শীল-শাস্ত্ৰ – ১০

১০.

কুন্তী দেবী ঘরে ঢুকে প্রণাম জানালেন চাণক্যকে। চোখে-মুখে এখনও বিষণ্ণতার ভাব স্পষ্ট। প্রতিনমস্কার জানিয়ে চাণক্য সোজাসুজি কাজের কথায় চলে গেলেন।

—কুন্তী দেবী। এই শোকের সময়ে আপনাকে বিব্রত করার জন্যে আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনাকে দিয়ে আমার একটা জিনিস পরীক্ষা করাতে হবে বলে এখানে ডেকে পাঠালাম। দেখুন তো এই চিঠিটা। এই হাতের লেখা আপনার পরিচিত? আমি সন্দেহ করছি এই হাতের লেখা আপনার দুই ছেলের মধ্যে একজনের।

কুন্তী দেবী চিঠিটা আচার্যর হাত থেকে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। যদিও তিনি নিজে পড়তে পারবেন না। কিন্তু হাতের লেখা তিনি দেখে বুঝতে পারবেন হয়তো। বেশ কিছুক্ষণ দেখে তিনি চিঠিটা ফেরত দিলেন।

—না, আচার্য। ক্ষমা করবেন। লেখা পড়তে না পারলেও আমি প্রত্যেকের হাতের লেখা চিনি। তাই নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে এই হাতের লেখা আমার অচেনা। কী লেখা আছে এই চিঠিতে?

—এটা কারুর নিজের প্রেয়সীকে লেখা প্রেমপত্র। কিন্তু এতে বেশ কিছু গোপন তথ্য আছে। আমি এই চিঠিটা খুঁজে পেয়েছি গতকাল। এটা যদি রাজপরিবারের কারুর লেখা না হয়ে থাকে, তবে এর অর্থ দাঁড়াল যে সৈনিকদের মধ্যে কেউ গোপন তথ্য ফাঁস করছে। আপনাকে অকারণ বিরক্ত করার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী, মহাশয়া।

নমস্কার জানিয়ে কুন্তী দেবী চলে গেলেন। জীবসিদ্ধি এতক্ষণ উৎসুক হয়ে ছিল। হঠাৎ এই চিঠি কোথা থেকে এল তা তার অজানা। এবং আচার্য যে আগে এই বিষয়ে কিছু বলেননি, সেই কথা ভেবেও মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণ হল।

—আচার্য, কীসের চিঠি? আমায় তো কিছু বলেননি। এর সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডর যোগ কোথায়?

চোখে কৌতুকের আভাস ফুটল চাণক্যর। ভূর্জপত্রটা শিষ্যর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

—নিজেই দেখে নাও।

চিঠিটা দেখে অবাক হল জীবসিদ্ধি। এতে একগাদা অসংলগ্ন কথা লেখা আছে। লেখাটার বিশেষ কোনো অর্থই দাঁড়ায় না। সবচেয়ে অদ্ভুত হল এতে তিনটে আলাদা রঙের কালি ব্যবহার করে লেখা হয়েছে। এবং এই হাতের লেখা জীবসিদ্ধির অতি পরিচিত। এই লেখা স্বয়ং আচার্য চাণক্যর

—এর অর্থ কী আচার্য? এ কেমন রসিকতা আপনার?

উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ পালটে চাণক্য বললেন,

—যাও হে, জীবসিদ্ধি। এইবার ছোটোরানিকে ডেকে আনো। সঙ্গে বিরাট আসতে চাইলেও আপত্তি কোরো না।

* * **

রানি কৌশল্যা একাই এলেন আচার্যর ঘরে। আচার্য তাঁর দিকে চেয়ে বললেন,

—মহাশয়া, আমি জানি বিরাট কী দেখেছিল।

এই কথার আশ্চর্য প্রভাব পড়ল রানি কৌশল্যার ওপর। তিনি চাণক্যর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। মিনতির ভঙ্গিতে বললেন,

—আচার্য! দয়া করুন! এই কথা সর্বসমক্ষে প্রকাশ পেলে আমার ছেলের নিশ্চিত জীবনহানি হবে। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে। যেখানে রবিনাথের মৃত্যুর পর আর কয়েকদিন পরেই বলদেব রাজসিংহাসনে বসতে চলেছে।

—আরে… আরে…. উঠুন রানি। আপনি যা করেছেন তা নিজের ছেলের জীবন রক্ষার্থে। আমি সবই বুঝি এবং আপনাকে একবারও দোষ দিই না। উঠুন চোখের জল মুছে নিন।

রানি উঠে দাঁড়াতে আবার বললেন আচার্য,

—বিরাটের ওপর কোনো আঘাত আসতে দেব না এই কথা দিলাম আপনাকে। কিন্তু আপনাকেও আমার কথা রাখতে হবে। আপনাকে যথাসময়ে সর্বসমক্ষে সত্যটা প্রকাশ করতেই হবে।

—আপনি অভয় দিলে আমি রাজি।

—অনেক ধন্যবাদ, মহাশয়া। আপনি আসতে পারেন।

—আপনাকে ধন্যবাদ, আচার্য। আপনি কীভাবে এই তথ্য জানলেন আমি জানি না। এই তথ্য আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তি কেউ জানে না। অথচ আপনি কোন অলৌকিক ক্ষমতায় তা জানলেন?

মৃদু হেসে চাণক্য উত্তর দিলেন,

—যুক্তিনির্ভর অনুধাবন এবং অনুমানের সাহায্যে, মহাশয়া।

.

রানি কৌশল্যা বেরিয়ে যেতেই আবার জীবসিদ্ধির প্রশ্নবাণ ছুটে গেল,

—আচার্য! কী ঘটল একটু আগে? আমি তো এক বর্ণও বুঝিনি কী বিষয় নিয়ে কথা হল আপনাদের মধ্যে। রানি কি তবে জানেন যে রবিনাথের হত্যাকারী কে?

—না। তিনি জানেন না। তবে ছোটোরানি অসম্ভব বুদ্ধিধারী রমণী। বোধ হয় উনি ঠিক না জানলেও অনুমান করতে পারেন হত্যাকারীর পরিচয়।

—তাই যদি হয় তো এতক্ষণ কোন গোপন কথা জানার কথা হচ্ছিল? উত্তর না দিয়ে চাণক্য জীবসিদ্ধির দিকে চেয়ে শুধুই মৃদু হাসলেন।

১১.

