওই সন্ন্যাসীর প্রেতকে।
—তাই নাকি? তা তাকে কেমন দেখতে?
—ঝাঁকড়া চুল, বিশাল বপু, এক হাতে রুদ্রাক্ষ জড়ানো আর গলায় আরও দুটো রুদ্রাক্ষের মালা। পরনে আলখাল্লা এবং হাতে নরবলির খড়া। চোখ তার জ্বলে কয়লার মতো। যান যান। গ্রেফতার করুন তাকে। কারাগারে দিন।
·
—রাজকুমার বলদেব!!
চিৎকার করে উঠেছেন কুন্তী দেবী। রাগতভাবে তিনি চেয়ে আছেন রাজকুমারের দিকে। ঘরে থাকা তিন রমণীর উদ্দেশে বললেন,
—বেরিয়ে যাও! এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও। আর এই সমস্ত সুরা নিয়ে যাও। রক্ষী! রক্ষী! রাজকুমারকে সুস্থ স্বাভাবিক করতে এখনই ব্যবস্থা নেয়া হোক।
বলদেব হাতে ধরা পানপাত্রটা ছুড়ে মারল তার বিমাতার মাথা লক্ষ করে। তিনি বোধ হয় এইরকম আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিলেনই। সময়মতো একদিকে সরে গিয়ে বাঁচলেন তিনি। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে দেখেই রাগে ফেটে পড়ল রাজকুমার।
তিন জন যখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, তখনও প্রচণ্ড নোংরা কটূক্তির বর্ষণ চলছে ভেতর থেকে।
.
চাণক্যকে একটু একান্তে পেয়ে জীবসিদ্ধি বলল,
—আচার্য! এ তো পুরোপুরি মাতাল।
—হুম। কিন্তু প্রেতের বর্ণনা বেশ আশ্চর্য রকমের পুঙ্খানুপুঙ্খ।
৬.
বাকি সময়টা কুন্তী দেবী অতিথিদের সঙ্গ দিলেন না। বলদেবের আচরণে তিনি লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং এক ভৃত্যকে তাঁদের সঙ্গে দিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে নিজে বিদায় নিলেন।
.
—সত্যিই মহীয়সী স্ত্রীলোক। এইভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় সামলানোর জন্যে ধৈর্য লাগে।
প্রশংসার সুরে বলে ওঠে জীবসিদ্ধি।
—হুমম। তা বটে। সে-বিষয়ে কোনো দ্বিমত হবে না।
ভৃত্য তাঁদের পুরো উত্তর মহল দেখিয়ে সব শেষে তাঁদের নিয়ে ঢুকল একটা বড়ো ঘরে। নাকে ভেষজ রঙের গন্ধ লাগল। ঘর জুড়ে বহু চিত্র। আবার কিছু অসম্পূর্ণ আঁকাও চোখে পড়ে। সঙ্গে কিছু আছে শুধুই সাদা- কালোয় ফুটিয়ে তোলা চিত্র। এগুলো রঙিন আঁকাগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।
—এই দুর্গে কেউ শিল্পকলায় এরকম পারদর্শী তা তো আগে জানতাম না। প্রতিটি চিত্রই অপূর্ব।
প্রশংসার সুরে বললেন চাণক্য। উত্তরে ভৃত্য বলল,
—আমাদের মহারাজ মহিপাল শখের শিল্পী ছিলেন। এইসব রঙিন চিত্র উনি বানাতেন।
—হুমম। কিন্তু ওই সাদা-কালো চিত্রগুলো? ওগুলোও কি ওঁরই কাজ? ওগুলো তো একদম আলাদা ধরনের।
—ওগুলো রাজকুমার বলদেবের।
—বাহ! অপূর্ব। বাবা ছেলের এই শখের কথা তো আগে কেউ বলেনি। তাদের মনে একটা শিল্পীসত্তা আছে দেখছি। কিন্তু একটা বিষয় বুঝলাম না। রাজকুমারের অঙ্কিত সমস্ত চিত্রই রংহীন কেন?
—কারণ রাজকুমার বলদেব রং দেখতে পান না, আচার্য।
—বর্ণান্ধ?
কথাটা বুঝতে না পেরে ভৃত্য প্রশ্ন করল,
—সে কী বস্তু, আচার্য?
—কিছু না। রঙের পার্থক্য না করতে পারার এক বিশেষ সমস্যা। যাক গে। যদিও আমার মধ্যে শিল্পীসত্তা অতি ক্ষীণ। তবে এইটুকু বুঝতে পারি যে সব চিত্রই বড়ো সুন্দর। সাদা-কালোগুলোও নিজের মতো করে সুন্দর। তোমার কী অভিমত, জীবসিদ্ধি?
জীবসিদ্ধিও সম্মত হল যে চিত্রগুলো বাবা ছেলের উৎকৃষ্ট শিল্প-জ্ঞানের প্রমাণ দেয়।
.
