মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ৬

।। ছয় ।।

নশে অর্থাৎ আনন্দচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র—দক্ষিণারঞ্জন

অন্নদাসুন্দরীর বড় মেয়ে অর্থাৎ কুসুম, তখন তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুটি কন্যা-সন্তানকে নিয়ে কুসুম কিছুদিনের জন্য পিতৃগৃহে এসেছিল।

সে পাকা গিন্নীর মত বাপের কথার উপরেই কথা বলে উঠল—পাস করবে কি করে বলুন বাবা! অত বৌয়ের আঁচল ধরা হলে লেখাপড়া হয়, না মন বসে লেখাপড়ায়? প্রত্যেক ছুটিছাটায় দেশে আসা চাই—আর যাবার নাম করে না!

পাকামি আর গিন্নীপনায় কুসুম ঠাকরুন বরাবরই একটু যেন মাত্রাতিরিক্ত ছিল। নচেৎ তার বোঝা উচিত ছিল, যে দাদা সম্পর্কে সে ওই ধরনের মন্তব্য অনায়াসেই করল, সে দাদা তার থেকে চার বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ অর্থাৎ কুসুমের বয়স তখন আঠারো কি উনিশ।

মেজো ছেলে মনোরঞ্জন—সেও তখন কলকাতায় ডাক্তারী স্কুলে পড়ে। গতকালই সে দেশে এসেছে কয়েকদিনের ছুটিতে, আর সে-ই এনেছে সংবাদটা। কাল বলেনি বাপকে, আজ বিকেলে দিয়েছে সংবাদটা।

মনোরঞ্জন ওইসময় ওইখান দিয়েই যাচ্ছিল। সে তার বড় বোনের কথায় আর চুপ করে থাকতে পারে না, বলে ওঠে—ফাজিল!’ কথা কস্ নে বড়দি।

—তুই থাম মোনা! কুসুম ঝংকার দিয়ে ওঠে—বড়দার কিছু হবে না, এই আমি বলে রাখলাম।

আনন্দচন্দ্র কিন্তু আর তখন সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। গৃহিণীকে সংবাদটা দিয়েই গলায় স্টেথোটা ঝুলিয়ে রোগী দেখতে বের হয়ে গিয়েছে।

নয় বৎসর বয়েসের সময়েই কুসুম ঠাকরুনের বিবাহ হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের লোকেদের বিচারে কুসুমের বিবাহ হয়েছিল যেন রাজার ঘরেই।

কুসুমের স্বামী দারোগাগিরি করতেন। নিঃসন্তান প্রথমা স্ত্রী বিয়োগের পর সেনমশাই অর্থাৎ নিবারণচন্দ্র সেনমশাই বিয়াল্লিশ বৎসর বয়সে দ্বিতীয়বার নয় বৎসরের বালিকা কুসুমের পাণিগ্রহণ করেছিলেন।

তখনকার দিনে দারোগাদের উপার্জনের যেমন আদিঅন্ত ছিল না, তেমনি তারাই ছিল প্রকৃতপক্ষে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আইনের জোরে তারা অকথ্য জুলুম করতেন। গরিব দুঃস্থ বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর গৃহে পদার্পণ করে কুসুম যেন হকচকিয়ে গিয়েছিল। স্বামীর অঢেল টাকা। থানায় যতক্ষণ থাকেন থাকেন, বাকী সময়টা ঘোড়ায় চড়ে তদন্ত করে বেড়ান। দাস, দাসী, সেপাই—সর্বক্ষণ যেন থানা রমরম করছে। তারই মধ্যে দারোগা সাহেবের গর্জন—হুংকার।

যখনই ঘরে আসেন, পকেট থেকে মুঠো মুঠো টাকা বের করেন। বালিকা বধূর সামনে এসে মুঠো-ভরা টাকা তার হাতে তুলে দেন—নাও সোনা-বৌ, তুলে রাখ সিন্দুকে টাকা।