পরের দিন সকালে সূর্যোদয়ের আগেই চাণক্য ও জীবসিদ্ধি নদীর তটের উদ্দেশে হাঁটছেন। তাঁদের পেছনে অনতিদূরে দু-জন রক্ষী চলেছে। প্রভাতকালীন ভ্রমণের প্রস্তাবটা জীবসিদ্ধিই উপস্থাপন করেছিল গতকাল। মহানদীর কূলে সূর্যোদয় দেখা তাঁদের উদ্দেশ্য।

গতকাল রাজকুমার বলদেবের ঘর তল্লাশি করে কিছু না পাওয়া গেলেও ছবি আঁকার ঘরে একটা রুদ্রাক্ষের মালা ঠিকই পাওয়া গেল। বলদেব সেটা তার নয় বলে অস্বীকার করেছে। অতএব প্রমাণ না হওয়া অবধি চাণক্যর আদেশে তাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। দু-জন মগধের সৈনিক সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকবে।

পথ চলতে চলতে আলোচনা আবার হত্যাকাণ্ডর প্রসঙ্গে চলে আসে।

—আচার্য। আপনি কীভাবে গতকাল বললেন যে রুদ্রাক্ষের মালা ওই আঁকার ঘরেই পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি?

—একটু বুদ্ধি প্রয়োগ করলেই তা তুমিও অনুমান করতে সক্ষম হবে।

—আচ্ছা, বেশ। সে না-হয় বললেন না। কিন্তু আমরা যদি নিশ্চিতই হই যে বলদেবই হত্যাকারী, তবে তাকে গ্রেফতার কেন করছি না?

—কারণ আমি এখনও শেষ সূত্রটা পাইনি। আমি এখনও জানি না যে হত্যাকারী কীভাবে সবার সামনে হত্যা করে কোন মন্ত্রবলে আমরা পৌঁছানোর আগেই স্থান ত্যাগ করতে সক্ষম হল। এই একটা প্রশ্নই আমায় ভাবিয়ে চলেছে সবচেয়ে বেশি।

—ঠিকই। বলদেব কীভাবে উত্তরের মহল থেকে সবার নজর এড়িয়ে দক্ষিণে গেল এবং কীভাবে হত্যা করার পর আবার আমাদের আগেই ফিরে এল সেটা বোঝা যাচ্ছে না।

—জীবসিদ্ধি। এতে বোঝার কিছু নেই। এই কাজ অসম্ভব।

—তবে?

প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে চাণক্য দূরের নদীর দিকে দেখালেন।

—ওই দেখো। সামনেই নদী চওড়া হয়েছে। ওই দেখা যায়। ঠিক সময়ে এসেছি। সূর্যোদয়ের ক্ষণ আসন্ন। এখন চুপ করে আমরা সূর্যদেবের দর্শন করব।

.

সূর্যর প্রথম কিরণ এসে পৃথিবীকে স্পর্শ করল। চাণক্য নদী থেকে অঞ্জলি ভরে জল তুলে সূর্যপ্রণাম মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন। অঞ্জলির জল সূর্যের উদ্দেশে অর্পণ করে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন এবং বললেন,

—হে সূর্যদেব, তোমার কিরণ যেমন আঁধার সরিয়ে আলোর পথ দেখায়, আমারও মনের আঁধার সরিয়ে আলোর পথ দেখাও। আহা! প্রকৃতির কী অপূর্ব শোভা দেখো, জীবসিদ্ধি। তোমার কথায় রাজি হয়ে আজ এখানে এসে বড়োই ভালো লাগল। মন প্রসন্ন হয়ে উঠল। চলো, ওই জায়গাটায় একটু বসি। প্রকৃতির শোভা দেখি একটু।

.

বসলেন দু-জন। চাণক্য পদ্মাসনে বসে নদীর বাহার দেখছিলেন। নদীর দিক থেকে কয়েকটা ছোটো নৌকো অনেকক্ষণ ধরে কিনারের দিকে এগিয়ে আসছিল। এতক্ষণে এসে পাড়ে ভিড়ল। কাঁধে জাল আর প্রচুর মাছ নিয়ে একদল মৎস্যজীবী নেমে এল। দুই ব্রাহ্মণকে বসে থাকতে দেখে তারা প্রণাম জানাল। চাণক্য প্রশ্ন করলেন,

—ওহে, শোনো। তোমরা কি সারারাত মাছ শিকার কর?

—হ্যাঁ, ব্রাহ্মণদেব। এই শেষরাতের দিকে কয়েক ঘণ্টার জন্যে নদীর জল নেমে যায়। তখন মাছ ধরা পড়ে অনেক। আবার একটু পরেই জল ফুলে ওঠে। তখন আমরা ফেরার পথ ধরি। আসতে আসতে সকাল হয়ে যায়।

—বেশ, বেশ।

মৎস্যজীবীরা তাদের পথ ধরল। তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন আচার্য। জীবসিদ্ধি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আবার আচার্যর মুখের ভাব দেখে থমকে গেল। চাণক্যর কপালে ভ্রূকুটি, চোখ উজ্জ্বল। আচমকা উঠে দাঁড়ালেন।

—তাড়াতাড়ি দুর্গে চলো। একটা বিষয় এক্ষুনি নিজের চোখে দেখা দরকার।

—কী? কী হল, আচার্য?

উত্তর না দিয়ে দ্রুতপদে ফিরে চললেন চাণক্য। দুর্গের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে সিঁড়ির কাছে এলেন। সিঁড়ির ঠিক পাশ থেকে নদীর জল শুরু হয়েছে। সেই জলের দিকে পা বাড়ালেন আচার্য। আটকানোর আগেই তিনি জলে তিন পা নেমে গেছেন।

জীবসিদ্ধি বলে উঠল,

—আরে, করেন কী আচার্য?

—জলের নীচে সিঁড়ি নেমে গেছে, জীবসিদ্ধি! এর তাৎপর্য বুঝতে পারছ?

—ন… না? কী বলতে চাইছেন?

—জলের নীচে, দুর্গর আরও একটা তলা আছে। আমি শেষ সূত্রটা পেয়ে গেছি, জীবসিদ্ধি। অবশেষে রহস্যর সমাধান হয়েছে!!

১২.

চাণক্যর নির্দেশে সভাঘরে সবাই উপস্থিত হয়েছেন। বলদেবের আসতে আপত্তি ছিল। কিন্তু তাকে জোর করেই নিয়ে এসেছে দুই সৈনিক। কুন্তী দেবী বিহ্বল চোখে বসে আছেন। তাঁকে উদ্ভ্রান্ত লাগছে এই প্রথমবার। বৃদ্ধ অমাত্য ভদ্রদাসের বয়স এই কয়েক দিনের ধকলে যেন আরও কয়েক বছর বেড়ে গেছে। একমাত্র ছোটোরানি কৌশল্যার দৃষ্টি দৃঢ় এবং তিনি চোয়াল শক্ত করে বসে আছেন। তাঁর পাশেই বিরাট একটা কাঠের পুতুল নিয়ে খেলছে। এ ছাড়া দুর্গর সমস্ত দাস-দাসী, রাজ্যের মন্ত্রীরা এবং সৈনিকরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

