৯
আজ মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল। ইংরেজি মতে অবশ্য একটু আগেই পঁচিশে এপ্রিল শুরু হয়ে গেছে। রাত বারোট বেজে পাঁচ মিনিটে আমরা কল্যাণ রায়ের এই থার্টিন বাই থ্রি-এ মহেশ ঘোষাল সেকেন্ড বাইলেনের বাড়িতে এসে ঢুকি। বাড়িতে এই মুহূর্তে আমরা ছাড়া আর কারও থাকার কথা নয়। নেইও। কল্যাণ রায়ের বউ আর দুই শালাকে শুনলুম ঘণ্টাখানেক আগে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। থানার বড়বাবু যতক্ষণ না জানতে পারছেন যে, আমাদের কাজ শেষ, ততক্ষণে তাদের সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে আসতে দেওয়া হবে না। এ-বাড়ির একতলায় আরশোলার ফড়ফড় ও ইঁদুরের কিচকিচ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ শুনতে পাইনি। দোতলাটা একেবারেই নিঃশব্দ। একতলায় একটা মিটমিটে, খুবই অল্প পাওয়ারের বাল্ব ও দোতলার প্যাসেজে একটা নিয়নের টিউব জ্বলছিল। দুটোই নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। গোটা বাড়ি এখন যেমন নিস্তব্ধ, তেমন অন্ধকার। আমরা খুব সন্তর্পণে হাঁটছি, তার উপরে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে রবারের সোল লাগানো জুতো পরে নিয়েছি বলে যেটুকু যাও-বা শব্দ হতে পারত, তাও হচ্ছে না।
শুধু এই বাড়ি বলে কথা কী, গোটা পাড়াটাই এখন নিঃশব্দ, সেই সঙ্গে অন্ধকারও বটে। আশপাশের অন্য কোনও বাড়ির কোনও ঘরে যদি আলো জ্বলত, তবে নিশ্চয় তার রশ্মি এসে পড়ত এই বাড়ির কোনও জানলার কাচে কিংবা বারান্দায়। তাও পড়ছে না। মনে হয়, এ-পাড়ার কোনও বাড়িতেই কেউ জেগে নেই। উত্তর কলকাতার এইসব গলি যে রাত বারোটাতেই এমন নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তা জানতুম না। এক-আধটা মাতালও তো মত্তাবস্থায় ঠুনঠুন-রিকশায় চেপে এই সময়ে বাড়িতে ফিরে হল্লা জুড়ে যেমন নিজের বাড়ির লোকজন তেমন পাড়া-প্রতিবেশীদেরও কাঁচা ঘুমের দফারফা করতে পারত। তাও যে করছে না, সেটাও কিছু কম আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। গোটা নর্থ ক্যালকাটাই কি আজ রাত্তিরে একেবারে ষোলো-আনা সচ্চরিত্র হয়ে গেল নাকি?
একেবারেই যে কোনও শব্দ আমার কানে এসে পৌঁছচ্ছিল না, তা অবশ্য নয়। কোনও দুধের বাচ্চা হয়তো দূরের কোনও বাড়িতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল। তার শব্দ ইতিমধ্যে এক-আধবার শুনতে পেয়েছি। নিদ্রিত জড়িত গলায় তার মা তাকে ফের ঘুম পাড়াচ্ছেন, দূরাগত সেই অস্পষ্ট শব্দও একবার শুনেছি। তা ছাড়া জমাট নৈঃশব্দ্যের মধ্যে আমাদের শ্রবণশক্তি খুবই প্রখর হয়ে ওঠে হয়তো। ফলে এমন অনেক শব্দ তখন আমরা শুনতে পাই, কোলাহলের মধ্যে যা আমাদের কানে ঢোকে না। যেমন, এই বাড়িতে ঢোকার মুহূর্তে শুনতে না-পেলেও খানিক বাদে একটা শব্দ আমি শুনতে পাই। প্রথমে বুঝতে না-পারলেও, দু’চার মিনিট বাদেই বুঝতে পারি যে, সেটা জলের শব্দ। নিশ্চয়ই কোথাও কোনও জলের কলের ওয়াশার কেটে গেছে। ফলে কলের তলায় পেতে রাখা বালতি কিংবা গামলার মধ্যে ফোঁটায়-ফোঁটায় জল পড়ছে তো ক্রমাগত পড়েই যাচ্ছে।
আজকের এই নৈশ অভিযানে মোট আটজন লোকের দরকার হয়েছিল। তার মধ্যে দু’জন শোভন চৌধুরির নিজের লোক। তবে পুলিশ বিভাগের কর্মী হলেও তারা উর্দি পরে আসেনি। পরনে সাধারণ পোশাক, সদর দরজা ভেজিয়ে রেখে তার আড়ালে তারা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বলে দেওয়া আছে যে, আমাদের কাজ যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ তারা বাইরে থেকে কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেবে না। উপরে উঠে এসেছি আমরা ছ’জন। ভাদুড়িমশাই, কৌশিক, সদানন্দবাবু, আমি, শোভন চৌধুরি আর চন্দ্রভান যাদব। চন্দ্রভান একটা গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ সঙ্গে করে এনেছে। আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে একটা করে পেনসিল টর্চ আছে ঠিকই, কিন্তু ভাদুড়িমশাইয়ের কড়া নির্দেশ, দারুণ রকমের দরকার না-হলে আমরা কেউই যেন সেটা না-জ্বালি। এখনও পর্যন্ত একমাত্র চন্দ্রভানই সেটা মাঝে-মধ্যে জ্বেলেছে। কিন্তু তাতেই এই দোতলার যেটুকু যা ইতিমধ্যে দেখতে পেয়েছি, তাতেই আমার চোখ প্রায় কপালে ওঠার উপক্রম হয়েছিল।
কিন্তু সে-কথায় আসার আগে একটু পিছিয়ে যাব। তার কারণ, এই নৈশ অভিযানের ব্যাপারটা আমি আদ্যন্ত লিখে রাখতে চাই। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত একটি কথাও বাদ দেব না।
