৫.
—সর্বনাশ। এই তবে হত্যাশস্ত্র! এই তীব্র বিষ মাখানো সুই ফুটিয়েই হত্যা করা হয়েছে ব্রাহ্মণকে!
বলে উঠলেন রাজবৈদ্য। উত্তরে চাণক্য বললেন,
—হুমম। আপাতত তাই মনে হচ্ছে। তবে বিষয়টা অদ্ভুত। বৈদ্য মহোদয়, আপনি দয়া করে আর একবার মৃতদেহ খুঁজে দেখুন। সুই ফোটানোর দাগ চোখে পড়লেও পড়তে পারে। তবে আমি এখনও খাবারে বিষ থাকার সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিচ্ছি না। মহা-অমাত্য মহোদয়, ওই অভুক্ত খাবারগুলো তো বোধ হয় এখনও পরীক্ষা করে দেখা হয়নি?
—আজ্ঞে না, আচার্য। কাল রাতেই খাদ্য-পরীক্ষক খেয়ে দেখেছে….. তাই….
উত্তর দিলেন অমাত্য কৃষ্ণনাথ। চাণক্য বললেন,
—আপনি এখুনি একটা পাখি আনার ব্যবস্থা করুন। খাবারটা আরও একবার আমি নিজে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে চাই।
—কিন্তু আচার্য, এই শলাকাটা যখন পাওয়া গিয়েইছে, তখন আর খাবার পরীক্ষা করার কি প্রয়োজন আছে?
—হয়তো নেই। তবু সব ধরনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে নেয়া উচিত। বিশেষ করে, খাবারগুলো ইতিমধ্যে ফেলে না দেয়ায় সে-সুযোগ যখন আমরা পাচ্ছি। সঙ্গে পানীয় জলও পরীক্ষা করতে হবে।
একটু বাদেই এক সৈনিক আরও একটা কাকোরা এনে হাজির করল। চাণক্য সেটাকে নিয়ে, থালা রাখা মেজটার দিকে এগিয়ে গেলেন। অমাত্যর দিকে ফিরে বললেন,
—একটা ছুরি নিয়ে আসতে বলুন ভৃত্যকে।
—ছুরি নেই ওখানে? ছিল তো রাতে একটা।
—আপাতত দেখছি না।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বহুক্ষণ থেকেই অমাত্যর ওপর ক্ষুণ্ন হয়ে ছিলেন। এইবার বিরক্তিটা প্রকাশ করে ফেললেন। বিরক্তি মেশানো গলায় বললেন,
—আপনি অকারণে এত বাক্যব্যয় করেন কেন? ছুরি নেই দেখেই তো আচার্য চাইছেন। এক্ষুনি একটা এনে দিন!
কৃষ্ণনাথ দ্রুত বেরিয়ে গেলেন ছুরি আনতে। চাণক্য একবার বৃদ্ধ বৈদ্যর দিকে তাকিয়েছিলেন। আপাতত তিনি মৃতদেহ পরীক্ষা করতে মগ্ন। তারপর চন্দ্রগুপ্তর উদ্দেশে চাপা গলায় বললেন,
—ক্রোধো বৈবস্বতো রাজা। অর্থাৎ ক্রোধ সাক্ষাৎ যমের অন্য নাম, চন্দ্রগুপ্ত। আপৎকালে একমাত্র মূর্খরা ক্রোধের আশ্রয় খোঁজে। বিপদে ধৈর্য হারানো সাধারণ মানুষের সাজে, কিন্তু একজন সম্রাটের কদাপি নয়। মহা- অমাত্য বয়োজ্যেষ্ঠ। ওঁকে এইভাবে বলাটা তোমার শোভা পায় না।
মাথা নীচু করে চন্দ্রগুপ্ত বললেন,
—আচার্য, ক্ষমা করবেন। আসলে…
—আমি তোমার উদ্বেগ বুঝতে পারছি চন্দ্রগুপ্ত। ঠান্ডা হও। জল ঠান্ডা বরফ হলে তবেই শক্ত থাকতে পারে। এতদপি গমিষ্যতি। এই বিপদও সময়ের সঙ্গে কেটে যাবে। বিশ্বাস রাখো।
এই মুহূর্তে একটা ছুরি হাতে ঘরে ঢুকলেন কৃষ্ণনাথ। ধন্যবাদ দিয়ে চাণক্য সেটা নিলেন। রুটির ডান দিক থেকে খাওয়া হয়েছে। আচার্য উলটো দিক থেকে ছোট্ট একটা টুকরো কেটে ছুড়ে দিলেন পাখিটার দিকে। তার চোখের রঙে কোনো পরিবর্তন আসে কি না লক্ষ করলেন। কিন্তু কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। এরপর একে একে বাকি খাবার এবং ফলগুলোও অল্প অল্প টুকরো কেটে চাণক্য পাখিটার দিকে এগিয়ে দিলেন। সবশেষে পানীয় জলের কলসি থেকে সামান্য জলও দেয়া হল। সকলে অধীরভাবে প্রতীক্ষা করছিলেন যে প্রাণীটির মধ্যে বিষক্রিয়ার কোনো ইঙ্গিত দেখা যায় কি না। ইতিমধ্যে একটা পাখির প্রাণ গেছে। আশঙ্কা ছিল যে বিষ পরীক্ষা করতে আরও একটা নিরীহ প্রাণীর প্রাণ যায়। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে গেলেও সেরকম কিছুই হল না। চাণক্যও শেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন। তবে এক ভৃত্যকে আজ সূর্যাস্ত অবধি নজর রাখতে বললেন এই পাখিটার ওপর।
ততক্ষণে রাজ-বৈদ্য মৃতদেহ পরীক্ষা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। চাণক্য তাঁকে প্রশ্ন করলেন,
—কিছু পেলেন মহোদয়?
