২
কথা ছিল এবারের বাংলা নববর্ষটা কলকাতায় কাটাবেন ভাদুড়িমশাই। পারেননি। বাঙ্গালোরের আপিসে বিস্তর কাজ জমে ছিল। তার ফয়সলা করতে-করতেই নববর্ষ পেরিয়ে যায়। বাঙ্গালোর থেকে দিল্লিতে ডাক পড়ে। সেখানেও হরেক ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ফলে আমরা ধরেই নিয়েছিলুম, এ-যাত্রায় আর তাঁর কলকাতায় আসা হচ্ছে না। এলেও হয়তো বৈশাখ পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠে আসবেন! কথাটা সদানন্দবাবুকে জানাতে তিনি বললেন, “জষ্ঠিতেও যদি না-আসেন তো বাই দ্যাট টাইম হিমসাগর যে ফিনিশ হয়ে যাবে, মশাই। মাথা খুঁড়েও বাজারে তখন আর ও-বস্তুর খোসাটা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
এলেন কিন্তু বোশেখ মাসেই। দিল্লি থেকে বিশে এপ্রিল রাত্তিরে হঠাৎ ফোন করে জানালেন যে, পরদিন অর্থাৎ একুশে এপ্রিল সকালের ফ্লাইটে তিনি কলকাতা আসছেন। কোনও কাজ পড়ে গিয়েছে কি না, জিজ্ঞেস করতে বললেন, “ধুর মশাই, আর কাজের কথা বলবেন না! কাজ করতে-করতে হাঁফিয়ে গেছি, এখন বিশ্রাম চাই। অন্তত এক হপ্তা। যেমন হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করব, তেমনি পেট ভরে ভালমন্দ খাব। কলকাতায় কি নতুন কোনও ভাল রেস্তোরাঁ খুলেছে?”
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আপিসে আমার তরুণ সহকর্মী রঞ্জন উপাধ্যায় একজন জানবুঝ ব্যক্তি। তাঁকে ফোন করতে তিনি বললেন, “চাইনিজে যদি আপত্তি না থাকে তো চোখ বুজে পার্ক স্ট্রিটের রয়্যাল চায়নায় চলে যান। নতুন খুলেছে, কিন্তু খাবার যা সার্ভ করছে, তার জবাব নেই। জায়গা পেতে হলে আগে-ভাগে টেবিল বুক করে যাওয়াই ভাল, কিরণদা। সন্ধের দিকে বড্ড ভিড় হয়!”
ভাদুড়িমশাই ঠিক সময়েই কলকাতায় পৌঁছে যান। প্লেন লেট করেনি, কৌশিক দিন কয়েক আগেই বাঙ্গালোর থেকে এসে গিয়েছিল, বাড়ির গাড়ি নিয়ে দমদমে গিয়ে সে-ই তার মামাবাবুকে কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে।
এটা কাল সকালের কথা। আমি আর সদানন্দবাবু ঠিক করে রেখেছিলুম, দেরি না-করে কাল সন্ধেতেই আমরা সবাই মিলে রয়্যাল চায়নায় আমাদের নৈশ আহার সমাধা করব। সেটা বেশ একটা ফ্যামিলি রি-ইউনিয়নের মতন ব্যাপার হবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনেককেই দলে পাওয়া গেল না। কৌশিক আসতে পারল না তার এক বন্ধুর জন্মদিনের নেমন্তন্ন ছিল বলে। অরুণ সান্যালের ব্লাড প্রেশার চড়ে গেছে। তাঁকে বাড়িতে একা রেখে মালতীর পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। মালতী না আসায় বাসন্তীও এল না। এদিকে সদানন্দবাবুর স্ত্রী আমাদের কুসুম-বউঠান তো বাতে-পঙ্গু, কোথাও যাওয়ার কথা হলেই তিনি জোড়হস্ত কপালে ঠেকিয়ে বলেন, ‘রক্ষে করো বাবা!’ ফলে ভাদুড়িমশাই, সদানন্দবাবু ও আমি, স্রেফ তিনজনের জন্যে একটা টেবিল বুক করা হয়। তা কাল একুশে এপ্রিল শনিবার রাতে সেখানে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার শেষ পর্বে কীভাবে এক ভদ্রমহিলার আবির্ভাব হয়, সে-কথা এর আগের পরিচ্ছেদেই বলেছি।
শান্তিলতার জন্যে একজন রক্ষীর ব্যবস্থা করে দিয়ে, রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসার আগে ভাদুড়িমশাই তাঁকে বলেছিলেন যে, সমস্ত কথা যদি খুলে বলতে হয়, তা হলে শান্তিলতা যেন কাল রাত্তিরেই কিংবা আজ সকালে তাঁকে একটা ফোন করেন।
আজ বাইশে এপ্রিল, রবিবার। সকাল আটটা নাগাদ ভাদুড়িমশাই ফোন করেছিলেন। ফোনটা বাসন্তী ধরেছিল। নিজে খানিকক্ষণ কথা বলার পরে রিসিভারটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “চারুদা। জিজ্ঞেস করছিলেন, তোমার ঘুম ভেঙেছে কি না।”
বললুম, “আমার ঘুম রোজ যেমন ভাঙে, আজও তেমন কাঁটায় কাঁটায় সাতটাতেই ভেঙেছে। তা আপনার খবর কী? ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন?”
“মিসেস মিত্র?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কাল রাত্তিরেই করেছিলেন। বললেন, সব কথা কাল বলতে পারেননি, আরও কিছু বলা দরকার। সকালেই চলে আসতে চাইছিলেন। নাকি খুবই জরুরি কথা।”
“তাতে আপনি কী বললেন?”
“বললুম, সকালে আমার সময় হবে না। সন্ধের দিকে ওঁর সঙ্গে বসতে পারি।”
“কোথায় বসবেন?”
“কোথায় আবার, এই কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে। সন্ধে সাতটায় সময় দিয়েছি। আপনিও চলে আসুন না।”
“আমি গিয়ে কী করব?”
“বাঃ, আপনি তো একেবারে গোড়া থেকেই সব দেখছেন। আপনি না-এলে চলে? …আর হ্যাঁ, সদানন্দবাবু যদি আসতে চান, তো ওঁকেও নিয়ে আসুন।”
হাসি চেপে বললুম, “সদানন্দবাবুকে কি আপনি চেনেন না? যেতে উনি চাইবেনই। হাতে হাজারটা কাজ থাকলেও সে-সব ফেলে রেখে উনি যাবেন। কিন্তু আমরা যাব কখন? ওই সাতটায়?”
“না, না, পাঁচটা নাগাদ চলে আসুন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৌশিককে একটা কাজে পাঠাচ্ছি। সে-ও মনে হয় পাঁচটার মধ্যে ফিরে আসতে পারবে।”
“যেতে যখন বলছেন, তখন যাব নিশ্চয়ই। তবে সত্যিই কি আমাদের যাওয়ার দরকার ছিল? স্ত্রীর চালচলন নিয়ে স্বামীর সন্দেহ, পিছনে লোক লাগানো, ঝগড়া—এ তো আকছার হচ্ছে। নেহাতই মামুলি ব্যাপার।”
“আপনি তা-ই মনে করেন?”
“কেন, আপনি করেন না?”
