মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ৫

।। পাঁচ ।।

সেই মেজ ঠাকরুনকে সহসা ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেখে সকলেই কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে চুপ করে যায়। সকলে কেমন যেন বিভ্রান্ত বোধ করে। অমন যে মুখরা সরোজিনী, সেও যেন বোবা হয়ে গিয়েছে।

ছোট ঠাকরুন সবে তখন অন্নদাসুন্দরীর মুখের ঘোমটাটা তুলে বামাসুন্দরীকে বলছিল, এই দেখ বৌ, কেমন লক্ষ্মী-প্রতিমার মত তোর ছেলের বৌ এনেছে দাদা। হ্যাঁ, পছন্দ আছে বটে দাদার।

আরো কিছু হয়ত বলতে যাচ্ছিল বিন্দুবাসিনী, কিন্তু বলা হল না, নিভাননীর গলার সাড়া পেয়ে হঠাৎ থমকে থেমে গেল।

কেমন বৌ হল দেখি! চারিদিকের ছোঁয়াছুঁয়ি সন্তর্পণে বাঁচিয়ে লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে নিভাননী এগিয়ে এল। বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখেই তাকালে অন্নদাসুন্দরীর দিকে। তারপর নিভাননী ছোট বোন বিন্দুবাসিনীকেই সম্বোধন করে বললেন—বিনি, আমার প্যাটরার মধ্যে দেখ একটা পুঁটলিতে কটা গহনা বাঁধা আছে, এই নে চাবি

কোমর থেকে চাবিটা ছুঁড়ে দিলেন নিভাননী বিন্দুবাসিনীর দিকে। বললেন– প্যাটরাটা খুলে দেখ ওর মধ্যে এক জোড়া সোনার ভারী কঙ্কণ আছে বোধ হয় এখনো, যা সেটা নিয়ে আয় বের করে। বাপ মিনসে তো দেখতে পাচ্ছি শুধু হাতেই ন্যাংটো করে মেয়েকে বিদায় দিয়েছে।

বিন্দুবাসিনী বললে—বিয়ে দিয়েছে তো ওর ঠাকুর্দা আর ঠাকুরমা। বাপ তো কোথায় লক্ষ্ণৌতে চাকরি করে। তা ছাড়া সেনমশাইয়ের অবস্থাও তো তেমন ভাল নয়, দেবে কোথা থেকে? দাদাও তাই—

ন্যাংটো মেয়ে ধরে এনেছেন বৌ করে, ঢাক ঢোল সানাই বাজিয়ে! ঘরে কারো মুখে দু’বেলা পেট পুরে অন্ন জোটে না, তার উপর আবার একজনকে এনে ঢোকালেন। কবিরত্ন যে কবরেজী করে কত পান, তা তো আর জানতে বাকী নেই। নিজের বিয়ে করা ইস্তিরীকে বছরে এক জোড়া শাড়িও কিনে দেবার ক্ষ্যামতা নেই। যাক গে, মরুক গে। শোন, ওই প্যাটরার মধ্যেই একটা রেশমী কাপড়ের টুকরোয় বাঁধা টাকা আছে। শ’দুই টাকা বের করে দিয়ে আয় গে দাদাকে। যজ্ঞিবাড়ির খরচা। শরম হায়া তো নেই, হয়ত গ্রামের মধ্যে এর তার কাছে কালই হাত পাততে বেরুবে।

বিন্দুবাসিনী মেজদির কথার কোন জবাব দেয় না। ঘরের কোণে একটা কাঁঠাল- কাঠের বেঞ্চের উপর এক রাশ কাঁথা, বালিশ, তোশকের নীচে মেজ ঠাকরুনের প্যাটরাটা ছিল। সেটা চাবি দিয়ে খুলে মেজদির কথামত কঙ্কণ ও টাকা বের করে নিয়ে এল।

—এই নাও।

—ছুঁস না, ছুঁস না আমায়—নিভাননী দু’পা যেন সভয়ে পিছিয়ে যান। বলেন, প্যাটরাটা ভাল করে চাবি লাগিয়েছিস তো?

