১.
পাটলিপুত্র। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর রাজসভা। রাজপুরুষ, মন্ত্রীগণ এবং সাধারণ নাগরিকদের সমাগম সভাঘর জুড়ে। রত্নখচিত সিংহাসনে বসে আছেন স্বয়ং সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। নাগরিকদের আর্জি তিনি শুনছেন মন দিয়ে। হঠাৎই গম্ভীর মুখে এক সৈনিক প্রবেশ করল। নতমস্তকে সম্রাটকে অভিবাদন জানাল,
—সম্রাটের জয় হোক।
ইশারায় সম্রাট তাকে কথা বলার অনুমতি দিলেন। সৈনিক বলল,
—পাটলিপুত্রর পশ্চিম দ্বারে এক ব্রাহ্মণ সহ আরও দুই ব্যক্তি আপনার দর্শনপ্রার্থী। ওঁরা নিজেদের উত্তর-পশ্চিমের গান্ধারের রাজদূত হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
গান্ধারের নাম শুনেই চাঞ্চল্য দেখা দেয় রাজসভায়। কারণ গান্ধার যে গত কয়েক বছর ধরেই মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ হতে অস্বীকার করে এসেছে তা সকলেরই জানা। কয়েক বছর আগে মৌর্য সাম্রাজ্য স্থাপনের সময় থেকেই গান্ধার মগধের বিরোধিতা করে এসেছে। এর প্রধান কারণ গান্ধার-রাজ অম্বির সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তর পুরোনো শত্রুতা। কিন্তু মগধ ক্রমেই ক্ষমতাবৃদ্ধি করেছে এবং ধীরে ধীরে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে গান্ধারের ওপর। রাজধানীতে আজ গান্ধারের রাজদূতের আগমন হয় আসন্ন যুদ্ধ অথবা মৈত্রীর ইঙ্গিত। সম্রাটের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা প্রধান-অমাত্য কৃষ্ণনাথ প্রশ্ন করলেন,
—পরিচয়পত্র পরীক্ষা হয়েছে?
—হ্যাঁ, আর্য।
এইবার সম্রাট বললেন,
—তাদের নগরে প্রবেশের আজ্ঞা দেয়া হল। তাদের সভায় উপস্থিত করা হোক। সৈনিক চলে যেতেই প্রধান-অমাত্য কৃষ্ণনাথ সম্রাটের কাছে এসে বললেন, – সম্রাট, সভা আজকের মতো ভঙ্গ করুন। গান্ধারের বিষয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন চন্দ্রগুপ্ত।
সভা সমাপ্তির ঘোষণা হতেই কয়েকজন অমাত্য ছাড়া এক এক করে প্রত্যেকেই সভাঘর ত্যাগ করল। প্রধান-অমাত্য কৃষ্ণনাথ উত্তেজিতভাবে প্রশ্ন করলেন,
—সম্রাট। আপনার কী ধারণা? কী সংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে দূত? গান্ধার কি আমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে নাকি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলেছে?
একটু ভেবে সম্রাট উত্তর দিলেন,
—অম্বি নিজে এক নীচ পিতৃহন্তা এবং কাপুরুষ। দূত পাঠিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা সে করবে না। অম্বি আক্রমণ করলে, তা অবশ্যই করবে আচমকা রাতের অন্ধকারে। তবে মগধের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা তার নেই। অতএব দূত যুদ্ধ ঘোষণা করতে আসছে না এই বিষয়ে আমি প্রায় নিশ্চিত।
—তার মানে নিশ্চয়ই আমাদের কূটনৈতিক চাপের কাছেই নতিস্বীকার করতে চায়! এটা পরম সুখবর, সম্রাট!
