১০.
আচার্য চাণক্য শিষ্য জীবসিদ্ধিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা শোনাচ্ছিলেন। ঘটনার পর ইতিমধ্যে দু-দিন অতিবাহিত হয়েছে। রাজকার্যে জীবসিদ্ধিকে গত এক মাসের জন্যে ভিনরাজ্যে থাকতে হয়েছে। আজকেই পাটলিপুত্রতে ফিরেছে সে। এবং স্বভাবসিদ্ধভাবেই প্রথমেই গুরুর কুটিরে এসেছে।
চাণক্যর প্রিয় ছয় ছাত্রর মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত ও জীবসিদ্ধি অন্যতম। নন্দ শাসনের সময়ে জীবসিদ্ধি চাণক্যর গুপ্তচর হিসেবে এই মগধেই বহাল ছিল। শত্রু শিবিরের সমস্ত গোপন খবর, চাণক্য পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার দুঃসাহসিক গুরুদায়িত্বটা তার ওপর ছিল। মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে, চন্দ্রগুপ্তকে সিংহাসনে বসিয়ে চাণক্য কিছুকাল নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কয়েক বছর আগে তিনি অমাত্যদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিজে রাজকার্য থেকে অবসর নেন। রাজমহল ছেড়ে অদূরেই এক নিরিবিলি জায়গায় নিজের কুটিরে সন্ন্যাসীর জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। আরও একটা কাজে এই মুহূর্তে চাণক্য ব্রতী হয়েছেন। বংশপরম্পরায় সঞ্চিত জ্ঞান এবং নিজস্ব জীবনে অর্জিত যাবতীয় অনুভব তিনি একত্রিত করে লিপিবদ্ধ করে যেতে চান ‘অর্থশাস্ত্র’ বইয়ে। অবসরের পর থেকে তিনি লেখালেখিতেই ডুবে থেকেছেন। এই অবসর জীবনে শিষ্য জীবসিদ্ধিই তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়েছে। চন্দ্রগুপ্তর সভাসদ পদ সে অস্বীকার করে এবং নিজেও ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী বেশ নিয়ে পাটলিপুত্রতেই থেকে গেছে।
গত দু-দিনে হত্যাকাণ্ডর কথা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। খোদ সম্রাটের অন্দরমহলে হত্যাকাণ্ড ঘটলে তা ছড়িয়ে পড়ার মতনই ঘটনা বটে। জীবসিদ্ধি সেই খবর পেয়েই ফিরে এসেছে। এতক্ষণ বিশদে পুরো ঘটনাটা শুনছিল আচার্যর কুটিরে বসে। এই পর্যন্ত শুনে প্রশ্ন করল জীবসিদ্ধি,
—তারপর? খাবার-পরীক্ষকের ওপর বিষক্রিয়া পরীক্ষা করিয়েছিলেন সম্রাট?
—হুমম।
—তো? তাতে কী ফল হল?
—গতকালই চন্দ্রগুপ্ত চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে কুম্ভর ওপর বিষ প্রভাব ফেলেছে। দু-দিন আগে সামান্য বিষ তার খাবারে মিশিয়ে দেয়া হয়। পরের দিনই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিষক্রিয়ার লক্ষণ স্পষ্ট। বৈদ্যর ওষুধের গুণে গতকাল সে আরোগ্য লাভও করেছে।
—এ তো বড়োই গম্ভীর সমস্যা, আচার্য। আপনি সমস্যার সমাধান সূত্র পেলেন কিছু?
বিষণ্ন ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আচার্য বললেন,
—যেকোনো রহস্যর সম্পূর্ণ সমাধানের জন্যে তিনটে প্রশ্নের উত্তর অনুধাবন করতে হয়। ‘কে?’, ‘কেন?’ এবং ‘কীভাবে?’। এই হত্যাকাণ্ডে ‘কেন?’-র উত্তর সহজ। রাজদূতকে হত্যার যথেষ্ট কারণ আমাদের শত্রুপক্ষের আছে। এইবার আসা যাক ‘কে?’-তে। যার ওপর আমার প্রবল সন্দেহ, তাকে অভিযুক্ত করার মতো প্রমাণ নেই। যতক্ষণ না ‘কীভাবে?’ হত্যা করা হয়েছে এই প্রশ্নর উত্তর খুঁজে পাচ্ছি, ততক্ষণ হত্যাকারীর অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
খানিক ভেবে জীবসিদ্ধি বলল,
—গান্ধার থেকে আসা দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে সত্যিই কোনো কিছু প্রমাণ করা যাচ্ছে না। কিন্তু গুরুদেব, আপনি নিজেই তো জিজ্ঞাসাবাদের সময় দ্বাররক্ষীদের দিকে সন্দেহর ইঙ্গিত দিয়েছেন। একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন ঢুকে হত্যা করতেই পারে। তাই নয় কি?
