।। বাইশ ।।
জানালাপথে যে দ্বিপ্রহরের স্বপ্নালোক ঘরের মধ্যে এসে ঢুকেছে সেই আলোতেই তামার কমণ্ডলুটা ঝকঝক করছে। আনন্দচন্দ্র কিছুক্ষণ নির্বাক স্থাণুর মত সেই দিকে তাকিয়ে রইলো—কমণ্ডলুটা হঠাৎ কারো নজরে পড়ার কথা নয়, কারণ তার আশেপাশে জড়ো করা ছিল পিতলের বাসনপত্র ও গোটাকয়েক বেতের ডালা। সেগুলোর মধ্যেও কি সব যেন রয়েছে।
আনন্দচন্দ্র পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেই দিকে ঘরের কোণে, মুহূর্তকাল কি যেন ভাবল, তারপর নীচু হয়ে কমণ্ডলু তুলতে গিয়ে হাত বাড়িয়ে নজরে পড়লো কমণ্ডলুটার মধ্যে আতপ চাল রয়েছে, বেশ ভারী। পাশে একটা ছোট পিতলের ঘটিতেও আতপ চাল রয়েছে আধাআধি। কি খেয়াল হল আনন্দচন্দ্রের, ঘটির মধ্যে কমণ্ডলুর চালটা ঢেলে ফেলতে গিয়ে চালের উপরে কয়েকটা টাকার মত কি চক্চক্ করছে নজরে পড়ল। ওই সঙ্গে একটা মোটা সোনার চন্দ্রহার, অন্ততপক্ষে ওজনে দশ ভরি তো হবেই, দুটো সোনার বাজুবন্ধ ও এক জোড়া কঙ্কণ।
সোনার মত ঝক্ ঝক্ করছিল যে টাকাগুলো, হাতে তুলে নিয়ে দেখলো আনন্দচন্দ্র, সেগুলো বাদশাহী মোহর। দশটা বাদশাহী সোনার মোহর।
পিতা ভারতচন্দ্রের ওই বোনটি অর্থাৎ মেজ পিসী ঠাকরুন নিভাননী দেবী বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে চলে আসবার সময় যে অনেক সোনাদানা মোহর ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, সেটা একটা কিংবদন্তীর মতই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল গ্রামে। এবং সেই কারণেই বার দুই ভারতচন্দ্রের গৃহে সিঁধেল চোরেরা সিঁধ কেটেছিল, কিন্তু তারা একটা কথা জানত না, সঙ্গে যা এনেছিলেন নিভাননী তার বেশির ভাগই একে একে বাপের অভাবের সংসারে তারই হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
যৎসামান্য খুদকুড়োই তার অবশিষ্ট ছিল।
ভারতচন্দ্রের কুণ্ঠার অবধি ছিল না, সংসার চালানোর জন্য নিজের বিধবা বোনের যা কিছু সম্বল তারই সামনে ভিক্ষুকের মত হাত পাততে।
কই, আর আর বোনরা তো কখনো নিভাননীর মত মুখ ফুটে কিছু বলেনি।
ভারতচন্দ্রকে সত্যিই নাজেহাল হতে হত তখন সস্তাগণ্ডার দিনেও অত বড় সংসারটা চালাতে। অতগুলি প্রাণী, তাদের দু’বেলা পেট পুরে আহার জোগানোও খুব সহজ নয়—তাই সংসারে অভাব ও দারিদ্র্যের দুঃখ লেগেই ছিল। কবিরাজী করে যা প্রথম দিকে উপার্জন করতেন, ক্রমশ তাও অলস ও শ্রমবিমুখ স্বভাব ও আয়েসী প্রকৃতির জন্য কমে এসেছিল। নেহাত জমি থেকে বৎসরে দুবার কিছু ধান পেতেন, কষ্টেসৃষ্টে তাই লোকগুলোর দুমুঠো আহার জুটতো।
ভারতচন্দ্রের আবার দুই-তিন পদ না হলে চলতো না। স্ত্রী বামাসুন্দরীকে বলতেন, যেদিন পাতে মাছ থাকতো না, বলি রাঁধিছো কি—কচু আর ঘেঁচু!