চাণক্য ঢুকেই প্রথমে প্রত্যেকের মুখের ওপর একবার দৃষ্টি দিলেন। প্রত্যেকে উপস্থিত হয়েছে সেটা লক্ষ করে সভার মাঝে এসে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে জীবসিদ্ধি অমাত্যর পাশের আসনটা দখল করল। যাতে তাঁর কথা সভার প্রত্যেকটা মানুষ শুনতে পায় তাই উচ্চকণ্ঠে কথা শুরু করলেন চাণক্য,

—আজ আপনাদের সবাইকে এখানে একত্রিত করার কারণ আপনারা অনেকেই হয়তো অনুমান করতে পারছেন। তবু আমি নিজের মুখে বলে দিই। আজ এখানে আমি দুটো হত্যারহস্যর সমাধান করব।

সারা সভায় গুঞ্জন উঠল। আচার্য আবার শুরু করলেন,

—হ্যাঁ। ঠিকই শুনছেন। গত এক মাসের মধ্যে একটা নয় দু-দুটো হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে এই দুর্গে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল যে প্রথম হত্যাকাণ্ডটাকে হত্যা হিসেবে চিহ্নিতই করা হয়নি। বেশিরভাগ মানুষই সেটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু অথবা অলৌকিক অভিশাপের ফল ভেবে নিয়েছেন। হ্যাঁ। আমি মহারাজ মহিপালের হত্যার কথা বলছি। ওঁর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। এবং আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে পারি যে তা কোনো প্রেতের দ্বারা সমাধা হয়নি। ওঁর মৃত্যু হয় বিষ প্রয়োগে!

একটু বিরতি নিয়ে সবার দিকে একবার দেখে নিলেন চাণক্য।

—এইবার প্রশ্ন হল কে হত্যাকারী? এই প্রশ্নর একটাই উত্তর হয়। রাজার মৃত্যুতে যে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে, হত্যাকারী সে-ই। এই ক্ষেত্রে মহারাজের মৃত্যুতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিলেন রাজকুমার রবিনাথ এবং তাঁর মা কুন্তী দেবী। কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে এই তথ্য কিন্তু মহারাজার মৃত্যুর আগে অজানা ছিল। রবিনাথ ও কুন্তী দেবী আশাও করেননি যে মহারাজ রবিনাথকে যুবরাজ ঘোষণা করতে চলেছেন। কারণ মহারাজের ইচ্ছাপত্রর কথা কেবলমাত্র জানতেন অমাত্য মহাশয়। অতএব অন্য সকলের মতোই রাজকুমার বলদের ধরেই নিয়েছিলেন যে, জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে উনিই রাজ-সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। তাই বাবা যখন তাঁর অরাজকীয় চালচলন নিয়ে তাঁকে ভর্ৎসনা করলেন তখনই বলদেব বাবাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।

—সব মিথ্যে! এ মগধের ষড়যন্ত্র! আমাকে হত্যাকারী সাব্যস্ত করে, মগধ চায় তোসালির শাসন নিজেদের হাতে নিতে। এই ব্রাহ্মণ মিথ্যাবাদী

উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, ফেটে পড়লেন রাজকুমার বলদেব। চাণক্য শান্ত কণ্ঠে বললেন,

—রাজকুমার। আপনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সব সুযোগ পাবেন। তার আগে আমি আমার কথা শেষ করে নিই?

দুই প্রহরী বলদেবের কাঁধে চাপ দিয়ে তাঁকে বসিয়ে দিল। চাণক্য কথা শুরু করলেন,

—প্রথমত বলদেব জানতেন যে বিষ প্রয়োগের হত্যাকে প্রাকৃতিক মৃত্যু বলে সহজেই চালিয়ে দেয়া যাবে। যদি কেউ সন্দেহ করে হত্যাকাণ্ড বলে, তাদের জন্যে উনি ছড়াতে লাগলেন এক অশরীরী কাপালিকের অভিশাপের গল্প। নিজে ছদ্মবেশে মাঝে মাঝেই রাতে দেখা দিতেন তাঁর বাবাকে। অবশ্যই যতটা সম্ভব অন্যের নজর এড়িয়ে। হয়তো আশা করেছিলেন দুর্বল হৃদয় মহারাজের ভয় পেয়ে মৃত্যু হবে। কিন্তু তা না হওয়ায় বলদেব অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন। তাই শেষ পর্যন্ত বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করলেন নিজের পিতাকে। রাজকুমার ছদ্মবেশ, নিজের কাছে না রেখে, তা লুকিয়ে রাখতেন ছবি আঁকার ঘরে, যাতে রাতে নিজের ঘর থেকে সন্ন্যাসীর সাজে তাঁকে বের হতে কেউ না দেখে। ছবি আঁকার অছিলায় মাঝে মাঝেই রাতে চলে যেতেন আঁকার ঘরে। এবং সেখান থেকে আলখাল্লা, দাড়ি, রুদ্রাক্ষ আর কৃপাণ নিয়ে অশরীরীর বেশে বেরোতেন। কিন্তু তিনি অনেকেরই চোখে পড়ে যান। দাস- দাসীরা তাঁকে অশরীরী ভাবলেও, অন্তত একজন কিন্তু তাঁকে সন্দেহ করল। রাজকুমার রবিনাথ। কিন্তু নিজের পরিস্থিতি বুঝে রবিনাথ চুপ থাকলেন। নিজের সন্দেহর কথা শুধু তাঁর মাকে জানালেন। কিন্তু মা কুন্তী দেবী এই কথা তাঁকে অন্যকে বলতে বারণ করলেন। কারণ পরিস্থিতি তাঁদের অনুকূল ছিল না সেই সময়ে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর যখন রবিনাথ জানতে পারেন যে তিনি যুবরাজ এবং তাঁর আর ভয়ের কিছু নেই, তখন তিনি নিজের সন্দেহর কথা আমায় বলেন। জীবসিদ্ধি আমার কথার সাক্ষী।

আবার বাধা দিল বলদেব,

—সব মিথ্যে। কী প্রমাণ আছে? ওই ছবি আঁকার ঘরের একটা রুদ্রাক্ষের মালা? হা-হা! ওটা প্রমাণ নয়। বাকি ছদ্মবেশ কই?

আবার শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন চাণক্য,

—ঠিক বলেছেন। ওটা হত্যাকাণ্ডর প্রমাণ নয়। ওটা খুঁজে পাওয়া শুধুমাত্র আমার অনুমান সত্যতার প্রমাণ। বাকি ছদ্মবেশ কোথায়, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আপাতত আপনার হত্যাকাণ্ডর প্রমাণ দিই। আপনার অপকর্মর একজন সাক্ষী আছে, রাজকুমার বলদেব। সে নিজের চোখে আপনাকে বিষ প্রয়োগ করতে দেখেছিল। এ তথ্য আপনার অজানা। কারণ সেই ব্যক্তির নাম আপনার জানা থাকলে আপনি তাকে আগেই হত্যা করতেন। বাবাকে হত্যা করতে আপনাকে যে নিজের চোখে দেখেছিল সে এই মুহূর্তে এই সভায় উপস্থিত।

এইবার কথা বেরোয় না বলদেবের মুখ থেকে। মৃদু হেসে চাণক্য বললেন,

—আপনার পাপের সাক্ষী স্বয়ং ছোটো রাজকুমার। রাজকুমার বিরাট!

