মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ২৩

।। তেইশ ।।

অন্নদাসুন্দরীর যেন বিস্ময়ের অবধি থাকে না।

কিশোরী অন্নদাসুন্দরী কয়েকটা মুহূর্ত বোবা সরল দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, ওগো মাগো, কি কও তুমি!

আমি ঠিকই কথিছি। বিশ্বাস কর বৌ, মেজ পিসী তা না হলি এ বাড়ির অন্য কারেও তার সোনা ও মোহরের কথা যাবার আগে কয়ে গেল না ক্যান! আমার কি মনে হয় জানিস বৌ?

কি গো?

মেজ পিসীর ইচ্ছা ছিল, হয়ত তরেই ওই সব দিয়া যাবেন।

বাঁইচা থাকতি দেবার পারে নাই ক্যান?

হয়ত ভাবছিল তরে দিলে সব কিছু আর কেউ যদি মনে ব্যথা পায়!

স্বামীর কথায় অন্নদাসুন্দরী কিছুক্ষণ যেন কি ভাবল, তারপর মৃদু গলায় বললে, এক কাম করবা!

কি?

ওসব যেহানে ছেলো সেহানেই রাখে আসো গে। ও গহনা—ও সোনার মোহরে আমাগোর কাম নাই।

পাগল নাকি! মেজ পিসী তরেই দিয়া গেছেন, এ সব তরই।

না গো না, ওসবে কাম নাই।

না, এসব আমি কাউরে দেব না।

এক কাম কর না তালি!

কি?

ও সব কিছু কালই ঠাকুরের হাতে তুলে দাও। ঠাকুর যা ভাল বোঝবেন তাই করবেন।

বাবার হাতে!

হ্যাঁ!

না।

ক্যান?

তুই জানস না, আমাগোর অভাবের সংসার, একটা দানাও এর থাকবো না।

তবে তুমি যা ভাল বোঝ কর—মোট কথা আমি ওয়ার কিছুই নিমু না।

নিবি না ক্যান?

কলাম ত—

সত্যি নিবি না?

না।

বৌ!

না, নিমু না।

কিশোরী অন্নদাসুন্দরীর সমস্ত মুখে রেখায় রেখায় যেন একটা দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আনন্দচন্দ্র রীতমত যেন বিস্মিত হয়। এতটুকু একটা মেয়ে, তার মধ্যে এত বড় আত্মসংযম ও চারিত্রিক দৃঢ়তা কোথা হতে এল! গহনার লোভ তো মেয়েদের কাছে কম নয়। তবে সে লোভ অতটুকু একটা মেয়ে কোন্ মনের জোরে সম্বরণ করল!

দেখতিছো কি অমন করে আমার মুখের দিকে তাকায়ে?

মৃদুকণ্ঠে আনন্দচন্দ্র বললে, তবে—

আমারে?

হ্যাঁ। বলতে বলতে আনন্দচন্দ্র আবার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায়।

সোনার গহনা ও বাদশাহী মোহরগুলোর লোভ যে আনন্দচন্দ্রের মনকে দোলা দেয়নি সে কথাটা তো সে অস্বীকার করতে পারে না। তার ডাক্তারী পড়তে অনেক টাকার দরকার। পিতা ভারতচন্দ্রের এমন অবস্থা নয় যে, তিনি নিয়মিত মাসে মাসে দেশের এত বড় একটা সংসার চালিয়ে জোগান দিয়ে যেতে পারবেন, অথচ এগুলো থাকলে তার পড়াশুনার কোন অভাবই হবে না।

অন্নদাসুন্দরী আবার বলে দৃঢ়কণ্ঠে, যাও, ওগুলান যেহান থেকে আনছো সেহানেই রাখে আসো গে।

কিন্তু বৌ—

একবার ভাইবা দেহো, মেজ ঠাকরুনের কত কষ্টের জিনিস ওগুলান, প্রাণে ধরে কখনো খরচ করতি পারেন নাই। ও নিলে তোমার মঙ্গল হবে না কিছুতেই, আমি কথিছি।