চিরদিনের শান্ত নির্বাক্ বামাসুন্দরী আবক্ষ ঘোমটার তলায় নিঃশব্দে অশ্রুবর্ষণ করতেন। তাঁরই কি এই কচুসিদ্ধ সামান্য মুসুরীর ডাল আর শুসনী শাকের ঝোল স্বামীর সামনে বেড়ে দিতে বুক ফেটে যেত না!
কিন্তু করবেন কি তিনি?
ভারতচন্দ্র বলতেন, কেন, একটু মাছও আনতি পার নাই। ওই হারামজাদা কৈলেস কি করে?
টপটপ করে মাটির নিকানো মেঝের উপর চোখের জল ঝরে পড়ত বামাসুন্দরীর। ওইসব কথা যখুনি নিভাননীর কানে যেত, পরের দিনই তিনি হয়ত কিছু টাকা বা সোনাদানা ভাইয়ের সামনে নিয়ে এসে ডাকতেন, ভারত!
কি—কিছু কথিছো দিদি?
হ্যাঁ, এই সোনার গহনাটা জগন্নাথ স্যাকরাকে বেচে—
না না, তোর সামান্য সম্বল ওই গহনা-
থাম দেহি, এই গয়না লয়ে আমি সঙ্গে বাতি দিতি যাবো! নে ধর এগুলান!
ভারতচন্দ্র ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত নিতেন।
দুটো দিন তারপর ভালই চলতো, তারপর আবার যথা পূর্বং তথা পরং—সেই অভাব আর অভাব।
এমনি করেই দিতে দিতে নিভাননীর সব প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছিল।
আনন্দচন্দ্র ছোটবেলায় একবার বাপকে বলেছিল, আচ্ছা বাবা, মেজ পিসীর অনেক টাকাকড়ি গহনাগাঁটি আছে, তাই না?
কেডা বললো তোমায়?
কেন, সবাই তো তাই কয়।
না, তারা মিথ্যা কয়—
মিথ্যা!
হ্যাঁ, ওর যা ছিল সব একে একে আমার অভাবের সংসারে—
তয় লোকে কয় ক্যান, মেজ পিসী যখ করি—
ছি ছি, ওদের কথায় তুমি কান দিও না—ওরা জানে না তাই ওইসব আলি ঝালি কথা কয়। এ কড়া কথা সর্বদা মনে রাখবা, তোমাগোর ওই মেজ পিসী না থাকলি তোমার তিন বোনের বিয়েই হত না। ওর মত মনিষ্যি হয় না।
আনন্দচন্দ্ৰ জানত—বুঝতেও পারত তার পিতা তার ঐ বিধবা বোনটিকে কত স্নেহ করতেন।
ভারতচন্দ্র মিথ্যা বলেননি—সত্যিই দুই মেয়ের বিবাহ বোনের সাহায্য না পেলে হত না।
অন্য বোনেরাও একেবারে নিঃসম্বল ছিল না, কিন্তু কই তারা তো কোনদিন ভাই-এর সংসারে একটি পয়সা দিয়েও সাহায্য করেনি!
আজ ওই সোনার গহনাগুলো ও বাদশাহী মোহরগুলোর দিকে তাকিয়ে আনন্দচন্দ্রের সেই কথাটাই বার বার মনে পড়তে থাকে।
সোনার বাদশাহী মোহরগুলো নিয়ে হাতের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে অন্যমনস্ক ভাবে হঠাৎই যেন গতরাত্রে স্ত্রী অন্নদাসুন্দরীর কথাগুলো মনে পড়ে যায়। অন্নদাসুন্দরী বলেছিল, প্রত্যক্ষ দেহি, মেজ পিসী ঠাকরেন আমার শিয়রের ধারে খাড়ায়ে আছেন, আমারে ডাকতিছেন হাতের ইশারায়, বাঁ হাতে তাঁর একটা কমণ্ডলু।
তবে কি মেজ পিসী আকারে ইঙ্গিতে অন্নদাসুন্দরীকে এই কমণ্ডলুর মধ্যে তাঁর সঞ্চয়ের অবশিষ্ট সোনাদানা ও মোহরগুলোর কথাই বলতে চেয়েছিলেন!
