শীল-শাস্ত্ৰ – ১

১.

—এই তবে তোসালির দুর্গ। সত্যি বিশাল এর পরিধি, গুরুদেব।

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে চাণক্য এবং জীবসিদ্ধির ঘোড়া। সামনে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল দুর্গটার দিকে দু-জনে চেয়ে আছেন। জীবসিদ্ধির কথা শুনে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,

—হুম। জীবসিদ্ধি আমাদের আসার খবর দিয়ে তুমি আগেই দূত পাঠিয়েছ তো?

—হ্যাঁ, আচার্য। ওই তো, দেখুন। প্রধান দরজা খুলে যাচ্ছে।

বেশ কয়েক দিনের যাত্রার পরে মগধের প্রতিনিধি দল পৌঁছেছে তোসালির দুর্গে। ঘোড়ার পিঠে করে আচার্য চাণক্য, ওঁর শিষ্য জীবসিদ্ধি এবং তাঁদের সঙ্গে জনা পঞ্চাশ সৈনিকের দলটা এগিয়ে চলল বিরাট লোহার ফটক পার করে দুর্গের ভেতরে। তাঁদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে এল এক বলিষ্ঠ যুবক পরনের রাজবেশ এবং ভূষণ দেখেই যুবককে রাজপরিবারের সদস্য বলে চিহ্নিত করা যায়। ততক্ষণে আচার্য এবং জীবসিদ্ধি ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়িয়েছেন। যুবক প্রথমেই এগিয়ে এসে জীবসিদ্ধিকে উদ্দেশ করে বলল,

—চাণক পুত্র, মহামতি আচার্য চাণক্যকে আমার প্রণাম।

জীবসিদ্ধি আচার্যর দিকে ইঙ্গিত করে বলল,

—ইনি আচার্য চাণক্য

যুবক চাণক্যর দিকে চেয়ে বিস্মিত হল। চাণক্য মনে মনে কৌতুক বোধ করলেন। এই যুবক বোধ হয় কোনো সুদর্শন, দীর্ঘকায় ব্যক্তিকে আশা করেছিল। বাস্তবে একজন কৃষ্ণবর্ণ, অতি সাধারণ চেহারার ব্রাহ্মণকে দেখে বিস্মিত হয়েছে। এই প্রথম নয়। আগেও বহুবার আচার্যর সঙ্গে এই ঘটনা ঘটেছে। যুবক নিজের ভুল শুধরে নিয়ে এইবার চাণক্যর সামনে এসে বলল,

—ক্ষমা করবেন, আচার্য। আপনাকে আমাদের অতিথি হিসেবে পেয়ে আমরা যারপরনাই সন্মানিত। আমি রাজকুমার বলদেব। মহারাজ মহিপালের পুত্র এবং তোসালির যুবরাজ। দুর্গে আপনাদের স্বাগত।

—আপনার পিতৃবিয়োগে আমরা শোকান্বিত, যুবরাজ। সমবেদনা জানাই। এই আমার শিষ্য এবং ছায়াসঙ্গী জীবসিদ্ধি।

—নমস্কার। আসুন, ভেতরে আসুন। সৈনিকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আস্তাবলে ঘোড়া ছেড়ে তারাও দুর্গে প্রবেশ করুক।

ইতিমধ্যে বলদেবের পেছনে আরও এক রাজবেশধারী যুবক, কিছুটা কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে লক্ষ করে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,

—আর আপনি? আপনার পরিচয় তো জানা হল না?

বলদেব ঘুরে এই যুবককে দেখে বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলল:

—তুমি এখানে কেন? বললাম যে তোমার প্রয়োজন নেই আসার। যাও। মগধ সৈনিকদের কোনো প্রয়োজন আছে কি না, দেখো।

দ্বিতীয় যুবকটি মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেলে, বলদেব বলল:

—ও রবিনাথ। আমার বাবার আর তার এক দাসীর গর্ভের সন্তান।

আপনারা ভেতরে আসুন।

রবিনাথকে নিজের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা বলে যে বলদেব পরিচয় দিল না, সেটা নজর এড়াল না চাণক্য এবং জীবসিদ্ধির। বলদেবের সঙ্গে দু-জন প্রবেশ করলেন দুর্গের ভেতরে।

২.

শরীর ক্লান্ত থাকায় সামান্য খাওয়া-দাওয়ার শেষে নিজের ঘরে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন চাণক্য। ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দুর্গের গঠন বোঝা যায়। দুর্গটা দু-মহলা এবং বিশাল। খরস্রোতা মহানদ থেকে খাল কেটে নদী বানানো হয়েছে এবং দুর্গের দুটো মহল নদীর দু-পাড়ে অবস্থান করছে। দু- দিকের মহল হুবহু একইভাবে তৈরি করা। অর্থাৎ আয়নার প্রতিচ্ছবির মতো। আচার্যর নিজের ঘর তিনতলায়। সামনের মহল দেখে বোঝা যায় তাঁর ঘরের জানলার ওপরে আরও তিনটে তলার জানলা আছে। দুটো মহলের মাঝে। একটা যোগাযোগ সেতু আছে যেটা দুটো মহলের তৃতীয় তল জোড়া লাগিয়েছে। সেতুর নীচে অর্ধচন্দ্রাকৃতি খিলানের নীচ দিয়ে নদী বয়ে চলেছে। জানলা দিয়ে নীচে তাকালেই নদী দেখা যায়। দুর্গের স্থাপত্যশৈলী দেখে এককথায় মুগ্ধ হলেন চাণক্য।