বেরিয়ে এসে, ভৃত্যর দেখানো পথে, দুই মহলের মাঝখানের সেতু পেরিয়ে তাঁরা দক্ষিণ মহলে পৌঁছোলেন। সিঁড়ি ধরে নেমে গেলেন দোতলায়। ছোটোরানি কৌশল্যা বাইরে বারান্দায় নিজের ছেলের সঙ্গে বসে আছেন। অতিথিদের আসতে দেখেই বিরাট ভয় পেয়ে মায়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। রানি কৌশল্যা মৃদু হেসে বললেন,
—ও নতুন লোকদের ভয় করে। আপনারা ওর ব্যবহারে ক্ষুণ্ণ হবেন না, ব্রাহ্মণদেব।
—না, না। আমরা বুঝতে পারছি। ওর বয়স কত হল মহারানি?
—এই ভাদ্র মাসে ষোলো বছর পূর্ণ হবে।
—বেশ, বেশ।
বিরাটের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন চাণক্য। তা দেখে আরও একটু আড়ালে লুকিয়ে পড়ল বিরাট। তার আচরণের ব্যাখ্যা দেয়ার ভঙ্গিতে রানি বললেন,
—আমার ছেলে বুদ্ধির দিক থেকে শিশু, আচার্য। কিছুই বোঝে না। অথচ তিরস্কার ছাড়া কিছুই জোটেনি ওর কপালে। বাবার ভালোবাসা থেকেও ও বরাবরই বঞ্চিত ছিল। কারণ ওর অস্বাভাবিকতা। শুধু কুন্তী দিদি আর রবি কোনোদিন ওর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেনি।
—মাতৃস্নেহ এই জগতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা, মহারানি। আপনার ছেলে সেই স্নেহ থেকে মোটেই বঞ্চিত নয়। সেটাই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। এইবার রবিনাথ সিংহাসনে বসলে আপনাদের মঙ্গলই হবে।
মাথা নত করলেন রানি কৌশল্যা। চাণক্য এইবার প্রসঙ্গ বদলে প্রশ্ন করলেন,
—আচ্ছা, আপনার স্বামী অর্থাৎ মহারাজের মৃত্যু সম্বন্ধে আপনার কী অভিমত?
একটুও না ভেবে দ্রুত উত্তর দিলেন রানি,
—কোনো ধারণাই নেই, আচার্য। অস্বাভাবিক ছেলে জন্ম দেয়ার পুরো দায় উনি আমার ওপর দিয়ে আমায় প্রায় বিতাড়িত করে দেন। এই মহলে আমাদের দু-জনের প্রায় নির্বাসিত জীবনই কেটেছে। আমারও এত বছরে সবসময় আড়ালে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। মহারাজের সঙ্গে আমার অনেক বছর কোনো যোগাযোগই ছিল না। তাই তাঁর সম্পর্কে কোনোরকম তথ্য দিতেই আমি অপারগ। সব কিছুর থেকে দূরে, নির্বিবাদে বাকি জীবন এই ছেলেটাকে নিয়েই কাটিয়ে দেব।
রানি কৌশল্যার চোখের কোণে জলের ফোঁটা দেখা গেল।
চাণক্য আবার প্রশ্ন করলেন,
—আপনি কখনো উত্তর মহলের জানলায় প্রেতমূর্তি দেখেছেন?
—না। তবে অনেকের মুখে এরকম কথা শুনেছি।
এতক্ষণে বিরাট একটু স্বাভাবিক হয়ে বেরিয়ে এসেছে মায়ের আড়াল থেকে। মেঝেতে বসে আছে। জীবসিদ্ধি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে নরম সুরে বলল:
—তোমার নাম কী রাজকুমার? নাম। তোমার নাম?
—র… রবি। রা… বি।
জীবসিদ্ধি মৃদু হেসে উঠল। রবিনাথ সত্যিই বেশ প্রিয় ব্যক্তি এই বালকের কাছে। শিশুরা অনেক সময় নিজের প্রিয় মানুষের নাম নিজের নামে বলে থাকে। এও তাই করছে।
চাণক্য তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।
আজ বিদায় দিন, মহারানি। আপনার মতো মা পাওয়া একজন ছেলের পক্ষে সৌভাগ্যের।
প্রণাম জানিয়ে বেরিয়ে এলেন দু-জন। ভৃত্যর সঙ্গে, ওপরতলার মহল পরিদর্শন করলেন বাকি সময়টুকু।
৭.