দু-পাশে মাথা নেড়ে বৃদ্ধ উত্তর দিলেন,
—না। যদিও আমি আশাও করিনি খুঁজে পাব। কারণ ওই ছোটো শলাকার ক্ষত চোখে না পড়াই স্বাভাবিক। রক্তপাতও সামান্যই হবে, যা প্রায় না হওয়ার মতো। বিষটা যে তীব্র সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। সামান্য ক্ষতেই মৃত্যু হয়েছে।
—হুমম।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এইবার মুখ খুললেন,
—গুরুদেব, তাহলে বাইরে থেকে হত্যাকারী প্রবেশ করেছিল বলেই ধারণা করা যায়। তাই না?
—হুমম। সব কিছু তো সেইরকমই ইঙ্গিত করছে, সম্রাট। খাবারে ও পানীয়তে যে বিষ নেই, তা প্রমাণিত। এর ফলে, গান্ধারের পাচক এবং খাদ্য-পরীক্ষককে সন্দেহ করার অবকাশ থাকে না। এই হত্যাকাণ্ডে তারা নিজেদের সম্পূর্ন নির্দোষ বলে দাবি করবে এবং গান্ধার অভিযোগের আঙুল আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে তুলবে। সঙ্গে আবার ওই ভূলুণ্ঠিত জলের পাত্র থেকে অনুমান করা যায় যে হত্যাকারীর সঙ্গে ধস্তাধস্তিতেই সম্ভবত সেটা উলটে গেছে।
—কিন্তু, বাইরে থাকা প্রহরীরা কিছু শোনেনি?
—ব্রাহ্মণ হয়তো চিৎকার করার সুযোগ পায়নি। মুখ চেপে ধরে যদি ওই শলাকা বিধিয়ে দেয়া হয়ে থাকে, তবে তাঁর তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে। প্রহরীদের প্রশ্ন করে হয়তো কিছু তথ্য জানা যাবে, সম্রাট। কালকে রাতে দরজায় এবং এই মহলের ছাদে পাহারায় থাকা সৈনিকদের একে একে সভাঘরে আসতে বলুন। আমি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই। তারপর গান্ধার থেকে আসা সেই দুই ভৃত্যকেও আসতে বলুন।
ঘর থেকে বেরোনোর আগে মৃতদেহর দিকে ফিরে চাণক্য করজোড় করে মৃতের আত্মার শান্তি কামনায় মন্ত্রপাঠ করলেন। মৃতদেহ সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
৬.
সভাঘরে এই মুহূর্তে চাণক্য, চন্দ্রগুপ্ত, মহা-অমাত্য এবং রাজ-বৈদ্য ছাড়া আর কেউ নেই। অমাত্য চাণক্যর নির্দেশমতো জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে সন্দেহভাজনদের হাজির করছেন। সভায় প্রবেশ করল দুই সৈনিক। কৃষ্ণনাথ তাদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন,
—অতিথিদের ঘরের দরজার বাইরে, গতকাল রাতে পাহারায় ছিল এই দুই সৈনিক।
দু-জন সৈনিক সভাঘরে ঢুকেই সবার আগে সম্রাট আর চাণক্যকে প্রণাম করল। তাদের অভিবাদন গ্রহণ করে চাণক্য সরাসরি প্রশ্নে চলে গেলেন,
—তোমাদের নাম?
—আমি সিদ্ধান্তক এবং আমার সঙ্গী কৃষাণ।
—কত বছর হল বাহিনীতে কাজ করছ?
একজন বলল,
—আমার পাঁচ হল, আচার্য। তিন বছর আগে ভালো কাজের জন্য আমায় রাজমহলের প্রহরী নিযুক্ত করা হয়।
—আর তুমি?
দ্বিতীয়জন উত্তর দিল,
—আমার চার বছর হল। আমি গত বছরই রাজমহলে নিযুক্ত হয়েছি।
—হুমম। সম্ভবত তোমরাই কাল রাতে ব্রাহ্মণ শুকদাসকে শেষবার দেখেছিলে?
—হ্যাঁ, আচার্য।
—শেষ কখন দেখেছিলে?
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর উনি যখন দরজা দেন, সেইসময়ে। সন্ধের দিকেই। রাত দ্বিতীয় প্রহর শুরুর ঘণ্টা বাজার আগেই। আমাদের সামনেই উনি দরজা বন্ধ করে, ভেতর থেকে তাতে খিল দেন।
—আর রাতে একবারও উনি দরজা খোলেননি বা তোমাদের ডাকেননি? দু-জনেই জানাল,
—না, আচার্য।
—কেউ কি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?
—না, আচার্য।
—কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছ? রাতে তোমরা একবারও পাহারা ছেড়ে যাওনি এটা তো সম্ভব নয়!
