মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ৯

।। নয় ।।

শাসন ক্ষমতা বলতে যা বুঝায়, ইংরেজদের সে আমলে গ্রাম, গঞ্জ, শহরে ইংরেজ অফিসার ও কর্মচারীদের বাদ দিলে যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা হচ্ছে থানার দারোগা এবং তারা এই দেশীয়। কাজেই দারোগা পদটি ছিল যেমন এদেশীয় লোকের পক্ষে লোভনীয় তেমনি বুঝি গর্ব করে বলবার মতও। দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল তাদের এবং সাধারণ গ্রাম, গঞ্জ, শহরের মানুষ তাদের নামে ভয়ে কাঁপত। ওই দারোগারাই ছিল তাদের কাছে দেওয়ানী-ফৌজদারী আদালত ও হাইকোর্ট।

গ্রামে গঞ্জে শহরে দারোগারাই ছিল সে সময় জজ ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর। কিন্তু শুধুই কি প্রতাপ? তেমনি ছিল তাদের অর্থাগম

দশ হাত দূর থেকে তাদের দেখলে সাধারণ লোক ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপত। কারোর বাড়ির ছেলে বা আত্মীয় দারোগা হলে গর্বের যেমন তাদের শেষ থাকত না, তেমনিই বুক ফুলিয়ে সে কথা প্রকাশ করত।

কাজেই চুয়াল্লিশ বছর বয়স্ক সেনমশাই প্রথম পক্ষ তার বড় বড় দুটি সন্তান রেখে গত হয়েছে জেনেও আনন্দচন্দ্র দারোগা নিবারণচন্দ্র সেনের হাতে তার নয় বৎসরের কিশোরী কন্যা কুসুমের হাত তুলে দিতে দ্বিধামাত্রও করেনি।

ঘটকও বুঝিয়েছিল আনন্দচন্দ্রকে, আর দ্বিধা করবেন না গুপ্তমশাই, শুধু প্রতাপ- প্রতিপত্তিই নয়, অঢেল টাকা—মেয়ে আপনার সোনার পালঙ্কে বসে ঘর করবে— রাজরাণী হয়ে থাকবে।

আনন্দচন্দ্রের অবস্থা তখন সচ্ছল তো নয়ই, বরং বেশ টানাটানির সংসার। গ্রামের মধ্যে সারাদিন উদয়-অস্ত খেটে ডাক্তারী করে যা উপার্জন করে, তার বৃহৎ পরিবারের পক্ষে সেটা যৎসামান্যই।

তিন-তিনটি বিধবা বোন, পাঁচটি পুত্র, তিনটি কন্যা—কুসুমই তো একমাত্র নয়, পরের কন্যাদেরও কয়েক বছরের মধ্যে বিবাহ দিতে হবে এক এক করে। তার চাইতেও বড় কথা ছেলেরা বড় হচ্ছে—তাদের শিক্ষা, তার জন্য খরচ ইত্যাদি। বিশেষ করে বড় ও মেজ ছেলে তখন কলকাতায় থেকে একজন মেডিকেল কলেজে ও অন্যজন স্কুলে ডাক্তারী পড়ছে। তার পরের ছেলেটি কলকাতায় পড়তে যাবে দু’এক বছরের মধ্যেই। অর্থের জোগান দিতে দিতে হিমশিম খেয়ে যেতে হচ্ছে আনন্দচন্দ্রকে সেই সময়

মেয়ের বিয়েতে খুব কম হলেও চার-পাঁচশ টাকার দরকার। কোথা হতে আসবে অত টাকা! কাজেই আনন্দচন্দ্র রাজী হয়েই গিয়েছিল।

নিবারণচন্দ্রের সঙ্গেই কুসুমের বিবাহ হয়ে গেল। এবং আনন্দচন্দ্র যে এ বিবাহে সম্মত হয়ে কত বড় বুদ্ধির কাজ করেছিল অনতিকাল পরেই বুঝতে পেরেছিল।

নিবারণচন্দ্রের মনটা যেমন ছিল বিরাট, স্বভাবটিও ছিল দিলদরিয়া। অর্থ তো তার ছিলই। শ্যালকদের সে যে কেবল স্নেহই করত তাই নয়, নিজের ভাইয়ের মত বুঝি ভালও বাসত। বস্তুত সে না থাকলে, তার নিয়মিত সাহায্য না পেলে আনন্দচন্দ্রের একটি ছেলেরও শিক্ষা সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত হত কিনা সন্দেহ পরবর্তীকালে।

