লগ্নজিতার রানীভবনে পদার্পণ
লগ্নজিতা কোনো খবর না দিয়েই রানীভবনের ভিতরে প্রবেশ করলো। লগ্নজিতার আন্ডারে মিস্টার প্রশান্ত রায় এই কেসটা নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করছিলেন। কিন্তু প্রশান্তর এলোমেলো কথা লগ্নজিতার মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর ওই সন্দেহের বীজ বপন ঠিক যখন থেকে তখন থেকেই প্রশান্তর কাছ থেকে কেসটার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে ও। লাবণ্যের মৃত্যুর দিন লগ্নজিতা রানীভবনে না এসে মস্ত বড় ভুল করেছিলো, এখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
ওই সময় লাবণ্যর ঘরের জিনিসপত্রের অবস্থান একবার দেখলেই হয়তো লগ্নজিতা বুঝে যেত এটা প্রিপ্ল্যানড মার্ডার নাকি সুইসাইড। এখন তার আর কোনো উপায় নেই। প্রশান্তর এলোমেলো রিপোর্ট আর শুভদীপ ঘোষালের অসংলগ্ন কথার ওপরে ভরসা করেই এগোতে হবে কেসটা নিয়ে। এর মধ্যে লাবণ্যের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো এমন দুটো মানুষ সম্পূর্ণ বেপাত্তা। কেসটা কেমন একটা রহস্যময় হয়ে উঠছে। অব্যয় বিশ্বাস, নামি আর্টিস্ট। অথচ ওর বন্ধুরা ওর প্রতি প্রসন্ন নয়। বর্ণিতা- বি বেঙ্গলি চ্যানেলের মেকআপ আর্টিস্ট। অব্যয়কে ভালোবাসে অথচ লাবণ্যের সম্পর্কে শুনেও যে অবাক হলো না।
শুভদীপ ঘোষাল-প্রমোটার, অথচ রানীভবনে কম টাকায় রেখে দিয়েছিলো লাবণ্যকে। শুধু মাত্র জেঠিমার কথাতে। মৃত্যুর দিন লাবণ্যর ব্যাগে টাকা এলো কোথা থেকে! চুরি যে মোটিভ নয় সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ওইদিন ওপরের চিত্রশিল্পী রাধারমণও উপস্থিত ছিলো, আবার লগ্নজিতার স্পাই বলছে, অব্যয় বিশ্বাসও সেদিন দুপুরের দিকে এসেছিলো লাবণ্যের ঘরে।
বাড়িতে ঢোকার মুখেই দেখা হলো একজন বেশ চটকদারী মহিলার সঙ্গে। লগ্নজিতাই উপযাচিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, রানীবালাদেবী আছেন? মহিলা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, বড়মা আছে। কিন্তু আপনি কি পুলিশের লোক? দাদাবাবু কোনো পুলিশের লোকের সঙ্গে বড়মার দেখা করাতে নিষেধ করেছেন।
লগ্নজিতা সিভিল ড্রেসে এসেছে, তবুও এই মহিলার কেন সন্দেহ হলো সেটা ঠিক বোধগম্য হলো না। অত্যন্ত সাবধানে বললো, আমি পুলিশের লোক নই, আমি লাবণ্যের দূর সম্পর্কের দিদি। রানীবালাদেবীর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। মহিলা চোখ ছোট করে বললো, লাবণ্যদিদি তো সুইসাইড করেছে, এখন আর এসে কি হবে? লগ্নজিতা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো, খবরটা খবরের কাগজে পড়েই আমি এলাম এখানে। লাবণ্য ফোনে প্রায় জেঠিমার কথা বলতো। বলতো রানীবালাদেবী খুব ভালো মানুষ।
মেয়েটা একটু থেমে বললো, বড়মা লাবণ্যদিদিকে খুব ভালোবাসতো। ওর স্বামী যখন ওকে ছেড়ে চলে গেলো, তখন বিনাভাড়ায় রেখেছিলো লাবণ্যদিদিকে। অর্ধেকদিন আমি খাবার দিয়ে এসেছি তাকে। শুকনো মুখে না খেয়ে বসে বসে কাঁদতো, বড়মা খাবার পাঠালে খেতে পেতো। যার জন্য তার এমন হাল সেই স্বামীকেই কিনা …..চলুন, আপনাকে বড়মার ঘরে দিয়ে আসি।
লগ্নজিতা বুঝলো, মহিলা কিছু একটা কথা গোপন করে গেলো। লাবণ্যের সঙ্গে কি তার মানে রাজেশ ঘটির কোনোরকম যোগাযোগ হয়েছিলো আবার!