কৃষাণ নামের সৈনিকটি গর্বিত ভঙ্গিতে বলল,
—না, আচার্য। আমি বা আমার সঙ্গী দু-জন একসঙ্গে কখনোই পাহারা ছেড়ে যাইনি। যখন ও গেছে, তখন আমি থেকেছি আর যখন আমি গেছি তখন আমার সঙ্গী থেকেছে।
—এর অর্থ কিন্তু এটাও হতে পারে যে একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন ঘরে ঢুকে থাকতে পারে। তোমাদের দু-জনের যে কেউই পাহারায় থাকাকালীন ঘরে ঢুকে থাকতে পারো, আবার অন্যজন ফিরে আসার আগেই কার্যসিদ্ধি করে বেরিয়েও আসতে পারো।
এই কথায় দু-জন প্রহরীই শঙ্কিত হয়ে উঠল। চোখে-মুখে ভয় ফুটে উঠল। হাত জোড় করে বলে উঠল,
—আমরা নির্দোষ, আচার্য। সম্রাট আমাদের পালনকর্তা। তাঁর দয়াতেই বেঁচে আছি। তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না।
—আরে… আরে…। ভয় পাচ্ছ কেন? আমি কি বলেছি তোমরা হত্যাকারী?
ঘাম মুছল একজন আর দ্বিতীয়জন ঢোঁক গিলল। আচার্য আবার প্রশ্ন করলেন,
—রাতে তোমরা কোনো শব্দ শুনতে পেয়েছ?
—না, আচার্য।
—কিন্তু আমি যদি বলি, একটা আওয়াজ শুনেছ?
দু-জনেই এই আচমকা প্রশ্নে অবাক হয়েছে। সিদ্ধান্তক প্রশ্ন করল,
—কীসের আওয়াজ, আচার্য?
—একটা ধাতুর বাসন মেঝেতে পড়ার আওয়াজ শুনতে পাওনি?
এই কথায় দু-জনেই চমকে উঠল। দু-জনেই সম্মতিতে ঘাড় নাড়ল। সিদ্ধান্তক বলল,
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন, আচার্য। এইরকম একটা শব্দ আমরা দু- জনেই শুনেছি বটে!
—হুমম। কখন সেটা শুনেছ, ঠিক সময়টা বলতে পারো?
পারি, আচার্য। আমরা ওই আওয়াজ শোনার কিছুক্ষণ পরেই রাত তৃতীয় প্রহর শুরু হওয়ার ঘণ্টা বেজে ওঠে বাইরে থেকে।
—হুমম। বেশ। তোমরা আসতে পারো।
প্রণাম জানিয়ে দু-জন সৈনিক বেরিয়ে গেল। চাণক্য নিজের মনেই ভাবলেন, প্রহরী দু-জনেই কিছুটা ভীত, আশঙ্কিত। এটা কি অপরাধীর মনের ইঙ্গিত? না মনে হয়। স্বয়ং সম্রাটের উপস্থিতিতে তারা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলো বলেই মনে হয়েছে ওঁর।
সবার সামনে একজন ভৃত্য এসে চাণক্যের সামনে একটা পাত্রে মধু মিশ্রিত দুধ দিয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পানপাত্র তুলে চাণক্য এক চুমুক দুধ খেলেন। তাঁর মনে হল মিষ্টি কম হয়েছে। আরও একটু মধু মেশালে ভালো হত। চাণক্য বরাবরই লক্ষ করেছেন রাজমহলের বাসিন্দারা মিষ্টি কম খায়। তিনি পাশের পাত্র থেকে আরও কিছুটা মধু দুধে ঢেলে নিলেন। তাঁর দিকে চেয়ে রাজ-বৈদ্য বললেন,
—আচার্য। এত বেশি মিষ্টি খাওয়া আপনার পক্ষে ক্ষতিকর।
একথায় চন্দ্রগুপ্ত শুধুই মৃদু হাসলেন। চাণক্যর অত্যধিক মিষ্টি প্রীতির কথা তাঁর সব শিষ্যর জানা। চাণক্য বৃদ্ধর কথার উত্তরে বললেন,
—আহ। জিভে মিষ্টির স্বাদ আমার মস্তিস্ককে বেশি সক্রিয় করে, মহাশয়।
—এটা সম্পূর্ণ আপনার ভ্রান্ত ধারণা।
রাজ-বৈদ্য তাঁকে আরও কিছু বলতেন কিন্তু তার আগেই চাণক্য তাঁকে প্রশ্ন করলেন,
—বৈদ্য মহোদয়। ওই জলের পাত্র যে সময়ে মাটিতে পড়ে যায়, অনুমান করা যেতে পারে সেই সময়েই আততায়ী হত্যা করে। মৃত্যুর সময় সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?
—সময়ের হিসেব ঠিকই আছে, আচার্য। আমি সকালে যখন মৃতদেহ পরীক্ষা করি, সেইসময়ে মৃতদেহ সবে কঠিন হওয়া শুরু হয়েছে। তার থেকে আমার অনুমান রাতের দ্বিতীয় প্রহর শেষে বা তৃতীয় প্রহর শুরুর দিকেই মৃত্যু ঘটেছে।
—হুমম।
আরও এক চুমুক দুধ পান করে চাণক্য মহা-অমাত্যকে বললেন,
—আর্য। এইবার দয়া করে ছাদে পাহারায় থাকা সৈনিকদের পাঠিয়ে দিন।
৭.