“করলে কি আর ফের ওঁকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলতুম? উনি প্রোটেকশানের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন, আমি সেটা করে দিয়েছি। বাস, ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যেত।”
ভাদুড়িমশাই আর কথা বাড়ালেন না, ফোন কেটে দিলেন।
আজ রবিবার। কিন্তু কাজের চাপ থাকায় আজও আপিসে যেতে হয়েছিল। যাওয়ার আগে সদানন্দবাবুর সঙ্গে কথা হল। বললুম, বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমার সঙ্গে তাঁকে কাঁকুড়গাছিতে যেতে হবে! ভাদুড়িমশাই যেতে বলেছেন। কোনও অসুবিধে হবে না তো? তাতে তিনি একগাল হেসে বললেন, “ভাদুড়িমশাই যেতে বলেচেন আর আমি যাব না? তাও কি হয় নাকি? একশোবার যাব। অসুবিদে হলেও যাব।”
“ঠিক আছে।” আমি বললুম, “তা হলে তৈরি হয়ে থাকবেন, সাড়ে চারটে থেকে পৌনে পাঁচটার মধ্যে আমি আপনাকে বাড়ি থেকে তুলে নেব।”
তা-ই নিয়েছিলুম। কাঁকুড়গাছিতে পৌঁছেও যাই পাঁচটার মধ্যেই। কৌশিক তখনও ফেরেনি। কোথায় কী কাজে তাকে পাঠানো হয়েছে, জিজ্ঞেস করতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “অত ব্যস্ত হবার কিছু নেই। ওকে ফিরতে দিন, ফিরে এলে ওর কাছেই শুনবেন। বিকেলে বাড়ি ফিরে চা খেয়েছেন?”
“সময় পেলুম কোথায়?”
“তা হলে চায়ের কথা বলি। আমিও খাইনি। আপনাদের সঙ্গে খাব বলে অপেক্ষা করছিলুম। অরুণ, তুমিও খাবে তো?”
মালতী ঘরে ঢুকে বলল, “ও খাবে না। বিকেলে এক কাপ খায়। সেটা একটু আগেই খেয়েছে। তোমাদের তিনজনের চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চা চলে এল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই এল কৌশিক। ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে বলল, “মা, বড্ড হাঁফিয়ে গেছি, আমিও চা খাব।”
কাজের মেয়েটি এসে বলল, “এই একটা বাড়তি কাপ রেকে যাচ্চি। মা বললেন, এখন আর চা হবেনি। পটে চা দিয়েছি, চারজনে ভাগ করে খান।”
চা বানাবার ভার ভাদুড়িমশাই নিজেই নিয়েছেন। আমার আর সদানন্দবাবুর কাপে হাল্কা লিকার ঢেলে, নিজের আর কৌশিকের কাপে লিকারের সঙ্গে দুধ-চিনি মেশালেন। তারপর কৌশিকের কাপটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “মা’কে আর জ্বালাস না। রেগে আছে।”
গলা নামিয়ে কৌশিক বলল, “কেন? বাবা ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছে না, তাই?”
“আরে না। সাতদিন আগে গ্যাস বুক করেছিল, এখনও তার ডেলিভারি দেয়নি। এদিকে সেকেন্ড সিলিন্ডারটাও ফুরিয়ে আসছে। রাগ তো হতেই পারে। কিন্তু সে কথা থাক। তোর কী খবর?”
“খবর সুবিধের নয়।”
“তার মানে আমি যা ভেবেছিলুম, তা-ই?”
“তার চেয়েও খারাপ।” চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে কৌশিক বলল, “যুগল চৌধুরি ইজ আ রটন অ্যাপ্ল!”
সদানন্দবাবু বললেন, “কোন যুগল চৌধুরি? মিসেস মিত্র কাল যার কথা বলছিলেন? …ওই মানে যে-ছোকরাটিকে নিয়ে মিসেস মিত্রের হাজব্যান্ডের সন্দেহ?”
ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে আমি বললুম, “আপনি কি তারই খোঁজ করতে কৌশিককে পাঠিয়েছিলেন নাকি?”
“তা নইলে আর কার খোঁজে পাঠাব?” ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “তার ঠিকানাটা তো জেনে রাখা হয়নি, শুধু জানি যে, এককালে সে-ও ট্র্যাভ্ল-স্টারে কাজ করত। তা সেইখানেই কৌশিককে পাঠিয়েছিলুম। ভাবলুম, যদি কিছু খোঁজখবর পাওয়া যায়। …এই মানে অ্যাজ অ্যান এমপ্লয়ি লোকটি কেমন ছিল। কাজে কর্মে মনোযোগী ছিল, না ফাঁকিবাজ। নিয়মিত কাজে আসত, না ডুব মারত মাঝেমধ্যে। ওবিডিয়েন্ট, না অ্যারোগ্যান্ট। লেজি, না চটপটে। ডিপার্টমেন্টের অন্য লোকজনদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল। ঝগডুটে ছিল কি না। কথায়-কথায় তর্ক জুড়ে দিত কি না। …এইসব টুকিটাকি খবর আর কী। …আরে, আপনি হাসছেন কেন?”
