৫
আমার ঘুম সাধারণত সকাল সাতটায় ভাঙে। কিন্তু কাল রাতে ঘুমোতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে আজ বিছানা ছেড়ে উঠতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। তাও হয়তো উঠতুম না, যদি না বাসন্তী এসে চেঁচামেচি জুড়ে দিত। বিছানা থেকেই বললুম, “কী হয়েছে, এত হল্লা কীসের?”
বাসন্তী বলল, “হল্লা হবে না? সাড়ে সাতটা বাজে, তাও তোমার ওঠার নাম নেই! ওদিকে বোসমশাই সেই সাতটা থেকে তোমার জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে আছেন। ওঠো, ওঠো!”
বোসমশাই মানে সদানন্দ বসু। তিনি আবার সাত-সকালে কী কাজে এলেন? তাড়াতাড়ি মুখেচোখে জল দিয়ে বসার ঘরে ঢুকে দেখলুম, সদানন্দবাবু নিবিষ্টমনে কাগজ পড়ছেন। বললুম, “কী খবর? এত মন দিয়ে কী পড়ছেন? শেয়ার বাজারে কি আবার ধস নামল নাকি?”
“ধুর মশাই” সদানন্দবাবু বললেন, “আজ তো সোমবার। কাল শেয়ার-বাজার বন্ধ ছিল, আজ তার খবর থাকবে কোত্থেকে?”
“তা হলে?”
“তার মানে আপনি এখনও কাগজ পড়েননি।” বলে হাতের কাগজখানা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “নিন। তিনের পাতায় যে খবরটা আমি দাগ দিয়ে রেকিচি, সেটা একবার পড়ুন দিকি। পিলে চমকে যাবে, মশাই।”
দীর্ঘকাল খবরের কাগজে কাজ করছি। স্নায়ুগুলি সম্ভবত সেই কারণেই একটু-একটু করে ভোঁতা হয়ে গেছে, ভূমিকম্প থেকে গণহত্যা, কোনও খবরেই আজকাল আর পিলে চমকে যায় না। তিনের পাতায় নীচের দিকে ছোট-হরফের হেডলাইনের তলায় লাইন আট-দশের যে খবরটা ছাপা হয়েছে, সেটাও একটু তাচ্ছিল্যভরেই পড়তে শুরু করেছিলুম। কিন্তু খানিক পড়েই আমার বুকের মধ্যে হঠাৎ ধ্বক করে উঠল। খবরটা এখানে তুলে দিচ্ছি।
নিজস্ব সংবাদদাতা : কাল রবিবার রাত সাড়ে দশটায় উত্তর কলকাতার মহেশ ঘোষাল লেনে এক ব্যক্তির মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। ফোনে উড়ো খবর পেয়ে স্থানীয় থানা থেকে সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়। নিহত ব্যক্তির মাথার পিছন দিকে গভীর ক্ষতচিহ্ন দেখে পুলিশের সন্দেহ, পিছন থেকে ভারী কোনও বস্তু দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছিল। পকেটে যে ভিজিটিং কার্ড ছিল, তাতে জানা যায়, নিহতের নাম কল্যাণ রায়। বয়স আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। পুলিশ বলছে, এটা রাজনৈতিক খুন নয়, ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করার ঘটনা। তদন্ত চলছে।
কাগজ থেকে মুখ তুলে সদানন্দবাবুর দিকে তাকাতে তিনি বললেন, “এ সেই কল্যাণ রায়, মশাই …মানে ওই গতকাল মিসেস মিত্র যার কথা বলছিলেন। …কী, আপনার মনে পড়ছে না? আরে ওই যার বউ গিয়ে মিসেস মিত্রের আপিসে খুব চোটপাট করেছিল।”
মনে আমার খুবই পড়ছিল। তা নইলে আর খবরের মধ্যে কল্যাণ রায় নামটা দেখে আমার বুকের মধ্যে হঠাৎ ধ্বক করে উঠবে কেন? তবু, মুখে যথাসম্ভব হাসি টেনে বললুম, “ছাড়ুন তো। এটা কোনও আনকমন নাম নয়, সারনেমটাও খুব কমন। কলকাতায় অন্তত হাজার খানেক কল্যাণ রায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে ইনিই যে তিনি, তা আপনি জানলেন কী করে?”
