মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ২৪

॥ চব্বিশ ।।

মল্লিকবাড়ির সদরে পা দিতেই ভোলানাথের সঙ্গে দেখা। ভোলানাথ এক গাল হেসে সাদর অভ্যর্থনা জানাল, আরে ‘আনন্দচন্দ্র যে, তারপর খবর কি কও!

ভাল।

সংক্ষেপে ছোট্ট জবাব দিয়ে আনন্দচন্দ্র ভোলানাথকে এড়াবার চেষ্টা করে, কিন্তু ভোলানাথ অত সহজে আনন্দচন্দ্রকে এড়িয়ে যেতে দেয় না—আরে যাও কই! দাঁড়াও না, দুটো কথা কই।

আমার এখন একটু তাড়া আছে ভোলাদা —

আরে সংসারে তাড়া কার নেই, সকলেরই তাড়া আছে। এদিকে যে এই বাড়িতে জোর খবর আছে।

জোর খবর!

হ্যাঁ। অনুমান কর তো কি?

তুমিই বলো ভোলাদা!

কত্তামশাই যে তাঁর বিধবা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন।

কি—কি বললে?

যাওনা, ভিতরে যাও, সবই শুনতে পাবে।

সুহাসিনীর বিয়ে দেবেন আবার মল্লিকমশাই!

তাই তো শুনছি—বলে মৃদু মৃদু হাসতে থাকে ভোলানাথ।

বিধবা সুহাসিনীর আবার বিয়ে! বিধবার বিয়ে! আনন্দচন্দ্র যেন কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, সত্যি বলছো ভোলাদা?

সত্যি না তো কি মিথ্যে! বিদ্যেসাগর মশাইয়ের সঙ্গে নাকি কত্তা দেখা করেছিলেন। তিনি নাকি বলেছেন, এ বিয়েতে কোন পাপ বা অন্যায় নেই।

বিদ্যাসাগরের নামটা শোনা বটে, কিন্তু আজ পর্যন্ত আনন্দচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাইকে চাক্ষুষ দেখেনি। লোকটা কেবল বিদ্যারই জাহাজ নয়, সকলপ্রকার শাস্ত্র যেন গুলে খেয়েছেন। চরিত্রবান, যেমন মহীয়ান তেমনি তেজস্বী এবং একরোখা।

এও শুনেছে আনন্দচন্দ্র, বহু শাস্ত্র ঘেঁটে বিদ্যাসাগর মশাই নাকি প্রমাণ করে দিয়েছেন, বিধবার বিবাহ শাস্ত্রসম্মত।

মনে হচ্ছে ভোলাদা, সুহাসিনীর বিবাহের ব্যাপারে তুমি যেন খুব খুশী। আনন্দচন্দ্ৰ বললে।

নিশ্চয়ই।

কেন? কেন আবার কি? কি ওর বয়স বল তো? তাছাড়া একটা রোগগ্রস্ত বুড়োর হাতে কত্তা অমন ফুলের মত সুন্দর মেয়েটাকে তুলে দিয়েছিলেন—কেন ইহ সংসারে কি আর সুহাসিনীর যোগ্য পাত্র ছিল না?

অশিক্ষিত ভোলানাথের সঙ্গে আর তর্কাতর্কি করতে ইচ্ছা হচ্ছিল না আনন্দচন্দ্রের। তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেল।

.

ওইদিনই দ্বিপ্রহরে অম্বিকাচরণের সঙ্গে আনন্দর দেখা হল।

সংস্কৃতের পণ্ডিত আসেননি সেদিন, তাই ক্লাস হয়নি। ছেলেরা ক্লাসরুমের মধ্যেই জটলা পাকাচ্ছিল।

অম্বিকা একটা ইংরেজী কবিতার বই নিয়ে ক্লাসের এক কোণে বসেছিল। আনন্দচন্দ্র তার সামনে এসে দাঁড়াল।

অম্বিকা!

