১০
মঙ্গলের উষা, বুধে পা। থানার সামনে থেকে সাড়ে চারটেয় ট্যাক্সিতে উঠেছিলুম। কাঁকুড়গাছিতে পৌঁছে ট্যাক্সি ছেড়ে দেওয়া হল। কৌশিককে নিয়ে ভাদুড়িমশাই সেখানে নেমে পড়লেন। চন্দ্রভানকেও ছাড়লেন না। বললেন, “এ-বেলা এখানে ঘুমিয়ে নিক, বিকেলে ক্যামাক স্ট্রিটের আপিসে যাবে।” কৌশিকদের ফ্ল্যাটবাড়ির একতলার পার্কিং স্পেসে আমার গাড়িটা রেখে দেবার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেটা বার করে সদানন্দবাবুকে নিয়ে আমাদের শেয়ালদার গলিতে পৌঁছতে-পৌঁছতে সাড়ে পাঁচটা বাজল। বাড়িতে ঢুকে, বিছানায় শুয়ে পড়তে-না-পড়তেই ঘুম।
প্রথম কিস্তির ঘুম ভাঙল বেলা এগারোটায়। তাও ভাঙত না, যদি না বাসন্তী অত হল্লা জুড়ে দিত। বললুম, “কী ব্যাপার? রাত্তিরে এক ফোঁটা ঘুম হয়নি, এখন দিনেও একটু ঘুমিয়ে নিতে দেবে না?”
“একটু নয়, টানা পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েছ।” বাসন্তী বলল, “ছটা থেকে এগারোটা। এখন উঠে হাত-মুখ ধোও। দাড়ি কামাও। চান করো। বাজার হয়নি, যা দুটি ডালভাত রান্না করে রেখেছি, মুখে দাও। আমি ধন্য হই। …আপিসে যাবে নাকি?”
চোখ তখনও ঘুমে জড়ানো। বললুম, “না।”
“ঠিক আছে। দুটি খেয়ে নিয়ে তা হলে ফের ঘুমিয়ে পড়ো। তবে হ্যাঁ, বিকেল পাঁচটার পরে আর ঘুমোনো চলবে না।”
“কেন?”
“ভাদুড়িদা ফোন করেছিলেন।”
ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিল। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে বললুম, “কেন? আবার কী হল?”
“বললেন যে, সন্ধেয় এক জায়গায় যেতে হবে।”
“সে তো উনি যাবেন।”
“না, না, শুধু উনি নন, আমাদেরও যেতে হবে। তোমাকে, আমাকে, এমনকি সদানন্দবাবুকেও।”
“কোথায়?”
“তা তো জানি না।” বাসন্তী বলল, “শুধু বললেন যে, ওঁর এক বন্ধু তাঁর ক্লাবে সবাইকে ডেকেছেন। ডিনারের নেমন্তন্ন।”
কে বন্ধু, কেন ডিনার, আমরা সেখানে যাবই বা কেন, কিছুই বুঝলুম না। ফোন করে ভাদুড়িমশাইকে ডেকে বললুম, “কী ব্যাপার বলুন তো?”
তেমন-কিছু নয়,” ফোনে হাসির শব্দ ভেসে এল। “শান্তিলতার অশান্তি মিটেছে তো, সেই উপলক্ষে একটু কথাবার্তা আর খাওয়া-দাওয়া। আপনারা তিনজনেই কিন্তু আসবেন।”
“তিনজনে কেন? আমরা যুগলে যাব, আর সদানন্দবাবু একা? কুসুম-বউদি যাবেন না?”
“তাঁকে কি আর বলিনি? বলেছিলুম। কিন্তু তাঁর বাতের ব্যথা ফের বেড়েছে, যেতে পারবেন না। এ বাড়ি থেকে অরুণও যেতে পারছে না। তবে মালতী যাবে।”
“বন্ধুটি কে? তাঁর এই ক্লাবটাই বা কোথায়?”
“সবই জানবেন। তবে সময়মতো।”
“ক্লাবটা কোথায়, অন্তত সেটা তো জানা দরকার। নইলে যাব কী করে?”
“ও নিয়ে ভাববেন না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৌশিক আর মালতীকে নিয়ে বিকেল ছ’টায় আমি আপনাদের ওখানে পৌঁছচ্ছি। আমি আমার গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছি। আপনিও আপনার গাড়ি নিয়ে তৈরি থাকুন। আমিই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব। …বাস, ওই কথাই রইল। …ও হ্যাঁ, রাত্রিজাগরণের ফলে শরীর বিগড়োয়নি তো?”
“না, না, আমি ঠিকই আছি। তবে সদানন্দবাবু কেমন আছেন জানি না।”
“সকাল ছ’টায় ফোন করেছিলুম। সদানন্দবাবুকে পাইনি। মিসেস বসু ফোন ধরেছিলেন। বললেন যে, বাড়িতে ফিরেই ভদ্রলোক মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছেন।”
.
