।। সাত ।।
অন্নদাসুন্দরী কি করবে বুঝতে পারে না।
সেজ ঠাকরুনই এসে অন্নদাসুন্দরীর হাত ধরে পালঙ্ক থেকে নামান।
অন্নদাসুন্দরীকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে সেজ ঠাকরুন ভ্রাতুষ্পুত্রকে সম্বোধন করে বললেন—দাদা বারান্দায় বসে আছেন, তোকে ডাকছেন নন্দ।
আনন্দচন্দ্র ঘর থেকে বের হয়ে কোঁচার খুঁটটা গায়ে টেনে উত্তরের পোতার বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
তখনো ভাল করে ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি—ঝাপসা ঝাপসা অন্ধকার চারিদিকে। সেই ঝাপসা ঝাপসা অন্ধকারে একটা বালাপোশ গায়ে জড়িয়ে ছোট একটা চৌকির উপর বসে ভারতচন্দ্র হুঁকায় তামুক খাচ্ছিলেন?
অতি প্রত্যুষে প্রায় রাত থাকতেই শয্যাত্যাগ করা ভারতচন্দ্রের চিরদিনের অভ্যাস। ভারতচন্দ্র—পিতামহের ওই গুণটি বা অভ্যাসটি তার একমাত্র ছেলে ও তার নাতিরা প্রত্যেকেই পেয়েছিল পরবর্তীকালে।
—আমাকে ডাকছিলেন বাবা? আনন্দচন্দ্র পিতার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
—হ্যাঁ, আজই আহারাদির পর দ্বিপ্রহরে তোমাকে রওনা হতি হবে-
আজই—কথাটা যেন আনন্দচন্দ্রের মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল নিজের অজ্ঞাতেই। সারা মন জুড়ে তখনো তার গতরাত্রের বালিকা বধূর স্পর্শের পুলকানুভূতি, এক অনাস্বাদিত শিহরণ, প্রথম যৌবনের সে এক বিচিত্ৰ অনুভূতি।
ভারতচন্দ্র হুঁকো থেকে মুখটা সরিয়ে বললেন—কেন? যাওয়ার কোন অসুবিধা আছে কি?
—না, অসুবিধা আর কি। তবে সান্ন্যালমশাই তো বলছিলেন পরশুর পরের দিন যাত্রা করবেন।
—না। তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করেছেন। কাল পরশু ও তার পরের দিনটা তেমন প্রশস্ত নয় বিদেশযাত্রার পক্ষে। মানে তেমন. শুভ নয়। তা ছাড়া অমাবস্যা। তাই গতরাত্রে তিনি এসে আমাকে বলে গেছেন, আজই দ্বিপ্রহরে বেলা আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে অমৃতযোগ আছে। সেই সময় যাত্রা করবেন। তুমি সব গোছগাছ করে প্রস্তুত হয়ে থেকো।
আনন্দচন্দ্র কোন জবাব দেয় না পিতার কথার। বিরক্তিতে মনটা তখন তার ভারী হয়ে উঠেছে। কিন্তু পিতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সেটা তাকে মনের মধ্যেই চেপে রাখতে হয়।
পিতা তার সরল, সাদাসিধে হলে কি হবে এবং সর্ব ব্যাপারে শিথিল হলেও, একমাত্র পুত্রের ব্যাপারে তিনি সর্বদাই অত্যন্ত সজাগ, যেন সর্বক্ষণ দশটা চোখ মেলে আছেন।
তাঁর বরাবরের আশা, স্বপ্ন—তাঁর একমাত্র পুত্র আনন্দচন্দ্র বড় হবে, মানুষ হবে, অনেক অনেক অর্থ উপার্জন করবে। এই প্রাত্যহিক নিষ্ঠুর দারিদ্র্যের অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আজ যেন ভারতচন্দ্র সত্যিই ক্লান্ত। অকালে বুড়িয়ে যেতে চলেছেন। গল্প, হাসিঠাট্টা করে ব্যাপারটাকে তিনি উড়িয়ে দিতে চাইলেও, ভাবব না বললেও সুস্থির হতে পারেন কই, উড়িয়ে দিয়ে নির্বিকার হতেই বা পারছেন কই!
