রুকসানা বেগম ও বেগমমহল

রুকসানা বেগম ও বেগমমহল

প্রথম যেদিন রুদ্রনগরের বেগমমহলে প্রবেশ করেছিলেন রুকসানা সেদিনই বুঝেছিলেন, ওদের ধবলগড় রাজ্য হিসাবে রুদ্রনগরের থেকে ক্ষমতায়, ঐশ্বর্যে অনেক নিচু মানের হলেও একটা বিষয়ে রুদ্রনগর অনেক পিছিয়ে। সেটা হলো শিক্ষায়। পাশের রাজ্যেই যে এমন হারেম আছে তা অজানা ছিল রুকসানার। উনি জানতেন দিল্লির মোঘল দরবারেই বুঝি শুধু হারেম আছে। যেখানে বেগমরা বন্দি অবস্থায় সোনা চাঁদির গহনা পরে আনন্দে মত্ত থাকে। মনের মধ্যে অজস্র প্রশ্ন ভিড় করে আসতো রুকসানার। পিতার আদরের কন্যা বলেই হয়তো একটু বেশিই প্রশ্রয় পেতেন বাদশাহের কাছ থেকে। তাই মাঝে মাঝেই বাদশাহের সম্মুখে প্রশ্নের ডালি সাজিয়ে বসতেন রুকসানা। হারেম নিয়ে ছিল তাঁর দীর্ঘ জিজ্ঞাসা।

অন্তরের গোপন কুঠুরিতে সাজিয়ে রেখেছিলেন এক ভয়ানক ভাবনা। কস্মিনকালেও যদি হারেমে উপস্থিত হন উনি তবে নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন ভিন্ন করে উদ্ধার করবেন বন্দিনীদের। রুদ্রনগরের হারেম সম্পর্ক উনি ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ। দুজন খোজা প্রহরীর তত্ত্বাবধানে রুকসানা প্রবেশ করেছিলেন বেগমমহলে। প্রবেশ করেই বুঝেছিলেন, এ মহলের নিয়মকানুন কঠিন। পুরুষ প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একমাত্র বাদশাহ ছাড়া আর কারোর প্রবেশের অধিকার নেই এখানে। বেগমমহলের উত্তরের বিশাল বিশাল চারটি ঘর বরাদ্দ রয়েছে কাঞ্চনীদের জন্য। তারাই হারেমের অবসর বিনোদনের একমাত্র পন্থা।

এছাড়া সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়টা এরা হাসি মস্করা করেই অতিবাহিত করে।

মুসাফিরের জন্মদাত্রীই বেগমমহলে ওকে সমাদর করে নিয়ে গিয়েছিলেন। নিয়মকানুন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। রুকসানার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিলো। স্বাধীনতা প্রিয় রুকসানা তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, রুদ্রনগরের বেগমমহলে তিনি স্বাধীন বাতাসের অনুপ্রবেশ ঘটাবেনই। এই পর্দানশীন জেনানাদের দেবেন উন্মুক্ত আকাশ।

.

এছাড়াও তিনি শাহজাদার সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন। যেদিন শাহজাদা অসিচালনায় পারদর্শী হয়ে উঠবেন সেদিনই রুকসানার নারীত্বের দাবিদার হবেন তিনি। প্রেমিকার যৌবনপুষ্ট অধরের নেশা তখন মুসাফিরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। রুকসানাকে জয় করার আকাঙ্ক্ষায় মুসাফির রাজি হয়ে যান রুকসানার শর্তে।

হারেমের সমস্ত বাসিন্দা অপলক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখেছিলো, বীরের পোশাক পরিধান করে শাহজাদার নবপরিণীতা বেগম ঝড়ের বেগে অসিচালনা করছেন বেগমমহলের ছাদে।

এ সংবাদ স্বয়ং মুসাফিরের কানে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রবেশ করেছিলেন রুকসানার মহলে। তিনিও বিস্মিত হয়ে দেখেছিলেন, তার ছোটি বেগমের তলোয়ারের ঝলকানি।

বাদশাহ মিজানুর প্রশংসাসুলভ স্বরে বলেছিলেন, প্রকৃত সুলতানা। বেগমমহলের কেউই বিষয়টাকে সহজভাবে মেনে নেননি। তারা ভেবেছিলেন, বাদশাহ মিজানুর অন্তত এর বিচার করবেন। শাস্তি একটা হবেই। কিন্তু তার উল্টো ফল হওয়াতে বেগমমহলে প্রথম দিন থেকেই রুকসানার শত্রুর জন্ম হলো। মুসাফিরের অন্য দুই স্ত্রীও সেই দলে ছিলো। কিন্তু রুকসানার তলোয়ার চালনার অভ্যেস একদিনের জন্যও বিশ্রাম নেয়নি এইসব তুচ্ছ কারণে। রুকসানা যেন মধ্যগগনের সূর্য। যার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অন্ধত্বই একমাত্র পরিণাম। মুসাফিরের মত কাব্যরসিক চিকিৎসক এমন নারীর বিপরীতধর্মী হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবুও রুকসানার রূপ, ব্যক্তিত্ব মুসাফিরকে ক্রমাগত আকৃষ্ট করে চলেছে।

.