থ্রি হানড্রেড ক্লাবের নাম শুনেছি, ডায়মন্ড হারবার রোড দিয়ে যাতায়াত করার সময়ে জোকা থেকে মাইল কয়েক দক্ষিণে রাস্তার ধারে এদের বিশাল দেউড়ি ও দেউড়ির গায়ে ক্লাবের নাম লেখা পেতলের ফলকটিও চোখে পড়েছে বার কয়েক। কিন্তু নানান জনের কাছে এই ক্লাব সম্পর্কে নানা সময়ে যা শুনেছি, তাতে দেউড়ি পেরিয়ে ভিতরে ঢোকার সাহস কখনও হয়নি।
এটা বাছাই-করা বড়লোকদের ক্লাব। এদের সদস্য-সংখ্যা গোনাগুনতি তিনশো। কোনও সদস্য মারা গেলে কিংবা সদস্যপদে ইস্তফা দিলে কিংবা যে-কোনও কারণেই হোক কারও সদস্যপদ খারিজ হলে তবেই তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে ওয়েটিং লিস্ট থেকে নতুন কাউকে বাছাই করে নেওয়া হয়। কিন্তু সদস্য-সংখ্যা কিছুতেই তিনশো ছাড়াতে দেওয়া হয় না।
আজই এখানে প্রথম ঢুকলুম। ঢুকে অবাক হয়ে যাই। দুটি লন, দুটি টেনিস কোর্ট, একটি সুইমিং পুল, দুটি জিম, নানারকম মরসুমি ফুলের কয়েকটি বাগান, একটি গোলাপ-বাগিচা ও একটি পার্কিং লট নিয়ে দেড়-মানুষ-সমান উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বিশাল কম্পাউন্ড। মোরাম-বিছানো রাস্তাটিও দিব্যি চওড়া। কম্পাউন্ডের মাঝ-বরাবর দোতলা ক্লাব-বিল্ডিং। তার একতলার গাড়ি-বারান্দার নীচে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, গাড়ি থেকে নামতেই তিনি এগিয়ে এসে হাসিমুখে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। দেখেই বুঝেছিলুম, ইনি আমাদের আমন্ত্রণকর্তা।
ভদ্রলোকের বয়স মনে হল বছর পঞ্চাশেক। মাথার চুলের রং নুনে-গোলমরিচে মিশে থাকলে যেমন হয়, সেই রকমের কাঁচাপাকা। চোখে চশমা নেই, গায়ের রং টকটকে ফর্সা, মেদহীন দীর্ঘদেহী পুরুষ, স্বাস্থ্যটি পেটানো। বস্তুত এই কারণেই আমি চমকে যাই, যখন শুনি যে, ইনিই ধনঞ্জয় মিত্র, ম্যাক্রো বিল্ডার্সের মালিক ও শান্তিলতার স্বামী। সদানন্দবাবুর অবস্থাও তথৈবচ। তিনিও, আমার মতো, ভাবতে পারেননি যে, বয়স যাঁর পঁয়ষট্টি, তিনি এমন সতেজ চেহারা ও সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারেন। চাপা গলায় আমাকে বললেন, “নিশ্চয়ই মর্নিং ওয়াক করেন।”
দলে আমরা মোট ছ’জন। শেয়ালদা থেকে আমি, বাসন্তী ও সদানন্দবাবু। কাঁকুড়গাছি থেকে ভাদুড়িমশাই, মালতী আর কৌশিক। প্রাথমিক আলাপ-পরিচয়ের পর্ব শেষ হবার পর ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “মিসেস মিত্রকে দেখছি না যে? তিনি কোথায়?”
“শান্তিলতা উপরে। আমার পুত্রবধূ ইন্দিরাও উপরে। দুজনে মিলে এখানকার স্টুয়ার্ডের সঙ্গে কথা বলছে। ডিনারের ব্যাপারে শেষ মুহূর্তের দুটো-চারটে ইন্সট্রাকশান দিচ্ছে আর কি।”
“আপনার ছেলে? তাকেও তো দেখছি না।”
“পুরন্দর?” ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “তাকে কি আমিই দেখতে পাই যে, আপনি দেখবেন? কৰ্ণাটক সরকারের নতুন যে কনস্ট্রাকশানের কাজটা পাবার কথা ছিল, কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছিলুম না, শেষ পর্যন্ত সেটা পাওয়া গেছে। ফলে পুরন্দর আটকে আছে বাঙ্গালোরে। ফোনে অবিশ্যি রোজই বার কয়েক কথা হয়, তবে কাজটা শুরু না-করিয়ে দিয়ে যে কলকাতায় আসতে পারবে, এমন মনে হয় না। … কিন্তু আপনারা দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, চলুন, দোতলায় যাওয়া যাক।”
সবাই মিলে দোতলায় উঠে এলুম। শান্তিলতা দোতলার ল্যান্ডিংয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বছর তিরিশ-পঁয়তিরিশের একজন বিবাহিতা মহিলা! এঁকে আগে দেখিনি। তবে বুঝতে অসুবিধে হল না যে, ইনিই ইন্দিরা, ধনঞ্জয় মিত্রের পুত্রবধূ।
শান্তিলতাকেও এর আগে মাত্র তিনদিনই আমি দেখেছি। শনিবার রাত্তিরে পার্ক স্ট্রিটের রয়্যাল চায়না রেস্তোরাঁয়, তারপর রবি আর সোমবার বিকেলে অরুণ সান্যালদের কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে। যতটুকু সময় দেখেছি, তার মধ্যে কখনও তাঁকে হাসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সারাক্ষণই তাঁর মুখে যেন একটা উদ্বেগ ও আতঙ্কের ছায়া ভেসে বেড়াত। আজ তিনি হাসছিলেন। হাসতে-হাসতে কথা বলছিলেন বাসন্তী আর মালতীর সঙ্গে। দেখে বড় ভাল লাগল।
দোতলার পিছন দিকের খোলা বারান্দাটা আজকের এই জমায়েতের জন্যে সোফা আর কৌচ দিয়ে চমৎকার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে নিয়েই বসানো হল আমাদের। উর্দি-পরা বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করে গেল, কে কী পানীয় নেবেন। লক্ষ করলুম, একমাত্র ধনঞ্জয় মিত্র ছাড়া কেউই কড়া পানীয় নিলেন না। বৈশাখ মাস। এই সময়ে মাঝেমধ্যে ঝড়বৃষ্টি হয়। কিন্তু আকাশে কোথাও আজ মেঘের লেশমাত্র নেই। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। গল্প জমে উঠতে দেরি হল না। এরই মধ্যে ধনঞ্জয় মিত্রকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলুম যে, এত বড় ক্লাব, অথচ ভিড়ভাট্টা নেই কেন? তাতে তিনি হেসে বললেন, “ভিড় দেখতে চান? তা হলে শনি-রবিবারে আসুন। ও দুটো দিন ভিড় উপচে পড়ে। মেম্বাররা প্রায় সবাই সেদিন আসে, ফলে পার্কিং স্পেসে গাড়ি রাখাই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।”