লগ্নজিতা সতর্কভাবে বললো, আপনিই তো সাবিত্রীদি তাই না? মহিলা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, আমার নাম কি করে জানলেন আপনি? লগ্নজিতা আফসোসের গলায় বললো, আপনার খুব নাম করতো লাবণ্য। বলেছিলো, আপনি খুব ভালো মানুষ। সাবিত্রীর কঠিন মুখের শিরায় নরম প্রলেপ পড়লো যেন। গলার স্বরে রূঢ়তা কমে গিয়ে সামান্য ভদ্রতার প্রলেপ পড়লো। সাবিত্রী বললো, বিশ্বাস বড্ড খারাপ জিনিস বুঝলেন। যে মানুষ একবার বেইমানি করে তাকে কি আর বারবার বিশ্বাস করা উচিত? লাবণ্যদিদির ভুলেই প্রাণটা গেলো। লগ্নজিতা বুঝলো, সাবিত্রী বেশ অনেক কিছুই জানে এ ব্যাপারে। কিন্তু সংসার অভিজ্ঞ মহিলা, তাই পেট থেকে কথা বের করা সহজ নয়।
বিশাল একটা ঘর। মেঝেতে সাদা-কালো দাবার ছক, পুরোনো বাড়ি কিন্তু খুব ভালো মেইনটেইন হয় সেটা দেওয়ালের নতুন রঙের পোচ দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঘোষাল যেহেতু প্রমোটার তাই জেঠিমাকে বেশ তোয়াজে রেখেছে। মেঝের পাথর থেকে আভিজাত্যপূর্ণ গন্ধ ভেসে আসছে। খাঁটি বার্মা সেগুনের পালংকে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন রানীবালাদেবী। দুদে উকিলের স্ত্রী ছিলেন সেটা ওনার বাচনভঙ্গিমাতেই বেশ পরিষ্কার। সারাজীবন স্বামীর পাশে থেকে বহু কেস দেখেছেন কাছ থেকে। তাই সাবিত্রী যখন গিয়ে বললো, বড়মা লাবণ্যদিদির এক দিদি এসেছে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
সাবিত্রীকে নির্দেশের ভঙ্গিমায় বললেন, এঘরেই নিয়ে আয় ওকে, আর চায়ের ব্যবস্থা কর। লগ্নজিতার দিকে বাইফোকাল চশমার মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, এখনকার মেয়েরা কত স্মার্ট। পুলিশে জয়েন করেছো দেখে খুব ভালো লাগলো। আমি তোমায় তুমিই বলি কেমন। হাজার হোক তুমি আমার নাতনির বয়েসী। চিন্ময়ের তোমার মতো বয়েসী একটা মেয়ে আছে। লগ্নজিতা কাঠের গদিওয়ালা একটা চেয়ারে বসলো ধরা পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিমায়। তারপর মিষ্টি করে ঘাড় নেড়ে বললো, অবশ্যই আমায় তুমি বলুন। কিন্তু চিন্ময়টা কে?
