৩
শান্তিলতা মিত্র আজ অন্য পোশাকে এসেছেন। পরনে হাতকাটা কামিজ, শালোয়ার, দোপাট্টা। দু’কানের লতিতে দু’ফোঁটা রক্তের মতো দুটি লাল পাথর। বাঁ হাতে ঘড়ি, ডান হাতে সরু দু’গাছা চুড়ি। সিঁথিতে কালকেও সিঁদুর ছিল না, আজও নেই। সদানন্দবাবুও আমাকে দেখে সামান্য হেসে, ভাদুড়িমশাইকে নমস্কার করলেন, তারপর অরুণ সান্যাল ও কৌশিকের দিকে যেভাবে তাকালেন, তাতে মনে হল, এঁদের সামনে কিছু বলা ঠিক হবে কি না, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এঁরা আমার ভগ্নিপতি ডক্টর অরুণ সান্যাল আর ভাগ্নে কৌশিক। আপনার যা কিছু বলার, এঁদের সামনে স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। ইন ফ্যাক্ট; কৌশিকের তো সব শোনাই দরকার। ও যেমন আমার আত্মীয়, তেমন সহকারীও বটে। ইনভেস্টিগেশনের ব্যাপারে প্রতি পদে আমাকে ওর উপরে নির্ভর করতে হয়।”
শান্তিলতা ইতিমধ্যে একটা সোফায় বসে পড়েছিলেন। সেখান থেকেই অরুণ সান্যাল ও কৌশিকের দিকে তাকিয়ে নমস্কারের একটা সংক্ষিপ্ত ভঙ্গি করলেন, তারপর ভাদুড়িমশাইকে বললেন, “আপনি ঠিকই ধরেছেন, সব কথা আমি কাল খুলে বলতে পারিনি, অত অল্প সময়ের মধ্যে, বিশেষ করে ওই পরিবেশে, সেটা সম্ভবও ছিল না। যা বলা হয়নি, এবারে সেটা বলতে চাই।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আগে বলুন, এখন আপনি কোত্থেকে আসছেন আর এলেনই বা কীসে?”
“আসছি উড স্ট্রিটের একটা বিউটি পার্লার থেকে। নিজেরই গাড়িতে আসছি। সেটা চালাইও আমি নিজেই।”
কৌশিক ইতিমধ্যে ঘর থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে বলল, “পরপর তিনটে গাড়ি। প্রথমটা একটা হলদে মাতিজ। তার ফুট কুড়ি পিছনে একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর। তারও ফুট তিরিশেক পিছনে একটা কালো মারুতি এইট হানড্রেড।”
শান্তিলতা বললেন, “হলদে মাতিজটা আমার। আর সাদা অ্যাম্বাসাডরটাই গত ক’দিন ধরে আমাকে ফলো করে যাচ্ছে।”
“আর সেটাকে ফলো করছে সি. বি. আই.-এর কালো মারুতি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ওটা আমাদের কলকাতা আপিসের গাড়ি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, মিসেস মিত্র, আপনাকে প্রোটেকশান দেবার ব্যাপারে কোনও গলতি রাখা হয়নি। …হ্যাঁ রে কৌশিক, ওটা চালায় কারা?”
“আলতাফ আর দীনবন্ধু। একজন দিনে, একজন রাত্তিরে। বাই রোটেশন। দুজনেই পাকা লোক।”
“একটা কথা বুঝতে পারছি না,” শান্তিলতা উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “এর মধ্যে সি. বি. আই. আসছে কোত্থেকে?”
অরুণ সান্যাল হেসে বললেন, “এটা অন্য সি. বি. আই.। সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনস নয়, চারু ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশনসের অ্যাক্রোনিম।”
আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে মালতী ঘরে ঢুকল। তারপর সকলের উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে শান্তিলতার দিকে তাকিয়ে বলল, “এঁদের চা খাওয়া হয়ে গেছে। আপনাকে কী দেব? চা, না কফি?”