রুদ্রনগরবাসী বোধহয় এমন আরেকটি আশ্চর্য বিষয়ের সাক্ষী থাকবে এ কল্পনাও করেনি কখনও। প্রথম সূর্যের আলো যখন রুদ্রনগরের প্রাসাদের গায়ে পিছলে পড়ছিল, তখনই একজন সৈন্যের সঙ্গে অসিচালনায় রত হলেন মুসাফির। শৈশব থেকেই মিজানুরের শত চেষ্টায়ও মুসাফিরের হাতে তলোয়ার ধারণ করাতে সক্ষম হয়নি কেউই। দুশ্চিন্তায় ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছিলেন মিজানুর। বাদশাহ পুত্র তলোয়ার চালনায় পারদর্শী নয়, এ চিন্তা ক্রমাগত হতাশা বহন করে নিয়ে এসেছিলো মিজানুরের অন্তরে। মুসাফিরের আকস্মিক এই পরিবর্তনে রাজ্যবাসীর সঙ্গে সঙ্গে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন স্বয়ং মিজানুর। এর কৃতিত্ব যে ধবল কন্যার সেটা সহজেই অনুধাবন করেছেন মিজানুর।

তাই ধবল কন্যা রুকসানাকে দাওয়াত পাঠিয়েছেন গজদন্তের বাঁটওয়ালা এক ধারালো তলোয়ার। লাল পশম কাপড়ে মুড়ে এ উপহার রুকসানার মহলে পৌঁছে দিয়ে গেছেন বাদশাহের বিশ্বস্ত অনুচর। গজমতির হার নয়, মুক্তোখচিত ফুলদানি নয়, এমন একটি তলোয়ার বাদশাহের আশীর্বাদস্বরূপ পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন রুকসানা বেগম। প্রতিজ্ঞা করেছেন, রুদ্রনগরের ওপরে অশুভ ছায়া পড়তে দেবেন না তিনি।

নিকাহের মাত্র সাতদিন অতিবাহিত হয়েছে। ইতিমধ্যেই রুদ্রনগরের চর্চিত বিষয় রুকসানা বেগম। বেগমের এমন অদ্ভুত শখ দেখে বিস্মিত রুদ্রনগরবাসী। বেগম নাকি জঙ্গলে শিকারে যেতে চান, এমনিই উপহার চেয়েছেন মুসাফিরের নিকট।

সোনা নয়, হিরে নয়, রাজকীয় মহল নির্মাণ নয়, বন্য জন্তু ভরা জঙ্গলে তির ধনুক হাতে শিকারে যেতে চান রুকসানা। এ কথা স্বয়ং মিজানুরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলার হিম্মতটুকুও নেই মুসাফিরের।

রুদ্রনগরের বেগমমহলকে সকলেই সম্মান করে। বেগমরা পর্দানশীন। তাদের শুধু কল্পনা করে মানুষ। তাদের মুখদর্শন করতে পারে না সাধারণ মানুষ। সেখানে পুরুষের পোশাকে ছোটি বেগম যাবেন শিকারে! এ কথা শোনামাত্র মিজানুর রুকসানাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করবেন এমনই আশা করা যায়। মুসাফির আদরে সোহাগে বেগমকে শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। রুকসানার একগুঁয়ে জেদ, শিকারে তিনি যাবেনই।

অবশেষে মিজানুরের কাছে পৌঁছালো এ বার্তা। স্বয়ং জাহানারা বেগমই বিরক্ত হয়ে রুকসানার স্পর্ধার কথা জানালেন। কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকলেন বাদশাহ। রুদ্রনগরের বেগমমহলে এর আগে কেউ কোনোদিন এমন গগনচুম্বী দাবি নিয়ে আসেননি বাদশাহের কাছে। হিরে-মতির হার, মহল অথবা তীর্থ দর্শনের আর্জি নিয়েই বেগমরা এসে হাজির হয়েছেন এত দিন। তিনিও কখনও কাউকে ব্যর্থ মনোরথে ফেরাননি। হারেমের লজ্জা, আব্রুকে তিনিও শ্রদ্ধা করেন। তাই সেদিকে থাকে তাঁর বিশেষ নজর। কিন্তু রুকসানা রুদ্রনগরের এত বছরের নিয়মকানুনকে ভেঙে দিতে চাইছে, কি করে এ আর্জিতে সম্মতি দেবেন তিনি!

ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে গিয়েছিল একটি সমস্যা সমাধানের বুদ্ধি। তিনি মুসাফিরকে জানিয়েছিলেন, রুকসানাকে নিয়ে খাউগিরির জঙ্গলে ভ্রমণ করে আসার কথা। সঙ্গে যাবে এক শত সৈন্য ও হাতির পিঠে যাবে তাঁবু বাঁধার সরঞ্জাম। দিন পাঁচেক তারা ওখানে অবস্থান করে ফিরে আসবে রুদ্রনগরের প্রাসাদে। বুদ্ধিমতী রুকসানা বুঝেছিলেন, বাদশাহ তাঁকে স্নেহ করেন। তাই ভ্রমণের স্থান স্থির করেছেন এমন জায়গায় যেখানে বুনো হরিণ আর শুকরের দেখা মেলে।

নিজের শিকারের অস্ত্রশস্ত্র গুছিয়ে নিতে নিতে রুকসানা খেয়াল করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে বেগমমহলে একটা চক্রান্ত ঘনীভূত হচ্ছে। মুসাফিরের আর দুই বেগম রোকেয়া ও খালেদা দুজনেই এই চক্রান্তের কেন্দ্রবিন্দু। রুকসানার প্রতি মুসাফিরের অন্ধ প্রেমই এর জন্য দায়ী। সঙ্গে রুকসানার প্রতি স্বয়ং বাদশাহের পক্ষপাতিত্বও মেনে নিতে পারছেন না কেউ। মুসাফিরের গর্ভধারিণী জাহানারা বেগম পর্যন্ত অত্যন্ত অসন্তুষ্ট রুকসানার প্রতি। মাত্র কয়েকদিন রুকসানা পা রেখেছে রুদ্রনগরের প্রাসাদে। এসেই নিয়মের অচলায়তন ভাঙতে বদ্ধপরিকর বলেই হয়তো অনেকের মনে বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে।

