মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ২

॥ দুই ॥

গাঁয়ের মানুষ সম্পূর্ণ গেঁয়ো হলেও ভারতচন্দ্রের দূরদৃষ্টি ছিল। তাঁর দৃষ্টি অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল, আর তাইতেই বোধ হয় সে যুগের সেই কষ্টসাধ্য দিনেও রীতিমত গাঁ থেকে দূরের পথ সেই কলকাতা শহরে শিক্ষার জন্য প্রেরণ করেছিলেন নিজের একটিমাত্র পুত্র-সন্তানকে। ছোট্ট পরিধির মধুমতী নদীর তীরবর্তী শান্ত ইতিনা গ্রাম নয়—কলকাতা শহর। যে ইয়োরোপীয় গোষ্ঠী তখন সারা ভারতবর্ষ জুড়ে রাজত্ব করছে, তখন তাদেরই মুখে মুখে একটি জার্মান প্রবাদ শোনা যেত— Stadtluf mach freit, যার অর্থ হল Town air makes a man free—নগরের হাওয়ায় মানুষ মুক্তির স্বাদ পায়।

ভারতচন্দ্র বুঝতে পারতেন তাঁর পুত্র-সন্তানকে ওই শান্ত নিরীহ গ্রাম্য পরিবেশ থেকে দূরে নাগরিক পরিবেশের মধ্যে না পাঠিয়ে দিতে পারলে তার জীবনের প্রকৃত শিক্ষা যেমন পাবে না সে, তেমনি তার মনটাও বিস্তৃতিলাভ করবে না।

তাই কঠোর দারিদ্র্য ও অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলেও তিনি তাঁর বড় আদরের একমাত্র পুত্র-সন্তানকে একপ্রকার সকলের অমতেই জোর করে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সংকীর্ণতার পরিবেশ থেকে তাই তিনি তাঁর নয়নমণিকে দূরে মহানগরীর পরিবেশে গড়ে ওঠবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

আনন্দচন্দ্র কিন্তু মা ও পিসীদের আদর ও প্রশ্রয়ের আশ্রয় ছেড়ে এক অজানা পরিবেশের মধ্যে প্রথমটায় সহজে যেতে চায় নি।

ভারতচন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন, এগিয়ে যেতে হবে তোমাকে বাবা—এগিয়ে যেতে হবে। যে এগোয় না, চলতে চায় না, সে শ্রেষ্ঠজন হলেও ক্রমে নীচ হতে থাকে।

চরৈবেতি—চরৈবেতি।

পণ্ডিত শ্রীধর তর্করত্ন মশাই ছিলেন ওই গ্রামেরই। তিনি কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে পড়াতেন। তাঁরই পরামর্শমত তাঁরই সঙ্গে এগারো বৎসরের বালক আনন্দচন্দ্রকে দূর দুর্গম পথে তখনকার দিনে কলকাতা শহরে শিক্ষার জন্য প্রেরণ করেছিলেন ভারতচন্দ্র।

কিছুদিন সংস্কৃত কলেজে পড়ে পরে আনন্দচন্দ্র হিন্দু কলেজে প্রবেশ করে।

আনন্দচন্দ্রের মধ্যে গত পাঁচ বৎসর কলকাতা শহরে থেকে অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। সে আর গেঁয়ো নয়—শহুরে ছেলে আজ যাকে বলে। তাঁর ইচ্ছা হিন্দু কলেজের শিক্ষা শেষ করে ডাক্তারী পড়বে মেডিকেল কলেজে।

তাই বুঝি অন্নদাসুন্দরীর কান্না দেখে তাঁর বিস্ময়বোধ হয়। অন্নদাসুন্দরী তখনো কেঁদে চলেছেন।

আনন্দচন্দ্র বললেন, বাড়ির লোকজনদের জন্য তোর মন খারাপ করছে বুঝি রে! তা কান্না কিসের, আমি কলকাতায় ফেরার পথে তোকে নামিয়ে দিয়ে যাব তোদের গ্রামে। আনন্দচন্দ্র স্ত্রীকে বুঝি আরো সান্ত্বনা দেবার জন্য বললেন, ওই দেখ বাইরে চেয়ে—দেখ কি সুন্দর এক ঝাঁক পাখি!