অসময়ে ঘুমোনোর অভ্যাস না থাকলেও আজ ক্লান্ত থাকায় কিছু সময়ের জন্যে ঘুম নেমে আসে আচার্যর চোখে। ঘুম থেকে জেগে আবার জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের শোভা দেখছিলেন চাণক্য, তখনই দরজায় মৃদু করাঘাত হল। দরজা খুলতে প্রথমে জীবসিদ্ধি ঢুকল এবং তার সঙ্গে একজন অপরিচিত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ। জীবসিদ্ধি পরিচয় করিয়ে দিল,

—ইনি হলেন অখণ্ড আর্যাবর্তের কাণ্ডারি তথা সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর গুরু আচার্য চাণক্য। এবং ইনি হলেন রাজা মহিপালের প্রধান অমাত্য ভদ্রদাস মহাশয়।

দু-জনেই একে অন্যের প্রতি নমস্কার জানালেন। বৃদ্ধ বললেন,

—আপনার বিশ্রামে কি বিঘ্ন ঘটালাম মহামতি?

—আজ্ঞে না। আমার বিশ্রাম সম্পূর্ণ হয়েছে অল্প আগে। আমি আপনার চেয়ে বয়সে অনুজ এবং তক্ষশিলার একজন প্রাক্তন আচার্য মাত্র। তাই আমায় মহামতি সম্বোধন নিষ্প্রয়োজন।

—আপনার কথায় বুঝতে পারছি যে বিনয়-ই জ্ঞানীর শ্রেষ্ঠ ভূষণ।

মৃদু হাসলেন চাণক্য, মুখে কিছু বললেন না। জীবসিদ্ধি জানে যে তার আচার্য মনে মনে আনন্দিত হয়েছেন। প্রকাশ না করলেও, আচার্য নিজের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করেন। সেটা তাঁর সব কাছের শিষ্যরাই জানে। চাণক্য দু-জনকে আসন দেখালেন,

—আসন গ্রহণ করুন, আর্য। আর বলুন আমার সঙ্গে সাক্ষাতের হেতু কি শুধুই আলাপচারিতা, নাকি, বিশেষ কোনো কারণ?

—না, আচার্য। নতুন রাজার অভিষেক হওয়ার আগেই এখানকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে আপনাকে একটু পরিচিত করিয়ে রাখাই আমার আজকের আসার উদ্দেশ্য। কারণ আজ সূর্যাস্তর পর মহারাজ মহিপালের ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্র পাঠ করা হবে সকলের উপস্থিতিতে। আমার ধারণা এর ফলে পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

—হুম। আপনার কথা থেকে অনুমান করতে পারি যে এই ইচ্ছাপত্রে মহারাজ কাকে নিজের উত্তরাধিকার বানিয়ে গিয়েছেন, তা আপনি জানেন। তাই নয় কি?

—হ্যাঁ। আমি জানি। আমার উপস্থিতিতে এবং আমার পরামর্শেই মহারাজ ওঁর ইচ্ছাপত্র নথিভুক্ত করেন। আর এতে উনি রবিনাথকে তোসালির যুবরাজ তথা ভাবী শাসক নির্বাচন করে গেছেন।

—সেকী? জ্যেষ্ঠপুত্র বলদেব তো এতে খুবই ক্ষুণ্ন হবেন বলে ধারণা করতে পারি।

—অবশ্যই হবেন। বলদের অতি বদরাগী এবং… ক্ষমা করবেন… মন্দবুদ্ধি। পিতার অতিরিক্ত আশকারায় সে বিগড়ে গেছে বাল্যকাল থেকেই। মহারাজ মহিপাল শেষের দিকে নিজের ভুল বুঝতে পারেন। নিজের দিন আসন্ন বুঝে তিনি নিজের সিংহাসন রবিনাথকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

—হুমম। হঠাৎ এই উপলব্ধির কারণ? তিনি কি অসুস্থ ছিলেন?

—তা ছিলেন। কিন্তু ওঁর নিজের মৃত্যু আসন্ন মনে হওয়ার কারণ অন্য ছিল।

—কী সেই কারণ?

—উনি বিশ্বাস করতেন যে এই রাজবংশের ওপর অভিশাপ আছে। মহারাজ মহিপালের কোনো এক পূর্বপুরুষকে, এক মৃত্যুপথযাত্রী সন্ন্যাসী অভিশাপ দিয়েছিলেন বলে এই প্রদেশে জনশ্রুতি আছে। প্রথমদিকে মহারাজ এই সমস্ত বিশ্বাস না করলেও, বয়সের সঙ্গেই তাঁর মন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। গত কয়েক মাস ধরেই মহারাজ আতঙ্কে ভুগছিলেন। তিনি নাকি রাতের বেলায়, এই দুর্গের অন্ধকার আনাচেকানাচে এক সন্ন্যাসীর অবয়ব দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি সেটাকে আসন্ন মৃত্যুর ছায়া বলেই ধরে নিয়েছিলেন।

—সেকী? অশরীরী উপস্থিত। আপনি নিজে কি এই কাহিনিতে বিশ্বাসী, আর্য?