গভীর রাত। আচমকা তীব্র আর্ত চিৎকারে সারা দুর্গ কেঁপে উঠল। ঘুম ভেঙে যায় চাণক্যর। গলা চিনতে অসুবিধা হয় না। রবিনাথ। তার ওপর আক্রমণ হয়েছে নিঃসন্দেহে। আর্তনাদ ভেসে এল দক্ষিণের মহল থেকে।
দ্রুত নিজের ঘরের জানলায় এসে দাঁড়ালেন চাণক্য। যে দৃশ্য দেখলেন তাতে ওঁর মতো লৌহ-স্নায়ু মানুষও কেঁপে উঠলেন এক মুহূর্তের জন্যে।
দক্ষিণ মহলের একটা জানলায়, প্রদীপের মৃদু হলদে আলোয়, রবিনাথকে দেখা যাচ্ছে। জানলার ধারে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে। তার ঠিক পেছনেই তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে এক সন্ন্যাসী মূর্তি। মৃদু আলোয় তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। শুধু আলখাল্লা পরা অবয়বটা দেখা যাচ্ছে। অবয়বটা রবিনাথের দুই কাঁধে হাত দিয়ে রয়েছে। পরমুহূর্তে মূর্তিটার হাতে ঝালক দিয়ে উঠল একটা বড়ো কৃপাণ। বিদ্যুদ্বেগে সে সেটা চালিয়ে দিল রবিনাথের গলা লক্ষ করে। এধার থেকে ওধার টেনে দিল কৃপাণটা। তারপর মৃদু ধাক্কায় রবিনাথের দেহ ফেলে দিল নীচে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীতে। চোখের সামনে যুবরাজের দেহ মিলিয়ে গেল অতল অন্ধকারে। শুধু জলে দেহ পতনের শব্দ এল কানে। পরমুহূর্তে দক্ষিণের জানলায় জ্বলতে থাকা প্রদীপ নিভে গেল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে অদৃশ্য হল আততায়ী মূর্তি।
ঘটনার আকস্মিকতায় কয়েক মুহূর্ত চাণক্য বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন জানলা আঁকড়ে ধরে। তিনি এখনও নিশ্চিত হতে পারছেন না যে এটা দুঃস্বপ্ন নাকি সত্যিই তিনি এইমাত্র একটা হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করলেন।
ঘোর কাটতেই তিনি উপলব্ধি করলেন যে একটু আগেই তিনি যা চাক্ষুষ করলেন, সেটা একটা ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড। বাস্তব। নিশ্চয়ই তিনি একা নন, উত্তর মহলের প্রতিটি বাসিন্দা এই ঘটনা দেখেছে। দ্রুত তিনি গুনলেন কোন তলার এবং সিঁড়ির দিক থেকে কত নম্বর ঘরে ঘটল ঘটনাটা। প্রায় প্রতি তলায় একটা বা দুটো প্ৰদীপ জ্বলছে, যার ফলে প্রতি তলার দুটো একটা জানলা আলো হয়ে রয়েছে। সেই মতো, একদম নীচের তলা থেকে গুনে দেখলেন চার তলার ঘর সেটা। তবে অন্ধকারে সেটা সিঁড়ির থেকে কোন ঘর তা ঠিক অনুমান করতে পারলেন না। তবে সম্ভবত সেটা রবিনাথের পুরোনো ঘর।
দ্রুত নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন চাণক্য। ততক্ষণে সারা উত্তর মহলে কোলাহল শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ শুধু তিনি একা নন। উত্তর মহলের সব বাসিন্দাই এই দৃশ্য চাক্ষুষ করেছে ঠিকই। পাশের ঘর থেকে হতবাক দৃষ্টি নিয়ে বেরিয়ে এল জীবসিদ্ধি।
—আচার্য! আচার্য! প্রেত… রাজা… হত্যা…
—দেরি নয়! দ্রুত চলো দক্ষিণ মহলে।
চাণক্য দেয়াল থেকে একটা জ্বলন্ত মশাল তুলে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটলেন দুটো মহলের মাঝের সেতুপথের দিকে। ততক্ষণে একদল সৈনিকও তাদের পিছু নিয়েছে। সেতু পার করে দক্ষিণ মহলে আসতেই দেখলেন নিজের ঘর থেকে কুন্তী দেবী বিহ্বল ভঙ্গিতে বেরিয়ে এসে নিজের দরজা বন্ধ করছেন। ওঁর চোখে জিজ্ঞাসু এবং আতঙ্কিত দৃষ্টি। তিনিও নিজের ছেলের আর্তনাদ শুনেছেন নিঃসন্দেহে। তাঁদের দেখে তিনি ছুটে এলেন চাণক্যর কাছে সিঁড়ির দিকে। ততক্ষণে নীচের সিঁড়ি থেকেও লোকজনের উঠে আসার আওয়াজ আসছে।
.
—কী হয়েছে?? রবিনাথের চিৎকার এল! কোথায় সে?
তীব্র আতঙ্কে মুখ সাদা হয়ে গেছে রাজমাতার। তিনি ছেলের বিপদের আশঙ্কা করেছেন। কিন্তু দক্ষিণ মহলের কেউই ঘটনা চাক্ষুষ করেনি। তাই যে অনর্থ ঘটে গেছে তা তিনি জানেন না। তিনি বাকি সকলের মতোই জানেন যে যুবরাজ উত্তর মহলে আছেন। মহারাজের ঘরে। তাই এই মহলে তাঁর আর্তনাদ শুনে তিনি বিভ্রান্ত।
ওঁর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চাণক্য সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠতে থাকলেন। সারা তলাটা অন্ধকার। দ্রুত দেখলেন যে পর পর আটটা ঘরের মধ্যে কোন ঘরের দরজা খোলা। কিন্তু দেখা গেল প্রতিটা দরজাই বাইরে থেকে বন্ধ। এতক্ষণে এসে হাজির হয়েছেন রানি কৌশল্যা, বলদেব এবং অমাত্য ভদ্রদাস তথা আরও কিছু সৈনিক এবং দাস-দাসী। দক্ষিণ মহলের বাসিন্দারা প্রত্যেকেই বিস্মিত কারণ তারা ঠিক বুঝতে পারছে না কী ঘটেছে।
চেঁচিয়ে উঠলেন আচার্য,
—এই তলায় হত্যাকারী নেই। ওপরের দুটো ফাঁকা তলার কোনো একটাতে সে গা-ঢাকা দিয়েছে নিঃসন্দেহে। সৈনিকরা চার ভাগে ভাগ হও। দু-ভাগ ওপরের দুটো তলা খোঁজো। তৃতীয় দল এইখানেই পাহারায় থাকো আর চতুর্থ দল নীচের দুটো তলা তল্লাশি করো।
.
