শান্তিলতার অশান্তি – ৪

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার সম্পর্কে ধনঞ্জয় মিত্রের সন্দেহ কিছু নতুন ব্যাপার নয়। ওটা ছিল আপনাদের পরিচয় আর ঘনিষ্ঠতার একেবারে প্রথম পর্যায় থেকেই। সেটাই যে স্বাভাবিক তা আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি। সন্দেহটা আরও জোর পায়, যুগলকে এই ট্র্যাভল স্টারেই চাকরি করে দেবার জন্যে যখন ধনঞ্জয় মিত্রের কাছে আপনি আবদার জানান। চাকরিটা ধনঞ্জয় মিত্র করে দিয়েছিলেন ঠিকই, আর তার দু’বছর বাদে নাইন্টিসিক্সে আপনাকে বিয়েও তিনি করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পরে আপনার একা-একা বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ করে দিয়েও তাঁর সন্দেহ গেল না কেন?”

শান্তিলতা বললেন, “কেন গেল না, সেটাই তো আশ্চর্যের ব্যাপার।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা-ই কি? আমার কিন্তু খুব আশ্চর্য ঠেকছে না।”

“কেন?”

এইজন্যে যে, কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হলে যে বাইরে বেরুতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। ওটা বাইরে না-বেরিয়েও দিব্যি রাখা যায়। চিঠিপত্তর দেওয়া-নেওয়া করে রাখা যায়, তা ছাড়া হাতের কাছে একটা টেলিফোন তো ছিলই, যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে ওটার কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন? …মিসেস মিত্র, বিয়ের পরে ওই যে আপনার বাইরে বেরুনো বন্ধ হয়ে গেল, তারপরে আর যুগলকে আপনি কোনও চিঠিপত্তর লেখেননি? কিংবা যুগল আপনাকে?

প্রশ্নটা করামাত্র শান্তিলতার ভুরু ধনুকের মতো বেঁকে গেল। তীব্র চোখে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “ইউ মিন লাভ-লেটার্স?”

ভেবেছিলুম এই পাল্টা-প্রশ্নে ভাদুড়িমশাই অস্বস্তিতে পড়ে যাবেন। পড়লেন না। নির্বিকার মুখে বললেন, “যদি তা-ই মিন করে থাকি?”

“তা হলে আমি আগেই যা বলেছি, তা-ই আর-একবার বলব। মিঃ ভাদুড়ি, যুগলের বয়েসের কথাটা ভুলে যাবেন না। ও আমার চেয়ে আট বছরের ছোট। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা প্রেমের নয়, লাভ-লেটার লেখার কোনও প্রশ্নই তাই উঠছে না।”

“দুঃখিত। অন্য-কোনও চিঠি? …চুপ করে রইলেন কেন? তাও লেখেননি?”

“লিখেছিলুম। নেহাত মামুলি চিঠি। …এই মানে ট্র্যাভল-স্টারে যাদের সঙ্গে কাজ করতুম….তা নেহাত কম দিন তো ওখানে কাজ করিনি… তারা কে কেমন আছে, যুগলের নিজেরই বা খবর কী, টিভিতে কিংবা রেডিয়োয় সে এর মধ্যে কোনও প্রোগ্রাম করেছে কি না, এইসব। …একখানা নয়, দুখানা চিঠি।”

“উত্তর পেয়েছিলেন?”

“একখানারও না।” শান্তিলতা বললেন, “অবশ্য পাবই বা কী করে? চিঠি পেলে তবে তো সে তার উত্তর লিখবে। কোনও চিঠিই সে পায়নি।”

“চিঠি কি আপনি নিজে পোস্ট করেছিলেন?”

“কী করে করব? আমি কি বাড়ি থেকে বেরুতে পারতুম? দু’বারই কাজের লোকদের কারও-না-কারও হাতে দিয়ে বলেছিলুম, সে যেন রাস্তার ধারের কোনও ডাকবাক্সে ফেলে দেয়।”

‘সে যে ফেলেনি তা তো বোঝাই যাচ্ছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিজের ইচ্ছেয় ফেলেনি, তা নয়, সে তার মনিবের হুকুম তালিম করেছে মাত্র। নিশ্চয় তাকে বলে রাখা হয়েছিল যে, মালকিন তাকে কোনও চিঠি দিলে সেটা যেন সে ডাকবাক্সে না-ফেলে মালিকের হাতে তুলে দেয়। …যা-ই হোক, যুগলের কাছে আপনার দুখানা চিঠির কোনওটাই যে পৌঁছয়নি, এটা আপনি কবে জানলেন?”