আনন্দচন্দ্রের ডাকে বই থেকে মুখ তুলে তাকাল অম্বিকাচরণ।—আনন্দ যে, কবে দেশ থেকে ফিরলে?

আজই সকালে।

পুজো কেমন কাটল?

ভাল। তারপর তোমার খবর কি বল?

আমি শীগগিরি খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করছি।

কথাটা শুনে আনন্দচন্দ্র যেন একেবারে থ হয়ে যায়। কয়েকটা মুহূর্ত তার বাক্যস্ফূর্তিও হয় না।

সত্যি বলছো?

হ্যাঁ।

কিন্তু তোমার মা-বাবা, তাঁদের মত নিয়েছো?

না।

নাওনি?

না। নেওয়া প্রয়োজন মনে করিনি।

তাঁরা জানেন কথাটা?

হ্যাঁ। একটা চিঠি লিখে তাঁকে সব জানিয়ে দিয়েছি।

তার মানে?

আমিও এখন বেশীর ভাগই আমাদের বাড়িতে থাকি না।

তবে—তবে কোথায় থাক?

রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক বন্ধুর বাড়িতে।

কাজটা কি ভাল করছ অম্বিকাচরণ? তা ছাড়া তোমার স্ত্রী রয়েছেন-

যে স্ত্রী তার স্বামীর সহগামিনী মনে প্রাণে না হতে পারে, সে আবার স্ত্রী কি?

তবু তাকে তুমি নারায়ণ, অগ্নিসাক্ষী করে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে একদিন গ্রহণ করেছিলে, ভুলে যেও না।

ভুলব কেন? যার সবটাই একটা মিথ্যা আড়ম্বর আর বুজরুকি মাত্ৰ – দেখো আনন্দচন্দ্র, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছ বোধ হয় ভাল করছ না!

কেন?

কথাটা শোনা অবধি ক্লাসের সবাই প্রায় আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেছে। তোমাকে আমার সঙ্গে মিশতে দেখলে হয়ত তোমার সঙ্গেও ওরা সম্পর্ক ত্যাগ করবে।

অম্বিকা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

কি?

কথাটা বেশ ভাল করে ভেবে দেখেছ তো?

ভেবেই স্থির করেছি—

তোমার অমন ক্যারিয়ার-

সে ক্যারিয়ার আমার আরও ভাল করবার সুযোগ পাব এবার আমি।

হিন্দু কলেজে যদি তোমাকে কর্তৃপক্ষ আর না পড়তে দেয়—

মাইকেল মধুসূদন দত্তর কথা কি তুমি জান না?

জানি।

তবে? কি জান আনন্দচন্দ্র, প্রতিভা তার নিজের পথ নিজেই করে নেয়। আজ মাইকেল মধুসূদন দত্ত ক্রিশ্চান হয়েছেন বলে কি তাঁর উর্ধ্বগতি কেউ রোধ করতে পেরেছে?

কিন্তু তাঁর জীবনও তো এখনো শেষ হয়নি; সামনে এখনো দীর্ঘ পথ পড়ে আছে। তা ছাড়া এদেশে স্থান হল না বলে চলে যেতে হল তাঁকে মাদ্রাজে।

প্রত্যুত্তরে অম্বিকাচরণ বললে, দেখ আনন্দ, যে স্ত্রী স্বামীর আপদে-বিপদে এবং সর্বকাজে সহযোগিনী ও সহগামিনী না হতে পারে সে স্ত্রীকে নিশ্চয়ই তুমি বলবে না সত্যিকারের সহধর্মিণী!

একটা কথা ভুলো না অম্বিকাচরণ, তোমার শ্বশুরমশাই পরম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ এবং তোমার মুখেই একদিন শুনেছিলাম, তাঁর মাতামহী সহমরণে গিয়েছিলেন। সেই নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণবংশের মেয়ে তোমার স্ত্রী। তার পক্ষে আজন্মের হিন্দু সংস্কার হঠাৎ বিসর্জন দেওয়া কি সম্ভব, না তাই কেউ পারে?