গতকাল রাতে উত্তর মহলের ছাদে পাহারায় ছিল মোট আট জন। তারা প্রত্যেকেই এখন চাণক্য এবং চন্দ্রগুপ্তর সামনে দাঁড়িয়ে। চন্দ্রগুপ্ত নিঃশব্দে তাদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন। সৈনিকরা এরপর চাণক্যকে অভিবাদন জানাল। চাণক্য প্রথমে কিছুক্ষণন কিছুই না বলে তাদের ভাবভঙ্গি এবং আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন।
একজন অপরাধীর আচরণ বা বাচনভঙ্গি থেকে অনেক কিছু অনুমান করা সম্ভব হয়। অশান্ত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক চাওয়া, যতটা সম্ভব আড়ালে দাঁড়ানো, সামনের ব্যক্তির সঙ্গে নজর না মেলানো বা হঠাৎ হঠাৎ শরীরে মৃদু কম্পন*। এই সমস্ত আচরণই একজন অপরাধীর ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিত্বের আচার আচরণে চাণক্য নিজে বহুবার এগুলো লক্ষ করেছেন। এদের একজনের মধ্যেও কি তিনি সেরকম কিছু লক্ষ করলেন? নাহ্। সম্রাট এবং তাঁর উপস্থিতিতে যতটা স্বাভাবিক থাকা সম্ভব, এরা তাই আছে।
চাণক্য বললেন,
—প্রত্যেকে একে একে নিজের পরিচয় দাও। সেইসঙ্গে এটাও বোলো যে কতদিন ধরে সৈনিক পদে বহাল আছ।
প্রত্যেকের উত্তর থেকে জানা গেল যে সবাই কম-বেশি চার বছর পুরোনো তো বটেই। কেউ কেউ আবার পাঁচ বছর পুরোনোও আছে। এমনিতেই ন্যূনতম দু-বছর সেনাবাহিনীতে সম্পূর্ণ হওয়ার আগে কাউকেই রাজমহলের রক্ষী নিযুক্ত করা হয় না। সেনাবাহিনীতে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং দক্ষতার প্রমাণ দিলে তবেই তাদের রাজমহলে রক্ষী নিযুক্ত করা হয়ে থাকে। অতএব এরা প্রত্যেকেই নিঃসন্দেহে বিশ্বাসযোগ্য।
চাণক্য তাদের বেশ কয়েকটা সাধারণ প্রশ্ন করলেন গতকাল রাতের বিষয়ে। প্রত্যেকেই একে একে উত্তরে দিল প্রতিটা প্রশ্নর। সব মিলিয়ে যা দাঁড়াল তা যথেষ্ট হতাশাজনক। ছাদের দরজা দিয়ে তারা ছাড়া বাইরের কেউ প্রবেশ করেনি। তাদের সকলের নজর এড়িয়ে কারুর প্রবেশ সম্ভব নয়। কিন্তু ওই দরজার সিঁড়ি দিয়ে নেমেই তাদের শৌচালয়ে যেতে হয়। তাই আটজনের প্রত্যেকেই একে অন্যকে এক অথবা একাধিকবার ছাদের দরজা দিয়ে নামতে দেখেছে। কিন্তু নেমে গিয়ে কী করেছে, স্বাভাবিকভাবেই সেটা কেউই দেখেনি। কেউই পাহারা থেকে খুব বেশিক্ষণ সময়ের জন্যে অনুপস্থিত ছিল না।
চাণক্য নিজের মনেই ভাবলেন যে যদি কেউ হত্যার উদ্দেশ্যে ঢুকে থাকে, তাতে অত্যধিক সময় লাগার কথাও নয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, এই আটজনের মধ্যে যে কেউই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে, দরজা খুলে হত্যা করে ছাদে ফিরে আসতে পারে। সিঁড়ির শেষেই নীচের ঘরের দরজা। অতিথিশালার ছাদের সিঁড়ির দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল না সেটা দেখেছেন। অতএব সকলেরই সমান সুযোগ ছিল হত্যা করার। তাদের এই প্রশ্ন করায়, প্রত্যেকেই নিজেদের ইষ্টদেবের নামে শপথ করে বলল যে তারা হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে কিছুই জানে না। বরং গতরাতে যে নীচের ঘরে কোনো অতিধি ছিলেন, এ তথ্যই তাদের অজানা ছিল। তারা নির্দোষ।
আচার্য চাণক্য নিজেও কিছুটা হতাশ হয়ে তাদের সবাইকে বিদায় দিলেন। সবাই বেরিয়ে যেতে সম্রাট প্রশ্ন করলেন,
—কিছু আন্দাজ করতে পারলেন, আচার্য? নিরাশ কণ্ঠে চাণক্য উত্তর দিলেন,
—কিচ্ছু না। সন্দেহভাজনের তালিকা উত্তরোত্তর বাড়ছে। এদের মধ্যে যে কেউই শত্রু দেশের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। যে কেউই হত্যাকারী হতে পারে। অপরাধী ধরা না পড়া পর্যন্ত এদের কাউকে পাটলিপুত্র ত্যাগ না করার নির্দেশ দেবেন। নিশ্চিতভাবে কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না।
—বেশ।
অপেক্ষারত অমাত্য কৃষ্ণনাথ চাণক্যর কাছে জানতে চাইলেন,
—এরপর কাকে পাঠাব, আচার্য?
—গান্ধারের দু-জনকে আলাদা আলাদাভাবে প্রশ্ন করতে চাই। প্রধান অমাত্য মহাশয়, যেকোনো একজনকে প্রথমে আসতে বলুন।
—
* এই পর্বে বর্ণিত অপরাধী শনাক্ত করার লক্ষণগুলো বাস্তবেই অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত আছে।
৮.