“থিয়েটার রোডের বাড়ি ছেড়ে তো আমি বেরিয়ে এসেছি। বেরিয়ে আসার পরে জানলুম। যুগলের কাছেই জানলুম।”

“ও-বাড়িতে থাকতে যুগলের সঙ্গে আপনার ফোনেও কথা হয়নি কখনও?”

“থিয়েটার রোডের বাড়ি থেকে সরাসরি ফোন করাও যায় না, ধরাও যায় না।” শান্তিলতা বিষণ্ণ হেসে বললেন, “সবই হয় পিবিএক্সের মাধ্যমে। সেখানে চব্বিশ ঘণ্টাই কেউ-না-কেউ ডিউটিতে থাকে। বাইরে থেকে আপনার কোনও কল এলে সে-ই আপনার দোতলার লাইনে সেটা দিয়ে দেবে। তার আগে অবশ্য আপনার লাইনে রিং করে জেনে নেবে যে, অমুক লোক আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান, তাঁর কলটা আপনি রিসিভ করবেন কি না।”

“বাইরে থেকে অমন কোনও কল আপনার কখনও আসেনি?”

“না, আসেনি। কিংবা হয়তো এসেছিল, কিন্তু পিবিএক্স থেকে তা আমাকে দেওয়া হয়নি। সেও হয়তো দেওয়া হয়নি আমার স্বামীরই হুকুমে।”

“ওরেব্বাবা,” কৌশিক বলল, “এ কি বাড়ি, না হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প?”

সদানন্দবাবু বললেন, “আপনাকে একেবারে হাজতে পুরে ফেলেছিল দেকচি! এ তো ভাবাই যায় না!”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কল তো রিসিভ করতে পারতেন না, নিজে কল করতে পারতেন?”

“সেও করতে হত গ্লু পিবিএক্স।” শান্তিলতা বললেন, “কিন্তু মজা কী জানেন, যতবার বাইরে কাউকে কল করার চেষ্টা করেছি, পিবিএক্স থেতে ততবারই আমাকে বলা হয়েছে যে, যে-লাইন আমি চাইছি সেটা টেম্পোরারিলি ডিসকানেক্টেড, নয়তো এনগেজড, নয়তো আউট অব অর্ডার, নয়তো রিং করে যাচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। প্রতিবার এই একই কাণ্ড হত।”

“এটাও আপনার স্বামীর নির্দেশেই হত। ভদ্রলোক চাইতেন না যে, বাইরের কারও সঙ্গে আপনি কথা বলুন, কিংবা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আপনার নিজস্ব কোনও সম্পর্ক থাক। যেখানে তিনি কিংবা তাঁর বাড়ির লোকেরা আপনাকে নিয়ে যাবেন, একমাত্র সেখানেই আপনার যাওয়া চলবে, আর হ্যাঁ, কথাবার্তা বলা আর সম্পর্ক রাখাও চলবে একেবারে ধরাবাঁধা গুটিকয় লোকের সঙ্গে। …বাই দ্য ওয়ে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, ধনঞ্জয় মিত্রের বাড়িতে কি ফোনের কোনও ডিরেক্ট লাইন নেই? মানে একেবারে সরাসরি…উইদাউট হ্যাভিং টু গো থ্রু দ্য পিবিএক্স…কারও সঙ্গে বাইরের কেউ কথা বলতে পারে না?”

“তা কেন পারবে না?” শান্তিলতা বললেন, “আমার স্বামীর সেলফোন আছে, পুরন্দরের আছে, ইন্দিরারও আছে। তাঁরা সরাসরি বাইরের লাইনের সঙ্গে কথা বলেন।”

“আপনার নেই?”

“ছিল। ট্র্যাভল স্টারে কাজ করতুম না? সেখান থেকে পাওয়া। চাকরি ছাড়ার সময় সেটা কোম্পানিকে ফেরত দিয়ে এসেছি।”

“তারপর থেকে আর নেই?”