খানিকক্ষণ চিন্তা করে সম্রাট বললেন,
—দেখাই যাক। তবে অম্বি নিজের হঠকারিতা ত্যাগ করে, এত তাড়াতাড়ি আমার কাছে হার মেনে নেবে সেটাও বিশ্বাস হয় না। গান্ধার-রাজ অম্বি মূর্খ কিন্তু তার প্রধান-অমাত্য অতি ধূর্ত ব্যক্তি। একইসঙ্গে তিনি অম্বির গুরুও বটে। লোকে তাঁকে মহাভারতের গান্ধার পুত্র, শকুনির সঙ্গে তুলনা করে। তাঁকে লোকে অমাত্য শকুনি বলে ডাকে।
—তবে আপনি কি এটা তারই কোনো নতুন ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ করছেন?
—নাহ্। পাটলিপুত্রতে এসে বিশেষ কিছুই করার সামর্থ্য তাদের নেই। তবে অম্বি আমায় যতটা ঘৃণা করে, তার আচার্য শকুনি, আচার্য চাণক্যকে ততটাই ঘৃণা করে। সেই কারণে সাবধান থাকাই শ্রেয়।
আর একজন সভাসদ প্রশ্ন করলেন,
—সম্রাট, মার্জনা করবেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। আপনি বরাবরই গান্ধারকে মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করতে এত তৎপর কেন?
মৃদু হেসে চন্দ্রগুপ্ত উত্তর দিলেন,
—কারণ তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয় গান্ধারে অবস্থিত। আপনারা সকলেই জানেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় আমার এবং আচার্য চাণক্যর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একসময়ে আচার্য নিজে সেখানে অধ্যাপনা করেছেন এবং আমি নিজে তাঁর ছাত্র ছিলাম তক্ষশিলায়। অখণ্ড আর্যাবর্তর স্বপ্নের সূত্রপাত সেখান থেকেই হয়েছিল। আর তা ছাড়া, গান্ধার হল এই দেশের সীমান্ত প্রদেশ। তা অম্বির মতো অপদার্থ শাসকের হাতে সুরক্ষিত নয়। আর সীমান্ত সুরক্ষিত না হলে এই দেশও সুরক্ষিত নয়।
সম্রাটের যুক্তিতে সকলেই সম্মতি জানাল।
কিছুক্ষণ বাদেই রাজসভায় দু-জন সৈনিক প্রবেশ করল এবং তাদের সঙ্গে এক ব্রাহ্মণ ও দু-জন ভৃত্য স্থানীয় ব্যক্তি। ব্রাহ্মণ নত হয়ে সম্রাট ও উপস্থিত সকলকে প্রণাম জানালেন। হাসিমুখে বললেন,
—ধন্য আমি, সম্পূর্ণ আর্যাবর্তর সম্রাট, বীর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর সাক্ষাৎ পেয়ে। হে সম্রাট, আমি শুকদাস, গান্ধার-রাজ অম্বির একজন অমাত্য। আমি সুখবর নিয়ে এসেছি, সম্রাট।
শুকদাস একটা রাজ-মোহর লাগানো চিঠি এগিয়ে দিলেন কৃষ্ণনাথের দিকে। সেটা খুলে পড়তেই কৃষ্ণনাথের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
—সম্রাট! এ যে সত্যিই সুখবর। গান্ধার-রাজ আমাদের সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে মগধের অন্তর্গত হতে চান।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্তও এই খবরে চকিত এবং হর্ষিত হলেন। ব্রাহ্মণের উদ্দেশে বললেন,
—এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হল, অমাত্য শুকদেব?