স্বপ্ন হোক, নিছক ঘুমের ঘোরে বা মিথ্যাই হোক, অন্নদাও মেজ পিসীর ধনরত্নের কথা কিছুই জানত না। তার পক্ষে জানাও সম্ভব নয়। তবে ব্যাপারটা কি? হিন্দুশাস্ত্রে প্রেতের কথা আছে বটে কিন্তু আনন্দচন্দ্র সে সব কিছুই বিশ্বাস করে না। যা আজ পর্যন্ত প্রমাণ হয়নি তা বিশ্বাসই বা করা যায় কেমন করে? কেমন করে আনন্দচন্দ্র বিশ্বাস করবে সেরাত্রে মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই মেজ পিসী সূক্ষ্ম দেহ ধারণ করে অন্নদাসুন্দরীর সামনে এসে দেখা দিয়েছিল তাকে। অথচ এও আনন্দচন্দ্রের স্থির বিশ্বাস, অন্নদাসুন্দরী তাকে মিথ্যা করে কোন গল্প বানিয়ে বলেনি।
মনের মধ্যে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের যেন একটা দ্বন্দ্ব চলতে থাকে আনন্দচন্দ্রের। বাইরে তখন ক্রমশ সূর্যালোক ম্লান হয়ে এসেছে। গাছের ছায়া দীর্ঘতর হয়েছে।
বাদশাহী মোহরগুলো ও সোনার গহনাগুলো কাপড়ের খুঁটে বেঁধে এক সময় ওই ঘর থেকে আনন্দচন্দ্র বের হয়ে এল।
এবং এক সময় চুপে চুপে গতরাত্রে তার যে ঘরে শয়নের ব্যবস্থা হয়েছিল সেই ঘরে প্রবেশ করে একটা মাটির হাঁড়ির মধ্যে সব কিছু সংগোপনে রেখে দিল। একবার মনে হয়েছিল আনন্দচন্দ্রের পিসীমণিকে ব্যাপারটা জানাবে গোপনে, কিন্তু আবার কি ভেবে চুপচাপই থেকে গেল।
.
আসন্ন সন্ধ্যার ম্লান আলোয় গাঙের ধারে বসেছিল একটা হেলে পড়া যজ্ঞি- ডুমুরের গাছের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে আনন্দচন্দ্র। মধুমতী ভাঙছে—মধ্যে মধ্যে ঝপ্ ঝপ্ করে পাড় ভাঙার শব্দ কানে আসে। যেখানটায় সে বসেছিল সেটা হয়ত আর কিছুদিন পরে মধুমতীর তীব্র স্রোতের টানে জলের তলায় ভেঙে তলিয়ে যাবে। এ পাড় ভাঙছে আর ও পাড়ে চর জাগছে।
একটা মাছরাঙ্গা পাখি মধ্যে মধ্যে যজ্ঞিডুমুরের একটা ডাল থেকে নদীর খরস্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ ধরবার চেষ্টা করছে। আনন্দচন্দ্রের মনেও সেই চিরন্তন প্রশ্নটি ঘোরাফেরা করছিল। মৃত্যুর পরেই কি সব শেষ! অন্ধকার, এক নিঃসীম অন্ধকার, না সেই ঘন শূন্য অন্ধকারের ওপারেও কিছু আছে!
ভূত-প্রেতের কথা বড়দের মুখে আনন্দচন্দ্র সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে। আগে যদিও বা কিছুটা বিশ্বাস করতো, কলকাতায় গিয়ে ইংরাজী শিক্ষাগ্রহণের পর ধীরে ধীরে সে সব কিছু সে অবিশ্বাস্য বলেই মনে করে।
Nothing beyond death! সহপাঠি অম্বিকাচরণ একদিন তাকে বলেছিল। কথাটা উঠেছিল কথায় কথায় আলোচনা প্রসঙ্গে, মৃত্যুর পরে কি? তারই জবাবে অম্বিকাচরণ ওই কথাগুলো বলেছিল।
তথাপি বহুদিনের সংস্কারবদ্ধ মনের তাগিদে তর্ক করেছিল আনন্দচন্দ্র বন্ধুর সঙ্গে। বলেছিল, তাহলে তুমি বলতে চাও অম্বিকা, হিন্দুদের ওই যে যুগ-যুগান্তরের ধারণা সেটা সব মিথ্যে!