সদানন্দবাবু দমে গেলেন না। ভারিক্কে চালে বললেন, “আমার মন বলছে, মশাই। আর হ্যাঁ, আমার মন যা বলে, তা কক্ষনো মিচে হয় না।”
কথাটা যে সত্যি-সত্যি ফলে যাবে, তা কি তখন জানি। জানা গেল মিনিট পাঁচেক বাদে, ফোনটা বেজে উঠবার পরে। ভাদুড়িমশাইয়ের গলা। “আজ তো আপনার আপিস আছে, তাই না?”
“তা তো আছেই।”
“আপিস থেকে বেরিয়ে কোথাও যাবার নেই তো? মানে কোনও বাংলা বর্ষবরণের উৎসবে, কি ওই রকম কোনও ব্যাপারে আর-কোথাও?”
হাসি চাপতে পারলুম না। বললুম, “কোথাও যাবার নেই। আপিস থেকে সরাসরি বাড়ি ফিরব।”
“তা হলে সদানন্দবাবুকে নিয়ে এখানে চলে আসুন।”
“কী ব্যাপার বলুন তো? মিসেস মিত্র ফের ফোন করে কিছু জানিয়েছেন?”
“না, বোধহয় ঘুম থেকে এখনও ওঠেননি। উঠুন, আজকের কাগজটা পড়ুন, তারপরেই নিশ্চয় ফোন করবেন।”
যা মনে হচ্ছিল, সেটা চেপে গিয়ে বললুম, “কেন, কাগজে কিছু বেরিয়েছে? সামথিং দ্যাট কনসার্নস হার? …কী, চুপ করে রইলেন কেন?”
“বিস্ময়ে কথা সরচে না। আরে মশাই, আপনি খবরের কাগজের লোক, অথচ আজকের খবরের কাগজটাই এখনও দেখেননি। ‘দৈনিক বার্তাবহ’র তিনের পাতার নীচের দিকে একটা খবর বেরিয়েছে। দয়া করে সেটা একবার দেখুন।”
বললুম, “ওই ‘রাজপথে হত্যাকাণ্ড’ খবরটা তো? পড়েছি। কিন্তু এ কি সেই কল্যাণ রায়?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে-ই। লালবাজারের শোভনকে তার বাড়িতে ফোন করেছিলুম। সে হেডকোয়ার্টার্সে গিয়ে ডিটেল্স জোগাড় করে বিকেলে এখানে আসবে। তবে ইতিমধ্যেই সে একটা খবর দিয়েছে। লোকটা নাকি এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের ব্যাবসা করত। …যা-ই হোক, আপনারা চলে আসুন।”
রিসিভার নামিয়ে রেখে সদানন্দবাবুর দিকে তাকালুম। ভাদুড়িমশাইয়ের কথা তিনি শোনেননি, শুনেছেন শুধু আমার কথাই। কিন্তু শুধু আমার কথা শুনেই যা বুঝবার বুঝে নিয়েছেন। নইলে অমন মিটিমিটি হাসবেন কেন?
হাসি দেখে গা জ্বলে গেল। যথাসম্ভব গম্ভীরভাবে বললুম, “আপনার কথাই ঠিক। এ সেই কল্যাণ রায়ই বটে।”
“হতেই হবে।” সদানন্দবাবু বললেন, “আমার মন কখনও মিচে কথা কয় না।”
সেটা যে পুরোপুরি একটা অন্তঃসারশূন্য আত্মম্ভরিতার ব্যাপার, তা-ই বা বলি কী করে। ডিটেকশান-ওয়ার্ক তো ছেলেখেলা নয়, সেটা একটা জটিল অঙ্ক, ধাপে-ধাপে নির্ভুল কষে তার উত্তরে পৌঁছুতে হয়। সে-অঙ্ক যেমন আমার মাথায় ঢোকে না, তেমনি সদানন্দবাবুর মাথায়ও ঢোকে না। অথচ মাঝে-মাঝেই তিনি ভারিক্কে চালে ‘আমার মন বলচে, মশাই’ বলে যে-সব বচন ঝাড়েন, তার অনেকগুলি দেখেছি মিলেও যায়।
ভারিক্কে চালটা বজায় রেখেই সদানন্দবাবু বললেন, “তা এ-ব্যাপারে ভাদুড়িমশাই এখন কী করবেন বলে মনে হয়? ফোনটা তো যদ্দুর বুঝছি তিনিই করেছিলেন। কিছু বললেন?”