—সম্রাট, সত্যি বলতে, মহারাজ আর প্রধান-অমাত্যর এই হঠাৎ হৃদয় পরিবর্তনে আমি নিজেও বিস্মিত। তবে আমরা অন্যান্য অমাত্য তথা সমগ্র রাজ্যবাসীর বহুদিনের দাবি ছিল গান্ধারকে মৌর্য সাম্রাজ্যের অঙ্গ করার। নাগরিকদের এই আন্দোলনের নেতৃত্ব আমি নিজে দিয়েছিলাম। এবং তাতে ইন্ধন দিয়েছে তক্ষশিলার আচার্যরা। গান্ধারে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সম্ভবত সেই কারণেই বাধ্য হয়ে এই নির্ণয়।
—হ্যাঁ। এই তথ্য আমার জানা যে গান্ধারের বিচক্ষণ অমাত্যরা তথা অধ্যাপকরা আমাদের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য আগেও বহুবার আর্জি জানিয়েছেন। প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে রাজার থেকে। তবে দেরিতে হলেও তাঁর যে শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, তা জেনে ভালো লাগল।
—যথার্থ বলেছেন, সম্রাট।
—আপনি আমাদের বিশেষ অতিথি মহোদয়। পথযাত্রায় আপনি নিশ্চয়ই ক্লান্ত। আমাদের আপ্যায়নে কয়েক দিন রাজমহলে যাপন করার আমন্ত্রণ জানাই।
—ধন্যবাদ, সম্রাট। তবে আমি দু-দিন বিশ্রাম নিয়েই আপনার উত্তর সমেত ফিরে যাব। শুভ কাজে দেরি নয়।
অমাত্য কৃষ্ণনাথ প্রশ্ন করলেন,
—আপনার সঙ্গে এরা আপনার ভৃত্য? আপনার সঙ্গে গান্ধারের কোনো প্রহরী আসেনি?
—আমাদের রাজা আমার সঙ্গে কোনো প্রহরী পাঠাননি। তিনি জানিয়েছেন যে আপনার দায়িত্বে তিনি আমার সুরক্ষা ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত। মগধকে তিনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন। শুধু নিয়মরক্ষার স্বার্থে সঙ্গে এই একজন পাচক আর খাবার-পরীক্ষক দিয়েছেন।
রাজপুরুষদের হত্যার ক্ষেত্রে বিষপ্রয়োগ হল সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। সেই কারণেই, রাজদূতদের সঙ্গে একজন নিজস্ব পাচক ও খাবার-পরীক্ষক পাঠানোটা নিয়ম। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত হেসে বললেন,
—সম্পূর্ণ ভরসা যে করেন না তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে আপনার সুরক্ষায় আপনার সঙ্গে সর্বদা দু-জন সৈনিক বহাল করলাম। আপনাকে গান্ধার অবধি সুরক্ষিত পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমার। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, মহোদয়। আপনি আমার বাড়িতে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।
২
রাজমহলের অন্দরেই একটি সুসজ্জিত অতিথি-কক্ষে শুকদাসের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুকদাস অমাত্য কৃষ্ণনাথের সঙ্গে দিনের বেলা মহল পরিদর্শন করলেন। সর্বক্ষণ তাঁর সঙ্গে দু-জন প্রহরী থেকেছে। ক্লান্ত থাকায় সূর্যোদয়ের পর দ্বিতীয় প্রহরের দিকে তাড়াতাড়িই খাওয়া-দাওয়া করে তিনি ঘরে দরজা দিলেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হওয়া অবধি কৃষ্ণনাথ নিজে অপেক্ষা করলেন এবং দরজার বাইরে দু-জন সশস্ত্র প্রহরীকে সারারাত পাহারায় থাকতে নির্দেশ দিলেন। কোনোভাবেই যেন ব্রাহ্মণকে একা ছাড়া না হয় বা তাঁর সুরক্ষায় কোনো গাফিলতি না হয় সেই নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি নিশ্চিন্ত মনে নিজের ঘরের দিকে এগোলেন। আজ সত্যিই শুভদিন।