“কোনওটাই না।” শান্তিলতা বললেন, “জাস্ট এক গেলাস জল।”
মালতী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার বোন। এটা ওরই ফ্ল্যাট, কলকাতায় এলে আমি এখানেই উঠি। ভাগ্নেটি অবশ্য আমার সঙ্গে বাঙ্গালোরে থাকে। ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছে।”
কাজের মেয়েটি ঘরে ঢুকে শান্তিলতার সোফার পাশের সাইড-টেবিলে এক জগ জল আর একটা গেলাশ রেখে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শান্তিলতা জগ থেকে গেলাশে জল ঢেলে পুরো জলটাই খেয়ে নিলেন। তারপর হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছে বললেন, “বড্ড তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এবারে বলুন আপনার সমস্যাটা কী। সত্যিই কেন আপনার মনে হচ্ছে যে, আপনার স্বামী আপনাকে খুন করতে চান। কাল রাত্তিরে যা বলেছেন, সেটা আসল কারণ নয়।”
শান্তিলতা বললেন, “আপনি তা-ই মনে করেন?”
“যে-কোনও বুদ্ধিমান লোকই করবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি যা বলেছিলেন, তাতে অন্তত ভাবা চলে না যে, এক্ষুনি তিনি আপনাকে খুন করে ফেলবেন। ব্যাপারটা আপনি নিজেই একবার ভেবে দেখুন।”
“কী ভাবব?”
“আপনার স্বামী এ পর্যন্ত যা করেছেন, তা অস্বাভাবিক কি না। অল্পবয়েসি স্ত্রী, তার একটি অল্পবয়েসি বন্ধু রয়েছে, তাদের মেলামেশা দেখাসাক্ষাতেরও কামাই নেই, কে জানে তারা কোথায় বসে কী শলা-পরামর্শ করছে,—যে-কোনও স্বামীকে সন্দিগ্ধ করে তোলার পক্ষে স্রেফ এইটুকুই তো যথেষ্ট। সন্ধিগ্ধ তিনি হতেই পারেন, আর হাত বাড়ালেই আজকাল যখন ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্য পাওয়া যায় আর তাঁরও যখন পয়সাকড়ির অভাব নেই, তখন স্ত্রীর গতিবিধির উপরে নজর রাখার জন্যে পয়সা ফেলে একটা টিকটিকি তো তিনি লাগিয়ে দিতেই পারেন। না, মিসেস মিত্র, আমি এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না।”
কৌশিক বলল, “ইন ফ্যাক্ট, আমাদের প্রাইভেট গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর যা টোটাল বিজনেস, তার একটা মস্ত অংশ তো আসছে এর থেকেই। এইসব কাজে টিকটিকি ভাড়া দিয়েই তো তারা যা-হোক কিছু পয়সা কামাচ্ছে, নইলে তাদের অনেকেরই বোধহয় ভাত জুটত না।”
আলোচনার বিষয়বস্তু সম্ভবত অস্বস্তিকর মনে হচ্ছিল, অরুণ সান্যাল তাই মেডিক্যাল জার্নালখানা হাতে নিয়ে ‘আমার ওষুধ খাওয়ার সময় হল, আমি একটু পাশের ঘরে যাচ্ছি’ বলে সোফা থেকে উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
সদানন্দবাবু বললেন, “বাপ রে বাপ, এ কী কাণ্ড! হাজব্যান্ড তার ওয়াইফের পেছনে টিকটিকি লাগিয়ে দিচ্চে! এত সন্দেহবাতিক, এত অবিশ্বাস! আমাদের সময়ে কি এসব ছিল?