যদিচ কুসুম ঠাকরুন ওই সব সাহায্যের কথা কিছুই জানত না, এবং স্ত্রী যে ঠিক সহজ ভাবে ব্যাপারটা নেবে না জানতে পেরেই বুদ্ধিমান নিবারণচন্দ্র গোপনে শ্যালকদের সাহায্য করত।

বস্তুত কুসুম ঠাকরুণ কোনদিনই তার স্বামীর ওই গোপন সাহায্যের কথা জানতে পারেনি। দরিদ্র অসচ্ছল বাপের ঘর থেকে এসে এই প্রাচুর্যের মধ্যে কুসুম ঠাকরুন যেন হঠাৎ হকচকিয়ে গিয়েছিল—কেবল প্রাচুর্য আর প্রাচুর্য!

প্যাটরা-ভর্তি কাঁচা টাকা—গা-ভর্তি অলঙ্কার—ঘরে অঢেল খাদ্যসামগ্রী – কুসুম ঠাকরুনের যেন বাঁশ বনে ডোম কানা’র মত অবস্থা।

পতিসোহাগে সোহাগিনী, গরবিনী কুসুম ঠাকরুন ঝলমলিয়ে বেড়ায়—সংসারে সে-ই সব কিছুর কর্ত্রী। সে যুগের মেয়েদের অল্প বয়েসে বিবাহ হলে কি হবে, শ্বশুরগৃহে সে রকম পরিবেশে পড়লে সহজেই যেন তারা গৃহিণীর পদে উন্নীত হয়ে যেত। কুসুম ঠাকরুনও তেমনি তেরো-চোদ্দ বৎসর বয়সেই পাকা গিন্নী হয়ে নিবারণচন্দ্রের সংসারের হালটা শক্ত মুঠোয় ধরেছিল।

অন্নদাসুন্দরীর বিবাহ হয়েছিল নয় পেরিয়ে দশে, এবং সে প্রথম সন্তানের মা হয় তার বয়স যখন মাত্র বারো বৎসর। সে যুগে ব্যাপারটার মধ্যে খুব একটা বোধ হয় অস্বাভাবিকতা ছিল না।

কুসুম ঠাকরুনের প্রথম সন্তান কন্যা হেমলতাও জন্মায় যখন, তখন তার তেরো বৎসর বয়সও না। যাক গে, সে সব তো আরও অনেক পরের কথা। অন্নদাসুন্দরীর বিবাহের তেরাত্তিরই তো এখনো পার হল না।

হ্যাঁরে, কামড়ে খেয়ে দেখ না—আনন্দচন্দ্র বলে।

পেয়ারা আর আমলকী অন্নদাসুন্দরীর চিরদিনের অতি প্রিয় বস্তু। পেয়ারাগুলো আকারেও বড় এবং গোল গোল।

একটা পেয়ারায় কামড় বসিয়ে হাতে নিয়ে দেখল অন্নদাসুন্দরী, তার স্বামী মিথ্যা বলেনি। সত্যি পেয়ারাটা যদিও তখনো ভাল করে পাকেনি, ভিতরটা কিন্তু গোলাপী—বিচিগুলোও ছোট ছোট।

খা—খা না—খেয়ে দেখ। নিজে একটা পেয়ারায় কামড় দিতে দিতে অন্নদা- সুন্দরীকে তাগিদ দেয় আনন্দচন্দ্র আবার।

খুব মিষ্টি তো! অন্নদাসুন্দরী বলে।

কেমন! বলিনি! খেয়েছিস এরকম পেয়ারা কখনো? এ পেয়ারা পশ্চিমে হয়।

আমার বাবা যেখানে থাকেন সেও তো পশ্চিম।

হ্যাঁ, লক্ষ্ণৌ তো পশ্চিমই

সেখানে এরকম পেয়ারা তো পাওয়া যায় না।

কেন যাবে না? পাওয়া যায়।

বাবা তো কখনো আনেননি।

হয়তো মনে পড়েনি কখনো পেয়ারার কথা।

তাই বোধহয়—অন্নদাসুন্দরী চিবিয়ে চিবিয়ে পেয়ারার স্বাদগ্রহণ করতে থাকে। চেয়ে থাকে আনন্দচন্দ্র বালিকা বধূর মুখের দিকে-

ছোট কপাল—টানা দুটি ভ্রূ—গভীর আঁখি-পদ্ম—টিকালো নাক—ঠোঁট দুটি কি পাতলা আর লাল! কয়েক গাছি চুড়ি ও স্থানভ্রষ্ট চূর্ণ কুন্তল উপর থেকে কানের পাশ দিয়ে গালে এসে পড়েছে। আনন্দচন্দ্রের প্রথম যৌবন যেন সেদিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। কেমন যেন স্বপ্নাচ্ছন্নের মত ডাকে—বৌ?

