মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ৪

॥ চার ॥

না ঠাকুরুন, আপনি যান। ভাত প্রায় হয়ে এসেছে। এখন গেলে সব নষ্ট হয়ে যাবে—

স্বামীর বিধবা বোনেদের ঠাকরুন বলেই বরাবর সম্বোধন করেন বামাসুন্দরী। বড় ঠাকরুন মেজো ঠাকরুন ও ছোট্‌ ঠাকরুন-

বিন্দুবাসিনী ঝংকার দিয়ে বলে ওঠে—ধন্যি বাবা জিদ তোমার বৌ! তা গুষ্টির পিণ্ডি নামিয়ে রেখেই না হয় চল। কোথায় শাশুড়ি গিয়ে প্রথম ছেলের বৌয়ের মুখ দেখবা, ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করবা—তা না, উনি রান্নাঘরে বসে গুষ্টির পিণ্ডি সিদ্ধ করিতেছেন। উঠে এস!

ভাতটা প্রায় হয়ে এসেছে। হাঁড়িটা নামিয়ে গেলে হয় না ছোট্‌ ঠাকরুন!

মরণ! দেব হাঁড়ি আমি উল্টে ফেলে উনুন থেকে। উঠে এস!

বামাসুন্দরী আর তর্ক চালাতে সাহস পান না। ভাতের হাঁড়িটা দু’হাতে উনুন থেকে নামিয়ে এক ঘটি জল ঢেলে দেন হাঁড়ির মধ্যে।

পরনে একটা ময়লা লালপাড় শাড়ি।

দু’হাতে তেলকালির ময়লা।

বিন্দুবাসিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন বামাসুন্দরী, চল।

বিন্দুবাসিনী বামাসুন্দরীর আপাদমস্তকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললে— এইভাবে পেত্নীর মত বেশ নিয়ে যাবা নাকি ছেলের বৌয়ের মুখ দেখতি, তারে আশীর্বাদ করতি?

কুণ্ঠিত গলায় বামাসুন্দরী বলেন—আর তো আমার শাড়ি নেই। পাড়টে ছিঁড়ে গিয়েছে—নতুন যেটা ছিল পোর্টমান্টো থেকে সেটা বের করে অবেলায় খার দিয়ে কেচে দিয়েছিলাম, ভাল করে এখনো শুকায়নি।

তা তোমাকেও বলি বৌ, এত হেনস্তা কেন সহ্য কর বলতি পার! সংসারে কেবল দাসীবাঁদীর মতই খেটে মরবা, তোমার নিজের কি কোন সুখ-দুঃখ, সাধ-আহ্লাদ নেই- থাকতি পারে না? কেন, দাদাকে বলতি পার না?

কিভাবে টানাটানির মধ্যে সংসার চলেছে, তুমি তো জান ছোট্‌ ঠাকরুন। একটা শাড়ির দাম দেড় টাকা।

তাতে তোমার কি? বিয়ে করা মাগকে একখানা শাড়ি কিনে দিতি পারবে নাই যদি, তার বিয়ে করা কেন? ছি ছি, ঘেন্না ধরে গেল তোমাদের এ সংসারের রকমসকম দেখে। বলি কেন অত হেনস্তা মুখ বুজে সও, বলতি পার!

বস্তুত ওই একজনই সংসারে বিন্দুবাসিনী, যে বরাবর বামাসুন্দরীকে স্নেহের চোখে দেখে এসেছে। তার কারণও ছিল। বামাসুন্দরী যখন ওই গৃহে বধূ হয়ে আসেন, তখন একমাত্র কিছুটা বয়েসের কাছাকাছি ওই বিন্দুবাসিনীকেই পেয়েছিলেন।

বিন্দুবাসিনী বোধ করি বৎসরখানেকের বড়ই ছিলেন বামাসুন্দরীর।

বিন্দুবাসিনীর ধনীর ঘরে তৃতীয় পক্ষে বিবাহ হয়েছিল। বিবাহের সময় তার বয়স ছিল বারো, আর তার স্বামী ভগবতীচরণের বয়স বাষট্টি। বিবাহের পর বছর কয়েক মাত্র বেঁচে ছিল স্বামী—তার পরই বিন্দুবাসিনী বিধবা হয়।