বহুক্ষণ চলল পুরো দক্ষিণ মহল তল্লাশি। কিন্তু মহলের কোনো ফাঁকা ঘরেই আততায়ীর চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। নীচের দুটো তলায় যদিও আগে থেকেই প্রহরী ছিল, তবু আবার তল্লাশি চালানো হল। এই ফাঁকে চাণক্য চোখ বুলিয়ে নিলেন সেখানে উপস্থিত সবকটা মানুষের দিকে। কুন্তী দেবী ইতিমধ্যে অন্যের মুখে ঘটনাটা জানতে পেরেছেন। শোকে পাথর হয়ে মেঝেতেই বসে আছেন তিনি। রানি কৌশল্যা নিজের ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছেন। এবং বৃদ্ধ অমাত্য হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে। বলদেবের চোখে-মুখে নেশা এবং বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি। তার মুখ দেখে মনে হয় সে এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না ঘটনাটা। এ ছাড়া কিছু দাস-দাসী এবং সৈনিক এই চারতলায় উপস্থিত। প্রত্যেকেই ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি ও বিস্মিত।
.
—এই তলায় সৈনিক নেই কেন? পাহারার ব্যবস্থা নেই কেন? এই তলাতেই তো যুবরাজের কক্ষ।
চাণক্যর প্রশ্নবাণের উত্তরে বৃদ্ধ অমাত্য আমতা আমতা করে বললেন,
—আসলে, গতকাল থেকেই তো যুবরাজ নিজস্ব ভৃত্যদের সঙ্গে উত্তরের মহলে স্থানান্তরিত হয়ে গেছেন। তাই এই তলা ফাঁকা বলে আর রক্ষী রাখা হয়নি।
—যুবরাজের নিজস্ব রক্ষীরা কই? তাদের কেউ কি এখানে এই মুহূর্তে উপস্থিত আছে?
চারজন সৈনিক এগিয়ে এল। চাণক্য তাদের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন,
—তোমরা কোথায় ছিলে? যুবরাজ এখানে কীভাবে এলেন?
—আচার্য, মহারাজ কিছুক্ষণ আগে নিজেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। বলেন ওঁর একটা কাজ আছে। এবং আমাদের নির্দেশ দেন ওঁর সঙ্গে না যেতে।
—তলোয়ার ছিল তার সঙ্গে?
এ প্রশ্নের প্রয়োজন যদিও ছিল না। কারণ সকলেই দেখেছে যে রবিনাথের হত্যার সময়েই তার কোমরে তলোয়ার ছিল। তবুও নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করলেন চাণক্য। প্রত্যেকেই জানাল যে যুবরাজ সাধারণ পোশাকে থাকলেও, সঙ্গে তলোয়ার নিতে ভুলে যাননি।
—কী কাজে যাচ্ছেন উনি বলেছিলেন?
—আজ্ঞে না, আচার্য।
কিছুক্ষণ বাদেই একজন সৈনিক এসে জানাল যে সারা মহল খোঁজা হয়েছে। আততায়ী দুরস্ত, সামান্য একটা রক্তের দাগও পাওয়া যায়নি কোনো জানলায়। দক্ষিণ মহলেও খোঁজা শুরু হয়েছে। তবে সেখানে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা যে নেই তা বলে দিতে হয় না। কারণ দুটো মহলের যোগাযোগের একটামাত্র পথ হল সেই সেতু। আর এতজন মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে সেতুপথ ধরে কারুর পক্ষেই পার হওয়া সম্ভব ছিল না। কেউ দক্ষিণ মহল থেকে উত্তর মহলে পালাতে গেলে, তাকে উত্তর মহল থেকে ছুটে আসা মানুষদের মুখোমুখি পড়তেই হত। কিন্তু সেইরকম কাউকেই আসতে দেখা যায়নি।
হতাশাজনক ভঙ্গিতে চাণক্য ডান মুঠো দিয়ে দেয়ালে একটা আঘাত করলেন।
৮.