দৃঢ়ভাবে দু-পাশে ঘাড় নাড়লেন বৃদ্ধ,

—একদমই না। ওটা অসুস্থ মানুষের বয়সকালীন অনুভূতিমাত্র। তবে যাই হোক, সেই কারণেই এই হঠাৎ হৃদয় পরিবর্তন।

—আপনার এই বিষয়ে কী মতামত ছিল? শুনেছি রবিনাথ রানির পুত্র নয়, সে দাসীপুত্র?

—আমি মহারাজের নির্ণয়কে স্বাগত জানিয়েছিলাম। রবিনাথের মা কুন্তী দেবী অতি দুঃখী এবং ভালোমানুষ। তাঁর ছেলেও তাঁরই মতো ভদ্র এবং শান্ত।

—স্বর্গত মহারাজ এবং ওঁর পারিবারিক ইতিহাস যদি একটু বলেন তাহলে বুঝতে সুবিধা হয়।

—রাজা মহিপালের পাটরানি ছিলেন রানি মণিমালা। উনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। রাজার সঙ্গে রানির কোনোদিনই বিশেষ গভীর সম্পর্ক ছিল না। সেই সময়ে রানির একজন দাসী ছিল কুন্তী। রাজা একবার অসুস্থ হলে এই দাসী তাঁর সেবা করেন। আর সেই থেকেই নিঃসঙ্গ মহারাজ মহিপালের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। কয়েক মাস পর রানি একসময় যখন অন্তঃসত্ত্বা হলেন তখন প্রায় একই সময়ে কুন্তীরও গর্ভে রাজার সন্তান আসে। পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে যায়। রানি মণিমালা এই অপমান মেনে নিতে পারেননি। তিনি দাসী কুন্তীকে তীব্র ভর্ৎসনা আর তিরস্কার করা শুরু করলেন। একসময় তা প্রায় অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছোয়। রানি গোপনে কুন্তীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। আমি কুন্তীকে সেই সময় রানির প্রকোপ থেকে বাঁচাই। রাজাও চেষ্টা করতেন কুন্তীকে যতটা সম্ভব রক্ষা করতে। কিন্তু রানির ক্রোধের আগুনে ওঁকেও কম দগ্ধ হতে হয়নি।

টানা অনেকক্ষণ কথা বলে একটু থামলেন বৃদ্ধ। জীবসিদ্ধি একটা পানপাত্রে সামান্য জল ভরে এগিয়ে দিল বৃদ্ধর দিকে। দু-চুমুক জল খেয়ে অমাত্য ভদ্রদাস আবার অতীতের কাহিনি শুরু করলেন,

—বলদেব ও রবিনাথ মাত্র কয়েক ঘণ্টার তফাতে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু বলদেবের জন্ম দিতে গিয়েই রানি মণিমালার মৃত্যু হয়। এবং তখন নিজের সন্তানের সঙ্গেই, মৃত রানির শিশুপুত্রর দায়িত্বও হাসিমুখে নিজের কাঁধে তুলে নেন কুন্তীদেবী। আজ অবধি তিনি নিজের সন্তান রবিনাথ এবং নিজের হত্যার চক্রান্তকারী মহারানির সন্তান বলদেবের মধ্যে কখনো ফারাক করেননি। দাসী কুলে জন্ম হলেও কুন্তী একজন সত্যিকারের মহীয়সী নারী এবং মা। সে আমার বোনের মতো। অথচ এত বছর তার নিজের হাতে মানুষ করা বলদেবের থেকেও তিরস্কার বই আর কিছু পায়নি। দাসী বলে বলদেব নিজের বিমাতাকে মায়ের সম্মান দেয়নি কোনোদিনই। রবিনাথকেও সে সারাজীবন দাসীপুত্র বলে হেয় করে এসেছে। অতএব যখন বলদের জানতে পারবে যে তার বাবা তাকে যুবরাজের পদ থেকে সরিয়ে, তার বিমাতার সন্তানকে যুবরাজ বানিয়ে গেছেন, সে এর বিরোধিতা করবেই কিন্তু আমি মনে করি রবিনাথ মানুষ হিসেবে বলদেবের চেয়ে উত্তম। এবং এইবার রবিনাথ রাজসিংহাসনে বসলে অন্তত কুন্তী দেবী তার যোগ্য সম্মান পাবে। রাজমাতা হবে সে।

—সত্যিই সাক্ষাৎ মাতৃরূপা নারী তিনি। ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছে রইল। তা, মহারাজের এই দুই সন্তানই আছে শুধু? অন্য কোনো রানি….