—ওহে জীবসিদ্ধি, সামান্য বুদ্ধি ব্যবহার করো। আমি ওই কথা শুধুমাত্র ওই প্রহরীদের ভয় পাওয়াতে বলেছিলাম। তাদের সামান্য বুদ্ধি থাকলে তারা নিজেরাই প্রমাণ করতে পারত যে এই উপায়ে, তাদের পক্ষে হত্যা করা সম্ভব নয়।
—কেন?
—পরের দিন দেখা গেছে অতিথিশালার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। যদি প্রহরীদের মধ্যে কেউ হত্যা করেও থাকে, তবুও তার পক্ষে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করাটা অসম্ভব।
—তাই তো! ঠিক কথা।
—হুম।
—তবে ছাদের প্রহরীরা? তাদের তো প্রত্যেকেরই সুযোগ ছিল।
—হ্যাঁ। সম্ভব। তাদের আটজনের যেকোনো একজনের পক্ষেই হত্যাকারী হওয়া সম্ভব। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন থেকে যায়।
—কী প্রশ্ন, আচার্য?
—যদি ঘরের মধ্যে ঢুকেই হত্যা করতে হয় তবে ওই বিষাক্ত শলাকাই কেন? ঘুমন্ত অবস্থায় বুকে ছুরি বসিয়ে বা গলায় তলোয়ার চালালেই হত। সেটাই অনেক সহজ পদ্ধতি। অকারণ বিষ প্রয়োগের কী প্রয়োজন? তাও আবার ওই শলাকায়?
উত্তর জীবসিদ্ধির কাছে নেই। তাকে চিন্তিত দেখে চাণক্য কৌতুক ছলে বললেন,
—ভাবো, ভাবো। বুদ্ধি ব্যবহার করো। আমিও গত দু-দিন ধরে ভাবছি। কিন্তু যতই ভাবছি ততই জটিল হয়ে যাচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ডর সবচেয়ে সমস্যার বিষয় কোনটা জানো?
—কোনটা?
—এই ক্ষেত্রে সবার জবানবন্দি একে অন্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। কারুর কথায় কোনো ফাঁক নেই। শুধু একজনের বাদে…
—কার?
—নিজেই ভেবে বলো।
—আমার পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা আপনি ভালোই জানেন, আচার্য। আপনার মতো অনুধাবন ক্ষমতা আমার নেই।
—হুম।
—আমি শুনলাম ইতিমধ্যে গান্ধারে হত্যাকাণ্ডর খবর পৌঁছে গেছে। অম্বিক এবং তার আচার্য শকুনি অন্য রাজাদের সঙ্গে আমাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মতবিরোধ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এবং গান্ধারের দুই নাগরিক, অর্থাৎ পাচক আর খাবার-পরীক্ষককে অবিলম্বে গান্ধারে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছে। আচার্য, তবে কি যুদ্ধ হবেই?
—হুমম। রহস্যর সমাধান করতে আমি সক্ষম না হলে যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এবং তাতে ফলাফল নির্বিশেষে, মগধের ক্ষতি। আর্থিক ক্ষতি এবং প্রাণহানি।
খানিকক্ষণ দু-জনের কেউই কথা বলল না। চাণক্যই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন,
—আমার মন বলছে যে সমাধান আমার চোখের সামনেই আছে। কিছু একটা অতি সামান্য তথ্য বা ঘটনা সেদিন উল্লেখ করা হয়েছে বা ঘটেছে যা এই রহস্য সমাধানের চাবিকাঠি। আমি তা দেখেও দেখতে পাচ্ছি না। কিছু একটা সূত্র আমার সামনেই আছে কিন্তু আমি ধরতে পারছি না।
চাণক্যর কপালে তীব্র ভ্রূকুটি ফুটে উঠেছে। যেন তীব্র মানসিক যন্ত্রণা হচ্ছে তাঁর। আচার্যকে এভাবে দেখে জীবসিদ্ধির দুঃখ হল। আচার্যর মন হালকা করতে বলে উঠল,
—আচার্য। আমি আপনার জন্যে দক্ষিণের রাজ্য থেকে কী নিয়ে এসেছি দেখুন। জীবসিদ্ধি নিজের কাপড়ের ঝোলা থেকে একটা প্রমাণ আকারের তরমুজ বের করে আনল। সঙ্গে শালপাতায় মোড়া নারকোলের মিষ্টি। আচার্যর মিষ্টির প্রতি ভালোবাসার কথা তাঁর শিষ্যমাত্রেই জানে।
—শুকনো নারকোলের মিষ্টিটা কয়েকদিন থাকবে। কিন্তু এই তরমুজটা টাটকা থাকতে থাকতেই শেষ করতে হবে। বিক্রেতা দাবি করেছে এটা মধুর মতো মিষ্টি হবে।
শিষ্যর প্রফুল্লতা কিছুটা চাণক্যর মধ্যেও সঞ্চারিত হল। জীবসিদ্ধি নিজেই ততক্ষণে একটা থালা তুলে তাতে তরমুজ কাটার প্রস্তুতি নিতে ভাঁড়ার ঘরে ঢুকল।
—আচার্য, একটা ছুরি দেবেন। এটা কাটব।
গুরুর কোনো সাড়া না পেয়ে আবার ডাকল জীবসিদ্ধি,
—আচার্য, কোথায় গেলেন??