সত্যিই এক ঝাঁক সবুজ পাখি তখন টি টি করে ডাকতে ডাকতে হরিদ্রাভ শস্যক্ষেতের ওপর দিয়ে একটু বিস্তৃত সবুজ মালার মতই উড়তে উড়তে কোথায় মিলিয়ে গেল। আবার কোথায় যেন সেই হলুদ পাখিটা ডেকে উঠল কোন বৃক্ষের কোন ঘন পত্রান্তরাল হতে—–বউ কথা কও, বউ কথা কও।

অন্নদাসুন্দরীর মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে আনন্দচন্দ্র তাঁর উত্তরীয়প্রান্ত দিয়ে অন্নদার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন গভীর মমতায়, ছি, কাঁদে না।

বালিকা বধূ অন্নদাসুন্দরীর কান্নার বেগটা যেন তাতে করে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। বুকের সমস্ত হাহাকার একাকীত্ব ও অসহায়বোধ যেন স্বামীর সান্ত্বনার মধ্যে কোন অবলম্বনই খুঁজে পায় না। আনন্দচন্দ্রের একবার মনে হয়েছিল, মেয়েটা এত বোকা কেন? মেয়েছেলে হয়ে যখন জন্মেছে বিয়ে তো তার একদিন না একদিন হতই, আর বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়িতেও যেতে হত। আর তাই তো হয়েছে—বিয়ের পর স্বাভাবিক নিয়মেই শ্বশুরবাড়ি চলেছে। তার মধ্যে এত কান্নার কি আছে? কিন্তু আনন্দচন্দ্র কেমন করে বুঝবে, বধূ বয়েসে নিতান্তই বালিকা। তাই এতদিন জ্ঞান হওয়া অবধি যাদের কাছে ছিল, যাদের সঙ্গে ছিল, যে পরিবেশে ছিল—সে সব কিছু ছেড়ে আসতে কত দুঃখ লাগে!

বিরক্তই হয় এবারে আনন্দচন্দ্র কিছুটা। তবু নানাভাবে ক্রন্দনরতা বালিকা বধূকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই অন্নদাসুন্দরীর কান্না যখন থামে না, ও চুপ করে বসে থাকে।

অপরাহ্ণের শেষ ম্লান আলোয় একসময় পরিশ্রান্ত বাহকেরা পালকি এনে কাঁধ থেকে নামাল ভারতচন্দ্রের গৃহের আঙ্গিনায়।

ভারতচন্দ্রের গৃহের ও সংসারের যাবতীয় কর্তৃত্ব তো তাঁর বোনেদের উপরেই অর্থাৎ ভারতচন্দ্রের স্ত্রী যাদের ঠাকরুন বলে সম্বোধন করতেন সেই তাদের উপরেই ভার ছিল বৌ-বরণের। বৌ-বরণের সকল ব্যবস্থা তারাই করে রেখেছিল কুলপ্রথানুযায়ী। গৃহিণী বামাসুন্দরী যেমন বিবাহ হয়ে ওই গৃহে আসা অবধি অন্তরালে ছিলেন, আজও তেমনই তিনি অন্তরালেই ছিলেন। গোলগাল কালো বেঁটেখাটো মানুষটি। পরনে একটা মলিন লালপাড় শাড়ি, গলা পর্যন্ত ঘোমটা টানা, হাতে মাত্র দুটি সোনাবাঁধানো, লোহা আর শাঁখা।

ভারতচন্দ্রের বড় তিনটি মেয়ের ইতিমধ্যেই বিবাহ হয়ে গিয়েছিল। কেবল ছোট দুটি মেয়ের বিবাহ তখনো হয় নি। বড় তিন মেয়ের মধ্যে একমাত্র জ্যেষ্ঠা চঞ্চলাই ভাইয়ের বিবাহে আসতে পেরেছিল। এক বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ একান্নবর্তী পরিবারে তার বিবাহ হয়েছিল। মেয়ে দেখতে সুন্দরী ছিল বলে ভারতচন্দ্রকে বড় মেয়ে চঞ্চলার বিবাহে কোন বেগ পেতেই হয় নি, মাত্র শাঁখা-সিন্দুর দিয়ে পাত্রস্থ করেছিলেন। এখন অবিশ্যি বড়ঘরের বৌ চঞ্চলা। তার হাতে সোনার চুড়ি, হাঙ্গরমুখী বালা, বাজুতে অনন্ত, গলায় মোটা বিছেহার পাঁচ নরীর, কানে সোনার ফুল, নাকে সোনার নথ, কোমরে গোট। সে যে বড়ঘরের বৌ সেটা তাকে দেখলেই বোঝা যেত এবং চালচলনে কথায়বার্তায়ও প্রকাশ পেত। বড়, সেজ ও ছোট পিসীদের পরামর্শমতই সব ব্যবস্থা হয়েছিল, গৃহিণী বামাসুন্দরীকে তারা ডাকেও নি, তিনিও আসেন নি। কিন্তু পিসীরাও সবাই বিধবা। তাদের তো মঙ্গলকার্যে কোন অধিকার নেই। তাই পালকি এসে আঙ্গিনায় নামাতেই চঞ্চলাই এগিয়ে এল সর্বাগ্রে।