শাঁখা-সিঁদুর দিয়ে মাত্র আনন্দচন্দ্র কন্যাদায় হতে উদ্ধার পেয়েছিলেন, কিন্তু বৎসর তিনেক বাদে প্রথম যেদিন সে একটি কন্যা-সন্তান কোলে নিয়ে পিতৃগৃহে এল—তার গা- ভরতি গহনা। সোনায়দানায় একেবারে যেন ঝলমল করছে। চলনে বলনে কথাবার্তায় সে কুমুম আর নেই। দেমাক যেন মাটিতেই পা পড়ে না।

কিন্তু সে তো আরো অনেক পরের কথা।

আনন্দচন্দ্র ও অন্নদাসুন্দরীর ফুলশয্যার রাতই তো তখনো পোহায়নি।

আনন্দচন্দ্র হঠাৎ বলে, তবে থাক আলো, জ্বলুক আলো। বলতে বলতে সহসা

দু-হাত বাড়িয়ে বালিকা বধূকে বুকের উপর টেনে নেয়।

ঘটনার আকস্মিকতা ও অভাবনীয়তায় অন্নদাসুন্দরী হঠাৎ কেঁদে ফেলে এবং নিজেকে স্বামীর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করবার জন্য বলে ওঠে—–এ–এ কি করছেন? ছিঃ ছিঃ ছাড়ুন ছাড়ুন।

—না, ছাড়বো না। আনন্দচন্দ্র বলে। আরো জোরে বালিকা বধূকে বুকের মধ্যে সাপটে ধরে।

বাইরে অন্ধকারে কোথায় যেন কোন্ গাছ থেকে বাগানের কোন পাখী বিশ্ৰী সুরে ডেকে ওঠে, তারপরই বিচিত্র একটা ডাক। অন্নদার সম্পূর্ণ অপরিচিত সে ডাক, সে শব্দ।

অন্নদা কান্না ভুলে গিয়ে সভয়ে ভেজা চোখেই আনন্দচন্দ্রকে দুহাতে জাপটে ধরে বলে ওঠে—ও মাগো, ও কি ডাকচে!

—বাঘ। গম্ভীর হয়ে আনন্দচন্দ্র বলে।

—বাঘ!

—হ্যাঁ, বাঘ। কেন, তোর বলে ভয়ডর কিছু নেই।

—আপনাদের গাঁয়ে বাঘ আছে?

—আছেই তো। শীতের সময় ওপারের বন থেকে বের হয়ে গাঙ্ সাঁতরে গাঁয়ে এসে ঢোকে।

—তা বাঘটা কোথায়? ভয়ে ভয়ে শুধায় অন্নদাসুন্দরী।

—এই ঘরেরই আশে পাশে ঝোপেঝাড়ে কোথায়ও হয়ত আছে।

—ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে যদি?

আনন্দচন্দ্র বালিকা বধূর কথায় কৌতুক বোধ করে। বলে—কেমন করে ঢুকবে, দরজা তো ঘরের বন্ধ!

—কেন, ওই জানালাটা তো খোলা আছে। জানালাটা বন্ধ করে দিন না।

—জানালা দিয়ে বুঝি বাঘ আসতে পারে? না, এ সে বাঘ নয়। সুন্দরবনের সেই বড় রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়—

—তবে?

—ঠিক বাঘ তো নয় তবে ওই জাতীয়ই একটা জন্তু। সবাই বলে খটাস।

—খটাস!

—হ্যাঁ। এদেরও গায়ে ছোপ ছোপ দাগ আছে হলদের উপরে। বড় শিয়াল দেখেছিস তো?

—হ্যাঁ।

—অনেকটা সেই আকারের। মানুষকে ওরা বড় একটা আক্রমণ করে না। হাঁস, মুরগী, ছাগলটাগল ধরেটরে খায়।

—আ—আপনি—

—কি?

—আপনি ওই যে কি বললেন, খটাস না কি—দেখেছেন কখনো?

