৮
শোভন চৌধুরি বিদায় নেবার পরে ভাদুড়িমশাই বললেন, “রাত হয়ে গেল। আপনাদের বাড়িতে আবার চিন্তাভাবনা করবে না তো?”
বললুম, “বাসন্তী জানে যে, আপনার এখানে এসেছি, তাই ফিরতে একটু রাত হতেই পারে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “আমার কতা আলাদা। আমি বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকলেই বরং আমার ওয়াইফ একটু অস্বস্তি বোধ করতে আরম্ভ করেন। ধরেই নেন যে, আমার শরীর নির্ঘাত বিগড়েচে, তা নইলে আমি ঘরের মধ্যে বসে রয়েচি কেন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হোক, অনেকক্ষণ হল আপনারা বাড়ির বাইরে, এদিকে শহরটাও তো ইদানীং সেই আগের মতো নেই, আমি বরং একটা ফোন করে দিচ্ছি বাসন্তী যাতে উদ্বিগ্ন না হয়।”
ডায়াল ঘুরিয়ে একটুক্ষণ অপেক্ষা করলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর ওদিক থেকে সাড়া পেয়ে বললেন, “আমি ভাদুড়িদা কথা বলছি, বাসন্তী। …হ্যাঁ, ওঁরা এখানেই আছেন। …না না, আমিই আটকে রেখেছিলুম। তবে এখন ছেড়ে দিচ্ছি, একটু বাদেই ওঁরা শেয়ালদায় ফিরবেন। আর হ্যাঁ, সদানন্দবাবুর বাড়িতেও খবরটা জানিয়ে দিয়ো, নইলে আবার মিসেস বসু চিন্তায় পড়ে যাবেন।”
ভাদুড়িমশাই তাঁর হাতের রিসিভার ক্রেড়লে নামিয়ে রাখলেন। কিন্তু আমরা যে তক্ষুনি উঠে পড়লুম, তা নয়। না-ওঠার কারণ মালতী ইতিমধ্যে রান্নার পাট চুকিয়ে আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকেছিল। একটা চেয়ার টেনে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদার নতুন ক্লায়েন্টটিকে কেমন দেখলেন কিরণদা?”
“কেমন আর দেখব।” আমি বললুম, “একদিকে স্বামী ওঁর পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে আমাদের শোভন ওঁকে মার্ডার চার্জে অ্যারেস্ট করার তালে আছে, এখন তোমার দাদাই ওঁর রক্ষাকর্তা। আমরা কেমন দেখছি, তাতে ওঁর কী এল-গেল, তোমার দাদা ওঁকে কেমন দেখছেন, সেটাই হচ্ছে আসল কথা।”
ভাদুড়িমশাই মালতীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর ব্যাপার কী বল তো! কাল থেকেই দেখছি মিসেস মিত্র সম্পর্কে তুই নাহক টিপ্পুনি কেটে যাচ্ছিস। ওঁর দোষটা কী দেখলি? বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছে বই তো নয়। অথচ তুই দেখছি ওঁকে সহ্যই করতে পারছিস না।”
মালতী ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “বিপদে পড়েছে না হাতি! এ-সব মেয়ের কাজই হচ্ছে অন্যদের বিপদে ফেলা, এরা নিজেরা কখনও বিপদে পড়ে না।”
“কী করে জানলি?”
“না-জেনে বলছি না দাদা। তোমার ভাগ্নের কাছে যেটুকু যা শুনেছি, তাতেই বুঝেছি যে, এ মোটেই সিধে-সরল পার্টি নয়, মহা ধড়িবাজ।”
এবারে মালতীর দিক থেকে কৌশিকের দিকে চোখ ফেরালেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “এই হনুমান, মিসেস মিত্র সম্পর্কে তুই তোর মা’কে কী বলেছিস?”
কৌশিক বলল, “বেশি কিছু বলিনি তো। শুধু বলেছি যে, ওঁর স্বামী খুব বুড়ো আর খুব সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। তাতে মা বলল, বুড়োকে বিয়ে করতে গেল কেন। আমি বললুম, বুড়ো হলে কী হয়, খুব বড়লোক। বাস, তাতেই মা খেপে গেছে। বলছে, টাকার জন্যে যারা বিয়ে করে, তারা কক্ষনো ভাল লোক হয় না?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওরে মালতী, টাকার জন্যে বিয়ে করার মধ্যে দোষের কী আছে? ওর কি ভাল খেতে ইচ্ছে হয় না? ভাল পরতে ইচ্ছে হয় না? ভাল বাড়িতে থাকতে আর ভাল গাড়িতে চড়তে ইচ্ছে হয় না? এ-সব ইচ্ছে কি খারাপ?”