ভাদুড়িমশাই বলে দিয়েছিলেন, রাত এগারোটায় আমরা যেন কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে চলে যাই। আমরা মানে আমি আর সদানন্দবাবু। সদানন্দবাবুকে আমিই তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিই। দুজনে মিলে ঠিক এগারোটাতেই হাজির হই অরুণ সান্যালের কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে।
এখানে সদানন্দবাবুর আজকের পোশাকের বর্ণনা দিয়ে রাখি। ভদ্রলোককে আমি ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কোনও পোশাকে আজ পর্যন্ত দেখিনি। তবে তাঁরই কাছে শুনেছি যে, সাহেব-কোম্পানিতে কাজ করতেন বলে কর্মজীবনে প্যান্ট-শার্ট পরতেন। আজ আবার তা-ই পরেছেন। নিজেই বললেন, “আরে মশাই, গায়ে-গতরে আর-একটু ভারী ছিলুম তো, এখন অনেক রোগা হয়ে গেচি, তাই প্যান্টটা একটু ঢলঢলে হয়ে গেচে। একটা বেল্ট পরলে ভাল হত, তবে মধ্বভাবে গুড়ং দদ্যাৎ বলে একটা কথা আচে না, খুব খাঁটি কতা, বেল্টের অভাবে কোমরে একটা নাইলনের দড়ি বেঁধে ঠিক ম্যানেজ করে নিয়েছি।” অন্য সময়ে ক্রোম লেদারের পাম্পশু পরেন। আজ পরেছেন ব্রাউন রঙের ক্যাম্বিসের জুতো। রাবার-সোলের জুতো পরার নির্দেশ থাকায় এই জুতোজোড়া বোধহয় সদ্য কিনেছেন। এ ছাড়া হাতে নিয়েছেন মাথায়-লোহার-বল-বসানো তাঁর সেই বিখ্যাত খেটে লাঠিখানি, প্রাতঃভ্রমণের সময় যেটি উঁচিয়ে তিনি নেড়িকুত্তাদের ভয় দেখান। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে তো নেড়িকুত্তা থাকার কথা নয়, তা হলে লাঠি দিয়ে কী হবে, জিজ্ঞেস করায় সদানন্দবাবু বললেন, “ইঁদুর আর ছুঁচো তো আচে, তাদের ভয় দেখাব।”
পরে অবশ্য এই লাঠিখানি অন্য কাজে লেগেছিল। সে-কথা যথাসময়ে বলা যাবে। এখন কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটের কথা বলি। ফ্ল্যাটে ঢুকে বছর বাইশ-তেইশের যে ছেলেটিকে দেখলুম, এর আগে তাকে কখনও দেখিনি। কৌশিক বলল, “এই হচ্ছে চন্দ্রভান। ছেলেটি বেহারি, বাড়ি গয়া জেলায়, খেতির কাজ ভাল না লাগায় বাড়ি থেকে পালিয়ে মুম্বইয়ে চলে গিযেছিল, সেখানে কুসঙ্গে পড়ে একটা পেটি বার্গলারির মামলায় জড়িয়ে গিয়ে তিন মাস জেল খাটে, তারপর ছাড়া পেয়ে চলে আসে বাঙ্গালোরে। মামাবাবু ওকে মাস-তিনেক বাঙ্গালোরে রেখে আমাদের কলকাতার আপিসে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
চন্দ্রভান সারাক্ষণই নিঃশব্দে হাসছিল। কথা হচ্ছিল তার সামনেই। কিন্তু সে যে তিন মাস জেল খেটেছে, সেটাও কৌশিক তার সামনে বলা সত্ত্বেও দেখলুম তার মুখের হাসি একটুও ম্লান হয়নি। তার উপরে আবার তার কীর্তিকলাপের কথা শুনে সদানন্দবাবু যখন তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “তুম তো বাহাদুর আদমি হো,” তখন চন্দ্রভান যে খুবই খুশি হয়েছে, সেটা বুঝলুম এই প্রথম সে একটু শব্দ করে হেসে ওঠায়।
ভাদুড়িমশাইকে ড্রয়িংরুমে দেখতে পেলুম না। তিনি কোথায়, জিজ্ঞেস করতে কৌশিক বলল, “শোবার ঘরে বসে বাবার সঙ্গে গল্প করছেন।” এটাও জানা গেল যে, অরুণ সান্যালের শরীর আজ আগের তুলনায় অনেক ভাল, তবে চেম্বারে যাবার অনুমতি আজও মেলেনি। সম্ভবত কালও তিনি বাড়ি থেকে বেরুবেন না, পুরো দিনটা রেস্টে থাকবেন।
একটু বাদেই ভাদুড়িমশাই অবশ্য ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকলেন। সদানন্দবাবুকে দেখে হেসে বললেন, “বাঃ, দিব্যি মানিয়েছে। কিন্তু সঙ্গে আবার এই লাঠিটা কেন? আমরা তো স্রেফ একটা বাড়ি দেখতে যাচ্ছি, একটু-আধটু তল্লাশিও হয়তো করব, কিন্তু যুদ্ধ করতে তো যাচ্ছি না।”
সদানন্দবাবু তাতে একটু অপ্রতিভ হেসে বললেন, “কী জানেন, এটা সঙ্গে থাকা ভাল। নইলে আমি একটু নার্ভাস বোধ করি, মনটা কেমন যেন দুর্বল-দুর্বল লাগে। ওই মানে পার্সোনালিটি বলেও একটা ব্যাপার আচে তো, সেটা একটু চুপসে যায়।”
“তাই?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে. তা হলে ওটা সঙ্গে নিন। আমি অবশ্য কিছুই নিচ্ছি না।”
শুনে সদানন্দবাবু যে খুব একটা আশ্বস্ত হলেন, এমন মনে হল না। বেজার গলায় বললেন, “অন্তত একটা ফায়ারআর্ম সঙ্গে রাখলে পারতেন।”
“দরকার কী? ওখানে তো হামলা হবার কোনও সম্ভাবনা নেই। তা হলে আর ও-সব নেব কেন? “ কথাটা যে ভুল, যথাসময়ে তাও বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু তাও যথাসময়ে বলব। আপাতত পরপর সব বলে যাই।
শোভন চৌধুরি এলেন সাড়ে এগারোটায়। এসেই জানালেন যে, তিনি দুজন লোককে সঙ্গে করে এনেছেন। “পুরনো লোক, অ্যাবসলুটলি ট্রাস্টওয়ার্দি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “চুপচাপ কাজ সারতে চাই, কিন্তু এ তো দেখছি একটা ক্রাউড হয়ে গেল! এদের দিয়ে আবার কী হবে?”