—হ্যাঁ। বিন্দুবাসিনী বলে।

—চাবিটা মাটিতে রাখ্।

বিন্দুবাসিনী মেজদির কথামত কাজ করলে।

হাতের ঘটি থেকে কিছু গঙ্গাজল চারিটার উপরে ছিটিয়ে দিয়ে চাবি বোধ করি স্পর্শদোষ থেকে পরিশুদ্ধ করে নিলেন মেজ ঠাকরুন, তারপর সেটা আবার কোমরে গুঁজে বললেন—কঙ্কণ দুটো পরিয়ে দে বৌয়ের হাতে। এই ছুঁড়ি, হাত বাড়া না!

ভয়ে এতক্ষণ যেন কাঠ হয়ে ছিল অন্নদাসুন্দরী। মাথার অবগুণ্ঠন তেমনি তোলাই। ফ্যালফ্যাল করে সে চেয়েছিল মেজ ঠাকরুনের মুখের দিকে। ভয়ে ভয়ে এবার তার সুডৌল গৌরবর্ণ হাত দুটি সামনে তুলে ধরল।

বিন্দুবাসিনী কঙ্কণ দুটো সেই হাত দুটিতে পরিয়ে দিল। বড় ছাঁদের ভারী কঙ্কণ নয়-দশ বৎসরের বালিকার হাতে হবে কেন? ঢলঢল করতে থাকে!

হঠাৎ মেজ ঠাকরুন বলে ওঠে—আহা রে, মরি মরি! ওই হাত না হলে সোনার গহনা মানায়? দেখ দিদি, দেখ সেজ, দেখ ছোট, কি সুন্দর মানিয়েছে! চোখ যেন জুড়িয়ে গেল রে।

এ যেন সবাকার পরিচিত নিভাননী নয়, এ যেন আর কেউ কথা বলছে। এ যেন আর কারো কণ্ঠস্বর—কোমল স্নেহসিক্ত মৃদু অশ্রুসজল।

কথাগুলো বলে মুহূর্তকাল স্তব্ধ হয়ে থেকে মেজ ঠাকরুন হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। সোজা এসে পশ্চিমের পোতার ছোট্ট ঘরটার মধ্যে ঢুকলেন। ঘরের মধ্যে অন্ধকার, তখনো প্রদীপ জ্বালানো হয়নি। বাইরের বাগানে অন্ধকারের ভেতর থেকে ঝিঁঝির একটানা সুর ভেসে আসছে।

ঘরের খোলা জানালাটার সামনে এসে দাঁড়ালেন নিভাননী। তাঁর সমস্ত চেতনাকে মথিত করে অনেক বৎসর আগেকার একটি দৃশ্য—একটি রাত্রির দৃশ্য তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বুঝি।

দশ বৎসরের বালিকা হয়ে ঠিক ওই বয়সেই নিভাননীর বিবাহ হয়েছিল মোড়ল- গঞ্জের জমিদার রায়চৌধুরীদের গৃহে। পাত্র স্বয়ং প্রৌঢ় জমিদার পতিতপাবন রায়চৌধুরী। প্রথমা স্ত্রী স্নেহলতার মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল আর বিবাহ করেননি। দুই ছেলে এক মেয়ে—সবারই বিবাহ হয়ে গিয়েছে। ঘরে গোটা তিনেক নাতনী ও দুটি নাতি। ইতনা গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়ি বিবাহের নিমন্ত্রণে এসে বালিকা নিভাননীকে দেখে চুয়ান্ন বৎসরের পতিতপাবনের মাথাটা যেন ঘুরে গেল।

হ্যাঁ, সত্যিই রূপ ছিল নিভাননীর। সাক্ষাৎ যেন জগদ্ধাত্রী। তার উপর গড়নও ছিল একটু বাড়বাড়ন্ত। নিভাননীকে দেখা অবধি সারাটা রাত ঘুমোতে পারলেন না প্রৌঢ় পতিতপাবন। পরের দিন খোঁজখবর নিয়ে গৃহে ফিরে গেলেন এবং দিন-তিনেক বাদে ঘটক এল বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে রামকান্তর কাছে।