মুসাফির এখনও রুকসানার শরীরের অধিকার পাননি। এখনও তাঁদের দুটো শরীরের মিলন ঘটেনি। তাই ছোটি বেগমের মর্জি মত নিজেকে রণকৌশলে পারদর্শী করে তুলতে তিনি বদ্ধপরিকর। রুদ্রনগরের প্রজারা অবাক হচ্ছে মুসাফিরের পরিবর্তন অবলোকন করে। মুসাফিরের এই আকস্মিক পরিবর্তনের কার্যকারণ যে ছোটি বেগম তা আন্দাজ করা দুষ্কর নয়। রুকসানার ফুলশয্যার রাত্রের শর্তের কথা বেগমমহল বাদশাহমহল ছাড়িয়ে এখন রুদ্রনগরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

মুসাফিরের এই পরিবর্তনে রাজ্যের সকলেই বিস্তর খুশি। বাদশাহ মিজানুরের পরবর্তীতে এক অকর্মণ্য বাদশাহ সিংহাসনের অধিকারী হবেন এ বড়ই দুঃখজনক ছিল রুদ্রনগরবাসীর জন্য। কেবল একজনের মনে শান্তি নেই। সে হলো প্যাট্রিক। প্যাট্রিকের ধারণা মুসাফির শুধুই রুকসানাকে জয় করবেন বলেই এই রণকৌশল কব্জা করতে ব্যস্ত। রুকসানা জয় সমাপ্ত হলে মুসাফির আবারও কাব্য, চিকিৎসা ও অন্য মহিলার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বেন।

রাজকার্য তাঁর জন্য নয়, এ কথা আর কারোর বোধগম্য হোক বা না হোক প্যাট্রিক জানেন। আরেকজনও জানেন— রুদ্রনগরের মন্ত্রী সুজান খান। মুসাফির যে মিজানুরের যোগ্য উত্তরাধিকারী হতে পারবেন না সেটা বিলক্ষণ বোঝেন সুজান খান। তাই মুসাফিরের এই অসিচালনার ব্যগ্র ইচ্ছা দেখে বাদশাহ খুশি হলেও এরা দুজন আশাবাদী হতে পারেননি।

.

পদ্ম সরোবরের সামনে দাঁড়িয়ে আপনমনে অসিচলনা করছিলেন রুকসানা বেগম। অস্তরাগের সূর্যের আভায় তার তেজোদীপ্ত মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মুসাফির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছিলেন, এ কি সত্যিই কোনো নারী? নাকি হুরি পরী? এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্য তো সাধারণ নারীর মধ্যে অবস্থান করে না। মুসাফির নিজের তলোয়ারটা কোমর বন্ধনী থেকে উন্মোচিত করে আচমকা রুকসানার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, পরীক্ষা প্রার্থনীয় বেগম। এ অর্বাচীন পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত। পুরস্কার ঘোষণা করা হোক। রুদ্রনগরের ছোটি বেগম নিশ্চয়ই এই অধমকে ব্যর্থ মনোরথে ফেরত পাঠাবে না?

রুকসানার আঁখিতে দৃঢ় প্রত্যয়। শরীরে হিল্লোল। মুসাফির বললেন, একজন বিচারকের নিতান্ত প্রয়োজন বেগম। তোমার যদি আজ্ঞা হয় তো আমার সুহৃদকে এ কাজের দায়িত্ব দিতে পারি।

রুকসানা এক অদ্ভুত অনুভূতির সম্মুখীন হলেন। মুসাফিরের সঙ্গে শাদি হলেও তাকে মন থেকে স্বামী হিসাবে বরণ করে নিতে পারেননি এখনও। কিন্তু ওকে জয় করার জন্য মুসাফিরের ঐকান্তিক ইচ্ছাটাই যেন ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছে রুকসানাকে। অন্তরে এক অভূতপূর্ব অনুভূতির আনাগোনা। পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে ভালো লাগার সুখানুভূতি। একে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা স্বয়ং বাদশাহ কন্যারও নেই। মুসাফিরের দাড়ির ভাঁজে কৌতুক, ভ্রূতে আদরের হাতছানি।

রুকসানা নিজেকে সংযত করে বললেন, শাহজাদা তার সুহৃদকে আহ্বান করতেই পারেন। তবে পরপুরুষের সম্মুখে অসিচালনাতে শাহজাদার কোনো আপত্তি নেই তো?

মুসাফির হেসে বললেন, এ যে বেগমমহলের খাস মেহমান রুকসানা। এই মানুষটির জন্যই আজ আমি রুকসানার সোহর। রুকসানা বুঝলেন, ফরাসী চিকিৎসক প্যাট্রিকই আসবে বিচারক হিসাবে। ওই মানুষটিকে মন্দ লাগেনি রুকসানার। লাজুক চাহনি, উগ্রতা নেই বাচন ভঙ্গিমায়। বিদেশি হয়েও বাংলা ভাষার প্রতি অপার প্রীতি। সত্যি বলতে কি রুকসানার ভীষণ আগ্রহ জন্মেছে ওই বিদেশির প্রতি। সোনালী চুল, নীল চোখের মনির মানুষটির চারিদিকে যেন রহস্য বেষ্টন করে আছে। হারেমে ঢোকার একমাত্র অধিকার আছে ওনার।

রুকসানা শুনেছেন, মুসাফির যখন ধবলগড় থেকে ফিরে ওকে পুনরায় দর্শনের আশায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং এ রোগের কিনারা করে উঠতে ব্যর্থ হয়ে পড়েছিলো হাকিমরা তখন বিচিত্র উপায়ে রুকসানার ছবি আঁকিয়ে ছিলেন শিল্পীকে দিয়ে। এ কথা শোনার পর থেকেই বিদেশি হাকিমের সঙ্গে আলাপের ইচ্ছে তীব্র হয়ে উঠেছিলো রুকসানার। কিন্তু মনের ইচ্ছেটা ব্যক্ত করে উঠতে সংকোচ হয়েছে।