আটটার সময় স্টুয়ার্ড-ভদ্রলোক এসে জানালেন, ডিনার রেডি। ধনঞ্জয় মিত্র তাঁর হাতের গেলাশে শেষ চুমুক দিয়ে গেলাশটা নামিয়ে রেখে বললেন, “তা হলে ওঠা যাক।”
সব মিলিয়ে আমরা লোক মাত্র ন’জন। সম্ভবত সেইজন্যেই এখানকার বড় ডাইনিং হল-এ নয়, তার লাগোয়া আর-একটি ছোট ঘরে আমাদের নৈশাহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘরটির মেঝে থেকে দেওয়ালের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাঠের কাজ। তার উপরে ক্রিম কালারের দেওয়ালে বেশ কয়েকটি বিলিতি ল্যান্ডস্কেপ। মনে হল, কনস্টেবলের কাজ। ধনঞ্জয় মিত্রকে সে-কথা বলতে তিনি জানালেন, আটখানার মধ্যে পাঁচখানা কনস্টেবলের আর তিনখানা গেনসবরোর। তারপর একটু হেসে বললেন, “বুঝতেই পারছেন, একখানাও ওরিজিন্যাল নয়, সবই প্রিন্ট। তবে এমন প্রিন্টও আজকাল আর পাবেন না। বিলেত থেকে আমিই আমাদের ক্লাবকে এনে দিয়েছিলুম।”
খাওয়ার পর্ব শেষ হবার পরে মেয়েরা আবার সেই বারান্দায় গিয়ে বসলেন। সদানন্দবাবুও তাঁদের সঙ্গ দেবার জন্যে পা বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু ধনঞ্জয় মিত্র তাঁকে আটকে দিয়ে বললেন, “ওদিকে নয়, ওদিকে নয়, ওঁরা ওঁদের মতো গল্প করুন, আমরা বরং আলাদা বসে গোটাকতক জরুরি কথা সেরে নিই।”
স্টুয়ার্ড আমাদের কাছাকাছিই ঘুরঘুর করছিলেন। ধনঞ্জয় মিত্র তাঁকে ইঙ্গিত করতেই তিনি আমাদের আর-একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। সম্ভবত এটা এদের কার্ডরুম। তবে মাঝখানে একটি ছোট টেবিল ও তার চারপাশে চারটি চেয়ার পাতা থাকলেও ঘরটি এখন নির্জন। ঘরের একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে খান পাঁচ-ছয় লেদার-চেয়ার। একজন বেয়ারা এসে তাসের টেবিল-চেয়ারগুলিকে একদিকে সরিয়ে দিয়ে লেদার চেয়ার ক’খানাকে ঘরের মাঝখানে বৃত্তাকারে সাজিয়ে দিল। গোল একটা সেন্টার-টেবিলও রেখে দিল তার সামনে। টেবিল ঘিরে আমরা গোল হয়ে বসলুম। ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “আমাদের স্টকে অতি উত্তম কিছু ব্রান্ডি আছে। আপনাদের দিতে বলি?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, আমাদের আর কিছুই লাগবে না। শুনে ধনঞ্জয় মিত্র বেয়ারাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা হলে আমিও কিছু নিচ্ছি না। তুমি যেতে পারো।”
বেয়ারাটি সেলাম ঠুকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। মিনিট খানেক নিঃশব্দে টানলেন সেটা। তারপর বললেন, “আপনি কী-সব কাজের কথা সেরে নেবেন বলছিলেন না?”
“হ্যাঁ।” ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “আসলে, সকালে তো আপনি আমাকে ফোন করেছিলেন, গোটা প্রবলেমটাকে কোন দিক থেকে আপনি দেখেছেন আর কীভাবে সেটা আপনি সল্ভ করেছেন, ফোন না করলেও সেটা আমি মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে পারতুম। কিন্তু কয়েকটা পয়েন্টে একটু ক্ল্যারিফিকেশন দরকার, নইলে ছবিটা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না, …আর হ্যাঁ, আমারও একটু অস্বস্তি থেকে যাচ্ছে। কয়েকটা প্রশ্ন করব আপনাকে। …অফ, কোর্স ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড…”
“মাইন্ড করার কী আছে,” ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “আপনি আমার ক্লায়েন্টের স্বামী, আপনাদের ভুল-বোঝাবুঝিও কেটে গেছে, সুতরাং প্রশ্ন তো আপনি করতেই পারেন। করুন।”
“শান্তির উপরে নজর রাখতে আমি লোক লাগিয়েছিলুম। সেটা বুঝে গিয়ে ও ভয় পায়। ওর ধারণা হয়, আমি ওকে খুন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনি ঠিকই বুঝতে পারেন, সেটা ওর ভুল ধারণা। আমার প্রথম প্রশ্ন, ওর কেসটা হাতে নেবার সঙ্গে-সঙ্গেই আপনি এটা বুঝলেন কী করে?”
“খুব সহজেই বুঝলুম।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মিঃ মিত্র, একমাত্র উন্মাদ কিংবা জড়বুদ্ধি মানুষ ছাড়া অকারণে কেউ কাউকে খুন করে না। তা আপনার স্ত্রীর কাছে তো শনিবার রাতেই জানতে পেরেছিলুম যে, আপনি ম্যাক্রো বিল্ডার্সের মালিক। জেনে বুঝলুম, উন্মাদ কিংবা জড়বুদ্ধি হলে এত বড় একটা কোম্পানির ঝক্কি আপনি সামলাতে পারতেন না। সত্যিই যদি কাউকে আপনি খুন করতে চান তো সেটা আপনি অকারণে করবেন না, তার একটা কারণ থাকতে হবে। তখন ভাবতে লাগলুম, কারণটা কী হতে পারে। আপনার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন, ওঁর চরিত্র নিয়ে আপনার সন্দেহটাই একটা মস্ত কারণ। কিন্তু আমার সে-কথা বিশ্বাস হল না। বিশ্বাস না-হবার কারণ, স্ত্রীর চরিত্রে সন্দিহান হয়ে কেউ যে খুন করে না, তা নয়, তবে ওই ধরনের খুন যে-সমাজে হয়, আপনি সেই সমাজের লোক নন। আপনারা সমাজের উপরতলা মানুষ, খুন যদি করতেই হয়, তো আপনারা ঠাণ্ডা মাথায় সবদিক ভেবেচিন্তে এমনভাবে করবেন, যাতে পুলিশের নজর কিছুতেই আপনাদের উপরে গিয়ে না পড়ে। মানে সরাসরি এইভাবে একটা গোয়েন্দা এজেন্সির লোক লাগিয়ে খুনটা আপনারা করবেন না। এ-দিকটা ভেবে মনে হল, স্ত্রীর পিছনে যাদের আপনি লাগিয়েছেন, আর যা-ই হোক, খুন করার মতলব তাদের নেই। …দেয়ার ইজ ইয়েট অ্যানাদার পন্ট।”
ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “সেটা কী?”