“ইচ্ছেটা খারাপ নয়, কিন্তু ইচ্ছে পূরণের জন্যে যে রাস্তাটা ও নিয়েছে, সেটাকে কী করে ভাল বলি? বলা সম্ভব? এখন তো তার মাসুল ওকে দিতেই হবে।”
‘একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন?” আমি বললুম, “মালতী আর শোভনের অ্যাসেসমেন্ট কিন্তু একই রকম। শুধু মালতী সেটা মুখে বলছে, আর শোভন সেটা মুখে না-বললেও ভাবে-ভঙ্গিতে জানিয়ে দিতে ছাড়ছে না। মালতী বলছে শান্তিলতাকে মাসুল দিতে হবে, আর শোভনেরও মনোগত ইচ্ছেটা ঠিক তা-ই।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “দোষ করলে তবে তো মাসুল। শান্তিলতা যে কোনও দোষ করেছে, তা-ই তো আমার মনে হয় না।”
মালতী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, “কী যে বলো দাদা! টাকার লোভে বিয়ে করা দোষ নয়?”
“কে কাকে বিয়ে করবে আর কেন বিয়ে করবে, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যাব কেন? আর তা ছাড়া, শান্তিলতা যে শুধু টাকার লোভেই ধনঞ্জয় মিত্রকে বিয়ে করেছিল, তা-ই বা তুই জানলি কী করে? কল্যাণ রায়ের ব্যাপারে মার খেয়ে গিয়ে ওর প্রেমের নেশা ছুটে যায়। এদিকে ওর বয়েস তখন পঁয়ত্রিশ, যে-বয়েসের অনেক আগেই মেয়েরা সাধারণত বিয়ে-থা করে এক ধরনের নিশ্চিন্ত জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কে জানে, শান্তিলতাও হয়তো তখন সেটাই চাইছিল। তুই ভাবছিস ও টাকার লোভে বিয়ে করেছে, আর আমার ধারণা ও বিয়ে করেছিল স্রেফ ওর অনিশ্চিত জীবন থেকে একটা নিশ্চিত নিরাপত্তার আশ্রয় পাবার জন্যে। আমার ধারণা যদি ঠিক হয় তো বলব, ধনঞ্জয় মিত্র যে একজন বিশাল বড়লোক, এটা একটা কো-ইনসিডেন্টাল ব্যাপার মাত্র… ওই যাকে আমরা কাকতালীয় বলি আর কি, বিয়ের ওটা আসল কারণ নয়।”
মালতী কী বুঝল কে জানে, তবে তার দাদার কথায় সে যে খুব খুশি হয়েছে তা মনে হল না। দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “যাই, তোমাদের খেতে দেবার ব্যবস্থা করি। …কিরণদা, আপনারাও এখানে খেয়ে গেলে পারতেন।”
বললুম, “না মালতী। একে দেরি করে ফিরছি, তার উপরে যদি খেয়ে যাই তো তোমার বউদি আর রক্ষে রাখবেন না। …তো অরুণ এখন আছে কেমন?”
“সে ন’টার মধ্যেই খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়েছে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমিও মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই উঠব।”
মালতী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কৌশিক বলল, “কাল রাতে কখন কী ভাবে ক’জন ওই বাড়িতে যাব, সে-সব কিছু ঠিক করেছ?”
“মোটামুটি ঠিকই আছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি আর তুই তো যাবই। কথা হচ্ছে রাত জাগার ধকল তোর কিরণমামার সইবে কি না। …কী মশাই, পারবেন?”
শেষ কথাটা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন। তাতে আমি অবাক হবার ভান করে বললুম, “পারব কি না, আমাকে জিজ্ঞেস করছেন? …আরে মশাই, আমি যদি না যাই, তো এই নৈশ অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনিটা লিখবে কে?”
“কাল রাত জাগলে পরশু বুধবার যে আপিসে যেতে পারবেন না, সারাটা দিন পড়ে-পড়ে ঘুমুতে হবে, সেটা ভেবে দেখেছেন?”
“ও আমি একটা দিন ক্যাজুয়াল নিয়ে নেবখন। ও নিয়ে ভাববেন না।”
সদানন্দবাবু গুম হয়ে বসে ছিলেন আর চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিলেন এতক্ষণ। এবারে ফুঁসে উঠে বললেন, “আরে আমি? আমি কী করব?”
কৌশিক হেসে বলল, “আপনিও যেতে চাইছেন নাকি?”
“চাইব না?” সদানন্দবাবু রীতিমতো রেগে গিয়ে বললেন, “আমি না-গেলে হয়? হেলিকপ্টারে করে তো আর ও-বাড়ির ছাতে গিয়ে নামব না, ওখানে ঢুকতে হবে সেই একতলা দিয়েই। সে-কথা ভেবে দেখেছ?”
