মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ১৭

।। সতেরো ।।

বল কি জানকী! রাধারমণ বললেন, সব কিছু বিক্রি করে দিলে?

হ্যাঁ, ভাই! ভাই তোমার কাছেও কিছু ধারি, সেটাও জোগাড় করে রেখেছি, যাবার আগে সব ঋণ থেকে মুক্ত হতে যে পেরেছি, সেই আমার সান্ত্বনা! তারপর একটু থেমে জানকী বললেন, জলদবালার দিকে তাকিয়ে, জলদ, আমার বালিশের তলায় টাকার একটা তোড়া আছে, সেটা রাধারমণকে দাও। একটু থেমে আবার বললেন, রাধারমণ, আমিও বুঝতে পেরেছিলাম, এই জ্বর আমায় ছাড়বে না।

কি যা-তা বকছ! কবিরাজ বা ডাক্তার কাউকে ডেকেছিলে?

হারাণ কবিরাজকে ডেকেছিলাম গতকাল সন্ধ্যায়।

কবিরাজ মশাই কি বললেন?

তিনিও শেষ জবাব দিয়ে গিয়েছেন। জানকী বললে, জান তো তাঁর নাড়িজ্ঞানের কথা!

শেষ জবাব দিয়ে গিয়েছেন কবিরাজ?

হাঁ, নাড়ি ধরে অনেকক্ষণ বসে রইলেন, তারপর বললেন, দত্ত মশাই, যেখানে যা করণীয় আগেই করে ফেলুন, নাড়ির গতিক সুবিধার নয়।

রাধারমণ বুঝলেন, অসাধারণ নাড়িজ্ঞান ওই বৃদ্ধ হারাণ কবিরাজের। তিনি যদি ওই কথা বলে থাকেন তো, জানকীর আয়ু শেষই হয়ে এসেছে। রাধারমণ যেন সত্যিই কেমন বিব্রত বোধ করলেন। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন চৌকিটার উপর, দীর্ঘদিনের সুহৃদ জানকী দত্তর দিকে তাকিয়ে।

তুমি তো জান রাধারমণ, আমার কোন সন্তানাদি নেই। সংসার বলতে, আপনার জন বলতে ওই আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা শিবনাথ।

কিন্তু তোমার অসুস্থ স্ত্রী-

হ্যাঁ, পক্ষাঘাতে পঙ্গু স্ত্রী। তা তাকে শিবনাথই দেখবে। শিবনাথকে একপ্রকার সেই তো মানুষ করেছে মাতৃস্নেহে। সংসারের কথা আমি ভাবছি না আর রাধারমণ, আমি শুধু ভাবছি এই জলদের কথা। জলদবালার কি হবে? অবিশ্যি ওকে যা দিয়েছি তাতে ওর বাকী জীবনটা কেটে যাবে। রাধারমণ তাকালেন পশ্চাতে। জলদবালা কখন যেন ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে।

জানকী দত্ত একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, অর্থ যাক আর যাই যাক, যুবতী স্ত্রীলোক। তাছাড়া সংসারে ওরও কেউ নেই আজ। কেবলই মনে হচ্ছে, কেন যে ওকে জীবনের সঙ্গে জড়ালাম?

ওসব কথা থাক জানকী। রাধারমণ বাধা দেবার চেষ্টা করলেন।

জানকী দত্তই বালিশের তলা থেকে টাকার তোড়াটা বের করে রাধারমণের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, সব বিক্রিবাটা করে ঋণশোধ দিয়েও এখনো কিছু টাকা অবশিষ্ট আছে। সেটা আমি তোমার হাতে দিয়ে যেতে চাই রাধারমণ।

আমার হাতে!

হ্যাঁ, তোমার হাতে। একমাত্র তোমাকে ছাড়া আর তো কাউকেই আমি সমস্ত প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে পারি না।

কিন্তু জানকী—

ওই টাকাটা তুমি আমার স্ত্রীর হাতে তুলে দিও নিজে। আর তার সঙ্গে আমার দেখা হবে না। নচেৎ নিজেই তার হাতে টাকাটা দিয়ে যেতাম। কথাগুলো বলে জানকী দত্ত হাঁপাতে লাগলেন। মনে হচ্ছিল তাতে, তিনি যেন অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

জলদ! মৃদু কণ্ঠে ডাকলেন জানকী।

জলদ ঘর থেকে বের হয়ে গেলেও বোধ হয় কাছাকাছি ছিল, ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল।

আমাকে ডাকছেন?