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সন্দেহবাতিকও ছিল, অবিশ্বাসও ছিল। তবে মহিলারা সেকালে বাড়ির বাইরে বিশেষ বেরুতেন না তো, তাই টিকটিকি লাগাবার কোনও দরকারও হত না। তাই বলে কি আর যাকে স্বাভাবিক সম্পর্ক ভাবছেন, কক্ষনো তার এদিক-ওদিক হত না নাকি? তাও হত। সন্দেহের আগুনও জ্বলত বই কী! তবে সেটা পারিবারিক চৌহদ্দির মধ্যেই থেকে যেত, বাইরে তার বিশেষ আঁচ পাওয়া যেত না।”
আমি বললুম, “তাও মাঝেমধ্যে পাওয়া যেত, মশাই। এসব নিয়ে কিছু-কিছু মামলা-মোকদ্দমাও তো সেকালে হয়েছে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “মূল কথায় ফেরা যাক। মিসেস মিত্র, একটা কথা আপনাকে গোড়াতেই জানিয়ে রাখা ভাল। আপনি আমার সাহায্য চাইছেন, সেটা আপনি পাবেন। কিন্তু আপনাকে কোনও স্তোকবাক্য আমি শোনাতে পারব না। যা আমার সত্য বলে মনে হয়, সেটাই আমি বলব।”
“বেশ তো,” শান্তিলতা বললেন, “তা-ই বলুন।”
“তা তো বললুমই। আপনার স্বামী যে আপনাকে সন্দেহ করেন, আর হ্যাঁ, আপনার গতিবিধির উপরে নজর রাখবার জন্যে এই যে তিনি লোক লাগিয়েছেন, এটাকে আমার খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয়। কিন্তু …”
এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর, শান্তিলতা যে কিছু বলতে যাচ্ছেন, সেটা বুঝতে পেরে, হাতের ইঙ্গিতে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “কিন্তু লোক লাগিয়েছেন বলেই যে তিনি আপনাকে খুন করতে চাইছেন, এমন কোনও ইঙ্গিত কিন্তু এর থেকে আমি পাচ্ছি না।”
“বাঃ, ওই যে তিনি আমাকে তাক করে একদিন একটা ফুলদানি ছুড়ে মেরেছিলেন, আর আরেক দিন একটা ভারী অ্যাশট্রে, সেটাই কি যথেষ্ট ইঙ্গিত নয়?”
“ওটা তো হঠাৎ রেগে গিয়ে একটা-কিছু করে ফেলার ব্যাপার, যা বাচ্চা-ছেলেরাও প্রায়ই করে, রেগে গিয়ে হাতের সামনে যা পায়, দুধের বাটি কি জলের গেলাশ, তা-ই ছুড়ে মারে। তাতে কেউ যে কখনও জখম হয় না, তাও নয়। কিন্তু তার মধ্যে মোটিভ কোথায়। একটা মোটিভ তো চাই।”
আমি বললুম, “সন্দেহটাই কি খুন করার একটা মস্ত মোটিভ নয়? তাতেও তো মাথায় খুন চেপে যেতে পারে। যায় না?”
“হঠাৎ রেগে গিয়ে খুন?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ওসব হয় সমাজের নীচের তলায়। সত্যি বলতে কী, মাথায় খুন চাপার জন্যে সেখানে সন্দেহেরও দরকার হয় না। রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্পের কথা ভাবুন।”
“দুখিরামের কথা বলছেন তো?”
“হ্যাঁ। খুনের কারণ তো তার সন্দেহ নয়। সারাদিন খাটাখাটুনি করে বাড়ি ফিরেছে, পেটে জ্বলছে খিদে। ভাত চাইতে বউ বলল, দুখিরাম তাকে চাল দিয়ে যায়নি, তাই ভাতও হয়নি, বউ কি নিজে রোজগার করে চাল আনবে? বাস, ওই একটা কথা। পেটের আগুন তাতেই মাথায় চড়ে যায়। খুন হয়ে যায় তার বউ।”
কৌশিক বলল, “ওটা তো গল্প।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “গল্প হলেও মিথ্যে নয়। রবীন্দ্রনাথ উপরতলার মানুষ ছিলেন ঠিকই, তবে নীচের তলার খোঁজখবরও তিনি ভালই রাখতেন। জানতেন যে, সেখানে আবেগের তাড়না বড় প্ৰবল। রেগে গিয়ে মানুষ সেখানে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করে বসতে পারে।”
“ওটা উপরতলায় হয় না?”