“তাতে কী হল?”
“বাঃ, তুমিই তো ও-বাড়ির একতলার একটা ডেসক্রিপশান দিয়েছিলে। তখন কী বলেছিলে, তোমার নিজেরই দেকচি তা মনে নেই।”
“কী বলেছিলুম?”
“বলেছিলে যে, সেখানে অগুন্তি আরশোলা আর ইঁদুর আছে। ছুঁচোও আছে নিশ্চয়। আর ওইসব জন্তু…মানে আরশোলা ইঁদুর আর ছুঁচো যদি থাকে, তা হলে চামচিকে কি বাদুড়ও কিছু-না-কিছু থাকতেই পারে। আর এরা থাকলে ভূতপেত্নিও গোটা দুচ্চার আছে, সে আমি হলপ করে বলতে পারি। তাই বলছিলুম যে, আমাকে সঙ্গে না-নিয়ে ওখানে যাওয়াটা তোমাদের ঠিক হবে না।”
“বুঝেছি, আপনি না-গিয়ে ছাড়বেন না।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “বেশ, আপনিও যাবেন। তবে রাত জাগার ধকল সামলাতে পারলে হয়। জ্বরজারি না বাধিয়ে বসেন!”
“ও নিয়ে ভাববেন না।” সদানন্দবাবু নিজের বুকে আঙুলের টোকা বাজিয়ে বললেন, “ডিউরিং দ্য লাস্ট ফিফটিন ইয়ারস একবারও আমার মাথা ধরেনি, পেট কামড়ায়নি, এমনকি ম্যালেরিয়া পর্যন্ত হয়নি। হবেই বা কেন। ভুলে যাবেন না, রোজ সানরাইজের আগে আমি মর্নিং ওয়াক করি। থ্রি মাইলস এ ডে!”
কৌশিক বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর লেকচার দিতে হবে না, আপনি যাবেন। …তা হলে আমরা চারজনই যাচ্ছি। প্লাস শোভন চৌধুরি। পাঁচজন। …মামাবাবু, তুমি কি আর-কাউকে নিতে চাও?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি চন্দ্রভানের কথা ভাবছিলুম।”
“আমাদের ক্যামাক স্ট্রিটের আপিসের নতুন রিক্রুট চন্দ্রভান যাদব?”
“হ্যাঁ। কাজের ছেলে। তালা খুলতে ওর জুড়ি নেই। কী করে খোলে, একমাত্র ওই জানে। ওকে সঙ্গে রাখ, বিদ্যেটা কাজে লাগবে। ও যেন ওর কিটব্যাগটা নিয়ে কাল রাত এগারোটায় এখানে চলে আসে। …কিরণবাবু, সদানন্দবাবু, আপনারাও কাল রাতে এখানে চলে আসুন। ওই এগারোটায়।”
কৌশিক বলল, “শোভন চৌধুরিকে তুমি নিজেই এটা বলে দিয়ো মামাবাবু। আমি বললে হয়তো তত সিরিয়াসলি নেবেন না।”
“ঠিক আছে, কাল সকালে বলে দিলেই চলবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর-কিছু জানবার আছে তোর?”
“মাত্র একটা কথাই জানার আছে। প্ল্যান অব অ্যাকশনটা কি এখনই ছকে ফেলবে তুমি?”
“ওটা আমার মাথার মধ্যে ছকে ফেলেছি। তবে দরকার মতো যে সেটা পালটাব না, তাও নয়। কথায় বলে ক্ষেত্রে কর্ম বিধীয়তে। ক্ষেত্রটা তো এখনও নিজের চোখে দেখিনি। কাল রাত্তিরে সেটা দেখি, তখন যা করার করব।”
আমরা উঠে পড়লুম, ভাদুড়িমশাই আমাদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এখন দুটো ফোন করব। একটা শান্তিলতাকে। তাকে বলে দেব, এক্ষুনি তার অ্যারেস্ট হবার সম্ভাবনা নেই, সুতরাং আগাম জামিন না-নিলেও চলবে।”
বললুম, “আর দ্বিতীয় ফোনটা? সেটা কাকে করবেন?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সেটা এখন বলব না।”
লিফ্ট উপরে এসে গিয়েছিল। আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লুম। গ্রাউন্ড ফ্লোরে বোতাম টিপতে যাচ্ছি, এমন সময় বাইরে থেকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা কথা বলতে ভুলেছি, রাবার সোলের জুতো পরে আসবেন।”
ঘাড় নেড়ে বোতাম টিপে দিলুম। লিফ্ট নীচে নামতে শুরু করল।