দরিদ্র রামকান্ত হাতে যেন স্বর্গ পেলেন। স্ত্রী চন্দ্রভামিনীকে কথাটা বললেন তখুনি গৃহাভ্যন্তরে গিয়ে।

চন্দ্রভামিনী বলেছিলেন—অত বয়স—

প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন রামকান্তপুরুষের আবার বয়স কি? কত বড় জমিদার, কত টাকাকড়ি! বরাতে যদি থাকে, দেখো মেয়ে তোমার শাঁখা-সিন্দূর নিয়েই স্বামীর আগে ড্যাংড্যাং করে চলে যাবে। সোনাদানায় একেবারে মুড়ে দেবে।

চন্দ্রভামিনী আর আপত্তি করেন নি।

বিবাহ হয়ে গেল।

তা মিথ্যা নয়—সোনাদানায় সত্যিই মুড়ে দিয়েছিলেন পতিতপাবন রায়চৌধুরী নবপরিণীতা বালিকা বধূর সর্বাঙ্গ।

বিরাট বাড়ি—বিরাট অবস্থা। লক্ষ্মীর আশীর্বাদে স্বাচ্ছল্য যেন উপচে পড়ছে। বিবাহের পর প্রায় এগারো বৎসর বেঁচে ছিলেন চৌধুরীমশাই। একুশ বৎসর বয়সের সময় পূর্ণযুবতী যখন নিভাননী, সারা দেহে রূপ আর যৌবন উথলে পড়ছে বর্ষার বন্যার মত, চৌধুরীমশাই হঠাৎ সন্ন্যাসরোগে দু’ঘণ্টার মধ্যে মারা গেলেন।

আর নিভাননী দশ বৎসরের বালিকা এক প্রৌঢ়ের ঘরণী হয়ে এসে এগারো বৎসরে কখন যে কেমন ভাবে একটু একটু করে ওই প্রৌঢ় মানুষটিকে ভালবেসে ফেলেছিল নিজেও তা জানতে পারেনি। উভয়ের মধ্যে বয়সের পার্থক্যটা যেন এতটুকু আঁচড়ও কাটতে পারেনি নিভাননীর বালিকা মনের মধ্যে। ছোট্ট একটি পুতুল নিয়ে যেমন মানুষ খেলা করে, আদর করে, চৌধুরীমশাই তাঁর বালিকা স্ত্রীকে তেমনিই করতেন।

ফুলশয্যার রাত্রে গা-ভর্তি অলংকার দিয়ে আগেই সাজানো হয়েছিল নিভাননীকে। পালঙ্কের উপর ঘোমটা টেনে বসে ছিল নিভাননী। অনেক রাত্রে চৌধুরীমশাই এসে ঘরে ঢুকলেন। কুণ্ঠিত পায়ে যেন চোরের মত—অপরাধীর মত। ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ এক বালিকাকে ওই বয়সে পুনরায় বিবাহ করে ফেলে ভিতরে ভিতরে চৌধুরীমশাই যেন একটা অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিলেন।

এ কি করলেন তিনি—এ কি করলেন!

ঘরের মধ্যে ঢুকে বালিকা বধূর মাথার উপর থেকে অবগুণ্ঠনটা তুলে দিলেন। নিভাননীর দুটি চক্ষুই মুদ্রিত।

—চোখ খোল। চাও। চৌধুরীমশাই বললেন।

নিভাননী কিছুতেই চোখ খোলে না। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর নিভাননী তাকিয়েছিল স্বামীর মুখের দিকে। সৌম্য শান্ত চেহারা। কেশে বেশ পাক ধরেছে, কিন্তু অত বয়স হলেও দেহের বাঁধুনী তখনো অটুট ছিল চৌধুরী মশাইয়ের। দেখলে মনেই হত না তাঁর বয়েস চুয়ান্ন হয়েছে।

মৃদু মৃদু হাসছিলেন যেন ঠিক এক কৌতুকে চৌধুরীমশাই। হঠাৎ বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল নিভাননীর—উমাও বুড়ো শিবের গলায় মালা দিয়েছিলেন মা।

—হ্যাঁ, আর বরও তো বুড়ো। কিন্তু তেমন তো কিছু মনে হচ্ছে না।

—তোমাকে বিয়ে করেছি বলে খুব দুঃখ পেয়েছো না; বৌ! না না, তোমাকে বৌ নয়, বলবো রাঙা-বৌ, কেমন?