গতকাল রাত থেকেই সারা দুর্গ জেগে। সকাল হতেই যুবরাজের হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা তোসালিতে। হত্যার ভয়ংকরতা আর অলৌকিকতার গল্প ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। এখন দুর্গর বেশিরভাগ মানুষেরই বিশ্বাস যে এই কাজটা প্রেতের।
চাণক্য রাত থেকেই ঠায় বসে রয়েছেন নিজের কাছের জানলার সামনে। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন দক্ষিণ মহলের দিকে। রাতের অন্ধকারে দেখা জানলা ঠিক কোনটা ছিল, সেটা এখন আর তিনি নিজেই ঠিক চিহ্নিত করতে পারবেন না। সবারই তথৈবচ অবস্থা। পুরো দৃশ্যটা ঘটতে মাত্র কয়েক মুহূর্ত সময় লেগেছিল গতকাল রাতে। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা সম্ভাব্য জানলার কথা বলছেন আর সবই নিছক অনুমান। চাণক্য জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ধ্যান মুদ্রায় শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছেন। ওঁর কপালে গভীর ভ্রূকুটি।
জীবসিদ্ধি দু-একবার কথোপকথনের বৃথা চেষ্টা করে বিফল হওয়ায় এখন চুপ করে চাণক্যরই ঘরে বসে আছে। দুপুরের দিকে সে সামান্য কিছু খাবার খেল এবং দুর্গর বাকি বাসিন্দাদের খবরাখবর নিল। আচার্যকে বার কয়েক খাওয়ার কথা বললেও তিনি আসন ছেড়ে একচুলও ওঠেননি বা একটা শব্দও বলেননি। অতএব জীবসিদ্ধি দুপুরে আর খিদে সইতে না পেরে একাই খেয়ে এল। ফিরে দেখল গুরুদেব এখনও একইভাবে বসে আছেন। তবে এইবার তাকে আসতে দেখে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,
—দুর্গর বাসিন্দাদের কী অবস্থা দেখলে?
—সবাই আতঙ্কিত। কুন্তী দেবী নিজের ঘরে দরজা দিয়ে বসে ছিলেন। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না। সবাই আশঙ্কা করছিল যে তিনি পুত্রশোকে কিছু একটা অঘটন না ঘটিয়ে ফেলেন। পরে রানি কৌশল্যা গিয়ে তাঁকে সামলিয়েছেন। ছোটোরানির বহু অনুরোধের পর দরজা খুলেছেন কুন্তী দেবী। যদিও এখনও তিনি ছেলের মৃত্যুটা মানতে পারেননি। উনি প্রলাপের মতো বলে চলেছেন যে ওঁর পুত্র নিশ্চয়ই নিখোঁজ হয়েছে। খুঁজলে পাওয়া যাবে।
—আর বাকিরা?
—বলদেবও সকাল থেকে বের হয়নি নিজের ঘর থেকে। সেও হতভম্ব। অমাত্য মহাশয় আপাতত ঠান্ডা মাথায় সব দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
—হুম।
—আপনি ভেবে কোনো আলো দেখতে পেলেন, আচার্য?
বিষণ্ন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন চাণক্য। আচার্যকে আবার মৌন অবস্থায় ফিরে যেতে দেবে না ঠিক করেই কথা বাড়াতে জীবসিদ্ধি বলে,
—আচার্য, চলুন একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। কথায় বলে স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে ভাবনার পরিবর্তন হয়।
এইবার আর আপত্তি না করে চাণক্য উঠে দাঁড়ালেন। দু-জনে দুর্গর বাইরে বাগানে এলেন। পাশ দিয়ে মহানদী বয়ে চলেছে আর বাগানের সমস্ত গাছে ফুলের সমাহার। এখানে এসে ভালো লাগছিল দু-জনেরই। রাতের বিষণ্ণতা কিছুটা হলেও কেটেছে। চলতে চলতে কথা হচ্ছিল। যদিও বেশিরভাগ কথা জীবসিদ্ধিই বলছে। আচার্য কেবল ‘হুম’ বলছেন মাঝে মাঝে। বহুবার তাঁর চিন্তাসূত্র নিয়ে প্রশ্ন করায় চাণক্য বললেন,
সমস্যা হল আগের মৃত্যুটা আদৌ হত্যা না স্বাভাবিক মৃত্যু সে-বিষয়ে ভাবতে ভাবতেই গতকালের ঘটনা আমায় নাড়া দিয়ে গেল। এই পুরো ঘটনায় দোষী হিসেবে খুব সহজেই বলদেবকে চিহ্নিত করা যেত,
যদি না কাল রাতে তাকে আমরা সবাই নিজের চোখে উত্তর মহল থেকে আসতে দেখতাম। অতএব তার পক্ষে কালকের হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব নয়।
—বেশ। কিন্তু সেইটাই তো সমস্যা। কালকে আমরা প্রত্যেককেই আমাদের পিছু পিছু আসতে দেখেছি। সেই অনুযায়ী তো তবে তাদের কারুর পক্ষেই হত্যাকারী হওয়া সম্ভব নয়। যদি না কোনো সৈনিক বা প্রহরী এই কাণ্ড ঘটিয়ে থাকে।
—সে কী? অশরীরী হত্যাকারীর সম্ভাবনা পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিলে?