এবারও সাড়া না পেয়ে জীবসিদ্ধি বেরিয়ে এল।
—আচার্য…
কথা মাঝপথে থামিয়ে দিল জীবসিদ্ধি। কারণ চাণক্য এই মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়েছেন। কপালে আর ভ্রূকুটি নেই, বরং তাঁর চোখের তারায় ঔজ্বল্য ফুটে উঠেছে। এই দৃষ্টির সঙ্গে জীবসিদ্ধির বহু বছরের পরিচয় আছে।
উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন চাণক্য,
—এই মুহূর্তে রাজমহলের দিকে যাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, সেটা চন্দ্রগুপ্তকে দেবে। আমি জানি কে হত্যাকারী। আমি জানি কোন উপায়ে হত্যা করা হয়েছে! সব রহস্যের সমাধান হয়েছে!
১১.
মাঝের একটা দিন প্রায় ঝড়ের গতিতে কেটেছে। মাত্র একদিনের ব্যবধানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পালটে গেছে। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত খানিকক্ষণ আগেই গান্ধারকে সম্পূর্ণ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। অন্যথায় মগধ পুরো সামরিক শক্তি নিয়ে গান্ধার আক্রমণ করবে এই কথাও লিখেছেন তাতে। সব সমস্যার মীমাংসা হয়ে যাওয়ার পর আচার্য চাণক্যর কুটিরে এই মুহূর্তে উপস্থিত আচার্য নিজে আর জীবসিদ্ধি। চাণক্য অতি প্রফুল্ল মনে একটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে আছেন। পাশে রাখা ধুনুচি থেকে ধুনো এবং কর্পূর মিশ্রিত সুগন্ধি ধোঁয়া দৃষ্টি ঝাপসা করে দিচ্ছে জীবসিদ্ধির।
দু-জনের মাঝে রাখা থালায় ফল-মূল ও মিষ্টি সাজানো। নারকোলের মিষ্টি চাণক্য এক চতুর্থাংশ শেষ করে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। ওঁরা প্রতীক্ষা করছেন তৃতীয় ব্যক্তির। অন্ধকার নেমেছে নগরের বুকে। সন্ধে হতেই চারদিকের গৃহস্থ কুটিরগুলো থেকে শঙ্খধ্বনি শোনা গেল। আজ সবাই শান্তিতে। গত চারদিন রাজ্যের ওপর যে যুদ্ধ আর অশান্তির ছায়া দেখা দিয়েছিল, তা আজ আর নেই। ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল বাইরে থেকে। কুটিরের সামনে তা থামল। কুটিরের দরজায় কড়া নাড়ল আগন্তুক।
ভিতরে আসুন, সম্রাট। দরজা খোলা আছে।
আপাদমস্তক কাপড়ে ঢেকে বাড়িতে ঢুকলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। দরজা লাগিয়ে গায়ের ঢাকা কাপড় সরিয়ে ফেললেন। প্রথমেই আচার্যর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। তারপর জীবসিদ্ধির পাশের আসন গ্রহণ করলেন। জীবসিদ্ধি এতক্ষণ নিদারুণ উত্তেজনা চেপে রেখেছিল। তাই আর থাকতে না পেরে বলে উঠল,
—এইবার তো চন্দ্রগুপ্তও উপস্থিত। এবার বলুন আচার্য রহস্যর সমাধান কীভাবে করলেন। আমি গতকাল থেকে অথই জলে রয়েছি।
জীবসিদ্ধির সুরে সুর মেলান চন্দ্রগুপ্ত,
—হ্যাঁ, আচার্য। আমার কাছেও সব রহস্য পরিষ্কার নয়। আপনি গোড়া থেকেই আরম্ভ করুন।
—একটু ধৈর্য ধরো। আগে একটা খেলা দেখাই তোমাদের।
আচার্য উঠে ভেতরে গেলেন। একটা ছোট্ট ছুরি নিয়ে ফিরলেন। ফলের পাত্র থেকে একটা আঙুর তুলে নিলেন। ছুরি দিয়ে সেটাকে কেটে দু-ভাগ করলেন। পাশে মাটির পাত্রে রাখা একটা গাছের মাটিতে টুকরো দুটো ফেললেন।