“সদর-দরজায় এই দু’জনকে পাহারায় বসিয়ে রাখব। যাতে বাইরে থেকে কেউ ভিতরে ঢুকতে না পারে।”
“সে তো ভিতরে ঢুকে সদরে খিল এঁটে দিলেই হত। যা-ই হোক, এনেছ যখন, তখন চলুক। কিন্তু লোকের সংখ্যাটা তো এদের নিয়ে আটে এসে গেল। প্লাস ড্রাইভার। তার মানে ন’জন।”
“ন’জন নয়, আটজনই। যে দু’জনকে নিয়ে এসেছি, তাদেরই একজন পাহারাদার কাম ড্রাইভার।”
“কিন্তু আটজনই বা যাবে কীসে?”
“ও নিয়ে ভাববেন না।” শোভন চৌধুরি বললেন, “আমি একটা জিপ নিয়ে এসেছি।”
শোভন চৌধুরির পকেটে সেলফোন বেজে উঠল। যন্তরটা কানে চেপে তিনি বললেন, “হ্যালো… হ্যাঁ, আমি চৌধুরি কথা বলছি।…”
দেড় মিনিট কথা হল। শোভন তাঁর সেলফোন ফের পকেটে পুরে বললেন, “লোক্যাল থানার বড়বাবু। বললেন যে, তিনজনকেই থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লাইন ক্লিয়ার। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার ব্যাপারে একটা অসুবিধে হয়েছে। থানায় যাবার আগে ওরা বাড়িতে তালা লাগিয়ে এসেছে, আমাদের তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে হবে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও নিয়ে ভেবো না। আমরা তো তৈরিই আছি, চলো, বেরিয়ে পড়া যাক। …তবে রওনা হবার আগে একটা কথা বলি। তুমি তোমার সার্ভিস রিভলভারটা সঙ্গে নিয়েছ দেখছি। ওটা কিন্তু ব্যবহার করা চলবে না। আন্ডার নো সারকামস্ট্যানসেস।”
শোভন চৌধুরি হাসলেন। কিছু বললেন না।
সদানন্দবাবু জোড়হস্ত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “দুগ্গা, দুগ্গা।”
ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আমরা বোতাম টিপে লিফ্টটাকে উপরে আনিয়ে নিলুম। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, পৌনে বারোটা।
জিপের সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে শোভন বসলেন। পিছনের মুখোমুখি দু’থাক আসনের একটিতে ভাদুড়িমশাই, কৌশিক ও চন্দ্রভান, অন্যটিতে আমি, সদানন্দবাবু ও একজন পাহারাদার। গাড়ি স্টার্ট নিল এগারোটা পঞ্চাশে। একে তো এত রাতে রাস্তা ফাঁকা, তার উপরে পুলিশের গাড়ি, যা কিনা ট্র্যাফিক-আইনকে থোড়াই পরোয়া করে। উল্টোডাঙার রেল-ব্রিজের তলা দিয়ে ঝড়ের মতো এগিয়ে আপার সার্কুলার রোড ক্রস করে, হাতিবাগান বাজারের পাশ দিয়ে ট্রাম-লাইন পেরিয়ে গ্রে স্ট্রিট দিয়ে এগিয়ে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে পড়ে বাঁয়ে বাঁক নিয়ে খানিক এগিয়ে মহেশ ঘোষাল সেকেন্ড বাইলেনে ঢুকে গাড়িটা যখন কল্যাণ রায়ের বাড়ির সামনে থামল, তখন ঠিক বারোটাই বাজে।
থানা থেকে ভুল খবর দেওয়া হয়নি, সদর-দরজায় সত্যিই একটা মস্ত বড় তালা ঝুলছে। শোভন চৌধুরি বললেন, “দুটো কাজ করা যায়। থানায় লোক পাঠিয়ে কল্যাণ রায়ের বউকে ভয় দেখিয়ে চাবির তোড়া নিয়ে আসা যায়। কিন্তু বউটি সেক্ষেত্রে সঙ্গে আসতে চাইবে। অন্য উপায় হল তালাটা ভেঙে ফেলা। কোনটা করব বলুন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও দুটোর কোনওটাই তোমাকে করতে হবে না। …চন্দ্রভান, তুই খুলতে পারবি?”
