।। ছাব্বিশ ।।
কথাটা শুনেই অন্নপূর্ণা একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে—কি বললে, কি করে ওসব ছাইভস্ম ভাবতে পারলে।
রাধারমণ মল্লিক বললেন, আগে আমার কথাটা ভাল করে শোনই না বড়বৌ।
ওসব ছাইভস্ম কি শুনব শুনি?
দ্যাখ বিদ্যাসাগর মশাই শুধু অসাধারণ পণ্ডিতই নন, আজকের সমাজের একজন কেউকেটা, বিশিষ্ট একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি। ব্যাপারটা অন্যায় বা ধর্ম-বিরুদ্ধ হলে কি তিনি—তাঁর মত একজন লোক—আইন পাস করাতেন সাহেবদের ধরে এত পরিশ্রম করে?
মুখে আগুন তোমার অমন লেখাপড়ার, অমন পণ্ডিতের! বিধবার আবার বিয়ে! ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ-!
আমি আজ বিদ্যাসাগর মশাইয়ের ওখানে গিয়েছিলাম। তাঁকে সুহাসের সব কথা বললাম। তিনি বললেন, বিধবা বিবাহের এই তো যোগ্যতম পাত্রী। তাছাড়া—
থামো, থামো! ওসব কথা শুনলেও পাপ হয়। গঙ্গাস্নান করতে হয়, প্রাচিত্তির করতে হয়।
সে তুমি যাই বল, আমি কিন্তু স্থির করেছি বড়বৌ, উপযুক্ত পাত্র পেলে আবার সুহাসের বিয়ে দেব।
আমি তাহলে ঠিক জেনো, হয় গলায় দড়ি দিয়ে না হয় গঙ্গার জলে ডুবে মরব।
বড়বৌ!
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওর কপালে নেই স্বামীর ঘর করা। নচেৎ এমনটাই বা হবে কেন? পোড়াকপালী যে কর্ম করে এসেছে, তেমনি ফলভোগ ওকে করতেই হবে।
কর্ম, কর্মের ফলভোগ, ওসব কতকগুলো কুসংস্কার।
না, কুসংস্কার নয়। হিন্দুধর্ম মিথ্যা তুমি বলতে চাও?
মিথ্যা আমি বলি না, তবে সেই ধর্মের নামে যা সব চলেছে দেখছি—
ছিঃ ছিঃ, বলো না—বলো না ওসব কথা। হ্যাঁগো, তুমি দিন দিন এমন ম্লেচ্ছ হয়ে উঠছ কেন? ওইসব ফিরিঙ্গিগুলোর সঙ্গে মিশেমিশেই তোমার মতিগতি অমন হচ্ছে দিনকে-দিন। এরপর ঠাকুরপুজোও হয়তো করবে না। সন্ধ্যা-আহ্নিকও করবে না।
বড়বৌ, বাইরের জগতে তো পা দিলে না কোনদিন। যুগ যে পালটেছে এবং প্রতিদিন পালটাচ্ছে, সে খবর তো রাখ না। রাখলে—
থাক, থাক। তিন কাল গিয়ে আর এক কাল আছে, এখন আর আমার ওসব জানবার প্রয়োজন নেই।
কূপমণ্ডূক আর কাকে বলে! রাধারমণ মল্লিক হাসতে থাকেন, বিদ্যাসাগর মশাই অধার্মিক নন।
আমিও তোমাকে বলে রাখছি, এসব ভাল নয়। হিন্দু হয়ে সনাতন হিন্দুধর্ম মানব না, এ পাপ—মহাপাপ।
রাধারমণ মল্লিক স্ত্রী অন্নপূর্ণাকে তো জানেন। তাই আর বেশী কথা বললেন না। কিন্তু তাই বলে মেয়ের পুনর্বিবাহের কথাটা ভোলেন না, ভুলতে পারেন না। মন থেকে কিছুতেই যেন কথাটা মুছে ফেলতে পারেন না।
বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মত অত বড় পণ্ডিত, যিনি সমস্ত শাস্ত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন—অমন দেবতুল্য চরিত্র, দয়ার সাগর, তিনি কি কখনো অন্যায় বা অযৌক্তিক কথা বলতে পারেন? তাছাড়া তাঁর নিজের ছেলে নারায়ণ তো বিধবা বিবাহ করেছেন। অন্যায় বা অধর্মের ব্যাপার হলে কি বিদ্যাসাগরমশাই সেই বিধবা মেয়েটিকে আপন পুত্রবধূ বলে মেনে নিতে পারতেন? সগর্বে সেকথা উচ্চকণ্ঠে সকলের সামনে বলতে পারতেন? না, অন্যায় অধর্ম বা পাপ কিছুই নেই বিধবার পুনর্বিবাহের মধ্যে। বিশেষ করে তাঁর সুহাসনীর মত বাল-বিধবাদের বিবাহের মধ্যে
যে যাই বলুক, কারো কথাই তিনি শুনবেন না।
কিন্তু মনে মনে রাধারমণ মল্লিক যাই ভাবুন না কেন, স্ত্রী অন্নপূর্ণার কথাটাও একেবারে মন থেকে দূর করতে পারেন না। বস্তুত তিনি অন্নপূর্ণাকে যেন কিছুটা ভয়ই করতেন। বিশেষ করে সেই ভয়টা যেন একটু বেশী করেই তাঁকে পেয়ে বসেছিল ইদানীং জলদবালার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর থেকে।