আগের পক্ষের ছেলেরা তাদের সৎমাকে গৃহে রাখতে চায়নি—বিন্দুবাসিনীও থাকতে চায়নি, কারণ তাদের ব্যবহার ভাল ছিল না বলে। তিনি পিতৃগৃহেই চলে আসেন। তবে সৎ ছেলেরা মাসে মাসে কিছু খরচা হিসাবে সৎমাকে পাঠিয়ে দিত।

বিন্দুবাসিনীর স্বামী বিবাহের পর স্ত্রীকে কিছু শাড়ি গহনা দিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর পিতৃগৃহে আসার সময় সে-সব তিনি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিলেন।

বিন্দুবাসিনী বলেন—সত্যি বৌ, তোর মত কপাল করে যেন কেউ না আসে এ সংসারে। তা কপালেরই বা সব দোষ দেব কি! তোর হইছে সেই চোরের মা’র অবস্থা। কিন্তু কেন, তাই বা কেন হবে? নিজের পাওনাগণ্ডা আদায় করে নিতে পারিস না? মেনিমুখো হয়ে থাকিস বলেই তো ওরা সকলে মিলে তোকে আরো হেনস্তা করে—

বামাসুন্দরীর কাছে বিন্দুবাসিনীর ওই ধরনের কথাগুলো নতুন নয়। বহুবারই তিনি শুনেছেন, কিন্তু কখনো কোন সাড়া দেননি। কেবল মৃদু হেসেছেন ঘোমটার আড়ালে। আজও তেমনি একটুখানি হাসি তাঁর ওষ্ঠ পর্যন্ত জেগে উঠেই মিলিয়ে গেল।

এক কাজ কর, পাঁচদুয়োরের পুকুরঘাট থেকে হাত মুখটা ধুয়ে আয়, আমি আসছি। বিন্দুবাসিনী চলে গেল।

উত্তরের পোতার বড় ঘরেই বড় সেজ ও ছোট তিন বোন থাকে। সেই ঘরে গিয়ে ঢুকল বিন্দুবাসিনী। ঘরের মধ্যে ভিড় তখন আর নেই। বড় ও সেজ বোন চন্দ্রকলা ও সরোজিনী তখন অন্নদাসুন্দরীর ঠাকুরদা ও ঠাকুরমার আক্কেলটা কেমন তাই নিয়ে সমালোচনা করছিল। চন্দ্রকলা বলছিল—না হয় ভাই আমাদের বলেছিলই শাঁখাসিঁদুর দিয়ে পাত্রী পাত্রস্থ করলেই হবে, তাই বলে একেবারে ন্যাংটো করে নাতনী সম্প্ৰদান করেছে গা। গলায় একচিলতে একটা সরু মটরমালা, আর হাতে দু’গাছা মাত্র বালা আর শাঁখা! চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা কথা আছে!

সেজ সরোজিনী বললে—দাদাও একেবারে মেয়ে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেলেন! বলা নেই, কারো সঙ্গে কোন পরামর্শ নেই, একেবারে বাক্যদান ও আশীর্বাদ। একটিমাত্র ছেলে, এক হাভাতের ঘরের মেয়েকে বৌ করে নিয়ে এলেন।

অন্নদাসুন্দরীর তখন অবগুণ্ঠনের অন্তরালে দু-চোখের কোল উপচে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু গণ্ড ও চিবুক প্লাবিত করে দিচ্ছে নিঃশব্দে।

বিন্দুবাসিনীকে ঘরে ঢুকতে দেখে চন্দ্রকলা বললে—কি হল, সেই নবাবনন্দিনী এল না?

বিন্দুবাসিনী বড়দির কথার জবাবে বললে—আসছে। অত তাড়াহুড়া করলে কি করে হবে? বাড়িতে একগুষ্টি আত্মীয়কুটুম এসেছে, তাদের পিণ্ডির যোগাড় করবে কেডা মরতি! মরণ তো সেই আবাগীরই।

সরোজিনী বলে ওঠে—থাম বিন্দি, আর আদিখ্যিতে করিস নে। রান্না যেন আর এ গাঁয়ে কোন বাড়ির বৌ করে না!