পরের দিন সকালে পাচক ও খাবার-পরীক্ষক শুকদাসের জন্যে প্রাতরাশ বানিয়ে উপস্থিত হল তাঁর দরজায়। সতর্ক দুই প্রহরী তখন নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে। তারা দরজার কড়া নাড়ল, কিন্তু দরজা খুলল না। প্রহরী ও দুই ভৃত্য অনেক ডাকাডাকি করতেও কোনো উত্তর না আসায় এক প্রহরী ছুটল প্রধান-অমাত্যকে খবর দিতে। চিন্তিতভাবে কৃষ্ণনাথ এলেন এবং তিনিও বার কয়েক ডাকাডাকি করলেন। কোনো ফল না হওয়ায় শঙ্কিত অমাত্য সম্রাটকে খবর পাঠালেন। সম্রাট নিজে কয়েকজন সৈনিক নিয়ে হাজির হয়ে নির্দেশ দিলেন দরজা ভেঙে ফেলতে।
শক্তপোক্ত সেগুন কাঠের দরজা ভেঙে ফেলা মোটেই সহজ হল না। ছ-জন বলিষ্ঠ সৈনিকের মিলিত চেষ্টায় সে দরজা ভাঙা হল। প্রথমেই প্রবেশ করলেন সম্রাট এবং ভেতরের দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ালেন। ওঁর পিছু পিছু অমাত্য, সৈনিকরা, সঙ্গে গান্ধারের দুই ভৃত্যও প্রবেশ করল। কিন্তু প্রত্যেকেই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কারণ ঘরের মেঝেতে ভূপাতিত হয়ে, নিশ্চল পড়ে আছেন শুকদাস। চোখ খোলা এবং তাতে বিস্ফারিত দৃষ্টি। সম্রাটের ইশারায় একজন সৈনিক এগিয়ে গিয়ে ব্রাহ্মণের নাকে হাত রাখল এবং হৃৎস্পন্দন পরীক্ষা করল। মাথা নাড়িয়ে জানাল যে ব্রাহ্মণ মৃত।
প্রাণহীন দেহটার দিকে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন। চরম বিপদ আসতে চলেছে। শত্রুদেশের রাজদূতের মৃত্যু হয়েছে তাঁর নিজের রাজমহলে! হত্যা করা হয়েছে তাঁকে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? কর্তব্য ঠিক করতে মাত্র কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল ওঁর। এই বিপদের মুহূর্তে ওঁর শুধু একজনেরই মুখ মনে আসছে। হ্যাঁ। একমাত্র তিনিই পারেন এই রহস্যর সমাধান করতে।
একজন সৈনিকের দিকে চেয়ে তিনি শান্তকন্ঠে নির্দেশ দিলেন,
—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আচার্য চাণক্যকে খবর দাও!
৩.
নিজের ঘরে একাকী বসে আছেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত। আজকে সভা করার পরিস্থিতি নেই। তাঁর মনের ভেতর দুশ্চিন্তার ঝড় চললেও বাইরে থেকে তিনি শান্ত। সম্রাটকে কখনো নিজের অন্তরের ভাব অথবা দুর্বলতা লোকসমক্ষে প্রকাশ করতে নেই। তিনি একজনের পথ চেয়ে অধীর অপেক্ষায় বসে আছেন। সেই মুহূর্তেই অতি পরিচিত খড়মের শব্দ তাঁর কানে এল। সেই আওয়াজ তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে। ঘরে ঢুকলেন সেই খড়ম পরা ব্যক্তি।
উচ্চতায় সম্রাটের চেয়ে সামান্য কম, কৃষ্ণবর্ণ, ন্যাড়া মাথায় শুধু লম্বা টিকি এবং সাধারণ ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীর বেশ। কপালে চন্দনের ত্রিবলী টিকা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা এবং বুকের ওপর দৃশ্যমান পইতে তাঁর ব্রাহ্মণ্যত্বের পরিচয় দিচ্ছে। অসম দন্তরাশির কারণে তাঁর মুখে একধরনের কুরূপতা প্রকাশ পায়। ব্যক্তির আপাত বিশেষত্বহীন চেহারায় উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁর দুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখ। অন্তর্ভেদী সেই