।। বত্রিশ ।।
অন্নপূর্ণা গৃহে ফিরে এল—
কিন্তু মাথার মধ্যে তখন তার যেন চিন্তার ঝড় বহে চলেছে। স্বামী তার তাহলে তলে তলে সবই ঠিক করে ফেলেছেন। কিন্তু এখন উপায়! সারাটা রাত্রি একটিবারও দু-চোখের পাতা একত্র করতে পারে না অন্নপূর্ণা—শয্যায় শুয়ে ছট্ফট্ করতে থাকে।
কথাটা যদি সত্য হয়—ভোলানাথ যা বলে গেল তা যদি সত্য হয় তো আর তো দেরি করা যায় না। আজ রবিবার, মধ্যিখানে মাত্র একটি দিন আছে, যা করবার তাকে এই একটি দিনের মধ্যেই করতে হবে।
রাত্রি শেষযামে শয্যা হতে উঠে পড়লো অন্নপূর্ণা—শাশুড়িকে? না না, কিছু জানানো হয়নি, সর্বাগ্রে তাঁকেই সব কথা জানানো প্রয়োজন, এই সময় ভবতারিণী ঠাকুরঘরে সন্ধ্যাহ্নিক নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
বিরাট মল্লিক গৃহ সুষুপ্তির মধ্যে যেন তলিয়ে আছে। অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা চারিদিকে—নিঃশব্দে অন্নপূর্ণা অন্দরমহল থেকে বের হয়ে ঠাকুরঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
ঠাকুরঘরের কবাট খোলা।
ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে—তারই মৃদু আলোয় কক্ষটি স্বল্পালোকিত।
অন্নপূর্ণা পায়ে পায়ে ঠাকুরঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
অত্যন্ত সজাগ শ্রবণশক্তি ভবতারিণীর—অন্নপূর্ণার মৃদু পদশব্দ তাঁর কর্ণে প্রবেশ
করতেই তিনি ফিরে তাকালেন—কে?
মা-
কে—বৌমা?
হ্যাঁ — মা—
কি হয়েছে বৌমা?
মা, সব ঠিক হয়ে গিয়েছে-
ঠিক হয়ে গিয়েছে? কি ঠিক হয়ে গিয়েছে! কি বলছো তুমি বৌমা?
সুহাসের বিয়ে।
কে বললে তোমায়?
ভোলানাথ—
ভোলানাথ!
হ্যাঁ, মঙ্গলার ছেলে—যাকে কয়দিন আগে এ গৃহ থেকে আমি বের করে দিয়েছি।
তার সঙ্গে কোথায় তোমার দেখা হল?
অন্নপূর্ণা তখন ওই দিন সন্ধ্যায় দীঘির পাড়ে যা ঘটেছিল সব বলে গেলো। পুত্রবধূ অন্নপূর্ণার মুখে সব কথা শুনে কয়েকটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন ভবতারিণী। ব্যাপারটা তাহলে এত দূর গড়িয়েছে তাঁর অজ্ঞাতে। পুত্র তাঁর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিধবা কন্যার সে বিবাহ দেবেই। ভবতারিণীর রক্তে পিতৃপুরুষের যে জিদ সেটা যেন টগবগ করে ফুটতে শুরু করে।
কি হবে মা!
কিসের কি হবে?
সুহাসের তাহলে বিবাহ হবে?
না।
কিন্তু মা—
না—হবে না।
কিন্তু কেমন করে বাধা দেবেন মা?
সুহাস কোথায়?
সে তো আমার ঘরে ঘুমিয়ে আছে।
যাও—তাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এসো।
ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসবো?
হ্যাঁ যাও—আর দেরি করো না। রাত পোহাবার আগেই আমাকে রওনা হতে হবে।
কোথায় যাবেন?
আপাতত নবদ্বীপে গুরুদেবের আশ্রয়ে।
সেখানে?