করবেন না কেন? কিন্তু একটা যজ্ঞিবাড়ির রান্না একজনের পক্ষে তো অত সহজ নয়।

থাম লো থাম। চন্দ্রকলা বলে ওঠে–বৌয়ের জন্য দরদে যে একেবারে উথলে উঠছিস!

বিন্দুবাসিনী বড়দির কথার আর কোন জবাব দিলে না। নিজের পোর্টমান্টো খুলে একটা দামী শাড়ি বের করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

রান্নাঘরে এসে দেখে বামাসুন্দরী তখন সবে পুকুরঘাট থেকে ফিরেছেন।

নে বৌ, এই শাড়িটা পরে নে।

হাত বাড়াতে গিয়েও হাত সংকুচিত হয়ে আসে বামাসুন্দরীর, হাত গুটিয়ে নিয়ে বলেন—এ শাড়ি—

যা বলছি, তাই কর। চটপট পরে নে।

কিন্তু ছোট্‌ ঠাকরুন—

দেখ, আমাকে রাগাসনে বৌ! চট্‌পট শাড়িটা পড়ে নে—

বামাসুন্দরী কাতর অনুনয়ে বলে ওঠেন—ছোট্‌ ঠাকরুন, দোহাই তোমার, পায়ে পড়ি—এ শাড়ি আমি পরতে পারব না। আমি পাশের ঘরে কাঠের উপরে সেই ভিজা খারে কাচা শাড়িটা টান টান করে মেলে দিয়েছিলাম, বোধহয় এতক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে, সেটাই এনে আমি—। একটুকু অপেক্ষা কর। বলতে বলতে বামাসুন্দরী রান্নাঘরের পাশের যে চালাঘরটায় হাঁড়িকুড়ি, মালসা, জালায় ধান চাল ও জ্বালানির জন্য বিন্দুবাসিনীরই প্রত্যহের এ বাগান ও বাগান থেকে আনা কাঠকুটো ডালপালা পাতা সংগ্রহ করা থাকে, সেই ঘরের দিকে পা বাড়াতেই কঠিন কণ্ঠ শোনা গেল বিন্দুবাসিনীর— বৌ!

সে কণ্ঠস্বরকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করবার মত দুঃসাহস ছিল না ঐ চিরদিনের লজ্জাবতী নিঃশব্দচারিণী, সদাকুণ্ঠিতা বামাসুন্দরীর। দাঁড়িয়ে যান থমকে বামাসুন্দরী।

যা বলছি, তাই কর। এই শাড়িটা পরে নে। কেন মেনিমুখী, তোর এত সংকোচ কিসের? তোর ঘরে আজ তোর ছেলের বৌ এসেছে—নে ধর!

বিন্দুবাসিনী যেন একপ্রকার জোর করেই শাড়িটা বামাসুন্দরীর হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে বললে, পরে নে, আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।

.

কুণ্ঠিতা, লজ্জা ও সংকোচে মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া সেই চোখ ঝলসানো দামী শাড়ি পরিহিতা বামাসুন্দরীকে নিয়ে এসে উত্তরের পোতার বড় ঘরে বিন্দুবাসিনী ঢুকল। কৈলাস তখন ঘরের মধ্যে সব চাইতে বড় সেজবাতিটা জ্বালিয়ে ঘরের কোণে কাঠের সিন্দুকের উপর বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। উজ্জ্বল আলোয় ঘর আলোকিত।

বড় ও সেজ ঠাকরুন চন্দ্রকলা ও সরোজিনী এবং পাড়ার এক বর্ষীয়সী সধবা মহিলা কেবল ঘরের মধ্যে ছিলেন। আর তক্তাপোশের উপর জড়োসড়ো হয়ে একগলা ঘোমটা দিয়ে বসে পুতুলের মত অন্নদাসুন্দরী।

হঠাৎ দামী শাড়ি পরিহিতা বামাসুন্দরীকে বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে চিনতে পারেনি চন্দ্রকলা ও সরোজিনী। উভয়ের কণ্ঠ হতেই বিস্ময়ের সঙ্গে উচ্চারিত হয় একটি প্রশ্ন—এ কে রে বিন্দু?