দৃষ্টিতে যেন বিদ্যুৎ খেলে চলে প্রতি মুহূর্তে। অপরিচিত কোনো ব্যক্তি এই ব্রাহ্মণকে দেখে কোনোদিন অনুমান করতে পারবে না যে ইনি মহামতি বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য। আর্যাবর্তে এই মুহূর্তে তাঁর চেয়ে ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তি, দ্বিতীয় কেউ নেই। সম্ভবত সম্রাট নিজেও নন। তিনি সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর বাল্যকালের আচার্য, মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মূল মস্তিস্ক এবং পরবর্তীকালে প্রধান অমাত্য পদে আসীন ছিলেন কয়েক বছর। যদিও এখন তিনি স্বেচ্ছাবসর নিয়ে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছেন। রাজভবন তিনি ত্যাগ করেছেন। পাটলিপুত্রেই এক তুলনামূলক নির্জন স্থানে নিজের কুটিরে স্বেচ্ছায় সন্ন্যাসী জীবনযাপন করেন।
গুরুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম জানালেন সম্রাট। মাথায় হাত রেখে চাণক্য আশীর্বাদ করলেন,
—আয়ুষ্মান ভবঃ। যশস্বি ভবঃ। উৎকৃষ্ট ভারতম সম্রাট।
চন্দ্রগুপ্ত উঠে গুরুকে আসনে বসিয়ে নিজেও তাঁর মুখোমুখি বসলেন। প্রহরীকে তাঁদের একান্তে ছেড়ে দিতে বলে দরজা বন্ধ হওয়া অবধি অপেক্ষা করলেন। তারপর বললেন,
—আচার্য! মগধের ঘোর বিপদ আসন্ন, আচার্য। আপনি ছাড়া এই মুহূর্তে আমি আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
—হুমম। কী ঘটেছে, সম্রাট?
—গান্ধার-রাজ অম্বিকে মনে আছে আপনার?
—অবশ্যই। আচার্য শকুনির শিষ্য। ক্ষমতার লোভে, এই দেশদ্রোহী অঙ্গি সিকন্দরের সঙ্গে মৈত্রী করে, যবন সেনাদের এদেশে প্রবেশের পথ করে দিয়েছিল। তাকে কি ভুলতে পারি?
—হ্যাঁ। সে এতদিন মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হতে রাজি হয়নি। তাই আমরাও এইদিক থেকে কূটনৈতিকভাবে গান্ধারকে চাপ দেওয়া শুরু করি। তাঁর রাজ্যে নজিরবিহীন অপশাসন। কৃষকরা আত্মহত্যা করছে, শ্রমিকরা ক্ষুধার্ত মরছে আর শিক্ষাব্যবস্থাও ধুঁকছে। তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর রাজ্যবাসী ও তক্ষশিলার আচার্যরা বিদ্রোহ করছে। মগধের অংশ হওয়ার দাবি করেছে।
—হুমম। অম্বি একা হলে বহুদিন আগেই বিদ্রোহীরা তাকে হত্যা করতে সক্ষম হত। কিন্তু আচার্য শকুনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি। সেই তক্ষশিলায় অধ্যাপনা করার সময় থেকেই আমি তাকে চিনি। তার বুদ্ধিতেই এখনও অম্বি রক্ষা পেয়েছে। যাই হোক, হঠাৎ তার প্রসঙ্গ উঠছে কেন? সে কি এইবার হার মেনেছে? মগধের বশ্যতা স্বীকার করতে চায়?
—হ্যাঁ। সেইরকম ইঙ্গিত দিয়েই এক ব্রাহ্মণ দূতকে তিনি পাঠিয়েছিলেন। গতকাল তিনি এখানে পৌঁছেছিলেন। আমি তাঁর যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা করি। প্রাসাদের অন্দরেই অতিথিশালায় ওঁর থাকার ব্যবস্থা করি। কিন্তু আজ সকালে…
পুরো কথা শেষ না করে সম্রাট চুপ হয়ে যেতে অশনির ইঙ্গিত অনুমান করেই চাণক্য বলে ওঠেন,
—দয়া করে এইটা বোলো না যে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
—তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। আমি ভাবতে পারছি না, আচার্য। খোদ রাজমহলের অন্দরে গুপ্তহত্যা!