সংস্কার আর সংস্কার! কতকগুলো মান্ধাতা আমলের অন্ধ আচার আর অর্থহীন নিয়মানুবর্তিতার প্রতি তোমাদের যে কি অন্ধ শ্রদ্ধা, সত্যিই আমি বুঝতে পারি না আনন্দ। তাছাড়া আরো একটা কথা তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, তোমার মতন তোমার স্ত্রী ইংরেজী শিক্ষার পাঠ নেয়নি। কাজেই তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও এক হতে পারে না।

সকলকেই যে পাঠ নিতে হবে তার কি মানে আছে—না, তা ঠিক নয়।

তাহলেও তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, একটা প্রস্তুতির দরকার। মৃদু হেসে আনন্দচন্দ্ৰ বললে।

থাম আনন্দ, তার হয়ে তোমার ওকালতি না করলেও চলবে।

ওকালতি করছি না আমি অম্বিকা, সেই নিরীহ মেয়েটির কথা তোমাকে একটু স্থিরচিত্তে ভাবতে বলছি মাত্র আরো ক’টি দিন। একটা প্রস্তুতিরও তো প্রয়োজন আছে।

আমি তাকে একটা পত্র দিয়েছি সব কথা বিশদভাবে জানিয়ে। সে লেখাপড়া জানে। টুলো পণ্ডিতের মেয়ে, বাপই তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, সংস্কৃত কাব্যও পড়িয়েছেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। কাজেই আশা করি সে তার নিজের ভালমন্দটা বুঝতে পারবে। তার জীবনের মঙ্গল কিসে তা সে বুঝতে পারবে। আমার কর্তব্য আমি করেছি, এখন তার কর্তব্য তার কাছে। তাছাড়া আমি এও জানিয়েছি, ইচ্ছা করলে এখানে এলে তার ইংরেজী শিক্ষার ব্যবস্থা আমি করে দেবো বেথুন স্কুলে।

যে সময়ের কথা হচ্ছে তখন বেথুন সাহেবের প্রতিষ্ঠিত বেথুন স্কুলে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা শিক্ষালাভ করছে। দেশে স্ত্রী-শি পর প্রয়োজনীয়তা অনেকেই স্বীকার করছেন। যদিও তখনো হিন্দু সমাজের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন হিন্দুরাই মনে করতেন, স্ত্রীলোকদের বিদ্যাভ্যাসের কোন প্রয়োজনই নেই। তাদের আদর্শ হওয়া উচিত কুলধর্ম বজায় রাখা। কিন্তু গণ্যমান্য প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তি, যেমন রাজা বৈদ্যনাথ রায়, ধনকুবের মতিলাল শীল প্রভৃতি অনেকে স্ত্রী-শিক্ষার নৈতিক সমর্থক ছিলেন। আর ইয়ং বেঙ্গল দলের তো কথাই নেই। তাঁরা স্ত্রী-শিক্ষাকে একটা প্রবল সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেন।

পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার আলোক পেয়ে রামগোপাল ঘোষ ও রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ইয়ং বেঙ্গলীরা স্ত্রীশিক্ষার প্রকৃত সামাজিক তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং ওই ধরনের মতদ্বৈধতার মধ্যেই বারাসতের কয়েকজন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উদ্যোগে ১৮৪৭ সনে সর্বপ্রথম একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এদেশে। তাদের মধ্যে অন্যতম উৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন প্রন্সিদ্ধ শিক্ষাবিদ প্যারীচরণ সরকার মশাই, বারাসতের কালীকৃষ্ণ মিত্র ও তাঁর ভাই নবকৃষ্ণ মিত্ৰ।

শোনা যায়, শিক্ষা সংসদের সভাপতিরূপে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন সাহেব বারাসতের ওই বালিকা বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করতে গিয়েই কলকাতা শহরে অনুরূপ একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবার প্রেরণা পেয়েছিলেন নিজের মধ্যে এবং তার দুই বছর পরে বেথুন সাহেব কলকাতা শহরে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন।