এখন কথা বলবার সময় নেই আর—বলতে বলতে আঁচল থেকে একটা ভারী চাবির গোছা খুলে পুত্রবধূর হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, আর শোন, এই চাবিটা নাও—আমার ঘরের সিন্দুকটা খুলে দুটো টাকার তোড়া আছে দেখতে পাবে, সে দুটোও নিয়ে এসো–যাও—
শাশুড়ির কণ্ঠস্বরে এমন একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা ছিল যে, অন্নপূর্ণা আর প্রশ্ন করবার সাহস পায় না—চাবির গোছাটা নিয়ে ঠাকুরঘর থেকে বের হয়ে যায়।
ভবতারিণীও উঠে দাঁড়ালেন—দীর্ঘ পথ একা ওই কিশোরী পৌত্রীকে নিয়ে যাবার সাহস হয় না ভবতারিণীর। একজন—বিশেষ করে পুরুষকে সঙ্গে নিতেই হবে।
কিন্তু কাকে নেবেন!
হঠাৎ মনে পড়ে একজনের কথা।
আনন্দচন্দ্ৰ।
আনন্দচন্দ্রকে বিশ্বাস করা যায়। ছেলেটির যতটুকু পরিচয় এই কয় বৎসরে পেয়েছেন ভবতারিণী—তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা যায়।
রাধামোহনের মন্দির থেকে বের হয়ে ভবতারিণী বহির্মহলের দিকে পা বাড়ালেন। রাত্রি তৃতীয় প্রহরও উত্তীর্ণপ্রায়। একটা ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে।
আনন্দচন্দ্র জেগেই ছিল।
শেষ পরীক্ষা আসন্ন। পাঠ্যপুস্তক খুলে প্রদীপের আলোয় বসে আনন্দচন্দ্ৰ পাঠে মগ্ন ছিল। আনন্দচন্দ্র আজকাল ঘরে একাই থাকে ভোলানাথ চলে যাবার পর থেকে।
আনন্দ!
কে? পাঠ্যপুস্তক থেকে মুখ তুলে তাকাল আনন্দচন্দ্র। সামনে দাঁড়িয়ে ভবতারিণী—কত্তামা—কি হয়েছে কত্তামা?
আমার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে পারবে?
কখন?
এই মুহূর্তে—
কোথায় যেতে হবে?
সে পরে জানতে পারবে, তুমি বলো যেতে পারবে কিনা?
কিন্তু কোথায় যেতে হবে কত্তামা?
বললাম তো পরে জানতে পারবে—তুমি কেবল যেতে পারবে কিনা আমার সঙ্গে বলো। ভয় নেই, কাল সন্ধ্যা নাগাদই তুমি ফিরে আসতে পারবে—সে ব্যবস্থা আমি করে দেবো। আমার বড় বিপদ বাবা-
কি হয়েছে কত্তামা?
এখন আর কথা বলবার সময় নেই—তুমি যদি যাও তো এক্ষুনি তোমাকে প্রস্তুত হয়ে নিতে হবে—
মল্লিকগৃহে আনন্দচন্দ্র যতদিন আছে—এই মহিলাটির অপর্যাপ্ত স্নেহ পেয়ে এসেছে বরাবর। আনন্দচন্দ্র ভবতারিণীকে যেমন শ্রদ্ধা করত তেমনি ভক্তি করত। আনন্দচন্দ্র আর দ্বিধা না করে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চলুন, কোথায় যেতে হবে-
তুমি প্রস্তুত হয়ে সোজা গঙ্গার ঘাটে চলে যাও।
গঙ্গার ঘাটে!
হ্যাঁ, আমি অল্পক্ষণের মধ্যেই সেখানে আসছি—তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করোগে গঙ্গার ঘাটে।
ভবতারিণী কথা রলে কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
আনন্দচন্দ্র গায়ে একটা জামা চড়িয়ে দড়ির আলনা থেকে চাদরটা টেনে নিল।
অন্নপূর্ণা ঘুমন্ত সুহাসিনীর গায়ে মৃদু ধাক্কা দিতে দিতে ডাকলো খুকী—এই খুকী—বার দুই ঠেলা দিতেই সুহাসের ঘুম ভেঙে যায়।
মা, কি হয়েছে মা?