“হ্যাঁ। বিকেলে ওঁর ওখানে লালবাজারের শোভন চৌধুরি আসছেন। আমাকে যেতে বললেন।”
“আমাকে যেতে বলেননি?”
“বলেছেন। তা আপনি যাবেন কীভাবে? একাই এখান থেকে যাবেন, না আপিসে থেকে ফিরতি পথে আমি আপনাকে তুলে নেব?”
“একা যে যেতে পারি না, তা নয়,” সদানন্দবাবু বললেন, “তবে আপনি যদি তুলে নিয়ে যান তো আমার ট্যাক্সি-ভাড়াটা বেঁচে যায়।”
“ঠিক আছে, আমিই তুলে নেব।”
“তা হলে ওই কথাই রইল। পাঁচটা নাগাদ আমি তৈরি হয়ে থাকব।”
ঘরের কোণ থেকে তাঁর মাথায়-লোহার-বল-বসানো লাঠিখানাকে তুলে নিয়ে সদানন্দবাবু সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।
আপিসে আজ খুব একটা কাজের চাপ ছিল না। গোটা দুই লেখা দেখে দেবার ছিল, সেইসঙ্গে জবাব লেখার ছিল খান-তিনেক জরুরি চিঠির। সে-সব কাজ সেরে, সহকর্মীদের সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে, আপিস থেকে ফিরতি পথে সদানন্দবাবুকে তুলে নিয়ে যখন কাঁকুড়গাছিতে পৌঁছলুম, ঘড়িতে তখন ঠিক সাড়ে পাঁচটা।
দরজা খুলে দিল মালতী। আমাদের দেখে বলল, “আসুন, আসুন। ওঁরা এসে গেছেন।” বললুম, “ওঁরা মানে?”
“মানে শোভন চৌধুরি আর মিসেস মিত্র। কৌশিকও একটু আগে ফিরেছে।” এই পর্যন্ত বলে মালতী একটু হেসে, গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে বলল, “আপনাদের এবারকার ক্লায়েন্টটি একটু গোলমেলে কিরণদা। সাবধানে পা ফেলবেন।”
হাসিটা সুবিধের ঠেকল না। আমরা ড্রয়িংরুমে ঢুকে দুটো চেয়ার টেনে বসে পড়লুম।
সকলের মুখ দেখলুম গম্ভীর। শান্তিলতার পরনে আজ আর শালোয়ার-কামিজ না, তিনি ফের সেই আগের দিনের মতো শাড়ি-ব্লাউজে ফিরে গেছেন। আমাদের দেখে সামান্য হাসলেন, তবে হাসিটা মনে হল চেষ্টাকৃত। ভঙ্গি আড়ষ্ট। চোখ লাল। কাঁদছিলেন কি না, বুঝলুম না।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনারা এসে গেছেন, ভালই হল। কৌশিক কিছু বলেনি, তবে শোভনের কাছে কিছু-কিছু খবর পেয়েছি, আপনারাও সব শুনবেন। শোভনের কাজের তাড়া রয়েছে, ও বেশিক্ষণ বসতে পারবে না, তাই ওর কথাটাই আগে শুনুন। …ওহে শোভন, তুমি এই কল্যাণ রায় সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত যেটুকু যা জানতে পেরেছ, তা তো আমরা শুনলুম। এখন সেটাই একটু সংক্ষেপে এঁদের বলো তো।”
শোভন চৌধুরি বললেন, “আমি বলতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে। তার চেয়ে বরং আপনি প্রশ্ন করুন, আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছি।”
“ঠিক আছে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে আমি প্রশ্ন করলে সেটা জেরার মতো শোনাবে কিন্তু যা-ই হোক, লোকটির নাম যে কল্যাণ রায়, তা তোমরা কী করে জানলে?”
“পকেটে ওর ভিজিটিং কার্ড ছিল, তার থেকে।”
সে তো কাগজের খবরেও দেখেছি। কিন্তু ওর পকেটে পাওয়া গেছে বলেই যে সেটা ওরই কার্ড, তা তো নাও হতে পারে। অন্য কারও ভিজিটিং কার্ডও কি আমাদের পকেটে অনেক সময় থেকে যায় না? এক্ষুনি যদি আমার পকেট সার্চ করো তো খুব সম্ভবত মিসেস মিত্রের একটা ভিজিটিং কার্ড সেখানে পেয়ে যাবে। কিন্তু তার মানে কি আমিই মিসেস মিত্ৰ?”