এই কথায় গুরু শিষ্য দু-জনেই হেসে উঠল। সুযোগ বুঝে জীবসিদ্ধি আচার্যর হাতে একটা আপেল ধরিয়ে দিল। সে জানে আচার্য কাল রাত থেকে অভুক্ত। তাই অপেক্ষায় ছিল কখন গুরুর মন একটু হালকা হতেই তাঁকে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করবে।
—আপেলটি বেশ মিষ্টি, আচার্য। পুরো মধু।
চাণক্য আপেলে একবার কামড় দিয়ে কথা শুরু করলেন,
—সৈনিকের পক্ষে হত্যা সম্ভব বটে। কিন্তু আমার বিশ্বাস তা হয়নি। কারণ সেক্ষেত্রে সত্য আজ নয়তো কাল প্রকাশ পাবেই। এবং রাজপরিবারের কেউ যদি এই হত্যাকাণ্ডর নেপথ্যে থাকে, তার নামও প্রকাশ পেয়ে যাবে। আমার মনে হয় না এতটা মূর্খামি কেউ করবে। হত্যাকাণ্ডর কথা গোপন রাখতে চাইলে নিজের হাতে হত্যা করাই শ্রেয়।
—তাহলে?
—কালকের রাতের ঘটনা নিয়ে আবার চিন্তাভাবনা করতে হবে। কাল রাতে প্রত্যেক বাসিন্দার অবস্থানগুলো বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমেই আসি রাজকুমার বলদেবের কথায়। বলদেব গভীর নেশাছন্ন হয়ে নিদ্রামগ্ন ছিল। সে ঘর থেকে বের হয়নি সেটা তার ঘরের রক্ষী জানিয়েছে। আমাদের সঙ্গেই সে রাতে প্রথম বের হয়। যদিও এই ক্ষেত্রে বলদেবের নিজস্ব রক্ষীদের কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
—আপনাকে এই কথা কে জানাল?
—তুমি যখন খেতে গিয়েছিলে, সেই সময়ে অমাত্য মহাশয় এসেছিলেন। তিনিই নিজের মতো করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন। তিনি আজ সকাল থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যা যা তথ্য পেয়েছেন তা আমায় জানালেন।
—বেশ।
—অমাত্য নিজেও রাতে আমাদের পেছনেই ছিলেন তা আমরা জানি। অতএব তিনিও উত্তর মহলেই নিজের ঘরে ছিলেন বলে জানিয়েছেন। এইবার আসা যাক দক্ষিণ মহলে। কুন্তী দেবী। তাঁর পুরো তলায় তিনি একা। তাঁর পক্ষে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে চারতলায় যাওয়া সম্ভব। কারণ তিনতলা থেকে সিঁড়িতে কোনো প্রহরী ছিল না। কিন্তু…
—কিন্তু ওঁকে সবার প্রথমেই বাদ দেয়া যেতে পারে। কারণ উনি মা।
—হুমম। ঠিক। কোনো মানসিকভাবে সুস্থ মা তার সন্তানকে হত্যা করেছে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে যেখানে রবিনাথের মৃত্যুতে উনি আবার সর্বহারা হলেন। রাজমাতা হওয়ার বা সুখের দিন দেখার শেষ আশাটাও আর থাকল না। তা ছাড়া, আমরা ওঁকে তিনতলার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। ওঁর পক্ষে কখনোই ওপরের তলায় গিয়ে, হত্যা করে, আবার আমাদের দক্ষিণ মহলে পৌঁছোনোর আগেই সিঁড়ি ধরে নেমে এসে নিজের ঘরে ফেরা সম্ভব না। অতএব এই সম্ভাবনাও বাদ যায়।
—ঠিক।
—এইবার আসা যাক দোতলার অন্য দুই বাসিন্দার কথায়। রানি কৌশল্যা ও তাঁর পুত্র বিরাট।
—আচার্য! আপনি কি বিরাটকেও সন্দেহ করছেন নাকি?
—আমি এখানে মানবিক প্রসঙ্গ দূরে রেখে শুধু যুক্তিনির্ভর চিন্তাভাবনা করছি। পক্ষপাতিত্ববিহীন সমান নজরে প্রত্যেককে রেখে সত্যান্বেষণ করাই যেকোনো অপরাধের তদন্তের প্রাথমিক শর্ত। আর তা ছাড়া, আরও একটা বিষয় আছে।
—কী আচার্য?
আপেলটা শেষ করে মাঝের অংশটা একদিকে ছুড়ে ফেলে চাণক্য বললেন,
—রানি কৌশল্যার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে উনি কিছু একটা গোপন করছেন। এমন কিছু তথ্য তিনি জানেন কিন্তু আমাদের কাছে তা প্রকাশ করছেন না। সম্ভবত ভয় পাচ্ছেন তিনি।
—কীসের ভয়?
একজন মা যে কারণে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় বোধ হয় সেই ভয়। তাঁর জীবনে হারানোর মতো তো একটাই জিনিস আছে। তবে কাল রাতের ঘটনায় দোতলার রক্ষীরা জানিয়েছে যে রানি বা রাজকুমার কেউই ওপরে ওঠেনি। আমরা পৌঁছোনোর পরে রানি ওপরে উঠেছিলেন। তবে এক্ষেত্রেও রক্ষীরা মিথ্যে বলে থাকতে পারে। কিন্তু তাতেও সেই একই প্রশ্ন থেকে যায় যে রানি অথবা বিরাট, হত্যা করে আবার চারতলা থেকে দোতলায় কী করে এত দ্রুত ফিরতে পারলেন।
—তাহলে তো সন্দেহর তালিকা থেকে সকলেই বাদ পড়ল।
হুম, জীবসিদ্ধি। কিছু একটা আমি ধরতে পারছি না। আমার একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি হচ্ছে যে এই রহস্যর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র আমি অনেক আগেই পেয়েছি। কিন্তু সেটা আমার মনে পড়ছে না। অতি সামান্য কোনো একটা ঘটনা। অথবা সামান্য কোনো সাধারণ, আপাত গুরুত্বহীন তথ্য। যেটা মনে পড়লেই ধরা দেবে রহস্যর সমাধান সূত্র।
.