স্বাভাবিক সহজ কণ্ঠে বলে বিন্দুবাসিনী—কে আবার! আমাদের বৌ।

বৌ! আমাদের বৌ? পুনরায় বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন চন্দ্রকলা ও সরোজিনীর

হ্যাঁ। যা বৌ, ছেলের বৌকে আশীর্বাদ কর। ওই দেখ থালায় ধানদূর্বা আছে। বলতে বলতে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে রাখা এক জোড়া সোনার কানবালা বের করে এগিয়ে বামাসুন্দরীর হাতের মধ্যে গুঁজে দেয়। বলে—এটা দিয়ে তোর ছেলের বৌকে আশীর্বাদ কর।

চন্দ্রকলা আর সরোজিনী স্তব্ধ। ওরা যেন আগাগোড়া ব্যাপারটার আকস্মিকতায় ও অবিশ্বাস্যতায় বিমূঢ়।

কি হল রে? হাঁদার মত দাঁড়িয়ে রইলি কেন? যা, আশীর্বাদ কর তোর ছেলের বৌয়ের মুখ দেখে। বলতে বলতে একপ্রকার যেন ঠেলেই দিল বেপথুমান বামাসুন্দরীকে সামনের দিকে বিন্দুবাসিনী।

বামাসুন্দরী তখন কাঁপছেন। ওই শীতেও তাঁর গলায় বুকে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। এক পাও এগোতে পারেন না বামাসুন্দরী।

বিন্দুবাসিনী তখন তাঁকে ঠেলে, যেখানে খাটের উপর একগলা ঘোমটা টেনে অন্নদাসুন্দরী বসে ছিল, সেখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিল বামাসুন্দরীকে। নিজেই হাত বাড়িয়ে অন্নদাসুন্দরীর মাথার ঘোমটা তুলে দিলে বিন্দুবাসিনী। অন্নদাসুন্দরীর দু চোখ বোজা। এতক্ষণ কেঁদেছে নিঃশব্দে, চোখের কোল ও গালের উপর থেকে সে জল এখনো শুকিয়ে যায় নি।

দেখ্‌ বৌ দেখ, কেমন দুর্গাপ্রতিমাটির মত বৌ এনেছে দাদা।

জলভরা চোখে চেয়ে দেখলেন বামাসুন্দরী তাঁর পুত্রবধূর মুখের দিকে। যেমন টানা-টানা ভ্রূ তেমনি গভীর আঁখিপদ্মে ঢাকা দুটি চক্ষু। উন্নত নাসা। ছোট কপালের উপর কয়েকটি চূর্ণকুন্তল এসে পড়েছে। দুই ভ্রূর মধ্যিখানে গোলাকার একটি সিঁদুরের টিপ।

কি হল রে? কর আশীর্বাদ কর! বিন্দুবাসিনী আবার তাড়া দেয়।

কম্পিত হাতে থালা থেকে ধানদূর্বা তুলে নিয়ে পুত্রবধূর মাথায় রাখতেই অন্নদাসুন্দরী চোখ মেলে তাকাল। তারপর উঠে নীচু হয়ে শাশুড়ির পদধূলি নিতেই বামাসুন্দরী দুই হাতে গভীর স্নেহে পুত্রবধূকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন।

বাইরে তখন সানাই বাজছিল।

খেয়াল ছিল না বুঝি মুহূর্তের জন্য বামাসুন্দরীর। সব কিছুই বোধ করি ওই মুহূর্তটির জন্য ভুলে গিয়েছিলেন।