ইংরেজী শিক্ষার প্রথম সুগঠিত প্রকাশ্য বিদ্যালয় ‘হিন্দু কলেজ’ এবং স্ত্রী শিক্ষার উদ্দেশ্যে বারাসতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় দুটিই সেই সময়কার কয়েকজন দূরদর্শী নব্যযুগের নব্য শিক্ষাপ্রাপ্ত বাঙ্গালীর উদ্যোগেই স্থাপিত হয়েছিল।

বেথুন সাহেবের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির প্রথমে নাম ছিল ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল, পরে তাঁর মৃত্যুর পরে নাম হয় ‘বেথুন স্কুল’। সেটা ১৮৫১ সনের কথা। এবং বেথুন নিয়ম করেছিলেন, সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের মেয়েরাই কেবল ওই বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে এবং এও তিনি প্রতিষ্ঠার সময় জানিয়ে দিয়েছিলেন স্পষ্ট ভাষায়, কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়।

আনন্দচন্দ্র যে ওইসব কথা জানত না তা নয়। তাই অম্বিকাচরণের কথাগুলো শুনে বললে, তা তুমি তো তোমার স্ত্রীকে খুব ভাল প্রস্তাবই দিয়েছ।

দেখ আনন্দ, আমি চাই আমার স্ত্রী যোগ্য সহধর্মিণী হোক আমার, শিক্ষায় দীক্ষায়, আচার ব্যবহারে রুচিতে এবং যেটা ইংরেজী শিক্ষা কিছুটা না পেলে হওয়া সম্ভব নয়। তুমি শুনলে অবাক হবে একটা কথা—

কি?

যে কথাগুলো এইমাত্র তোমায় বললাম, ওই কথাগুলো বহুবার স্ত্রীকে আমি বলেছি, তাকে বোঝাবার চেষ্টাও করেছি, কিন্তু সবই অরণ্যে রোদন হয়েছে।

কি বলেছেন তিনি?

ওই শিক্ষা ম্লেচ্ছ শিক্ষা-

বলেছেন তিনি?

হ্যাঁ। আর তাই তো তাকে শেষ ultimatum দিয়ে আমি খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করাই স্থির করেছি।

কবে তুমি তোমার স্ত্রীকে ওই পত্র দিয়েছ?

পূজার ঠিক আগে।

কোন জবাব দেননি তিনি?

দিয়েছে। সে লিখেছে, আমি ইচ্ছা করলে ধর্মান্তর গ্রহণ করতে পারি কিন্তু সে করবে না। পরোধর্ম ভয়াবহ। আরো কি লিখেছে জান?

কি?

আমি যদি আমার বিবাহিত স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব না পালন করাই মনস্থ করে থাকি, তাহলে তার আর বলবার কিছু নেই।

হুঁ। তাহলে তোমার খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করাই একেবারে স্থির?

হ্যাঁ। সামনের ডিসেম্বরের বড়দিনের সময় ধর্মান্তর গ্রহণ করব আমি।

কি জানি ভাই, আমার যেন ব্যাপারটা আদৌ ভাল লাগছে না অম্বিকাচরণ।

কেন?

তুমি যা ভাবছ তা হয়ত হবে না।

কেন, কি ভাবছি আমি?

ধর্মান্তর গ্রহণ করে তুমি ভাবছ হয়ত সুখী হবে, আমার মনে হয় তা হবে না।

কেন, ওকথা তোমার হঠাৎ মনে হচ্ছেই বা কেন?