কথাটা শুনে একমাত্র সদানন্দবাবুই হেসে উঠলেন। কিন্তু আমরা কেউই হাসছি না .দেখে পরমুহূর্তেই দেখলুম সামলেও নিলেন নিজেকে
শোভন বললেন, “ওটা কালকের ব্যাপার। তখন পর্যন্ত এই কার্ডটা ছাড়া পুলিশের হাতে আর-কিছু ছিল না। কিন্তু আজ সকালে কল্যাণ রায়ের বউ এসে লাশ শনাক্ত করে বলেছে যে, হ্যাঁ, ওটা তার স্বামীর ডেডবডিই বটে।”
“নিহত ব্যক্তির পকেটে এই ভিজিটিং কার্ডখানা ছাড়া আর কী পাওয়া গেছে বলো।”
“পাওয়া গেছে আড়াই হাজার টাকা। সবটাই একশো টাকার নোটে। যে-ই ওকে খুন করে থাক, সে টাকার জন্যে করেনি।”
“এটা কী করে বুঝলে?”
“সিম্পল। টাকার জন্যেই যদি খুন করবে, তবে ভিকটিমের পকেটে সেটা থেকে গেল কেন? খুনি সেটা নিয়ে যেত।”
“জোর করে তা কি বলা যায় শোভন? এমনও তো হতে পারে যে, টাকার জন্যেই ওকে খুন করা হয়েছে, কিন্তু ভিকটিমের চিৎকারে পাড়ার লোক জেগে যাওয়ায় খুনি সরে পড়ে। তাড়াহুড়োর মধ্যে পালাতে গিয়ে সে আর টাকাটা নিয়ে যেতে পারেনি। আবার এমন হওয়াও বিচিত্র নয় যে, ভিকটিমের পকেটে টাকা আরও বেশি ছিল। তার কিছুটা খুনি কেড়ে নিয়েছে, কিছুটা সে ফেলে রেখেই পালায়।”
“আপনি তা-ই মনে করেন?”
“আমি অনেক কিছুই মনে করি।” ভাদুড়িমশাই হাসলেন। “কেন মনে করি, জানো? আমার তো তোমাদের মতো ওয়ান-ট্র্যাক মাইন্ড নয়, তাই যা-ই ঘটুক না কেন, সেটাকে দেখবার চেষ্টা করি নানান দিক থেকে। এমনকি খুনির দিক থেকেও।”
শোভন চৌধুরির মুখেও এবারে হাসি ফুটল। বললেন, “এইজন্যেই বলে যে, খুনি আর গোয়েন্দা আসলে একই পয়সার এপিঠ ওপিঠ। দে হ্যাভ দ্য সেম মাইন্ডসেট।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কথাটা একেবারে মিথ্যেও নয়। …যা-ই হোক, সকালে যখন তোমাকে ফোন করি, তখন তুমি বললে যে, লোকটা এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যাবসা করত। এটা তুমি কোত্থেকে জানলে?”
“লোক্যাল থানা থেকেই জানাল। বলল যে, ভিজিটিং কার্ডে নামের তলায় পরিচয় লেখা ছিল : রিপ্রেজেন্টেটিভ, গ্লোব্যাল মার্কেটিং এজেন্সি, এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স।”
“খুনটা ঠিক কখন হয়েছে জানা গেল?”
“পুলিশের ডাক্তারকে তক্ষুনি-তক্ষুনি পাওয়া যায়নি। ডাক্তার আসেন রাত সাড়ে বারোটায়। তিনি বলছেন, মৃত্যু হয়েছে রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যে।”
শুনে ভাদুড়িমশাই চকিতে একবার শান্তিলতার দিকে তাকালেন। সামান্য হাসলেন। তারপর শোভনকে বললেন, “তোমার তাড়া আছে বলছিলে। আজ আর তাই তোমাকে আটকে রাখছি না। তবে তোমার সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখব।”
শোভন চৌধুরি তাঁর সোফা থেকে উঠে বললেন, “একটা কথা বুঝতে পারছি না। এই মার্ডারটার ব্যাপারে আপনার কৌতূহলের কারণ আমি আন্দাজ করতে পারি, সম্ভবত আপনার কোনও ক্লায়েন্টের স্বার্থ আপনি দেখছেন, যদিও তা নিয়ে আপনি অন্তত এখনও পর্যন্ত আমাকে কিছু জানাননি, আর আমিও কিছু জানতে চাইনি। কিন্তু একটা কথা শুনে আমার একটু অবাক লাগছে। এর মধ্যে আবার একটা উটকো লোক এসে নাক গলাল কেন
“গলিয়েছে বুঝি?”