জলদবালার মোহপাশ ছিন্ন করবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন রাধারমণ মল্লিক, কিন্তু পারেননি।
শুধু যে পারেননি তা নয়, ক্রমশ যত দিন যাচ্ছিল রাধারমণ যেন ততই বেশী করে জলদবালার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছিলেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধা এলেই যেন দুর্বার এক আকর্ষণ তাঁকে জলদবালার গৃহের দিকে টানতে শুরু করত। তাকে একটিবার দেখবার জন্য মনটা হাঁপিয়ে উঠত।
মনকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন রাধারমণ, এ তাঁর অন্যায়-অন্যায়কে তিনি প্ৰশ্ৰয় দিচ্ছেন। কিন্তু সমস্ত যুক্তি যেন বন্যার জলে কুটোর মতই ভেসে যেত।
প্রথম প্রথম কেউ যাতে না দেখতে পায়, রাত্রির অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পায়ে হেঁটে যেতেন জলদবালার গৃহে, কিন্তু ক্রমশ যত দিন যেতে লাগল, তাঁর সমস্ত সংকোচ ও লজ্জা যেন কোথায় চলে যেতে লাগল। সহিস আবদুলকে বলতেন ব্রহাম নিয়ে আসতে। সেই ব্রুহামে চেপেই যেতেন জলদবালার গৃহে। ব্রুহাম দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত নির্জন পথে—ফিরবার সময় আবার সেই ব্রুহামে আরোহী হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতেন।
লোহার গেট দিয়ে রাত একটা সোয়া একটার সময় আরবী ঘোড়া খুরের খটখট শব্দ তুলে গাড়িবারান্দার সামনে এসে দাঁড়াত। রাধারমণ ব্রহাম থেকে অবতরণ করে ভিতরে প্রবেশ করতেন।
কিন্তু গৃহাভ্যন্তরে পা দিয়েই কেমন যেন থমকে যেতেন। বিরাট মল্লিকবাড়ি তখন সুষুপ্তিমগ্ন। অন্দর ও বহির্মহলের ঘরে ঘরে তখন সকলেই প্রায় নিদ্রার ঘোরে ঢলে পড়েছে। মধ্যরাত্রির স্তব্ধতা চারিদিকে, দূর থেকে ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসছে। তা সত্ত্বেও আপনা হতেই কেন জানি রাধারমণের গতি শ্লথ হয়ে আসত। পা টিপে টিপে অন্দরমহলে গিয়ে প্রবেশ করতেন, যেন অনেকটা চোরের মতই।
মনের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়ের দোটানা আবার শুরু হয়ে যেত। অবচেতন মনের মধ্যে জলদবালার ব্যাপারে যে ভয়টা তাঁকে অস্থির করে রাখত সেই ভয়টাই যেন সমস্ত চেতনার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠত।
ভয় স্ত্রী অন্নপূর্ণাকে।
যদিও জলদবালার কথাটা স্ত্রী অন্নপূর্ণা যাতে কোনমতে জানতে না পারে সেজন্য অতিমাত্রায় সতর্ক ছিলেন, তথাপি প্রতিরাত্রেই গৃহে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রহাম থেকে নেমে ওই ভয়টা যেন চারিদিক থেকে তাঁকে চেপে ধরত।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতে থাকেন রাধারমণ, জলদবালার মোহপাশ তাঁকে ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু রাত্রের সেই প্রতিজ্ঞা প্রত্যুষের আলোয় কোথায় যেন বিলীন হয়ে যেত।
সেরাত্রেও ব্রুহাম থেকে নেমে পা টিপে টিপে বহির্মহল থেকে যখন অন্দরমহলে প্রবেশ করছেন, বুকটার মধ্যে তাঁর একটা কাঁপুনি শুরু হয়েছে—সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে প্রায় নিঃশব্দ পদসঞ্চারের মধ্য দিয়ে যেন নিজেকেই নিজের কাছে গোপন করতে চাইছিলেন। হঠাৎ বহির্মহল অন্দরমহলের সংযোগপথের ঝাপসা আলো- আঁধারের মধ্যে একটা মূর্তি দেখে থমকে দাঁড়ালেন রাধারমণ।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাতেই বুঝতে পারলেন, বহির্মহল ও অন্দরমহলের সংযোগ- পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক নারীমূর্তি।
কে—কে ওখানে?