চাণক্য আসন ছেড়ে উদ্বিগ্নভাবে পায়চারি করতে শুরু করলেন। উত্তেজিত অথচ ধীর কণ্ঠে বললেন,
—চন্দ্রগুপ্ত! চন্দ্রগুপ্ত! এই অনর্থ তুমি কীভাবে ঘটতে দিলে? তুমি বুঝতে পারছ এই ঘটনার রাজনৈতিক তাৎপর্য? রাজদূতকে হত্যা একেই ধর্মবিরুদ্ধ পাপ। তার ওপর ব্রহ্মহত্যা! কাউকে বিশ্বাস করাতে পারবে না যে এতে মগধের হাত নেই। প্রত্যেকে তোমার ওপরেই দোষারোপ করবে। মৌর্যদের শাসনব্যবস্থার ওপর প্রশ্ন উঠবে। বিরোধী-রাজ্যরা তো বটেই, এমনকী মগধের অঙ্গরাজ্যের শাসকদের কাছেও মগধের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। তারা একজোট হবে আর ব্রাহ্মণদের উসকানি দেবে। সমস্ত মগধ বিরোধী রাজ্য এর লাভ ওঠাবে। বিশেষ করে গান্ধার।
—আমি আপনারই শিষ্য। আমি মূর্খ নই, আচার্য। আমি সব বুঝছি। আমি আপনাকে আশ্বাস দিতে পারি যে আমার তরফ থেকে যথাযথ সুরক্ষা আর সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে, বন্ধ ঘরে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। অপরাধী শীঘ্র ধরা না পড়লে যুদ্ধর সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সেই কারণেই আপনার সাহায্য চাই, গুরুদেব। এই রহস্যর সমাধান আপনিই করতে পারেন, আচার্য।
—হুমম। তুমি নিশ্চিত যে হত্যাই করা হয়েছে?
‘হ্যাঁ’ সূচক ঘাড় নাড়লেন সম্রাট। বললেন,
—মৃতদেহ দেখলে আপনিও সহজেই নিশ্চিত হবেন।
পায়চারি থামিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাণক্য বললেন,
—হত্যাস্থলে নিয়ে চলো আমায়।
—চলুন, আচার্য।
৪.
অতিথিশালাটা সুবিশাল। মূল্যবান আসবাবপত্র, পর্দা, অপূর্ব ভাস্কর্য, রঙিন চিত্র প্রভৃতি দিয়ে সাজানো। ঘরের একদিকে রুপোর থালায় এখনও গতরাতের অর্ধভুক্ত ভোজন, ফল-মূল আর রুটি পড়ে আছে। ঘরের মাঝখানে সুসজ্জিত পালঙ্ক এবং পালঙ্কর লাগোয়া একটা কাঠের তেপায়া মেজ। পালঙ্কর পাশেই মেঝেতে পড়ে আছে মৃতদেহ। একটা সোনার পানপাত্র মেঝেতে উলটে গড়িয়েগেছে দেয়ালের কোনায়। মেজের পাশেই খানিকটা জায়গায় জলের শুকনো দাগ। মৃতদেহর মুখ থেকে সাদা গ্যাঁজলা বেরিয়ে এসেছে। খোলা চোখে তীব্র যন্ত্রণার চিহ্ন স্পষ্ট। হাত এবং পায়ের নখ নীলাভ যা স্পষ্টতই বিষক্রিয়ার লক্ষণ।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ এই সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছিলেন চাণক্য। ঘরের মধ্যে আচার্য ছাড়াও স্বয়ং সম্রাট, অমাত্য কৃষ্ণনাথ এবং বৃদ্ধ রাজবৈদ্য উপস্থিত। চাণক্য অমাত্যর দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন,
—এই দরজা ছাড়াও ওদিকে দ্বিতীয় একটা দরজা দেখতে পাচ্ছি। ওই দরজা কোথায় খোলে?
