মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ২৭

॥ সাতাশ ।।

অন্নপূর্ণার যেন বিস্ময়ের অবধি ছিল না। অকস্মাৎ অন্নপূর্ণা যেন একেবারে পাথর হয়ে যায়। রাধারমণ—তার স্বামীর ক্ষণপূর্বের কথাগুলো যেন তখনো তার কানের পর্দায় ঝমঝম করে বাজছে।

নিঃশব্দে দুই চক্ষু মেলে অন্নপূর্ণা কেবল তখনো স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে।

তুমি তাহলে জানকী দত্তর মাগীটার কাছেই মাঝরাত্তির পর্যন্ত রোজ রোজ কাটিয়ে আস!

হ্যাঁ, আসি। তাতে হয়েছেটা কি?

না, কিছুই হয়নি। শান্ত গলায় ধীরে ধীরে কথাগুলো উচ্চারণ করল অন্নপূর্ণা।

আমার যা খুশি তাই করব বুঝেছো? কারো তোয়াক্কা আমি করি না। রাধারমণ আবার চেঁচিয়ে উঠলেন।

লজ্জায়, আত্মধিক্কারে কিছুক্ষণ অন্নপূর্ণা স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, আমি আসন পাতছি, এস।

রাধারমণ বললেন—দরকার নেই, আমি খাব না।

খাবে না?

না, আমি সেখান থেকেই খেয়ে এসেছি।

অন্নপূর্ণা আর দাঁড়াল না। নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মধ্যরাত্রি তখন উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। হেমন্তকাল—রাত্রে হেমন্তের শিশির ঝরে। শিশির ভেজা বাতাসে বেশ একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। অন্দরমহলে কেউ জেগে নেই

অন্নপূর্ণা ঘর থেকে বের হয়ে বিরাট খোলা অন্ধকার আঙ্গিনায় এসে দাঁড়াল। ক্লান্ত অবসন্ন দৃষ্টি তুলে উপরের দিকে তাকাল। এদিক ওদিকে কিছু নক্ষত্র রাত্রির আকাশে পিটপিট করে জ্বলছে।

রাধানাথ! এ কি শুনতে হল আজ তাকে? এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে যখন আসে অন্নপূর্ণা, প্রথম প্রথম শাশুড়ির সঙ্গে একই ঘরে একই শয্যায় সে শুত। কখনো কোন রাত্রেই শ্বশুরঠাকুরকে সে ঘরে আসতে দেখেনি। সে আর তার শাশুড়িঠাকরুনই একটা ঘরে শুয়ে থাকত, ভবতারিণী দেবী বালিকা পুত্রবধূকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকতেন।

কতটুকুই বা বয়স তখন তার—বালিকা মাত্র। কিছুই বুঝতে পারত না, বোঝবার মত বয়সও ছিল না তার। তা সত্ত্বেও হঠাৎ এক দিন রাত্রে একটা চাপা কান্নার শব্দে তার ঘুমটা ভেঙে গেল। বিরাট পালঙ্কের উপরে সে আর ভবতারিণী শুতেন। বিরাট ঘরটি। এক কোণে পিলসুজের উপরে প্রদীপ জ্বলছে। তারই মৃদু আলোয় সারা ঘরে একটা আলো-আঁধারির সৃষ্টি হয়েছে।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে কান্নার শব্দ শুনে প্রথমটায় অন্নপূর্ণা কিছু বুঝতে পারে না। এদিক ওদিক তাকায় ঘুম-ভাঙা চোখে—কে কাঁদে!

তারপরই মনে হল অন্নপূর্ণার, তার পাশে শুয়ে তার শাশুড়িঠাকরুনই কাঁদছেন ফুলে ফুলে।

মা—মাগো? ঠেলা দিল অন্নপূর্ণা ভবতারিণীকে, বললে, কি হয়েছে মা, কাঁদছেন কেন মা?

কই মা, আমি তো কাঁদিনি।

অন্নপূর্ণা বললেন, হ্যাঁ, আপনি কাঁদছিলেন!