চন্দ্রভান তার গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বিঘতখানেক লম্বা একটা সরু তার বার করে এনে বলল, “এক মিনিট।”
কার্যত এক মিনিটও লাগল না। চাবি ঢোকাবার গর্তের মধ্যে তারটা ঢুকিয়ে সেটাকে অল্প-একটু নাড়াচাড়া করেই বলল, “খুলে গেছে সাব।”
সদানন্দবাবুর মুখ আমরা বিস্ময়ে প্রায়ই হাঁ হয়ে যেতে দেখি। এবারে একই সঙ্গে শোভন চৌধুরির মুখও দেখলুম হাঁ হয়ে গেছে। বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে উঠে তিনি বললেন, “এ তো দেখছি সাংঘাতিক লোক! কোত্থেকে জোটালেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও-সব কথা পরে হবে। এখন ভিতরে ঢুকে আলোটা নিবিয়ে দাও। পেনসিল-টর্চ জ্বেলে শব্দ না-করে সামনে এগোও। একসঙ্গে একটার বেশি টর্চ জ্বালা চলবে না।”
মাঝে-মাঝে ফড়ফড় শব্দ হচ্ছে। আরশোলা ওড়ার শব্দ। ইঁদুরের কিচকিচও শুনতে পাচ্ছি। কৌশিক এক বিন্দু বাড়িয়ে বলেনি। সদানন্দবাবু চাপা-গলায় বললেন, “বাদুড় সম্ভবত নেই, তবে নর্দমার ধেড়ে ইঁদুর থাকতেই পারে। সেও কিছু কম ডেঞ্জারাস নয়।”
একতলার আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। কৌশিক সামনে। এ-বাড়িতে একমাত্র সে-ই এর আগে একবার এসেছে, তাই তাকেই দেওয়া হয়েছে পথ চিনিয়ে দোতলায় নিয়ে যাওয়ার ভার। তার টর্চটা সে মাঝে-মধ্যে জ্বালছে, আবার নিবিয়েও দিচ্ছে পরক্ষণে। তার পিছনে-পিছনে পা টিপে-টিপে আমরা এগোচ্ছি। অন্ধকারের মধ্যেই শোভন চৌধুরি বললেন, “বাপ্স, এ তো দেখছি গোলকধাঁধা।” কৌশিক বলল, “আর দু’পা। তারপর উঠোন।”
উঠোন পর্যন্ত পৌঁছে একবার টর্চ জ্বেলেই ফের নিবিয়ে ফেলল কৌশিক। কিন্তু সেই এক লহমার আলোতেই দেখলুম, উঠোনের একদিক থেকে একটা সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। সিঁড়ির গোড়ায় কোলাপসিবল গেট। তাতেও তালা লাগানো।
চাবির গর্তে একই তার ঢুকিয়ে, ডাইনে-বাঁয়ে সেই একই কায়দায় সেটাকে বারকয়েক নেড়ে, এ-তালাটাও চন্দ্রভান খুলে ফেলল। আমরা একে-একে উপরে উঠে এলুম। দোতলার বারান্দাটা বেশ চওড়া। বারান্দার এক দিকে একটা নিয়নের টিউব জ্বলছে। ঢাকা বারান্দা, তাই একতলা থেকে তার আলো আমরা দেখতে পাইনি।
দোতলায় উঠেই বারান্দার টিউবের সুইচটা ভাদুড়িমশাই অফ করে দিলেন। কিন্তু তার আগেই যেটুকু আমার চোখে পড়েছিল, তাতেই আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাবার উপক্রম। গোটা বারান্দাটা পুরু কার্পেটে মোড়া। সিমেন্ট-বালির পলস্তারা ঢেকে একদিকে দেওয়াল-জোড়া উড-প্যানেলিং। তার মধ্যে খোপ কেটে বড় সাইজের একটি হাল-ফ্যাশনের ঘড়ি বসানো। বিপরীত দিকের দেওয়ালে, গয়নার দোকানে যেমন দেখা যায়, বিশাল সাইজের আয়না। বুঝতে পেরেছিলুম, এ-বাড়ির একতলায় আর দোতলায় একেবারে আকাশ-পাতাল ফারাক। সত্যিই এ যেন এক আলাদা রাজ্যে এসে আমরা ঢুকেছি। আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। পেনসিল টর্চ জ্বেলে আলোর রশ্মিটাকে চারদিকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “বারান্দা থেকে চারটে দরজা বেরিয়েছে দেখছি। তার মধ্যে তিনটে তালা ঝোলানো, মাত্র একটাতে তালা নেই।”
কৌশিক বলল, “যে-তিনটেতে তালা ঝোলানো, তার দুটো বেডরুম, একটা ড্রয়িংরুম। যেটায় তালা লাগানো নেই, সেটা কিচেন। সে-সব আমি কালকেই দেখে নিয়েছি।”
ভাদুড়িমশাই চন্দ্রভানকে তালা তিনটে খুলে ফেলতে বললেন। চন্দ্রভান একটার-পর-একটা সেই একই কায়দায় সেগুলি খুলে ফেলল। আমরাও একে-একে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তে লাগলুম। বেডরুম দুটো একই সাইজের। দুটোতেই ডাবল বেড বিছানা পাতা। সেই সঙ্গে একদিকের দেওয়ালে একটি ড্রেসিং টেব্ল ও অন্যদিকে কাঠের ওয়ার্ডরোবের পাশে স্টিলের আলমারি। দুটি ঘরেরই আলমারির লক এত অনায়াসে খুলে ফেলল চন্দ্রভান যে, আমার মনে হল, তার কাছে এর চেয়ে সহজ কাজ আর কিছুই হতে পারে না।
ওয়ার্ডরোব আর আলমারির জামাকাপড় আর অন্যসব জিনিসপত্রের মধ্যে হাত চালিয়ে অতি দ্রুত তাঁর তল্লাশি শেষ করলেন ভাদুড়িমশাই। মনে হল, যা তিনি খুঁজছেন তা পাননি। বললেন, “এবারে ড্রয়িংরুমটা দেখব।”