শুধু ওইদিনের ব্যাপারেই নয়, পরবর্তী কালেও আনন্দচন্দ্র দেখেছে, তার স্ত্রী অন্নদাসুন্দরীর চরিত্রের দৃঢ়তা। এই স্বল্পবাক্ মেয়েটির মন যে কত দৃঢ়, কত নির্লোভ, তার পরিচয় সে বহুবার পেয়েছিল।

ভারতচন্দ্রের সংসারে তার যা অভাব ছিল, আনন্দচন্দ্রের সংসারে তার চাইতেও বড় অভাব দেখা দিয়েছে। ছয়টি কন্যা ও ছয়টি পুত্রকে নিয়ে পরবর্তী কালে তাকে নিদারুণ অর্থকষ্ট ও অভাবের মধ্যে দিনযাপন করতে হয়েছে। সংসারের সর্বত্র কেবল অভাব আর অনটন। নেই আর নেই। তথাপি কখনো অন্নদাসুন্দরীর দিক থেকে এতটুকু অভিযোগও কখনো উচ্চারিত হয় নাই। বরং আনন্দচন্দ্র অভাবের তাড়নায় ভেঙে পড়লে স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, অত ভাবতিছো কি কও দেহি, আমার পোলারা দেহো প্রত্যেকে মানুষের মত মানুষ হবে, তহন দেহো সংসারে আর কোন অভাব থাকবে না।

হয়েছিলও তাই। একমাত্র সেজ ও ছোট ছেলেই জীবনে সাচ্ছল্যের দেখা পায়নি। অন্নদাসুন্দরীর অন্য ছেলেরা কিন্তু প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছে তাদের কর্মজীবনে। দেশের কাঁচা খড়ের ছাওয়া দরমার বেড়া দেওয়া বাড়ি ভেঙে বিরাট পাকা দালান করেছে। পাকা মণ্ডপে হৈ-হৈ করে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে দুর্গোৎসব করেছে, কিন্তু কোথায় তখন অন্নদাসুন্দরী! সেদিনকার সেই রমরমা ঐশ্বর্যের কিছুই সে দেখে যায়নি। কিন্তু পরবর্তীকালের ইতিকথাও বর্তমান কাহিনীর প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। এ কাহিনী বামাসুন্দরীর একমাত্র পুত্রবধূ অন্নদাসুন্দরীকে নিয়ে। যার সারাটা জীবন ওই স্বামীর গৃহে দুঃখে আর অভাবের মধ্যেই কেটেছে, দুবেলা ভাল করে পেট ভরে অন্নও জোটেনি। দুখানার বেশী তিনখানা পরনের শাড়ি জোটেনি। তাই খারে সিদ্ধ করে কেচে তাকে পরতে হয়েছে। আর অলং কার বলতে দু হাতে মাত্র দুখানি লাল শাঁখা

নিরাভরণা ওই স্ত্রীলোকটির মাথায় একটি গোলাকার সিন্দুরের টিপ, পরনে একটা আধময়লা লালপাড়া তাঁতের শাড়ি—তাতেই মনে হয়েছে যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী ঠাকরুনটি। একগলা ঘোমটা টেনে তেতাল্লিশ বৎসর পর্যন্ত যতদিন বেঁচে ছিল এঘর ওঘর করে বেড়িয়েছে। তার দাদু বিবাহের সময় সামান্য যে ক’টি অলংকার দৌহিত্রীকে দিয়েছিলেন, তাও একটি একটি করে স্বামীর অভাবের সংসারের দাবি মেটাতে তার হাতে হাসিমুখে তুলে দিয়েছে। কিন্তু সে তো আরো অনেক পরের কথা।

আনন্দচন্দ্র ভেবে পায় না, এখন ওই গহনা ও মোহরগুলো নিয়ে কি করবে সে!