নিজের মাকে ছোটবেলায় হারিয়েছে অন্নদাসুন্দরী। মায়ের কোন কথাই তার, মনে ছিল না। মা কেমন, মা কি বস্তু, মায়ের স্নেহ্ কি—তার কোন স্বাদই তো কোনদিন জ্ঞান হওয়া অবধি সে পায় নি। হঠাৎ বামাসুন্দরী দু’হাতে তাকে বুকে টেনে নিতে অন্নদাসুন্দরীর ছোট কচি বুকের ভিতরটা যেন অনাস্বাদিত এক পুলকে শিরশির করে ওঠে।

আর সেই মুহূর্তে সেই সন্ধ্যারাত্রে যে স্নেহের বাঁধনে পরস্পর পরস্পরের কাছে বাঁধা পড়েছিলেন, সে বাঁধন আর শিথিল হয়নি

হঠাৎ যেন চন্দ্রকলার কর্কশ কণ্ঠে ক্ষণিকের মোহজাল ছিন্ন হয়ে গেল।

হয়েছে, হয়েছে। বৌ তো ঘরেই রইল। সোহাগ করবার জন্য তো সারাটা জীবনই পড়ে রইল। এবারে রান্নাঘরে যাও রাজেন্দ্ৰাণী। এতগুলো লোকের খাবার ব্যবস্থা— রাত যেন আবার কাবার করে ফেলো না!

হঠাৎ সর্পদংশন করলে যেমন মানুষ শিউরে ওঠে, বামাসুন্দরীও তেমনি শিউরে উঠে পুত্রবধূর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে সরে দাঁড়ান। তারপর নিঃশব্দে লজ্জায় যেন মাটির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রকলা বলে ওঠে ছোট বোনকে সম্বোধন করে—এটা কি হল বিন্দু!

কেন বড়দি?

কেন আবার শুধাচ্ছিস! আমাদের মুখে কালি লেপে দিয়ে

ওমা! সে কি গো? তোমাদের মুখে আবার কালি লেপতে গেলাম কখন?

আগে না হয়, সরোজিনী বললেন তীক্ষ্ণ গলায়—তুই বড়লোকের বউ ছিলি, তোর প্যাটরা-ভরা শাড়ি, অলংকার—

সেজদি!

অত দেমাক ভাল নয় রে ভাল নয়। সরোজিনী বললেন।

দেমাকের কি হল সেজদি? বিধবা মানুষ আমি, ও গয়না আর শাড়ি এ জীবনে কোন্ কাজেই আর আমার আসত! তাছাড়া ও তো আমাদের পর নয়—

থাম্ লো থাম্।

আমরাও ঘাসে মুখ দিয়ে চলি নে ছোট। চন্দ্রকলা সায় দেয়।

কিন্তু চন্দ্রকলার কথা শেষ হল না, একটা গরদের থান পরিহিতা মেজ বোন নিভাননী বড় বড় ঠ্যাং ফেলে ফেলে চারিদিককার স্পর্শ বাঁচিয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন। হাতে একটা গঙ্গাজলের ছোট ঘটি। আনন্দ কলকাতা থেকে গঙ্গাজল এনে দিয়েছে মেজ পিসি মেজ ঠাকরুনকে। দিবারাত্র পূজা-আর্চা নিয়েই থাকেন সংসার থেকে দূরে নিভাননী। আর কেবল ছোঁওয়া-ছুঁয়ির ভয়ে সর্বক্ষণ যেন থাকেন আতঙ্কিত হয়ে। দিনেরাত্রে পাঁচ-সাতবার বাড়ির পিছনে এঁদো পুকুরঘাটে গিয়ে ডুব দিয়ে আসেন।

এককালে যৌবনে হয়ত দেখতে সুন্দরই ছিলেন নিভাননী, কিন্তু আজ তেতাল্লিশের কোঠা উত্তীর্ণ হবার আগেই তাঁর দেহের সমস্ত রূপ রস যেন শুকিয়ে ঝরে গিয়েছে, কঠোর আত্মনিগ্রহে কঠিন নিয়মপালন ও সুকঠোর তপস্যায়।