—তোমার নাম?
—আমার নাম অন্ধকা।
প্রশ্নকর্তা আচার্য চাণক্য এবং উত্তর দিচ্ছে গান্ধারের পাচক।
—হুমম। কতদিন ধরে শুকদাস মহাশয়ের পাচকের কাজ করছ?
—তা অনেক দিন। তিন বছর হবে।
—গতকাল সন্ধে থেকে আজ সকাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম সংক্ষেপে বলতে পারো?
একটু ভেবে নিয়ে পাচক বলল,
—নিশ্চয়ই পারি। মহলে প্রবেশের পরেই শুকদাস মহাশয় মহা-অমাত্যর সঙ্গে মহল ভ্রমণে চলে গেলেন। এরপর থেকে আমি রান্নার কাজেই ব্যস্ত ছিলাম। সমস্ত ব্যঞ্জন, রুটি, ফল-মূল, বাসন, রান্নার চুলা অবশ্য রাজভাণ্ডার থেকেই দেয়া হয়। সবার চোখের সামনেই আমি রান্না করি। অমাত্য ছাড়াও আরও পাঁচজন সৈনিক সারাক্ষণই আমার আশেপাশে ছিল। রাতে আমি নিজে সব খাবার সাজিয়ে মনিবকে খেতে দিই। প্রতিটা খাবার আমি নিজের হাতে প্রথম টুকরো কেটে আগে কুম্ভকে খেতে দিই। কুম্ভ মানে খাবার- পরীক্ষক। পুরোটাই অমাত্য এবং বাকি প্রহরীদের চোখের সামনে ঘটে। শুরুদাস মহাশয়ের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে আমি চলে যাই নিজের ভৃত্য- গৃহে। কুম্ভও আমার সঙ্গেই চলে আসে। আমার কোনো দোষ নেই মহাশয়।
সম্রাট এবং চাণক্যর প্রতি হাত জোড় করে অন্ধকা।
—হুম।
—আমি নির্দোষ, মান্যবর। আমি কিছুই করিনি। আমি ব্রাহ্মণ দেবের পুরোনো বিশ্বস্ত লোক। আপনার বিশ্বাস না হলে আপনি অমাত্য কৃষ্ণনাথ মহাশয় এবং প্রহরীদের জিজ্ঞেস করুন, আমি যা বলেছি তা সত্যি কি না। তাঁরা সর্বক্ষণ আমার সঙ্গেই ছিলেন।
—রাতে আর দেখা করতে যাওনি মনিবের সঙ্গে?
—একবারও না। আমি এক ঘুমে সকালে উঠেছি। আমার ঘরের বাইরে প্রহরী ছিল। তারাই সাক্ষী দেবে।
—হুমম। আজ সকালের ঘটনা বলো।
—সকালে খাওয়ার জন্যে সামান্য ফল-মূল সাজিয়ে আমি এবং কুম্ভ অতিথিশালায় উপস্থিত হই। কিন্তু আমি ডাকতে ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয় না। আমি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ব্রাহ্মণ দরজা খুললেন না। আমরা এবং সঙ্গে দুই প্রহরী অনেক ডাকাডাকি করলাম। লাভ হল না। তারপর একজন খবর দিল অমাত্য মহাশয়কে। তাঁর ডাকেও সাড়া না দিতে তিনি সম্রাটকে খবর দেন। সম্রাট নিজে এসে দরজা ভাঙার আদেশ দিলেন। দরজা ভাঙা হলে আমরা সকলে ভেতরে ঢুকি। আর তখনই আমরা ব্রাহ্মণদেবের মৃতদেহ দেখতে পেলাম।
—হুম। একাদশীর তিথিতে কী কী বিশেষ পদ রান্না করতে?
এরকম একটা অদ্ভুত প্রশ্নে পাচকটি একটু থতোমতো হয়ে যায়। উত্তর দিল,
—রোজকার যা করি…
উত্তর শেষ করতে না দিয়েই পরের প্রশ্ন করলেন আচার্য,
—শেষ প্রশ্ন, কাল রাতের থালা আর উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো ঘর থেকে পরিষ্কার করোনি কেন?
আমতা আমতা করে উত্তর দিল,
—আসলে বাড়িতেও থালা আমি তুলতাম না। অন্য ভৃত্য এসে থালা তুলত। তাই কাল রাতেও ওটা সরানোর কথা খেয়াল ছিল না।
—বেশ। তুমি আসতে পারো। ওই খাবার-পরীক্ষক… কী যেন নাম বললে? হ্যাঁ… কুম্ভকে পাঠিয়ে দাও।
.
অন্ধকা ঘর থেকে বেরোতেই দ্বিতীয়জন ঢুকল। এগিয়ে এসে প্রণাম জানাল উপস্থিত প্রত্যেককে। চাণক্য প্রশ্ন করলেন,
—নাম কী তোমার?
—আজ্ঞে… কুম্ভ।
—কতদিন কাজ করছ শুকদাসের কাছে?
—আমি ওঁর কাছে কাজ করি না। আমি গান্ধারের মহলে মেজোরানির খাবার-পরীক্ষকের কাজ করি।
—সে কী? তাই নাকি? তুমি তো গান্ধার-রাজের নিজের লোক তবে। তাই না?