বেডরুম দুটির তুলনায় ড্রয়িংরুমটি বড় মাপের। একদিকে একটি রাইটিং টেব্ল। অন্যদিকে উড-প্যানেলিং করা দেওয়াল ঘেঁষে সোফা ও কৌচ। তার সামনে সেন্টার টেবিল। রাইটিং টেলটির একদিকে দুটি ড্রয়ার। সে দুটি খুঁজেও ভাদুড়িমশাই কিছু পেয়েছেন বলে মনে হল না।
আমাদের কারও মুখে টু-শব্দটি নেই। ঘরের মধ্যে একটা অনৈসর্গিক আবহের সৃষ্টি হয়েছে। ঘরটা যদি সম্পূর্ণ অন্ধকার হত, তা হলে হয়তো এই পরিবেশকে এতটা অলৌকিক বলে মনে হত না। কিন্তু ঘরটা এখন আর পুরোপুরি অন্ধকার নয়। ভাদুড়িমশাই এই মুহূর্তে যদিও কিছু খুঁজছেন না, তবু তাঁর হাতের পেনসিল-টর্চটা জ্বলছে। সম্ভবত ওটা নেবাতে তিনি ভুলে গেছেন। পেনসিল-টর্চের সরু আলো পড়েছে মেঝের উপরে। একই জায়গায় সেই আলোর রশ্মি স্থির হয়ে আছে। একটুও নড়ছে না। ভাদুড়িমশাইও নিঃশব্দ নিষ্পন্দ দাঁড়িয়ে আছেন একটা পাথরের মূর্তির মতো। যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন।
ঘোরটা হঠাৎই কেটে গেল। চন্দ্রভানকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কার্পেট তুলে মেঝেগুলো ঠুকে দ্যাখ। তিনটে ঘরের কোনওটাই বাদ দিবি না।”
চন্দ্রভান যেন এই হুকুমের জন্যে তৈরি ছিল। গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ থেকে সঙ্গে-সঙ্গেই একটা হাতুড়ি বার করল সে। তারপর কার্পেট তুলে ঘরের মেঝেয় হাতুড়ি ঠুকতে শুরু করল। আস্তে আস্তে ঠুকছে। যাতে তত শব্দ না হয়। যাতে আশপাশের বাড়িতে কারও ঘুম না ভাঙে।
কার্পেট তুলে মেঝেতে হাতুড়ি ঠোকার কাজ পরপর তিনটে ঘরেই চালিয়ে গেল সে। প্রথমে ড্রয়িং রুম, তারপর বেডরুম দুটো। ঠুকে-ঠুকে দেখছে যে, মেঝের কোথাও এমন কোনও ফাঁক-ফোকর রয়েছে কি না, যার মধ্যে কিছু লুকিয়ে রাখা যায়।
এখন আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি না। কিন্তু বুঝতে পারছি যে, সময় চলে যাচ্ছে। কে জানে কী খুঁজছেন ভাদুড়িমশাই। কে জানে যা খুঁজছেন তা পাওয়া যাবে কি না। চুপ করে তিনি চন্দ্রভানের সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরছেন আর নিবিষ্ট হয়ে শুনে যাচ্ছেন তার হাতুড়ি ঠোকার শব্দ।
মেঝের উপরে উবু হয়ে বসে চন্দ্রভান তার কাজ করে যাচ্ছে। এক সময় সে সিধে হয়ে দাঁড়াল। তারপর কপালের ঘাম মুছে বলল, “বিলকুল সলিড ফ্লোর। কোই ফোকর-উকর নেই, সাব।”
দেওয়ালগুলি আগেই পরীক্ষা করেছেন ভাদুড়িমশাই। আলমারি, ওয়ার্ডরোব, সোফা, কৌচ—সবকিছুরই গায়ে হাত বুলিয়ে-বুলিয়ে পরীক্ষা করেছেন কোথাও কোনও চোরা ফোকর রয়ে গেল কি না। এবারে মেঝেতেও যে সন্দেহ করার মতো কিছু নেই, চন্দ্রভানের কাছে এটা শুনে খানিকক্ষণ তিনি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর প্রায় আত্মমগ্ন ভাবে বললেন, “বারান্দা, কিচেন আর অ্যাটাচ্ড বাথরুম দুটো দেখা হয়নি, সব দেখতে হবে, সব। চলুন, আগে বারান্দাটা দেখা যাক।”
বারান্দাটা পুবে-পশ্চিমে টানা। খোলা নয়, ঢাকা বারান্দা, তাই আলাদা একটা ঘর বলেই মনে হয় পুব দিকে এক-পাল্লার দরজা; দরজা খুললে সিঁড়ির ল্যান্ডিং। এই সিঁড়ি দিয়েই আমরা একতলা থেকে দোতলায় উঠেছি! বারান্দার উত্তর দিকের দেওয়ালে একটা বিশাল আয়না, আর তার উলটো দিকে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকের দেওয়ালের কাঠের প্যানেলের মধ্যে খোপ কেটে একটা বড়সড় ঘড়ি বসানো। এই আয়না ও ঘড়ির উল্লেখ আমি আগেও করেছি।
গোটা বারান্দার উড-প্যানেলের উপর দিয়ে আস্তে-আস্তে হাত বুলিয়ে গেলেন ভাদুড়িমশাই। কাঠের জোড়ের প্রতিটি জায়গা পরীক্ষা দেখলেন। তারপর চন্দ্রভানকে বললেন, “এখানেও তো ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেট পাতা। নে, এবারে কার্পেট তুলে মেঝেটা হাতুড়ি ঠুকে দ্যাখ। এখানেও যদি সুবিধে না হয় তো এরপর কিচেনে ঢুকব।”
কিচেন পর্যন্ত যাবার দরকার হল না। ভাদুড়িমশাইয়ের নির্দেশ পাবার সঙ্গে-সঙ্গে কার্পেট তুলে ফেলেছিল চন্দ্রভান, তারপর বারান্দার পশ্চিম দিকের প্রান্ত থেকে মেঝেতে হাতুড়ি ঠুকতে-ঠুকতে পুব দিকে এগিয়ে আসছিল। চন্দ্রভান যখন বারান্দার আয়না আর ঘড়ির মাঝ-বরাবর জায়গা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে, ভাদুড়িমশাই তখন হঠাৎই বলে উঠলেন, “থাম।”