“হ্যাঁ। কথাটা থানার ওসি’র কাছেই শুনলাম। সে বলল, আজ দুপুরে একটা লোক মহেশ ঘোষাল লেনে এসে পুলিশের লোক বলে নিজের পরিচয় দিয়ে পাড়ার লোকদের নানান কথা জিজ্ঞেস করছিল। কল্যাণ রায়ের বাড়িতে গিয়ে তার বউয়ের সঙ্গেও দেখা করেছে সে। অথচ ওসি বলছে, থানা থেকে আজ দুপুরে সে কাউকে ওখানে পাঠায়নি। এক্সট্রিমলি ফিশি ব্যাপার। আপনার কী মনে হয়? কে হতে পারে লোকটা?”
“হয়তো কল্যাণ রায়ের আপিসেরই কোনও লোক।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাগজে খবর দেখে খোঁজ করতে এসেছিল।”
“তা-ই হয়তো হবে।”
শোভন আর দাঁড়ালেন না। চিন্তিত মুখে বিদায় নিলেন। কৌশিক ওঁকে লিফটে তুলে দিয়ে ফিরে এস বলল, “উটকো লোকটা কে, সেটা বুঝতে পেরেছ মামাবাবু?”
“তা কেন বুঝব না?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুই মহেশ ঘোষাল লেনে গিয়েছিলি। কিন্তু সেটা তো পরের কথা। যা যা হয়েছে, প্রথম থেকে বলে যা।”
কৌশিক বলল, “প্রথমে যাই ট্র্যাভল-স্টারে। সেখান থেকে কল্যাণ রায়ের ঠিকানা জোগাড় করি। ভদ্রলোক মহেশ ঘোষাল লেনে খুন হয়েছেন বটে, কিন্তু ওখানে ওঁর বাড়ি নয়, বাড়ি থার্টিন বাই থ্রি-এ মহেশ ঘোষাল সেকেন্ড বাইলেনে। সেটা ওই মহেশ ঘোষাল লেন থেকে বেরিয়েছে।”
শান্তিলতা এতক্ষণ একটাও কথা বলেননি। এবারে বললেন, “কিন্তু কল্যাণ তো থাকত দক্ষিণ কলকাতায়। যদ্দুর মনে পড়ছে, রাস্তাটার নাম আস্রফ আলি রোড। আর নম্বর…হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তেতাল্লিশ।”
“মাস দুয়েক আগেই উনি আস্রফ আলি রোডের বাড়ি ছেড়ে উঠে আসেন। এটা ওই ট্র্যাভল-স্টারেই শুনলুম। ওঁরা ওঁদের খাতা খুলে আমাকে দেখালেন যে, পুরনো ঠিকানা কেটে সেখানে ওই মহেশ ঘোষাল সেকেন্ড বাইলেনের ঠিকানা লেখা রয়েছে।”
শান্তিলতার দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “থিয়েটার রোডের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে যুগলের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়েছিল, আপনি নিজেই বলেছেন। তখনই তার কাছে আপনি জানতে পারেন যে, বিয়ের পরে তাকে যে দুখানা চিঠি আপনি লিখেছিলেন, তার একখানাও সে পায়নি। তা যোগাযোগটা কীভাবে হয়েছিল? আপনি কি দেখা করেছিলেন তার সঙ্গে?”
“না। তার শিবপুরের বাড়িতে ফোন করি। নিজের বাড়ি নয়, ওখানে এক চেনা ভদ্রলোকের বাড়িতে ও পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকত। ওরাই জানাল যে, যুগল আর এখন ওখানে থাকে না। ওরা ওর নতুন ঠিকানা দিতে পারেনি, শুধু একটা ফোন নাম্বার দেয়। সেই নাম্বারে যুগলকে ফোন করি। তখনই জানতে পারি যে, আমার চিঠি ও পায়নি। ঠিকানা জানতে চেয়েছিলুম। তাতে বলল, ঠিকানা দিয়ে কী হবে, এখন আর দেখা-সাক্ষাৎ না-হওয়াই ভাল, বিশেষ করে আমার স্বামী যখন সেটা চান না।”
“তার মানে ফোনে যোগাযোগ হলেও যুগলের সঙ্গে আপনার ইদানীং…আই মিন থিয়েটার রোডের বাড়ি থেকে আপনি বেরিয়ে আসার পরে আর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি।”
“না।”
একেবারে হঠাৎই চোখ দুটো ভীষণ সরু হয়ে গেল ভাদুড়িমশাইয়ের। তীব্র চাউনি। যে চাউনি দেখে মনে হয় যে, সামনের মানুষটির একেবারে অন্তস্তল পর্যন্ত তিনি দেখে নিতে চাইছেন। শান্তিলতার দিকে স্থির চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন। তারপর, প্রায় ধমক দেবার ভঙ্গিতে বললেন, “ফের মিথ্যে কথা বলছেন?”