ভারতচন্দ্রের হঠাৎ খেয়াল হল, পুত্র আনন্দচন্দ্র সামনে দাঁড়িয়ে। কলকেটা বোধ হয় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। হুঁকোতে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে হঠাৎ যেন সচেতন হয়ে উঠলেন। বললেন—কি হল? দাঁড়ায়ে রইলে?
—না, এই একটা কথা ভাবছিলাম—
—ভাবছিলে একটা কথা! তা কথাটা কি?
—মানে, ওকে, ভেবেছিলাম কলকাতা যাবার পথে ওদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাব।
—কি বলতিছো মাথামুণ্ডু! কার কথা যে বলতিছো, কিছুই তো বুঝতে পারতিছি না! কারে যাওয়ার পথে নামায়ে দিয়ে যাবা? ভারতচন্দ্র প্রশ্নটা করে ছেলের মুখের দিকে তাকলেন।
—বলছিলাম ওর কথা। বড্ড কান্নাকাটি করছে-
—বলি কেডা—কার কথা বলতিছো? কেডা আবার কান্নাকাটি করতিছে?
—মানে আপনার পুত্রবধূর কথা। কথাটা যেন কোনমতে উগড়ে দিয়ে আনন্দচন্দ্ৰ পিতার মুখের দিকে তাকাল। বুকটার মধ্যে আনন্দচন্দ্রের তখন ধড়াস ধড়াস করছে অজ্ঞাত এক ভয়ে।
—অঃ, বৌমারে তার বাপের বাড়িতে নামায়ে দিয়ে যাবা! তারপরই চিৎকার করে উঠলেন—এই কৈলেস—কৈলেস—এক ছিলেম তামুক দিয়ে যা। এই হতভাগা—গেলি কোথায়?
ভারতচন্দ্র যেন হঠাৎ রেগে উঠেছেন। অত্যন্ত রেগে গিয়েছেন।
—কৈলেস—এই হতভাগা কৈলেস! মরেছিস, না বাঁইচে আছিস?
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে ভৃত্য কৈলাস-ডাকতিছেন কত্তা!
—হ্যাঁ, নবাবপুত্তুর। কলকেটা বদলে দেবা, না না—
কৈলাস হুঁকোর মাথা থেকে পোড়া কলকেটা নিয়ে চলে গেল।
বৌমার জন্যি তোমার চিন্তা করতি হবে না। বুঝিছ! তার ব্যবস্থা আমিই করতি পারব। বিয়ের পর দুটো দিনও কাটেনি, এখনি বাপের সামনে আসি বৌয়ের কথাডা বলতি একটু হায়া হল না! হতভাগা শহরে পড়তি গিয়া একেবারে গোল্লায় গেছ! এই লেখাপড়া শিখতিছ তুমি?
আনন্দচন্দ্র যেন পাথর। চলচ্ছক্তিহীন। ঘর থেকে যে বের হয়ে যাবে, তারও ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত যেন তখন আর অবশিষ্ট নেই।
—যা হতভাগা বেহায়া, যা আমার সম্মুখ থেকে, যা! কুলাঙ্গার! গেলি? এখনো খাড়ায়ে আছিস?
আনন্দচন্দ্র যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালায় পিতা ভারতচন্দ্রের সামনে থেকে। ছুটতে ছুটতে একেবারে বাড়ির পশ্চিম দিকে আমবাগানের মধ্যে গিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর ধুস্ করে বিরাট আমগাছটার গুঁড়ির উপর বসে পড়ে?