মুসাফিরের তলব পেয়ে দ্রুতগতিতে পদ্মসায়রে প্রবেশ করলেন প্যাট্রিক। রুকসানাকে দেখে ইতস্তত করে প্যাট্রিক বললেন, নমস্তে বেগম সাহেবা। আমার ত্রুটি মার্জনা করা হোক। মুসাফির অট্টহাস্যে বললেন, প্যাট্রিক এসো হে। এই মুহূর্তে তুমি বিচারক। তোমার ওপরে গুরুদায়িত্ব অর্পণ করলাম। অসি চালনায় প্রথম নির্বাচন করতে হবে তোমায়। প্যাট্রিক বিষয়টা বুঝতে পেরে বললেন, হুজুরের জন্য প্যাট্রিক হাজির।

শুরু হলো তলোয়ার চালনা। রুকসানা অভ্যস্ত হাতে আক্রমণ করলেন মুসাফিরকে। মুসাফির শুধু ঢাল দিয়ে সে আঘাত প্রতিহত করলেন। একের পর এক আঘাত আসছিল রুকসানার পক্ষ থেকে। পিছু হঠছিলেন মুসাফির। রুকসানার দক্ষতা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন প্যাট্রিক। তাঁর চোখে অপার বিস্ময়। এ যে রণকৌশলে রীতিমত পারদর্শী! বেগম না হয়ে যদি কোনো পুরুষ হতেন রুকসানা তবে হয়তো বাদশাহ মিজানুর এনাকে প্রধান সেনাপতির পদে নিযুক্ত করে দিতেন। প্যাট্রিক আফশোসের সুরে বলেই ফেললেন, রুদ্রনগর দুর্ভাগ্যক্রমে একজন বীর যোদ্ধাকে হারালো। বেগম সাহেবার অস্ত্রচালনা প্রমাণ করে নারীরাও কম শক্তিশালী নন। বীরাঙ্গনার জন্ম সার্থক হোক।

প্রশংসা বাক্য শুনে রুকসানার অজান্তেই ওঁর গাল আবির বর্ণ হলো। দৃষ্টি নিম্নগামী। সেদিকে দৃষ্টিপাত করে মোক্ষম মুহূর্তে মুসাফির একটা জোরে আঘাত হানলেন। ঝনঝন শব্দে ভূমিতে পতিত হলো রুকসানার তলোয়ারটি। রুকসানা বেগম হতচকিত হয়ে বললেন, আমি অন্যমনস্ক ছিলাম শাহজাদা। মুসাফির হেসে বললেন, কেন বেগম? তোমার মনের অন্যস্থানে গমনের হেতু কি?

লজ্জায় সে কথা প্রকাশ করতে পারলেন না রুকসানা। মুসাফির বললেন, প্যাট্রিক…আজকের প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হোক। তুমিই একমাত্র বিচারক এ যুদ্ধের।

প্যাট্রিক একটু ইতস্তত করে বললেন, ছোটি বেগম সাহেবা বিজয়িনী আমার বিচারে।

.

মুসাফিরের ঠোঁটে হাসির ছোঁয়া। রুকসানার চোখে অপার বিস্ময়। তার হাত থেকে তলোয়ার ভূপাতিত হয়েছে, এর পরেও কেন তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করছেন বিদেশি চিকিৎসক সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না। মুসাফির পুনরায় বললেন, কেন তাঁকে পরাজিত ঘোষণা করা হচ্ছে সেটা জানার অধিকার নিশ্চয় আছে প্রতিযোগী হিসাবে।

প্যাট্রিক ধীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, হুজুর, রুকসানা বেগম সহজাত যোদ্ধা। তাঁর রণকৌশল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। একজন বিচারক হিসাবে আমি তাঁর অসিচালনার পদ্ধতি দেখে বিস্মিত হয়েছি। শিহরিত হয়েছি তাঁর দক্ষতা দেখে। আমি উপভোগ করেছি তাঁর এই পারদর্শীতা। তাই শেষ মুহূর্তে অন্যমনস্কতার কারণে তাঁর পরাজয় মেনে নিতে আমি অপারগ।

মুসাফির ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বললেন, তোমার বিচার একেবারে সঠিক প্যাট্রিক। আমিও ক্ষণে ক্ষণে রুকসানার কাছে হেরে গিয়ে শিহরিত হয়েছি। এমন দক্ষতা একজন সেনাদলের প্রধানের কাছ থেকেই প্রার্থনীয়। অগত্যা হার স্বীকার করলাম। প্যাট্রিক রুকসানাকে প্রণাম জানিয়ে প্রস্থান করলেন।

মুসাফিরের ঠোঁটে পরাজয়ের ম্রিয়মাণ করুণ হাসির ছোঁয়া। রুকসানা সেদিকে তাকিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, আজ রাত্রে আমার মহলে আপনার নিমন্ত্রণ রইলো। আমি অপেক্ষায় থাকবো শাহজাদার আগমনের।

মুসাফির স্তম্ভিত হয়ে বলেছিলেন, কিন্তু বেগম আমি যে পরাজিত।

রুকসানা বললেন, প্যাট্রিক সাহেবের বিচারে আপনি পরাজিত। কিন্তু আমার বিচারে আপনি আজ জয়ী। কয়েকদিনের অনুশীলনে এমন দক্ষ অসিচালক হয়ে ওঠা সত্যিই বিরল ঘটনা।

মুসাফির রুকসানার সম্মুখে নতজানু হয়ে বললেন, সবই তোমার মন জয়ের হেতু বেগম।

রুকসানা লজ্জিত হয়ে বললেন, শাহজাদার আগমনের প্রতীক্ষায় থাকবো আমি।

.