সেটা এই যে, শান্তিলতার চরিত্র নিয়ে সন্দিহান হবারও কোনও কারণ আপনার ছিল না। মানে প্রথম দিকে ছিল হয়তো, কিন্তু আপনাদের বিয়েটা হয়ে যাবার অ্যাদ্দিন পরে আর ছিল না। কথাটা এইজন্যে বলছি যে, আপনার সন্দেহ তো ছিল আপনার স্ত্রীর সঙ্গে বাইরের লোকের সম্পর্ক নিয়ে, ইন ফ্যাক্ট বিয়ের সঙ্গে-সঙ্গেই তাই বাইরের জগতের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগের সমস্ত রাস্তাই আপনি বন্ধ করে দেন। …কী, আমি কি ভুল বলছি?”
“না, আপনি ঠিকই বলছেন। প্লিজ প্রসিড।”
“ফলে আপনার স্ত্রীর অবস্থা দাঁড়ায় হারেমের বন্দিনির মতো। তিনি যে বাইরে যেতে পারতেন না তা নয়। কিন্তু সঙ্গে থাকত নজরদার। তিনি বাইরে কাউকে চিঠি লিখলে সে-চিঠি সম্ভবত ডাক-বাক্সের বদলে আপনার হাতে গিয়ে পৌঁছত, এবং সম্ভবত নিক্ষিপ্ত হত আপনার ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। বাইরে থেকে কেউ ওঁকে কোনও চিঠি লিখেছিল কি না বলা সম্ভব নয়। যদি-বা লিখে থাকে, সে-চিঠি ওঁর হাতে যাতে না-পৌঁছয়, সম্ভবত তারও ব্যবস্থা আপনি করে রেখেছিলেন। বাকি রইল ফোন। তা না ছিল ওঁর মোবাইল, না ডিরেক্ট লাইন। ফোন করতে হত পি বি এক্সের মাধ্যমে। মজা এই যে, বিয়ের পরে উনি বাইরের কোনও কল কখনও রিসিভ করেননি, আবার নিজে যখনই বাইরের কাউকে ফোন করার চেষ্টা করেছেন, পি বি এক্স থেকে ওঁকে বলা হয়েছে, লাইন এনগেজড, নয়তো আউট অব অর্ডার, নয়তো দিস লাইন ডাজ নট এগজিস্ট, নয়তো নো রিপ্লাই। অর্থাৎ আপনার প্ল্যান সফল, বিয়ের পরে বাইরের কারও সঙ্গে ওঁর কোনও সম্পর্ক থাকবে না, এটাই তো আপনি চেয়েছিলেন। তো তা-ই হল। থিয়েটার রোডের বাড়ির বাইরে কারও সঙ্গে ওঁর আর কোনও সম্পর্ক রইল না। …এখন বলুন মিঃ মিত্র, যাঁকে আপনি ঘরের মধ্যে আটকে ফেলেছেন, তাঁর চরিত্র নিয়ে তবু সন্দেহ করতেই থাকবেন, আপনি কি এতই বোকা লোক?
ধনঞ্জয় মিত্র একেবারে নির্বাক হয়ে শুনছিলেন, একটি শব্দও তাঁর মুখ থেকে বার হল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাইও। তারপর বললেন, “অথচ, চরিত্র নিয়ে সন্দিগ্ধ হবার কোনও কারণ না-ই থাক, সন্দেহ আপনার একটা ছিলই। তা যদি না-ই থাকবে তো শান্তিলতা আপনাদের থিয়েটার রোডের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে তাঁর পিছনে আপনি গোয়েন্দা লাগিয়ে দিলেন কেন? সন্দেহটা তা হলে কী নিয়ে? টাকাকড়ি? গয়নাগাটি? সম্পত্তি? কিন্তু না, তা নিয়ে সন্দেহ করারও তো কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। টাকাকড়ির কথাই ধরা যাক। শান্তিলতার ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্টে আপনি পঁচিশ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন। তা সেই পঁচিশ লাখ টাকার সবটা কিংবা তার একটা অংশ উনি ইতিমধ্যে অন্য কারও নামে ট্রান্সফার করেছেন কি না, তা জানা কি খুব শক্ত? বিশেষ করে আপনার মতো প্রতিপত্তিশালী লোকের পক্ষে? বলুন, শান্তিলতার অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে ব্যাঙ্কে কি আপনি হালে কোনও খোঁজ নেননি? চুপ করে থাকবেন না, মিঃ মিত্র, আমার প্রশ্নের জবাব দিন।”
ধনঞ্জয় মিত্র মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। মাথা না তুলেই বললেন, “হ্যাঁ, খোঁজ নিয়েছিলুম।”
“এবং খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন যে, সেই পঁচিশ লাখের একটি পয়সাও শান্তিলতা ইতিমধ্যে তুলে নেননি। টাকার অঙ্কটা যা ছিল, ঠিক তা-ই আছে, কেমন?”
“হ্যাঁ।”
“বাকি রইল গয়নাগাটি আর সম্পত্তি। তা গয়নাগাটির চোদ্দো আনাই থাকে আপনাদের বাড়ির নিজস্ব লকারে, আর তার চাবি থাকে আপনারই কাছে। বাকি দু’আনা আলমারি থেকে উনি নিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু তাও উনি নিয়ে আসেননি। এমনকি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় আলমারির চাবিটা পর্যন্ত আপনাকে দিয়ে এসেছিলেন। আর সম্পত্তি? অস্থাবর সম্পত্তি বলতে আপনি ওঁকে কিছু গয়না, একটা মাতিজ গাড়ি, আর হ্যাঁ…ওই পঁচিশ লাখ টাকা দিয়েছেন। আর স্থাবর সম্পত্তি বলতে একটা ফ্ল্যাট। তা ছাড়া কোথাও কোনও বাড়ি কি জমি দিয়েছেন নাকি?”
“না।”
“ম্যাক্রো বিল্ডার্স কি অন্য কোনও কোম্পানির শেয়ার?”
