৬
কৌশিক বলল, “যুগলবাবুর সঙ্গে তো দেখা হল না। তাঁর বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে আমি রামগোপাল স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে আসি। বেলা তখন সওয়া একটা। বাড়ি থেকে সেই যে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছিলুম, তার পরে তো আর পেটে কিছু পড়েনি, খুব খিদে পেয়ে গেসল।”
সদানন্দবাবু তালুতে জিভ ঠেকিয়ে ‘চুকচুক’ করে একটা শব্দ করে বললেন, “আহা রে! খিদের জ্বালা বড্ড জ্বালা। তোমাদের এই লাইনে দেকচি কষ্টের শেষ নেই!”
“থামুন তো!” ভাদুড়িমশাই সদানন্দবাবুকে কড়া গলায় একটা ধমক দিয়ে কৌশিকের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “তারপরে কী হল তা-ই বল, তোর খিদে পেয়েছিল কি পায়নি, সে-সব আজেবাজে কথা আমরা শুনতে চাই না।”
কৌশিক কাতর গলায় বলল, “তা বললে হয় মামাবাবু? আমার পেটে তখন আগুন জ্বলছিল যে!”
“ঠিক আছে, আগুন জ্বলছিল। তো তারপরে কী হল?”
“তারপরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের একটা ধাবায় ঢুকে একপেট রুটি-তড়কা খেয়ে ধীরেসুস্থে যখন মহেশ ঘোষাল লেনে গিয়ে ঢুকলুম, ঘড়িতে তখন ঠিক দুটো।”
“তার মানে রামগোপাল স্ট্রিট থেকে জায়গাটা খুব দূরে নয়!”
“যুগলবাবু যে রাস্তায় থাকেন, তার কথা বলছ তো? …না না, দূরে কেন হবে, কাছেই। হাঁটাপথে এই ধরো মিনিট পনেরো কুড়ি। এটাও…মানে এই মহেশ ঘোষাল লেনও চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ থেকেই বেরিয়েছে। তবে ওই রামগোপাল স্ট্রিট থেকে ফার্দার নর্থ।”
“সেখানে গিয়ে কী দেখলি?”
“যা আশা করেছিলুম, তা-ই দেখলুম। রাস্তা ফাঁকা, লোকজন বলতে গেলে নেই। শুধু রাস্তার মোড়ে দুটো রিকশাওলা তাদের টানা-রিকশার ছাউনি তুলে দিয়ে তার তলায় গদির উপরে কুকুর-কুণ্ডুলি হয়ে ঘুমুচ্ছে, একজন ভেন্ডার তার আইসক্রিমের চাকাওয়ালা গাড়ির হাতল ধরে রাস্তা দিয়ে চলেছে, আর যে বাড়ির সামনে খুনটা হয়েছিল তার রোয়াকে বসে ঝিমুচ্ছে একজন কনেস্টবল। বাস, বাদবাকি রাস্তায় আর কাউকে দেখলুম না।”
“খুনের জায়গাটা চিনলি কী করে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “স্রেফ ওই কনেস্টবলটিকে দেখে?”
“না মামাবাবু।” কৌশিক বলল, “শুধু ওকে দেখে নয়। রোয়াকের সামনে রাস্তার খানিকটা জায়গা দেখলুম লম্বালম্বি….এই ধরো ছ’ফুট বাই তিন ফুট…খান কয়েক ইট সাজিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। তাতে বোঝা গেল, লাশটা ওখানেই পড়েছিল। রক্ত-টক্তের দাগ অবশ্য দেখলুম না, সে-সব ধুয়ে ফেলতে পুলিশের লোকেরা দেরি করেনি।”
“তোকে দেখে কনেস্টবলটি কিছু বলল না?”