বুকের মধ্যে তখনো তার ধড়াস ধড়াস করছে। এমনিতে নির্বিরোধী শান্তশিষ্ট মানুষটি ভারতচন্দ্র, কিন্তু হঠাৎ ক্ষেপে উঠলে আর রক্ষে থাকে না। তা ছাড়া একমাত্র বড় আদরের পুত্র হিসাবে আনন্দচন্দ্র পিতা ভারতচন্দ্রের কাছ থেকে বরাবর স্নেহ-মমতার সঙ্গে বেশীমাত্রায় একটু প্রশ্রয়ই পেয়ে এসেছে।
রাগারাগি বা বকাঝকা তো দূরের কথা, কখনো উঁচু গলায় একটা কথা পর্যন্ত বলেননি ছেলেকে ইতিপূর্বে। আনন্দচন্দ্রের চোখ ফেটে যেন জল আসতে চায়।
কি এমন কথা বলেছিল আনন্দচন্দ্র যে, এতগুলো কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন বাবা!
উৎসবের বাড়ি অনেক আগেই জেগে উঠেছে। শোরগোলও শুরু হয়েছে কর্মব্যস্ততার মধ্যে।
একমাত্র পুত্রের বিবাহে ভারতচন্দ্র তাঁর আত্মীয়স্বজনদের দূর ও নিকট সকলকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁর সাধ্যের অতীত জেনেও এসেছিল অনেকে। আজ ক’দিন থেকেই বাড়িটা গমগম করছে। টাকার অভাব হয়নি—তা সেজদিই মিটিয়ে দিয়েছেন। আর কোন দুর্ভাবনা নেই তাঁর।
আমবাগানের মধ্যে কেবল আম গাছই নয়, যদিও সবাই বলত ওটাকে আমবাগান, কাঁঠাল গাছ, গোটা দুই ফলসা গাছ, গাব গাছ—আর কিছু কলা গাছ, নারকেল গাছ, ও কিছু সুপারী গাছ ছিল।
দিনের বেলাতেও ঘন গাছপালার জন্য বাগানের মধ্যে বিশেষ একটা রৌদ্র প্রবেশ করতে পারে না। বাগানের মধ্যে দিয়ে সরু একটা পায়ে-চলা-পথ সোজা পশ্চিম দিকে চলে গিয়েছে, যেখানে বাড়ির লোকদের ব্যবহারের জন্য গোটা-দুই দরমার বেড়া ঘেরা পাশাপাশি পায়খানা, তার ওদিকে একটা ছোট ডোবার মত।
চারপাশে ঘন বেত বন। গোটাকয়েক যজ্ঞিডুমুরের গাছ ও বেত গাছের গায়ে গায়ে লতিয়ে উঠেছে তেলাকুচা ফলের লতানো গাছ। সবুজ যেগুলো কাঁচা এবং লাল যেগুলো পাকা। তেলাকুচা ফল অজস্র ফলে থাকে সর্বদা। পাখিগুলো এসে পাকা ফলগুলো ঠুকরে ঠুকরে খায়। বর্ষার সময় ডোবাটা জলে উপচে ওঠে, তারপর ক্রমশ শুকোতে থাকে। শীতের শেষে ও গ্রীষ্মে ডোবাটায় সামান্যই জল থাকে। ওরই মধ্যে বিরাট একটা গোসাপ সাঁতরে বেড়ায়—ডুব দেয় ল্যাঠা, কই, মাগুর মাছের সন্ধানে।
পাখির দল এসে পাকা তেলাকুচা ফলের আশায় গাছের ডালে ডালে ভিড় করে। আনন্দচন্দ্র একটা বিরাট আমগাছের গুঁড়ির উপর বসেছিল। একসার লাল পিঁপড়ে সার বেঁধে গাছের গুঁড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠছে—সেই দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ ছোট বোন সুন্দরীর ডাকে যেন তার চমক ভাঙল।
দাদা!
কে? ও সুন্দর!
এখানে বসে কি করতিছেন দাদা? ওদিকে পিসীমা যে আপনাকে খুঁজতিছেন তখন থেকে সারাটা বাড়ি।
কেন? কি হয়েছে?
তা তো জানি না। আমাকে আর মেনীকে বললেন—দেখ্ তো, বড় খোকা কোথায়?