“না।”
“অর্থাৎ তেমন-কিছু দেননি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “স্রেফ একটা ছোট গাড়ি, কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট আর পঁচিশ লাখ টাকা। আপনার মতো বিত্তবান লোকের পক্ষে যা নেহাতই হাতের ময়লা ছাড়া কিছু নয়।”
বুকের কাছে ঝুঁকে থাকা মাথাটা এবারে একটু তুলে, ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে, ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “কিন্তু ও তো আর-কিছু কখনও চায়ওনি।”
“চাননি, চাইবেনও না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “উনি নিজেই সে-কথা আমাকে বলেছেন। বলেছেন যে, যা পেয়েছেন, তাতেই উনি খুশি। অ্যান্ড আই বিলিভ হার। এবং একই সঙ্গে আমি বিশ্বাস করি যে, আপনিও তা জানেন। …কী মিঃ মিত্র, চুপ করে রইলেন কেন, জানেন না?”
অস্ফুট গলায় ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “জানি।”
“রাইট।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি জানেন বলেই আমি অনুমান করেছিলুম। ফলে, ঘুরেফিরে সেই একই প্রশ্ন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রশ্নটা কী? না কোনও ব্যাপারেই যখন শান্তিলতাকে সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই, তখন আপনি এইভাবে ওঁর পিছনে রাউন্ড দ্য ক্লক গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছেন কেন?”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। নতুন একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, “বড় কঠিন প্রশ্ন। শনিবার আমি এর উত্তর পাইনি। রবিবারও না। তারপর সোমবার সকালে একেবারে হঠাৎই একটা সম্ভাবনার কথা উকি মারে আমার মাথায়। আমার মনে হয়, এমনও তো হতে পারে যে, শান্তিলতার ক্ষতি করার জন্য নয়, বরং কেউ যাতে ওঁর কোনও ক্ষতি করতে না পারে, সেটা দেখার জন্যেই আপনি ওঁর পিছনে লোক লাগিয়ে রেখেছেন। বাস, কথাটা মনে হবার সঙ্গে-সঙ্গেই ছবিটা আমার চোখের সামনে পালটে যায়।”
এতক্ষণে সিধে হয়ে বসলেন ধনঞ্জয় মিত্র। হাসলেন। বললেন, “সত্যি আমি ভয় পেয়েছিলুম যে, শান্তির উপরে একটা আঘাত আসতে পারে। লোক লাগিয়েছিলুম সেটা ঠেকাবার জন্যে, বিপদ ঘটলে শান্তিকে রক্ষা করার জন্যে। কিন্তু যে গোয়েন্দা এজেন্সির সাহায্য আমি নিয়েছিলুম, শনিবার রাত বারোটায় যখন তারা আমাকে জানায় যে, রয়্যাল চায়না রেস্তোরাঁয় শান্তিলতা আপনার সঙ্গে দেখা করেছে, আর আপনিও সম্ভবত সাহায্য করছেন ওকে, তখন আমার ভয় অনেকটাই কেটে যায়। আমার মনে হয়, আপনি ঠিকই বুঝতে পারবেন যে, সমস্যাটা আসলে কী।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “থ্যাঙ্ক য়ু ফর সেয়িং দ্যাট। কিন্তু, মিঃ মিত্র, তখন আবার একটা নতুন প্রশ্নের সামনে এসে আমি দাঁড়ালুম। কে শান্তিলতার ক্ষতি করতে পারে? ওঁর উপরে কার রেগে থাকা সম্ভব? ওঁর অতীত ইতিহাসের যেটুকু আমি জানি, তার কিছুটা উনি নিজেই আমাকে বলেছেন আর কিছুটা আমাকে প্রশ্ন করে-করে জানতে হয়েছে। তাতে দু’জনের নাম পাই। যুগল চৌধুরি আর কল্যাণ রায়। তা উনিও বলেছেন আর আমিও মনে করি যে, যুগলের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক একেবারেই নিরামিষ। কিন্তু কল্যাণ সম্পর্কে তা বলা যাচ্ছে না। তার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক কিছুটা…এই মানে দু’চারখানা চিঠি-লেখালিখি পর্যন্ত…গড়িয়েছিল। যুগলকে রুল আউট করলেও তাই কল্যাণকে আমি ছাড় দিতে পারিনি। তখন ভাবতে থাকি যে, কীভাবে তার পক্ষে শান্তিলতার ক্ষতি করা সম্ভব। সে কি শান্তিলতাকে একলা কোথাও পেলে বোমা কিংবা অ্যাসিড বাল্ব ছুড়বে? কিন্তু ও-সব কাজ তো হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ছেলে-ছোকরারা করে। একজন মধ্যবয়সী বিবাহিত লোক কি তা করবে? মনে তো হয় না। তা ছাড়া তাতে ঝুঁকি আছে। তা হলে? কীভাবে সে তা হলে ক্ষতি করবে শান্তিলতার? একটু ভাবতেই আমার মনে হয় যে, সে ব্ল্যাকমেল করতে পারে। তাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি তো নেই-ই, বরং লাভের সম্ভাবনা আছে ষোলো আনা। কল্যাণ রায় অতএব ব্ল্যাকমেলিংয়ের রাস্তা ধরে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “ব্ল্যাকমেলিং? আরে ছ্যাছ্যা, এ তো দেকচি মহা নচ্ছার লোক!”
আমি বললুম, “এই সম্ভাবনার কথাটা প্রথম কখন আপনার মাথায় আসে?”