“ছিল না। এখন আবার আছে। থিয়েটার রোডের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর প্রথমেই যে ক’টা জিনিস কিনি, তার একটা এই সেলফোন।”

শান্তিলতা তাঁর হ্যান্ডব্যাগ খুলে সেলফোনটা বার করে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন। ভাদুড়িমশাই সেটা কৌশিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “নম্বরটা টুকে রাখ।” কৌশিক তার নোটবুকে নম্বর টুকে রেখে যন্ত্রটা আবার শান্তিলতাকে ফিরিয়ে দিল।

“প্রায় পাঁচ বছর আমি স্বামীর ঘর করেছি।” শান্তিলতা বললেন, “তার মধ্যে না হোক তো পাঁচশো বার বলেছি আমাকে একটা সেলফোন দিতে। দেননি। সারাক্ষণ সন্দেহ যে, এই বুঝি আমি বাইরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করব। ভাবা যায়? মিঃ ভাদুড়ি, আমার পাগল-পাগল লাগত! ভয় হত যে, সত্যি আমি পাগল হয়ে যায়। এত সন্দেহ! এর মধ্যে থাকা যায়? শেষপর্যন্ত আমি আর পারলুম না, আমাকে ওবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হল। অথচ তাতেই বা রেহাই পেলুম কই। ওঁর সন্দেহ এখনও আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এমন যে হবে, তা কিন্তু আপনার বোঝা উচিত ছিল। এটা নতুন-কিছু নয়, সন্দেহ উনি বিয়ের আগে থেকেই করছেন। পরে সেটা আরও বেড়েছে মাত্র।”

“কেন বাড়ল, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। এ পর্যন্ত যা বললুম, তাতে কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছেন?”

“কারণ তো নানা রকমই হতে পারে। কিন্তু সেটা আপনারই জানার কথা। আমরা বাইরের লোক, স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক কখন কী কারণে কোন পথে মোড় নেয়, তা আমরা কীভাবে জানব? অনুমান হয়তো করতে পারি, কিন্তু সেটাই যে সঠিক, তা-ই বা বলতে পারছি কই?”

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “একটা প্রশ্ন করছি। খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দেবেন। প্রশ্নটা আপনার অতীত জীবন সম্পর্কে। মানে ধনঞ্জয় মিত্রের সঙ্গে যখন আপনার বিয়ে তো হয়ইনি, এমন কী পরিচয় পর্যন্ত হয়নি, সেই তখনকার জীবন সম্পর্কে।”

শান্তিলতা বললেন, “বেশ, করুন।”

মিঃ মিত্রের সঙ্গে যখন বিয়ে হয়, আপনার বয়েস তখন পঁয়তিরিশ। আমি ধরে নিচ্ছি, তার বছরখানেক আগে আপনাদের পরিচয় হয়। ভুল বলছি?”

“না, ঠিকই বলছেন, আমাদের পরিচয় হয় নাইন্টিফাইভের মার্চে।”

“তখন আপনার চৌত্রিশ চলছে, কেমন?”

“রাইট।”

“কিন্তু চৌত্রিশও তো খুব কম বয়েস নয়। বিয়ে নাহয় না-ই করলেন, অনেক মেয়েই আজকাল ওই বয়েস পর্যন্ত অবিবাহিত থাকেন। এস্পেশালি যাঁদের ভাবনাচিন্তা একটু কেরিয়ার-ওরিয়েন্টেড, মানে বিয়েটাকে যাঁরা চাকরিতে উন্নতির পথে একটা বাধা বলে ভাবেন, তাঁরা তো থাকেনই। তো তা আমি জানি, আর তা নিয়ে কোনও প্রশ্নও তাই করছি না। আমি ভাবছি, বিয়ে না-করলেই যে কারও সঙ্গে কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠবে না, তার তো কোনও মানে নেই। তাই…ইফ ইউ ডু নট মাইন্ড…আমি জানতে চাইব, চৌত্রিশ বছর বয়েস পর্যন্ত কি সত্যিই কারও সঙ্গে তেমন কোনও সম্পর্ক আপনার গড়ে ওঠেনি?”

মুখ নিচু করে সব শুনছিলেন শান্তিলতা। একেবারে হঠাৎই তিনি মুখ তুললেন এই প্রশ্ন শুনে। তীব্র চোখে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওহ গড়, আপনি কি এখনও সেই যুগলের কথাই ভেবে যাচ্ছেন?”