—এই গাছের মাটিটায় পিঁপড়ে থাকে। দেখো কী হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আঙুরের দুটো টুকরোতেই পিঁপড়ের ঝাঁক ছেঁকে ধরল। অদ্ভুতভাবে দেখা গেল একটা টুকরোয় ছেঁকে ধরা প্রতিটা পিঁপড়ের মৃত্যু হল। কিন্তু অন্য টুকরোয় থাকা পিঁপড়েগুলোর কিছুই হল না।
সেইদিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে চাণক্য বললেন,
—এই হল হত্যা রহস্যর সমাধান, সম্রাট।
দুই শিষ্য হতবুদ্ধির মতন তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছে দেখে আচার্য বলে উঠলেন,
—বুঝলে না তাও? বেশ। প্রথম থেকেই বলি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সবচেয়ে সহজ সমাধানটাই ঠিক সমাধান হয়ে থাকে। এইক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। পুরো ঘটনায় কয়েকটা বিষয় প্রথম থেকেই সন্দেহজনক ছিল। প্রথমত, গান্ধার-রাজ অম্বিকের হঠাৎ হৃদয় পরিবর্তন। এটা অস্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, সে দূত হিসেবে পাঠাল কাকে? তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা অমাত্যকে। সঙ্গে কোনো নিজস্ব সৈনিক পর্যন্ত পাঠাল না। যাতে অনর্থ কিছু ঘটলে তার সম্পূর্ণ দায় চাপানো যায় মগধের ওপর। আমি নিশ্চিত এই সম্পূর্ণ খেলাটার নেপথ্যে রয়েছেন মগধের প্রধানমন্ত্রী আচার্য শকুনি। তিনি জানতেন যে, ব্রাহ্মণ শুকদাসের মৃত্যু যদি পাটলিপুত্রতে ঘটে, তবে এক বাণে দুটো শিকার করা হবে। যে অমাত্য ওঁর গলার কাঁটা হয়ে রয়েছে এতদিন, তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। এবং সেইসঙ্গেই মগধের বিরুদ্ধে গান্ধারের হাতে একটা মোক্ষম অস্ত্র চলে আসবে। যুক্তি দিয়ে ভাবলেই এ বিষয়ে কোনো সন্দেহর অবকাশ থাকে না যে শুকদাসের হত্যার নেপথ্যে গান্ধারের গভীর ষড়যন্ত্র আছে। আচার্য শকুনিই এই হত্যা সংগঠিত করিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল কীভাবে?
আরও খানিকটা মিষ্টি নিজের মুখে দিয়ে, আচার্য শুরু করলেন,
—প্রথমেই সন্দেহ গিয়ে পড়ে, অবশ্যই গান্ধার থেকে আসা পাচক আর খাবার পরীক্ষকের ওপরে। কিন্তু তাদের প্রতিটা গতিবিধি নজরবন্দি ছিল। তবে তারা হত্যা করবে কীভাবে? আমার প্রথম সন্দেহ জাগে হত্যার শস্ত্রটিকে নিয়ে। বিষ-যুক্ত শলাকা। কেন? অন্য কোনো অস্ত্র কেন নয়? যদি রাতে ছাদের দিক দিয়ে আমাদের কোনো সৈনিক ঢুকেই থাকে, তবে সে তলোয়ার দিয়েই হত্যা করবে। এই অতি নাটকীয় হত্যার উপায় কেন বেছে নেবে? ক্রমেই আমার বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে ওই শলাকাটা, আমাদের বিভ্রান্ত করার উপায় মাত্র। আসলে খাবারের সঙ্গেই বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু সমস্ত প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে খাবারে বিষ নেই। এই বিষয়টাই আসল সমস্যা। এটার সমাধানে একটু পরে আসছি। আপাতত তর্কের খাতিরে যদি শলাকাটাকে ভুলে যাই, তাহলেই কিন্তু বাইরের থেকে হত্যাকারীর প্রবেশের যুক্তিটা আর থাকে না। এবং তাতেই রহস্য অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। হত্যাকারী অবশ্যই ওই পাচক, অথবা পরীক্ষক, অথবা দু-জনই ষড়যন্ত্রে যুক্ত।