রুকসানা চলে গেলেন তাঁর মহলের অন্দরে। ফুলশয্যার প্রস্তুতি নিতে হবে। এ মিলন যেন অভাবনীয় হয় শাহজাদার কাছে। রুকসানা বেগম যে আর পাঁচজন সাধারণ নারী নয় সেটুকু অন্তত বুঝিয়ে দেবেন।

মহলে ঢুকেই দাসীদের হুকুম করলেন, বেলজিয়ামের পুষ্পদানিতে পদ্ম সাজাতে। গোলাপবাগ থেকে রক্ত গোলাপ সংগ্রহ করে আনতে। নিজের হাতে আজ শয্যা প্রস্তুত করবেন রুকসানা। শরতের আকাশের মত নীল রঙের একটা শাড়ি ও ফুলের গহনা পরিধান করবেন তিনি। খোঁপায় সোনার চিরুনি নয় গুঁজবেন ময়ূরের নীল পালক।

মুসাফির আর রুকসানার প্রেমকাহিনীর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়বে রুদ্রনগরের আকাশে-বাতাসে। মুসাফিরের প্রিয় শরবত নিজের হাতে আজ বানাবেন রুকসানা। মুসাফিরের মুখটা কল্পনা করেই লজ্জা পেলেন রুকসানা। মনে পড়ে গেলো ধবলগড়ের জঙ্গলে অজ্ঞানপ্রায় রুকসানার মুখের ওপর নেমে এসেছিলো একটা চিন্তান্বিত পুরুষের অবয়ব। যিনি নিজের হাতে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছিলেন রুকসানাকে। নাহলে হয়তো জ্ঞানহীন অবস্থায় রক্তক্ষরণের মাধ্যমেই প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যেতো রুকসানার। আরক্ত হলো ওঁর মুখমণ্ডল। সেদিন রাত্রের সমস্ত কথা পুঙ্খানুপুঙ্খ দৃষ্টিপথে ভিড় করে এলো। মুসাফিরের ওঁর প্রতি দুর্বলতা, আগ্রহ সব মিলিত হয়ে যে আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছিল সেটাকেই নির্মমভাবে উপেক্ষা করে বেরিয়ে এসেছিলেন রুকসানা। আজ ভালোবাসায় সোহাগে ভরিয়ে দিতে চান মুসাফিরকে।

ভাবনার সাগরে অবগাহন করতে করতেই নিজেকে সাজালেন রুকসানা। চারজন সহচরী রুকসানাকে সাজিয়ে দিলো সেই আদিম যুগের গুহাবাসীনির মত। পরণে নীল শাড়ি, ওর নিরাভরণ দেহটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। উদ্ধত যৌবনের কাছে সে হার স্বীকার করেছে। তাই শাড়ির ভাঁজেও বেঁধে রাখা যায়নি রুকসানার মোহময়ী যৌবনকে। খোঁপায় গুঁজে দেওয়া হয়েছে ময়ূরের পেখম। কণ্ঠে হাতির দাঁতের অলংকার। কোমরে ফুলের বন্ধনী।

সহচরীরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছে, আমরাই পথভ্রষ্ট হচ্ছি ছোটি বেগম, শাহজাদা যে এ সূরা পান করে মত্ত হয়ে যাবেন। তাঁকে উদ্ধার করার কি কোনো পথ নেই?

রুকসানা লজ্জা মাখানো কণ্ঠে বলেছেন, পদ্মসায়রের থেকেও বেশি গভীর কি এ যৌবন?

সখীরা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছে।

তবে কি শাহজাদা এ গভীরতা অতিক্রম করতে অপরাগ হবেন? সহচরীরা বলেছে, তিনি তলিয়ে যাবেন।

নিজের সজ্জা সম্পূর্ণ করেই সোনার রেকাবে ফুল সাজিয়ে সুগন্ধি কাগজে প্রেমপত্র লিখে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন রুকসানা মুসাফিরের মহলে।

.

‘রুকসানা বেগমের দ্বার উন্মুক্ত হলো শাহজাদার উদ্দেশ্যে। রুকসানা অপেক্ষারত।’

.

এমন সুন্দর প্রেমপত্র পেয়ে মোহিত হয়েছিলেন মুসাফির। হারেমের বেগমরা বাদশাহের জন্য হাপিত্যেস করে বসে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক রুদ্রনগরে। বাদশাহের পায়ের ধুলো একবার হারেমে পড়লে ধন্য হন তাঁরা। কারণ হারেমের বেগমরা একমাত্র বাদশাহের পূজারী। তাঁরা অন্য কোনো পুরুষের সম্মুখীন হতে পারেন না। বাদশাহের মর্জিতে তাঁদের শারীরিক ইচ্ছেপূরণ হয়। একাধিক বেগম উপস্থিত থাকেন হারেমে। তাই একজন বেগমের কাছে হয়তো বাদশাহের পৌঁছাতে অতিবাহিত হয় প্রায় বৎসরখানেক। অথবা বাদশাহের প্রিয়তমা বেগমের কাছেই তিনি মাসের পর মাস অতিবাহিত করেন। অন্যরা পার্থিব মণিমুক্ত আর প্রাসাদের কূটকাচালি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হন। হারেমে বাদশাহের প্রবেশে গর্বিত হন বেগমরা। তাঁরা প্রার্থনা করেন বাদশাহের আগমনের জন্য।

সেখানে রুকসানা বেগম প্রথম হারেমের নিয়মভঙ্গ করলেন। তাঁর নির্দেশে শাহজাদা মুসাফির প্রবেশ করবেন তাঁর মহলে। বেগমমহলের সকলেই প্রায় ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন রুকসানার দিকে। তাঁর এই দম্ভ, সাহস মেনে নিতে সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে মুসাফিরের আর দুই স্ত্রীর। কিন্তু তারা নিরুপায়, রুকসানাকে আশীর্বাদ করেছেন স্বয়ং বাদশাহ মিজানুর। তাই তার বিপক্ষে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করা বেগমমহলের কারোরই তেমন নেই।

.