“হাসব না?” আমি বললুম, “এ তো ইউজলেস ইনফর্মেশন। এসব জেনে কী হবে?”
“কিছুই হবে না? আরে মশাই, আর কিছু না হোক, লোকটার মানসিকতা কোন ধাঁচের, আর হ্যাঁ, তার মেজাজ-মর্জিই বা কেমন, তার তো একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। সেটাই বা কম কী?”
“ঠিক আছে, কিন্তু আজ তো রবিবার, ট্র্যাভল-স্টার আজ খোলা ছিল?”
“সেটা আমিও ভেবেছিলুম, কিরণমামা।” কৌশিক বলল, “কিন্তু মামাবাবু তো ট্র্যাভল-স্টারের বাঙ্গালোর আপিসের পুরনো ক্লায়েন্ট। গত তিন-চার বছর ধরে ওরাই মামাবাবুর ট্র্যাভল এজেন্ট হয়ে সব কাজকর্ম করে দিচ্ছে। তাই উনি জানেন যে…”
“হপ্তায় সাতদিনই ওদের সব আপিস খোলা থাকে। অল ওভার ইন্ডিয়া। রোববারে অবশ্য কর্তাব্যক্তিরা যান না, তবে কিছু-না-কিছু লোক থাকেই।”
কৌশিকের কথাটা ভাদুড়িমশাই শেষ করলেন। “এটা একটা মস্ত সুবিধে। বিশেষ করে যারা ফরেনে যায়, তাদের পক্ষে। মানে পাসপোর্ট, ভিসা, হেলথ-সার্টিফিকেট, ট্র্যাভলার্স চেক, এয়ার টিকেট, বখেড়ার তো শেষ নেই, অনেককে একেবারে শেষ মুহূর্তে এগুলো ধরিয়ে দিতে হয়। দ্যাটস হোয়াই।”
“তা তো হল,” আমি বললুম, “কিন্তু লোকটার সম্পর্কে জানাটা গেল কী?”
কৌশিক বলল, “সেটাই তো বলতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তোমরা বলতে দিচ্ছ কই। খালি আগড়ম-বাগড়ম। এখন যা বলছি, মন দিয়ে শোনো। মামাবাবু ভেবেছিল, লোকটা ফাঁকিবাজ, কাজেকর্মে মন নেই, মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করা টাইপ, মেজাজি, অর্কেস্ট্রা পার্টি নিয়ে বাইরে কোথাও যাবার জন্যে ছুটি চেয়েছিল, সেটা মঞ্জুর না-হওয়ায় মেজাজ দেখিয়ে কাজ ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু এটা যে কাজ ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপার নয়, টাকা চুরির দায়, কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপার, মামাবাবু তা ভাবতে পারেনি। কী মামাবাবু, পেরেছিলে?”
“না, পারিনি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কত টাকা?”
“অ্যামাউন্টটা বড় নয়, হাজার পাঁচেক। সেটার জন্যে ওরা আর থানা-পুলিশ করেনি। জাস্ট ওর মাইনে থেকে টাকাটা কেটে রেখে ওকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বিদেয় করে দেওয়া হয়।”
“এটা কার কাছে জানলি?”
“ওর একজন কলিগের কাছে।”
“তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলি যে, যুগল চৌধুরি ওখানকার চাকরিতে কীভাবে ঢুকেছিল? “তার মানে?”
“তার মানে কাগজে কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করে ইন্টারভিউয়ে সিলেক্টেড হয়ে…মানে নর্মালি লোকে যেভাবে চাকরিতে ঢোকে আর কি…সেইভাবে ঢুকেছিল, নাকি কারও সুপারিশে?”