তাদের প্রশ্ন করলে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু তাদের মিথ্যে বলার সম্ভাবনাই বেশি। অন্ধকা কিংবা কুম্ভ, অথবা দু-জনই সম্ভবত গুপ্ত-হত্যাকারী। তারা আসলে পাচক বা খাবার-পরীক্ষক নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যে দু-জনই স্বীকার করেছে যে তারা একে অন্যকে আগে চিনত না। অর্থাৎ যদি একজন মিথ্যে বলে, অপরজন সেটা ধরতে পারবে না। তাই তাদের পরীক্ষা করতে আমি তাদের একটা করে প্রশ্ন করি। পাচক দাবি করে সে গত তিন বছর ধরে ব্রাহ্মণ শুকদাসের কাছে রান্নার কাজ করছে। অথচ যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে একাদশীর দিন সে কী পদ বানায়, সে উত্তর দিল ‘রোজ যা হয়’। সব ব্রাহ্মণ বাড়ির পাচকরাই জানে যে একাদশীর দিন ব্রাহ্মণরা অন্ন গ্রহণ করে না। তারা শুধুই ফলাহার করে। অর্থাৎ পাচক অন্ধকা মিথ্যে বলছে। সে খুব সম্ভবত গান্ধারের নিযুক্ত গুপ্ত-হত্যাকারী।
একইভাবে কুম্ভ অর্থাৎ খাবার-পরীক্ষককে প্রশ্ন করি সে হাফুস বা আপুস আম খেয়েছে কি না। এই বিশেষ জাতের আম আমাদের দেশের সবচেয়ে দামি ফলের মধ্যে অন্যতম। এই আম সাধারণত শুধুমাত্র রাজকীয় খাবারেরই অংশ হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষ এই আম খাওয়া দুরস্ত, নামও শোনেনি। কিন্তু এইক্ষেত্রে কুম্ভ হাফুস নাম শুনেই সেটাকে আম বলে চিনল এবং তা সে খেয়েছে বলেও স্বীকার করল। অর্থাৎ সে সত্যিই রাজ পরিবারের খাবার- পরীক্ষকই বটে। গান্ধার-রাজের কর্মচারী শুনেই আমরা তাকে বেশি সন্দেহ করব, তা জেনেও কিন্তু সে সত্য বলেছে। কারণ সে নির্দোষ। নির্দোষের ভয় কম থাকে। মিথ্যে বলার প্রয়োজনও সে বোধ করেনি।
চাণক্য থামতে জীবসিদ্ধি বলল,
—বেশ। অর্থাৎ ওই অন্ধকা নামের পাচকই হত্যাকারী। কিন্তু সে হত্যা করল কীভাবে? খাবারে তো বিষই ছিল না।
—না। খাবারে বিষ ছিল না। কিন্তু খাবারের মাধ্যমেই ব্রাহ্মণের শরীরে বিষ ঢোকানো হয়েছে।
জীবসিদ্ধি এবং চন্দ্রগুপ্ত দু-জনেই প্রশ্ন করে উঠলেন,
—এটা কীভাবে সম্ভব?
১২.
চাণক্য মিষ্টির অর্ধেকটা শেষ করে ফেলেছেন। বাকিটুকু থেকে আরও একটু তুলে নিয়ে বললেন,
—হুমম। সম্ভব। অতি সরল অথচ অসম্ভব চতুর একটা কৌশলে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। সম্রাটের নিশ্চয়ই মনে আছে হত্যাকাণ্ডর পরের দিনের কথা। যখন আমি উচ্ছিষ্ট খাবারে বিষ আছে কি না পরীক্ষা করতে যাই, সেখানে সমস্ত বাসন এবং উচ্ছিষ্ট পড়ে থাকলেও, ফল কাটার ছুরিটা সেখানে ছিল না। আমি যখন অমাত্যর কাছে ছুরি চাই, তখন অমাত্য কৃষ্ণনাথ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেন– ‘ছুরি নেই? ছিল তো রাতে….।’ এই কথাটা ওই পরিস্থিতিতে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়ায় চন্দ্রগুপ্ত সামান্য ক্ষুণ্ণও হয়েছিল সেইদিন। অথচ এই কথাটা যদি সেদিনই আমি খেয়াল করতাম, তবে রহস্যর সমাধান সেইদিনই হয়ে যেত। ছুরি সেখানে ছিল না। সমস্ত থালা বাসন পড়ে আছে, শুধু ওই একটা সাধারণ বস্তু নেই। নিশ্চয়ই কেউ সরিয়েছে। কিন্তু কেন? কারণ, সেই ছুরিটাই হল আসল হত্যা-শস্ত্র। হত্যা করা হয়েছে ওই ছুরি ব্যবহার করেই।
—অর্থাৎ? মৃত্যু তো হয়েছে বিষ প্রয়োগে?