সুন্দরী কেবল নামেই নয়—সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী। রোগা পাতলা চেহারা। সবে এই এগারোয় পা দিয়েছে। আনন্দচন্দ্রের থেকে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট। বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, এই সময় হঠাৎ আনন্দচন্দ্রের বিয়ের ব্যাপারটা এসে যাওয়ায় সুন্দরীর বিয়ের কথাটা চাপা পড়ে গিয়েছে।
ভাল ঘর থেকে দুটি সম্বন্ধও এসেছিল—কিন্তু সুন্দরী রোগা বলে তারা শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছে।
সুন্দরী! আনন্দচন্দ্র ডাকল।
আজ্ঞে?
বাবা কোথায় রে?
বাবা তো একটু আগে লোহাগাড়ার থেকে কে একজন ডাকতি এয়েছিল— সেখানে রোগী দেখতে চলে গেলেন।
আমার বোধ হয় জ্বর আসবে রে সুন্দরী।
ওমা সে কি! জ্বর সত্যিই আসতিছে নাকি?
হ্যাঁ রে। কেমন যেন শীত-শীত করছে তখন থেকে।
কখন থেকে আপনার শীত-শীত করতিছে, আর আপনি এখানে বাগানের মধ্যি বসে! চলেন—সেই সকাল থেকেই—তা বাবাকে বললেন না কেন কথাড়া—
দূর, বাবাকে বলে কি হবে? বাবা খানিকটা পাঁচন গিলিয়ে দিতেন শুনলে হয়ত—
তা জ্বর হলি পাঁচন তো খাতিই হয়।
বিশ্রী তেতো। আনন্দচন্দ্র মুখটা বিকৃত করে।
সুন্দরী মিটি মিটি হাসে। তারপর আবার বললে—চলুন দাদা, পিসীমা ডাকতিছেন আপনারে।
তুই যা—আমি আসছি।
সুন্দরী চলে গেল।
ভাল লাগছে না। কিছুই ভাল লাগছিল না যেন আনন্দচন্দ্রের। পিসীমা ডাকছেন কেন, তাও বুঝতে যে পারছিল না আনন্দচন্দ্র তাও নয়। নিশ্চয়ই বাবা লোহাগাড়ায় রোগী দেখতে যাবার আগে ঠাকরুনদের বলে গিয়েছেন আনন্দচন্দ্র আজই দ্বিপ্রহরে যাত্রা করবেন। সেই ব্যাপারেই হয়ত ঠাকরুনরা ডাকছেন।
হঠাৎ একটা কথা মনে হয় আনন্দচন্দ্রের। বাবা পিসীদের কথা শোনেন—বিশেষ করে ছোট ঠাকরুন বিন্দুবাসিনীকে অত্যন্ত স্নেহ করেন বলে তাঁর কথা কখনও ফেলেন না।
বিন্দুবাসিনীও ভাইপো আনন্দচন্দ্রকেও অত্যন্ত ভালবাসেন। ভালবাসার একটা কারণও ছিল।
আনন্দচন্দ্রকে জন্ম দেবার পরই বামাসুন্দরী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কাজেই বামাসুন্দরী তাঁর নবজাত পুত্রের দেখাশোনা তেমন করতে পারতেন না। বিন্দুবাসিনী ই তখন স্বেচ্ছায় আনন্দচন্দ্রের দেখাশোনার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
আনন্দচন্দ্র যেবারে জন্মান, তার মাস ছয়েক আগে বিন্দুবাসিনী বিধবা হয়ে ভাইয়ের সংসারে ফিরে আসেন।
স্বামীর সঙ্গে বিন্দুবাসিনীর বয়সের অনেক তফাত ছিল। এক-আধ বৎসরের নয়, প্রায় পঞ্চাশ বৎসরের। ভারতচন্দ্রের আদৌ ইচ্ছা ছিল না, সর্বকনিষ্ঠা বোনটির তৃতীয় পক্ষে ওই ঘরে বিবাহ দেন। কিন্তু বেঁকে বসল বিন্দুবাসিনী।
সে বললে–আপনি ওইখানেই আমার বিয়ের ব্যবস্থা করুন দাদা।
ভাইয়ের অবস্থাও অজানা ছিল না বিন্দুবাসিনীর। অত বড় একটা সংসার যে কিভাবে তিনি কোনমতে টেনে নিয়ে চলেছেন, তাও তাঁর অজানা ছিল না। ভারতচন্দ্রের পিতা রামকান্ত তখন যেন সংসারে থেকেও নেই।