দেখ, তোমার স্ত্রীকে আমি দেখিনি কিন্তু তোমার মুখ থেকে তাঁর কথা শুনে মনে হচ্ছে ইংরেজী শিক্ষার আলো না পেলেও সত্যিকারের শিক্ষা তিনি পেয়েছেন। ওই স্ত্রীকে তুমি হারালে, মনে হয় তোমার জীবনে কখনো সুখ আসবে না।

আসবে আনন্দচন্দ্র, তুমি দেখে নিও। কারণ আমার নিশ্চিত ধারণা, একদিন সে তার ভুল বুঝতে পারবে, আর তখুনি তার মনের সকল দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে। একদিন সে বুঝতে পারবে, কেন শেষ পর্যন্ত আমি ধর্মান্তর গ্রহণ করেছিলাম। দুঃখ কি জান—it will be rather too late!

যেটাকে তুমি তাঁর একটা ভুল বলছ, সেটা তিনি কোনদিন ভুল বলে বুঝতে পারবেন কিনা জানি না। ….

পারবে। আমার স্থির ধারণা সে পারবে।

পারলে ভালই। সেই আশাই করব। তবে আমার ধারণা, হয়ত সেরকম কিছু হবে না।

তাহলে বুঝব, সে আমাকে কোনদিনই ভালবাসতে পারেনি।

একটা কথা, আনন্দচন্দ্র বললে, ধরো তাকে নিয়ে সংসার করা যদি তোমার আদৌ না সম্ভব হয় তখন তুমি কি করবে? তখন কি তুমি শেষ পর্যন্ত কোন খ্রীস্টধর্মাবলম্বীকেই পুনরায় বিবাহ করবে?

সে-সব কথা অবান্তর। ওসব কিছু এখন আমি ভাবছিই না।

ভাবতে হবে, কারণ ব্যাপারটা সত্যিই লঘু নয়। তাছাড়া এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে তোমাকে সকল দিকে ভেবে বিবেচনা করেই অগ্রসর হতে হবে।

আনন্দ, তুমি বড় বেশী ভাব।

বেশী ভাবি?

নয় তো কি! অত চিন্তা-ভাবনা করতে গেলে জীবনে কোন decision-ই নেওয়া যায় না।

সেদিন অতঃপর আর দুই বন্ধুর মধ্যে কোন কথাবার্তাই হয়নি। তাদের আলোচনা ওইখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু তর্কাতর্কি শেয় হয়ে গেলেও, আনন্দচন্দ্রের কিন্তু কলেজে বাকী সময়টা ও গৃহে প্রত্যাবর্তনের পথে অম্বিকাচরণের কথাগুলোই মনের মধ্যে আনাগোনা করছিল। অম্বিকাচরণের যুক্তিগুলো একেবারে নস্যাৎ করে উড়িয়ে দিতে পারছিল না আনন্দ। অম্বিকাচরণের স্ত্রীকে আনন্দ কখনো দেখেনি—পরিচয়ের সুযোগ তো দূরের কথা। তথাপি যেন তার মনে হচ্ছিল, স্ত্রীলোকের এত জিদ ভাল নয়। স্বামী ধর্মান্তর গ্রহণ করবে, তথাপি তাকে তার স্বামী যেরকম ভাবে গড়ে তুলতে চায় তাতে সে সম্মত হচ্ছে না। হাজার হোক স্বামী তো! কি জানি কেমন সে স্ত্রী?

মনে হয় একবার অন্নদাসুন্দরীর কথা। সেও যদি ধর্মান্তর গ্রহণ করত, অন্নদাসুন্দরীও কি অনুরূপ ব্যবহার করত!

পরক্ষণেই আবার মনে হয় আনন্দচন্দ্রের, কি আবোলতাবোল সে ভাবছে? হঠাৎই এক সময় মনে হয় একটা কথা আনন্দচন্দ্রের, আচ্ছা সুহাসিনীর জীবনের তো কোন ভবিষ্যৎই নেই! আর সেই কারণেই হয়ত তার পিতা রাধারমণ মল্লিক মশাই বিধবা কন্যা সুহাসিনীর আবার বিবাহের কথা ভাবছেন। কিন্তু সুহাসিনীর বিবাহ না দিয়ে তাকে যদি লেখাপড়া শিখবার ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় বেথুন স্কুলে ভর্তি করে, হয়ত জীবনটা তার একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাবে না।