‘সোমবার দুপুরে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিকেলে যখন কৌশিকের কাছে কল্যাণ রায়ের বাড়ির দোতলার বর্ণনা শুনি, তখন সন্দেহটা আরও জোর পায়। ভাবি যে, লোকটা তো একটা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানির কর্মচারী মাত্র, মালিক নয়, জাস্ট একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ। অন্তত সেই পরিচয়টাই তার ভিজিটিং কার্ডে লেখা রয়েছে, তো তা-ই যদি হয় তো দোতলাটাকে এত রাজসিকভাবে সাজাবার মতো টাকা সে কোত্থেকে পায়। কেন, টাকা পাবার উপায় তো তার হাতেই রয়েছে। শান্তিলতার লেখা চিঠি। তা শান্তিলতা এখন বড়লোকের বউ। কল্যাণ যদি তাকে ভয় দেখায় যে, চিঠির কথা সে ফাঁস করে দেবে, কেলেঙ্কারির ভয়ে শান্তিলতা কি তা হলে বেশ কিছু টাকা তাকে দিয়ে দেবে না? আমার ধারণা, বিয়ের পরে-পরেই সে শান্তিলতার সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করেছিল। হয় ফোন করে, নয়তো চিঠি লিখে। কিন্তু শান্তিলতা তো তখন কড়া পাহারার মধ্যে রয়েছেন। বাইরে থেকে কেউ ফোন করলে কলটা তিনি রিসিভ করতে পারেন না, বাইরের চিঠিও দেওয়া হয় না তাঁকে। কল্যাণ অগত্যা সরাসরি মিঃ মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অবশ্য এইসবই আমার অনুমান। তবে অনুমানটা সম্ভবত ভুল নয়। কী মিঃ মিত্র, কল্যাণ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি? আপনার বউয়ের লেখা প্রেমপত্র ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে আপনার কাছে টাকা চায়নি?”
ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “আপনার গেসওয়ার্ক ভুল নয়। সে যোগাযোগও করেছিল, টাকাও চেয়েছিল।”
“এবং পারিবারিক সম্মানরক্ষার তাগিদে বেশ কিছু টাকা তাকে আপনি দিয়েওছেন। তা-ই না?”
“তা দিয়েছি।” ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “তবে পারিবারিক মর্যাদা আর আমার স্ত্রীর সম্মানরক্ষার মূল্য হিসেবে টাকার অঙ্কটা তত বড় নয়। এক-এক দফায় পাঁচ লাখ করে দু’দফায় মোট দশ লাখ।”
“প্রথম দফার পাঁচ লাখ কবে দিয়েছিলেন?”
“ইয়ার বিফোর লাস্ট। নাইন্টিনাইনে।”
‘সেই টাকা দিয়েই সে দোতলাটাকে অমন রাজসিকভাবে সাজিয়েছে। আর দ্বিতীয় দফার পাঁচ লাখ? ওটা কবে দিলেন?”
“কিছুদিন আগে।” ধনঞ্জয় মিত্র একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “গত ফেব্রুয়ারি মাসে।”
“তার সাড়ে চার লাখ কল্যাণের বাড়ির দোতলার মেঝের ফোকর থেকে উদ্ধার করে থানায় জমা দেওয়া হয়েছে আর আড়াই হাজার পাওয়া গেছে কল্যাণ রায়ের জামার পকেটে। …ও হ্যাঁ, ফোকরে কিছু গয়নাও পাওয়া যায়। আপনি দিয়েছিলেন?”
“না তো। আমি শুধু ওই দশ লাখই দিয়েছি।”
“তা হলে ওটা আর-কোনও পার্টিকে ব্ল্যাকমেল করে পাওয়া। সম্ভবত তার অতীত জীবনের অন্য কোনও মহিলার কাছ থেকে।”
“একটা কথা না-জানিয়ে পারছি না।” ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “রাস্কেলটা বলেছিল যে, তার কাছে শান্তিলতার দুখানা চিঠি আছে, পাঁচ লাখ টাকা পেলেই সে চিঠি দুখানা ফেরত দেবে। আমি সেক্ষেত্রে পাঁচ লাখের জায়গায় দশ লাখ দিয়েও চিঠি দুখানা ফেরত পাইনি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “চিঠির কথায় পরে আসব। তার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। কল্যাণ রায়ের দাবির টাকাটা কি আপনি যুগল চৌধুরির হাত দিয়ে পাঠাতেন?”
“আপনি জানলেন কী করে?”
“অনুমান, মিঃ মিত্র, অনুমান।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “শান্তিলতার অনুরোধে আপনি ট্র্যাভল স্টারের ম্যানেজমেন্টকে বলে সেখানে ওর চাকরি করে দিয়েছিলেন। আবার বোকামি করে সেখানে যখন চাকরিটা ও খোয়াল, তখন তাকে রক্ষা করার কোনও চেষ্টাই আপনি করলেন না। : আমার তো মনে হয়, যেমন তার চাকরি পাবার, তেমন তার চাকরি যাবার পিছনেও আপনার হাত ছিল।”
ধনঞ্জয় মিত্র চমকে উঠে বললেন, “এ কথা কেন বলছেন?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “বলছি এইজন্যে যে, ওখানে ওর চাকরি না-গেলে তো ওকে আপনি নিজের কাজে লাগাতে পারতেন না। শান্তিলতার কাছে শুনেছিলেন, তা ছাড়া আপনি নিজেও বুঝে গিয়েছিলেন যে, ও প্রেমিক নয়, আসলে ও ছিল শান্তিলতার মোস্ট ওবিডিয়েন্ট ডগ। তা ও-রকম একটি ভক্ত কুকুর তো আপনারও চাই। তাই ওকে আপনি নিজের কাছে টেনে নিলেন। তাতে ওরও সুবিধে হল। বেহালা বাজায়, দল করেছে, দল নিয়ে মাঝেমধ্যে বাইরে যেতে হয়, দশটা-পাঁচটার চাকরি ওর পোষাবে কেন। এখন দিব্যি আছে, চাকরি বলতে শুধু মাঝেমধ্যে আপনার ফরমাশ খেটে দেওয়া, বাস। শান্তিলতা অবশ্য এ-সব কথার বিন্দুবিসর্গও জানেন না। …যা-ই হোক, এখন একটা কথা বলি। শান্তিলতার কাছে শুনলুম, আমার সাহায্য নেবার পরামর্শ নাকি যুগলই ওঁকে দিয়েছিল। কিন্তু আমার ধারণা, আপনিই যুগলকে বলে দিয়েছিলেন যে, শান্তিলতাকে সে যেন এই পরামর্শ দেয়। …কী, এটাও ঠিক বলছি তো?”
“আপনার একটা কথাও বেঠিক নয়।” ধনঞ্জয় বললেন, “কিন্তু এতসব আপনি জানলেন কী করে?”