পর পর তিন কন্যার বৈধব্যে কেমন যেন তিনি হয়ে গিয়েছিলেন জবুথবু। ভারতচন্দ্রই তখন প্রকৃতপক্ষে সংসারের দেখাশোনা করছেন। জ্যোতিষী বা কবিরাজী কোনটাই আর করেন না তখন রামকান্ত। তিন মেয়ের বিবাহ দিতে গিয়ে কিছু ধার-কর্জ ও হয়ে গিয়েছিল। ভারতচন্দ্র যেন সংসার নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন।
সেনহাটি থেকে যিনি সম্বন্ধটা এনেছিলেন, ইতনা গ্রামেরই বাঁড়ুজ্যেপাড়ার লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুজ্যেমশাই, তিনি রামকান্তকে বলেছিলেন—আগে কোষ্ঠীবিচার করে— দেখেশুনে তো তিন মেয়ের বিবাহ দিয়েছিলেন রামকান্ত ভায়া, কিন্তু কি হল? বুঝলে ভায়া, ওসব কিছু না। ভাগ্যং ফলতি সর্বত্র—ভাগ্যে থাকলে লোহার বাসরেও সর্পদংশনে মৃত্যু ঘটে।
আমি কিছু জানি না লক্ষ্মীকান্তদা, তুমি ভারতকে জিজ্ঞাসা কর।
ভারতচন্দ্র ওই সময় পিতার পাশেই বসে একজন রোগীর ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছিলেন। বললেন—না জ্যাঠামশাই, ওখানে বিয়ে দেব না-
ক্যান্ দেবা না, ক্যান্?
প্রায় পঞ্চাশ বছরের বড়-
তাতে হলোডা কি! পুরুষমানুষের আবার বয়স কি? কিশোরী উমা বৃদ্ধ শিবের গলায় মালা দেননি? শোন ভারত, অমত করো না। হ্যাঁ, সেন মশাইয়ের বয়েস হয়েছে ঠিকই, কিন্তু চেহারা দেখলি বুঝবার উপায় নেই তিনি ষাট উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখনো চেহারা জোয়ান—গাঁট্টা-গোট্টা—
তা হোক, বয়সটা তো তাতে কারো কমে যাবে না কিছু জ্যাঠা—
যাবে না ঠিকই, তবে ওর কপালে থাকলি শতায়ু হবেন সেনমশাই। দীর্ঘজীবীর বংশ ওরা, ধনে-জনে পরিপূর্ণ সংসার। তেজারতী কারবার করে বহু অর্থ সোনাদানা সঞ্চয় করেছেন। তাছাড়া বলেছেন—বিবাহ হলি তার স্ত্রীকে সমস্ত কিছুর এক ভাগ তো দেবেনই, অলংকারে মাথা থেকে পা পর্যন্ত মুড়িয়ে দেবেন। একটু থেমে বলতে লাগলেন—আরও একটা কথা ভেবে দেখ, তোমার অন্যান্য বোনেদের মত বিন্দুর চেহারাটা বা রঙটা তেমন ফরসা নয়। কালোই বলতি পার।
ভারতচন্দ্র তথাপি সম্মত হন না। বলেন—না। বিন্দুর বিবাহ ওখানে হতি পারে না।
লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুজ্যে তখন বললেন—সেনমশাই আরো একটা কথা বলেছেন, রামকান্ত ভায়ার যা ধার দেনা আছে, সব তিনি শোধ করে দেবেন।
ভারতচন্দ্র মাথা নাড়েন। অর্থাৎ তবু তিনি সম্মত নন। ভারতচন্দ্র জানতেন না, ওঁদের সমস্ত কথাবার্তা আড়াল থেকে বিন্দুবাসিনী শুনছিল।
বিন্দুবাসিনী যে তার বাপ ও ভাইকে দায়মুক্ত করবার জন্যই অগ্রজকে ওইখানেই বিবাহে সম্মতি দিতে বলেছিল, সেটা কি আর ভারতচন্দ্র বুঝতে পারেননি।
পেরেছিলেন, কিন্তু তবু সম্মত হতে পারেননি। কিন্তু বিন্দুবাসিনী যেন নাছোড়বান্দা।
ওইখানেই তার বিবাহ দেওয়া হোক জানিয়ে অগ্রজকে ঘন ঘন তাগিদ দিতে লাগলেন।
না, তা হয় না বিন্দু—
কেন হয় না?