দু’দিন ধরে কথাটা মনের মধ্যে আনাগোনা করতে থাকে। অবশেষে আনন্দ একদিন কলেজ থেকে ফিরে হাতমুখ ধুতে দীঘির ঘাটে গিয়ে দেখে বাঁধানো সিঁড়ির ওপরে বসে আছে একাকী সুহাসিনী। কেমন উদাস দৃষ্টিতে সন্ধ্যার আসন্ন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এক মাথা রুক্ষ কেশ পৃষ্ঠের উপর ছড়িয়ে আছে, আঁচলটা শাড়ির এক পাশে খসে পড়েছে।

চারিদিকে আসন্ন সন্ধ্যার একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা।

সুহাসিনী!

আনন্দর ডাকে চমকে ফিরে তাকাল সুহাসিনী।—কে? ওমা, আনন্দদাদা যে! দেশ থেকে কবে ফিরলে গো?

সে তো আজ তিন দিন হয়ে গেল।

তা আমার সঙ্গে দেখা করোনি যে বড়! না সুহাসকে ভুলেই গিয়েছিলে?

আনন্দচন্দ্ৰ মৃদু হেসে বললে, ভুলব কেন?

তবে?

সামনেই পরীক্ষা তো, পড়াশুনার বড্ড চাপ পড়েছে। শেষ পরীক্ষা-

পাস করলে এবারে তো ডাক্তারী পড়বে, তাই না?

হ্যাঁ, সেই রকমই তো ইচ্ছা আছে।

ভাবতেও হাসি পায়, তুমি আনন্দদাদা হবে ডাক্তার!

কেন, ডাক্তার কি আমি হতে পারি না নাকি? আচ্ছা সুহাস—

কিছু বলছিলে?

হ্যাঁ, তুমি স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করবে?

ওমা পড়াশুনো করব কি গো? তাও খেস্টানদের স্কুলে ভর্তি হয়ে!

আনন্দচন্দ্র হেসে বলে, বেথুন স্কুলটা খ্রীস্টান সাহেবের প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে অনেক মানী জ্ঞানী হিন্দুঘরের মেয়েরা ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করছে।

গলায় দড়ি জোটে না তাদের? মেয়েছেলের আবার ন্যাকাপড়া কি! যত সব ম্লেচ্ছ জাত।

লেখাপড়া করবে, স্কুলে ভর্তি হবে, তার মধ্যে ম্লেচ্ছ হবার কি আছে? তবে তো আমিও ম্লেচ্ছ।!

তুমি? তোমার কথা আলাদা।

আলাদা কেন?

তুমি তো আমাদের মত মেয়েছেলে নও, পুরুষ মানুষ

না সুহাস, ওসব তোমার ভুল ধারণা। লেখাপড়া শিখলেও কোন মেয়ে ম্লেচ্ছ হয়ে যায় না, যেতেও পারে না। বরং শিক্ষায় মনের প্রসারতা বাড়ে। দেখবে তোমার দৃষ্টিভঙ্গিই হয়ত বদলে যাবে। যে কুসংস্কারে আজ তোমার মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে, লেখাপড়া শিখলে সে আচ্ছন্নতা কেটে যাবে। হয়ত নতুন এক জগতের সন্ধান পাবে।

ওই কথাগুলো যে অমন গুছিয়ে কোনদিন বলতে পারে আনন্দ, নিজেও ভাবতে পারেনি ইতিপূর্বে। তার নিজেরই যেন নিজেকে কেমন আশ্চর্য ঠেকে। ওই কথাগুলো তো তার নয়, ও যে অম্বিকাচরণের কথা। তারই কথার পুনরাবৃত্তি সে করেছে।

তোমার কি হয়েছে আনন্দদাদা? সুহাসিনী বললে।

কেন? কি হবে?

ওইসব কথা বলছ?