—আছে। ছোটোরানি কৌশল্যা। তার এবং মহারাজের কনিষ্ঠ পুত্র হল বিরাট। কিন্তু সে… সে ঠিক আর পাঁচটা শিশুর মতো স্বাভাবিক নয়। তার মুখের গঠন অস্বাভাবিক, বোধবুদ্ধি কম এবং কথা বলতে পারে না ঠিকমতো। এই সন্তানকে নিয়ে মহারাজ মহিপালের লজ্জা ছিল। ছোটোরানি কৌশল্যাকে তিনি সুস্থ পুত্রর জন্ম না দিতে পারার দোষে ভর্ৎসনা করতেন। এই কারণেই ছোটোরানি জনসমক্ষ থেকে নিজেকে এবং নিজের সন্তানকে ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলে। সে তার সন্তানকে নিয়ে থাকে শুধু অন্দরমহলে।

—আহা! বড়োই দুঃখের বিষয়।

—সত্যিই দুঃখের। মহারাজ নিজে এবং বলদেব বিরাটকে খুবই হেয় করত। অথচ ওই অবোধ সারাদিন তাদেরই আশেপাশে থাকার চেষ্টা করত। যাই হোক, আজ একটু পরে সবার সঙ্গেই আপনাদের সাক্ষাৎ হবে। বলদেবকে রাজা করা হবে না জানতে পারলে সে প্রচণ্ড রেগে যাবে। হয়তো রাজদ্রোহ করতেও উদ্যত হবে। সেই কারণেই আপনাদের উপস্থিতি আমার বিশেষ প্রয়োজন, আচার্য।

—হুম। আমার থেকে আপনি কী ধরনের সহযোগিতা আশা করেন?

—রবিনাথকে যুবরাজ করার পর আপনি শুধু মগধের হয়ে নিজের সমর্থন জানাবেন। ব্যস। এইটুকুই যথেষ্ট। কেউ আর বলদেবের হয়ে বিদ্রোহ করে শক্তিশালী মৌর্যদের বিরাগভাজন হওয়ার সাহস করবে না।

—বেশ। তাই হবে। মগধও চায় যেন এই রাজ্য ঠিক আগের মতোই সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে থাকে। আপনি যদি আশ্বাস দেন যে রবিনাথকে সমর্থন করাই মগধের পক্ষে হিতকর হবে, তবে তাই হোক।

—অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আচার্য। আমায় তবে বিদায় দিন।

—বেশ। সূর্যাস্তর পর সাক্ষাৎ হবে তাহলে। প্ৰণাম।

বেরিয়ে যাচ্ছিলেন বৃদ্ধ অমাত্য। চাণক্য পিছু ডাকলেন।

—আর্য।

পিছু ফিরলেন বৃদ্ধ। চাণক্য প্রশ্ন করলেন,

—একটা সংশয় আছে। ভালোমানুষ মানেই সবসময় ভালো শাসক হয় না। রবিনাথের মধ্যে রাজগুণ কতখানি আছে?

মৃদু হাসলেন বৃদ্ধ। বললেন,

—আশ্চর্যভাবে তার অর্ধ রাজরক্তের মধ্যে রাজলক্ষণ পূর্ণ রাজরক্তধারী যুবরাজের চেয়ে বেশি আছে বলেই আমি এত বছরে দেখেছি। আমি মনে করি রবিনাথের মধ্যে সমস্ত রাজগুণ আছে। সে একজন উৎকৃষ্ট শাসক হবে।

—যাক। নিশ্চিন্ত হলাম আপনার কথায়।

৩.

সন্ধ্যার সময়। সভাঘরে একত্র হয়েছেন সকলে। চাণক্য শেষ কোনায় একটা আসনে বসেছেন। এই জায়গা থেকে বাকি প্রত্যেকের মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন। তবে ওঁর জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে। আখের রস ওঁর পছন্দ নয়। মিষ্টি জাতীয় কিছুর স্বাদ নিতে ইচ্ছে করছে ওঁর। আচার্যর পাশেই জীবসিদ্ধি বসে আছে। সভাঘরের উলটো মাথায় বসে আছেন অমাত্য ভদ্রদাস এবং তাঁকে ঘিরে স্বর্গীয় মহারাজের পরিবারের সদস্যরা। নিজের নিজের বাকি আসনে অপেক্ষারত আরও কয়েকজন সভাসদ। সাধারণ সাদা কাপড়ে তুলনামূলক বয়স্ক মহিলা যিনি বসে আছেন, ওঁকে কুন্তী দেবী বলে চিনতে অসুবিধা হয় না। মহিলার মুখে দৃঢ় প্রত্যয়ী ভাব স্পষ্ট। মায়ের পাশেই শান্তভাবে বসে রবিনাথ। তাদের মুখোমুখি উলটো দিকে বসে আছে বলদেব। তার মুখে অধৈর্য ভাব ফুটে উঠছে। ছোটোরানি কৌশল্যা আর রাজকুমার বিরাটের জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছিল।

নূপুরের শব্দে চোখ ঘুরে গেল সকলের। সভাঘরে প্রবেশ করলেন রানি কৌশল্যা সঙ্গে তার মায়ের হাত ধরে বিরাট। মুখ সামান্য বাঁকা, একপাশে টানা। পদক্ষেপ টলোমলো। তার আচরণ বা চাহনি থেকেই অস্বাভাবিকতা নজরে পড়ে। তার মা তাকে বলদেবের পাশের আসনে বসাতে গেল, কিন্তু সে কিছুতেই বসল না। মুখ দিয়ে ‘গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল। বলদেব বিরক্তিসূচক ভঙ্গিতে চাইল ভাইয়ের দিকে। বিরাট কিছুই না বুঝে বলদেবের দিকে নিজের খর্বকায় আঙুল তুলে ‘গোঁ গোঁ করতে লাগল। জড়ানো জিভে উচ্চারণ করল,