“আইসক্রিমের ভেন্ডারটিকে কিছু বলেনি, কিন্তু আমাকে দেখবামাত্র হাতের লাঠি ঠুকে আমার সামনে এসে বলল, কাহাঁ জাওগে? তাতে আমি পকেট থেকে আমার আইডেন্টিটি কার্ড বার করে ওর নাকের ডগায় উঁচিয়ে ধরে বললুম, লালবাজার থেকে আসছি, পুলিশের লোক, চুপচাপ নিজের কাজ করে যাও, আর হ্যাঁ, চারদিকে বেশ ভাল করে নজর রাখো।”
আমি বললুম, “তোমার কার্ডটা একবার পড়েও দেখল না? দেখলেই তো বুঝতে পারত যে, ওটা সি. বি. আই. …মানে চারু ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশনসের আইডেন্টিটি কার্ড, তুমি পুলিশের লোক নও।”
“হয় ইংরিজি পড়তে পারে না, নয়তো আমি লালবাজারের লোক শুনেই ঘাবড়ে গেসল। সঙ্গে-সঙ্গে বুটে বুট ঠুকে, কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, সেলাম সাব, ম্যয় তো চারো তরফ নজর রাখ রহা হুঁ। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে, মহেশ ঘোষাল সেকেন্ড বাইলেনটা আর কতটা এগিয়ে, সেটা ওরই কাছে জেনে নিয়ে চটপট সেখান থেকে সরে পড়লুম।”
সদানন্দবাবু হাসছিলেন। হাসতে-হাসতেই বললেন, “বোজো ব্যাপার! আমরা ভয় পাই পুলিশকে, আবার পুলিশ ভয় পায় লালবাজারকে!”
হাসছিলেন ভাদুড়িমশাইও। ভাগ্নেকে একটা কপট ধমক দিয়ে বললেন, “এ সব ওস্তাদি বার-বার করিস না, ধরা পড়ে গেলে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে। শোভন তো বলেই ফেলল যে, এর মধ্যে একটা বাইরের লোক নাক গলিয়েছে। তুই সেটা শুনলিও। তা একবার যখন সন্দেহ হয়েছে, তখন বাইরের লোকটি যে কে, সেটা না জেনে কি ও ছাড়বে নাকি?”
কৌশিক বলল, “কিন্তু নিজেকে যদি না লালবাজারের লোক বলতুম, ওই কনেস্টবলটি তো আমাকে তা হলে আর এগোতেই দিত না। ওখান থেকে ফিরে আসতে হত। তখন তুমিই বলতে যে, কৌশিক একটা অপদার্থ, এই সামান্য কাজটাও ওর দ্বারা হবার নয়।”
“ঠিক আছে, শোভন তোকেই সন্দেহ করেছে কি না, তা নিয়ে পরে ভাবা যাবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন বল থার্টিন বাই থ্রি-এ মহেশ ঘোষাল সেকেন্ড বাইলেনের বাড়িটা ঠিক খুঁজে পেয়েছিলি তো?”
“তা কেন পাব না?”
“বাড়িতে লোকজন ছিল?”
ছেলেপুলে নেই। তাই বাড়িতে তাদের থাকারও কোনও প্রশ্ন ওঠে না। থাকার মধ্যে ছিলেন কল্যাণ রায়ের বউ আর এক শালা। কলিং বেল টিপতে বউটিই দোতলা থেকে নীচে নেমে দরজা খুলে দেন। আমি কে, জানতে চাইলে সেই একই কথা বলি। অর্থাৎ আমি পুলিশের লোক, লালবাজার থেকে আসছি। শুনে ভদ্রমহিলা বলেন, তিনি তাঁর স্বামীর দেহ শনাক্ত করে এসেছেন, তখনই লোক্যাল থানার বড়বাবু তাঁকে ঘণ্টা দুয়েক জেরা করে যা জানার ছিল সব জেনে নিয়েছেন, তা হলে এখন আবার পুলিশ তাঁর কাছে নতুন করে কী জানতে চায়।”
“তাতে তুই কী বললি?”
“বললুম, আমরা পুলিশে কাজ করলেও অমানুষ নই, তাঁর এই শোকের সময়ে আমি তাঁকে জেরা করতে আসিনি। লালবাজারে আমাদের একটা স্পেশাল ফান্ড আছে, কল্যাণবাবুর কাছ থেকে নানা সময়ে নানা কাজে আমরা অনেক সহযোগিতা পেয়েছি, সেই কারণে সেই ফান্ড থেকে তাঁর পরিবারের হাতে কিছু তুলে দেবার জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে। টাকার পরিমাণটা অবশ্য যৎসামান্য, তবে কল্যাণবাবুর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা যদি সেটা দয়া করে গ্রহণ করেন, তো আমরা কৃতার্থ হব।”
“তখন-তখন এসব কথা বানিয়ে বললি?”
“বললুম।” কৌশিক বলল, “তা নইলে তো বাড়ির মধ্যে এন্ট্রিই পেতুম না, বাইরে থেকেই চলে আসতে হত। কিন্তু তুমি তো আমাকে বাড়িটা ভাল করে দেখে আসতেই বলেছিলে। তা-ই না?”