চন্দ্রগুপ্তর এই প্রশ্নে চাণক্য মৃদু হেসে উত্তর দিলেন,
—ঠিক। কিন্তু সেই বিষ খাবারের সঙ্গে মেশানো হয়েছে ওই ছুরি দিয়ে। পরোক্ষভাবে ওই ছুরি দিয়েই হত্যা করা হয়েছে। একটা সাধারণ ফল কাটার ছুরি, যেমন ধরো এইটা (সামনে পড়ে থাকা ছুরি তুলে নেন আচার্য), এর বাঁ-দিকের ফলায় লাগানো হয় মারণ বিষ এবং ডান দিকের ফলা রাখা হয় নির্বিষ। শুধু একদিকের ফলা বিষাক্ত। এই ছুরি দিয়ে কোনো ডান হাতি ব্যক্তি যদি ফল বা রুটি কাটে, তবে প্রতি ক্ষেত্রে শুধু প্রথম টুকরোটা হবে নির্বিষ। অথচ পরবর্তী প্রতিটা টুকরো হবে বিষাক্ত। প্রথমবার কাটায় প্রথম টুকরো নির্বিষ হবে, কিন্তু তার সঙ্গেই বিষাক্ত ফলাটা ঘষে যাবে রুটি বা ফলের বাকি অংশের গায়ে। আমি এই ছুরিটাতেও একইভাবে বাঁ-ফলায় বিষ লাগিয়েছি। সাধারণ পিঁপড়ে মারার বিষ। যে কারণে এটা দিয়ে কাটা আঙুরের ডান দিকের ভাগ সাধারণ হলেও অন্য ভাগটা বিষাক্ত। ফলাফল তো নিজের চোখেই দেখলে একটু আগে।
—এ তো সাংঘাতিক কৌশল, আচার্য।
—হুমম। আমি নিশ্চিত এই সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্র, এই কৌশল পুরোটা আচার্য শকুনির মস্তিষ্কপ্রসূত। উনি নিজের এই ক্ষুরধার মস্তিস্ক জনকল্যাণে ব্যবহার করলে, আজ আমরা মিত্র হতাম। কিন্তু উনি নিজেকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। সেই তক্ষশিলায় অধ্যাপনার সময় থেকেই আমাদের দু-জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তোমরা দু-জনেই সেই সময়ে আমার ছাত্র ছিলে। তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে সেইসব কথা।
কিছুক্ষণ অতীতের চিন্তায় ডুবে গেলেন চাণক্য। তারপর বললেন,
—ভেবে দেখো, কী অভিনব হত্যাকৌশল। রুটি এবং ফলের প্রথম যে টুকরোগুলো খাদ্য-পরীক্ষক খাবে, তাতে বিষের চিহ্নমাত্র থাকবে না। অথচ তারপর থেকে যতবারই সেই একই ছুরি দিয়ে রুটি আর ফল কেটে মুখে দিয়েছেন ব্রাহ্মণ, ততবারই নিজের অজান্তেই মারণ বিষ ঢুকেছে তাঁর শরীরে। প্রতি গ্রাসের সঙ্গে তাঁর শরীরে বিষের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং সেইসঙ্গেই, ছুরির ফলা থেকে বিষও উঠে গেছে। অতিথিশালায় দাঁড়িয়ে থাকা আরও অতগুলো মানুষের চোখের সামনে অপরাধ ঘটেছে। অথচ কেউ টেরও পায়নি। উচ্ছিষ্ট খাবারে যদি বিষ থেকেও থাকে, তা অতি সামান্যই হবে। কারণ প্রতিবার ছুরি দিয়ে এক একটি কাটার সঙ্গেই বিষের পরিমাণ কমে এসেছে। উচ্ছিষ্ট খাবারে আর বিষ না থাকাই স্বাভাবিক।
কিন্তু বিষ ব্যবহারের ফলে ছুরিটার একদিকের ফলার রং নিঃসন্দেহে অন্যদিকের চেয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তাই সেটা নজরে পড়ার আগেই পাচক অন্ধকা সরিয়ে ফেলে। হয় সেই রাতেই খাওয়া শেষের পর সেটা সরিয়েছিল, অথবা পরের দিন সকালে যখন দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে, সেই সময়ে। এই সময়ে অন্ধকা আরও একটা কাজ করে। একটা অন্য মারণ বিষ মাখানো শলাকা সবার অলক্ষে ফেলে দেয় ঘরের মেঝেতে। তাতে লাগা রক্ত সম্ভবত কোনো হতভাগ্য পশুর বা পাখির। সে জানত ওইটা আমরা খুঁজে পাব। এবং তাহলেই বিভ্রান্ত হয়ে বাইরে থেকে আততায়ী এসেছিল বলে অনুমান করে নেব। খাবারে বিষ থাকার কথা মাথায় আসবে না আর। এই সম্পূর্ণ পরিকল্পনার সবচেয়ে বড়ো অংশ হল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কৌশলগুলো। সেই রাতে জেনেবুঝেই উচ্ছিষ্ট খাবার সরিয়ে ফেলেনি পাচক। সে চেয়েছিল যেন সকালে আরও একবার খাবারে বিষ আছে কি না, সেটা পরীক্ষা হোক। এতে তার ওপর থেকে সন্দেহ পুরোপুরি সরে যায়। আমিও প্রায় বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম, যদি না, গতকাল জীবসিদ্ধি আসত।
—আমি? আমি কী করলাম?