চঞ্চলা একা নয়, আশেপাশের সমবয়সী গৃহস্থ বধূরাও তার পাশে পাশে এগিয়ে আসে। বিরাট একটা পাথরের থালায় নিকানো আঙ্গিনার মাঝখানে আলপনা ও পদ্ম এঁকে দুধ ঢালা ছিল। নববধূকে চঞ্চলাই হাত ধরে নামিয়ে আনে পালকি থেকে। অন্যান্যরা কেউ উলুধ্বনি দেয়, কেউ শঙ্খে ফুঁ দেয়। গাঁটছড়া বাঁধা আনন্দচন্দ্র পাশে দাঁড়ায়। নববধূ চঞ্চলার নির্দেশে আলতাপরা ছোট ছোট দুখানি পা দুধভরতি পাথরের থালায় রাখে।

সাদা দুধ আলতায় রঙিন হয়ে ওঠে।

ঝেঁটিয়ে এসেছে সব আশপাশের গৃহস্থবাড়ি থেকে বৌ, ঝি, গিন্নীরা ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। তারা ঠেলাঠেলি করে বৌ দেখবার জন্য।

ভারতচন্দ্র চেঁচিয়ে বলেন, ওহে গোপীনাথ, বাজাও বাজাও—সানাই বাজাও। ওরে কেষ্টা, ঢোল বাজা।

বৌ-বরণ-পর্ব শেষ হবার পর চঞ্চলা সকলকে বলে, ওগো, তোমরা একটু সরে দাঁড়াও, পথ দাও। তারপর অন্নদাসুন্দরীর হাত ধরে বলে, এসো গো বউ, চল ঘরে চল।

অন্নদাসুন্দরী যেন কেমন জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

কি গো, কি হল, চল ঘরে চল! চঞ্চলা অন্নদাসুন্দরীর হাত ধরে সামনের দিকে ঈষৎ আকর্ষণ করে।

অন্নদাসুন্দরী এবারে ননদিনীর নির্দেশ পালন করে দুধভর্তি পাথরের থালা থেকে পা তুলে চিত্রিত আঙ্গিনায় রাখে।

চল, এবারে চল।

পরিষ্কার ঝকঝকে গোবরে নিকানো আঙ্গিনায় পা ফেলে ফেলে নয় বৎসরের বালিকা বধূ অন্নদাসুন্দরী ভারতচন্দ্রের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল। ভারতচন্দ্রের চার বিধবা বোন। একজনের বয়স প্রায় পঞ্চাশ—ভারতচন্দ্রের বড়, দ্বিতীয়ার বয়স চল্লিশ পার হয়েছে, অন্যজনা মানে তৃতীয়ার বয়সও চল্লিশ এবং চতুর্থার বয়স তা প্রায় বত্রিশ-তেত্রিশ হবে। ওরা দুইজন ভারতচন্দ্রের ছোট। চন্দ্রকলা, নিভাননী, সরোজিনী ও বিন্দুবাসিনী। ভারতচন্দ্রের সংসারের প্রকৃত কর্তৃত্ব ওই চার বিধবা বোনের উপরেই ন্যস্ত।

সংসারের ব্যবস্থা তারা যেমনটি করবে তেমনি হবে—তার অন্যথা হবার কোন উপায়ই নেই। ভারতচন্দ্রের পিতা রামকান্তর অবস্থা ছিল খুবই গরিব। তিনিও বৃত্তিতে ছিলেন কবিরাজ এবং সঙ্গে জ্যোতিষচর্চাও করতেন। কৈশোরে বারাণসীধামে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দুটি বিদ্যা অর্জন করে দীর্ঘ আট বৎসর পরে আবার গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। দীর্ঘ আট বৎসর কেউ তাঁর কোন সংবাদ পায় নি। তখনকারের দিনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চিঠিপত্রের আদানপ্রদানের ব্যবস্থাও তেমন ছিল না। তাহলেও তিনি গৃহে কোন সংবাদই দেন নি। সকলেই ধরে নিয়েছিল, বিশেষ করে বৃদ্ধ পিতামাতা ও বালিকা বধূ, যে হয় তিনি বেঁচে নেই অথবা সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছেন। অবশেষে পুত্র রামকান্তর নৌকা গঙ্গার ঘাটে এসে লাগল এক শ্রাবণের বৃষ্টিঝরা মধ্যরাত্রিতে।