চলতে চলতে একটা বাঁক ঘুরতেই তাঁরা দেখতে পেলেন রাজকুমার বিরাটকে। একটা গুলমোহর ফুলগাছের পেছনে লুকিয়ে আছে বিরাট। ঠিক যেমন একটা শিশু লুকোচুরি খেলে, সেভাবে। সে দু-জনকে আসতে দেখেনি। নিজের খেলায় মেতে আছে উৎফুল্ল মনে। দূর থেকে তার মায়ের ডাক শুনতে পাওয়া গেল,
—বীরা! বীরা! কই লুকোল আমার চাঁদের কণা?
খিল খিল করে হেসে উঠল বিরাট। সত্যিই সরল শিশু। মনে মনে ভাবল জীবসিদ্ধি। আর আচার্য কিনা একেও সন্দেহর তালিকায় রেখেছেন।
মাকে আসতে দেখেই বিরাট আবার অন্য একটা জবাফুল গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়তে দৌড় দিল।
—বীরা! বীরা!
রানি কৌশল্যা এগিয়ে আসতে চাণক্য এবং জীবসিদ্ধিকে দেখতে পেলেন। দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে গেলেন ছেলেকে খুঁজতে। জীবসিদ্ধি আবার পা বাড়াল সামনে। দু-পা এগিয়েই খেয়াল করল আচার্য তার পাশে নেই। পেছন ঘুরে চাণক্যকে দেখে চমকে গেল জীবসিদ্ধি।
চাণক্য নিজের জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে আছেন। কপালে ভ্রূকুটি এবং চোখের তারা জ্বলজ্বল করছে। তাঁর দৃষ্টি সামনের দিকে নিবদ্ধ, কিন্তু মানসচক্ষুতে অন্য কিছু দেখছেন। এই দৃষ্টি জীবসিদ্ধির পরিচিত। খুব পরিচিত। এই দৃষ্টি রহস্যর অন্ধকারে আলোকবিন্দু দেখতে পাওয়ার ইঙ্গিত বিড়বিড় করে নিজের মনে কিছু বলছেন চাণক্য। তাঁর দিকে এগিয়ে যেতে কয়েকটা খাপছাড়া শব্দ শুনতে পেল শুধু।
—প্রথমটা হল… দ্বিতীয়টা আলাদা?… কিন্তু কীভাবে?
কয়েক মুহূর্ত স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ চিন্তাজাল থেকে নিজেই বেরিয়ে এলেন চাণক্য। বললেন,
ওহে জীবসিদ্ধি, ঘরে ফিরে চলো। আমার জন্যে আরও কিছু খাবারের ব্যবস্থা করো। পারলে কিছু মিষ্টিও। এখন তা উদরস্থ করে আমি ধ্যানে বসব। রাতে আর আমায় ডাকবে না। ভাবতে হবে। অনেক ভাবতে হবে শেষ সূত্রটা খুঁজতে হবে।
দ্রুত ফিরে চললেন আচার্য। হাঁটার গতি বাড়িয়ে জীবসিদ্ধি ওঁর পাশাপাশি পৌঁছে প্রশ্ন করল,
—সূত্র পেলেন??
—- হুম। তাও আবার একটা নয়। একসঙ্গে দুটো।
এরপর আর হাজার প্রশ্ন করলেও একটা উত্তরও আচার্য যে দেবেন না, সেটা জীবসিদ্ধি জানে। তাই আর বৃথা বাক্যব্যয় না করে, দুর্গে প্রবেশ করে গুরুর নির্দেশ পালন করতে লাগল সে। মা আর ছেলের সামান্য এই লুকোচুরি খেলা থেকে তার গুরুদেব কী এমন সূত্র পেলেন তা অনেক ভেবেও জীবসিদ্ধি অনুমান করতে পারল না।
৯.
পরের দিন সকালে জীবসিদ্ধির ঘুম ভাঙল তার নিজের ঘরের দরজায় করাঘাতের শব্দে। দরজা খুলে দেখল স্বয়ং আচার্য চাণক্য দাঁড়িয়ে আছেন।
—কী হল আচার্য? কী ঘটেছে?