.

সভায় উপস্থিত প্রতিটা চোখ ঘুরে গেছে বিরাটের দিকে। সে অবশ্যই নিজের মনে খেলে চলেছে। কোনো কথাই সে খেয়াল করেনি।

.

—ওই উন্মাদ? ওর কথা কে বিশ্বাস করবে?

কথাটা বলদেব বলল। উত্তর দিলেন আচার্য।

—আমি। তার মা। সকলেই করবে। কারণ তার পক্ষে বানিয়ে মিথ্যে বলা সম্ভব নয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা হল, এই দুর্গে আমি আসার প্রথম দিনেই রাজকুমার বিরাট সবার সামনে আপনাকে হত্যাকারী বলে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু আমরা কেউ তার কথা বুঝিনি, শুধু তার মা ছাড়া। বিরাটকে কয়েকদিন আগে তার নাম জিজ্ঞেস করায় সে জীবসিদ্ধিকে উত্তর দিয়েছিল তার নাম- ‘রবি’। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে বিরাট নিজের বড়ো দাদা রবিনাথের নাম বলছে। এটা আমাদের বুঝতে ভুল হয়েছিল। বিরাট ঠিক উত্তরই দিয়েছিল। সে বলেছিল ‘রাবি’। আসলে বিরাট বেশি উত্তেজিত হলে, তার কথার অক্ষর উল্টে যায়। এই ব্যাপারটা পরে অনুমান করতে পারি যখন দু-দিন আগে বিরাটকে তার মায়ের সঙ্গে বাগানে খেলতে দেখলাম। তার মা তাকে ডাকে ‘বীরা’ নামে। বিরাট নিজেকে তার মায়ের দেয়া নামেই পরিচয় দেয়। কিন্তু উত্তেজনায় ‘বীরা’ হয়ে গিয়েছিল ‘রাবি’। এইবার আপনাদের একটা প্রশ্ন করি। মহারাজের ইচ্ছাপত্র পাঠের সন্ধ্যায় রাজকুমার বিরাট বড়ো রাজকুমারকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। বলদেবের দিকে অভিযোগের তর্জনী তুলে একটা শব্দ বার বার উচ্চারণ করেছিল বিরাট। মনে পড়ে শব্দটা কী ছিল?

—শিব!

একসঙ্গে উত্তর দিল জীবসিদ্ধি এবং অমাত্য। চাণক্য বললেন,

—ঠিক! কিন্তু এখানেও আমরা ভুল করি তার কথা বুঝতে। সে বলছিল ‘ষিব’, কিন্তু বলতে চেয়েছিল ‘বিষ’। তার মা আগেই জানতেন পুরো ঘটনা। কিন্তু নিজের পরিস্থিতি বিচার করে কথাটা কাউকে তিনি জানাননি। কারণ ভাবী মহারাজের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা মূর্খতা। এতে বিরাটের প্রাণ সংশয় দেখা দেবে। কিন্তু বিরাট এত কিছু না ভেবেই সবার সামনে কথাটা বলে ফেলায় তার মা ভীত হয়ে পড়েন সেই সন্ধ্যায়। রানি কৌশল্যাকে অনেক আগেই বিরাট সব বলেছিল। একমাত্র মা-ই সবসময় তার সন্তানের ভাষা বুঝতে পারে। রানি সেইসব কথা সর্বসমক্ষে এতদিন বলেননি। কিন্তু এইবার তিনি বলবেন।

উঠে দাঁড়ালেন রানি কৌশল্যা। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,

—হ্যাঁ, আচার্যর বলা প্রতিটা কথা সত্য। ছেলের প্রাণের ভয়ে এতদিন আমি মৌন ছিলাম। কিন্তু এখন আমি প্রস্তুত। মহারাজের মৃত্যুর দিন তাঁর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার ছেলে সব দেখেছিল। এবং এসে আমায় রাজকুমার বলদেবের দ্বারা ঘটানো হত্যাকাণ্ডর বিবরণ সে দেয়। আমি নিজের সন্তানের এবং নিজের রাজকুলের নামে শপথ করে বলছি। রাজকুমার বলদেব তার বাবা তথা আমার স্বামী মহারাজ মহিপালের হত্যাকারী!

সারা সভা ফেটে পড়ল গুঞ্জনে। কুন্তী দেবীর হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। তিনি অনেক কষ্টে নিজের গলা থেকে নির্গত হতে চাওয়া চিৎকার সংবরণ করে রেখেছেন মনে হল। কিন্তু এতক্ষণে উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়িয়েছেন বৃদ্ধ অমাত্য এবং অন্যান্য সভাসদ। অমাত্য বললেন,

—বাবার এবং ভাইয়ের হত্যার অপরাধে আমি রাজকুমার বলদেবকে আটক করার নির্দেশ দিচ্ছি।

—না! না! আমি রবিনাথকে হত্যা করিনি। আমি… আমি করিনি তাকে হত্যা। বলদেবের কথায় কান না দিয়ে অমাত্য বললেন,

—এখনও মিথ্যের আশ্রয় নেবে তুমি, বলদেব? ধিক্কার তোমায়! বাবার হত্যায় তোমায় এমনিতেই শূলে চড়ানো হবে। ভাইয়ের হত্যার দায়ে আমি সম্ভব হলে তোমায় দ্বিতীয়বার মৃত্যুদণ্ড দিতাম 1

—কিন্তু… কিন্তু আমি সত্যি রবিনাথকে হত্যা করিনি।

—রাজকুমার ঠিক কথাই বলছেন।

সকলে চমকে ওঠে এইবার। কারণ আগের কথাটা যার মুখ থেকে বেরিয়েছে তিনি স্বয়ং আচার্য চাণক্য। ওঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আরও একবার ঘুরে গেছে উপস্থিত সভাসদদের দিকে। বললেন,

—রবিনাথের হত্যাকারী বলদেব নয়। তার হত্যাকারী অন্য এক ব্যক্তি।

১৩.