না মা, আমি কাঁদিনি। তুমি ঘুমোও বৌমা।

অন্নপূর্ণা আর প্রশ্ন করেনি। কিন্তু একটা ব্যাপার অন্নপূর্ণার যেন কেমন লেগেছিল সেই বয়সেই। দিনের বেলা তার শ্বশুরঠাকুরকে সর্বক্ষণই বাড়ির মধ্যে দেখতে পেত, তাঁর গলা তাঁর উপস্থিতি টের পেত—কিন্তু সন্ধ্যার পর সন্ধ্যাহ্নিক করে কিছু জলযোগ করে, কোচানো ধুতি পরে, ঝোলা বেনিয়ান গায়ে, গলায় পাকানো উড়ুনি, মাথায় টেরি, ছড়ি হাতে প্রত্যহই বের হয়ে যেতেন, সারাটা রাত আর ফিরতেন না। ফিরতেন সেই প্রত্যুষে।

কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে বালিকা অন্নপূর্ণা কখনো মাথা ঘামায়নি। কেবল একদিন শাশুড়িকে শুধিয়েছিল।—মা, ঠাকুরকে রাত্রিতে দেখি না কেন?

ভবতারিণী বালিকা পুত্রবধূর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কি জবাব দেবেন তিনি যেন বুঝতে পারেন না।

ঠাকুরের ঘরটা রাত্রে দেখি বাইরে থেকে শেকল তোলা থাকে।

উনি বাইরে শোন। মৃদু কণ্ঠে অতঃপর জবাব দিয়েছিলেন ভবতারিণী।

সেদিনও শাশুড়ির কথাটা সরল মনে বিশ্বাস করে নিয়েছিল অন্নপূর্ণা, আর দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করেনি।

কিন্তু বড় হবার পর অন্নপূর্ণা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। শ্বশুরঠাকুর রাত্রে গৃহেই থাকেন না, তাঁর এক রক্ষিতা আছে, সেখানেই তার গৃহে রাত্রি যাপন করেন। সেই দিন শাশুড়ির কান্নার কারণটাও তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে একটা অহেতুক আশঙ্কাও তার মনের মধ্যে ক্রমশ দানা বেঁধে উঠেছিল।

তার স্বামীও কি শেষ পর্যন্ত শ্বশুরঠাকুরের মত গৃহের বাইরে রাত্রি যাপন করবে নাকি! তাকেও কি ঠাকরুণের মত প্রতি রাত্রে চোখের জলে উপাধান সিক্ত করতে হবে!

কিন্তু আশঙ্কার কথাটা অন্নপূর্ণা কখনো স্বামীকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি, কিন্তু মধ্যে মধ্যে জেগে উঠে দেখত স্বামী তার শয্যায় আছে কিনা।

রাধারমণ বোধ হয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই একদিন শুধিয়েছিলেন— প্রায় দেখি বড়বৌ, তুমি রাত্রে জেগে ওঠ। তোমার কি রাত্রে ভাল ঘুম হয় না?

কেন, ঘুম হবে না কেন?

তবে বার বার জেগে ওঠ কেন?

ও কিছু না।

কিছু না মানে? কি ব্যাপার বল তো?

বলছি তো ও কিছু না।

কিন্তু রাধারমণকে নিবৃত্ত করতে পারেনি অন্নপূর্ণা। রাধারমণ শেষ পর্যন্ত অন্নপূর্ণার কাছ থেকে কথাটা শুনে তবে থেমেছিলেন।

অন্নপূর্ণা বলেছিল—আমার ভয় করে।

ভয় করে? কিসের ভয় বড়বৌ?

না, কিছু না!

বল, বল।

দেখি কি জান?

কি?

শয্যায় তুমি আছ কিনা।

তার কিছুদিন পূর্বেই রাধারমণের পিতৃদেব স্বর্গে গেছেন। রাধারমণ বললেন মৃদু হেসে—ভয় নেই বড়বৌ, সে রকম প্রবৃত্তি আমার কোনদিনই হবে না।

ঠিক বলছ?

হ্যাঁ বড়বৌ! তোমার মত স্ত্রী যার, সে কোন্ দুঃখে অন্য স্ত্রীলোকের কাছে যাবে?

বড় পিসীঠাকরুন কি বলছিলেন সেদিন জান?

কি বলছিল?