“উত্তরে তো সেই একই কথা ফের বলতে হয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অনুমান, সবই আমার অনুমান। তবে হ্যাঁ, একই সঙ্গে এটাও বলব যে, একটা অনুমানও যুক্তিহীন নয়। …কিন্তু ও-সব ছেড়ে এখন আসল কথায় আসা যাক। আসল কথাটা কী? না কল্যাণ রায়কে যে তার বড় শালাই খুন করেছে, তা আমি আন্দাজ করলুম কী করে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “হ্যাঁ, সেটাই শুনি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “পুলিশ প্রথম থেকেই ধরে নিয়েছিল, এটা টাকার জন্যে খুন নয়। কেন নয়? না নিহত কল্যাণ রায়ের পকেটে আড়াই হাজার টাকা ছিল, খুনি সেটা নেয়নি। এই যে যুক্তি, এটা ভাল লাগেনি আমার। তখনও অবশ্য আমি সিদ্ধান্ত করিনি যে, এটা টাকার জন্যে খুনই বটে। সেটা সম্ভবও ছিল না। শুধু ভাবছিলুম যে, পুলিশের এত ওয়ান-ট্র্যাক মাইন্ড কেন, এটা মার্ডার ফর মনিটারি গেইন না-ই হতে পারে, কিন্তু হতেও যে পারে, এত তাড়াতাড়ি এই সম্ভাবনাটাকে তারা কেন রুল আউট করছে। পরে দুটো কথা শুনি। এক, একটা দামি বিদেশি গাড়ি এসে খুনের জায়গায় ঘোরাফেরা করছে। দুই, নিহত কল্যাণ রায়ের বাড়ির দোতলার বর্ণনা, যা শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক, কল্যাণ রায় রীতিমত পয়সাওয়ালা লোক। তা পয়সাওয়ালা লোকেরা পয়সার জন্যেই খুন হবে, এটা তো কিছু বিচিত্র ব্যাপার নয়, এমন খুন হামেশা হচ্ছে। তখন প্রশ্ন জাগে যে, কল্যাণ রায় তো একটা কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ মাত্র, এত রাজসিকভাবে বাড়ি সাজাবার পয়সা সে কোথায় পেল? সে কি টাকা ছাপে? নাকি সে স্মাগলার? নাকি কনম্যান, মানে ঠকবাজ? নাকি তোলাবাজ? নাকি লোককে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করে? ভাবতে-ভাবতেই মনে পড়ল যে, বিয়ের আগে শান্তিলতা তাকে খান দুই চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠি ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে সে টাকা আদায় করত না তো? কার কাছ থেকে আদায় করত? শান্তিলতার কাছ থেকে? কিন্তু তা কী করে হবে? বিয়ের পরে তো শান্তিলতার সঙ্গে কল্যাণের কোনও যোগাযোগই হয়নি। তা হলে কি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে? সেটা তো অসম্ভব নয়।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “মিঃ মিত্র, নিহত কল্যাণ রায়ের পকেটে শুধু আড়াই হাজার টাকাই ছিল না, একটা চিরকুটও ছিল। তাতে ছিল দুটি নামের আদ্যক্ষর। একট যুগলের, একটি শান্তিলতার। আমার সন্দেহের তালিকাতেও ছিল শান্তিলতার নাম। সেটা কেটে দিয়ে এবার সেখানে আমি আপনার নাম বসাই। তার কারণ, আমি অনুমান করি, সত্যি যদি এটা ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায়ের ব্যাপার হয়, তো সে-টাকা শান্তিলতা দিতেন না, দিতেন আপনি। কিন্তু একজন ব্ল্যাকমেলারের সঙ্গে নিজে কথা বলবেন, কিংবা নিজে গিয়ে তাকে টাকা দেবেন, এমন কাঁচা মানুষ তো আপনি নন। একে তো সেটা নিরাপদ নয়, তার উপরে আবার আপনার আত্মমর্যাদার পক্ষেও সেটা হানিকর। কল্যাণের সঙ্গে কথা বলার ভার তা হলে আপনি কাকে দিয়েছিলেন, আর তাকে টাকাটাই বা কার হাত দিয়ে পাঠাতেন? নিশ্চয়ই যুগল চৌধুরি। তা নইলে আর কল্যাণের চিরকুটে যুগলের নামের আদ্যক্ষর আসবে কেন?”
ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “য়ু আর আ ভেরি ক্লেভার ম্যান, মিঃ ভাদুড়ি। কিন্তু থামলেন কেন? বলে যান।”
“বলছি।” ভাদুড়িমশাই ফের বলতে শুধু করলেন তাঁর কথা। “কল্যাণ কার কাছ থেকে টাকা পেত, তা তো আন্দাজ করা গেল। অতঃপর প্রশ্ন, খুনি কে? মিঃ মিত্র, একটু আগে আপনি বলেছেন যে, টাকা দিয়েও আপনি চিঠি ফেরত পাননি। টাকা যে আপনিই দিতেন, তা আমি আন্দাজ করেছিলুম ঠিকই, তবে নিশ্চিতভাবে তা তখনও জানতুম না। তবে এটা জানতুম যে, যেই টাকা দিক, চিঠি দুটো ফেরত দিলেই সে তো ছাড়া পেয়ে গেল, ফলে তার কাছ থেকে ভবিষ্যতে আরও আরও টাকা পয়সা পাওয়ার পথটাও বন্ধ হয়ে গেল। কোনও ব্ল্যাকমেলারই তার শিকারকে তাই ছাড়ে না, বড়শিতে আটকে রাখে। তাই আমার সন্দেহ হয় যে, আপনিই যদি কল্যাণকে টাকা দিচ্ছেন তো আপনিও নিশ্চয় চিঠি ফেরত পাননি, আর লোকটার হাত থেকে কখনও যে আপনি ছাড়া পাবেন না সেটা বুঝে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়তো ছাড়া পাবার একমাত্র উপায় হিসেবে…”
ভাদুড়িমশাই কথাটা শেষ করলেন না। ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “বুঝেছি। আপনার সন্দেহ হল যে, আমিই কল্যাণকে খুন করেছি। এই তো?”