আস্তে, চেঁচিও না। আমি। চাপা নারীকণ্ঠে জবাব এল।
সেই চাপা নারী-কণ্ঠস্বর চিনতে এতটুকুও কষ্ট হয় না রাধারমণের এবং সঙ্গে সঙ্গে যেন রাধারমণ একেবারে পাথর হয়ে যান।
এসো। নারীকণ্ঠ হতে আবার মৃদু আহ্বান উচ্চারিত হল।
নিজের অজ্ঞাতেই যেন এক সময় রাধারমণ সেই আহ্বানে সামনের দিকে এগিয়ে যান।
নিজের শয়নকক্ষে এসে প্রবেশ করলেন রাধারমণ মল্লিক, সেই নারীমূর্তির পিছনে পিছনে তাকে অনুসরণ করে।
সেই নারী-মূর্তি আর কেউ নয়—স্ত্রী অন্নপূর্ণা।
ঘরের মধ্যে অনুজ্জ্বল সেজবাতি জ্বলছিল। তারই আলোয় কক্ষ মৃদু আলোকিত।
রাধারমণ যেন কোনমতেই চোখ তুলে তাকাতে পারছিলেন না তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণার দিকে। অন্নপূর্ণা সত্যিই মর্মান্তিক আঘাত পেয়েছিলেন তাঁর স্বামীর অন্য নারীতে আসক্তির কথাটা শুনে। সেরাত্রে দীঘির ঘাটে উচ্চকণ্ঠে যে কথাগুলো ভোলানাথ আনন্দকে বলেছিল সে কথাগুলো আনন্দচন্দ্র একেবারে চেপে গেলেও চাপা থাকেনি।
সংসারে এক ধরনের মানুষ আছে যারা এই ধরনের কেচ্ছা-সংবাদ আর দশজনের কাছে রসালো করে বলে তৃপ্তি পায়। মানুষের দুর্বলতার কথাকে অন্যের কাছে প্রকাশ করে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি পায়।
মল্লিকবাড়ির আশ্রিতা কাদু ঠাকরুন অর্থাৎ কাদম্বিনী ঠাকরুন, রাধারমণ মল্লিকের দূর সম্পর্কীয়া জ্যাঠতুত বোনের কন্যাটি ছিল সেই প্রকৃতির। সংসারের কোন কাজকর্মই করত না, কেবল ঘরে ঘরে অন্দরমহলে ঘুরে বেড়াত আর তার ছিদ্রান্বেষী দুটি চোখ আর দুটি কান কোথায় কি দেখা যায়, কোথায় কি শোনা যায় তাই দেখে ও শুনে বেড়াত।
আনন্দচন্দ্র সেরাত্রে ব্যাপারটা চেপে গেলেও, কাদু ঠাকরুনের কর্ণে মোটামুটি সব কথাই প্রবেশ করছিল।
সন্ধ্যায় নিত্য দীঘির জলে স্নান করা ছিল কাদু ঠাকরুনের একটা অভ্যাস। সেদিন সন্ধ্যারাত্রে ভোলানাথ যখন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথাগুলো বলছিল, গায়ে গামছাটা জড়িয়ে অন্ধকারে কাদু ঠাকরুন স্নান করতে ঘাটের দিকে আসছিল।
ঘাটের কাছাকাছি আসতেই ভোলানাথের উচ্চকণ্ঠ তার কানে আসে। ভোলানাথ স্থান কাল পাত্র ভুলে তখন হিংস্রকণ্ঠে বলে চলেছে সুহাসিনীকে, হ্যাঁগো ঠাকরুন, তোমার বাবা—শহরে যে একেবারে ঢিঢি পড়ে গিয়েছে, জানকী দত্তের রক্ষিতা মাগীটাকে নিয়ে—
কাদু ঠাকরুন থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল কথাটা তার কানে যেতেই।