এখনো অমন করে বসে ভাবতিছো কি? যাও, ওগুলান যেহানে ছেলো সেহানেই রাখে আসো গে—ওসবে আমাগো কাম নেই।

আনন্দচন্দ্র শেষ পর্যন্ত মোহর ও গহনাগুলো সেইরাত্রেই মেজ পিসীর পরিত্যক্ত ঘরে সেই কমণ্ডলুর মধ্যে গিয়ে রেখে চাল চাপা দিয়ে যেমনই ছিল তেমনটি করে রেখে এসেছিল। তারপর আর আনন্দচন্দ্রেরও সে-সব কথা মনে ছিল না বহুকাল।

আনন্দচন্দ্রও সে-সব কথা কাউকে বলেনি।

কিন্তু সেরাত্রে আনন্দচন্দ্রের চোখে বহুক্ষণ ঘুম আসেনি। নিষুতি রাত, বাইরে গাব গাছের ডালে থেকে থেকে রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপাটানোর শব্দ ও তক্ষকের কটকট ডাক কেবল মধ্যে মধ্যে তার কানে এসেছে।

অতটুকু মেয়ে অন্নদাসুন্দরী, সেও ঘুমায়নি—তার চোখেও ঘুম ছিল না—রাত যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বড় ঠাকরুনের স্তোত্রের শব্দ কানে ভেসে আসতেই ধড়ফড় করে উঠে বসে অন্নদাসুন্দরী ভূশয্যা থেকে। এবং পরনের শাড়িটা গুছিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে হঠাৎ স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললে, জাগিছো!

আমি জেগেই আছি। আনন্দচন্দ্ৰ বলে।

সারাটা রাত ঘুমাওনি?

না।

তুমি কি রাগ করিছো, ব্যাজার (বিরক্ত) হইছো আমার ‘পরে?

কেন, ব্যাজার হবো কেন?

তয়?

কি তয়!

ঘুমালে না ক্যান? তারপর একটু থেমে বলেছিল—দেহো, আমি তোমারে কোন খারাপ পরামর্শ দিই নাই।

আমি কি কইছি তা!

না, তা কও নাই বটে, তয়—

তয় কি!

দেহো দাদু আমারে একটা কথা প্রায়ই কইতেন, জীবনে লোভ করলি শান্তি পাওন যায় না। লোভে লোভই বেড়ে চলে।

সেদিন আনন্দচন্দ্র সত্যিই অবাক হয়েছিল অতটুকু এক বালিকার মুখে ওই কথা শুনে। সেই সঙ্গে তার বাপ ভারতচন্দ্রের একটা কথাও মনে পড়েছিল।

বড় ঠাকরুনকে বাবা বলেছিলেন—দিদি দ্যাখবা আমি সাক্ষাৎ লক্ষ্মীপ্রতিমারে ঘরে আনছি। এ সংসারে কোন দুঃখই একদিন থাকবে না।

ভারতচন্দ্রের জীবিতকালে ও আনন্দচন্দ্রের জীবিতাবস্থায় তার কোন আভাস না দেখা গেলেও অন্নদাসুন্দরীর পুত্র ও পৌত্ররা লক্ষ্মীর আশীর্বাদে ধন্য হয়েছিল। আর অন্নদাসুন্দরীর তৃতীয় পুত্র সত্যরঞ্জন যে অনেকটা তার মায়ের মতই গৌরবর্ণ ও বেঁটেখাটো মানুষটি ছিল, প্রায় তার মায়ের আকৃতিই পেয়েছিল। নিজের জীবনে সে সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও তার পুত্র যে পিতা আনন্দচন্দ্রের কথাটাকে সত্য বলে প্রমাণিত করেছিল, তা সে জেনে গিয়েছিল।

ষষ্ঠীর দিন প্রত্যুষেই ঢাকের বাদ্যিতে আনন্দচন্দ্রের ঘুম ভেঙে গেল। মনে পড়লো আজ বোধন, কাল পূজা।

কটা দিন পুজোর হৈ-চৈ করেই কেটে গেল।

তারপর দেখতে দেখতে পূজোর ছুটিও শেষ হয়ে গেল। আনন্দচন্দ্রের মন চাইছিল না এত তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরতে। অন্নদাসুন্দরী যে তার জীবনে এক নতুন স্বাদ এনে দিয়েছে। কিশোরী অন্নদাসুন্দরীর দেহের প্রতি অণুপরমাণু যেন আনন্দচন্দ্রের দেহের কোষে কোষে জাগিয়েছে এক অনাস্বাদিত পুলক।

কিন্তু ছুটি ফুরিয়েছে, কলকাতায় ফিরে যেতেই হবে। এবারে শেষ পরীক্ষা। তারপরই ডাক্তারী পাঠ শুরু। তাকে ডাক্তার হতে হবে।