নিভাননী নিরুত্তর।

তারপরই ঘরের কোণে সিন্দুক খুলে ওই কঙ্কণ জোড়া এনে নিভাননীর হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন চৌধুরীমশাই—পার্বতীর—আমার প্রথমা স্ত্রীর খুব প্রিয় ছিল এই কঙ্কণ জোড়া। তার কোন গহনাই তোমাকে আমি দিইনি। সব তোমাকে নতুন করে গড়িয়ে দিয়েছি সনাতন স্বর্ণকারকে দিয়ে। কিন্তু কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম, তোমার দিদি এসে যেন সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, আমার কঙ্কণ জোড়া নতুন বৌকে দিও।

ঢলঢল করছিল নিভাননীর হাতে কঙ্কণ জোড়া।

চৌধুরীমশাই বলেন—এটা তুমি কখনো হাত থেকে খুলো না রাঙা-বৌ, কেমন?

নিভাননী ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল।

খোলেনি নিভাননী, সর্বদা পরেছে। চৌধুরীমশাইয়ের মৃত্যুর পর সব যখন সহসা কেমন ফাঁকা শূন্য হয়ে গেল তার চারিদিকে, একটা বেদনার হাহাকারে যখন বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল, কঙ্কণ জোড়া নিজেই হাত থেকে খুলে ফেলেছিল। শুধু তাই নয়, সৎ ছেলেরা তাকে মায়ের মতই ভালবাসত, ভক্তিশ্রদ্ধা করত। তারা অনেক অনুরোধ করেছিল নিভাননীকে চৌধুরী বাড়িতেই থাকবার জন্য। কিন্তু নিভাননী চৌধুরীমশাই-শূন্য চৌধুরী বাড়িতে থাকতে পারেনি। শ্রাদ্ধশান্তি ঢুকে যাবার দিন দুই পরেই বড় ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন তাকে পিতৃগৃহে পৌঁছে দেবার জন্য। পিতৃগৃহে নিভাননী এল বটে কিন্তু মনের শূন্যতা হাহাকার গেল না। পাগলের মতই যেন কটা মাস কেবল ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে রইল, তারপর শ্বশুরকুলের কুলগুরুকে ডেকে মন্ত্র নিল।

গুরু মন্ত্র দিয়ে দীক্ষা দিয়ে চলে গেলেন। সেই যে শিবপূজা নিয়ে পড়লেন নিভাননী

হুক্কা হুয়া—হুক্কা হুয়া—একদল শৃগাল ডেকে উঠল। চমকে উঠলেন নিভাননী।

আর সেই রাত্রে—

আনন্দচন্দ্রের ফুলশয্যা।

দক্ষিণের পোতার ঘরে ফুলশয্যার ব্যবস্থা হয়েছিল। আনন্দচন্দ্র শয্যায় শুয়ে অপেক্ষা করছিল, বৌ এখনো ঘরে আসেনি।

বোধ হয় একটু তন্দ্রামত এসেছিল। বড় বোন চঞ্চলার কণ্ঠস্বরে তন্দ্রাটা ছুটে গেল আনন্দচন্দ্রের। কিন্তু সে যে জেগে গিয়েছে, সেটা বড় বোন চঞ্চলাকে জানতে দেয় নি। যেমন দরজার দিকে পিঠ করে পাশ ফিরে শুয়ে ছিল, তেমনিই পড়ে থাকে নিঃসাড়ে, যেন কি গভীর নিদ্রায়ই নিদ্রিত।

—যাও বৌ, আনন্দ বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশে গিয়ে চুপটি করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়। তারপরই আবার কি ভেবে বললে, না, আমি ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছি, তুমি ঘরের দরজায় হুড়কো দিয়ে শুয়ে পড়।

চঞ্চলা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

অন্নদাসুন্দরী কিছুক্ষণ যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঘরের মধ্যে। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ঘরের দরজার হুড়কোটা টেনে দেয়।

তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথার অবগুণ্ঠনটা সামান্য তুলে সামনের দিকে তাকাতেই হঠাৎ যেন থমকে যায়। :

ঘরের এক কোণে সেজবাতি জ্বলছে, আর সেই আলোয় অন্নদাসুন্দরীর চোখে পড়ল, পালঙ্কের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আনন্দচন্দ্ৰ পা দোলাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তের জন্য বুঝি বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল অন্নদাসুন্দরী। পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে আসতেই আবক্ষ গুণ্ঠন টেনে দেয়।

আনন্দচন্দ্র মিটি মিটি হাসছে তখনো।

অন্নদাসুন্দরী পাথরের মত দাঁড়িয়ে অল্পদূরে—খোলা জানালাপথে উত্তুরে ঠাণ্ডা বায়ু আসছে।

সেজবাতির শিখাটা মৃদু মৃদু কাঁপছে। আর সেই হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসছে চাঁপাফুলের গন্ধ। বাড়ির পিছনে বাগানে একটা বারোমেসে স্বর্ণচাপার গাছ আছে। বারোমাসই তাতে ফুল ফোটে। চাঁপার মিষ্টি গন্ধ আর তার সঙ্গে রজনীগন্ধা ও কোন নাম-না-জানা বনফুলের কটু গন্ধ মেশামেশি হয়ে। আনন্দচন্দ্র ততক্ষণে পালঙ্ক থেকে নেমে পড়েছে। পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে বৌয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দু হাতে তার ঘোমটা তুলে দেয়।

অন্নদাসুন্দরী চোখ বোজে।

—কি হল রে, চোখ খোল! তাকা! ঘরে আর এখন কে আছে রে তুই আর আমি ছাড়া বৌ!

অন্নদাসুন্দরী স্বামীর কথার কোন জবাব দেয় না।

—আয়, চল। শুবি চল—

অন্নদাসুন্দরীর নরম পেলব একখানি হাত মুঠো করে ধরে আনন্দচন্দ্ৰ ঈষৎ আকর্ষণ করল।

দুজনে এসে পালঙ্কের উপর পাশাপাশি বসল।

খোলা জানালাপথে মধ্যরাত্রের উত্তুরে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। অন্নদাসুন্দরীর শীত শীত করে, মৃদু মৃদু কাঁপে সে।

—আলোটা নিভিয়ে দিই? আনন্দচন্দ্র বলে।

—না, না–থাক। আলো থাক। অন্নদাসুন্দরী জবাব দিয়েছিল।

—কেন রে? অন্ধকারে ভয় করে বুঝি?

— না।

—তবে?

—থাক না আলো!

—নিশ্চয়ই তোর অন্ধকারে ভয় করে।

–সত্যি বলছি, অন্ধকারকে আমি ভয় করি না।

—বাঃ, তুই ত বেশ কথা বলতে পারিস বৌ। আমি তো ভেবেছিলাম-

—কি ভেবেছিলেন?

—তুই বুঝি বোবা।

অন্নদাসুন্দরীর ওষ্ঠপ্রান্তে ক্ষীণ একটা হাসির রেখা জেগে ওঠে।

অনেককাল পরে সে রাত্রের গল্প শুনতে শুনতে নাতি নীরদচন্দ্র শুধিয়েছিল—সত্যিই তোমার ভয় করছিল ঠাকমা!

—না, ভয় করবে কেন?

—তবে ঠাকুর্দাকে ঘরের আলো নিভাতে দিলে না কেন?

—দিলাম না—আমার খুশী-

—তারপর কি হল ঠাকমা? ঠাকুর্দা কি করলো?

গল্পের স্রোতে বাধা পড়ে, বাইরে আনন্দচন্দ্রের গলা শোনা যায়—কই গো! কোথায় গেলে?

সে হচ্ছে অন্নদাসুন্দরীর মৃত্যুর বৎসর তিনেক আগের কথা।

এক গলা ঘোমটা টেনে অন্নদাসুন্দরী বের হয়ে এল ঘর থেকে নাতির হাত ধরে।

–এবারও পাস করতে পারলে না নশে! আনন্দচন্দ্ৰ বললে।