রামকান্ত ছিলেন যেমন দীর্ঘদেহী, তেমনি গৌরবর্ণ পুরুষ। গত আট বৎসরে তাঁর চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাই কেরোসিন কুপির ম্লান আলোয় আগন্তুককে বৃদ্ধ বাপ ঠিক চিনে উঠতে পারেন নি।

তিনি শুধিয়েছিলেন, কে তুমি? কোথা থেকে আসতেছো বাছা এই ঝড়জলের রাত্রে? নৌকাডুবি হইছে কি?

চিনতে কিন্তু পেরেছিলেন রামকান্তর মা বিধুমুখী। পুত্রকে চিনতে মায়ের কষ্ট হয় নি। তিনিই বলেছিলেন, কে, রাম?

হ্যাঁ, মা।

রামকান্ত মা-বাবার পদধূলি নিল।

গৃহমধ্যে মুহূর্তে সে একটা আনন্দের সাড়া পড়ে গেল।

মা চিৎকার করে বললেন, ওরে হতভাগী, শাঁখ বাজা, শাঁখ বাজা!

হতভাগী, অবহেলিত পুত্রবধূ চন্দ্রভামিনী অদূরে ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে ছিল। সব কথাই তার কানে গিয়েছে।

তার সমগ্র দেহ তখন বেতসপত্রের মত কাঁপছে। দু’খানি তো মাত্র চালাঘর। একটি বড়, একটি ছোট। তারপর একটি আঙ্গিনা। আঙ্গিনা পার হলে একটি খুপরির মত রন্ধনশালা, তার পাশে ঢেঁকিশালা।

সাত বৎসর বয়সে এই গৃহে সে বধূ হয়ে এসেছিল এবং বিবাহের চার বৎসর পরই তার স্বামী গৃহত্যাগ করে। গত আট বৎসরে কখন কৈশোর ছাপিয়ে সারা দেহে এসেছে যৌবনের জোয়ার, বেচারী হতভাগিনী বধূ সেটা জানবারও অবকাশ বুঝি পায় নি। গৃহত্যাগী স্বামীর অবহেলিতা স্ত্রী লজ্জা ও নিজের দুর্ভাগ্যের মর্মদাহে যেন জীবস্মৃতা হয়ে ছিল। আজ শাশুড়ির কথায় তার সেই অবহেলিত যৌবন-নির্যাতিত মর্যাদা যেন সহসা ওই মুহূর্তে জেগে ওঠে।

স্খলিতপদে চন্দ্রভামিনী টলতে টলতে যেন পাশের ঘরে গিয়ে ঢোকে। ঠাকুরের আসন ছিল সেই ঘরে। ঘর অন্ধকার, কোনমতে টলতে টলতে গিয়ে ঠাকুরের আসনের সামনে বসে। তারপর হাতড়ে হাতড়ে শঙ্খটা তুলে নেয় হাতে, কিন্তু শঙ্খে ফুঁ দিলেও তা থেকে কোন আওয়াজ বের হয় না। কেবল রুদ্ধকণ্ঠ চন্দ্রভামিনীর দু চোখের কোণ বেয়ে এত বছরের নিরুদ্ধ অশ্রুপ্রবাহ দরদর ধারায় তার গণ্ড ও চিবুক প্লাবিত করতে থাকে।

রামকান্ত ফিরে এলেন। আবার সংসারধর্ম করতে লাগলেন। কবিরাজী ও জ্যোতিষচর্চা শুরু করলেন।