আনন্দচন্দ্র লক্ষ্য করেনি, কারণ তার কান পড়েছিল ভোলানাথ কি বলছে সেই দিকে। নচেৎ তার হাত-পাঁচেক দূরে একটা শ্বেতকরবীর ঝোপের পাশে দাঁড়িয়েছিল কাদম্বিনী।
তার পরের সব কথাই কাদু ঠাকরুনের কানে এসেছিল।
কাদু ঠাকরুনের আর স্নান করা হল না, ভুলে গেল সে একটু আগে স্নান করতে গিয়েছিল দীঘির ঘাটে। এমন একটা রসালো সংবাদ শোনার পরও কি আর স্নানের কথা মনে থাকে! কাদু ঠাকরুন ফিরে চলল অন্দরমহলের দিকে।
অন্দরমহলে পা দিয়েই চারিদিকে তাকাল কাদু ঠাকরুন, কিন্তু অন্নপূর্ণাকে কোথাও দেখতে পেল না। তখন বুঝল কাদু ঠাকরুন, অন্নপূর্ণা মন্দিরেই আছেন। কারণ ইদানীং কর্ত্রীঠাকরুণ ভবতারিণী দেবী সংসারের সব কিছু থেকেই সরে গিয়েছিলেন। তা ছাড়া বাতের ব্যথায় ক্রমশ যেন তিনি পঙ্গু হয়ে যাচ্ছিলেন। কাজেই সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে গৃহদেবতা রাধানাথের সকলপ্রকার পরিচর্যার ভারটাও অন্নপূর্ণার স্কন্ধেই এসে পড়েছিল।
সন্ধ্যারাত্রিটা অন্নপূর্ণাকে গৃহদেবতার শেতলভোগ, সন্ধ্যারতির ব্যবস্থা প্রভৃতি নিয়েই থাকতে হত।
ভোলানাথকে যে গৃহ ছেড়ে চলে যাবার কথাটা তার মাতা মঙ্গলাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা কাদু ঠাকরুনের অজ্ঞাত ছিল না। কথাটা শোনা অবধি তার মনটা ছট্ফট করছিল। এ বাড়ি থেকে ভোলানাথ চলে গেলে কাদম্বিনী বাঁচবে কি করে!
কেমন করে ভোলানাথহীন এই মল্লিকবাড়িতে সে টিকবে? কিন্তু কাদু ঠাকরুন প্রতিকারের কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিল না। অন্নপূর্ণাকে সে ভাল ভাবেই চেনে। একবার যখন সে তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে, তাকে আর টলানো যাবে না, কাদু ঠাকরুন জানত।
ভোলানাথকে মল্লিকবাড়ি ছাড়তেই হবে। ভোলানাথের কথা ভেবে ভেবে কাদু ঠাকরুন যখন কোন দিকে কোন দিশা খুঁজে পাচ্ছে না, ঠিক সেই সময় তার কানে এল কত্তার কেচ্ছার সংবাদটা। কাদু ঠাকরুন স্নানের কথাও ভুলে গেল——ছুটল অন্নপূর্ণার সন্ধানে।
সন্ধ্যারতি তখন সবে শেষ হয়েছে। পুরোহিত কুলদাচরণ ঠাকুরকে শেতলভোগ দিয়ে মন্দির থেকে বের হয়ে এলেন। অন্নপূর্ণা মন্দিরের অভ্যন্তরে সব কিছু রাত্রির মত গুছিয়ে রাখছিলেন, মন্দিরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কাদম্বিনী। কাদম্বিনী অন্নপূর্ণাকে বৌঠান বলেই ডাকে।
ডাকল কাদম্বিনী, মামী!