উঁ! অন্নদাসুন্দরী সাড়া দেয় তার সাধের পেয়ারা চিবুতে চিবুতে।

তুই খুব সুন্দর

হঠাৎ যেন ওই সুন্দর কথাটা শুনে কেমন বোকা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় আনন্দচন্দ্রের মুখের দিকে, তারপর হঠাৎই বলে – ধ্যাৎ।

সত্যি তুই খুব সুন্দর। একটু যা তোর গড়নটা বেঁটে, লম্বা না। তা হোক। ঢ্যাঙ্ ঢ্যাঙ্ েলম্বা মেয়েছেলে আমার একটুও ভাল লাগে না। দেখ না মেজপিসীকে—ওই যে রে মেজ ঠাকরুন—গায়ের রঙ তোর চাইতেও ফরসা, কিন্তু কি বিশ্ৰী লম্বা! যেন একটা তাল গাছ!

অন্নদাসুন্দরী ফিক করে হেসে ফেলে।

শুধু তোর গায়ের রঙই গৌরবর্ণ নয়, গড়নটিও তোর ভারী চমৎকার।

কিন্তু আনন্দচন্দ্রের প্রেমালাপ মধ্যপথে বাধা পেল–গুনগুন করে শিবস্তোত্র উচ্চারণ করতে করতে নিভাননী ঠাকরুন তসরের থান পরনে চারিদিককার ছোঁয়া বাঁচাতে বাঁচাতে ঘরে এসে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন—কেডা রে?

অন্নদাসুন্দরী তাড়াতাড়ি একগলা ঘোমটা টেনে দেয়, আর আনন্দচন্দ্ৰ যেন প্রস্তরীভূত, চুরি করতে গিয়ে যেন আচমকা ধরা পড়ে গিয়েছে বেচারী।

ঘরের মধ্যে দিনের আলো তেমন প্রবেশ করতে পারে না বলে আবছা আবছা অন্ধকার। তথাপি মেজ ঠাকরুনের চিনতে কষ্ট হয় না। বলেন—অ, তুই? ওহানে তোরা দুজনে করতিছিস কি রে?

অন্নদাসুন্দরীর মুখভর্তি পেয়ারা—চিবুতেও সে ভুলে গিয়েছে, রুদ্ধশ্বাস।

মেজ ঠাকরুন কিন্তু আর ওদের দিকে তাকালেনও না। কি একটা নিতে ঘরে এসে ঢুকেছিলেন—নিয়ে বের হয়ে গেলেন। ঘোমটার আড়াল থেকে দেখতে পেল অন্নদাসুন্দরী, হাঁটুর উপর কাপড় তুলে চারিদিকের অস্পৃশ্যতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে মেজ ঠাকরুন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলার ভঙ্গিটা অন্নদাসুন্দরীর হাসির উদ্রেক করে। সে ঘোমটার আড়ালেই একমুখ পেয়ারা নিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে।

বাবাঃ, নে ঘোমটা তোল। চলে গেছেন মেজ পিসি। আনন্দচন্দ্র বলল।

অন্নদাসুন্দরী কিন্তু ঘোমটা তোলে না। সে ততক্ষণে আবার অর্ধসমাপ্ত পেয়ারা, চিবুতে শুরু করে দিয়েছে।

আনন্দচন্দ্ৰই ঘোমটাটা টেনে অন্নদাসুন্দরীর মাথার উপর থেকে টেনে ফেলে দেয়। অন্নদাসুন্দরী আবার ফিক করে হাসে।—উনি কে?

কার কথা বলিতিছিস?

ওই যে—একটু আগে এ ঘরে এসেছিলেন।

ও তো মেজ ঠাকরুণ, মেজ পিসী।

আর সেই যে হেসে হেসে কথা বলেন?

সে তো ছোট পিসী—ছোট্‌ ঠাকরুন, পিসিমণি। বাবার চার বোন—চন্দ্ৰকলা, নিভাননী, সরোজিনী, বিন্দুবাসিনী।

ওঁরা সবাই এখানেই থাকেন বুঝি?