“একেবারেই হয় না, তা বলছি না, তবে কালেভদ্রে হয়। তার কারণ, তাদের কাণ্ডজ্ঞান টনটনে, তারা ভেবেচিন্তে এগোয়, রাগের মাথায় কি ঝোঁকের মাথায় দুম করে সেটা করে না।”
আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। কিছু ভেবে নিলেন। তারপর শান্তিলতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মিসেস মিত্র, আপনার স্বামী তো শুধুই উপরতলার মানুষ নন, অনেক-অনেক উপরতলার মানুষ। সমাজে ওঁর একটা প্রতিষ্ঠা আছে, নামডাক আছে। সবাই ওঁকে চেনে। উনি ওইরকম ফুলদানি কি অ্যাশট্রে ছুড়ে কাউকে খুন করবেন না। যদি করেন তো ঠাণ্ডা মাথায় এমনভাবে করবেন, যাতে সন্দেহটা সরাসরি ওঁর উপরে না পড়ে। আর হ্যাঁ, যাতে সরাসরি উনি একটা মার্ডার কেসে জড়িয়ে না যান। টু বি মোর প্রিসাইজ, উনি নিজে হাতে সেটা করবেন না।”
শান্তিলতা ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন, “সেইজন্যেই তো আমার পিছনে লোক লাগিয়েছেন। যাদের লাগিয়েছেন, তারা সুযোগ পেলেই আমাকে খুন করবে।”
“না মিসেস মিত্র,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তাতেও ওঁর নাম জড়িয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। কীভাবে জড়িয়ে যাবে শুনুন। আপনি যে আমার কাছে এসেছেন, এতক্ষণে আপনার স্বামীর সেটা জেনে যাবার কথা। উনি বুদ্ধিমান লোক, সুতরাং সহজেই বুঝে যাবেন যে, কোন এজেন্সির লোককে উনি আপনার পিছনে লাগিয়েছেন, একটু চেষ্টা করলেই আমি সেটা জানতে পারব। থু মাই নেটওয়ার্ক। ফলে, ওদের হাতে আপনি যদি খুন হন, তো ওরা কোন এজেন্সির হয়ে কাজ করছে, পুলিশকে সেটা জানিয়ে দিতে আমার এক মিনিটও সময় লাগবে না। অ্যান্ড দ্য লং হ্যান্ড অব জাসটিস উইল রিচ দ্যাট এজেন্সিজ ক্লায়েন্ট আলটিমেটলি। তাদের ক্লায়েন্ট…মানে আপনার স্বামী সেটা ভালই বোঝেন। সুতরাং আপনাকে খুন করার দায়িত্বটা অন্তত ওদের উনি দেননি। আদৌ কাউকে দিয়েছেন বলেও আমার মনে হয় না।”
“এ-কথা বলছেন কেন?”
“বলছি, তার কারণ, এ পর্যন্ত আপনার কাছে যেটুকু শুনেছি, তার মধ্যে আমি কোনও খুনের মোটিভ খুঁজে পাচ্ছি না। শুনেছি তো শুধুই সন্দেহের কথা। সন্দেহের বশেও অনেকে অবশ্য খুনখারাপি করে। কিন্তু আগেও বলেছি, এখনও বলছি যে, সেসব খুনখারাপি আপনাদের মহলে বড়-একটা হয় না। বিশেষ করে আপনার স্বামীর বয়েসের কথাটাও আমি ভাবছি।”
আমি বললুম, “বয়েসের কথা উঠছে কেন, ওটাও একটা ফ্যাক্টর?”
“অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর, যেটাকে আমাদের হিসেবের মধ্যে রাখতে হবে। …মিসেস মিত্র, আপনার স্বামীর নাম যেন কী বললেন?”
“ধনঞ্জয় মিত্র।”
“ও হ্যাঁ, ধনঞ্জয় মিত্র। এটা তাঁর সেকেন্ড ম্যারেজ।”
“হ্যাঁ।”
“আর আপনার?”
“প্রথম।”
“কিন্তু আপনার বয়েস তখন পঁয়তিরিশ। তা, এর আগে আপনার বিয়ে না-ই হয়ে থাক, ওই বয়েস পর্যন্ত কোনও পুরুষের প্রতি আপনি আকৃষ্ট হননি, আপনার স্বামীর পক্ষে তা কি ভাবা সম্ভব? বিশেষ করে আপনি যখন পর্দানশিনা নন, অন্দরমহলের চৌহদ্দি পেরিয়ে বাইরের জগতে কাজ করতে বেরিয়েছেন?”
“কিন্তু তিনি তো সব জেনেশুনেই আমাকে বিয়ে করেছিলেন।” শান্তিলতা বললেন, “তা হলে আর হঠাৎ এত সন্দেহের কী কারণ ঘটল?”