“তা বলেছিলুম। কিন্তু তারপর কী হল?”
“ভদ্রমহিলা বললেন, তাঁদের ছেলেপুলে নেই, কল্যাণ রায়ের স্ত্রী হিসেবে তিনিই টাকাটা নেবেন। তাতে আমি বললুম, টাকাটা তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেওয়া যাবে না, সই-সাবুদের ব্যাপার আছে, একটু কোথাও বসবার সুবিধে থাকলে ভাল হত। এই কথা শুনে ভদ্রমহিলা একটু ইতস্তত করলেন, তারপর যেন খুব অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলছেন এইভাবে বললেন, ঠিক আছে, তা হলে দোতলায় আসুন।”
“তার মানে কল্যাণ রায় তার বউকে নিয়ে দোতলায় থাকত?”
“দোতলায় কেন, গোটা বাড়িটাই তো কল্যাণ রায়ের। তবে একতলায় মনে হল কেউ থাকে না। জানালা-দরজা বন্ধ, ভ্যাপসা, অনেকটা গুদাম-ঘরের মতো। দোতলায় ওঠার সময় বউ ছাড়া আর-একজনকে দেখলুম। পুরুষ। বয়েস মনে হল বছর তিরিশেক হবে। দোতলা থেকে কল্যাণ রায়ের বউকে দেখে সে বলল, ‘আমি ভাবলুম দাদা এল বুঝি,’ তারপর বউটির পিছন-পিছন সিঁড়ি দিয়ে আমাকে উপরে উঠতে দেখে চুপ করে গেল।”
শান্তিলতা এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। এবারে জিজ্ঞেস করলেন, “মহিলাটিকে দেখতে কেমন?”
“কালো, লম্বা, চাউনি দেখলে রাগী টাইপের বলে মনে হয়, সামনের নীচের পাটির একটা দাঁত ভাঙা…”
কৌশিককে থামিয়ে দিয়ে শান্তিলতা বললেন, “বাস্ বাস্, আর বলতে হবে না, চিনতে পেরেছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ইনিই নাইন্টিফাইভের গোড়ার দিকে আপনার আপিসে গিয়ে হামলা করেছিলেন?”
“হ্যাঁ। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মস্তান টাইপের দুটো ভাইকে। হুমকি দিয়ে বলেছিলেন যে, আমি যদি ওঁর সংসার ভাঙি তো উনিও আমাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন।”
“ভাই দুটোকে দেখতে কেমন?”
“ওই যে বললুম, মস্তান টাইপের। তার মধ্যে যেটা বড়, তার কটা চোখ, কানে রিং, চুল কামানো, হাতে স্টিলের বালা। ছোটটার বয়েস বছর কুড়ি, ঘাড় অব্দি চুল, আঙুলে একটা চাবির রিং ঘোরাতে-ঘোরাতে কথা বলছিল।”
কৌশিক বলল, “আমি সম্ভবত ছোটটাকেই দেখেছি। তার কথা শুনে মনে হল, দাদাটি অনেকক্ষণ বাড়িতে নেই বটে, তবে সে তারই ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বউটিকে কত দিলি?”
“এক হাজার।” কৌশিক বলল, “প্রথমে ভেবেছিলুম শ-পাঁচেক দেব। কিন্তু পরে ভেবে দেখলুম লালবাজার, স্পেশ্যাল ফান্ড ইত্যাদি সব বড়-বড় কথা বলার পরে যদি অন্তত হাজার না খসাই তো ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। …এটা কিন্তু আমার নিজের গাঁট থেকে খসিয়েছি, মামাবাবু, রিইমবার্স করে দিয়ো।”
“তা দেব, কিন্তু রসিদ লিখে রেভিনিউ স্ট্যাম্পে সই করিয়ে নিয়েছিস তো?”
“তা নিয়েছি। বউটি সই করলেন। ভাইটিকে উইটনেস হিসেবে সই করতে বলেছিলুম। তো সে ব্যাটা নিরক্ষর, তাই টিপছাপ দিয়েছে।”
“ঠিক আছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এবারে বাড়িটার একটা ভিভিড ডেসক্রিপশন দে। … এক কাজ কর, মুখে না বলে ওটা বরং তুই লিখে ফ্যাল। যা তোর চোখে পড়েছে, কিছু বাদ দিবি না। ….কোথায় দরজা, কোথায় জানলা, সদরে কিংবা দোতলার সিঁড়ির মুখে কোথাও কোলাপসিবল গেট আছে কি না, বারান্দা, ঝুল-বারান্দা…বেশিক্ষণ তো ছিলি না, তার মধ্যে যেটুকু যা দেখেছিস, সব লিখবি। মানে আমি যদি ওখানে যাই, তো জায়গাটা যেন আমার অচেনা মনে না হয়। অন্ধকারেও যেন সব চিনতে পারি।”
সদানন্দবাবুর চোখ প্রায় কপালে উঠে গেসল। ঢোক গিলে তিনি বললেন, “অ্যাঁ, রাত্তিরে ওই বাড়িতে আপনি যাবেন নাকি?”