হ্যাঁ। বিধবা যে। তাই বাবার কাছেই থাকে।

সবাই বিধবা?

হ্যাঁ, সবাই বিধবা।

ওঁদের আলাপে বাধা পড়ল। ভৃত্য কৈলাস এসে ঘরে ঢুকল – দাদাবাবু?

কিরে কৈলাসদা?

বৌমণির সঙ্গে গল্প করতিছো আর এদিকে যে সান্যাল মশাই তোমারে খুঁজতিছেন।

সান্যাল মশাই! ধক্ করে ওঠে আনন্দচন্দ্রের বুকের ভিতরটা। ক্ষীণপ্রায় বোজা কণ্ঠে বলে—কেন রে কৈলাসদা?

তা আমি কবো ক্যামনে! চল—

কিন্তু আমার যে ভীষণ জ্বর।

জ্বর! কখন জ্বর আয়লো? দেহি-

সেই রাত থেকেই। কথাটা বলে আনন্দচন্দ্র আর দাঁড়ায় না। সোজা বিরাট জোড়া দেওয়া চৌকির উপর গিয়ে শুয়ে পড়ে, একটা কাঁথা টেনে নিয়ে গায়ে দিয়ে বলে—যা কৈলাসদা, বল্ গে আমার ভীষণ জ্বর।

তা কত্তাবাবুরে কথি পারো নাই কথা। পাঁচন দিয়ে যাতেন। দেহ দেহি, কি কাণ্ডটা বাধালে। প্রথম ঠাণ্ডা, তা জ্বর কাশি তো হতিই পারে। যাই সান্যাল মশাইরে বলি গে।

অন্নদাসুন্দরী তার স্বামীর জ্বরের কথায় রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছে। কৈলাস চলে যেতেই গুটিগুটি পা ফেলে এসে চৌকির পাশে দাঁড়ায়—সত্যি আপনার জ্বর হইছে?

ক্যান্? জ্বর হতি পারে না? আমি কি মিথ্যা বলছি?

অন্নদাসুন্দরী—বালিকা অন্নদাসুন্দরী অতশত বোঝে না। বলে—রাত থেকেই জ্বর হল, তা তো কই আমারে কন নাই!

তুই কি ডাক্তার না কবরেজ, যে জ্বরের কথা তোরে কথি যাবো!

আজ তালে ভাত খাবেন না।

ক্যান্? ভাত খাব না ক্যান্?

ওমা, জ্বরের মধ্যি ভাত খাবেন?

এ তো মেলেরিয়া জ্বর, হুস্ করে কাঁপায়ে আসে আবার হুস্ করে চলে যায়।

কৈলাসের গৃহমধ্যে আবার আবির্ভাব ঘটল, দাদাবাবু, কত্তাবাবু আয়লো, তোমারে ডাকতিছেন।

বাবা রোগী দেখে ফিরে এসেছেন?

সেখানে তো যান নাই। পথেই শুনলেন রোগী মারা গেছে—চলে আয়লেন।

বাবাকে বলেছিস নাকি?

কি বলব?

আমার জ্বরের কথা।

ওই যা, ভুলে গেছি তো! যাই, কয়ে আসিগে।

এই কৈলাসদা, যাস নে। হ্যাঁরে, সান্যাল মশাই চলে গেছেন?

না, দুজনে বসি তামুক খাতিছেন।

আচ্ছা, তুই যা। আমি যাচ্ছি।

কৈলাস চলে গেল। একটু পরেই দুরু দুরু বক্ষে আনন্দচন্দ্র গিয়ে ভারতচন্দ্রের সামনে দাঁড়াল।

এই যে নশো, হুঁকোটা মুখ থেকে সরিয়ে ভারতচন্দ্র শুধালেন—তোমার নাকি জ্বর হইছে?

হ্যাঁ, মানে হয়েছিল, এখন আর নেই। দেখুন না গা ঠাণ্ডা

ভারতচন্দ্র বিচক্ষণ কবিরাজ। ছেলের হাতটা নিয়ে নাড়ী পরীক্ষা করে বললেন, নাড়ী তো চঞ্চল নয়। জ্বরের নাড়ী তো নয়। ঠিক আছে, আজ আর তালি স্নান করো না, ভাত খায়ো না। শোন, সান্যাল মশাই আজ যাচ্ছেন না, পরশুই যাবেন।

আনন্দচন্দ্রের বুকের উপর থেকে যেন একটা পাষাণ ভার নেমে গেল। সে তখন ওখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে।