রানীবালা হেসে বললেন, আমার ভাইপো, শুভদীপের দাদা। শুভদীপের সঙ্গে তো তোমার কথা হয়েছে তাই না? শুভ এসে বলছিলো, তুমি কোনোদিন আসবে বলেছিলে। শুভ অবশ্য বলে গেছে, ওর সামনে ছাড়া কোনোভাবে কোনো পুলিশের লোককে যেন আমি অ্যাটেন না করি। কিন্তু আমার মন বলছিলো তুমি আসবে। আমি খুব চাই লাবণ্যের খুনি ধরা পড়ুক। আমার কাছ থেকে সবরকম সাহায্য তুমি পাবে। নেহাত বাতের ব্যথাটা বেড়েছে তাই ওপর-নীচ করা আর হয়ে ওঠে না। তাই লাবণ্যের ঘরে যেতে চাইলে সাবিত্রী চিনিয়ে দেবে তোমায়। বাকি আমি সবরকম সাহায্য করবো। মহিলার সঙ্গে দু-মিনিট কথা বলেই লগ্নজিতা বুঝতে পারলো, লাবণ্য নামক মেয়েটিকে খুব স্নেহ করতেন রানীবালাদেবী। লাবণ্য নামটা উচ্চারণ করার সময় গলাটা কেঁপে উঠলো ওনার। ঠিক ভাড়াটে মালিকের সম্পর্ক ছিল না ওদের মধ্যে। লগ্নজিতা চট করে মোবাইলের ফোটো গ্যালারিটা খুলে অব্যয়ের ছবিটা সামনে ধরে বললো, একে আগে দেখেছেন?
রানীবালার চোখে মুখে উত্তেজনা। একেই তো ভালোবেসেছিলো হতভাগী। বড় ভালো আঁকতো ছেলেটা। ব্যবহারও ভালো ছিলো। লগ্নজিতা বিস্মিত হয়ে বললো, ভালোবাসতো আপনি কি করে জানলেন? রানীবালা স্মৃতি রোমন্থনের মত করে চোখ বন্ধ করলেন। ধীরে ধীরে বললেন, একদিন দুধপুলি করেছিলাম। সাবিত্রী গিয়েছিলো লাবণ্যকে দিতে। গিয়ে দেখে এই ছেলেটি ওর ঘরে বসে আছে। আমায় এসে বিষয়টা জানিয়েছিলো। আমি লাবণ্যকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। লাবণ্য এসে লাজুক মুখে বলেছিলো, শিল্পী মানুষ, আমি শ্রদ্ধা করি, হয়তো ভালোও বাসি। উনি আমার সম্পর্কে ঠিক কি ভাবেন আমি জানি না। তবে আমার মত অবাঞ্ছিত মেয়েকেও উনি সম্মানের চোখে দেখেন, এটুকুই প্রাপ্তি। লগ্নজিতা কাঁসার ভারী গ্লাসে মুখ দিয়ে বেশ খানিকটা ঠান্ডা জল এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিয়ে বলেছিল, লাবণ্যের পেশাটা কি আপনি জানতেন?
রানীবালা একটু জোরেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, জানতাম মানে আন্দাজ করেছিলাম। কখনো জিজ্ঞেস করিনি। সমর্থ মেয়েকে কি এই সমাজ এমনি এমনি টাকা দিচ্ছে? তাই বুঝে নিয়েছিলাম। তবে আমার কড়া নির্দেশ ছিলো, এ আমার স্বামীর ভিটে। এখানে ওসব চলবে না। লাবণ্য আমার কথা রেখেছিলো। সম্ভবত কোনো বারে বা ক্লাবে কাজ করতো ও। বাড়িতে আটপৌরে মেয়েটি হয়েই ছিলো। লগ্নজিতা বললো, রাজেশকে আপনি চিনতেন?