উপস্থিত সকলের তীব্র গুঞ্জন প্রায় কোলাহলের পর্যায়ে পৌঁছেছে। চাণক্য ডান হাত তুলতেই পরমুহূর্তে নিশ্চুপ হয়ে গেল সভাঘর। সূচ পতনের নীরবতা ঘরে। চাণক্য গম্ভীর মুখে বলে চললেন,

—শীল বড়ো তাৎপর্যময় জিনিস। শীল অর্থাৎ মা-বাবা তথা বংশ সূত্রে পাওয়া মানুষের বৈশিষ্ট্য। পণ্ডিতরা বলেন রক্ত কথা বলে। রক্তের মাধ্যমে পাওয়া গুণ-সমষ্টি মানুষের চরিত্র, গতিবিধি, স্বভাব তথা ভবিষ্যৎ সব নির্ধারণ করে। এই পুরো ঘটনাক্রমে শীলের ভূমিকা সবচেয়ে প্রধান।

কথাগুলো কিছুটা যেন নিজের মনেই বললেন আচার্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—যুবরাজ রবিনাথের হত্যার ঘটনায় আসা যাক। রাত তৃতীয় প্রহরে তার চিৎকার শোনা যায় দক্ষিণ মহলে। তার পরের দৃশ্য এখানে উপস্থিত বেশিরভাগ মানুষেরই চোখের সামনে ঘটে। কিন্তু তার মৃত্যু রেখে যায় কিছু প্রশ্নচিহ্ন। প্রথমত তার আর্তনাদ সর্বপ্রথম শোনা গেছিল। অর্থাৎ ধারণা করা যায় যে ঠিক সেই মুহূর্তেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাহলে তারপর তাকে আমাদের সামনে, জানলায় দেখিয়ে কেন আবার গলায় কৃপাণ চালানো হল? তবে কি হত্যাকারীর উদ্দেশ্য ছিল যাতে তাকে সবাই দেখে হত্যা করতে? দ্বিতীয়ত, আমি রবিনাথকে সাবধান করেছিলাম যে তার ভাই তাকে গুপ্তহত্যা করার চেষ্টা করতে পারে। সে নিজেও সেই সম্ভাবনার জন্যে প্রস্তুত ছিল। অথচ তার পরেও সে রাতে স্বেচ্ছায় নিজের ঘর ছেড়ে একলা গেল কেন? তার সঙ্গে তলোয়ার ছিল। তবুও তাকে হত্যা করা হল সহজেই। কেন? এর একটাই উত্তর হয়। সেই রাতে রবিনাথ যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, সেই ব্যক্তি তার পরিচিত এবং অত্যন্ত ভরসাযোগ্য ব্যক্তি, যার কাছে রাজকুমার এতটাই নিশ্চিন্ত ছিল যে অসাবধান হয়ে পড়েছিল। এখানে সেইরকম মানুষ একজনই উপস্থিত আছেন। এমন একজন যাকে রবিনাথ এতটাই ভরসা করতেন যে তাঁর মনের সব কথা তাঁকেই প্রথম বলতেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন যে তিনি সেই ব্যক্তির থেকে কোনো কথা গোপন করেন না।

—আচার্য? এ আপনি কী ইঙ্গিত করছেন? মা কি তার সন্তানের ….

অমাত্যর কথা মাঝপথেই হাত তুলে থামিয়ে দিলেন চাণক্য। কুন্তী দেবী একইভাবে স্থির হয়ে বসে আছেন। ওঁর দিকে এক মুহূর্ত দৃষ্টি দিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন আচার্য। বললেন,

—না। মা কখনোই তার ছেলের প্রাণ নিতে পারে না। মমতার টানের কাছে এই বিশ্বের সব শক্তি তুচ্ছ। এই ক্ষেত্রেও তারই প্রমাণ দেব আমি। একজন মা তার ছেলের জন্যে কতদূর যেতে পারে আজ তারই কাহিনি শোনাব আমি। একজন দাসী রাজার প্রেমে পড়ে। তার গর্ভে আসে রাজার সন্তান। এদিকে দৈবাৎ রাজার পাটরানিও প্রায় একই সময়ে সন্তান ধারণ করেন। দুটো শিশুর জন্ম হয় প্রায় একইসঙ্গে। একদিন আগে পরে। কিন্তু রানির মৃত্যু হয় এবং তার ফলে শিশু দুটোর দায়িত্ব বর্তায় দাসীর ওপর। এবং এইখানেই মা, তার সন্তানের সুখের স্বার্থে একটা অভাবনীয় কাজ করেন। তিনি শিশু দুটোর পরিচয়ের অদলবদল করেন। নিজের সন্তানকে তিনি সবার কাছে মাতৃহারা পালিত রাজকুমার বলে পরিচয় করান। এবং রাজকুমারকে নিজের সন্তান হিসেবে। কারণ দাসী চেয়েছিলেন অদূর ভবিষ্যতে যেন তাঁর সন্তানই সিংহাসনে বসে। নিজের গর্ভে ধারণ করা সন্তান, তাঁর নিজের রক্ত, যেন সেই সম্মান পায় যা থেকে তিনি নিজে বঞ্চিত হয়েছেন। এটা এক অর্থে, মৃত রানির প্রতি তাঁর চরম প্রতিশোধও বটে। যে রানি তাঁকে এবং তাঁর পেটের সন্তানকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরই সন্তানকে নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন তিনি। কিন্তু বিধাতাপুরুষ সেইদিন হেসেছিলেন।

—না! না! না!! এ… এ হতে পারে না। আমি… আমি রাজকুমার! আমার ধমনিতে রাজরক্ত! আমি রাজকুল-শীল, আমি ওই দাসীর পুত্র না। এ হতে পারে না!

থরথর কাঁপছে বলদেব। একইভাবে কাঁপছেন কুন্তী দেবী। একবারের জন্যেও দৃষ্টি তুলছেন না তিনি। নির্মমভাবে চাণক্য বলতে থাকলেন,

—আপনার কুল-গৌরব মিথ্যে, রাজকুমার। আমার দাবির প্রমাণ আমি দেব। কারণ পরিচয় পালটে গেলেও শীল অপরিবর্তিত থাকে। আপনারা উপস্থিত প্রত্যেকেই, প্রতিনিয়ত একটা দৃশ্য দেখে এসেছেন। অতি সাধারণ দৃশ্য, যা আমি নিজেও এখানে আসার পরের দিন সকালেই চাক্ষুষ করি। কুন্তী দেবী দেবতার পুজোর জন্যে ফুল তুলতে যান গাছ থেকে, অন্য কারুর সহায়তা ছাড়া খুঁজে পান না তিনি। তাঁকে একজন দাসী সেদিন ফুলগুলো দেখিয়ে দিচ্ছিল। তারপর তিনি তা গাছ থেকে তুলেছিলেন। এই ব্যাপারটা দেখে আমি সেদিন তার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারিনি। কারণ তখনও কোনো ঘটনা ঘটেইনি। আমি ভেবেছিলাম নিশ্চয়ই কুন্তী দেবীর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। এরপরে, রাজকুমারের ছবি আঁকার ঘরে গিয়ে জানতে পারি রাজকুমার বলদেব বর্ণান্ধ। আমি তখনও এই ঘটনা দুটোর যোগসূত্র খুঁজে পাইনি। কারণ ফুল তোলার মতো সামান্য ঘটনা আমার মনে ছিল না। কিন্তু দু-দিন আগেই রাজকুমার বিরাট তার খেলার ছলে অজান্তেই আমায় সেই ঘটনা মনে করায়। সেইদিন বিরাট আমায় একটা নয়, দুটো গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিয়েছে। ‘বিষ’-এর কথা আগেই বলেছি। দ্বিতীয় সূত্র পাই যখন সে খেলার ছলে একটা জবা গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ে। সেই জবা গাছ দেখেই আমার সেই দ্বিতীয় দিন দেখা দৃশ্য মনে পড়ে যায়। আমার মনে সন্দেহ উঁকি দেয়। তবে কি কুন্তী দেবীও বর্ণান্ধ? এবং তিনি কি সেটা গোপন করছেন?