এই প্রশ্নে ভৃত্যটির মুখে আশঙ্কার কালো মেঘ নেমে এল। সহজেই সে অনুমান করতে পারছে যে এর ফলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা সবচেয়ে কম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তও সচকিত হয়ে তার দিকে চাইলেন একবার। কাঁপা কন্ঠে সে উত্তর দিল,
—মান্যবর, আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি নির্দোষ। আমি কিছু জানি না। ব্রহ্মহত্যার মহাপাপ আমি করিনি।
—হুম। তুমি তার মানে পাচক অন্ধকাকে আগে চিনতে না?
না, হুজুর। কয়েকদিন আগেই রাজার আদেশে আমায়, শুকদাস আর অন্ধকের সফরসঙ্গী হতে হয়েছে।
—হুম। গতকাল থেকে আজ সকাল অবধি নিজের গতিবিধি বর্ণনা করো। সামান্য ভেবে নিয়ে কুম্ভ উত্তর দিল,
—গতকাল এসে থেকে আমি নিজের ভৃত্য গৃহেই ছিলাম। আমি এবং অন্ধকা একই ঘরে। সে অবশ্য রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল সূর্যাস্তর পর থেকেই। আমি নিজের ঘরেই ছিলাম। পরে, শুকদাস মহাশয়ের রাতের খাওয়ার সময়ে আমার ডাক পড়ে অতিথিশালায়। অন্ধকা একটা একটা করে খাবার প্রথমে আমায় দিত, আমি তা মুখে দেয়ার পরে তবেই ব্রাহ্মণের থালায় সেগুলো সাজাতে থাকে অন্ধকা। অন্নর প্রথম গ্রাস আমি খাই, রুটি ও ফলের প্রথম টুকরোও আমিই প্রথম খাই। প্রতিটা খাবার পরীক্ষা হয়ে গেলে, তবেই ব্রাহ্মণ খাওয়া শুরু করেন। এরপর আমরা দু-জনই একসঙ্গে ঘরে ফিরে আসি। অন্ধকা ঘুমিয়ে পড়ে। আমার অবশ্য ঘুম কিছুটা দেরিতে আসে। এরপর আজ সকালে অন্ধকার সঙ্গেই আমি প্রাতরাশ নিয়ে যাই অতিথিশালায়। গিয়ে দেখলাম দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আমরা সকলেই অনেক ডাকাডাকি করলাম। অমাত্য মহাশয় এবং সম্রাট এলেন। অনেক ডাকাডাকিতেও সাড়া না পেয়ে সম্রাট দরজা ভাঙতে বলেন প্রহরীদের। দরজা ভাঙার পর আমরা ভেতরে ঢুকি। দেখলাম… উফফ! সে বড়ো ভয়ংকর দৃশ্য!
—হুম। আচ্ছা, হাফুস* ফল খেয়েছ কখনো?
আচার্য চাণক্যর এহেন সম্পূর্ণ আচমকা এবং উদ্ভট প্রশ্নে লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সামলে নিয়ে বলে,
—হাফুস? মানে আপুস আম? আজ্ঞে, হ্যাঁ মহাশয়। দু-একবার খেয়েছি।
—কেমন খেতে? কোথায় খেয়েছ?
—আজ্ঞে, সে আম বড়োই সুস্বাদু। মধুর মতো মিষ্টি এবং বাতাসে তার সুগন্ধ দূর থেকে পাওয়া যায়। গান্ধারের রাজমহলে খাবার-পরীক্ষকের কাজ করার সুযোগেই দু-এক টুকরো খেতে পেরেছি। তার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে মহাশয়!
—বেশ, বেশ। তুমি আসতে পারো।
উপস্থিত সকলকে প্রণাম করে বেরিয়ে গেল লোকটা।
—
* হাফুস/আপুস – আলফানসো আম।
৯.
চাণক্য মুখ ফেরালেন সভায় উপস্থিত বাকি তিনজনের দিকে। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত চিন্তিত মুখে অন্যদিকে চেয়ে ভাবছেন কিছু। কিন্তু অমাত্য কৃষ্ণনাথ এবং বৃদ্ধ রাজ-বৈদ্য অবাক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আচার্যর দিকে চেয়ে আছেন। তাঁদের দেখে আচার্য স্মিত হেসে বললেন,
—কী হল? আমার প্রশ্ন অবান্তর মনে হল?