কার্পেটের তলায় গোটা বারান্দাটা শ্বেত পাথরের টালি দিয়ে বাঁধানো। দেখে মনে হল, প্রতিটি টালি এক ফুট বাই এক ফুট। চন্দ্রভানকে যেখানে থামতে বলেছিলেন, এবারে নিজেই সেখানে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। হাতুড়িটা নিজের হাতে নিয়ে একটা টালির উপরে দু’বার ঠুকলেন। তারপর বললেন, “আগে বারান্দার আলো জ্বাল, তারপর তোর ব্যাগ থেকে বাটালি বার করে চাড় দিয়ে এই টালিটা তুলে ফ্যাল। সাবধানে তুলবি, যাতে টালিটা ভেঙে না যায়।”
টালি তুলতেই তার তলায় একটা ফোকর বেরিয়ে পড়ল। তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ভাদুড়িমশাই যা বার করে আনলেন, তা আর কিছুই নয়, কারেন্সি নোটের একটা বাণ্ডিল। সবই পাঁচশো টাকার নোট। আমাদের চক্ষুঃস্থির।
পরক্ষণেই যা ঘটল, সে-কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠি। কিচেনের সেই ভেজানো দরজাটা যে নিঃশব্দে কখন খুলে গেছে, কেউ খেয়াল করেনি। তার ভিতর থেকে একটা লোক একেবারে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এসে ভাদুড়িমশাইয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বারান্দার নিয়ন-বাতি ইতিমধ্যে জ্বেলে দেওয়া হয়েছিল। লোকটার হাতে যে একটা ছুরি চকচক করছে, সেটাও তাই আমার নজর এড়াল না। ছুরিটা যে সে ভাদুড়িমশাইয়ের বুকে বসিয়ে দিত, তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু এ-যাত্রায় তিনি রক্ষা পেয়ে গেলেন স্রেফ হাতুড়িটা তখনও তাঁর হাতে থাকায়। সেটা তিনি সঙ্গে-সঙ্গেই চালিয়েছিলেন নিশ্চয়, তা নইলে আর অমন বিকট চিৎকার করে লোকটা ওইভাবে ধরাশায়ী হবে কেন। এটাও দেখলুম যে, সেই ধরাশায়ী অবস্থাতেই সদানন্দবাবু তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী খেটে লাঠিখানি দিয়ে লোকটার ঘাড়ে একটি মোক্ষম ঘা কষিয়ে দিলেন। ফলে সে আর নড়াচড়া করল না, নেতিয়ে পড়ে রইল। মনে হল, সাময়িকভাবে হলেও সে বেঁহুশ হয়ে গেছে।
যা ঘটল, তার আকস্মিকতায় আমরা যে প্রচণ্ড রকমের একটা মানসিক ধাক্কা খেয়েছিলুম, তা না বললেও চলে। বিস্মিত নিশ্চয় ভাদুড়িমশাইও হয়েছিলেন। কিন্তু, আশ্চর্য ব্যাপার, তাঁকে খুব একটা বিচলিত বলে মনে হল না। দাঁড়িয়ে উঠেই তিনি তিনজনকে তিনটি নির্দেশ দিলেন। কৌশিককে বললেন, “লোকটার বাঁ চোখের বাঁ পাশ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে…চন্দ্রভানের ব্যাগ থেকে জলের বোতল, ডেটল, তুলো আর লিউকো প্লাস্ট বার করে কাটা জায়গাটা ধুয়ে ওখানে তুলো আর লিউকো প্লাস্ট লাগা।” চন্দ্রভানকে বললেন, “ব্যাগের মধ্যে তো নাইলনের দড়িও এক বান্ডিল রয়েছে; দড়ি বার করে ওকে বেঁধে ফ্যাল।” শোভনকে বললেন, “ওরা ওদের কাজ করুক, তুমি ততক্ষণে এই ফোকরে হাত চালিয়ে যা-যা পাবে, সব বার করে আনো।”
কৌশিক আর চন্দ্রভানের কাজ শেষ হতে তিন মিনিটও লাগল না। লোকটা দু’-একটা অস্ফুট শব্দ তখন করেছিল বটে, কিন্তু তার পরেই আবার ঝিম মেরে যায়। বোঝা যাচ্ছিল যে, ভাদুড়িমশাইয়ের হাতুড়ি আর সদানন্দবাবুর লোহার-বল-বসানো লাঠির ঘা, দুটোর ধকল কাটিয়ে উঠতে তার আরও কিছুটা সময় লাগবে।
শোভনের কাজ অবশ্য অত তাড়াতাড়ি শেষ হল না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে, আরও বেশ কয়েকটি নোটের বান্ডিল, বেশ কিছু গয়না ও কিছু কাগজপত্র তিনি সেই ফোকর থেকে বার করে ফেলেছেন। শোভন যখন উবু হয়ে বসে ফোকর থেকে সেগুলি তুলছেন, তখন কাগজপত্রগুলি পরীক্ষা করতে-করতে তার খানকয়েক কাগজ যে ভাদুড়িমশাই নিজের পকেটে পুরে ফেললেন, তাও লক্ষ করলুম।
কাজ শেষ হবার পর ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওহে শোভন, গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগের মধ্যে একটা এক্সট্রা ঝোলা আছে, আমি দেখেছি। চন্দ্রভান সেটা বার করে তার মধ্যে এই নোটের বান্ডিলগুলি, গয়না আর কাগজপত্তর তুলে ফেলুক। তারপর চলো থানায় যাই। লোকটাকেও নিয়ে যেতে হবে। নীচে তোমার যে দু’জন লোক পাহারা দিচ্ছে, তাদের ডাকো। তারাই একে চ্যাংদোলা করে গাড়িতে তুলে দিক। থানায় সব জমা দিতে হবে তো!”