মহারাজা মহিপাল যে বর্ণান্ধ ছিলেন না সেটা তাঁর আঁকা রঙিন ছবিদেখেই নিশ্চিত হওয়া যায়। হতে পারে বড়োরানি বর্ণান্ধ ছিলেন। কিন্তু সেটা অতি কাকতালীয় হয়ে যায়। অতএব আমি একটা পরীক্ষা করি। আমি নিজে একটা চিঠি লিখি তিনটে আলাদা রঙের কালিতে। হাতের লেখা পরীক্ষার অজুহাতে আমি সেটা দেখতে দিই কুন্তী দেবীকে। উনি হাতের লেখা দেখতে পান, অর্থাৎ ওঁর দৃষ্টিশক্তি মোটেই ক্ষীণ নয়। কিন্তু চিঠিটা পরীক্ষা করার সময়ে তিনি একবারও প্রশ্ন করেন না, যে সেটা তিনটে আলাদা রঙে কেন লেখা। অর্থাৎ তিনি রঙের পার্থক্য করতে পারেননি। এতেই আমি নিশ্চিত হলাম যে আমার সন্দেহ অমূলক নয়! এরপর বলদেবের মায়ের পরিচয় অনুমান করা কঠিন কাজ নয়। কী কুন্তী দেবী? আমি কি এখনও অবধি ঠিক বলছি?

দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে আছেন কুন্তী দেবী ও বলদেব। তাঁদের ভঙ্গিমা এই মুহূর্তে সত্যিই মা-ছেলে বলেই চিনিয়ে দিচ্ছে যেন। এত বড়ো ঘটনা সবার মনে থিতু হতে সামান্য সময় দিলেন আচার্য। কয়েক মুহূর্ত মৌন থেকে বললেন,

—আপনার ওপর আমার করুণা হয়, কুন্তী দেবী। এত বছরের ত্যাগ, অপমান আর নিজের ছেলের কাছে তিরস্কার সব সহ্য করেও শেষরক্ষা হল না। এত কিছুর পর যেদিন শুনলেন যে মহারাজ আপনার ছেলেকে বঞ্চিত করে তাঁর সিংহাসন রবিনাথকে দিয়ে গেছেন, সেদিন আপনার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মহারাজ সত্যি বুঝতে পেরেছিলেন, নাকি সত্যি তিনি রবিনাথকে যোগ্য শাসক হিসেবে চিনতে পেরেছিলেন তা আমার জানা নেই। তবে এতে আপনার সতিন, মৃত রানি আরও জিতে গেল। আপনি তা সহ্য করতে পারলেন না এবং তখনই আপনি এক ভয়ংকর নির্মম সিদ্ধান্ত নিলেন। আপনি ঠিক করলেন যে নিজের এত বছরের সাধনা আপনি বিফল হতে দেবেন না। তারজন্য রবিনাথকে তার রাজ্যাভিষেকের আগেই মরতে হবে। আপনি নিজে তাকে হত্যা করবেন বলে ঠিক করলেন। তাকে হত্যা করায় আপনার ছেলে বলদেবের দুটো লাভ। প্রথমত, তার পথের কাঁটা দূর হবে। দ্বিতীয়ত, তার ওপর থেকে অশরীরীর বেশে রাজহত্যার সন্দেহ সরে যাবে।

রবিনাথ আগেই আপনাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি নিজের ভাইকে সন্দেহ করেন। আপনি সেই সময় নিজেদের পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে তাকে মৌন রাখতে সক্ষম হলেন। কিন্তু এরপরেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেল। রবিনাথ যুবরাজ হয়ে নিজের সন্দেহর কথা আমায় জানাল। রাতে যখন সেই কথা আপনাকে বলল সেই মুহূর্তে আপনি বুঝলেন যে আপনার পালিত ছেলে না মরলে আপনার নিজের ছেলেকে রক্ষা করে যাবে না। এরপরেই আমরা যেদিন তার ঘরে গেলাম, সেইদিন সুরার নেশায় সে নিজেই অশরীরীর বর্ণনা আমাদের দিয়ে দিল। আপনি তখনও তাকে বাঁচালেন এবং মাঝপথেই তার কথা থামিয়ে দিলেন। আপনি সহজেই অনুমান করতে পেরেছিলেন যে বলদেবই তার বাবার হত্যাকারী। আপনি এও জানতেন, অথবা রবিনাথই নিজের সন্দেহর কথা আপনাকে জানিয়েছিল, যে, বলদেবের ছদ্মবেশ তার ছবি আঁকার ঘরে লুকোনো থাকে। আপনি সেটা সরিয়ে ফেললেন। কিন্তু আপনি যেহেতু তার সম্পূর্ণ সাজের কথা জানতেন না, তাই একটা রুদ্রাক্ষের মালা আপনি ভুলে না নিয়েই চলে এলেন। এর পরের দিন রাতে রবিনাথকে দক্ষিণ মহলে ডেকে পাঠালেন। গোপন জরুরি কথা বলার অজুহাতে তাকে একলা আসতে বললেন। আপনি কাপালিকের ছদ্মবেশে তৈরি ছিলেন।

পরের ঘটনা শুধুই আমি অনুমান করতে পারি। সে আপনাকে সেই বেশে দেখে চমকাল। কী ঘটছে জানতে চাইল। আপনি বললেন তাকে ঘরের উলটো দিকের জানলা দিয়ে উত্তর মহলে দেখতে। তাহলেই সব উত্তর পেয়ে যাবে। আপনার কথামতো সে জানলার ধারে এসে দেখতে গেল। আর তখনই তাকে আপনি পেছন থেকে আঘাত করলেন। ততক্ষণে রাজকুমারের আর্তনাদে উত্তরের সমস্ত দর্শক জেগে উঠেছে। অতএব, সর্বসমক্ষে আরও একবার তার গলায় কৃপাণ চালিয়ে তার দেহ ঠেলে ফেলে দিলেন নদীতে। মৃতদেহ উদ্ধার করা গেলে দেখা যেত যে গলায় আঘাতের আগেই তার শরীরে অন্য একটা মারণ আঘাত করা হয়েছিল।