—হ্যাঁ, গত বছর শীতের সময় একটা এসেছিল গাঁয়ে। বাঁড়ুয্যে জ্যাঠার দো-নালা বন্দুক আছে, সেই বন্দুক দিয়ে মেরেছিল খটাসটাকে।

—আপনার বাঁড়ুয্যে জ্যাঠার তো খুব সাহস।

—হ্যাঁ, নামকরা শিকারী। অনেক শিকার করেছে।

—কোথায় তিনি থাকেন?

—কেন, বাঁড়ুয্যে পাড়ায়!

হঠাৎ অন্নদার আবার ওই সময় খেয়াল হয়, তখনো সে স্বামীর আলিঙ্গন-বদ্ধ। সে আবার বলে ওঠে—ছাড়ুন, আমার লাগছে।

রঞ্জনের বাবা আনন্দচন্দ্রের তৃতীয় পুত্র (গণ্ডে যার ডাকনাম ও ভালনাম সত্যরঞ্জন) সে তার বাপের মুখে শুনেছে, তার বাবার মা অর্থাৎ পিতামহী ছিল যেন নরম-সরম ঠিক মাখন দিয়ে গড়া ছোটখাটো একটি পুতুল-প্রতিমার মত। রঞ্জন দেখেনি তার পিতামহীকে কিন্তু বাপের মুখে তার মাতৃরূপের বর্ণনা শুনে শুনে তার মনের মধ্যে যেন একটা ছবি চিরদিনের মত আঁকা হয়ে গিয়েছিল, সেই বালিকাটির—যে নয় বৎসর উত্তীর্ণ হয়ে সবে একগলা ঘোমটা দিয়ে গাঁটছড়া বাঁধা তার পিতামহের পিছনে পিছনে নিকানো চিত্ৰিত আঙ্গিনার উপরে দুধে-আলতার পায়ের ছাপ ফেলে ফেলে একদা তাদের গৃহে এসে প্রবেশ করেছিল। কোন এক অতীত কালের শীতের এক ম্লান সন্ধ্যায়

অন্নদাসুন্দরীর তার প্রতি বিরাগ দেখে আনন্দচন্দ্র বলে—আয় না কাছে একটু বৌ, অমন করিস কেন? আর তো মাত্র দুটো দিন। তারপরই তো কলকাতায় কত দূরে চলে যাব—আবার কবে আসব, আবার কবে দেখা হবে

—কেন? কলকাতায় যাবেন কেন?

—বাঃ, সেখানে আমি লেখাপড়া করি না! হিন্দু কলেজে পড়ি। আরও এক বছর বাকী আছে সেখানকার পড়া শেষ করবার

—তারপর বুঝি চাকরি করবেন?

—চাকরি! না।

—আমার বাবা লক্ষ্ণৌতে। জানেন লক্ষ্ণৌ কোথায়? অনেক—অনেক দূরে, চার দিনের পথ। সেখানে নবাব সরকারে চাকরি করেন।

—কিন্তু কই, বিয়ের সময়ও তোর বাবাকে দেখলাম না!

—দেখবেন কি করে? বাবা কি আসতে পেরেছেন? অত দূরের পথ, আসব বললেই অমনি হল। আপনি—আচ্ছা আপনি রেলগাড়ি দেখেছেন?

—কেন দেখব না!

—দেখেছেন, সত্যি?

—হ্যাঁ, চড়েছিও তো। যশোর পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে তো রেলগাড়িতে চেপেই কলকাতা যেতে হয়।

আনন্দচন্দ্রের যখন বিবাহ হয়, রেলগাড়ি মাত্র তার কিছুদিন আগেই যশোর পর্যন্ত এসেছে। তাও সিঙ্গল লাইন, খুলনা শহর পর্যন্তও আসেনি এবং পাশাপাশি ডবল লাইনও হয়নি। গাঁয়ের মানুষদের তখনো রেলে চাপার একটা ভীতি রীতিমত শঙ্কিত করে রেখেছে। তারা রেলে চাপতে ভয় পেত।

—আচ্ছা রেলের গাড়ি মানে তো একটা কাঠের বাক্স, তাই না?