বিস্মিত হয়ে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল। স্মিত হেসে আচার্য উত্তর দিলেন,
—তুমি যে তরমুজটা আনলে। ওইজন্যই তো আমার মাথায় সমাধান এল। তুমি তরমুজ কাটার জন্য যেই আমার থেকে ছুরি চাইলে, সেই মুহূর্তে আমার ছুরির কথাটা মনে এল। দু-দিন আগে অমাত্যর ছুরি না থাকার কথাটা মনে পড়ল। মুহূর্তে সব কিছু চোখের সামনে দেখতে পেলাম। সন্দেহ তো আগে থেকেই ছিল পাচকের ওপরে। শুধু হত্যাকৌশলটা আন্দাজ করতে পারছিলাম না। সেটা মাথায় আসতেই পুরো রহস্যের জট খুলে গেল।
—আপনি অসাধারণ, আচার্য!
চন্দ্রগুপ্তর উক্তিটা অগ্রাহ্য করে চাণক্য বললেন,
—এটা একটা প্রায় ‘নিখুঁত হত্যাকাণ্ড’ ছিল। সম্রাট, তোমার কি সেইদিন রাজ-বৈদ্যর বলা কথাটা মনে আছে? উনি বলেছিলেন যে মৃতদেহর নীল রং দেখে ওঁর প্রাথমিকভাবে সন্দেহ হয়েছিল বিষ প্রয়োগ রাতের প্রথম প্রহরের দিকে করা হয়েছে। ভেবে দেখো, ওঁর অনুমানই কিন্তু ঠিক ছিল। বিষ রাতের শুরুর দিকেই শরীরে প্রবেশ করেছিল। খাবারের সঙ্গে। তারপর বিষ ধীরে ধীরে কাজ শুরু করে। ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। রাত দ্বিতীয় প্রহরের শেষের দিকে বিষক্রিয়ার কারণে, অস্বস্তিতে ব্রাহ্মণের ঘুম ভেঙে যায়। বেশিরভাগ বিষেরই উপসর্গ হল গলা শুকিয়ে যাওয়া। এইক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ব্রাহ্মণ জলের পাত্র নিতে পালঙ্ক থেকে হাত বাড়ান। কিন্তু উনি পালঙ্ক থেকে পড়ে যান। সেই মুহূর্তে ওঁর মৃত্যু ঘটে এবং জল ভরতি পাত্র উলটে যায়।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার কথা শুরু করেন আচার্য,
—ওই সামান্য শলাকাটা প্রথম থেকেই আমাদের কতটা বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে ভেবে দেখো। আমরা সকালে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছিলাম যে শলাকার ওই তীব্র বিষেই মৃত্যু ঘটেছে। অথচ ওই শলাকার বিষ আর হত্যায় ব্যবহৃত বিষ সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির। শলাকার বিষ অতি তীব্র প্রভাব ফেলে। এই বিষ রক্তর সংস্পর্শে আসার কয়েক মুহূর্তেই মৃত্যু হয়। কিন্তু ছুরিতে ব্যবহৃত বিষ সম্পূর্ণ আলাদা। সেটা প্রভাব বিস্তার করে ধীরে। প্রায় দু-প্রহর সময় ধরে বিষক্রিয়া সারা দেহে ছড়ায়। তারপর মৃত্যু হয় আক্রান্তর। অর্থাৎ বিষক্রিয়ার মুহূর্ত এবং মৃত্যুর মুহূর্তর মাঝে অনেকটা সময়ের ব্যবধান। রাজ-বৈদ্য নিশ্চিত ছিলেন যে মৃত্যু শেষরাতের দিকে হয়েছে। তাই ধরেই নেন যে বিষ প্রয়োগ সেই সময়েই করা হয়েছে। এই জায়গাটাই বুঝতে ভুল করে ফেলেন তিনি। হত্যা-শস্ত্র হিসাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে শলাকাটাই নির্বাচন করার কারণ হল সেটার ক্ষুদ্রতা। খুব সহজেই সবার নজর এড়িয়ে সেটা নিয়ে ঢুকেছিল অন্ধকা এবং সবার অলক্ষে ওই ছোটো শলাকাটা ঘরের মেঝেতে ফেলে দিয়েছিল।
কথা থামিয়ে দুই শিষ্যর মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন চাণক্য। বললেন,