ধমক খেয়ে কুঁকড়ে গেলেন শান্তিলতা। মাথা নিচু করে বললেন, “আপনার কাছে কি একটাও মিথ্যে কথা বলা যাবে না?”
“একটাও না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সারাক্ষণ যারা আপনাকে ফলো করছে, শনিবার রাত্তিরে রয়্যাল চায়না রেস্তোরাঁ থেকে রাস্তায় বেরিয়ে শুধু যে তাদেরই আমি দেখতে পেয়েছিলুম, তা নয়। দেখেছিলুম অল্পবয়েসি একটি ছেলেকেও। পরনে হালকা রঙের ট্রাউজার্স আর সবুজ শার্ট। একটু ছটফটে প্রকৃতির, তবে সেটা নার্ভাসনেসের জন্যেও হতে পারে। আমার ধারণা সে-ই যুগল। সে-ই আপনাকে রয়্যাল চায়নায় নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নিজে ভিতরে ঢোকেনি। …কী, চুপ করে রইলেন কেন? ভুল বললুম?”
শান্তিলতা মাথা তুললেন না। বললেন, “না, আপনি ঠিকই বলেছেন।”
“শনিবারের আগে কিংবা পরে আর যুগলের সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?”
“না। তার আগেও না, তার পরেও না।” মাথা তুলে শান্তিলতা বলনেল, “তা হলে সবটাই আপনি শুনুন। শনিবার সকালে ফোন করে যুগলকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে আমি সব কথা বলি। সে-ই আমাকে আপনার সাহায্য চাইতে পরামর্শ দেয়। আপনাদের ক্যামাক স্ট্রিটের আপিস থেকে সে-ই আপনার কাঁকুড়গাছির ফোন নাম্বার জোগাড় করে। তারই কথায় কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে ফোন করে আমি জানতে পারি যে, আপনি রয়্যাল চায়না রেস্তোরাঁয় রয়েছেন। তখন যুগলই আমাকে সেখানে নিয়ে যায়। আপনারই কথামতো; রেস্তোরাঁ থেকে আপনারা চলে যাবার খানিক বাদে আমি রাস্তায় বেরোই। যুগল তখনও রাস্তায় আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আপনি যে আমার প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করেছেন, এটা জেনে সে নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি চলে যায়। তারপরে সে আর আমার সঙ্গে দেখা করেনি। তার ঠিকানাও আমাকে দেয়নি। যাবার আগে বলে যায় যে, আমাদের আর দেখাসাক্ষাৎ করা উচিত হবে না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আশা করি এর একটা কথাও মিথ্যে নয়।”
শান্তিলতা ম্লান হাসলেন। বললেন, “মিথ্যে বলে যে পার পাব না, সে তো আমি বুঝেই গেছি।” কৌশিকের দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এবারে তোর কথা বল, ট্র্যাভল-স্টার থেকে কল্যাণ রায়ের ঠিকানা জোগাড় করে তুই কি প্রথমেই মহেশ ঘোষাল সেকেন্ড বাইলেনে চলে গেলি?”
“না। আমার মনে হল, কাগজে সদ্য খুনের খবরটা বেরিয়েছে, স্পটে হয়তো এখনও পুলিশ রয়েছে, তাই এখুনি না গিয়ে দেরি করে যাওয়া ভাল। পাড়ার লোকেরা যখন দুপুরের চান খাওয়া-দাওয়া সারতে যে যার বাড়িতে ঢুকে পড়বে, রাস্তাতেও আর তেমন ভিড়ভাট্টা থাকবে না, তখন যাব।”
“ততক্ষণ তা হলে কী করলি?”