পর পর দুটি কন্যার পর এক পুত্র আর দুই কন্যা হল। সংসারে মানুষ বাড়তে লাগল কিন্তু আয় তেমন নেই। কবিরাজী বা জ্যোতিষী কোনটা থেকেই তেমন একটা সুরাহা হয় না। কোনমতে দিনগত পাপক্ষয় যেন। তার মধ্যেই কন্যাদায়। ইতিমধ্যে পিতা ও মাতা দুজনারই স্বর্গবাস হয়েছিল। বড় দুটি কন্যাকে বিবাহ দিলেন, তৃতীয়টির বিবাহের জন্য চেষ্টাচরিত্র করছেন, এমন সময় বজ্রাঘাত হল। বড় জামাইটি বিবাহের দুই বৎসর পরেই নিদারুণ বিসূচিকা রোগে মারা গেল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চন্দ্রকলা বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে ফিরে এল এগারো বৎসর বয়সেই। তারই মধ্যে তৃতীয়া ও চতুর্থা কন্যার বিবাহ দিলেন এবং কনিষ্ঠার বিবাহের দুই বৎসর পরে দ্বিতীয় কন্যা নিভাননী পিতৃগৃহে বিধবা হয়ে ফিরে এল। সন্ন্যাস রোগে আকস্মিক মৃত্যু ঘটেছে তার স্বামীর—মোড়লগঞ্জের প্রৌঢ় স্বামী পতিতপাবন চৌধুরীর। প্রৌঢ় দোজবরে দ্বিতীয় কন্যার বিবাহ দিলেও বোনেদের মধ্যে তারই সব চাইতে অবস্থাপন্ন ঘরে বিবাহ হয়েছিল।

ভারতচন্দ্র যেমন সুরসিক ছিলেন তেমনি গল্প করতে পারতেন। লোকে তাই বলত—গল্প শোন তো যাও ভারতচন্দ্রের গৃহে।

ওইসব অতীতের গল্প বালিকা বধূ অন্নদাসুন্দরীর শ্বশুরের মুখ থেকেই শোনা। তিনি বলতেন, আমার পিতাঠাকুর রামকান্তর জীবনটা যেন একটা নাটকীয় গল্প, বুঝলে বৌমা! আঘাতের পর আঘাত এসেছে তাঁর জীবনে, কিন্তু ভাগ্যের কাছে কখনো মাথা নোয়াননি পিতাঠাকুর। বলতেন—জানতাম, জানতাম জ্যোতিষীর গণনা মিথ্যা হবার নয়। মূর্খ আমি, বিশ্বাস করিনি। ভাগ্যের নিষ্ঠুর ইঙ্গিতকে অস্বীকার করবার চেষ্টা করেছি। বিশ্বাস করি নি, চুল-পরিমাণ ছিদ্রপথেও কি করে কালনাগিনী লোহার বাসরে প্রবেশ করে মৃত্যু-দংশন হানতে পারে!

জ্যোতিষার্ণব রামকান্তর ওই কথাগুলো বলার কারণ ছিল।

প্রত্যেক সন্তানের কোষ্ঠী তিনিই নিজে রচনা করেছিলেন এবং বার বার গণনা করে দেখেছিলেন প্রত্যেকটি কন্যারই নিষ্ঠুর বৈধব্যযোগ রয়েছে অল্প বয়সেই। মনে মনে কত সময় ভেবেছেন রামকান্ত। তাঁর গণনা ভুলও তো হতে পারে, তাঁর গণনা যে একেবারে নির্ভুল তারই বা নিশ্চয়তা কি? আবার এও ভেবেছেন সঙ্গে সঙ্গে—মেয়েদের বিবাহ দেব না। থাক তারা তাঁরই গৃহে চিরকুমারী।

কিন্তু সমাজের ভয়ে ও স্ত্রীর অবিরাম তাগিদে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।

তোমার মতলবখানা কি বলতি পার? মেয়ের কি বিবাহ দেবা না?

রামকান্ত করুণ দৃষ্টিতে কেবল চেয়ে থেকেছেন স্ত্রীর মুখের দিকে। বলতে পারেন নি—সাহস হয় না বৌ, কন্যাদের যে প্রত্যেকেরই বৈধব্যযোগ রয়েছে।

কিন্তু নিয়তি কে খণ্ডাতে পারে! অলঙ্ঘ্য নিয়তিই তার নিজস্ব পথে রামকান্ত ও তাঁর কন্যাদের অলক্ষ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছে।