“আমিও তো ঠিক সেই কথাই ভাবছি। যখন আপনাকে বিয়ে করেন, ধনঞ্জয় মিত্রের বয়েস তখন ষাট। অর্থাৎ সাংসারিক ব্যাপারে তখন তিনি রীতিমত অভিজ্ঞ হিসেবি ও ঝানু একজন মানুষ। তিনি খুব ভালই জানতেন যে, যে-মেয়ে ঘরে বসে নেই, যে বাইরের জগতে বেরিয়ে এসেছে, আর হ্যাঁ, যার বয়েস পঁয়তিরিশ, বিস্তর পুরুষের সান্নিধ্যে তাকে আসতে হয়েছে, আর তাদের কারও-না-কারও সঙ্গে তার যদি একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ইতিমধ্যে গড়ে উঠে থাকে, তো তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, বরং সেটাই খুব স্বাভাবিক। তো একজন হিসেবি মানুষ এক্ষেত্রে কী চাইবেন?”
প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করে শান্তিলতা বললেন, “কী চাইবেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তিনি প্রথমেই চাইবেন যে, বিয়ের আগে যদি তেমন সম্পর্ক কারও সঙ্গে ঘটেই থাকে তো ঘটুক, কিন্তু বিয়ের পরে যেন সেটা আর না গড়ায়। সত্যিই যাতে না গড়ায়, তার জন্যে কী করবেন তিনি?”
শান্তিলতা আবারও সেই একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে বললেন, “কী করবেন?”
“তিনি প্রথমেই আপনার বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেবেন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মিসেস মিত্র, আপনার স্বামী ঠিক তা-ই করেছিলেন।”
“হ্যাঁ, তা-ই করেছিলেন। তাঁরই কথায় আমি চাকরি ছাড়ি। বাইরে তো যেতুম চাকরি করতে, চাকরি ছাড়ার ফলে বাইরে বেরুনোও বলতে গেলে বন্ধই হয়ে যায়। একেবারেই যে বেরুতুম না, তা নয়। মাঝেমধ্যে শপিং করতে বেরুতুম, সিনেমা কি থিয়েটারেও যেতুম।”
“কিন্তু একা বেরুতেন না, কেমন?”
“না, একা বেরুতুম না। বাড়ির গাড়িতে বেরুতুম, তখন কেউ-না-কেউ সঙ্গে থাকত।”
“কারা সঙ্গে থাকত?”
“হয় আমার স্বামী, আর নয়তো ইন্দিরা। …ও হ্যাঁ, বিয়ের পরে আমার ড্রাইভিং তো বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তাই একজন ড্রাইভারও থাকত।”
“ইন্দিরা কে?”
পুরন্দরের বউ। পুরন্দরের কথা তো আপনাকে বলেছি। আমার স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলে। থিয়েটার রোডের বাড়ির দোতলার একটা অংশে ওরা আলাদা থাকে। ওরা মানে পুরন্দর, ইন্দিরা আর ওদের ছেলে। তবে এসব কথা হয়তো কালই আপনাকে বলেছি। …আর-কিছু জানতে চান?”
“এ ব্যাপারে এখুনি আর-কিছু জানতে চাই না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে পরে হয়তো জানার দরকার হতে পারে। এখন একটু আগের কথায় ফিরি। আপনার স্বামী যে আপনার ট্র্যাভল স্টারের চাকরি ছাড়িয়ে দিলেন, তার কারণ হিসেবে তিনি কী বলেছিলেন?”
“বলেছিলেন যে, বউ চাকরি করবে এটা তাঁর পছন্দ নয়।”
“এটা কালই বলেছেন। আর কিছু বলেননি?”
“বলেছিলেন, লোকে চাকরি করে অভাবে। কিন্তু তাঁর তো কোনও কিছুরই অভাব নেই, তা হলে তাঁর বউ কেন চাকরি করবে? এটা ভাল দেখায় না। আমি চাকরি ছাড়লে যদি সেখানে একজন অভাবী লোকের কাজের সংস্থান হয়, তবে সেটাই তো ভাল।”
“আর-কিছু?”