কয়েকটা প্রশ্ন তাঁদের অবশ্যই অবান্তর মনে হয়েছে। হত্যাকাণ্ডর সঙ্গে আপুস আমের কী সম্পর্ক থাকা সম্ভব তা কারুরই মাথায় এল না। এটা কি চাণক্যর মিষ্টি খাবারের প্রতি অত্যধিক আকর্ষণের ফল? বোধ হয় প্রশ্নের মাঝেই ওঁর মাথায় মিষ্টি আমের চিন্তা চলে এসেছিল। কিন্তু মনে এই কথা ভাবলেও চাণক্যর সামনে মনের ভাব প্রকাশের সাহস তাঁরা দেখালেন না।
তাঁদের মনের ভাব বুঝতে পেরে চাণক্য মনে মনে হাসলেন। বললেন,
—একটা ছোট্ট পরীক্ষা করছিলাম। বাদ দিন। এইবার আপনাদের কিছু প্রশ্ন করতে চাই যদি অনুমতি দেন।
—অবশ্যই।
—বেশ। বৈদ্য মহাশয়। আপনি হত্যার বিষয়ে আপনার নিজস্ব অভিমত বলুন। অতি সামান্য কোনো তথ্যও বাদ দেবেন না।
বৃদ্ধ নিজেকে সামান্য গুছিয়ে নিয়ে অনেকটা বৃদ্ধ অধ্যাপকের ভঙ্গিতে বললেন,
—আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই। মৃতদেহর হাতের নীলবর্ণ নখ ও মুখ থেকে নির্গত ফেনা থেকে নির্দ্বিধায় সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে তীব্র বিষক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটেছে। দেহে অন্য কোনো আঘাতের চিহ্ন পাইনি। মৃতদেহ ইতিমধ্যে যতটা কঠিন হয়েছে, তার থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে মৃত্যু রাত দ্বিতীয় প্রহরের শেষ থেকে তৃতীয় প্রহরের শুরুর ভেতরেই হয়েছে। শলাকার তীব্র বিষের সামান্য একটা ক্ষতেই মৃত্যু হওয়া সম্ভব। তবে… নাহ্। আর সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এই যা।
—কিছু একটা মনে হয় বলতে গিয়ে থেমে গেলেন মহাশয়। প্রার্থনা করব, তা যতই অবান্তর মনে হোক, আমাকে বলে ফেলুন। এই মুহূর্তে কোন তথ্য অবান্তর এবং কোন তথ্য গুরুত্বপূর্ণ, সে-বিচারের ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন।
একটু ভেবে বৃদ্ধ বললেন,
—সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আসলে, মৃতদেহর হাত, পায়ের তালু এবং নখ যে পরিমাণ গভীর নীলবর্ণ হয়েছিল তাতে প্রথম দর্শনে আমি ভেবেছিলাম মৃত্যু বোধ হয় রাতের প্রথম প্রহরের দিকে হয়েছে। কারণ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে শরীরে বিষক্রিয়া হলে অতটা গভীর নীল হয়ে পড়ে নখ। তবে দেহ পরীক্ষা করতে গিয়ে সেই ভুল ভাঙে। আমি নিশ্চিত যে ওই রাত দ্বিতীয় প্রহরের শেষ থেকে তৃতীয় প্রহরের শুরুর ভেতরেই মৃত্যু ঘটেছে। তার আগে নয়। শলাকায় ব্যবহৃত বিষ, নিশ্চয়ই কোনো অজানা মারণ বিষ, যা এত কম সময়ে শরীর নীলবর্ণ করতে সক্ষম।
চাণক্যর কপালে ভ্রূকুটি দেখা গেল। মেঝের দিকে চেয়ে গভীরভাবে কিছু যেন চিন্তা করছেন। কৃষ্ণনাথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন। ইশারায় ওঁকে আচার্যর চিন্তাসূত্র ভঙ্গ করতে বারণ করলেন। এই মুদ্রা চন্দ্রগুপ্তর অতি পরিচিত। তিনি কোনো সূত্র পেয়েছেন। গভীরভাবে চিন্তা করার সময়ে আচার্যর কপালে ভ্রূকুটি দেখা দেয়। এই সময়ে চিন্তাসূত্রে বাধা পড়াটা একদমই পছন্দ করেন না তিনি। নন্দ সাম্রাজ্যর বিরুদ্ধে বিদ্রোহর দিনগুলোতেও, বহুবার চন্দ্রগুপ্ত নিজের আচার্যকে এভাবেই চিন্তামগ্ন থাকতে দেখেছেন। বেশিরভাগ সময়েই এর ফলাফল ইতিবাচক হয়ে থাকে।
কয়েক মুহূর্ত পর আচার্য নিজেই চিন্তাজাল থেকে বেরিয়ে এলেন। কৃষ্ণনাথের দিকে ফিরে বললেন,
—হুমম। কী জানি করছিলাম… ও হ্যাঁ। আপনাকে আর একটু কষ্ট দেব প্রধান অমাত্য মহাশয়। আপনি কাল রাত থেকে ঘটনাগুলো আমায় আরও একবার বলুন।
পানপাত্র থেকে খানিকটা জলপান করে গলা ভিজিয়ে নিলেন কৃষ্ণনাথ। তারপর শুরু করলেন,
—গতকাল সভার শেষের দিকে গান্ধারের দূত হিসেবে ব্রাহ্মণ শুকদেব উপস্থিত হন। আলোচনা হয় সম্রাটের সঙ্গে। কথা শেষে সম্রাট ওঁকে বিশ্রাম করতে বলেন। আমি নিজে ওঁকে অতিথিশালার সবচেয়ে ভালো ঘরটা বেছে দিই। যদিও এখন মনে হচ্ছে সেটাই ভুল করে ফেলেছি। মানে, অন্য কোনো ঘরে তাঁর থাকার আয়োজন করলে হয়তো এই বিপত্তি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হত। অন্য ঘরে ছাদের দিকের সিঁড়ির দরজা থাকত না।
—নিজের ওপর দোষ দেবেন না, মহাশয়। নিয়তি বড়োই অলঙ্ঘ্যনীয় বস্তু। তার সামনে আমরা বিবশ। আপনি তার পরের ঘটনা বলুন।
—এরপর আমি ওঁকে নিয়ে রাজপ্রাসাদ পরিদর্শন করাই। সন্ধের দিকে ওঁর পাচক রান্নার কাজ শুরু করে। আমি সবসময়ে নজর রেখেছি। সঙ্গে আরও পাঁচজন প্রহরী রেখেছিলাম তার ওপর নজর রাখতে। তাদের বিশেষভাবে বলে দিয়েছিলাম খেয়াল রাখতে যাতে খাবারে বিষ জাতীয় কিছু না মেশাতে পারে। সঙ্গে রাজ-পাচক নিজেও উপস্থিত ছিল। যাতে রান্নার মাঝেও কোনোরকম অসংগতি দেখা দিলে তার নজর না এড়িয়ে যায়। আমি তাদের জিজ্ঞেসও করেছি আজকে। প্রত্যেকে নিশ্চিত করে বলেছে যে রান্না হওয়া থেকে ব্রাহ্মণের খাবার খাওয়া অবধি বিষ মেশানো হয়নি। এরপর প্রথম গ্রাস তথা রুটি ও ফলের প্রথম টুকরো কেটে কেটে পাচক অন্ধকা আমার সামনেই পরীক্ষককে দেয়। খাবার-পরীক্ষক কুম্ভ তা উদরস্থ করে। এমনকী পানীয় জল এবং দুধও আগে পরীক্ষককে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নেয়া হয়েছিল। খাবারে বিষ নেই তা নিশ্চিত হওয়ার পরেই শুকদাস তা গ্রহণ করেন। ওঁর খাওয়া শেষ হওয়ার পর তিনি নিজে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করেন। সেই অবধি নিজে ওঁকে জীবিত দেখেছি।
—হুমম। পাচক ডান হাতি না বাঁ-হাতি?