পুরুষ মানুষ—তাকে নাকি বিশ্বাস নেই—

না বড়বৌ, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। তোমাকে ছাড়া আর কোন স্ত্রীলোকে আমার কখনো প্রবৃত্তি হবে না।

সত্যিই এত বৎসর অন্নপূর্ণা তার কোন ব্যতিক্রম দেখেনি। তাইতেই বুঝি স্বামীর দিক থেকে সে সত্যিই নিশ্চিন্ত ছিল। কত জনের কত কথা তার কানে এসেছে কত সময়, কিন্তু তার স্বামী সম্পর্কে কেউ কখনো কিছু বলতে পারেনি। অন্নপূর্ণার সে কারণে গর্বেরও বুঝি অন্ত ছিল না। সেই গর্ব—সেই বিশ্বাস যে মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল কাদম্বিনীর কথায়, অন্নপূর্ণার পায়ের তলা থেকেই যেন মাটিটা সরে গেল।

অন্নপূর্ণার সব কিছুই যেন কেমন শূন্য, অর্থহীন মনে হয়। কাঁদতে পারে না অন্নপূর্ণা। চোখের কোণ দুটো যেন জ্বালা করতে থাকে। আজ যেন তার মনে হয়—সব কিছু মিথ্যা হয়ে গিয়েছে। তার সংসার—তার বাসনা কামনা—সব আজ যেন মিথ্যা হয়ে গিয়েছে।

মা!

হঠাৎ সুহাসিনীর ডাকে চমকে ওঠে অন্নপূর্ণা। কখন সুহাসিনী এসে সামনে দাঁড়িয়েছে অন্নপূর্ণা টেরও পায়নি।

একা এই আঙ্গিনার মধ্যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছ কেন মা? চল শোবে চল—বলতে বলতে সুহাসিনী এসে মায়ের একটা হাত ধরল।

হঠাৎ সুহাসিনীকে দুহাতে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে হাউ মাউ করে একেবারে কেঁদে উঠল অন্নপূর্ণা।

সুহাসিনী সব কথাই শুনেছিল পাশের ঘর থেকে তার মা ও বাবার। মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মাকে কি করে, কি বলে যে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারে না। কোন মতে মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়।

.

অম্বিকাচরণের পিতা অনাদিচরণ ঘোষাল তখনকার দিনে কলকাতা শহরের রীতিমত একজন ধনী ব্যক্তি ছিলেন। মুৎসুদ্দির কাজ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন। ঠনঠনের কাছে বিরাট তাঁর বাড়ি। আত্মীয়-স্বজন, দাস-দাসীতে সর্বদা রমরম করত। একমাত্র পুত্র তাঁর অম্বিকাচরণ। পুত্রকে অনাদিচরণ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। পর পর চারটি সন্তানের জন্মের পরপরই মৃত্যু হওয়ায় অম্বিকাচরণের প্রতি তাঁর স্নেহ ও প্রশ্রয় দুটোই মাত্রাধিক্য ছিল।

সাহেবসুবোদের সঙ্গে মিশে মিশে অনাদিচরণ বাইরে আচার-ব্যবহারে অনেকটা সাহেবী ভাবাপন্ন হলেও মনের মধ্যে রীতিমত গোঁড়ামি ভাব ছিল। তা হলেও কালের সঙ্গে পা ফেলে চলতে তিনি কখনো পিছপাও ছিলেন না। তাইতেই তাঁর একমাত্র পুত্রকে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করবার জন্য হিন্দু কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।

তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন কালের সঙ্গে সমানভাবে পা ফেলে চলতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ইংরেজী শিক্ষার—কিন্তু অনাদিচরণ স্বপ্নেও ভাবেননি ইংরেজী শিক্ষার প্রভাবে ছেলের মতিগতি অন্যরকম হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত সে খ্রীস্টান ধর্মগ্রহণ করতে বদ্ধপরিকর হবে।

অনেক দেখেশুনে পুত্রের বিবাহ দিয়েছিলেন অম্বিকাচরণ, যখন সে মাত্র কিশোর। পুত্রবধূ নির্বাচনে অনাদিচরণ ভুল করেননি। সুধাময়ী যেমন দেখতে লক্ষ্মী প্রতিমার মত, তেমনি বুদ্ধিমতী।