শান্তিলতাও প্রায় একই কথার সংক্ষিপ্ত প্রতিধ্বনি করে বললেন, “যাবেন?”
ভাদুড়িমশাই শান্ত নিরুত্তেজ গলায় বললেন, “বোধ হয় যাব। বাড়িটা একবার দেখা দরকার।”
“তাই বলে রাত্তিরে যাবেন?”
“উপায় কী।” ভাদুড়িমশাই শান্তিলতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কল্যাণ রায়ের বউ আর দুই শালার যা বর্ণনা আপনার মুখে কালও শুনেছি, আবার আজও শুনলুম, তাতে তো মনে হয়, দিনের বেলায় গেলে ওরা আমাকে ঢুকতেই দেবে না। তাই ভাবছি যে, ওরা ঘুমিয়ে পড়লে মাঝরাত্তিরে গিয়ে ঢুকব। …ওরে কৌশিক, ডেসক্রিপশনটা পরে লিখিস বাবা, এখন বরং সংক্ষেপে বল যে, বাড়িটা কেমন দেখলি।”
কৌশিক খাতা-কলম নিয়ে লিখতে শুরু করেছিল, সে-সব একপাশে সরিয়ে রেখে বলল, “খুব সংক্ষেপে বলতে হলে বলব যে, দোতলাটা কেমন হবে, একতলা দেখে তা আমি কল্পনাই করতে পারিনি। দুটো তলার মধ্যে একেবারে আকাশপাতাল ফারাক। মহেশ ঘোষাল সেকেন্ড বাইলেন হচ্ছে একটা স্যাতা-পড়া, হাড়-পাঁজরা বার-করা, গোবরের গন্ধে ভরা এঁদো গলি। থার্টিন বাই থ্রি-এ বাড়িটা তথৈবচ। পলেস্তারা খসা নোনা-ধরা বাড়ি। একতলাটা এত অন্ধকার যে, চব্বিশ ঘণ্টাই লাইট জ্বেলে রাখলে ভাল হয়। আরশোলা আছে, শব্দ শুনে মনে হল ইঁদুরও আছে অগুন্তি। গুমোট ভ্যাপসা দমবন্ধ অ্যাটমসফিয়ার। কিন্তু একতলা থেকে যেই না দোতলায় এলুম, কী বলব মামাবাবু, ঝপ করে যেন আর-একটা জগতের দরজা আমার সামনে খুলে গেল। আমার মনে হতে লাগল, আমি আর নর্থ ক্যালকাটার কোনও বাইলেন-টাইলেনে নেই, ফুসমন্তরে কোনও একটা মালটি-ন্যাশনাল কোম্পানির বড় সাহেবের অ্যাপার্টমেন্টে এসে ঢুকে পড়েছি। কিংবা ধরো, বর্ষাকালের জলে ভরা মিশকালো মেঘের রাজ্য ফুঁড়ে একটা জেট প্লেন যখন ঝলমলে নীল আকাশে গিয়ে ঢোকে, তখন তার প্যাসেঞ্জারদের অবস্থা যেমন হয়, আমার অবস্থাও হল ঠিক সেইরকম।”
কৌশিক সম্ভবত আরও দু’চারটে তুলনা টানত। কিন্তু দাঁতে দাঁত ঘষে, পেল্লায় একটা ধমক দিয়ে ভাদুড়িমশই বললেন, “থাম! কাব্যি ছেড়ে বল যে, দোতলাটা কী রকম!”