—আশা করি, তোমাদের সমস্ত প্রশ্নর উত্তর দিতে পেরেছি। কালকে সন্ধেবেলা রহস্যর সমাধান করতে পেরেই জীবসিদ্ধিকে পাঠাই তোমার কাছে, চন্দ্রগুপ্ত। চিঠিতে নির্দেশ দিই যে এক্ষুনি যেন পাচককে গ্রেফতার করা হয় আর তার ঘর তল্লাশি করা হয়। এই কারণেই অম্বি তার দু-জন লোককে ছেড়ে দেয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছিল। কারণ একবার তারা মগধ ত্যাগ করলে আর কোনোদিনই দোষ প্রমাণ করার উপায় থাকত না। আমি অনুমান করেছিলাম যে ওই একদিকের ফলায় বিষ মাখানো ছুরি সে সাবধানে লুকিয়ে রাখবে। যত্রতত্র সেটা ফেলে দেয়ার সুযোগ পাবে না। কারণ সে নজরবন্দি। তার মনে সর্বক্ষণ ধরা পড়ার ভয় কাজ করবে। এবং ছুরিটাই এই পুরো পরিকল্পনার ভিত্তি। ওটা খুঁজে পাওয়া গেলেই অন্ধকা দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হবে। এবং ঘটেছেও ঠিক তাই। এই পুরো ঘটনায় কুম্ভ নামের খাবার- পরীক্ষকটি নিজের অজান্তেই হত্যাকাণ্ডর সহায়ক হয়েছে। সে নির্দোষ
—জানি, আচার্য। সেই কারণেই, তাকে নিজের দূত করে আজ গান্ধারে পাঠিয়েছি।
চন্দ্রগুপ্তর কথায় মৃদু হাসলেন চাণক্য। জীবসিদ্ধির দিকে ফিরে বললেন,
—হুম। সাধু। ওহে জীবসিদ্ধি, তুমি কি একটু কষ্ট করে ভাঁড়ার থেকে অন্য একটা ছুরি নিয়ে আসবে? এই ছুরিটা তো তোমাদের খেলা দেখাতে গিয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেল। আজ আমরা তিনজন মিলে তোমার আনা তরমুজটার স্বাদ গ্রহণ করতে পারি। এই তরমুজটার জন্যই আজ সম্রাটের জয় হল বটে।
***
উপসংহার :
প্ৰিয় আচাৰ্য,
আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করব না। আজ আপনার কারণেই একটা অযাচিত যুদ্ধ থেকে মৌর্য সাম্রাজ্য রক্ষা পেয়েছে।
আপনার অবগতির জন্য জানাই, গান্ধার আত্মসমর্পণ করেছে। অম্বির অবশ্য আর কোনো উপায় ছিল না। ব্রহ্মহত্যা আর ষড়যন্ত্রর দায়ে তার নিজের রাজ্যবাসী এবং অন্যান্য রাজারা তাকে তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছে। এদিকে তার গুরু, আচার্য শকুনি নিখোঁজ। তিনি তাঁর শিষ্যকে পরিত্যাগ করে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তবে তিনি নাকি আপনাকে এবং মগধকে ধ্বংস করার শপথ নিয়েছেন। তাঁর সন্ধান করছে আমাদের গুপ্তচরেরা।
আমার প্রণাম নেবেন। আশীর্বাদ করবেন।
ইতি,
আপনার শিষ্য,
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।
.
পুনশ্চ: আপনার অর্থশাস্ত্র লেখার কাজ কতদূর অগ্রসর হল?
***
১. এই গল্পে বর্ণিত হত্যার পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রাচীন গ্রিসের এক রানি তাঁর শাশুড়ি, অর্থাৎ রাজমাতাকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
২. ভূর্জপত্র বা ভূজপাতা আসলে ভূজ গাছের পাতলা ছাল। এই ছাল একবার ছাড়িয়ে নিলে আবারও গজিয়ে যায়। এই ছাল আদিকালে লেখার কাজে ব্যবহার হত।
***
References :
1. T. Ganapati Sastri, Koutaliyam Arthaśāstra Srimulākhyayā vyākhyā, Rastriya Sanskrit Samsthan, New Delhi, Edition 2002, Part -1 and Part – 2.
2. More Sharda Hanumantrao and Pol Hemant Sambhajirao, Poisoning In Ancient India W.S.R. To Kautilya Arthashastra, International Journal of Applied Ayurved Research.