কিন্তু সেই রাতে সবাই দেখল এক অশরীরীকে হত্যা করতে। এতে সেই সময়ে উত্তর মহলে থাকা বলদেবের ওপর কারুর আর সন্দেহের অবকাশ রইল না। সে এই ছদ্মবেশী কাপালিক হতেই পারে না। কিন্তু মৃদু আলোয় মুখ না দেখা গেলেও একটা জিনিস বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল উত্তর মহল থেকে। ডান হাত দিয়ে হত্যা করার মুহূর্তে আপনার হাত সামনে উঠে আসে এবং আমি দেখেছিলাম যে ছায়ামূর্তির হাতে রুদ্রাক্ষের মালা নেই, যেটা বলদেবের বর্ণনা অনুযায়ী তার ডান হাতে থাকত। তাই কিছুটা অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই বলেছিলাম যে ওই রুদ্রাক্ষের মালাটা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এতক্ষণ সবার মনে চলতে থাকা প্রশ্নটা করেই ফেলল জীবসিদ্ধি।

—কিন্তু গুরুদেব, একটা বিষয় আপনি ভুল বলছেন যে। হত্যাকাণ্ড কুন্তী দেবীর ঘরে কীভাবে হয়? আমরা প্রত্যেকে দেখেছি যে আততায়ী তিন নয়, চার তলার কোনো একটা জানলায় ছিল।

—হুম। এই একটা প্রশ্নই ছিল আমার কাছে শেষ অমীমাংসিত রহস্য, যা আজ ভোর বেলা পর্যন্ত আমায় ধন্দে রেখেছিল। এর সমাধান সূত্র আমি পাই মৎস্যজীবীর কথা থেকে। এরজন্যে তোমায় বিশেষ করে ধন্যবাদ হে, জীবসিদ্ধি। আজ সূর্যোদয় না দেখতে গেলে সম্ভবত এখনও আমি অন্ধকারেই রয়ে যেতাম।

—কীভাবে গুরুদেব?

.

জীবসিদ্ধির প্রশ্নর সোজাসুজি উত্তর দিলেন না চাণক্য। বললেন,

—রোজকার সাধারণ ঘটনা আমরা সবসময়ই সহজে উপেক্ষা করে ফেলি। এখানে উপস্থিত প্রত্যেকে হয় এই দুর্গর বহুদিনের বাসিন্দা অথবা আপনাদের নিয়মিত যাতায়াত। আপনারা প্রতিদিন দিনের তৃতীয় প্রহরে একটি ঘটনা চাক্ষুষ করেন। দুর্গর দুটো মহলের মাঝে বয়ে চলেছে মহানদী। প্রতিদিন একটা বিশেষ সময়ে নদীর জল ভাটার টানে নেমে যায়। আর তখন বেরিয়ে আসে নদীর নীচে থাকা এই দুর্গর আসল প্রথম তলা। এর কারণ বলতে পারেন, অমাত্য?

অমাত্য উত্তর দিলেন,

—হ্যাঁ। আসলে এই দুর্গ তৈরির পরে নদী কেটে মাঝখান দিয়ে জল আনা হয়। কিন্তু নদীর জল আনার পর একটা সমস্যা দেখা দেয়। নদীর জল জোয়ারের সময়ে প্রথম তলাটা প্লাবিত করে ফেলে। তাই এই দুর্গর চারপাশের মাটি ফেলে উঁচু করে, দ্বিতীয় তলাকেই প্রথম তলা বানিয়ে ব্যবহার শুরু হয়।

—হুম। কিন্তু সেই তলা বেশিরভাগ সময়েই ডুবে থাকলেও নদীতে ভাটার সময় সেটা উন্মুক্ত হয়। উন্মুক্ত হয় সেখানে প্রবেশ করার সিঁড়ি। তাই নয় কি?

—হ্যাঁ। তা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে হত্যার কীসের সম্পর্ক? – বড়োই গভীর সম্পর্ক, আর্য। আমি আজ সকালে মৎস্যজীবীদের থেকে জানতে পারি যে ভাটা শুধু দিনেই নয়, রাতেও আসে। কয়েক দণ্ডর* জন্যে। আর তখনই আমার কাছে সেই রাতের ঘটনা পরিষ্কার হয়।

কুন্তী দেবী এই রাতে জলের স্তর নেমে যাওয়ার প্রাকৃতিক ঘটনাটাকে অসাধারণভাবে ব্যবহার করেন। রাতে দ্বিতীয় প্রহরের শুরুতে যখন জল নেমে লুকোনো তলাটা উন্মুক্ত হয়, তিনি সেইসময়ে নীচে গিয়ে অব্যবহৃত তলায় কয়েকটা তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে ফিরে আসেন নিজের ঘরে, তিনতলায়। তিনি ঠিক দ্বিপ্রহরের শেষের দিকে রবিনাথকে আসতে বলেছিলেন নিজের ঘরে। প্রসঙ্গত এই তৃতীয় তলায় কুন্তী দেবীর আদেশে প্রহরী বা দাস-দাসী ছিল না তা তিনি নিজেই আমাদের জানিয়েছিলেন। কথামতো রবিনাথ আসে এবং নিজের বিমাতার হাতে প্রাণ দেয়। কিন্তু উত্তরের জানলায় দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষ যখন রাতের অন্ধকারে, অনতিদূরের দক্ষিণ মহলের দিকে দেখেন, অভ্যাসমতো তাঁরা প্রতিটা তলায় আলো দেখে সেটা কোন তলা তা হিসেব করেন। অন্ধকারে ওপরের তলা থেকে বোঝা অসম্ভব। কারণ একদম ওপরের তলা অব্যবহৃত এবং অন্ধকার। অতএব আমি, আপনি এবং আমরা প্রত্যেকে একদম নীচের প্রজ্বলিত তলা থেকে গুনতে শুরু করি। নীচের অব্যবহৃত তলাতেও আলো থাকায় ওটাকে আমরা প্রথম তলা বলে ভুল করলাম। অতএব তৃতীয় তলা, সেই রাতের অন্ধকারে উত্তর মহলের বাসিন্দাদের কাছে হয়ে গেল চতুর্থ তলা!