হ্যাঁ মিথ্যা, অন্ধ কুসংস্কার একটা।
এতকালের বিশ্বাসটা বলতে চাও তাহলে—
হ্যাঁ, বাধা দিয়ে বলে উঠেছিল অম্বিকাচরণ, মিথ্যা!
মহা মহা পণ্ডিতরা যে বিশ্বাস করে এসেছেন—শাস্ত্রে যা লেখা আছে—
ওসব শাস্ত্র-পুস্তক আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে আমাদের আনন্দ, নচেৎ জেনো মুক্তি আসবে না।
আত্মা বলেও তাহলে কিছু আছে তুমি বিশ্বাস করো না অম্বিকা! মরীয়া হয়ে আনন্দচন্দ্র বলেছিল।
না। So long there is existence, I believe it—but after death where there is no existence, decline to believe anything, all stories and superstitions.
অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।
নদীবক্ষ থেকে দিনশেষের শেষ আলোটুকুও মুছে গিয়েছে। কেবল যতদূর দৃষ্টিচলে দিগন্তবিস্তৃত একটা কালো পর্দা যেন ঘন জমাট বেঁধে আছে।
উঠতে গিয়ে আনন্দচন্দ্র যেন হঠাৎ শিহরিত হয়। একটা অশরীরী উপস্থিতি যেন সে সর্বচেতনা দিয়ে অনুভব করে।
কেউ যেন তার পাশেই রয়েছে।
হাত দিয়ে তাকে স্পর্শ করা না গেলেও সে যেন অশরীরীর উপস্থিতিটুকু অনুভব করতে পারছে।
আনন্দ! একটা চাপা কণ্ঠস্বর, ঠিক যেন সন্ধ্যার ঘনীভূত অন্ধকারে একেবারে পাশ থেকেই শোনা গেল। থমকে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে আনন্দচন্দ্র। বাঁ পাশে ঘন বাঁশ ঝোপে হাওয়া লেগে তার পাতাগুলো যেন অকস্মাৎ থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো। একটা সিপ্ সিপ্ শব্দ।
শুনতে তার ভুল হয়নি তো? কই, আশেপাশে তার কোথাও তো কেউ নেই! তবে কে ‘আনন্দ’ বলে তাকে ডাকল? সত্যিই কেউ ডাকল, না তার শোনার ভুল! সেই দ্বিপ্রহর. থেকে কেবলই তার মনের মধ্যে মেজ পিসীর কথা আনাগোনা করছে, হয়ত তারই সাড়া মন থেকে এসেছে।
কিছুক্ষণ তবু দাঁড়িয়ে রইলো আনন্দচন্দ্র নদীতীরে সেই ঘনীভূত অন্ধকারের মধ্যে। তারপর একসময় পা চালাল।
গৃহে যখন পৌঁছাল নজরে পড়লো হ্যারিকেনের আলোয় পাল মণ্ডপে প্রতিমার গায়ে রং চড়াচ্ছে—মা-দুর্গার গায়ে বাসন্তী রং
আর দিন চারেক বাদেই পুজো।
রমাকান্তর পিতার আমল থেকে এই বাড়িতে দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে। তাঁর আদিপুরুষরা যখন বরাহনগরে বসবাস করতেন, সেই সময় থেকেই দুর্গোৎসব শুরু হয়, বংশানুক্রমে সেটা চলে আসছে।
ভারতচন্দ্রের অবস্থা তেমন নয়, তথাপি তিনি পূজো বাদ দেন না। যেমন করেই হোক পূজা করেন। সম্বৎসরে মা-দুর্গা আসবেন না গৃহে, তাই হয় নাকি!
মণ্ডপের পাশ দিয়ে বহির্বাটির দিকে এগোতেই পিতার কণ্ঠস্বর কানে এল আনন্দচন্দ্রের, কেডা যাতিছে!
সাড়া দিল, আনন্দচন্দ্ৰ, আজ্ঞে আমি।
কোহানে গিছিলে?