মাথার চুল ছোট ছোট করে কদমছাঁটে ছাঁটা।

তোবড়ানো গাল, কোটরগত চক্ষু, ঝুলে পড়া নাক। দু চক্ষের দৃষ্টিতে যেন সর্বদা ঝরে পড়ছে সমস্ত বিশ্ব-সংসারের প্রতি একটা অনীহা। সংসারের কিছুতেই যেন তিলমাত্র আকর্ষণও আজ আর তাঁর মনের মধ্যে কোথায়ও অবশিষ্ট নেই। পশ্চিমের পোতায় একটা ছোট ঘর। সেই ঘরের মধ্যেই যেন সংসারের থেকে সকল স্পর্শ বাঁচিয়ে দিন ও রাত্রির বেশির ভাগ সময়েই তাঁর কেটে যায় পূজা-আর্চা করে। ইদানীং আবার কিছুদিন হল উত্তরের পোতার যে বড় ঘরটায় অন্য তিন বোন থাকতেন, সে ঘরেও আর পা দেন না নিভাননী। এমন কি খাওয়াদাওয়াও আলাদা করে বৎসর খানেক ধরে।

আঁশ-হেঁসেলের রান্না সেরে বামাসুন্দরীকেই স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ভিজে কাপড়েই হবিষ্যি-ঘরে গিয়ে বিধবা ননদদের রান্না করতে হয়। আজকাল হবিষ্যি-ঘরের রান্নাও স্পর্শ করেন না নিভাননী, যেহেতু সে রান্না করেন বামাসুন্দরীই।

একটু ভাতেভাত নিজেই পশ্চিমের ছোট ঘরের পিছনের সংকীর্ণ দাওয়ায় একটি ছোট উনুন পেতে নিয়ে, যাহোক করে ফুটিয়ে নেন। একটি বোগনো, একটি ঘটি আর একটি পাথরের থালা।

সামনেই বাড়ির পশ্চাৎ দিকের বাগান।

বাগানের পরেই একটা শ্যাওলা-ভরতি ডোবা। তার চারপাশে যজ্ঞিডুমুর আর আশ শ্যাওড়া ও বেতবন আর তেলাকচু লতায় ছেয়ে আছে। লাল লাল তেলাকচু ফল খেতে আসা শ্যামা দোয়েল প্রভৃতি পাখির আর মধ্যে মধ্যে শালিকের বিচিত্র ডাক শোনা যায়। বড় বড় ব্যাঙ আছে ডোবাটার মধ্যে, আর বোধহয় আছে ল্যাঠা আর শোল মাছ—কইও আছে। বর্ষণকালে ডোবার জল যখন কানায় কানায় ভরে ওঠে, কানে হেঁটে মধ্যে মধ্যে কই মাছ একটা আধটা উঠে আসে। আর আসে বিরাট আকার দুটো গো- সাপ, ঠিক যেন বাচ্চা কুমির। সে দুটোও মধ্যে মধ্যে ডাঙায় উঠে আসে নানা পোকা- মাকড়ের লোভে। সরু লিকলিকে জিভ বার করে ইতি উতি তাকায়, মানুষের সাড়া পেলেই সঙ্গে সঙ্গে সড়সড় করে জলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ওই দিকটা একেবারে নির্জন। বাড়ির কেউ সেদিকে বড় একটা যায়ই না। দ্বিপ্রহরের স্তব্ধতায়ও ঝিঁঝি পোকার একটানা ঝিঁঝি ডাক শোনা যায়। তারই মধ্যে ভেসে আসে দূরে কোন পত্রশাখা হতে ক্লান্ত ঘুঘুর ডাক।

রাত্রে শিয়াল ডাকে প্রহরে প্রহরে।

অন্য কেউ হলে পশ্চিমের পোতার ওই নির্জন ঘরটায় থাকতে সত্যিই ভয় পেত হয়ত। কিন্তু মেজ ঠাকরুনের ভয় ডর বলে বুঝি কিছুই নেই। তাছাড়া দিবারাত্র সে তো পূজা-আর্চা নিয়েই আছে সংসারের সঙ্গে সমস্ত বন্ধন ও সম্পর্ক ছিন্ন করে।