দুই মহলের মাঝের সেতু, দু-দিকের তিনতলা জোড়া লাগায়। আমরা দৌড়ে পৌঁছোলাম দক্ষিণের তৃতীয় তলায়। আর সেই অপেক্ষায় ছিলেন কুন্তী দেবী। ততক্ষণে ছদ্মবেশ ত্যাগ করে সবার সামনে তিনি বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করেন। এরপর আমরা যখন কয়েক মুহূর্ত আগেই দেখা একটা বিভ্রমের উদ্দেশে ওপরে ছুটে চললাম, তিনিও সঙ্গে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই চারতলায় কাউকে পাওয়া গেল না। এদিকে বাকি তলা যখন তল্লাশি হল তখন কুন্তী দেবীর ঘর বাদ দিয়েই দেখা হল। কারুর সন্দেহ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ তা বাইরে থেকে তালা দেয়া ছিল। ভেবে দেখুন অমাত্য, সেই সময়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে, যখন কুন্তী দেবী চারতলায় বসে আমাদের সামনে ছেলে হারানোর শোকে বিলাপ করছেন, সে সময়ে, তাঁরই ঘরে রক্তাক্ত একটা কৃপাণ, ছদ্মবেশ এবং রক্তের দাগ পড়ে আছে। এদিকে সৈনিকরা সেটাই অন্য সর্বত্র খুঁজে চলেছে। এই পুরো ঘটনায় ততক্ষণে তৃতীয় প্রহর শেষ হয়ে গেছে এবং নীচের লুকোনো তলা আবার প্লাবিত হয়ে সেখানে আলো নিভে গেছে বহু আগেই। উত্তর মহলে ফিরে গিয়ে আর অনুধাবন করার কোনো উপায় নেই কোনটা কোন তলা ছিল। কারণ ততক্ষণে আসল চারতলায় আলো জ্বলে উঠেছে এবং নীচের অতিরিক্ত তলাটা আবার নদীর নীচে লুকিয়ে পড়েছে। কী অভাবনীয় পরিকল্পনা! এতগুলো মানুষের চোখের সামনে পুরো অপরাধ ঘটানো হল। অথচ কেউ সেটা দেখেও দেখতে পেল না।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আচার্য তাকালেন কুন্তী দেবীর দিকে।

—এরপর ভোরের একটু আগে তিনি ফিরে এলেন নিজের ঘরে। শোকার্ত হওয়ার ভান করে দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে একান্তে কাটালেন সারা সকাল। এই সময়ে উনি ছদ্মবেশ এবং রক্তাক্ত কৃপাণ, জানলা দিয়ে নদীর জলে ছুড়ে ফেলেন অথবা হয়তো পুড়িয়ে ফেলেন নিজের ঘরেই। পরিষ্কার করে ফেলেন ঘর, যাতে হত্যাকাণ্ডর কোনো চিহ্ন বা রক্তের দাগ না থেকে যায়। অভূতপূর্ব হত্যাকাণ্ড, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এত কিছুর পরেও তিনি আজ বিফল হলেন।

.

সারা সভাঘর নিশ্চুপ হয়ে আছে। রহস্যর আকস্মিকতা আর অপ্রত্যাশিত সমাধানে সবাই হতবাক। এতক্ষণ দু-হাতে মুখ ঢেকে কুন্তী দেবী শুধু সমস্ত কথা শুনছিলেন। একটা বাক্য বলেননি এতক্ষণ। হঠাৎ এইবার তিনি শান্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। প্রত্যেকের দৃষ্টি এখন তাঁর ওপর নিবদ্ধ। কাঁপা অথচ দৃঢ় গলায় বললেন,

—আমি দুটো হত্যার দায় স্বীকার করছি। দুটো হত্যাই আমি একা ঘটিয়েছি। এতে রাজকুমার বলদেবের কোনো দায় নেই।

—তা হয় না, কুন্তী দেবী। আপনারা দু-জনই দুটো আলাদা হত্যার দায়ে দোষী।

শান্ত কণ্ঠে বললেন আচার্য। এইবার কেঁপে উঠল কুন্তী দেবীর স্বর। এই প্রথম দুর্বল শোনাল তাঁকে।

—আমি আপনার কাছে নিজের ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাইছি, আচার্য! দয়া করুন! এটা এক মায়ের শেষ আর্তি।

কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে আচার্য চাণক্য ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন,

—বেশ। কথা দিলাম রাজকুমার বলদেবের প্রাণদণ্ড হবে না। তাকে আজীবন কারাবাসে দণ্ডিত করা হবে। কিন্তু এর বেশি কিছু আমার কাছে চাইবেন না। এর বেশি কিছু করতে আমি অপারগ। শুধু গর্ভে ধারণ করলেই মা হওয়া যায় না। রবিনাথের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে আপনি সমগ্র স্ত্রীজাতি ও মায়েদের কলঙ্কিত করেছেন। এর ক্ষমা নেই।

—আমি এই অপরাধের ক্ষমা ভিক্ষা করছি না, আচার্য। আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ, আচার্য।

দু-জন সৈনিক এগিয়ে এসে কুন্তী দেবীকে নিয়ে চলল সভাঘরের বাইরে। তিনি বাধা দিলেন না বা প্রতিবাদ করলেন না। সম্ভবত তিনি এই ভবিতব্যের জন্যে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। দরজা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার শুধু জলে-ভেজা চোখে তিনি ফিরে চাইলেন রাজকুমার বলদেবের দিকে। বলদেবও তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে। এই প্রথমবার বলদেবের কাঁপা ঠোঁটে একটা শব্দ উচ্চারিত হল। যে শব্দটা তার মুখে শোনার জন্যে কুন্তী দেবীকে একুশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

—মা!

* ১ দণ্ড = ২৪ মিনিট।

উপসংহার:

আচার্য চাণক্যর ঘরে বসে আছেন বৃদ্ধ অমাত্য এবং জীবসিদ্ধি। বৃদ্ধ বললেন,

—তোসালি-র এইবার কী হবে, আচার্য? রাজসিংহাসন তো খালি রাখা যায় না।

—হুম। খালি কেন থাকবে? কালকেই তো রবিনাথের অভিষেকের তিথি। সেই শুভ তিথিতেই রাজকুমার বিরাটের অভিষেক হোক।

—বিরাট? কিন্তু…

—সে সিংহাসনে বসুক। আর রাজ্যপাট তার মা কৌশল্যা দেবী সামলাবেন। আমি যতদূর তাঁকে চিনেছি এই কয়েক দিনে, তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং মেধাবী। যোগ্য শাসক হবেন তিনি। আপনার মতো যোগ্য প্রধান অমাত্য পাশে থাকলে এই রাজ্যের কুশল হবে তাতে আমি নিশ্চিত।

—আপনি যা বলবেন, আচার্য। আমার মনেও কৌশল্যা দেবীর কথা এসেছিল। কিন্তু বাকি অমাত্যরা কি বিরাটকে রাজা হিসেবে মেনে নেবে? এক স্ত্রীলোকের নির্দেশ কি তারা মানবে?

মৃদু হেসে চাণক্য উত্তর দিলেন,

—মগধের পূর্ণ সমর্থন থাকলে তারা মানতে বাধ্য। আমার উপস্থিতিতেই কালকে বিরাটের রাজ্যাভিষেক হোক।

—বেশ। তাই হোক।

—হুম। আমরাও তার পরের দিন রওনা হয়ে যাব। ওহে জীবসিদ্ধি, সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে আগেই একটা চিঠি লিখে পাঠাও। দু-দিন পরে আমাদের রওনা হওয়ার খবর দাও। তাকে জানাতে ভুলো না যে এদিকে সব ভালোভাবে মিটেছে।