“বলছি।” কৌশিক বলল, “একতলার দেওয়ালে পলেস্তারা খসে পড়ছে, অথচ দোতলার দেওয়ালে পঙ্কের কাজ। আগাগোড়া প্লাস্টার অব প্যারিসের প্রলেপ। আইভরি ফিনিশ। দুটো ঘর দেখেছি। দুটোরই ওয়াল টু ওয়াল পুরু কার্পেট। সোফা, কৌচ, সেন্টার টেবিল—সবই টপ ক্লাস। জল খাওয়ার অছিলায় বউটির পিছনে-পিছনে গিয়ে কিচেনে উঁকি মেরে থ হয়ে যাই। মাইক্রোওভেন থেকে ওটিজি, সেখানে নেই হেন গ্যাজেট নেই। ইন্টিরিয়র ডেকোরেটরের সাহায্য ছাড়া ও ভাবে বাড়ি সাজানো যায় না, মামাবাবু। বেশ ভাল রকমের পয়সা খর্চা করেছে।”
“তার মানে টাকাকড়ির অভাব নেই।” বলে একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। মনে হল কিছু একটা কথা ভেবে নিলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “অভাব নেই, অথচ লালবাজারের স্পেশ্যাল ফান্ড থেকে দিচ্ছিস বলে যে-টাকাটা তুই সাহায্য হিসেবে দিলি, সেটা হাত পেতে নিতে কোনও আপত্তি করল না?”
“আপত্তি কী বলছ, আমার পকেট থেকে টাকাটা বার করে এগিয়ে ধরতেই ভদ্রমহিলা একেবারে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন।”
“এর দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। এক, টাকাটা নেবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু লালবাজার থেকে পাঠিয়েছে শুনে আপত্তি করতে সাহস পায়নি।”
আমি বললুম, “আর দু’নম্বর ব্যাখ্যা?”
“মান-সম্মান নয়, টাকাটাই ওঁর কাছে বড় ব্যাপার। বউটি লোভী।”
কৌশিক বলল, “দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে। ভদ্রমহিলা লোভী।”
“আমারও তা-ই ধারণা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যা-ই হোক, একটা কথা তোকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। বাড়িতে শুধু ওই বউটি আর তার ভাই ছাড়া কাউকে দেখলি না? মানে কোনও কাজের লোক টোক?”
“না। চোখে পড়েনি। আর তা ছাড়া গেসলুম তো দুটো-আড়াইটের সময়। ওই সময়ে কোনও ঠিকে লোক কি থাকে? তারা সকালে এসে এক-আধ ঘণ্টা কাজ করে চলে যায়, তারপরে ফের এলেও সেই বিকেলে আসে। হোলটাইমের লোক হলে অবশ্য ওই সময়ে থাকতে পারত। হয়তো ছিলও। তবে আমি দেখিনি। হয়তো কোথাও পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছিল।”
এই পর্যন্ত বলে, একটু থেমে থেকে, কৌশিকই ফের বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি, মামাবাবু। ভদ্রমহিলাকে টাকাটা দিয়ে, কাঁচা রসিদে সই করিয়ে ফের তো তাঁরই সঙ্গে নীচে নামি। তিনিই সদর-দরজা খুলে দেন। তো তাঁকে নমস্কার করে যখন বেরিয়ে আসছি, বাইরে থেকে একটা লোক সেই সময় ভিতরে এসে ঢোকে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে কোনও কথা না বলে সে তাঁর পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে চলে যায়।”
“কাজের লোক?”
“হাঁটার ধরন দেখে তা মনে হল না। তা ছাড়া, কাজের লোকেরা কি মালকিনের সামনে সিগারেট ফোঁকে? লোকটা সিগারেট খাচ্ছিল। ভদ্রমহিলাকে দেখেও সেটা লুকোবার চেষ্টা করেনি।”
“লোকটা কি বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল?”
“হতে পারে। তবে কলিং বেল বাজায়নি। হয়তো বাজাত, কিন্তু ভদ্রমহিলা ঠিক সেই সময়েই দরজা খুলে দেন বলে আর বেল বাজাবার দরকার হয়নি।”
“ছোট ভাইটাকে তো দোতলায় দেখেছিলি,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কে জানে এটাই তার দাদা কি না!”
শান্তিলতা বললেন, “মাথা কামানো? কটা চোখ?”
“একতলাটা এত অন্ধকার যে, তার মধ্যে কার চোখের রং কেমন, তা খেয়াল হবার কথা নয়, আমার হয়ওনি।” কৌশিক বলল, “তবে মাথা ন্যাড়া নয়, দিব্যি লম্বা চুল।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “মিসেস মিত্র, নাইন্টিফাইভের গোড়ায় আপনি কল্যাণ রায়ের শালা দুটোকে দেখেছিলেন। কিন্তু সে তো ছ’বছর আগের ব্যাপার। বড় শালাটির মাথা তখন কামানো ছিল বলেই যে আজও সেইরকমই থাকবে, এটা ভাবছেন কেন?”