—ওই দরজা দিয়ে বেরিয়েই ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি।
চাণক্য দ্বিতীয় দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলেন।
—এ কী? দরজায় ভেতর থেকে খিল দেয়া নেই। বাইরে থেকে বন্ধ। এর মানে তো যে কেউ ঢুকতে পারে এই দরজা দিয়ে।
আমতা আমতা করে অমাত্য বললেন,
—ওটা তো… মানে খেয়াল করিনি।
অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে সম্রাট বললেন,
—আপনার এই খেয়াল না করাতেই কেউ ওইখান দিয়ে ঢুকে হত্যা করে গেছে সম্ভবত। আপনাকে এত বার সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছিলাম। তারপরেও এই ভুল কীভাবে হয় আপনার?
বয়োজ্যেষ্ঠ কৃষ্ণনাথকে এর বেশি কিছু আর বললেন না চন্দ্রগুপ্ত।
অমাত্যর হয়ে চাণক্য উত্তর দিলেন,
—সম্রাট, এখনও কিন্তু প্রমাণিত হয়নি যে বাইরে থেকে লোক ঢুকেছিল। তা ছাড়া, ছাদে তো সারারাত পাহারা থাকে। তাই না?
এই কথায় সাহস পেলেন কৃষ্ণনাথ। বললেন,
—আজ্ঞে হ্যাঁ, আচার্য। ওখান থেকে সবার চোখ এড়িয়ে আততায়ী ঢুকতে পারবে না।
পরের প্রশ্ন আচার্য করলেন রাজ-বৈদ্যের উদ্দেশে,
—মৃত্যু বিষ প্রয়োগেই হয়েছে এই বিষয়ে নিশ্চিত তো?
—আজ্ঞে, হ্যাঁ। তবে দেহে আর কোনো ক্ষতচিহ্ন আমার চোখে পড়েনি। সাপের কামড় নয়।
—হুমম। খাবারে বিষ থাকার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।
কৃষ্ণনাথ বললেন,
—সেটা সম্ভব নয়, আচার্য। গতকাল রাতের পুরো রান্না হয়েছে আমার নিজের চোখের সামনে। গান্ধারের পাচক ও খাদ্য-পরীক্ষকটিকে বিশ্বাস করা যায় না। খাবারে যাতে বিষ প্রয়োগ কোনোভাবেই সম্ভব না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে, আমি এবং সঙ্গে আরও পাঁচজন প্রহরী কড়া সতর্কতার সঙ্গে নজর রেখেছি সর্বক্ষণ। আনাজ, চাল, ঘি ইত্যাদি সব আমরা রাজভাণ্ডার থেকে দিয়েছিলাম। শুধু তা রান্না করেছে গান্ধারের পাচক। সেই প্রতিটা খাবার, শুকদাস মুখে তোলার আগে গান্ধারের নিজস্ব খাবার-পরীক্ষক আমাদের সামনে তা প্রথমে খেয়ে দেখেছে। সেই ব্যক্তির ভেতর কোনোরকম বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়নি।
—হুমম। বিষাক্ত চাল ফোটানোর সময়ে অস্বাভাবিক ময়ূর-নীলাভ ধোঁয়া বের হয়। সবজিতে বা ফলে বিষ থাকলে তার রঙের সামান্য হলেও পরিবর্তন আসে। শুকনো হয়ে যায়। দইতে কালো রং এবং মধুতে সাদা রং দেখা দেয়। এগুলো সবই সম্রাটের নিজস্ব পাচক জানেন। তিনি কি উপস্থিত ছিলেন কালকে রান্নার সময়ে?
সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন মহা-অমাত্য। বললেন,
—হ্যাঁ, আচার্য। আমি সেই ব্যবস্থাও করেছিলাম। সমস্ত রান্না রাজ- পাচকের উপস্থিতিতেই রেঁধেছে গান্ধারের পাচক।
—হুমম।
এগিয়ে গিয়ে থালায় সাজানো অভুক্ত খাবারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন চাণক্য। প্রশ্ন করলেন,
—এগুলো এখনও রাখা কেন এখানে? রাতে সরানো হয়নি কেন?