একটু ভেবে নিয়ে শান্তিলতা হেসে বললেন, “ও হ্যাঁ, আমার চেহারা খারাপ হয়ে যেতে পারে বলে খুব ভয় দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাইরে ঘোরাঘুরি মানেই তো অস্বাস্থ্যকর এক্সপোজার। ওতে স্কিনের ক্ষতি হয়, ন্যাচারাল কমপ্লেকশনেরও বারোটা বেজে যায়।”
এবারে ভাদুড়িমশাইও হাসলেন। বললেন, “এ-সব কথার একটাও উড়িয়ে দেবার মতো নয়, মিসেস মিত্র। কিন্তু আসল কথাটা কী, সেটা আপনার বোঝা উচিত। সত্যিই যদি বিয়ের আগে কারও সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক গড়ে উঠে থাকে, তা হলে বিয়ের পরে সেটা যাতে আর না গড়ায়, তারই জন্যে তিনি একা-একা আপনার বাইরে বেরুনো বন্ধ করে দেন, তারই জন্যে আপনার চাকরি ছাড়ানো।
“কিন্তু এটা তো একেবারেই অকারণ সন্দেহের ব্যাপার, এর তো কোনও ভিত্তিই নেই।”
“আপনার কাছে অকারণ, আপনার কাছে ভিত্তিহীন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অ্যান্ড আই ট্রাস্ট মাই ক্লায়েন্টস। আমি ধরে নিচ্ছি যে, আপনি যা বলছেন, সেটাই ঠিক। কিন্তু কথা তো আপনাকে নিয়ে হচ্ছে না, হচ্ছে আপনার স্বামীকে নিয়ে। তাঁর দিক থেকে ব্যাপারটা দেখুন। দেখবেন, সুন্দরী, আর হ্যাঁ, অন্তত তাঁর তুলনায় খুবই অল্পবয়েসি স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর যে সন্দেহ, তাকে আদৌ অকারণ কিংবা অযৌক্তিক ঠেকছে না। বরং আপনারও মনে হবে যে, হ্যাঁ, এমন সন্দেহ তো ওই বয়েসের একজন স্বামীর হতেই পারে।”
এই পর্যন্ত বলে, প্রায় অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতন করে, একেবারে হঠাৎই একটা প্রশ্ন করে বসলেন ভাদুড়িমশাই। “ট্র্যাভল-স্টার কোম্পানিতে যুগল চৌধুরির চাকরিটা যে আপনার স্বামীর সুপারিশেই হয়েছিল, তা আপনি জানেন নিশ্চয়?”
প্রশ্ন শুনে আমি তো হকচকিয়ে গেসলুমই, শান্তিলতার মুখ দেখে মনে হল, তিনিও কিছু কম বিস্মিত হননি। খানিকক্ষণ তিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর অস্ফুট গলায় বললেন, “যুগল ওখানে কার সুপারিশে ঢুকেছিল, তা আমি কী করে জানব?”
“জানা উচিত। তার কারণ সুপারিশটা ধনঞ্জয় মিত্র করেছিলেন আপনারই অনুরোধে। মিঃ মিত্রের সঙ্গে তখনও অবশ্য আপনার বিয়ে হয়নি, এটা নাইন্টিফোরের অর্থাৎ আপনাদের বিয়ের দু’বছর আগের ব্যাপার, তবে বিয়ে না হলেও মিঃ মিত্রকে আপনি তখনও খুব ভালই চিনতেন।”
শান্তিলতা সেই অস্ফুট গলাতেই বললেন, “তাতে কী প্রমাণ হল?”
“এইটে প্রমাণ হল যে, যুগলের ব্যাপারে আপনি এরই মধ্যে একটা মিথ্যে কথা বলেছেন।”
“কী মিথ্যে কথা?”
“আপনি বলেছেন যে, ট্র্যাভল-স্টারের রবিনসন স্ট্রিটের হেড আপিসে আপনি কাজ করতেন, যুগল যেখানে নাইন্টিফোরে কাজে ঢোকে, আর যুগলের সঙ্গে সেখানেই আপনার পরিচয়। এই যে স্টেটমেন্ট, এর প্রথম অংশটা সত্যি, তবে দ্বিতীয় অংশটা নয়।”
বৈশাখ মাস। বিকেলে হঠাৎ ঝড় উঠেছিল। বৃষ্টি না-হলেও আবহাওয়া মোটামুটি ঠাণ্ডা। তবু লক্ষ করলুম, শান্তিলতার কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে। হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল বের করে তিনি মুখ মুছলেন। তারপর বললেন, “আপনার কথাটা আমি বুঝতে পারছি না।”
“না-বোঝার কিছু নেই!” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি যে রবিনসন স্ট্রিটের আপিসে কাজ করতেন, সেটা সত্যি। যুগল যে নাইন্টিফোরে সেখানে চাকরিতে ঢোকে, সেটাও সত্যি। কিন্তু সেখানেই যে যুগলের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছিল, এটা সত্যি নয়। আসলে, যুগলকে তার আগে থেকেই আপনি চিনতেন।”
“এ-কথা কেন বলছেন?”