ছেলেকে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন—সেই কথা ভেবেই অনাদিচরণ পুত্রবধূ সুধাময়ীকেও বেথুন স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, যাতে করে সে তার পুত্রের যোগ্য সহধর্মিণী হতে পারে।

কিন্তু সুধাময়ী যতই লেখাপড়া করুন না কেন পরম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের পৌত্রী ও কন্যা হওয়ায় হিন্দুর আচার-ধর্মের প্রতি তার একটা প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সংঘর্ষ বাধল সেইখানেই।

অম্বিকাচরণের কাছে আদর্শ ছিল তখনকার দিনের মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন। মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করত অম্বিকাচরণ মাইকেলকে। যেমন করে নিষ্ঠাবান হিন্দু মা-বাপের ঘরে জন্ম নিয়েও সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করে মাইকেল একদিন খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, ইংরেজী শিক্ষাকে, তাদের আচার ব্যবহার ধর্মকে মনেপ্রাণে সর্বতোভাবে গ্রহণ করবার জন্য—সব শুনেছিল অম্বিকাচরণ। মনে হয়েছিল এই তো আদর্শ।

তারপর তাদের গৃহের সন্নিকটেই রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়—তাঁর সাহিত্য ও জ্ঞানের তুলনা ছিল না এবং সেখানে প্রায়ই যেত অম্বিকাচরণ—তার মনের মধ্যে রীতিমত একটা প্রভাব বিস্তার করছিল। এবং সেই প্রভাবের বশবর্তী হয়েই তার মনের মধ্যে খ্রীস্টানধর্ম গ্রহণের অঙ্কুর জাগরিত হয়। পাক্কা এবং পুরোপুরি একজন সাহেব হতে হলে এই পচা পুরাতন হিন্দুধর্মের গোঁড়ামির মধ্যে বাস করে কোনক্রমেই সেটা সম্ভব হবে না। তাকেও খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর তারপর সে যাবে সাগরপাড়ি দিয়ে ইংলন্ডে—জ্ঞানের সাগর মন্থন করতে, এবং মনের বাসানাটা একদিন সর্বপ্রথমে অম্বিকাচরণ স্ত্রী সুধাময়ীর কাছে ব্যক্ত করে।

দেখ সুধা, একজন মানুষের মত মানুষ হতে হলে কেবলমাত্র ইংরেজী শিক্ষা নিলেই সেটা সম্ভব নয়।

তবে কি করতে হবে শুনি? সুধাময়ী প্রশ্ন করে স্বামীকে।

মাইকেল মধুসূদনের নাম শুনেছ?

শুনেছি বৈকি, ওই যে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে যিনি ম্লেচ্ছর ধর্ম গ্রহণ করেছেন।

অমন উদার খ্রীস্টধর্ম, তাকে তুমি ম্লেচ্ছর ধর্ম বল?

ম্লেচ্ছ ছাড়া কি? বাবা বলেন—পরধর্মো ভয়াবহ।

না না, শোন, আমি কি ভাবছি জান?

কি?

আমি খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করবো।

কি! কি বললে? অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে সুধাময়ী।

খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করবো।

তোমার কি মাথা খারাপ হল? ছিঃ ছিঃ! কথাটা ভাবলে কি করে? কথাটা শুনেই গা আমার গুলোচ্ছে।!

গা গুলোচ্ছে তোমার সুধাময়ী?

হ্যাঁ-

কিন্তু তুমিও শুনে রাখ সুধাময়ী, আমি মনঃস্থির করেছি খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করে সাগরপাড়ি দিয়ে আমার মানসভূমি ইংলন্ডে যাব।

মানে-

মানে তোমাদের বিলেতে যাব।

ও গো, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, ও কাজ তুমি করো না—ওতে করে কোন মঙ্গল হবে না, ধর্মে পতিত হলে সবাই তোমাকে ত্যাগ করবে!

করুক, মাইকেলকেও সবাই ত্যাগ করেছে—তাতে কি হল তাঁর! তিনি মাদ্রাজে চলে গেলেন—সেখানে বসে Captive Lady লিখলেন—ইংরেজীতে যদি পড়তে সে কাব্য! দেখো তিনিও একদিন দান্তে-হোমার-ভার্জিলের মত মহাকবি হবেন—

তাই যদি হবে তো আবার তিনি সেই ইংরেজী ছেড়ে মেঘনাদবধ কাব্য রচনা করলেন কেন?