রানীবালা ঘাড় নেড়ে বললেন, চিনতাম, তবে আলাপ ছিল না সেভাবে। আসলে লাবণ্যর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিলো কাকতালীয় ভাবেই। বাড়ির ভাড়াটেদের নিয়ে আমার কোনোদিনই ইন্টারেস্ট ছিলো না। শুভই দেখাশোনা করতো। আমি একদিন লক্ষ্মী পুজোর আল্পনা দিচ্ছিলাম বারান্দায়। হাঁটুর ব্যথায় ভালো বসতে পারছিলাম না। তো ওই লাবণ্য এসে জোর করে আমার হাত থেকে চালবাটার পাথরের বাটিটা কেড়ে নিয়ে গোটা বারান্দায় ছবির মত আল্পনা এঁকে দিয়েছিলো। সে আল্পনার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরানো দায়। রোগা রোগা শ্যামলা গড়নের মেয়েটার মধ্যে যে এত গুণ আমি ভাবতে পারিনি। আসলে ওর আঙুলগুলোই শিল্পীর আঙুল। রান্নার হাতটিও সাক্ষাৎ দ্রৌপদীর মত। আসন, সোয়েটার বোনা, গানের গলা সবই যেন ব্যতিক্রমী মেয়েটার মধ্যে। ওই জন্যই ভগবান কেড়ে নিলো। না দিলো সুখ না দিলো সংসার। অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর। লগ্নজিতা বললো, অব্যয় কি রোজই আসতো? রানীবালার চোখে হারানোর যন্ত্রণা। অস্ফুটে স্বরে বললেন, না না রোজ আসতো না।
রানীবালার কথার রেশ ধরে সাবিত্রী বললো, মাসে একবার কিংবা দু-বার আসতো। তবে এলে থাকতো অনেকক্ষণ। রংতুলি নিয়েই বসে থাকতো দেখেছিলাম। দরজা হাট করে খুলে আঁকতো।
লগ্নজিতা বললো, এই অব্যয় কি লাবণ্যকে কোনো টাকা দিতো জানো? সাবিত্রী ঘাড় নেড়ে বললো, লাবণ্য বেশি কথা বলতো না। তাই এসব বলেনি কোনোদিন। রানীবালা বললেন, রাজেশ, অব্যয় আর রাধারমণ মুখুজ্জে এদের তিনজনের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিলো লাবণ্যের বাড়ির মধ্যে। রাজেশ তো কবেই পালিয়েছিলো। এখন এই দুজনও বেপাত্তা। লগ্নজিতা বললো, রাজেশ এর মধ্যে এসেছিলো কি না জানো? সাবিত্রী ঠোঁট উল্টে বললো, আমার কি কাজ নেই নাকি? কে কখন আসছে যাচ্ছে হাতে দূরবীন নিয়ে দেখবো বসে বসে। দিনরাত ব্যাংকের লোকজন আসছে। পাঁচতলার কলেজের ছেলেগুলোও বন্ধু নিয়ে ঢুকছে বেরোচ্ছে। কে কার খোঁজ রাখছে বলুন তো? তাছাড়া এরপরেও যদি রাজেশকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেয় লাবণ্যদিদি, তাহলে আর বলার কিছুই থাকে না। আমি দেখিনি বটে তবে গোপাল বলছিলো, রাজেশ বোধহয় মাঝে মাঝে এসে টাকা নিয়ে যেত। বেইমানকে আবার বিশ্বাস করলে এমন তো হবেই। পুরুষ মানুষকে যে অন্ধবিশ্বাস করবে সে মরবে। লগ্নজিতা দেখলো, সাবিত্রী রীতিমত পুরুষ বিদ্রোহী।
লগ্নজিতা বললো, সাবিত্রীদি, আমাকে একবার লাবণ্যর ঘরটা দেখাতে হবে যে। রানীবালা চোখের ইশারা করতেই সাবিত্রী একটু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো, তার মানে আপনি পুলিশের লোক তাই না? চলুন ঘরটা দেখিয়ে দিই।
.
সিল করা ঘরের চাবি খুলে লগ্নজিতা পা দিলো অপরিচিতা মৃত মেয়েটার ঘরের মেঝেতে।
.