“এইজন্যে বলছি যে, কারও সঙ্গে চেনাশুনো না থাকলে কি তার একটা চাকরি করে দেবার জন্যে কাউকে আমরা অনুরোধ করি? তা নিশ্চয় করি না। যুগলকে কাজে ঢোকাবার জন্যে আপনি ধনঞ্জয়
মিত্রকে অনুরোধ করেছিলেন কেন? যেহেতু আপনি যুগলকে আগে থেকেই চিনতেন, আর একই সঙ্গে
এটাও জানতেন যে, আপনি অনুরোধ করলে ধনঞ্জয় মিত্র সেটা ফেলতে পারবেন না।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “সো ফার সো গুড। কিন্তু তারপরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। ধনঞ্জয় মিত্র তো তাঁর নিজের কোম্পানি ম্যাক্রো বিল্ডার্সেই যুগলের জন্যে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন। তা না-করে যুগলের চাকরির ব্যবস্থা তিনি ট্র্যাভল-স্টারে করতে গেলেন কেন?”
শান্তিলতা নিশ্চয় বুঝে গিয়েছিলেন যে, তিনি শক্ত লোকের পাল্লায় পড়েছেন। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বললেন, “আমি ট্র্যাভল-স্টারের কথাই ওঁকে বলেছিলুম।”
“যাতে যুগল আপনার কাছে-কাছেই থাকে। ঠিক আছে। এখন বলুন, যে ছেলে বি.কম.টাও পাশ করতে পারেনি, ধনঞ্জয় মিত্র বললে যে ট্র্যাভল-স্টারে তার চাকরি হবেই, এটা আপনি জানতেন?”
“তা কেন জানব না? ওঁর কোম্পানি ম্যাক্রো বিল্ডার্স তো একে ট্র্যাভল-স্টারের বিরাট ক্লায়েন্ট, বছরে লাখ-লাখ টাকার বিজনেস দেয়, তার উপরে উনি ওদের একজন ডিরেক্টরও। ওরা যে ওঁর কথা সঙ্গে-সঙ্গে মেনে নেবে, সে আমি ভালই জানুতম।”
শুনে ভাদুড়িমশাই হাসলেন। তারপর হাসির রেশটুকুকে চোখের মধ্যে ধরে রেখে বললেন, “মিসের মিত্র, আপনাকে ধন্যবাদ, আমি ধরেই নিচ্ছি, প্রথমে যা-ই বলে থাকুন, পরে যা-যা বলেছেন, সবই সত্যি। এটাও আপনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে, যাঁর সাহায্য আপনি চাইছেন, অন্তত তাঁর কাছে সত্য গোপন করে কোনও লাভ নেই, বরং তাতে লোকসানের আশঙ্কাই ষোলো-আনা। কেন না, আপনি যা বলবেন, তার উপরে নির্ভর করেই আমাকে এগোতে হবে। যদি ভুল কথার উপরে নির্ভর করে এগোই, তো আমার সিদ্ধান্তগুলোও ভুল হতে থাকবে, আর তার ফলে যদি কোনও বিভ্ৰাট ঘটে, তো তার ফল ভুগতে হবে আপনাকেই। যা-ই হোক, আসল কথায় আসার আগে, যুগল সম্পর্কে আপাতত আর মাত্র একটা প্রশ্নই আপনাকে আমি করব। ওর সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা ঠিক কী? ওর প্রতি এত টান কেন আপনার?”
একটুও সময় না নিয়ে শান্তিলতা বললেন, “টান থাকবে না? হি ইজ মাই ম্যান ফ্রাইডে।”
“অর্থাৎ আপনার বিশ্বস্ত অনুচর। অনুগত সঙ্গী। যা-ই করতে বলুন, ও সেটা করে দেবে, কেমন?”
“হ্যাঁ, সেইজন্যেই ওকে ছাড়া আমার চলে না।”
“ভাল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এইবারে আমি আসল কথায় আসব।”