খারাপ বা অন্যায় কিছু আমি বলিনি সুহাস।—

হঠাৎ ওই সময়ে ভোলানাথের কণ্ঠস্বরে দুজনেই চমকে পিছন ফিরে তাকাল।

এই যে সুহাস, তোমাকে সারা বাড়িতেই খুঁজছি, আর তুমি এখানে রয়েছ! আরে আমাদের আনন্দবাবু যে, খবর কি?

ভোলানাথের দিকে একটিবার তাকিয়ে আনন্দচন্দ্র ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল, কিন্তু ঘাট ছেড়ে গেল না একেবারে। সন্ধ্যার ঘোর লাগা অন্ধকারে বিরাট আমগাছটার নীচে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইল।

ভোলানাথের কথাই প্রথমে কানে এল আনন্দর।

আমি তোকে খুঁজছিলাম সুহাস।

খুঁজছিলে কেন? সুহাসিনী শুধায়।

আমি এখান থেকে—এ বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি।

চলে যাচ্ছ? সুহাসিনী বললে।

হ্যাঁ।

কেন, চলে যাচ্ছ কেন?

গিন্নীমার হুকুম হয়েছে। তা আমার থাকবার জায়গার অভাব আছে নাকি এই শহরে? দত্তদের বাড়িতেই ছোটবাবু বলেছেন থাকতে—

গিন্নীমা মানে মা বলেছে তোমাকে চলে যাবার জন্য?

হ্যাঁ, একেবারে শেষ হুকুম জারি হয়ে গিয়েছে।

তা হঠাৎ এমন হুকুম দিলেই বা কেন?

আমি নাকি একেবারে বয়ে গিয়েছি। চরিত্র বলে আমার আর কিছু নেই।

মা বলেছে ওই সব কথা?

হ্যাঁ। তবে কি আমি মিথ্যা বলছি! আমার মাকে স্পষ্টই বলে দিয়েছে গিন্নীমা—বামুন মেয়ে, তোমার ছেলেকে এ বাড়িতে থাকতে দিতে পারি না। ইচ্ছা করলে তুমি যেমন আছ তেমনি থাকতে পার, তোমার ছেলের এখানে ঠাঁই হবে না আর।

তা মঙ্গলাদিদি কি বললে?

কি আর বলবে? কাঁদছিল মা।

তা আমি তো এসব কিছুই জানি না। শুনিওনি ভোলাদা।

শোনোনি বলেই তো বলে গেলাম।

না, না। যেওনা ভোলাদা, মাকে আমি বুঝিয়ে বলব।

হঠাৎ ওইসময় ভোলানাথ ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বলে উঠল, আমি চরিত্রহীন, খারাপ! আর নিজের স্বামীটি কি?

কি বলছ ভোলাদা? কার কথা বলছ?

করা কথা আবার, তোমার পিতৃদেব। মল্লিকমশাই—

বাবা! আমার বাবা?

হ্যাঁ গো ঠাকরুন, তোমার বাবা। শহরে যে একেবারে ঢিঢি পড়ে গিয়েছে। জানকী দত্তর রক্ষিতা মাগীটাকে নিয়ে—

হঠাৎ যেন দপ করে আনন্দচন্দ্রের মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। অন্ধকারে আর সে আত্মগোপন করে থাকতে পারে না। তরতর করে সোপান বেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমে আসে। তীক্ষ্ণকণ্ঠে ডাকে, ভোলানাথ!

আনন্দবাবু যে! যাওনি তাহলে? ঘাপটি মেরে ছিলে অন্ধকারে?

একটু আগে মল্লিক কাকার নামে যা সব বলছিলে—

হ্যাঁ। সেই মাগীটার ওখানেই রোজ রাত্রে আজকাল তোমার মল্লিক কাকা মশাই লীলাকেত্তন—

আনন্দচন্দ্র আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ভোলানাথের কথা শেষ হবার আগেই একটা চপেটাঘাত বসিয়ে দিল ঠাস করে ভোলানাথের গালে। বললে, stupid!