মুসাফির প্রবেশ করলেন রুকসানার কক্ষে। বাতিদানিতে বাতি জ্বলছে। পর্দা দুলছে দখিনা বাতাসে। ধূপ আর ফুলের গন্ধে শিহরিত হলেন মুসাফির। মহলের বিশেষ কক্ষটি যে আজ অন্যরূপে সজ্জিত হয়েছে সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছিলেন মুসাফির। রুকসানাকে দেখার প্রচেষ্টায় এদিক ওদিক অগ্রসর হবার আগেই রুকসানার কণ্ঠ শুনতে পেলেন মুসাফির। ভরাট গলায় বললেন, আসুন শাহজাদা। আমার মহলে আপনাকে স্বাগত জানাই। জোরে একটা তালি দিয়ে বললেন, একান্ত….

সহচরী, দাসীরা বেরিয়ে গেলো। নূপুরের ঝিনিঝিনি আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না মুসাফির। ফুলবিছানো পালংকে বসলেন।

তখনই চোখ ধাঁধানো রূপ নিয়ে উপস্থিত হলেন রুকসানা। আদিবাসী জংলী মেয়েদের সাজে ওর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না মুসাফির। বুনো ফুলের গন্ধের মত ওকে তীব্র আকর্ষণ করছিলেন রুকসানা। মুসাফির এগিয়ে যেতেই রুকসানা ওর সম্মুখে কোরান খানি রাখলেন। বিস্মিত হয়ে মুসাফির বললেন, এ কেমন ব্যবহার বেগম। তোমার এত আয়োজন কি তবে ধর্মপাঠের উদ্দেশ্যে! এ চরম শাস্তি যে রুদ্রনগরের বাদশাহও কাউকে দেন না।

এমন কঠিন পরীক্ষা কেন নিচ্ছো বেগম? আমার অপরাধ কি? ভালোবাসাই কি আমার একমাত্র অপরাধ? রুকসানার ক্ষীণ কোমর হাত দিয়ে বেষ্টন করতে গেলেন মুসাফির। রুকসানা নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। মুসাফির ব্যর্থ হয়ে বললেন, আজ তবে তোমার মহলে আমার কিসের আমন্ত্রণ বেগম? এ ফুলশয্যা, এ মোহিনী রূপ সব কি কেবল মায়া? ধর্মগ্রন্থ পাঠের আয়োজন কি এসব? রুকসানা স্থির হয়ে তাকিয়ে আছেন ঘিয়ের প্রদীপটার দিকে। চোখের তারায় বিষণ্ণতা।

নরম সুরে উদাসী কণ্ঠে রুকসানা বললেন, হুজুর আমি শাহজাদী। তাই আমার ভবিতব্য একজন বাদশাহ পুত্র হবে সেটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু আমি দরিদ্র কৃষক কন্যা হতে চেয়েছিলাম। একজন পুরুষের ওপরে থাকতো আমার একাধিপত্য। আমার গোটা শরীর জুড়ে তার ছোঁয়া। দিনান্তে একটি কুঁড়েতে বসে সুখ দুঃখের কথা বলতাম। আমি এই রাজ ঐশ্বর্যের কাঙাল নই। নিজের সোহরকে বেগমমহলের অন্য কক্ষে ভাগ করে নিতে আমি প্রস্তুত নই। আমাকে স্পর্শ করার পরে আবার আপনার হাত খুঁজবে অন্য একটি শরীরের রহস্য। এ বড় গ্লানির শাহজাদা। একজন নারীর কাছে এ বড় অপমানের। হারেমের বন্দি জীবন আমার পছন্দের নয়।

.

রুকসানার গলায় এ অদ্ভুত কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মুসাফির। শাহজাদার একজন মাত্র বেগম থাকবে? এসব কি কষ্টকল্পনা করছে রুকসানা! তাহলে রাজত্ব টিকবে কি করে?

সন্ধিনীতির জন্যেও কত রাজ্যের শাহজাদীকে নিকাহ করতে হয়। তাছাড়া হারেম ছাড়া রাজ্যের জৌলুস কোথায়!

মুসাফিরের কৌতূহলী দৃষ্টি অনুসরণ করে রুকসানা বললেন, আমি জানি হুজুর। এ অসম্ভব। তবে আজকের এই শুভ সন্ধ্যায় আমি যদি কিছু উপহার চাই আপনার কাছে তা কি মঞ্জুর হবে?

রোকেয়াও উপহার চেয়েছিলো মুসাফিরের কাছে। একটা ফুলমহল। চারিদিকে ফুলগাছ দিয়ে ঘেরা একটা মহল। মাঝে একটি শ্বেতপাথর নির্মিত পরী। যার নাভীদেশ থেকে ফোয়ারার আকারে জল পড়ছে। সে মহল গড়তে রুদ্রনগরের শিল্পীদের একবৎসর সময় অতিবাহিত হয়েছিলো। বড়ই মনোরম সে মহল। মুসাফির ভাবলেন, রুকসানাও নিশ্চয়ই আজ অমনই একখানা মহল উপহার হিসেবে দাবি করবে।

মুসাফির নিজের বুকে হাত রেখে হেসে বললেন, এ কলিজা তোমার জন্য কুরবান বেগম। বলো কি উপহার চাও?

রুকসানা ধীর স্থির কণ্ঠে বললেন, আমিই আপনার শেষ বিবাহিত স্ত্রী হলাম। এরপর আপনি আর কারোর সঙ্গে নিকাহ করবেন না শাহজাদা। আমিই আপনার শেষ স্ত্রী হয়ে থাকতে চাই।

রুকসানার গলায় আবেদনময়ী আদেশের সুর। মুসাফিরের মনে হলো, এর থেকে বেশি সৌন্দর্য কি আল্লাহ আর কোনো নারীকে প্রদান করেছেন? নিশ্চিত নয়। রুকসানার তলোয়ার চালানো হাত দুটো এখন মেহেন্দি রাঙানো। পদ্মকলির মত অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে হীরকখণ্ড। মুসাফির হাতটা আকর্ষণ করে বললেন, কথা দিলাম। রুকসানা মাঝপথে মুসাফিরকে থামিয়ে বললেন, দাঁড়ান শাহজাদা। এই পবিত্র কোরান শরীফ স্পর্শ করে আপনি প্রতিজ্ঞা করুন, আর কোনো বাদশাহ কন্যা এ হারেমে প্রবেশ করবে না আপনার স্ত্রীর পরিচয়ে।