কৃষ্ণনাথ উত্তর দিলেন,
—এই দায়িত্ব গান্ধারের দুই ভৃত্যের ছিল। তাদের গাফিলতি।
যে চারপায়াটার ওপর খাবার রাখা আছে, তার কাছের জানলার পর্দা সরিয়ে দিলেন আচার্য। রোদ্দুর এসে থালায় পড়ল। ঝুঁকে পড়ে থালা বাসন পরীক্ষা করলেন। বললেন,
—ভালোই হয়েছে এগুলো না সরিয়ে। একবার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নেবেন এতে বিষ আছে কি না। বিষ বাসনেও থাকতে পারে। ধাতুতে বিষ থাকলে তার ওপর পড়া আলোকরশ্মি কম প্রতিফলিত হয়। কারণ বিষাক্ত ধাতু তার জৌলুস হারায়। এক্ষেত্রে সেরকম কিছু তো আপাতত নজরে পড়ছে না।
বিষক্রিয়ার ওপর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন চাণক্য, কিন্তু থেমে গেলেন। জানলা দিয়ে ভেতরে ঢোকা রোদ্দুর মেঝের ওপর কোনো একটা ছোটো বস্তুর ওপর এসে পড়েছে। সেটার থেকে প্রতিফলিত আলো চাণক্যর চোখে লাগল। ভুরু কুঁচকে এগিয়ে গেলেন পালঙ্কর দিকে। নীচু হয়ে সাবধানে মেঝে থেকে কিছু একটা তুলে নিলেন তিনি। একটা সরু শলাকা। অনেকটা কাপড় সেলাই করতে যেমন সুই ব্যবহার হয়, সেইরকমই। তবে দৈর্ঘ্যে সামান্য বেশি। সেটা নিজের চোখের সামনে ধরে, নিজের মনেই প্রশ্ন করলেন তিনি,
—এটা কী?
চন্দ্রগুপ্ত এগিয়ে এসে সেটা দেখলেন। বললেন,
—সুই বা ছোটো শলাকা জাতীয় কিছু মনে হচ্ছে।
—হুমম। কিন্তু এর সুচালো দিকে কালচে যে জিনিসটা লেগে আছে, সেটা তো শুকিয়ে যাওয়া রক্ত মনে হচ্ছে। ভালো করে দেখো, এটার সুচালো দিকের রং অন্য দিকের চেয়ে সামান্য আলাদাও বটে।
বাকিরাও এগিয়ে এসে দেখল। সত্যিই তাই। একটা সুই, তবে সেটা অবশ্যই সেলাইইয়ের কাজে ব্যবহারের জন্য নয়। কারণ এটার অন্য মাথায় সুতো পরানোর জায়গা নেই।
কৃষ্ণনাথের দিকে ঘুরে, চাণক্য বললেন,
—পাখিশাল থেকে একটা কাকোরা* পাখি নিয়ে আসতে বলুন, এখুনি। চন্দ্রগুপ্ত প্রশ্ন করলেন,
—গুরুদেব। হঠাৎ কাকোরা কেন?
—কারণ হালকা বিষক্রিয়াতেও কাকোরা পাখির চোখ লাল হয়ে ওঠে।
নির্দেশমতো ব্যবস্থা হল তৎক্ষণাৎ। কিছুক্ষণের ভেতরেই একজন সৈনিক একটা কাকোরা নিয়ে হাজির হল। মগধের পাখিশালে পাখির অভাব নেই।
চাণক্য তাঁর হাতের শলাকাটা পাখিটার গলার কাছে ফুটিয়ে দিলেন। মুহূর্তে পাখিটার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল এবং যন্ত্রণানায় ছটফট করে উঠল। মাত্র কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই সেটার ঘাড়টা একদিকে নেতিয়ে পড়ল। বোঝাই যায় শলাকার মাথায় লাগানো আছে তীব্র মারণ বিষ!
—
* কাকোরা- তিতির পাখি (Partridge)