কে? সাড়া দিল অন্নপূর্ণা।
আমি কাদু, মামী।
অ—কাদু! তা বাইরে কেন, ভিতরে আয় না রে।
না মামী, এখন আমি মন্দিরের মধ্যে যাব না, এখনো সন্ধ্যার স্নান আমার হয়নি।
অন্নপূর্ণা জানত কাদম্বিনী প্রত্যহ সন্ধ্যায় স্নান করে।
তা হ্যাঁ রে, কিছু বলবি?
হ্যাঁ মামী, একটা কথা আছে।
দাঁড়া বাসনপত্রগুলো গুছিয়ে আসছি।
ঠিক আছে, তুমি এসো আমি দাঁড়াচ্ছি। কাদম্বিনী বলল।
কিছুক্ষণ পরে অন্নপূর্ণা মন্দিরের পুজোর বাসনপত্র সব গুছিয়ে রেখে প্রদীপদানের ওপরে প্রদীপের শিখাটা একটু উস্কে দিয়ে বাইরে এল।
অন্নপূর্ণার পরনে চওড়া লালপাড় মুর্শিদাবাদের গরদের শাড়ি, মাথার চুল খোলা, বুকের এক পাশ দিয়ে ঘন চুলের গোছা নেমে এসেছে। মাথার উপরে স্বল্প ঘোমটা।
নাটমন্দিরে তখন কেউ ছিল না। একটি মাত্র আলো নাটমন্দিরের ছাত থেকে ঝুলছে। তারই মৃদু আলোয় একটা মৃদু আলো-আঁধারির সৃষ্টি করেছে যেন নাটমন্দিরে।
নাটমন্দিরটি বিরাট। ওই নাটমন্দিরেই প্রতি বৎসর দুর্গোৎসব ও কালীপূজা হয়। রাধানাথের মন্দিরে স্থান-সংকুলান হয় না।
অন্নপূর্ণা কাদম্বিনীর সামনে এসে দাঁড়ান, কি রে?
একটা কথা আজ কিছুদিন থেকেই শুনছি মামী –
কাদম্বিনীর ভণিতাতেই কেন না-জানি অন্নপূর্ণার বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে। ওই স্ত্রীলোকটিকে অন্নপূর্ণা ভাল ভাবেই চেনে। কোন ভাল কথাই ওর মুখ থেকে কখনো আজ পর্যন্ত শোনেনি অন্নপূর্ণা।
কি হয়েছে কি! অন্নপূর্ণার গলার স্বরটা যেন কেঁপে ওঠে।
কাদম্বিনী একবার চারিদিকে তাকাল সতর্ক দৃষ্টিতে, তারপর কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বললে, শোনা অবধি কথাটা আমার বুকের মধ্যে যে এ ক’দিন ধরে কি হচ্ছে মামী!
কথাটা কি?
বড় দুঃখের—বড় লজ্জার কথা মামী।
কাদু, কথাটা কি!
কি করে বলবো তাই ভাবছি মামী। হে ঠাকুর, কথাটা যা শুনেছি তা যেন সত্যি না হয়।
কাদু, কথাটা কি? অন্নপূর্ণা এবার রীতিমত অধৈর্য কণ্ঠে প্রশ্ন করে, একটু যেন রূঢ়ভাবেই।
কথাটা মামা সম্পর্কে মামী—
মামা!
হ্যাঁ, মামা
কি কথা?
না, থাক মামী—বড় নোংরা, বড় লজ্জা, বড় ঘেন্নার কথা। ও ছাইভস্ম শুনে তোমার কাজ নেই। রলে কাদম্বিনী চলে যাবার জন্য পা বাড়ায়।
কাদু!
কাদম্বিনী অন্নপূর্ণার সেই কণ্ঠস্বরে ঘুরে দাঁড়ায়।
কি কথা বল্
বলব?