চল্—
কোথায়?
তোর ঠাকুমা তোকে ডাকছেন।
ঠাকুমা! কোথায়?
রাধামোহনের মন্দিরে।
সুহাস ঘুম-ঘুম চোখেই উঠে বসে এবং সেই অবস্থাতেই অন্নপূর্ণা কন্যার একটা হাত ধরে তাকে শয্যা থেকে টেনে তোলে, বলে, আয়—
মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভবতারিণী।
সর্বাঙ্গে একটা মুগার চাদর জড়ানো।
ঠাকুমা—সুহাসিনী ডাকল।
আয়—বলে পৌত্রীর একটা হাত ধরে ভবতারিণী সদরের দিকে অগ্রসর হলেন হাতে টাকার থলি দুটো নিয়ে। অন্নপূর্ণা দাঁড়িয়ে রইলো।
সদর পর্যন্ত গিয়ে আবার কি ভেবে ফিরে এলেন ভবতারিণী। না, দেউড়ি দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। দেউড়ির দারোয়ানটাকে বিশ্বাস নেই। তাছাড়া রাধারমণ তার উপরে কি হুকুম দিয়ে রেখেছে কে জানে? যদি সে বাধা দেয়, গোলমাল করে, তার চাইতে বাগানের খিড়কি-পথেই যাওয়া ভাল।
ভবতারিণী ফিরতে দেখে অন্নপূর্ণা শুধালো, কি হল মা, ফিরে এলেন?
দেউড়ি দিয়ে যাবো না। খিড়কি দিয়ে যাবো।
ওই সময় সুহাসিনী প্রশ্ন করে, কোথায় যাচ্ছি আমরা ঠাকুমা?
তোর না আজ বিয়ে? ভবতারিণী বললেন।
আজ আমার বিয়ে!
হ্যালো, বিয়ের দিন সকালে গঙ্গাস্নান করতে হয় যে,—চল্ গঙ্গাস্নান করে আসি।
সুহাসিনীর মনে আর কোন প্রশ্ন থাকে না। হঠাৎ ঘুম থেকে তার মা তাকে তুলে আনার পর থেকে ব্যাপারটা সে আদৌ বুঝতে না পেরে কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে ছিল এতক্ষণ। কি হচ্ছে, কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছিল না।
গঙ্গায় স্নান করতে যাবো, গামছা তো নিলাম না?
আমি নিয়েছি, চল্।
অন্ধকার খিড়কি পথে পৌত্রীর হাত ধরে যখন মল্লিকগৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন ভবতারিণী, আকাশে তখন প্রথম আলোর ছোপ ধরছে। গাছের ডালে ডালে পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে।
নির্জন পথ ধরে ভবতারিণী পৌত্রীর হাত ধরে গঙ্গার ঘাটের দিকে অগ্রসর হলেন। মধ্যে মধ্যে কেবল দু’-একজন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে দেখা গেল কেউ গঙ্গাস্নান সেরে ফিরছে বা কেউ গঙ্গাস্নানে চলেছে।
তার মধ্যে একজন কৃষ্ণের শতনাম করতে করতে চলেছে মৃদুকণ্ঠে।
হরেকৃষ্ণ নাম রাখে প্রিয় বলরাম।
ললিতা রাখিল নাম দূর্বাদলশ্যাম ॥
বিশাখা রাখিল নাম অনঙ্গমোহন।
সুচিত্রা রাখিল নাম শ্রীবংশীবদন।
সরু নোংরা পথ, তারই মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেন ভবতারিণী। পৌত্রীর বাম হাতটা তাঁর দক্ষিণ হস্তে। বেশ দ্রুতই হেঁটে চলেন ভবতারিণী।
তখনকার দিনে কলকাতা থেকে নবদ্বীপধামে যেতে হলে দুটি মাত্র পথ ছিল— হয় হাঁটাপথে না-হয় গঙ্গাপথে নৌকাযোগে। ভবতারিণী ভাবছিলেন মনে মনে- -একবার নৌকায় উঠে বসতে পারলে আর ভয় নেই।
গঙ্গার ঘাটে আনন্দ দাঁড়িয়ে ছিল ভবতারিণীর অপেক্ষায়।
ভবতারিণীর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে সে ঘন ঘন পথের দিকে তাকাচ্ছিল। দূর থেকে ভবতারিণীকে দেখে নিশ্চিন্ত হল আনন্দচন্দ্র। কিন্তু ভবতারিণীর সঙ্গে ও কে আর একজন! কাছে আসতেই আনন্দ চিনতে পারে সুহাসিনীকে।
আনন্দ—
বলুন কত্তামা।
একটা নৌকা ভাড়া করো, বলবে নবদ্বীপধাম যেতে হবে।
আনন্দ কোনরূপ প্রশ্ন না করে ঘাটের অল্প দূরে যেখানে সার সার সব নৌকা বাঁধা ছিল সেই দিকে এগিয়ে গেল।
একটা নৌকার গলুইয়ে বসে ভোরের আবছা আবছা আলোয় একজন মাঝি বসে বসে হুঁকায় তামাক খাচ্ছিল।
আনন্দ এগিয়ে গিয়ে ডাকল, অ মাঝি, ভাড়া যাবে?