ভারতচন্দ্র কথাটা বলে আবার সান্যাল মশাইয়ের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন।

কিন্তু আনন্দচন্দ্রের পরের পরশু তো নয়ই—সাত-আট দিনেরও বেশী থেকে যেতে হল একটা আকস্মিক ঘটনা বিপর্যয়ে।

মেজ ঠাকরুন নিভাননীর হঠাৎ একেবারে কথা বন্ধ হয়ে গেল।

নিজের পূজা-আর্চা নিয়েই বাড়ির পশ্চিমের পোতার ছোট ঘরটিতে নিভাননী ব্যস্ত থাকতেন। সারাটা দিনমান তো বটেই, অধিক রাত্রি পর্যন্ত ওই পুজোই করতেন।

সেদিন মধ্যরাত্রে হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ জীর্ণ চিৎকারে বাড়ির অনেকেরই ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙলেও কেউই ব্যাপারটা সঠিক অনুমান করতে পারেনি। একমাত্র পেরেছিল বিন্দুবাসিনী। তার জন্যে মনে হয়েছিল, জেগেই ছিল সে তখনো। তার মেজদির পুজোর ঘর থেকেই চিৎকারটা ভেসে এল।

সে একটা কুপি হাতে চলে গেল নিভাননীর ঘরের দিকে। ঘরের মধ্যে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল। পুজোর ফুল, বিল্বপত্র চারদিকে ছড়ানো। কালো পাথরের শিবলিঙ্গটি উলটে পড়ে আছে, আর সেই বিপর্যয়ের মধ্যেই, বিস্রস্তবসনা নিভাননী দেবী পড়ে আছেন। গায়ের আঁচল খসে গিয়েছে, ছোট ছোট করে ছাঁটা মাথার চুলগুলো কাদায় লেপটা-লেপুটি, চক্ষু দুটি বিস্ফারিত, সামান্য একটু হাঁ হয়ে আছে, কস বেয়ে গ্যাজলা গড়াচ্ছে।

এই মেজদি! মেজদি! কি হল মেজদি! বিন্দুবাসিনী ডাকেন, ছোঁয়াছুঁয়ির কথা একপ্রকার যেন ভুলে গিয়েই নিভাননীর গায়ে হাত দিয়ে ঠেলা দেয়।

কিন্তু নিভাননীর দিক থেকে কোন সাড়া আসে না।

ইতিমধ্যে ভারতচন্দ্রেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তিনি বিন্দুবাসিনীর চিৎকারে ছুটে আসেন—কি, কি হয়েছে বিন্দী?

দাদা, দেখ মেজদি কি রকম হয়ে পড়েছে। কথা বলতিছে না।

ভারতচন্দ্র নিভাননীকে পরীক্ষা করে বুঝলেন নিভাননীর বাক্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত সন্ন্যাস রোগ। তখন সকলে ধরাধরি করে নিভাননীকে বড় ঘরে নিয়ে এল।

নিজের বুদ্ধি ও বিবেচনা মত ঔষধপত্র দিলেন, কিন্তু নিভাননীর গলা দিয়ে কোন ঔষধই নামল না। বাড়িতে উৎসবের ঝামেলা মিটতে না মিটতেই আর এক ঝামেলা এসে পড়ল।

আনন্দচন্দ্রের কলকাতা যাত্রা স্বভাবতই স্থগিত হয়ে গেল।

তিনদিন পরে নিভাননীর জ্ঞান ফিরল বটে কিন্তু কথা বন্ধ। ঠোঁট দুটি ও জিহ্বাটা কাঁপে, কোন শব্দ বের হয় না। দেহের একটা দিকও পঙ্গু হয়ে গিয়েছে—বাম দিকটা।

ডান পা ও ডান হাত সচল আছে বটে কিন্তু তাও তিনি নাড়ান না।

বিন্দুবাসিনীই সর্বক্ষণ তার মেজদিদির দেখাশোনা করে। পাঁচদিনের দিন ভারতচন্দ্র আনন্দচন্দ্ৰকে ডাকলেন।

ডাকছিলেন আমাকে!

হ্যাঁ। তোমার পড়াশুনার ক্ষতি হতিছে। কালই কলকাতায় যাবা। পরাণ মণ্ডলরে কয়ে দিছি, সে তার নাওয়ে তোমারে তারপাশায় পৌঁছে দেবা নে। একা একা যাতি পারবা না?