“ওই ট্র্যাভল-স্টার থেকেই জোগাড় করলুম যুগল চৌধুরির শিবপুরের সেই পুরনো ঠিকানা আর ফোন-নম্বর। তারপর সেখানে ফোন করে মিসেস মিত্রের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, আমারও তা-ই হল। যুগলের নতুন ঠিকানা ওঁরা দিতে পারলেন না, দিলেন শুধু নতুন ফোন নম্বর। সেখানে ফোন করলুম, কিন্তু ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বেজে গেল, কেউ ধরলেন না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাড়িতে গেলি না কেন? ফোন নম্বর পেলি আর বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করতে পারলি না, তাও কি হয়?”
কৌশিক একগাল হেসে বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও! সবটা বলতে দাও আমাকে। টেলিফোনে নো-রিপ্লাই হয়ে যাওয়ায় ক্যালকাটা টেলিফোনের হেড আপিসে গিয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সুবিমল দত্তরায়ের সঙ্গে দেখা করি। সুবিমল আমার ইস্কুলের বন্ধু। সে তক্ষুনি তাদের বিল ডিপার্টমেন্টে গিয়ে নম্বরটা দেখিয়ে ঠিকানা এনে দেয়। ঠিকানা হল নর্থ ক্যালকাটারই ফিফটিন-এ রামগোপাল স্ট্রিট। সেখানে গিয়ে জানতে পারি যে, বাড়িটাতে যুগলবাবু একটা ওয়ান-রুম ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। সঙ্গে থাকেন তাঁর এক বন্ধু। বন্ধুটি বললেন, রোব্বার সকাল থেকেই যুগলবাবু কলকাতায় নেই, তিনি তাঁর অর্কেস্ট্রা পার্টির একটা প্রোগ্রাম নিয়ে কথা বলতে দুর্গাপুরে গেছেন; আজ রাত্তিরে কলকাতায় ফিরবেন।”
“যুগলকে দিয়ে তোর কী দরকার, বন্ধুটি তা জানতে চাইল না?”
“চাইল বই কি। তাতে আমি বললুম যে, আমি ব্যান্ডেল থেকে আসছি। সেখানকার ন্যাশনাল কালচারাল ক্লাব খুব নামডাকওয়ালা অর্গানাইজেশন, আমি তার অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, এবারে আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তীটা খুব বড় মাপের হবে, তা আমরা ভাবছিলুম যে, উনি যদি রবীন্দ্রনাথের গোটাকয় গানের টিউন আমাদের ওখানে বেহালা বাজিয়ে শোনান, তো সেটা একটা নতুন ব্যাপার হয়। সঙ্গে অবশ্য তবলা থাকবে।”
“তাতে বন্ধুটি কী বলল?”
“বলল যে, তিনি তো কলকাতায় নেই, আমি যদি আমাদের ব্যান্ডেলের ঠিকানাটা রেখে যাই, তো দুর্গাপুর থেকে ফিরে তিনি আমাদের সঙ্গে চিঠি লিখে যোগাযোগ করে নেবেন।”
“ঠিকানা দিলি?”
“ঠিকানা আছে নাকি যে দেব? একটা ফিকটিশাস অ্যাড্রেস অবিশ্যি দিতে পারতুম, কিন্তু মনে হল সেটা ঠিক হবে না। তাই বললুম যে, না না, উনি আর্টিস্ট মানুষ, ওঁর ব্যস্ত হবার দরকার নেই, আমি তো এখন কলকাতায় আছি, কাল-পরশুর মধ্যে আমিই ফের যোগযোগ করে নেব।”
“ফ্ল্যাটটার ডেসক্রিপশন দে।”
“ফ্ল্যাট মানে তো একটাই ঘর। দুটো জানলা। দুটো তক্তপোষ। একধারে একটা নড়বড়ে আলনা। তাতে একটা ময়লা গেঞ্জি, একটা লুঙ্গি আর বাসী কিছু জামাকাপড় ঝুলছে। ঘরের মধ্যে গোটা দুই-তিন মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ছড়ানো। এক কোণে একটা কুঁজো। বাথরুমে উঁকি মেরেছিলুম। নোংরা। নো কিচেন।”
“যুগল যে কাল সকাল থেকেই কলকাতায় নেই, রাত্তিরেও ছিল না, এটা সত্যি বলে মনে হল?”
“এ-কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “পরে বলব। এখন মহেশ ঘোষাল সেকেন্ড বাইলেনে কী দেখলি বল।”