পায়ে পায়ে আনন্দচন্দ্র বাইরের ঘরে ফরাসপাতা চৌকিটার উপর যেখানে বসে ভারতচন্দ্র আলবোলায় তামুক সেবন করছিলেন সেখানে এসে দাঁড়াল।
সারাডা দিন ছিলে কোহানে? পিতার প্রশ্ন
আজকাল সন্ধ্যে হলেই শিশির পড়তি শুরু করে, ঠাণ্ডাফাণ্ডা লাগায়ো না।
আনন্দচন্দ্র চুপ করে থাকে। কোন জবাব দেয় না।
পড়াশুনা কেমন হতিছে?
ভাল।
এবারেই তো তোমার শেষ পরীক্ষা?
আজ্ঞে।
তারপর ডাক্তারী—দেহো তুমি আমার একমাত্র পুত্রসন্তান—অনেক আশা তোমার উপর আমার, তুমি ডাক্তারী পাস করে গ্রামে বসবা—এ তল্লাটে একটিও পাস করা ডাক্তার নাই।
আমি ভাবছিলাম—ডাক্তারী স্কুলের পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তারী কলেজে পড়বো—
ডাক্তারী কলেজে পড়বা সে টাকা আমার কোথায়? কি করে যে সংসার চলতিছে তুমি তো জান না—
যা হোক একটা ব্যবস্থা চেষ্টা করলে হয়ে যাবে বাবা—
না, না—কি হবে কলেজে পড়ি, স্কুলের পাসই যথেষ্ট। দেখতিছো তো আমার শরীরের অবস্থা, বয়েস হইছে আর তেমন খাটতিও পারি না—
সত্যি এবারে এসে আনন্দচন্দ্রের পিতাকে দেখে তাই মনে হয়েছে। মানুষটার শরীরটা যেন একেবারে ভেঙে গিয়েছে।
যাও—বাড়ির মধ্যে যাও।
আনন্দচন্দ্র ঘর থেকে বের হয়ে এল।
রাত্রে আবার সেই উত্তরের পোতার ঘরে আনন্দচন্দ্রের দেখা হল স্ত্রী অন্নদাসুন্দরীর সঙ্গে। একপাশে স্তূপীকৃত জ্বালানী কাঠ কেমন একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ ছড়াচ্ছে, মধ্যে মধ্যে আরশুলা আর ইঁদুরের চলাচলের শব্দ
এই শোন! আনন্দচন্দ্ৰ ডাকল।
কি, কও?
তোমারে একটা জিনিস দেখাবো—
কি জিনিস?
চোখ বোজ—
চোখ বুজতি হবে!
হ্যাঁ।
কেন?
যা বলি কর, বোঝ চোখ—
কিশোরী অন্নদা চোখের পাতা দুটো বোজায়।
যখন চোখ খুলতি কব—তহন খুলবা, বুঝিছো?
হ্যাঁ। মাথা দোলাল অন্নদাসুন্দরী।
কিছুক্ষণ পরে আবার স্বামীর গলা শোনা গেল, হ, এহনে চোখ খোল।
প্রদীপের আলোয় স্বামীর সামনে রাখা সোনার গহনা ও বাদশাহী মোহরগুলো ঝিলমিল করছে।
ও মাগো, এ সব কনে পালে?
চুপ, চেঁচায়ো না।
এ যে পাটিহার—বাজুবন্ধ, আর ওগুলো কি গো!
সোনার টাকা।
সোনার আবার টাকা হয় নাকি?
হয়। এগুলোরে কয় বাদশাহী মোহর। দেশে যখন আকবর বাদশা রাজত্ব করতো তারই তৈরি ও প্রচলিত আকবরী মোহর।
দেহি দেহি। কৌতূহলী হাতে তুলে নেয় মোহর কয়টা অন্নদাসুন্দরী। দেখতে দেখতে বলে, এসব তুমি কোথায় পালে গো?
মেজ পিসীর ঘরে একটা তামার কমণ্ডলুর মধ্যে ছিল।
সত্যি!
হ্যাঁ। এগুলো বোধ হয় মেজ পিসী তোমারেই দিতি চেয়েছিলেন—
আমারে!
তা না-হলে উনি তোমারে স্বপ্নে দেখা দেবেন ক্যান?