“না, আমি যুগলের কথা ভাবছি না!” একটুও বিচলিত না-হয়ে সেই একই রকমের নির্বিকার শান্ত গলায় ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি-বলেছেন যুগল আপনার ম্যান ফ্রাইডে, অ্যান্ড আই বিলিভ ইউ, আমি ধরে নিচ্ছি যে, সেটাই সত্যি কথা। কিন্তু মিসেস মিত্র, যুগলই তো একমাত্র পুরুষ নয়, সে ছাড়াও তো বিস্তর পুরুষের ক্লোজ টাচে আপনাকে আসতে হয়েছে, তো আপনার চৌত্রিশ বছর বয়েসের মধ্যে তাদের কেউ কি একটা চিঠি পর্যন্ত আপনাকে লেখেনি?”

“তা তো লিখতেই পারে, তাতে কী হল?”

“প্রশ্ন না করে জবাব দিন। আপনিও লিখেছেন?”

“না-লেখার কী আছে। আর তা ছাড়া সে তো অনেক আগের কথা। মিঃ মিত্রের সঙ্গে তখন আমার পরিচয় পর্যন্ত হয়নি। পরিচয় হবার পরে যে কারও সঙ্গে আমি কোনও সম্পর্ক রাখিনি, সেটাই তো আসল কথা। তার আগে যদি কেউ আমাকে চিঠি লিখে থাকে কি আমি চিঠি লিখে থাকি কাউকে, তো সেটাই আপনি একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার বলবেন নাকি?”

“মোটেই না।” ভাদুড়িমশাই হোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “বরং তাকেই আমি সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করব। ইন ফ্যাক্‌ট্ তা-ই আমি মনে করছি। তবে একইসঙ্গে যে একটু চিন্তায় পড়ে যাচ্ছি, তাও ঠিক।”

“চিন্তা কেন?”

“ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলেই চিন্তা।”

“তার মানে?”

“বুঝতে পারছেন না, কেমন?”

সদানন্দবাবু বললেন, “আমিও কিন্তু বুঝতে পারচি না। যাকে আপনি সবচেয়ে স্বাভাবিক…. ওটা মশাই আপনারই কথা…সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করেন, তা নিয়ে চিন্তার কী আচে?”

কৌশিক মৃদু-মৃদু হাসছিল। তার দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোর হাসি দেখে মনে হচ্ছে, এঁরা না বুঝলেও তুই অন্তত বুঝতে পেরেছিস।”

“বোধহয় পেরেছি।” কৌশিক বলল, “কী বুঝেছি, বলব?”

“থাক, তোকে কিছু বলতে হবে না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা স্বাভাবিক ব্যাপার নিয়ে আমার অত চিন্তা কেন, আমিই সেটা বুঝিয়ে বলছি। বিয়ের আগে…এমনকী হবু-স্বামীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ারও আগে কোন মেয়ের সঙ্গে কার চিঠিপত্তর লেখালিখি হয়েছিল, সেটা কোনও বুদ্ধিমান লোকেরই ভাবনার বিষয় হতে পারে না। ধনঞ্জয় মিত্রকেও বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। অত বড় একটা ব্যাবসা যিনি চালাচ্ছেন, ইন ফ্যাক্‌ট খুবই সাকসেসফুলি চালাচ্ছেন, এত-এত লোক চরিয়ে খাচ্ছেন, ধরেই নেওয়া যায়, তাঁর বুদ্ধি খুবই টনটনে। সুতরাং…”

ভাদুড়িমশাইকে থেমে যেতে দেখে আমি বললুম, “সুতরাং কী?”