পারব।

ভয় করবে না তো?

না। ভয় কি?

হ্যাঁ, পুরুষ ছাওয়াল, ভয় করলি চলবে ক্যান্? ভাল করে পড়াশুনা করবা, সামনের বার যাতে ডাক্তারিতে ভর্তি হবার পারো, বুঝিছো?

হ্যাঁ।

যাও জিনিসপত্র সব পোর্টমান্টোতে গুছায়ে নাও গে।

.

রাত্রে আনন্দচন্দ্র অন্নদাসুন্দরীকে বললে—কাল আমি যাচ্ছি বৌ।

কাল!

হ্যাঁ, সকাল ন’টার মধ্যেই যাত্রা করতে হবে।

আবার কবে আসবেন?

ছুটি হলেই আসবো।

অন্নদাসুন্দরী চুপচাপ যেন কি ভাবছে তখন।

মন কেমন করবে তোর বৌ, না?

কেন?

কেন কি! আমার জন্য তোর মন খারাপ করবে না? আমার তো খুব মন কেমন করবে।

তাই বুঝি

হ্যাঁ দেখিস, তোরও মন কেমন করবে।

আমাকে যে বলেছিলেন কলকাতা যাবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আমাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাবেন।

সে তোরে বাবাই পাঠায়ে দেবেন।

কবে?

এই দু’চার দিনের মধ্যেই।

অন্নদাসুন্দরী সরল মনেই বিশ্বাস করেছিল বোধ হয় সেদিন কথাটা। কিন্তু বিশ্বাসটুকু ভাঙতে তার দেরি হয়নি।

দুই বৎসরের মধ্যেও যখন তার আর বাপের বাড়ি যাওয়া হল না, যাওয়ার কথা একটিবার কেউ বললে না পর্যন্ত, সে বুঝতে পেরেছিল, আর জীবনে কখনোই সে বাপের বাড়ি যেতে পারবে না।

আশ্চর্য! তার জন্য অন্নদাসুন্দরী কোনদিন এতটুকু অভিযোগ কারো কাছে করেনি। এমন কি আনন্দচন্দ্রের কাছেও কথাটা তোলেনি।

নিভাননী আর সুস্থ হলেন না। সেই যে শয্যা নিলেন—সেই তাঁর শেষ শয্যা। আনন্দচন্দ্রের বোনেরা একে একে শ্বশুরগৃহে চলে গেল। নিভাননী রোগশয্যায় শুয়ে—বিন্দুবাসিনী সর্বক্ষণ তাঁর সেবা নিয়ে ব্যস্ত।

চন্দ্রকলা—বড় ঠাকরুন আর সরোজিনী সেজ ঠাকরুন তাঁরা কোনদিনই সংসারে কর্তৃত্ব করা ছাড়া অন্য কাজ করতেন না। সংসারের কাজে বামাসুন্দরীকে সাহায্য করত বিন্দুবাসিনীই। সেই বিন্দুবাসিনী নিভাননীর সেবার কাজে আটকে পড়ায় মুশকিল হল বামাসুন্দরীরই। একা একা যেন বেচারী হিমশিম খেয়ে যান।

ব্যাপারটা একদিন অন্নদাসুন্দরীর নজরে পড়ল। বামাসুন্দরী উঠানে রৌদ্রে কলাই শুকাতে দিচ্ছিলেন, অন্নদাসুন্দরী এসে পাশে দাঁড়াল

মা!

কে? ও বৌমা। কি হয়েছে মা?

কলাইগুলো আমি ঠিক করে ছড়িয়ে দেব রৌদ্রে?

না মা থাক। ছেলেমানুষ তুমি পারবা না।

খুব পারবো মা। আপনি সরুন, আমি দেখছি।

পারবা!

হ্যাঁ, পারব।

তবে তাই দাও মা।

ঘণ্টাখানেক বাদে অন্নদাসুন্দরী শাশুড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ধান সিদ্ধ করছিলেন

বামাসুন্দরী।

মা।

দিয়েছো মা কলাইগুলো ভাল করে রৌদ্রে শুকুতে?

হ্যাঁ, আপনি অন্য কাজ করুন মা, আমি ধান সিদ্ধ করছি।

না মা, হাত-টাত পোড়ায়ে ফেলবা।

কিছু হবে না।

বামাসুন্দরী পুত্রবধুর মুখের দিকে তাকালেন। রৌদ্রতাপে সুন্দর মুখখানি টুকটুকে লাল হয়ে উঠেছে।