হ্যাঁ, বল্।
কোন্ এক জানকী দত্তমশাই না কে, তার এক রক্ষিতা ছিল—
বিদ্যুতের একটা তীব্র কশাঘাত যেন অন্নপূর্ণার গায়ে এসে পড়ে। দত্তমশাইয়ের রক্ষিতা—তবে কি কর্তার বন্ধু মৃত জানকী দত্তর রক্ষিতা। অন্নপূর্ণার কণ্ঠ দিয়ে আর শব্দ বের হয় না।
কাদম্বিনী তখন বলে চলেছে, ছিঃ ছিঃ, কি ঘেন্না—কি লজ্জা! সেই বেবুশ্যে মাগীর কাছে নাকি মামা রোজ রাত্রে যায়। তাকে নিয়ে নাকি সারাটা রাত ধরে—
অকস্মাৎ তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল অন্নপূর্ণা, হারামজাদী, তোর এত বড় স্পর্ধা! কার নামে কি বলছিস তুই জানিস? বেরো—বেরো তুই আমার সামনে থেকে।
তা যেতে বলছ যাচ্ছি মামী, আমার মুখ না হয় তুমি বন্ধ করলে, কিন্তু বাইরের সমাজের আর দশজনের মুখ তুমি পারবে বন্ধ করতে? বাইরে যে মামার কেচ্ছা নিয়ে একেবারে ঢি-টিক্কার পড়ে গেছে, কান পাতা যাচ্ছে না।
এখনো দাঁড়িয়ে আছিস? বেরো—বেরো আমার সামনে থেকে
কাদম্বিনী আর দাঁড়াতে সাহস পায় না। অন্নপূর্ণার অমন উগ্র রণরঙ্গিনী মূর্তি ইতিপূর্বে আর কখনো সে দেখেনি।
অন্নপূর্ণা সত্যিই তখন কাঁপছিল থরথর করে।
কাদম্বিনী চলে যাবার পরও শূন্য নাটমন্দিরে পাথরের মত অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল অন্নপূর্ণা। হে রাধানাথ, এ কি শুনল সে!
ঝরঝর করে তার দুচোখের কোণ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমে এল। এই—এই জন্যই তার স্বামীর আজকাল গৃহে ফিরতে রাত হয়—একটা দেড়টার আগে ফেরে না এবং এর আগে সামান্য কানাঘুষায় যা তার কানে এসেছে তাও তাহলে সত্যি।
জানকী দত্তর রক্ষিতা মাগী!
.
অন্নপূর্ণা স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বামীর মুখের দিকে।
কি দেখছো অমন করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে? রাধারমণ শুধালেন।
দেখছি তোমাকে। শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয় অন্নপূর্ণা।
আমাকে!
হ্যাঁ, তোমাকে। বড়বৌ!
তুমিও তাহলে শেষ পর্যন্ত শ্বশুরমশাইয়ের পথই ধরলে? কি বলছ?
বুঝতে পারছ না কি বলছি?
বড়বৌ!
তুমি—তুমি শেষ পর্যন্ত আরেকজনের রক্ষিতাকে নিয়ে-
রাধারমণ মল্লিকের মুখের ওপর যেন সপাং করে একটা তীক্ষ্ণ চাবুকের আঘাত পড়ল। অন্নপূর্ণা তখনো বলে চলেছে, তাই—তাই তোমার জানকী দত্তর ব্যাপারে এত উৎসাহ!
শোন বড়বৌ, তুমি ঘরের বৌ—বৌয়ের মতই থাকবে—
কি বললে?
হ্যাঁ, আমি বাইরে কি করি না করি তা নিয়ে তোমার মাথাব্যথার কোন প্রয়োজন নেই।
তুমি ভুল করছ—
ভুল করছি!
হ্যাঁ, আমি তোমার মা নই। আমার স্বামী সারারাত-
থাম। একটা হুংকার দিয়ে উঠলেন অকস্মাৎ রাধারমণ মল্লিক। এতদিন যে লজ্জা ও সংকোচটা জ্ঞানে অহরহ পীড়া দিচ্ছিল, যে কারণে চোরের মত আনাগোনা করতেন তিনি, স্ত্রীর দিকে ভাল করে তাকাতে পারতেন না পর্যন্ত, আজ সেই সংকোচ ও লজ্জার পর্দাটা যখন অকস্মাৎ ছিন্ন করে দিল অন্নপূর্ণাই, রাধারমণ যেন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
বস্তুত এমনিই বুঝি হয়, লজ্জা বা সংকোচ ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ একটা সূক্ষ্ম আবরণ তাকে ঘিরে রাখে। কিন্তু সেই আবরণটা যে মুহূর্তে অপসারিত হয়—সব কিছুই যেন হুড়মুড় করে একেবারে ভেঙে পড়ে।