ওই বুড়ো—ঘাটের মড়া—তেজপক্ষ—
কপালে আমার যদি সুখ থাকে, স্বামীর ঘর করা থাকে, ওইখানেই সব হবে।
কিন্তু জেনেশুনে—
দিদিদেরও বাবা অনেক দেখেশুনে; অনেক বিচার করে বিবাহ দিয়েছিলেন, কিন্তু কি হল! তাদের দুর্ভাগ্যকে কি ঠেকাতে পেরেছেন আপনারা? কপালে যদি আমার অকাল-বৈধব্য থাকেই—কেউ তা রোধ করতি পারবা না।
অবশেষে ভারতচন্দ্রকে সম্মত হতে হয়েছিল।
ষাট বছরের এক বৃদ্ধের সঙ্গে মাত্র বারো বৎসরের আদরিণী বোন বিন্দুবাসিনীর বিবাহ হয়ে গেল।
সত্যি, সেনমশাইকে অত বয়স হলেও বুড়ো দেখাতো না।
লম্বা-চওড়া গাঁট্টা-গোট্টা শরীর। চুলে তখনো পাকই ধরেনি বলতে গেলে। টকটকে গৌরবর্ণ।
বিবাহের সময় সকলে বলতে লাগল সব ভুলে গিয়ে—হর-গৌরীর মিলন হল। কিন্তু দুটি বৎসর মাত্র স্বামীর ঘর করে বিন্দুবাসিনী সিঁথির সিন্দুর মুছে হাতের নোয়া খুলে পিতৃগৃহে ফিরে এলেন, সেদিন আদরের বোনটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভারতচন্দ্রের সে কি কান্না হাউমাউ করে!
আর রামকান্ত বাইরের ঘরে গুম মেরে বসে রইলেন।
বিন্দুবাসিনীও যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল। কারো সঙ্গে কথা বলত না, ঘর থেকে বেরুত না। এবং ওইভাবেই চলছিল। ভারতচন্দ্র সর্বক্ষণ ছোট বোনটির কথা ভাবতেন। কিন্তু সান্ত্বনার কোন ভাষা যেন খুঁজে পেতেন না।
আনন্দচন্দ্রের জন্মের পর বামাসুন্দরী যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, পাশে শুয়ে ছেলেটা চেঁচিয়ে কাঁদে। বামাসুন্দরী হাত বাড়িয়েও ছেলেটাকে নিতে পারেন না কাছে টেনে। তখন হঠাৎ একদিন কান্না যখন আর আনন্দচন্দ্রের থামে না, বিন্দুবাসিনী এসে ঘরে ঢুকল!
হাত বাড়িয়ে আনন্দচন্দ্রকে বুকে তুলে নিল।
আশ্চর্য! ছেলেটাও সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল। বিন্দুবাসিনী আনন্দচন্দ্রের সব ভার নিল।
সেই থেকে আনন্দচন্দ্র তার কাছেই মানুষ।
আনন্দচন্দ্রেরও যত আবদার ওই পিসিমণির কাছেই।
অন্দরে যেতে যেতে ওই ছোট পিসির সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল আনন্দচন্দ্রের। ডাকলো—পিসিমণি?
—কি রে, মুখটা অমন শুকনো কেন রে? সকালে কিছু খাসনি?
—না।