মুসাফির কোরান স্পর্শ করে বললেন, প্রার্থনা মঞ্জুর হলো বেগম।

রুকসানার খোঁপার ময়ূরের পালক খসে পড়লো। শাড়ির আঁচল হলো অসংলগ্ন। বাতিদানের বাতি জ্বলতে জ্বলতে ক্ষয়ে এলো। মুসাফির নিজেকে হারিয়ে ফেললেন রুকসানার শরীরের উষ্ণতায়।

রুকসানা কানে কানে বললেন, রুদ্রনগর জানবে আমাদের প্রেমকাহিনী। পদ্মসায়রে, ঝোরার জলে, দখিনা বাতাসে রচিত হবে আমাদের নাম। মুসাফির বললেন, রুকসানা! শরাবের থেকেও কঠোর নেশা তুমি। এ নেশা থেকে আমি মুক্তি চাই না। আমি এ নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে চাই।

.

রুকসানার নেশায় মোহিত হয়ে কেটে যাচ্ছিলো মুসাফিরের জীবনটা। রুকসানার সঙ্গে জঙ্গল ভ্রমণের উদ্দেশ্য নিয়ে শিকারে যোগদান করেছিলেন মুসাফির। রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেও কখনও শিকারের নেশা তৈরি হয়নি মুসাফিরের। জীবনে এই প্রথমবার তিনি রুকসানার সঙ্গে শিকারে অংশগ্রহণ করেছেন। তীরধনুকের নিখুঁত নিশানায় রুকসানা ঘায়েল করেছেন বুনো হরিণ বা শুকর। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থেকেছেন রুকসানার দিকে। দক্ষ একজন শিকারি তার জীবনসঙ্গিনী সেটাও অনুভব করেছেন। সর্বোপরি মুসাফির অনুধাবন করেছেন রুকসানা পৃথক ধাতুতে গড়া। ওকে বশ করার নিত্যনতুন কৌশল আয়ত্তে করাটাই মুসাফিরের বর্তমান নেশা। রুদ্রনগরের বাতাসে যখন মুসাফির আর রুকসানার প্রেমকাহিনী ভেসে বেড়াচ্ছিল ঠিক তখনই রুদ্রনগরের বুকে নেমে এলো চরম বিপর্যয়।

.

বল্লভপুরের রাজার সঙ্গে রুদ্রনগরের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এ খবর রুকসানাকে বলেছিলেন মুসাফির।

রুকসানা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাহলে শাহজাদা আপনি এখনও রুদ্রনগরের প্রাসাদে কেন রয়েছেন? যুদ্ধক্ষেত্রে আপনি কেন অনুপস্থিত?

মুসাফির রুকসানার কোমল ওষ্ঠে চুম্বনরত অবস্থায় বলেছিলেন, বাদশাহ স্বয়ং উপস্থিত আছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। আমি ওই স্থানে নেহাতই নিষ্প্রয়োজন। রুকসানা মুসাফিরের বক্ষলগ্না হয়ে বলেছিলেন, আপনি রুদ্রনগরের ভাবি বাদশাহ, আপনারও উচিত যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থাকা। আপনি এভাবে কর্তব্য অবহেলা করতে পারেন না। রুদ্রনগরের প্রজারা বিক্ষোভ করবে, সৈন্যরা বিদ্রোহ করবে।

মুসাফির মৌতাত ভেঙে যাওয়ার কণ্ঠে বলেছিলেন, বেগম, মানুষের প্রাণ নেওয়া আমার কর্তব্য নয়। আমি একজন চিকিৎসক। মানুষের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়াই আমার লক্ষ্য। যুদ্ধ নিয়ে অতি উত্তেজিত রুকসানার মন জয় করার উদ্দেশ্যেই মুসাফির শুনিয়েছিলেন বল্লভপুরের যুদ্ধের ফলাফল। রুদ্রনগর নাকি জয় ঘোষণা করে তাদের জয় পতাকা স্থাপন করেছে বল্লভপুরের সীমানায়।

এ সংবাদে রুকসানার ঠোঁটে হাসি ফুটেছিলো। তৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, জয় রুদ্রনগরের জয়।

বল্লভরাজ পরাজিত হয়েছে এমন সংবাদ যখন রুদ্রনগরের বাদশা, বেগমমহলের কোনায় কোনায় ভাসছে তখনই সেই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলো গুপ্তচর।

বল্লভপুর জয় করে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত করে বাদশাহ মিজানুর জয়ের কেতন উড়িয়ে ফিরছিলেন নিজের রাজ্যে। এমন সময় নাকি যুদ্ধনীতি ভঙ্গ করে বল্লভপুরের রাজা হত্যা করেন মিজানুরকে।

রুদ্রনগরের সামরিক শক্তি এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বল্লভপুরের রাজাকে হত্যা বা বন্দি না করেই ফিরে এসেছিলো রাজ্যে। এমনকি সুজান খানের মত প্রতিশোধপরায়ণ সুদক্ষ মন্ত্রী পর্যন্ত মিজানুরের মৃত্যুতে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে বাদশাহের মৃতদেহ নিয়ে ফিরে এসেছিলেন রুদ্রনগরে।

.