ওটাই তো জিনিয়াসের লক্ষণ। বিরাট এক প্রতিভার লক্ষণ। শোন সুধাময়ী, বিলেত আমায় যেতেই হবে—আর সেটার সুবিধা হবে খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করলে।

তোমার দুটি পায়ে পড়ি, ওই সব মতলব ছাড়। ঠাকুর—তোমার বাবা ওকথা জানতে পারলে হয়ত অন্ন-জল ত্যাগ করবেন।

তা যদি করেনই তিনি তা করবেন।

তুমি পিতৃঘাতী হবে।

কিছুই হবে না, তুমি দেখে নিও সুধাময়ী—মধুসূদনের বাবা রাজনারায়ণ দত্ত কি আত্মঘাতী হয়েছেন? বরং পুত্রার্থে আবার বিবাহ করেছেন, না, কেউ আমার সংকল্পে বাধা দিতে পারবে না।

তুমি তাহলে আমাকেও ত্যাগ করবে?

ত্যাগ কেন করব? তুমি আমার সহধর্মিণী।

ত্যাগ ছাড়া কি? তুমি ধর্মান্তর গ্রহণ করবে, আমি কেমন করে আর তোমার প্রতি স্বামীর কর্তব্য পালন করবো?

সে কি! তুমি আমারই সঙ্গে থাকবে—আমার গৃহে—

না-

কি না—

তুমি ধর্মান্তর গ্রহণ করলে আমার পক্ষে তখন আর সেটা সম্ভব হবে না।

সম্ভব হবে না?

না।

তুমি কি আমার সহধর্মিণী নও, আমার সঙ্গে কি তোমার অগ্নি নারায়ণশিলা সাক্ষী রেখে মন্ত্র পড়ে বিবাহ হয়নি?

কিন্তু যে ধর্মমতে তোমার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়েছে সেই ধর্মই তো তুমি ত্যাগ করছ—

কেন—তুমিও আমার সঙ্গে ধর্মান্তর গ্রহণ করতে পারবে না?

না।

পারবে না।

না।

কিন্তু স্বামীর ধর্মই তো স্ত্রীর ধর্ম সুধাময়ী—তোমাদের শাস্ত্রেই তো তা বলে।

কিন্তু আমাদের ধর্ম তো তুমি ত্যাগ করছ।

একদিনই নয়—তারপর আবার অনেকদিন অনেকবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ওই আলোচনা হয়েছে, কিন্তু সুধাময়ী অনমনীয়া। তার সেই এক কথা।

কথাটা ক্রমশ অনাদি ঘোষালেরও কানে উঠল তাঁর একমাত্র পুত্র ধর্মান্তর গ্রহণ করছে।

অনাদি ঘোষালের স্ত্রী কৃপাময়ী দেবীও স্বামীর মুখ থেকে কথাটা শুনে কেঁদে উঠলেন। বললেন—সে কি গো, কি বলছ তুমি!

যা বলছি তা সত্য।

না না, তা হয় না। হতে পারে না—

সেই দিনই সন্ধ্যার পর অম্বিকাচরণ যখন কলেজ থেকে ফিরেছে, কৃপাময়ী পুত্রের ঘরে ছুটে গেলেন সোজা।

বাবা?

কে? মা!

হ্যাঁ বাবা, এ কি শুনছি! কি শুনছ মা?

তুই নাকি ম্লেচ্ছর ধর্ম নিবি?

হ্যাঁ মা, তুমি ঠিকই শুনেছ।

ওরে না, না, অমন কাজ করিস না!

আমি সব একেবারে স্থির করে ফেলেছি মা।

কিন্তু কেন? কেন তুই ধর্মান্তর গ্রহণ করবি? কিসের দুঃখ তোর? কিসের অভাব

তবে সত্যি কথাটাই বলি তোমাকে। আমি মা—আমি বিলেত যেতে চাই। ধর্মান্তর গ্রহণ করলে সেটা সহজ হবে—

বিলেত যাবি?

হ্যাঁ মা, আমার স্বপ্ন বিলেত—ইংলন্ড।