—সুপ্রভাত। কিছুই ঘটেনি। তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে দুঃখিত। কিন্তু আচার্যদের এই যৎসামান্য অত্যাচার শিষ্যদের সহ্য করতেই হয়। এটা তাদের শিষ্য ধর্মেরই অঙ্গ। গুরুদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে তাঁর ছাত্রর ঘুম ভাঙানোর।
গুরুর কথায় হেসে ফেলে জীবসিদ্ধি। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে কালকের চিন্তাভাবনা নেহাতই বিফল হয়নি। তাই আজ আচার্যর মনে সামান্য কৌতুকের আভাস দেখা দিয়েছে।
—কিছুক্ষণ সময় দিলাম। তৈরি হয়ে নাও। বেশ কিছু করণীয় গুরুত্বপূর্ণ কার্যভার আছে আজ আমাদের। তোমায় ছাড়া এই কাজগুলো আমি একা করলে তুমিই পরে আমায় দোষারোপ করবে যে তোমায় কোনো তথ্য আমি দিইনি।
এই কথা বলেই আচার্য সোজা নিজের ঘরে ফিরে গেলেন।
কিছুক্ষণ বাদেই জীবসিদ্ধি হাজির হল গুরুর সামনে। চাণক্য প্রথমেই একজন প্রহরীকে ডেকে বললেন অমাত্য ভদ্রদাসকে তলব করতে। খানিক বাদেই অমাত্য চাণক্যর ঘরে ঢুকলেন। একে অপরকে প্রণাম জানিয়ে চাণক্য বললেন,
—অমাত্য মহোদয়, প্রথমেই আপনাকে এভাবে তলব করার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। এইবার আপনাকে আমি কিছু কথা বলব যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, তোসালির বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে এই মুহূর্তে বলা চলে রাজ্য শাসকহীন। তাই আমি এই রাজ্যের আপতকালীন শাসন সরাসরি মগধের হাতে তুলে নিচ্ছি। এই মুহূর্ত থেকে তা কার্যকর করা হল। আপনি এই নির্দেশ ঘোষণা করে দিন। মগধের অঙ্গরাজ্য হিসেবে সেই ক্ষমতা আইনত মগধের আছে।
প্রধান অমাত্যর মুখে স্পষ্ট উদ্বেগ আর ভয় ফুটে উঠল। তাঁর মনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে সম্ভবত সুযোগের সদ্বব্যবহার করে আচার্য তোসালির স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে চাইছেন। বৃদ্ধর মনের ভাব অনুমান করতে পেরেই চাণক্য ওঁকে আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন,
—আহা! আপনি যে দেখছি ভীত হয়ে পড়লেন, আর্য। আপনাকে আমি আশ্বস্ত করছি যে আপনার উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যে এটা সম্পূর্ণ সাময়িক। মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্যে।
প্রায় হাফ ছেড়ে বাঁচলেন বৃদ্ধ। বললেন,
—বেশ। আপনার কথায় আমি ভরসা করছি, মহামতি।
—হুম। এইবার, যেহেতু এই মুহূর্তে সাম্রাজ্যর প্রতিনিধি স্বয়ং আমি, অতএব আমি আপনাকে নির্দেশ দিচ্ছি যে রাজকুমার বলদেবের ঘর এবং তার ছবি আঁকার ঘরে তল্লাশি চালানো হোক। এই তল্লাশি আপনার এবং জীবসিদ্ধির তত্ত্বাবধানে, মগধের সৈনিকরা করবে। আমি যে বিশেষ জিনিসটা খুঁজছি সেটা হল সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশের অংশ। বিশেষ করে একটা রুদ্রাক্ষের মালা। তবে এগুলো নাও পাওয়া যেতে পারে। বলদেব বাধা দিলে মগধের সৈনিকদের দ্বারা বল প্রয়োগ করার নির্দেশ দিলাম জীবসিদ্ধিকে।
—বেশ। তাই হবে।
—আমি দু-জনকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। প্রথম জন হলেন কুন্তী দেবী। আর দ্বিতীয় জন হলেন ছোটোরানি কৌশল্যা। আপাতত আপনার আর কোনো দায়িত্ব নেই, অমাত্য মহোদয়। আপনি আমার নিজস্ব সৈন্যদের তৈরি হতে বলুন। তাদের নিয়েই তল্লাশির কাজ সমাধা হবে।
নমস্কার জানিয়ে বৃদ্ধ অমাত্য চলে গেলেন। তিনি বেরিয়ে যেতে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,
—অর্থাৎ বলদেবই সেই ছদ্মবেশে অশরীরী কাপালিক?
—হুমম। তা তো বটেই। অন্যথায় এত সুন্দরভাবে অশরীরীর বর্ণনা কীভাবে দেবে? তুমি যাও হে জীবসিদ্ধি। গিয়ে কুন্তী দেবীকে এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো। প্রহরী যেন ওঁকে বলে যে ওঁর সঙ্গে আচার্য চাণক্যর বিশেষ প্রয়োজন।
—বেশ। তার মানে আপনি সব সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন?
এইবার গম্ভীর হল চাণক্যর মুখমণ্ডল। বললেন,
—নাহ। শেষ একটা সূত্র এখনও অধরা।
—অর্থাৎ?
—যেকোনো রহস্যর সমাধানে তিনটে প্রশ্নের উত্তর পেতে হয়। ‘কে?’-র উত্তর আমি জানি। ‘কেন?’-র উত্তরও আমার এখন জানা। কিন্তু ‘কীভাবে?’-র উত্তর এখনও আমার অধরা।