“সুতরাং, ওই চিঠি-লেখালিখির ব্যাপারটা যদি তিনি জানতে পারেন, তা হলে তিনি আদৌ বিচলিত হবেন না, বরং আমাদেরই মতো তিনিও এটাকে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলে ভাববেন। তিনি বিচলিত হতে পারতেন, যদি দেখতেন যে, চিঠি লেখালিখির ব্যাপারটা শেষ হয়ে যায়নি, সেটা বিয়ের পরেও চলেছে।”

“সে-প্রশ্ন তো উঠছেই না।” শান্তিলতা বললেন, “সেই নাইন্টিফাইভের মার্চ থেকেই…আই মিন মিঃ মিত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় একটু ঘনিষ্ঠ হবার পর থেকেই আমি কল্যাণকে চিঠি লেখা বন্ধ করে দিই, তাকেও ফোন করে জানিয়ে দিই যে, সে যেন আমাকে আর চিঠি না লেখে। কল্যাণও তার পরে আর আমাকে কোনও চিঠি লেখেনি। সে কথা দিয়েছিল আমাকে আর চিঠি লিখে জ্বালাবে না, অ্যান্ড হি কে হিজ প্রমিস।”

“কল্যাণ কে?”

“কল্যাণ রায়। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ছোটখাটো একটা ব্যাবসা করত। ব্যাবসার কাজে মাঝেমধ্যে ব্যাংককে, কুয়ালালামপুরে কি সিঙ্গাপুরে যেত।”

“টিকিট, ভিসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিতেন আপনারাই?”

“হ্যাঁ, সেই সূত্রেই ট্র্যাঙ্ক-স্টারে আসত। কল্যাণের সঙ্গে সেখানেই আমার পরিচয়।”

“ম্যারেড?”

প্রশ্নটা একেবারে আচমকা আসায় শান্তিলতা একটু হকচকিয়ে গেসলেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “কার কথা জিজ্ঞেস করছেন?”

“কল্যাণ রায়ের কথা। উনি কি বিবাহিত?”

“হ্যাঁ।” মাথা নিচু করে শান্তিলতা বললেন, “কিন্তু যখন পরিচয় হয়, তখন তা আমি জানতুম না। জানতে পারি বছর দুয়েক বাদে। ওই নাইন্টিফাইভেরই গোড়ার দিকে।”

“কী করে জানলেন?”

“ওর স্ত্রী আমাদের অফিসে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। সঙ্গে একখানা চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। আমারই চিঠি। কল্যাণকে লেখা। …ওহ্, দ্যাট ওয়জ হরিল!”

সদানন্দবাবু বললেন, “এসে খুব কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলেন বুঝি?”

“কান্নাকাটি নয়, হট্টগোল!” শান্তিলতা বললেন, “সঙ্গে মাস্তান-টাইপের দুটো লোককে নিয়ে এসেছিলেন। বললেন, তাঁর ভাই। তারা তো আস্তিন গুটিয়ে আমাকে এই মারে তো সেই মারে! চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে লোকজন ছুটে এল। তাদের সামনেই তিনি আমাকে চার্জ করে বললেন যে, তাঁর সংসারটা আমি ভেঙে দিতে চাইছি।”

“তার পরেই আপনি কল্যাণের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক শেষ করে দেন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “চিঠি-লেখালিখিরও সেইখানেই ইতি। কেমন?”

“হ্যাঁ।”

“তা হলে তো সব মিটেই গেল। যা বললেন, সবই তো আপনার বিয়ের আগেকার ব্যাপার। আর ধনঞ্জয় মিত্র যেহেতু বুদ্ধিমান মানুষ, তাই আমি ধরেই নিচ্ছি চৌত্রিশ বছরের একটি মেয়ের জীবনে যে এমন দু’-চারটে অ্যাফেয়ার থাকা খুবই স্বাভাবিক, এটা তাঁর হিসেবের মধ্যেই ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, বিয়ের পরে তার জের টানা হয়েছিল কি না। আপনি বলছেন, টানা হয়নি। আপনিও টানেননি, কল্যাণ রায়ও টানেননি। অ্যান্ড আই রিপিট, আই ট্রাস্ট মাই ক্লায়েন্টস। ব্যাপারটা তা হলে শেষমেশ এই দাঁড়াচ্ছে যে, আপনাকে অন্তত এই ব্যাপারে সন্দেহ করার কোনও কারণই আপনার স্বামীর নেই।”