শোভন বললেন, “পাহারাদার দু’জনকেও কি আমাদের সঙ্গে থানায় নিয়ে যাব?”
“না, না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “চন্দ্রভান তালা খুলতে পারে, কিন্তু খোলা-তালাকে ফের লাগাতে পারে না। গাড়ি আমিই চালিয়ে নিয়ে যাবখন, ওরা এখানে পাহারায় থাকবে। বাড়িটাকে তো এইরকম অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে পারি না।”
তা-ই হল। কাঁকুড়গাছি থেকে রওনা হয়েছিলুম আটজন। তার মধ্যে শোভনের দুই সঙ্গীকে এই বাড়ির পাহারায় রেখে আমরা এখন থানায় চলেছি। ভাদুড়িমশাই গাড়ি চালাচ্ছেন, তাঁর পাশের আসনে শোভন চৌধুরি। পিছনের দু’সারির দুটি লম্বা সিটের একটিতে আমরা চারজনে, অর্থাৎ কৌশিক সদানন্দবাবু চন্দ্রভান আর আমি ঠেসাঠেসি করে বসেছি। অন্য সিটটির উপরে বেহুঁশ লোকটিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। সদানন্দবাবু যে-ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, তাতে বুঝতে পারছি, লোকটা নড়াচড়া করার চেষ্টা করলেই তিনি তাকে আবার এক-ঘা লাঠির বাড়ি ঝেড়ে দেবেন। গাড়ি একটু এগোতেই কৌশিক বলল, “মামাবাবু, এই লোকটিকে আমি চিনতে পেরেছি।”
পিছনে না-তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মানে?”
“তার মানে কাল দুপুরে যখন কল্যাণ রায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি, এই লোকটিকেই তখন আমি খালি-গায়ে বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকতে দেখেছিলাম!”
“সে কী!” এবারেও পিছনে না-তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ-ই তা হলে কল্যাণ রায়ের বড় শালা। কিন্তু এর তো তা হলে এখন থানায় থাকার কথা! অথচ এ তো বাড়ির মধ্যেই ছিল! আশ্চর্য!”
পুলিশের তরফে যে একটা মস্ত বড় ভুল কোথাও ঘটেছে, শোভন চৌধুরি সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরে রাগে ফুঁসছিলেন তিনি। থানায় পৌঁছে সেই রাগ একেবারে বোমার মতো ফাটল।
ও.সি. ভদ্রলোকের কপাল মন্দ, অন্যদের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি ঘুমোতে যাননি, তল্লাশির কাজ চুকিয়ে শোভন চৌধুরি থানায় চলে আসবেন, সেটা জানতেন বলে তাঁরই প্রতীক্ষায় তিনি বসে ছিলেন। ফলে, তাঁকে সামনে পেয়ে গেলেন শোভন, আর দেখবামাত্র বাঘের মতো গর্জে উঠে বললেন, “আপনার লজ্জা করে না? এর নাম কাজ? এর নাম লাইন ক্লিয়ার? বাড়ির মধ্যে লোক ছিল কেন?”
ধমক খেয়েই সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। আমতা-আমতা করে বললেন, “সে কী স্যার? তা কেমন করে হবে? আমি তো তিনজনকেই ধরে এনেছি!
থানার দু’জন লোক ইতিমধ্যে জিপ থেকে দড়ি-বাঁধা লোকটিকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এসে বড়বাবুর আপিস-ঘরের মেঝেয় নামিয়ে রেখেছিল। শোভন তার দিকে আঙুল তুলে বড়বাবুকে বললেন, “তিনজনকেই ধরে এনেছেন? ফের চালাকি? এ তা হলে কে? এ-ই তো শুনছি কল্যাণ রায়ের বড় শালা!”
“না স্যার, তা কী করে হয়?” বড়বাবু কাঁদো-কাঁদো মুখে বললেন, “যেমন কল্যাণ রায়ের উইডো, তেমনি তার দুই শালাকেই তো আমি থানায় নিয়ে এসেছি। তাদের মধ্যে একজন আবার গুঙ্গা, কথা বলতে পারে না। তিনজনেই তো এখানে রয়েছে!”
“বার করুন তাদের!”
থানা-হাজতেই তিনজনকে আটকে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে তাদের আপিস-ঘরে নিয়ে আসা হল। আর তিনজন এসে ঢুকবামাত্রই একজনের দিকে আঙুল তুলে কৌশিক বলে উঠল, “আরে, এ-ই তো সেই আইসক্রিমওয়ালা! কাল দুপুরে একেই আমি মহেশ ঘোষাল লেনে দেখেছি। এ-ই গুঙ্গা নিশ্চয়?”
বড়বাবু বললেন, “হ্যাঁ, পেটে রুলের গুঁতো মেরে দেখেছি, মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না, শুধু আঁউ-আঁউ করে একটা আওয়াজ বেরোয়।”
কৌশিক বলল, “এখন বুঝতে পারছি, ফেরিওয়ালা হয়েও লোকটা ‘আইসক্রিম আইসক্রিম’ বলে হাঁক পাড়ছিল না কেন। …একেই তা হলে কল্যাণ রায়ের বড় শালা সাজানো হয়েছে! চমৎকার! আর আসল বড় শালাটি ওদিকে বাড়ির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল!”
কথাবার্তা হচ্ছিল কল্যাণ রায়ের স্ত্রীর সামনেই। তাঁর দিকে তাকিয়ে শোভন চৌধুরি বললেন, “একে ভাই সাজিয়ে এখানে নিয়ে আসার বুদ্ধিটা সম্ভবত আপনারই। তা-ই না?”