“আরে না না, আপনি খুন করবেন কেন? আপনার মতন লোকেরা যে নিজের হাতে কাউকে খুন করেন না, তা আমি বিলক্ষণ জানি। খুন যদি করতেই হয় তো আপনারা অন্যদের দিয়ে সেই জঘন্য কাজটা করান। পুলিশকে আমি সেই কথাই বলতুম। আর একই সঙ্গে বলতুম, ওই যে ফল্স নাম্বার প্লেট লাগিয়ে একটা বিদেশি গাড়ি ওই রাস্তায় এসে ঢুকেছিল, তার মালিককে খুঁজে বার করতে। ওটা তো আপনারই গাড়ি, তা-ই না?”
“হ্যাঁ।” ধনঞ্জয় বললেন, “যে-লোকটা আমার গলায় গামছা দিয়ে টাকা নিচ্ছিল, সে খুন হয়েছে। খুনটা আমি করিনি। কিন্তু যে-ই করে থাক, আমার কাছে এটা তো ষাঁড়ের শত্রু বাঘে খাওয়ার ঘটনা। কাগজে খবরটা পড়ে খুশি হইনি বললে মিথ্যে বলা হবে। একটু কৌতুহলও হয়েছিল। তাই মার্সিডিজটা নিয়ে আমিই ওখানে যাই। ওটা কাঁচা কাজ হয়ে গেসল।”
“খুবই কাঁচা কাজ। শহরে ক’টাই বা মার্সিডিজ আছে বলুন। পুলিশ ঠিকই বুঝে ফেলত।”
“ওই নিয়ে আবার কোনও ফ্যাসাদে পড়ব না তো?”
“পড়তেই পারতেন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু আপনি ভাগ্যবান ব্যক্তি, তাই সোমবার রাত্তিরে কৌশিকের একটা কথা শুনে আমার নজর হঠাৎ আপনার দিক থেকে অন্য দিকে ঘুরে যায়। আমি বুঝতে পারি, খুনিটি কে।”
“খুনি তো কল্যাণের বড় শালা!”
“তা তো বটেই। কিন্তু সেটা অনুমান করলুম কী করে? না কৌশিকের একটা কথা শুনে। কথাটা কী? না সোমবার দুপুরে কৌশিক যখন কল্যাণ রায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল, তখন সে স্যান্ডো গেঞ্জি পরা একজন লোককে বাইরে থেকে বাড়িতে ঢুকতে দ্যাখে। লোকটার গায়ে পাঞ্জাবি কি শার্ট ছিল না। তার আগে কল্যাণ রায়ের ছোট শালার একটা কথা শুনে কৌশিকের মনে হয়েছিল যে, সে তার দাদার ফেরার অপেক্ষায় আছে। আর কৌশিকের মুখে এই খবর শুনে আমি ভাবতে থাকি, দাদাটি তা হলে কোথায় ছিল, কতক্ষণ ছিল, আর সেই সঙ্গে এটাও ভাবি যে, বেশ কিছুক্ষণ যদি সে বাড়ির বাইরে কাটিয়ে থাকে, তা হলে সে যখন বাড়িতে ফিরে এল, তখন তার গায়ে জামা ছিল না কেন?”
আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “মনে-মনে আমি ব্যাপারটাকে সাজিয়ে নিতে থাকি। কল্পনায় রিকনস্ট্রাকট করতে থাকি খুনের দৃশ্যটাকে। ভাবতে থাকি, এমনও তো সম্ভব যে, টাকার লোভে এই লোকটাই তার ভগ্নিপতিকে খুন করেছে। খুনটা যেন আমি চোখের সামনে দেখতে পাই। পিছন থেকে ডাণ্ডা মারল কল্যাণ রায়ের মাথায়, সঙ্গে-সঙ্গে রক্ত ছিটকে এসে খুনির জামায় লাগল। তারপর? রক্তমাখা জামা গায়ে সে বাড়ি ফিরবে কী করে? তা হলে কি সেইজন্যেই সে জামাটা কোথাও কাচতে দিয়ে গোটা রাতটা বাইরে কাটিয়ে পরদিন দুপুরে যখন বাড়ি ফেরে, তখন তার গায়ে জামা ছিল না? শোভনকে যে আমি একটা জামার খোঁজ করতে লোক লাগাতে বলেছিলুম, সে তো এইজন্যেই। তা সেই রক্তমাখা জামা পাওয়া গেছে।”
কৌশিক বলল, “শোভন চৌধুরি লালবাজার থেকে মামাবাবুকে ফোন করেছিলেন। বললেন যে, জেরার মুখে আসামি ভেঙে পড়ে। সে তার দোষ স্বীকার করেছে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা এই হচ্ছে ব্যাপার। ও হ্যাঁ, একটা কথা জানাই। নিহত কল্যাণ রায়ের পকেট আর বাড়ি থেকে যত কারেন্সি নোট উদ্ধার হয়েছে, তার প্রত্যেকটির এক কোণে খুদে অক্ষরে লেখা রয়েছে এম বি। ওটা বোধহয় ম্যাক্রো বিল্ডার্স। প্রমাণ দিলে টাকাটা ফেরত পাওয়া যাবে।”
ধনঞ্জয় মিত্র বললেন, “টাকা ফেরত চাই না। যা ফেরত পাবার দরকার ছিল, তার কী হবে?”
“চিঠির কথা বলছেন তো?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “গয়নাগাটি আর একগাদা কারেন্সি নোটের সঙ্গে দুখানা চিঠিও ও-বাড়ির সেই ফোকরের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। শোভন চৌধুরির অলক্ষ্যে সে-দুটি আমি সরিয়ে ফেলি। তবে তা আর আপনাকে ফেরত দেওয়া যাবে না।”
“কেন?”
“ও-সব চিঠি নিজেও রাখতে নেই, কাউকে দিতেও নেই। পুড়িয়ে ফেলতে হয়। আমি পুড়িয়ে ফেলেছি।”
সদানন্দবাবু বারবার তাঁর হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। অনুচ্চকণ্ঠে বলেই ফেললেন, “এগারোটা বাজে।”
ভাদুড়িমশাই শুনতে পেয়েছিলেন। হেসে বললেন, “ভয় নেই, পরপর দু’রাত জাগার ইচ্ছে নেই আমারও। চলুন, ওদিককার বারান্দা থেকে মেয়েদের তাড়া দিয়ে এবারে বাড়ি ফেরা যাক।”
***
রচনাকাল : ১৪০৮