শান্তিলতা আবার ঈষৎ অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে তাঁর কাঁধ ঝাঁকালেন। বললেন, “আপনার কথা বিশ্বাস করতে পারলে আমি খুশি হতুম। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি কোথায়। মিঃ ভাদুড়ি, সন্দেহ যদি তিনি না-ই করবেন তো আজও আমার পিছনে তিনি লোক লাগিয়ে রেখেছেন কেন? কেনই বা তাদের নজর এড়িয়ে আমি কোথাও যেতে পারছি না? আমার পিছু নিয়ে তারা এখানে এসেছে। আবার যে-মুহূর্তে আপনার এখান থেকে বেরিয়ে আমার মাতিজ আমি স্টার্ট করব, তখুনি সাইড-গ্ল্যাসে চোখ রেখে দেখতে পাব যে, সাদা ওই অ্যাম্বাসাডরটাও আমার পিছু-পিছু আসছে। না, মিঃ ভাদুড়ি, তাঁর সন্দেহ যায়নি।”

ভাদুড়িমশাই সঙ্গে-সঙ্গে কিছু বললেন না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সামান্য হেসে বললেন, “আপনি বোধহয় আমার কথাটা ঠিকমতো শুনতে পাননি। আমি তো এমন কথা বলিনি যে, আপনার স্বামী তাঁর তাবৎ সন্দেহ থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন।”

“তা হলে আপনি কী বললেন?”

“বললুম যে, আপনাকে অন্তত এই ব্যাপারে সন্দেহ করার কোনও কারণই তাঁর নেই। আপনি বোধহয় ‘এই ব্যাপারে’ কথাটা শুনতে পাননি।”

“তার মানে এই ব্যাপারে…আই মিন যুগল কিংবা কল্যাণ কিংবা অন্য কোনও পুরুষকে নিয়ে সন্দেহ না-করলেও অন্য-কোনও ব্যাপারে তাঁর সন্দেহ এখনও রয়েছে?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার তো সেইরকমই মনে হয়। কিন্তু সেটা কী হতে পারে? টাকাপয়সা? গয়নাগাটি? জমিজমা? প্রপার্টি? …বাই দ্য ওয়ে, ব্যাংকে যে টাকাটা আপনার স্বামী আপনার নামে ডিপজিট করে দিয়েছিলেন, তার থেকে কি বড় কোনও অ্যামাউন্ট আপনি ইতিমধ্যে তুলে নিয়েছেন? কিংবা চেক কেটে ট্রান্সফার করেছেন অন্য কারও অ্যাকাউন্টে?”

“না তো। অন্যের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করার তো কোনও প্রশ্নই উঠছে না, নিজের দরকারেও সেই পঁচিশ লাখ টাকার একটা পয়সাও আমি তুলিনি। তোলার দরকারও হয়নি। পরে যদি দরকার হয় তো তুলব ঠিকই, তবে ওটা ছাড়াও তো আমার নিজের কিছু পয়সাকড়ি আছে, আপাতত তা-ই দিয়েই মোটামুটি চালিয়ে নিচ্ছি।”

“গয়নাগাটি?”

“আমার নিজের কিছু ছিল। এই যা পরে আছি, এ ছাড়া অল্প-কিছু। উনি অবশ্য বিয়ের পরে প্রচুর দিয়েছেন। কিন্তু সে-সব তো আমি ব্যবহার করি না।”

“সেগুলি কোথায় থাকে?”

“বেশিরভাগই থাকে বাড়ির ভল্টে। তবে মাঝেমধ্যে ব্যবহার করার দরকার হতে পারে তো, তাই আমাদের শোবার ঘরের আলমারিতেও অল্প-কিছু থাকে।”

“বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় তার কিছুই আপনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেননি?”

“না, আনার কোনও ইচ্ছেই হয়নি।” শান্তিলতা ম্লান হেসে বললেন, “অবশ্য ইচ্ছে হলেই যে আনতে পারতুম, তাও নয়। ভল্টের চাবি তো আমার স্বামীর কাছে থাকে। বাকি রইল ঘরের আলমারিতে রাখা গয়না। তাও আনিনি। আলমারির চাবিটাও না। অল্প-কিছু জামাকাপড় বার করে সুটকেস গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আগে চাবির তোড়া আমার স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে এসেছি।”

“বিয়ের শর্ত হিসেবে কলকাতা কি অন্য কোনও জায়গায় কোনও ল্যান্ডেড প্রপার্টি কি ম্যাক্রো বিল্ডার্সের কোনও অংশ কি আপনি ওঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন?”