—শি… শি… শিব! শিব। শিব।

পরক্ষণেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে চিৎকার জুড়ে দিল বিরাট। তার মা আতঙ্কিত চোখে একবার বলদেবের দিকে তাকালেন।

জীবসিদ্ধি চাণক্যর কানের কাছে নিজের মাথা এনে বলল:

—বলদেবের রাগকে প্রত্যেকেই বেশ সমীহ করে দেখছি।

—হুম।

.

বলদেব মেজাজ হারাচ্ছে দেখে পরিস্থিতি সামাল দিলেন স্বয়ং কুন্তী দেবী। নিজের আসন ছেড়ে উঠে গিয়ে বিরাটের মাথায় হাত রেখে তাকে শান্ত করলেন। তাকে বলদেবের সামনে থেকে সরিয়ে এনে রবিনাথ আর তাঁর নিজের মাঝের আসনে বসালেন। ছেলে শান্ত হওয়ায় কৌশল্যা দেবী একবার কুন্তী দেবীর দিকে চেয়ে মাথা নত করে নিঃশব্দ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। নিজে বলদেবের থেকে একটা আসন ছেড়ে পরের আসনে বসলেন।

সবাই এসে গেছে দেখে বৃদ্ধ অমাত্য শুরু করার অনুমতির অপেক্ষায় একবার চাণক্যদেবের দিকে চাইলেন। আচার্য মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। অমাত্য শুরু করতেই যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বলদেব উঠে দাঁড়াল।

—বাবার শেষ নথি পাঠ করার আগেই আমি কয়েকটা কথা স্পষ্ট বলে দিতে চাই। এই দাসী পুত্র আর তার মাকে বাবা দয়াপরবশ হয়ে মহলে জায়গা দিয়েছিলেন এত বছর। কিন্তু আমি তাদের নিজের সম্বন্ধী বলে মানি না। আমার সিংহাসনে বসার তিন দিনের মধ্যে এই দু-জন যেন দুর্গ ত্যাগ করে।

দূর থেকেই চাণক্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন যে অপমানে রবিনাথের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কুন্তী দেবী কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুখ চেপে মাথা নীচু করে আছেন। রবিনাথ মেঝের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,

—আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, যুবরাজ। আপনার কাছে মাকে এমনিতেও আমি আর অপমানিত হতে দেব না। মা শুধুমাত্র বাবার টানে এতদিন এখানে পড়ে ছিলেন। আমরা কাল সূর্যোদয়ের সঙ্গেসঙ্গেই এই রাজ্য ত্যাগ করব। নেহাত অমাত্য মহাশয়ের অনুরোধ রক্ষা করতে আমরা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি।

বিরাট আরও একবার বলে উঠল, ‘শ… শিব।’ আর তার দিকে চোখ পড়তেই বলদেব তাকাল রানি কৌশল্যার দিকে।

—আপনিও শুনুন, আপনাদের আমি দুর্গ থেকে বিতাড়িত করব না ঠিকই। কারণ বিরাট যাই হোক রাজবংশের পুত্র। কিন্তু এই অপদার্থটাকে আমার নজরের থেকে যেন দূরে রাখা হয়। এর প্রলাপ আমার কানে যেন না আসে। আমার ধারে-কাছে যেন এ না আসে। বুঝালেন?

মিন মিন করে কৌশল্যা দেবী কিছু একটা বললেন। এইবার অমাত্য শক্ত কণ্ঠে বাধা দিলেন,

—রাজকুমার বলদেব, আসন গ্রহণ করুন। অতি উৎসাহ ভালো নয়। সন্মানীয় অতিথিদের সামনে একজন রাজপুরুষের পক্ষে কি নিজের এই ব্যবহার প্রকাশ শোভনীয়?

দাঁতের ফাঁক দিয়ে কিছু অপশব্দ বলে নিজের আসনে ফিরে গেল রাজকুমার বলদেব। গলাখাঁকারি দিয়ে বৃদ্ধ অমাত্য কথা শুরু করলেন।

—আমাদের মধ্যে আজ মগধের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত মহামতি বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। তোসালির পক্ষ থেকে আসুন আমরা ওঁকে এবং ওঁর শিষ্য মহাশয় জীবসিদ্ধিকে স্বাগত জানাই।

প্রত্যেকে চাণক্য এবং জীবসিদ্ধির দিকে চেয়ে অভিবাদন জানালেন। আরও একবার গলা পরিষ্কার করে বৃদ্ধ বললেন,

—এই মুহূর্তে আমার হাতে আছে স্বর্গীয় মহারাজ মহিপালের নিজের হাতে লেখা এবং মোহর লাগানো নথি। এতেই তিনি নিজের পরবর্তী উত্তরসূরির নাম লিখে গেছেন। এই আমি সর্বসমক্ষে রাজমুদ্রিকার মোহর খুলেছি। এবার তাঁর ইচ্ছাপত্র আমি পাঠ করে এখানে উপস্থিত সকলকে জানাব।

‘আমি মহারাজ মহিপাল স্বেচ্ছায় বলে যেতে চাই যে আমার মৃত্যুর পেছনে….’