ভদ্রমহিলা মাটির দিকে তাকিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, একটিও কথা বললেন না! থানার বড়বাবুর ব্যক্তিত্ব আবার কিছুটা ফিরে এসেছিল বোধহয়। তিনি এগিয়ে এসে রুল উঁচিয়ে বললেন, “কী, কথা বলছেন না কেন? দেব নাকি আড়ং ধোলাই?”
শোভন চৌধুরি বললেন, “থাক থাক, আর বীরত্ব দেখাতে হবে না!” তারপর বড়বাবুকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বললেন, “হিউম্যান রাইটস কমিশনের কথাটা মনে রাখুন। থানার মধ্যে ও-সব করেছেন কি মরেছেন!”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওহে শোভন, বড়বাবুকে জিজ্ঞেস করো তো ওঁকে যা করতে বলা হয়েছিল, সেটা কদ্দুর কী হল।”
বড়বাবু একবার শোভন চৌধুরির দিকে তাকালেন, একবার ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে। তারপর উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কোন কাজ স্যার?”
ভাদুড়িমশাই যে কোন বিষয়ে জানতে চান, শোভন সেটা ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন। বললেন, “কাছাকাছি সব ধোবিখানা আর লন্ড্রিতে খোঁজ করার কাজ। যেমন আপনাকে তেমনি আপনার পাশের থানাকেও খোঁজ করতে বলেছি।”
“হ্যাঁ, স্যার, একটা জামার খোঁজ। সেটা পাওয়া গেছে।”
শোভন বললেন, “কোথায় পাওয়া গেল?”
“আমাদেরই থানার জুরিসডিকশানে। সুদাম শেঠ লেনের একটা ধোবিখানায়। জামা মানে একটা হলদে টি-শার্ট। আপনাকে দেখাব বলে কাগজে মুড়ে রেখে দিয়েছি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “শোভন, শার্টটা ওঁকে নিয়ে আসতে বলো, আমি দেখতে চাই।”
বড়বাবুর নির্দেশে একজন কনস্টেবল গিয়ে কাগজে-মোড়া শার্টটা নিয়ে এল। মোড়ক খুলে ভাদুড়িমশাই সেটা দেখে বললেন, “এতে রক্ত লেগে আছে। রক্ত শুকিয়ে গেছে। কিন্তু আমার ধারণা, নিহত কল্যাণ রায়ের মাথা থেকে যে রক্ত ঝরেছিল, সেই রক্তই ছিটকে এসে খুনির শার্টে লেগে যায়। সেটা প্রমাণ করা শক্ত হবে না। কিন্তু তার আগে জানা দরকার, শার্টটা যে কাচতে দিয়ে গিয়েছিল, ধোবি তাকে শনাক্ত করতে পারবে কি না।”
“পারবে স্যার।” বড়বাবু বললেন, “আমাদের রামটহল তাকে চেনে। লোকটার নাম শিউলাল। আজ সকালে রামটহলই তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে থানায় নিয়ে এসেছিল। শিউলাল বলল, রোব্বার রাত এগারোটা নাগাদ মস্তান-মতো একটা লোক তাকে ওই শার্টটা দিয়ে যায়। ধোবি যে এর মধ্যে ওটা ভাটিতে দেয়নি, এই রক্ষে।”
শোভন বললেন, “তিনজনকে তো ধরেই এনেছেন। হাত-পা-বাঁধা এই লোকটাকে নিয়ে চারজন হল। সব ক’টাকে হাজতে পুরে ফেলুন।”
আমরা যে-লোকটাকে ধরে এনেছিলুম, তার হুঁশ ফিরে এসেছিল অনেক আগেই। তার বাঁধন খুলে দেওয়া হল। তারপর চারজনকেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল আমাদের সামনে থেকে।
খুনের মামলায় সরকার পক্ষের যেটা তুরুপের তাস হবার সম্ভাবনা, রক্ত-মাখা সেই শার্টটি যে তিনিই উদ্ধার করতে পেরেছেন, এই গৌরবেই বোধহয় বড়বাবুর ব্যক্তিত্ব ইতিমধ্যে আরও খানিকটা ফিরে এসেছিল। শোভনের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “কিচ্ছু ভাববেন না, স্যার। মামলাটা আমি এমন ভাবে সাজাব যে, একটাও পার পাবে না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “শোভন, আমার কাজ শেষ। এবার আমরা বিদায় নেব।”
বড়বাবুকে থানার আপিস-ঘরে বসিয়ে রেখে শোভন আমাদের সঙ্গে বাইরে এলেন। আমাদের পৌঁছে দেবার জন্য থানা থেকে তিনি গাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। ভাদুড়িমশাই নিলেন না। বললেন, “কাঁকুড়গাছি পর্যন্ত একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেব। সেখান থেকে কিরণবাবু তাঁর নিজের গাড়িতে সদানন্দবাবুকে নিয়ে চলে যাবেন। তবে যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। ওখান থেকে বিস্তর টাকা আর গয়না উদ্ধার হয়েছে। শোভন, টাকাটা তুমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে গোনাবে। গয়নাগুলোর একটা লিস্ট করবে। তারপর থানার আয়রন-চেস্টে ওগুলো তুলিয়ে রাখবে। …আর হ্যাঁ, তুমি তো পাকা লোক, তবু বলি, বড়বাবুর হাতে ওই টাকা আর গয়না হ্যান্ডওভার করার পর ওঁকে দিয়ে একটা রসিদ লিখিয়ে নিতে ভুলো না।”
একজন কনস্টেবল একটা ট্যাক্সি ধরে এনেছিল। আমরা তাতে উঠে পড়লুম। আকাশে তখনও আলো ফোটেনি। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, সাড়ে চারটে বাজে।