“না। কেনই বা লিখিয়ে নেব? ওঁর কাছ থেকে কী পেয়েছি আপনি জানেন। পঁচিশ লাখ টাকা, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে একটা ফ্ল্যাট আর ওই মাতিজ গাড়িটা। তা সে কিছু কম হল? এর বেশি আমার দরকার নেই, চাইও না।”

“তা হলে উনি আপনাকে সন্দেহ করছেন কেন?” প্রায় আত্মমগ্নভাবে, যেন নিজেকে শুনিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “প্রেম-ট্রেম নিয়ে যে এখন আর সন্দেহ করছেন না, করার কোনও কারণ নেই বলেই সন্দেহ করছেন না, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। অথচ সন্দেহ যে করছেন, তাও তো ঠিক। নইলে উনি নিজেরই স্ত্রীর পিছনে চব্বিশ ঘণ্টা এইভাবে লোক লাগিয়ে রাখতেন না। তা হলে কী নিয়ে সন্দেহ করছেন? টাকা নিয়ে? কিন্তু উনি প্রভাবশালী লোক, যে-ব্যাংকে উনি আপনার নামে আকাউন্ট খুলে পঁচিশ লাখ টাকা জমা রেখেছেন, সেটা আপনি তোলেননি কিংবা ট্রান্সফারও করেননি, সে তো উনি ইচ্ছে করলেই জেনে যেতে পারেন, এতক্ষণে নিশ্চয় জেনেও গিয়েছেন। তা হলে? বাকি রইল গয়নাগাটি। কিন্তু তাও তো রয়েছে ওঁরই হেফাজতে। কোনও প্রপার্টি কি ব্যাবসার অংশও তো আপনাকে উনি লিখে দেননি। তবে? সন্দেহটা তবে কী নিয়ে?

বুঝতে পারছিলুম, ভাদুড়িমশাই একটা ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছেন। ধাঁধা মানে গোলকধাঁধা। যা থেকে বেরুবার রাস্তাটা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর চোখেমুখে এমন একটা ক্লান্তি ও অসহায়তার ছাপ ক্রমশ ফুটে উঠছিল, যা আমি আগে কখনও দেখিনি। সমস্যা যা-ই হোক না কেন, সব সময়েই তিনি চটপটে ও সপ্রতিভ। অঙ্ক যতই জটিল হোক, তার মর্মমূলে পৌঁছতে তো এত সময় তিনি নেন না। অথচ, আজ তিনি শুধু একটার পর একটা প্রশ্নই করে যাচ্ছেন।

এখন অবশ্য প্রশ্নও আর করছেন না। আত্মমগ্নভাবে কথা বলতে-বলতেই এক সময়ে চুপ করে গেছেন। আমরাও কেউ কিছু বলছি না। ঘর একেবারে স্তব্ধ।

হঠাৎই সেই স্তব্ধতাকে ভেঙে ভাদুড়িমশাই বললেন, “অনেক রাত হয়ে গেল। প্রায় দশটা বাজে। মিসেস মিত্র, আজ আপনি বাড়ি যান। আমি একটু ভাবি। ইতিমধ্যে একটা কথা বলি আপনাকে। কাল আপনার মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ দেখেছিলুম। সেটা আজও দেখছি। কিন্তু না, ভয়ের কিছু নেই। যদি কিছু হয়ও, তো এখুনি সেটা হবে না। আর তা ছাড়া আমি তো আছিই। আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব।”

শান্তিলতা উঠে পড়লেন। কৌশিক ওঁকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে গেল। ফিরেও এল একটু বাদেই। ফিরে এসে বলল, “সাদা অ্যাম্বাসাডরটা ওঁর পিছু ছাড়েনি। আমাদের গাড়িটাও অবশ্য সঙ্গে-সঙ্গে লেগে আছে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দুটো লোক এখন কোথায় আছে, কী করছে, জানা দরকার। যুগল চৌধুরি আর কল্যাণ রায়। কাল সকালেই কাজে লেগে যা।”

“ওদের ঠিকানা কোথায় পাব?”

“যুগল পারফর্মিং আর্টিস্ট। ভায়োলিন বাজায়। তার এখনকার ঠিকানা রেডিয়ো কিংবা টিভিতে পাবি। আর কল্যাণের ঠিকানা পাবি ট্র্যাঙ্ক স্টারে। কল্যাণ তাদের পুরনো ক্লায়েন্ট।”