পাঠ যত এগোতে থাকল, সভায় উপস্থিত প্রত্যেকের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। যুবরাজ হিসেবে রবিনাথকে পেয়ে সকলেরই মুখে বিস্ময় ফুটে উঠলেও, চাণক্য লক্ষ করলেন যে প্রত্যেকেই যেন খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। কিন্তু রবিনাথের নাম উচ্চারিত হতেই ক্রোধে ফেটে পড়ল বলদেব। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করতে লাগল রবিনাথ এবং নিজের বিমাতাকে। হয়তো শারীরিক আক্রমণও করত যদি না অমাত্যর নির্দেশমতো আগেই দু-জন সৈনিক রবিনাথের পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকত।

—এই মহিলা। এই নীচ দাসী আমার বাবাকে বশ করেছিল। এই মহিলাই আমার বাবার মনে আমার বিরুদ্ধে বিষ ঢেলে তাঁর হৃদয় বিষিয়ে দিয়েছে। এই দাসী…

—মৌন!

সারা সভা গমগম করে উঠল রবিনাথের হুংকারে। নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বলদেবের চোখে চোখ রেখে বলল,

—আর একবার আমার মায়ের নামে কুকথা উচ্চারণ করলে এই মুহূর্তে তোমায় কারাগারে নিক্ষেপ করব!

শান্ত রবিনাথের মুখে এহেন হুংকার শুনে কেমন থতোমতো খেয়ে গেছে বলদেব। হতবাক দৃষ্টিতে প্রথমে রবিনাথ, তারপর কুন্তী দেবী আর সব শেষে অমাত্য ভদ্রদাসের মুখের দিকে একে একে চাইল। তারপর সভাসদদের মুখের দিকে চাইল। বোধ হয় কোনো সভাসদের সমর্থন আশা করছিল। কিন্তু কারুর থেকেই সেই রকম কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে মুহূর্তে নিজের অবস্থান বুঝে নিল রাজকুমার। নিজের আসনে গিয়ে বসে পড়ল সে।

ছেলের এরকম দৃঢ়তায় প্রচণ্ড হতবাক হয়েছেন কুন্তী দেবীও। অবাক দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন রবিনাথের রাগত মুখের দিকে। রবিনাথ দু-পা বলদেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—পাশার দান পালটে গেছে, রাজকুমার। এইবার আমি তোমায় তিন দিন সময় দিলাম। তারমধ্যে তোসালি ছেড়ে চলে যাবে তুমি।

এই প্রথম মুখ খুললেন কুন্তী দেবী। চিৎকার করে উঠলেন,

—রবিনাথ! এ তুমি কী বলছ? বলদেব তোমার বড়ো দাদা, সেটা ভুলে যেয়ো না।

রবিবনাথ তার মায়ের দিকে চোখ ফেরাল। মায়ের এই রুদ্রমূর্তি দেখে সেও একটু হতবাক হয়েছে। তার চোখের তারা থেকে নিমেষে রাগ বিদায় নিল। হাত জোড় করে মায়ের উদ্দেশে বলল :

—আমায় ক্ষমা করবেন, মা। আপনার অপমানে আমি রেগে গেছিলাম। সত্যিই তো। বলদেব ভাইকে বিতাড়িত করলে তার এবং আমার মধ্যে পার্থক্য কী থেকে যাবে। আমায় ক্ষমা করুন, জ্যেষ্ঠ।

রবিনাথের কথায় প্রচ্ছন্ন তিরস্কার স্পষ্ট ছিল। কিন্তু তার এই ব্যবহার সত্যিই রাজোচিত ছিল। রবিনাথ অমাত্য এবং উপস্থিত সমস্ত সভাসদকে প্রণাম জানাল। প্রত্যেকেই অভিনন্দন জানাল তাকে। সবার শেষে রবিনাথ এগিয়ে এল চাণক্যর দিকে। হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে বলল :

—মহামতি চাণক পুত্ৰ, মহাপণ্ডিত কৌটিল্যর সাক্ষাতে আমি ধন্য। আশা করি মগধ আমাকেও আগের মতোই তার সমর্থন দিয়ে যাবে। এবং আমিও নিজের পূর্ণ সমর্থন এবং আপনাদের বহুদিনের দাবি অনুযায়ী মগধের নির্ধারিত রাজকর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলাম।

উত্তরে চাণক্য বললেন,

—অতি উত্তম, রাজন। আমাদের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত আপনাকে পূর্ণ সমর্থন করবে।

—অনেক ধন্যবাদ। আপনাকে অনুরোধ করব আপনি আরও কিছুদিন আমার আতিথ্য গ্রহণ করুন। অন্তত আমার রাজ্যাভিষেক হওয়া অবধি আপনার সেবা করার সুযোগ দিন। আপনার মতো একজন রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ আমার কাছে মূল্যবান।

.