—ডান হাতি। কেন বলুন তো?
—কিছুই না। আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পরীক্ষা নিলাম। ও যে ডান হাতি তা আমিও লক্ষ করেছি। আপনি সেটা লক্ষ করেছেন কি না নিশ্চিত হলাম। আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা নেই।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এতক্ষণ মৌন বসে ছিলেন সিংহাসনে। এইবার বলে উঠলেন,
—বেশ। তবে আপনারা একটু একান্তে থাকতে দিন আমায় এবং আচার্যকে। আমাদের কিছু কথা আছে।
কৃষ্ণনাথ আর রাজ-বৈদ্য তাঁদের দু-জনকে প্রণাম জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তাঁদের বেরিয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করলেন সম্রাট। তারপর বললেন,
—আচার্য, আমার মনে একটা সন্দেহ এসেছে।
—বলো, কী সন্দেহ।
লোকসম্মুখে চাণক্য শিষ্যকে তার সম্রাট পদের সম্মান দিয়ে ‘আপনি’ সম্বোধন করলেও, একান্তে তা ‘তুমি’ তে নেমে আসে সহজেই। চন্দ্রগুপ্ত উৎসাহিত হয়ে বললেন,
—গুরুদেব। এই গুপ্ত কথাটা বিশেষ কেউই জানে না যে আপনি আমায় বাল্যকাল থেকে সামান্য পরিমাণে বিষ খাইয়ে এসেছেন। এবং তা আজও আমি নিয়মিত গ্রহণ করি আপনার নির্দেশমতো। এত বছর ধরে শরীরে বিষ ঢোকার ফলে আমার শরীরে কোনোরকম মারণ বিষের প্রভাব পড়ে না। কিন্তু আচার্য, এই খাবার-পরীক্ষকও তো সেরকমই হতে পারে? হয়তো খাবারে বিষ ছিল, কিন্তু গান্ধার জেনে বুঝেই সেইরকম কোনো ব্যক্তিকে পরীক্ষক করে পাঠিয়েছে যার শরীরে বিষের প্রভাব পড়বে না।
—আমি বুঝতে পারছি তুমি ওই গান্ধারের ভৃত্য দুটিকেই সন্দেহ করছ। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ এই হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি লাভ গান্ধারেরই হবে। তারা সোজাসুজি এইবার মৌর্য সাম্রাজ্যর অংশ হতে অস্বীকার করবে। এবং এইবার তাদের হাতে যথাযথ কারণও থাকবে। কিন্তু চন্দ্ৰগুপ্ত, ভুলে যেয়ো না যে ওই খাবারে যে বিষ ছিল না সেটা আমরা নিজেরাই আজ সকালেই দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করে দেখেছি। তবুও তোমার যদি সন্দেহ থাকে, তবে একটা সামান্য পরীক্ষা করে দেখা যেতেই পারে।
—কী পরীক্ষা??
মৃদু হেসে চাণক্য উত্তর দিলেন,
—রাজ-বৈদ্যর সঙ্গে পরামর্শ করে, খাবার-পরীক্ষক কুম্ভর খাবারে সামান্য পরিমাণ বিষ মিশিয়ে দিতে বলো। খুবই অল্প পরিমাণে যাতে তার কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু বিষক্রিয়ার উপসর্গগুলো যেন দেখা দেয়। আগামীকাল যদি তার শরীর খারাপ করে, তবেই তুমি নিশ্চিত হবে যে তার ওপর বিষের প্রভাব আছে কি না।
চাণক্যর দিকে চেয়ে থাকলেন চন্দ্রগুপ্ত। এহেন উপায় একমাত্র তাঁর গুরুর মস্তিস্ক থেকেই বেরোনো সম্ভব। চন্দ্রগুপ্তর আরও একবার মনে পড়ল কেন তাঁর গুরুকে সারা আর্যাবর্ত ‘কৌটিল্য’ নামে ডাকে।