স্ত্রীর—বালিকা স্ত্রীর অজ্ঞতায় ও সারল্যে আনন্দচন্দ্র বেশ একটু মজাই পায়, ব্যাপারটা উপভোগও করে। বলে—কাঠের বাক্স কি রে, সে তো রেলের কামরা। অবিশ্যি কাঠ দিয়ে তৈরি, বসবার বেঞ্চ আছে, ছোট ছোট জানালা আছে শিক দেওয়া, তলায় চাকা বসানো। সেই চাকা মাটির উপর পাতা দুটো লোহার লাইনের উপর দিয়ে গড়গড়িয়ে চলে।

—কেউ ঠেলে দেয় বুঝি?

—দূর বোকা, ঠেলবে কে! ইঞ্জিন টানে। ভোঁস ভোঁস–ভোঁস ভোঁস, কু–সিটি বাজে।

—আমাকে—বলতে বলতে অন্নদাসুন্দরী স্বামীর গা ঘেঁষে বসে ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে, আমাকে দেখাবেন রেলের গাড়ি?

—দেখাব। আনন্দচন্দ্র যেন সহসা অত্যন্ত উদার হয়ে ওঠে। দু’হাতে ভক্তকে বর দান করার মত বদান্যতায় অন্য এক মানুষে পরিণত হয়। বলে, দেখাব, চড়াবও একদিন।

—সত্যি-সত্যি চড়াবেন!

— হুঁ

—কবে? কবে চড়াবেন?

আনন্দচন্দ্র বালিকা বধূকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে ওঠে—চড়াব একদিন। কলকাতা শহর দেখিয়ে আনব।

—কলকাতা শহর! সে কত দূর গো?

—সে অনেক দূর।

—সত্যি আপনি আমাকে রেলের গাড়িতে চড়াবেন!

—হ্যাঁ, চড়াব।

কিন্তু অন্নদাসুন্দরীর সেই স্বপ্নের রেলগাড়িতে চড়া জীবনে ঘটে ওঠেনি। নয় বৎসরের বালিকা বধূটি সেই যে সেদিন ভারতচন্দ্রের গৃহে প্রবেশ করেছিল, তারপর তার জীবনের দীর্ঘ ছত্রিশটা বৎসর ওই গাঁয়েই কেটে গিয়েছে।

সংসারচক্রে নিষ্পেষিত হতে হয়েছে। আনন্দচন্দ্রের দারিদ্র্য আর অভাবের সংসারে তার গতায়াতের পরিধি ছিল রন্ধনশালা, হবিষ্যি-ঘর, ঢেঁকিশালা আর প্রথম দক্ষিণের পোতার ঘরে ও পরে সেজ ঠাকরুনের মৃত্যুর পর তার পশ্চিমের পোতার ছোট্ট ঘরটির মধ্যে।

যদিও পরবর্তীকালে তার বড় ছেলে দক্ষিণারঞ্জন জাহাজে চেপে কোন্ সুদূর মালয় দেশে ডাক্তারী করতে গিয়েছিল এবং নাতিনাতনীরা বহু দূরদূরান্তে, দেশে-বিদেশে— বিলাতে আমেরিকায় জাহাজে চেপে ও জেট-বিমানে চেপে কতবার যাতায়াত করেছে।

রাত বোধ হয় শেষ হয়ে এসেছিল বাইরে।

কোথায় একটা কোকিল ডেকে ওঠে—কুকু কুহু কুহু

সেই সঙ্গে ঘুম-ভাঙা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায়। অন্নদাসুন্দরী বলে—রাত পুইয়ে এল।

অন্নদাসুন্দরীর কথা শেষ হল না, বাইরের দরজার শিকল খোলার শব্দ শোনা গেল।

আনন্দচন্দ্র এক লাফে পালঙ্ক থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজার হুড়কো খুলে দেয়। অন্নদাসুন্দরী কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। কেবল মাথার ঘোমটাটা বুক পর্যন্ত টেনে দিয়ে জবুথবু হয়ে পালঙ্কের উপরে বসে থাকে।

সেজ ঠাকরুণ এসে ঘরে ঢোকেন—বৌ!