রবিনাথের এরকম রাজোচিত সুআচরণে চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি দু-জনই প্রসন্ন হল। যাক, বৃদ্ধ অমাত্য এবং মহারাজ মহিপাল তবে ভুল করেননি। একে একে সভাসদদের বিদায় দিয়ে রবিনাথ নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সে বেরিয়ে যেতেই কৌশল্যা আর বিরাট দ্রুত বেরিয়ে গেল। কুন্তী দেবী কিছু বলতে গেলেন বলদেবকে। কিন্তু বলদেবের অবস্থা দেখে আর তিনি সাহস করে তা বলে উঠতে পারলেন না। চাণক্যকে প্রণাম জানিয়ে তিনিও প্রস্থান করলেন। বৃদ্ধ অমাত্য হাসিমুখে এগিয়ে এলেন চাণক্যর দিকে। জীবসিদ্ধি এবং চাণক্যর সঙ্গেই তিনিও প্রস্থান করলেন। পাথরের মতো স্থবির হয়ে, মেঝের দিকে চেয়ে শুধু বসে রইল বলদেব।

সত্যিই, ভাগ্যদেব কত সহজেই না কয়েক মুহূর্তে পরিস্থিতি অদলবদল করে দিতে পারে। আজকের রাজা মুহূর্তে হয়ে যেতে পারে আশ্রিত আর দাস হয়ে যেতে পারে রাজা।

৪.

পরদিন সকাল। চাণক্য বরাবরই সূর্যোদয়ের সঙ্গেসঙ্গেই শয্যা ত্যাগ করেন। কয়েক ঘণ্টা প্রার্থনা, ধ্যান এবং স্বল্পাহারের পর অধ্যয়ন। আজও সে রকমই মেঝেতে বসে প্রাণায়াম করছিলেন তিনি। দরজায় মৃদু করাঘাত হল। দরজা খুলতে জীবসিদ্ধি ঢুকল।

—সুপ্রভাত, আচার্য।

—সুপ্রভাত।

—এইদিকের সমস্যা তবে সহজেই মিটল। কি বলেন?

—হুম। আশা করছি তাই, জীবসিদ্ধি। মনেপ্রাণে তাই আশা করছি।

—অর্থাৎ? আপনি কি কিছু আশঙ্কা করছেন?

—আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কী জানি না, কিন্তু কিছু একটা ঘটবে, জীবসিদ্ধি।

কথা মাঝপথে থামাতে হল কারণ তখনই এক ভৃত্য এসে তাঁদের দু- জনকে প্রাতরাশের জন্যে আসতে বলল। দু-জন পৌঁছে দেখলেন প্রচুর ফল-মূল সাজিয়ে তাঁদের অপেক্ষায় বসে আছেন রবিনাথ এবং কুন্তী দেবী। মা এবং ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের স্বাগত জানাল। আপ্যায়ন করে তাঁদের বসালেন কুন্তী দেবী।

কুন্তী দেবীকে উদ্দেশ করে চাণক্য বললেন,

—আপনার মতো এক জীবনযুদ্ধে জয়ী নারীর সাক্ষাৎ পেয়ে আমি সম্মানিত, মা।

—না, না। একথা বলে আপনি আমার পাপ বাড়াবেন না, আচার্য। আপনার মতো পণ্ডিত ব্রাহ্মণের সামনে একইসঙ্গে বসে খাওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই। আপনাদের অতিথি হিসেবে পেয়ে আমরা ধন্য।

বিভিন্ন কথাবার্তার মাঝেই খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হল। রবিনাথ আচার্য এবং জীবসিদ্ধিকে তার সঙ্গে বাগানে আসতে আমন্ত্রণ জানাল। তাদের সঙ্গে কুন্তী দেবীও এলেন বাগানে এবং এক দাসীকে ডেকে নিলেন। দাসীটিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ফুল তুলতে চলে গেলেন বাগানের অন্যপাশে। মা দূরে চলে যেতেই রবিনাথ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল,

—আচার্য, আপনাকে কয়েকদিন এখানে থেকে যেতে বলার পেছনে আমার আরও একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। আপনার কাছে আমার একটা আবেদন আছে।

—বলুন, যুবরাজ।

খানিক থেমে রবিনাথ বলল,

—আমার ধারণা আমার বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। আপনি কি জানেন যে উনি মৃত্যুর আগে এক সন্ন্যাসীর প্রেতমূর্তি দেখতে পেতেন এই দুর্গে?

—হ্যাঁ। অমাত্যর কথায় শুনেছি সেকথা। উনি সেটাকে মহারাজের কল্পনা বলে মনে করেন।

—আমিও তাই মনে করতাম। যদি না সেই ছায়ামূর্তি আমি স্বচক্ষে দেখতাম।

—সেকী?

—আজ্ঞে, হ্যাঁ। প্রথমে বাবার কথা আমিও ভেবেছিলাম কল্পনামাত্র। কিন্তু একদিন রাতে আমার ঘুম না আসায় আমি পূর্ব মহলে নিজের ঘরের জানলায় বসে ছিলাম। তখনই উলটো দিকের মহলের একটা জানলায় সেই ছায়ামূর্তিটা দেখি। জ্বলতে থাকা রাতপ্রদীপের আবছা আলোয় অস্পষ্ট দেখতে পাই তাকে, বাবার ঘর যে তলায়, সেই তলার জানলায়।

—হুম। আপনি কি বিশ্বাস করেন সেটা অলৌকিক প্রেতমূর্তি?