রুদ্রনগরের প্রাসাদের চূড়ায় কালো পতাকা উত্তোলন হয়েছিল। শোকে মুহ্যমান হয়েছিল রাজ্যবাসীরাও। মুসাফিরের মাথার ওপর থেকে বটবৃক্ষের ন্যায় ছায়াটা অপসৃত হয়েছিলো। বাস্তব এসে করাঘাত করেছিলো তাঁর সুখসজ্জিত মহলে। তাঁর কাব্যের জগতে ঘটে গিয়েছিলো পালাবদল। কোমল শব্দের আনাগোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেখানে। পীতবর্ণের কাগজের ওপরে কালো অক্ষরগুলো আকস্মিকভাবেই পথ পরিবর্তন করে নিয়েছিলো।

রুদ্রনগরের সিংহাসনের গুরুদায়িত্বর একমাত্র অধিকারী মুসাফির চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। এ রাজ্যপাট, এ যুদ্ধ, সন্ধি তাঁর ঘোরতর অপছন্দের স্থান। রুকসানা বাদশাহী তাজ মাথায় পরিয়ে দিয়ে আর বাদশাহ মিজানুরের রক্ত মাখা তলোয়ারটা ওঁর হাতে দিয়ে বলেছিলেন, রক্ষা করুন হুজুর। এ রাজ্যের প্রতিটা মানুষের ভরসা স্থল আপনি। কঠিন হয়ে দমন করুন বহিরাগত শত্রুদের। আর পিতার হত্যাকারীর প্রতিশোধ নিয়ে আমায় গর্বিত করুন। বেগমমহলকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্বও আপনার।

কাব্য আর চিকিৎসার জগৎ থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন মুসাফির। রুকসানা বেগমমহলের নিয়ম লঙ্ঘন করেই সুজান খানের সঙ্গে গোপনে দেখা করেন। মুসাফিরের দুর্বল মনোবল দেখে রুকসানা সম্যক অনুভব করেছিলেন, ভগ্নপ্রায় শিরদাঁড়াকে শক্তিশালী করতে হলে একজনের সাহায্য ওঁর নিতান্ত প্রয়োজন। সুজান খান যে সেই ব্যক্তি এটা অনুধাবন করেছিলেন রুকসানা। তাই কালবিলম্ব না করেই সুজান খানকে ডেকে পাঠান নিজের মহলে।

সুজান খানের কাছ থেকে বল্লভপুরের রাজার বাদশাহকে হত্যা করার পদ্ধতি শুনে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন রুকসানা।

সন্ধি শেষে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন বল্লভরাজ। মিত্রতার সুযোগ নিয়ে বিষাক্ত অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেন মিজানুরকে। এ বেইমানিতেই সুজান খানের নিদ্রা অপহৃত হয়েছে।

রুকসানার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পরে দুজনেই সিদ্ধান্ত নেন, মুসাফিরই যাবেন বল্লভপুর আক্রমণ করতে। সেই মানসিকতা তৈরি করার দায়িত্ব ভাগ করে নেন রুকসানা ও সুজান খান। বল্লভরাজের মৃত্যুই দিতে পারে বাদশাহ মিজানুরের কবরের শান্তি।

রুকসানার মত তেজী নারীকে পছন্দ হয় যুদ্ধবিলাসি সুজান খানের। নেহাত রুদ্রনগরের সিংহাসনে কোনো নারীর অভিষেক হয় না তাই রুকসানাকে সিংহাসনে বসাতে অপারগ সুজান খান। নচেৎ এ সিংহাসনের যোগ্য দাবিদার রুকসানা স্বয়ং। তাঁর মধ্যে রয়েছে তেজদৃপ্ত সুলতানি মানসিকতার প্রতিফলন। যা বিন্দুমাত্র উপস্থিত নেই মুসাফিরের শরীরে।

.

মুসাফির সিংহাসনে আরোহণ করবেন। অথচ রাজ্যবাসীর মনে আনন্দ নেই। এমন কাব্যরসিক অপদার্থ বাদশাহকে তারা ভরসা করতে পারছে না। তাই স্বতঃস্ফূর্ত কোনো অনুষ্ঠান নেই মুসাফিরকে ঘিরে। সদা ভাবুক মুসাফির ইচ্ছার বিরুদ্ধেই রুদ্রনগরের সিংহাসনে বসলেন। রুকসানা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে মুসাফিরেকে বাদশাহ রূপে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

মুসাফিরের গর্ভধারিণী জাহানারা বেগম একটাই শর্ত দিয়েছেন পুত্রকে। রুদ্রনগরের সিংহাসনে আরোহণ করার পরে তার একটাই লক্ষ্য। বাদশাহ মিজানুরের হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড।

এসব জটিলতায় ইতিমধ্যেই হাঁপিয়ে উঠেছেন মুসাফির। রুকসানার সৌন্দর্যের আকর্ষণে তিনি বারংবার ছুটে ছুটে যান ছোটি বেগমের মহলে। কিন্তু রুকসানা তাঁর হাতে তলোয়ার দিয়ে বলেন, পরাজিত করুন আমায়। তারপর স্পর্শ করবেন আমার শরীর।

রুকসানাকে প্রতি রাতে কামনা করলে অসি লড়াইয়ে ওকে পরাজিত করতে হবে, তবেই সে রাতে ওকে অধিকার করতে পারবেন মুসাফির।

ফলত প্রতি রাতেই পরাজিত হচ্ছিলেন মুসাফির। আর ব্যর্থ মনোরথে বেগমমহল থেকে ফিরে আসছিলেন। রুকসানাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা ক্রমাগত বেড়েই চলছিলো ওঁর। রুকসানাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সোহরকে যুদ্ধে পারদর্শী করে তুলবেনই। বেপরোয়া, বীর, সাহসী একজন বাদশাহে পরিণত করতে চান তিনি মুসাফিরকে। সে প্রচেষ্টায় তাকে সব রকমের সাহায্য করছেন মন্ত্রী সুজান খান।

রুকসানা যেন রুদ্রনগরের নতুন সূর্য। নিয়মের নাগপাশ ভেঙে বেরিয়ে আসা বীরাঙ্গনা। যার আড়ালে সমালোচনা করা গেলেও সম্মুখে নতমস্তক হতে বাধ্য সকলে। রুদ্রনগরের অলিগলিতে এখন একটাই আলোচনা, মুসাফিরের অপদার্থতা আর রুকসানা বেগমের নিয়মভঙ্গ।