যাবেন কোথায়?
নবদ্বীপধাম।
তা যাব না কেন? ভাড়া পাঁচ টংকা লাগবে।
ঠিক আছে—ওই ঘাটে ভিড়াও নাও।
যান আসছি।
নৌকা ঘাটে এসে লাগতেই ভবতারিণী সুহাসিনীর হাতটা আকর্ষণ করে বললেন, চল্ –-
কোথায়? সুহাসিনী ভীতকণ্ঠে শুধায়।
ওই নৌকায় ওঠ, বললেন ভবতারিণী।
কেন? নৌকায় যাবো কেন? না, যাবো না। তুমি বলেছিলে গঙ্গাস্নান করতে এসেছি আমরা।
হঠাৎ একটা চাপা গর্জন করে উঠলেন ভবতারিণী। হারামজাদী, খুন করে ফেলবো তোকে। চল্, ওঠ নৌকায়।
না।
উঠবি না?
না।
বিধবা মাগী, বিয়ে করবি তাই না? ওঠ—ওঠ বলছি।
না।
সুহাস?
আনন্দচন্দ্ৰ স্তব্ধ বিমূঢ়। পাথরের মত দাঁড়িয়ে এক পাশে।
হঠাৎ ভবতারিণী সুহাসিনীর দক্ষিণ হস্তটা শক্ত করে চেপে ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে সুহাসিনীকে নৌকায় নিয়ে তুললেন একেবারে। সুহাসিনী ছাড়াবার চেষ্টা করে কিন্তু ভবতারিণীর শক্ত মুঠি থেকে নিজের হাত ছাড়াতে পারে না।
এসো আনন্দ—এই মাঝি, নৌকা ভাসাও। ভবতারিণী বললেন আদেশের সুরে। তারপর একটা ধাক্কা দিয়ে সুহাসিনীকে পাটাতনের উপরে ফেলে দিলেন।
সুহাসিনী কেঁদে ওঠে,—ওগো—ঠাকুমা গো—আমি যাবো না—আমি যাবো না।
নৌকা তখন ভেসে চলেছে!
জোয়ারের স্রোত—তরতর করে নৌকা চলেছে ভাগীরথীর স্রোতে।
নতুন এক শহর কলকাতার তটভূমি ছুঁয়ে ভাগীরথী বহে চলেছে। যদিও তার তরঙ্গে তরঙ্গে এক নতুন যুগের গান—পুরাতন দিনের ভবতারিণীর কানে সে সুর প্রবেশ করে না। বেচারী সুহাসিনী!
তার আর বিবাহ হল না।
বালবিধবা সুহাসিনী সে যুগের অন্ধ কুসংস্কারের যূপকাষ্ঠে আরো অনেক হতভাগিনীর মত বলি হয়ে গেল। ভাগীরথী কুলকুলু শব্দে কেবল বয়ে চলে।
***