—না। আমি মনে করি কেউ একজন ওই প্রেতের ভেক ধরে মহারাজকে ভয় দেখাত।

—আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?

—হ্যাঁ। বলদেব। এটা নিঃসন্দেহে তারই কাজ। তার সঙ্গে মহারাজের একদিন প্রবল বাগবিতণ্ডা হয়। তারপর থেকেই এই প্রেতমূর্তি দেখতে শুরু করেন বাবা। বার্ধক্যে পৌঁছে বাবার মন এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আমার ধারণা বলদেব এটাই চেয়েছিল যাতে এই অলৌকিক কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে বাবার মাধ্যমে। আর তাতেই তার পরবর্তী কাজে সুবিধা।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,

—হুমম। অর্থাৎ, আপনি আপনার বড়ো দাদাকে পিতৃহত্যার দোষী হিসেবে সন্দেহ করেন?

—হ্যাঁ। তার পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়।

হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা কুন্তী দেবী যেখানে ফুল তুলছিলেন সেখানে এসে পড়েছেন। এবং মায়ের কাছাকাছি আসতেই রবিনাথ চুপ করে গেল। কুন্তী দেবীর দৃষ্টিশক্তি সম্ভবত ক্ষীণ। তাই একজন দাসী জবা গাছের ফুল ফোটা ডালগুলো টেনে দিচ্ছে আর তা থেকে তিনি ফুল তুলছেন। রবিনাথ চুপ করে গেছে সেটা লক্ষ করে চাণক্য নীচু গলায় প্রশ্ন করলেন,

—আপনার সন্দেহর কথা বোধ হয় আপনার মা জানেন না?

—জানেন। কিন্তু বিশ্বাস করেননি। উনি অতি সরল মনের মানুষ। বলদেবকে খুবই স্নেহ করেন। এত অপমানের পরেও আমায় কিছুই বলতে দেন না। কালকের ঘটনা তো নিজের চোখেই দেখলেন আপনারা।

—সেই। অন্যদিকে চলুন তবে।

কুন্তী দেবীর থেকে সামান্য তফাতে এসে রবিনাথ আবার কথা শুরু করল, এই সম্ভাবনার কথা মাকে বলতেই তিনি আমার ওপর সাংঘাতিক ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বলেন এইসব কথা দ্বিতীয়বার কারুর সামনে বললে আমি তাঁর মরা মুখ দেখব। তাই এখন আপনাকে এই কথা যে বলছি তা ওঁকে না জানিয়েই।

—আপনি কি চান এই বিষয়টা আমরাও ওঁর থেকে গোপন রাখি?

একটু ভেবে যুবরাজ উত্তর দিলেন,

তার প্রয়োজন হবে না, আচার্য। আমি আমার মাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। উনি সারাটা জীবন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে, তীব্র লাঞ্ছনা সহ্য করে আমায় মানুষ করেছেন। আমি মায়ের থেকে কোনো কথাই গোপন করি না। তাই আজ রাতেই আমি সব কথা বুঝিয়ে বলব মাকে। আশা করি উনি বিষয়টার গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন।

—হুম। কিন্তু আপনি আমাকে এই কথা কেন বললেন? কী সাহায্য চান আপনি আমার থেকে?

—আচার্য, আপনার ক্ষুরধার মস্তিস্ক এবং অনুধাবন ক্ষমতার কথা আমার অজ্ঞাত নয়। আগেও বহুবার আপনি রহস্যের জট খুলে মগধকে সাহায্য করেছেন। আমি চাই বাবার মৃত্যুর জন্যে যদি সত্যিই কেউ দায়ী হয়ে থাকে তবে সে যথাযথ শাস্তি পাক। আমি চাই এই বিষয়ে আপনি বিচার বিশ্লেষণ করুন। আপনাকে কোনোরকম প্রতিশ্রুতি দিতে হবে না। আপনি আপনার মতো করে সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করুন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করুন। আমার বিশ্বাস তাতেই ফল হবে।

—হুম। আমি চেষ্টা করব, যুবরাজ। কিন্তু আপনিও সতর্ক থাকবেন। একটু অবাক হয়ে রবিনাথ প্রশ্ন করল,

—আমি? কেন?

—যদি আপনার ধারণা অমূলক না হয়, তবে তার অর্থ দাঁড়ায় যে আপনার ভাই সিংহাসনের লোভে পিতৃহত্যা করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু এরপরেও সে আপনার কাছে তার প্রাপ্য সিংহাসন হারিয়েছে। অতএব, এইবার তার সম্পূর্ণ আক্রোশ কিন্তু আপনার ওপর পড়বে।

মৃদু হেসে নিজের কোমরবন্ধে বাঁধা তলোয়ারের ওপর হাত রেখে রবিনাথ বললেন,

—সেবিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আচার্য। আমি তার থেকে সদা সতর্ক থাকব।

—হুম।