সেলফোন বেজে উঠল। সেটাকে টেবিল থেকে তুলে কানে চেপে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি ভাদুড়ি কথা বলছি। …শোভন? কী ব্যাপার?”
মিনিট পাঁচেক কথা হল। একতরফা কথা। ভাদুড়িমশাই শুনে যাচ্ছেন মাত্র, আর মাঝেমধ্যে হ্যাঁ-হুঁ দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কিছুই বলছেন না। একেবারে শেষের দিকে হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বললেন, “এখন সাড়ে সাতটা বাজে, তুমি আটটা নাগাদ চলে আসতে পারবে? …বেশ, তা হলে চলে এসো। আমি আছি।”
লাইন কেটে দিয়ে সেলফোনটা ফের সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর শান্তিলতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “যা শুনলুম, সংক্ষেপে বলছি। পুলিশের ধারণা, কল্যাণ রায়ের খুনের ব্যাপারে একজন নয়, বাইরের দু’ দুজন লোক নাক গলিয়েছে। তাদের একজন কৌশিক। অন্য জন সম্পর্কে শোভন কিছু বলল না। শোভন সন্দেহ করছে আপনাকেও। ওর ধারণা, এই খুনের ব্যাপারে আপনিও জড়িত। তবে এমন ধারণা কীসের ভিত্তিতে হল শোভন তা জানায়নি। তা না-ই জানাক, আমার মনে হচ্ছে, কাল-পরশুর মধ্যে ওরা আপনাকে অ্যারেস্ট করতে পারে। …না না, ভয় পাবেন না, আমি আপনাকে একজন ল-ইয়ারের নাম আর ফোন নম্বর লিখে দিচ্ছি।”
এক টুকরো কাগজে দ্রুত হাতে দু’লাইন লিখে কাগজটা শান্তিলতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভাদুড়িমশাই তাঁর আগের কথার জের টেনে বললেন, “এঁর সঙ্গে আজই রাতে যোগাযোগ করে বলুন যে, আপনি আমার ক্লায়েন্ট, ইনি কাল সকালেই আপনার আগাম জামিনের ব্যবস্থা করে দেবেন। …এখন আপনি যান। একটু বাদেই শোভন এসে পড়বে। আপনি থাকলে তার কথা বলার অসুবিধে হতে পারে।”
চিরকুটটা হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে শান্তিলতা বিদায় নিলেন। ভাদুড়িমশাই বললেন বটে, ‘ভয় পাবেন না’, কিন্তু ভদ্রমহিলার মুখ দেখে বোঝা গেল তিনি বিলক্ষণ ভয় পেয়েছেন।
মিনিট কয়েক চুপচাপ কাটল। তারপর আমি আর সদানন্দবাবু উঠে পড়বার উপক্রম করছি দেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু বসে যান, দেখি শোভন কী বলে। যা বলার, আপনাদের সামনেই বলুক।”
কৌশিক বলল, “তাঁর তো আসার সময় হয়ে এল। তার আগে তোমাকে একটা কথা জানানো দরকার, মামাবাবু। মিসেস মিত্রের সামনে বলতে চাইনি। আজ দুপুরে দেখা তিনটে ব্যাপার নিয়ে আমি একটু ভাবনায় পড়ে গেছি।”
“কী দেখলি?”
“প্রথম ব্যাপার ওই আইসক্রিমের ভেন্ডার। সে তো ফিরিওয়ালা, মাল বিক্রি করার জন্য ফিরিওয়ালারা চেঁচায়, সে কিন্তু ‘আইসক্রিম, আইসক্রিম’ বলে একবারও হাঁক পাড়েনি। দ্বিতীয় ব্যাপার হল কল্যাণ রায় তো সদ্য মারা গেছে, অথচ তার বউয়ের মুখে একটুও শোকের চিহ্ন নেই। আর তৃতীয় ব্যাপারটা হল কল্যাণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাইরে থেকে যে লোকটিকে ভিতরে ঢুকতে দেখি, তার পরনে ছিল ট্রাউজার্সের সঙ্গে জাস্ট একটা হাতকাটা স্যান্ডো গেঞ্জি। জামা ছিল না।”
ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ দুটো দেখলুম হঠাৎই ভীষণ সরু হয়ে এসেছে। চাপা গলায় তিনি বললেন, “তা-ই?”
কলিং বেল বেজে উঠল।