বিবাহ দিতে হয়েছে এক এক করে প্রত্যেকটি মেয়েরই এবং ছেলে খুঁজে খুঁজে নানাভাবে তাদের কোষ্ঠীবিচার করে তার বিবাহ দিয়েছেন, যার ভাগ্যে অকালে মৃত্যুযোগ নেই। কিন্তু তথাপি কন্যাদের বৈধব্য এড়াতে পারেন নি। এবং শেষ ও কনিষ্ঠা কন্যাটিও যখন বিবাহের দুই বৎসরের মধ্যে বিধবা হয়ে তাঁরই গৃহে ফিরে এল—রামকান্ত কটা দিন কেমন যেন ভাম হয়ে বসে রইলেন। কারো সঙ্গে কথা বলেন না, না খাওয়া না কিছু। লোকে কবিরাজীর জন্য আসে, ফিরিয়ে দেন।

অবশেষে একদিন যে জ্যোতিষের পুঁথিপত্রগুলো বহু শ্রমে বারাণসীধাম থেকে একদা সংগ্রহ করে এনেছিলেন, যে পুঁথিগুলো তাঁর জীবনের অন্যতম প্রিয় বস্তু ছিল, সেগুলো সব এক মধ্যরাত্রে আগুন জ্বেলে এক এক করে অগ্নিতে সমর্পণ করলেন। চোখের সামনে তাঁর সব প্রিয় পুঁথিগুলো পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন সেই ভস্মস্তূপের সামনে রামকান্ত।

.

কখন প্রত্যুষের আলো ঘরের গবাক্ষপথে কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করেছে জানতেও পারেন নি। হঠাৎ স্ত্রী চন্দ্রভামিনীর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলেন।

এ কি! ঘরময় এত ছাই কিসের?

কোন জবাব দেন না রামকান্ত। কেমন যেন অসহায় বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন স্ত্রীর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে।

পুঁথিপত্রের সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিষচর্চাও একেবারে ছেড়ে দেন।

কনিষ্ঠা কন্যার বৈধব্যের পর আর অবিশ্যি বেশী দিন বেঁচে থাকেন নি রামকান্ত। বছর দুইয়ের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়।

একমাত্র পুত্র ভারতচন্দ্রের তখন মাত্র একুশ বৎসর বয়স। তিনি তাঁর বাপের কাছ থেকে কবিরাজী চিকিৎসা-বিদ্যা আয়ত্ত করে কবিরাজী ব্যবসা শুরু করেছেন বৎসর চারেক হল। বিবাহ হয়েছে, একটি পুত্র ও একটি কন্যাও হয়েছে।

সংসারের সকল দায়দায়িত্ব এসে পড়ল একুশ বৎসরের এক যুবক ভারতচন্দ্রের স্কন্ধে।

ঘরের চারটি বিধবা বোন ও পনেরো বছরের কিশোরী স্ত্রী বামাসুন্দরী। সংসারের সকল প্রকার দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব যেন ওই চার বিধবা ভগিনীই কখন নিজেদের স্কন্ধে তুলে নিয়েছিল। বাড়ির বধূ বামাসুন্দরী ওই চার-চারটি বিধবা বয়োজ্যেষ্ঠা ননদিনীর আড়ালে পড়ে গেলেন কেমন করে যেন একটু একটু করে।

স্বভাবতই বামাসুন্দরী খুব কম কথা বলতেন। তিনি যেন আরো নিঃশব্দ হয়ে গেলেন। বাড়িতে কেউ এলে দেখত বধূটি বুক পর্যন্ত প্রায় অবগুণ্ঠন টেনে নিঃশব্দে বাড়ির মধ্যে সব কাজ করে চলেছে।

অন্নদাসুন্দরী তার শ্বশুরের কাছেই শুনেছিল—বুঝলে বৌমা, ভাগ্যে দিদিরা ছিল, তাই আজ পর্যন্ত কখনো কিছু সংসারের জন্য আমাকে ভাবতে হয় নি। যা রোজগার করি বড়দির হাতে এনে তুলে দিই। ব্যাস্‌, আর আমায় কোন দায়দায়িত্ব পালন করতে হয় নি।

অন্নদাসুন্দরীকে ভারতচন্দ্রের ওই কথাগুলো বলবার প্রয়োজন ছিল না। কারণ সে শ্বশুরগৃহে পা দেওয়ার কিছুকাল পরেই বুঝতে পেরেছিল, ওই আবক্ষগুণ্ঠন-টানা ভদ্রমহিলাটি, যিনি তার শাশুড়ি ঠাকরুন, তাঁর কোন কর্তৃত্বই নেই সংসারে। যা করবেন ওই চার পিসশাশুড়িই। সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী হয়েও তিনি সংসারের কেউ নন।