কোনও ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দিলে কিংবা কারও কথায় অত্যধিক কৌতুহলী হলে ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ যেমন হঠাৎই সরু হয়ে যায়, কৌশিকও সেটা রপ্ত করেছে দেখছি। হঠাৎই সরু চোখে সে তার মামাবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি জানলে কী করে?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কী জানব?”
“যুগল কোনও মুরুব্বির সুপারিশের জোরে ওখানে চাকরি পেয়েছিল।”
“জানি না তো।” হাসিটা ধরে রেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “জাস্ট অনুমান করেছিলুম।”
“ঠিকই অনুমান করেছ।” কৌশিক বলল, “তবে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি। ভদ্রলোক নিজের থেকেই বললেন, বি. কম. পরীক্ষায় গাড্ডু মেরেও মুরুব্বির জোরে চাকরি পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু সেটা রাখা যায় না। চাকরি রাখার জন্যে কাজ জানা চাই, অনেস্টি থাকা চাই, কোম্পানির প্রতি লয়্যাল থাকা চাই। এগুলি একেবারে মিনিমাম রিকোয়ারমেন্ট। কিন্তু যুগলের নাকি এর কিছুই ছিল না।”
আর-সবাই চা পেলেও গিন্নি বাগড়া দেওয়ায় তিনি চা পাননি, অরুণ সান্যাল সম্ভবত এই কারণেই এতক্ষণ বিরস মুখে একটা মেডিক্যাল জার্নালের পাতা ওলটাচ্ছিলেন কিন্তু জুতসই একটা বিষয় পেয়ে যাওয়ায় তিনি আর মুখ না খুলে থাকতে পারলেন না। বললেন, “এইজন্যেই তো আমাদের আপিসগুলোতে কোনও কাজ হয় না। লোকগুলো সব মুরুব্বির জোরে চাকরি পায় আর ফ্যানের হাওয়া খেতে-খেতে হাই তোলে! আ হোল লট অব ওয়ার্থলেস পিল!”
সদানন্দবাবু বললেন, “হাই তোলে আর জাবর কাটে। তা হলে আর কাজকম্মো হবে কোত্থেকে। আমাদের জেঙ্কিনস অ্যান্ড জেঙ্কিনসে কিন্তু এমনটা হবার জো ছিল না। আরে বাবা, মুরুব্বির জোর তো আমারও ছিল, কিন্তু তাই বলে কি কখনও কাজে ফাঁকি দিতে পেরিচি? মাঝখানে আধ ঘণ্টা টিপিনের কতা যদি ছেড়ে দেন তো নাইন থার্টি টু ফাইভ শুধু কাজ আর কাজ। তা সে তো হবেই, মাথার ওপরে একজন সায়েব ছিল যে!”
“ওহো, একটা কথা বলা হয়নি।” কৌশিক বলল, “আপিস থেকে তাড়িয়ে দেবার আগে, যুগলকে দিয়ে একটা লেটার অব রেজিগনেশন লিখিয়ে নেওয়া হয়েছিল। যাতে ইউনিয়ন না ঝামেলা পাকাতে পারে।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আর নোটিস-পিরিয়ডের মাইনেটাও না দিতে হয়। তা তো হল, যুগলের মুরুব্বিটি কে, তা জানতে পারলি?”
“ঠারেঠোরে জানবার চেষ্টা করেছিলুম। কিন্তু কলিগটি দেখলুম মহা সেয়ানা, যুগলের চাকরি যাবার খবরটা দেবার পরেই কচ্ছপের মতন হঠাৎ শুঁড় গুটিয়ে নিল। তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলেছিল বটে।”
সেটা কী?”
“বলেছিল যে, যুগলের চাকরি যাওয়ায় তার গডফাদারও নাকি অখুশি হননি। চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার তাঁকে ফোন করে খবরটা দেওয়ায় বলেছিলেন, আপদ গেছে!”
কথা আর এগোল না। ডোর বেল বাজল। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, কাঁটায় কাঁটায় সাতটা। কাজের মেয়েটি এসে বলল, এক ভদ্রমহিলা দেখা করতে এসেছেন।