হ্যাঁ। সেই টাকার তোড়াটা বের করে ওকে দাও সিন্দুক থেকে।

জলদবালা ঘরের এক কোণে একটা ছোট লোহার সিন্দক ছিল সেটা খুলে একটা টাকার তোড়া এনে জানকীর হাতে দিতে গেল।

না না, আমাকে নয়, ও অর্থ আমি আর স্পর্শ করব না। ওটা ওকে দাও।

জলদবালা জানকীর নির্দেশ পালন করল। টাকার তোড়াটা এনে রাধারমণের হাতে তুলে দিল। রাধারমণ হাত পেতে অন্য তোড়াটাও নিলেন।

তুমি যে এসে পড়েছ রাধারমণ, এটা তাঁরই ইচ্ছা বোধ হয়। নচেৎ টাকা দিতে তুমি নিজেই বা আসবে কেন আজ? শোন ভাই, আর একটি অনুরোধ তোমার কাছে আমার আছে। এই জলদকে তুমি দেখো।

রাধারমণ এবার অদূরে দণ্ডায়মান জলদবালার দিকে তাকালেন। জলদ তারই দিকে তাকিয়ে ছিল ওই সময়। এবার কিন্তু জলদবালা তার চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিল না। পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

এতকাল নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন স্ত্রীলোকের মুখের দিকে যে মানুষটা কখনো তাকায়নি, তাকাবার ইচ্ছাও হয়নি, আজ সেই মানুষটাই যেন নির্লজ্জের মত তাকিয়ে থাকেন নির্নিমেষে এক যুবতী নারীর দিকে। অগ্নিশিখার মত রূপ জলদবালার যেন। এ রূপের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরানো যায় না। চুম্বকের মত এক অদৃশ্য আকর্ষণে যেন কেবলই সামনের দিকে টানতে থাকে।

জানকী দত্ত চোখ বুজে নিঃসাড়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ যেন চমকে ওঠেন। রাধারমণ জলদবালার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকালেন আবার জানকী দত্তর দিকে।

জানকী, আমি তাহলে আজ উঠি। আবার কাল সকালে আসব।

কিন্তু জানকী দত্তর দিক থেকে কোন সাড়া এল না। তিনি যেমন চোখ বুজে পড়েছিলেন তেমনিই পড়ে রইলেন। জলদবালার দিকে আবার তাকালেন রাধারমণ। জলদবালা তখনো তার দিকেই তাকিয়েছিল।

দত্তদা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি তাহলে উঠছি, কাল সকালে আবার আসব’খন।

আপনি একটু ভাল করে দেখুন তো ওকে। জলদবালা বললে শান্তগলায়, মনে হচ্ছে ঠিক স্বাভাবিক ঘুম নয়—

জলদবালার কথায় যেন একটু চমকেই চৌকি থেকে উঠে পড়লেন রাধারমণ। এগিয়ে গেলেন পালঙ্কের কাছে। নীচু হয়ে বন্ধুকে কিছুক্ষণ ভাল করে দেখলেন। তারপর জানকী দত্তর গায়ে হাত দিয়ে ডাকলেন, জানকী!

জানকী! জানকী!

কোন সাড়া এল না তবু।

রাধারমণের যেন কি রকম সন্দেহ হল। জানকীর নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলেন, না তেমন কোন শ্বাস-প্রশ্বাসই বইছে না। নাড়ীটা পরীক্ষা করলেন — নাড়ীও পাওয়া গেল না। তবে’ কি জানকী দত্তর মৃত্যু হয়েছে। এত অতর্কিতে! এত নিঃশব্দে মৃত্যু এসে গেল!

রাধারমণের আর বুঝতে বাকী থাকে না, জানকী দত্ত সত্যিই আর বেঁচে নেই। তার মৃত্যু হয়েছে।

হতভম্ব রাধারমণ ফিরে এসে চৌকিটার ওপর বসে পড়লেন।

আরো মিনিট কুড়ি পরে।

রাধারমণ তখনো সেই জলচৌকিটার উপর স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। শয্যার উপর জানকীর মৃতদেহ, আর তার পাশেই পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে জলদবালা। দেওয়াল- গিরিটা মিটিমিট জ্বলছে। ঘরের মধ্যে একটা হিমশীতল মৃত্যু-স্তব্ধতা

বাইরে কোথায় যেন একটা পেচক ডেকে উঠল।

রাধারমণ একবার তাকালেন জলদবালার মুখের দিকে। জলদবালাও তাঁরই মুখের দিকে তখনো চেয়ে আছে। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করেন রাধারমণ। বাড়িতে তো জানকীর একটা খবর দেওয়া দরকার। কেমন যেন নিজেকেই নিজে কথাটা বললেন রাধারমণ। জলদবালা কোন সাড়া দিল না।

আমি তাহলে ওর বাড়িতে গিয়ে একটা খবর দিয়ে আসি।

আপনি চলে যাবেন? জলদ মৃদু স্বরে বললে।

হ্যাঁ, ওর বাড়িতে একটা খবর দিতে হবে, সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে।

আমার—আমার কেমন ভয় করছে। জলদ বললে।

ভয়? কিসের ভয়?

আপনি যাবেন না। আমার বড্ড ভয় করছে—

ভয়ের কি আছে জলদ? আমি যাব আর আসব।

আপনি আবার ফিরে আসবেন তো?

হ্যাঁ, তা আসতে হবে বৈকি। ওর সৎকারের সব ব্যবস্থা করতে হবে তো। আমি এখুনি আসছি শিবনাথকে একটা সংবাদ দিয়ে।

কথাগুলো বলে রাধারমণ আর দাঁড়ালেন না, একটু যেন দ্রুতপায়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

.

সংবাদ পেয়েই শিবনাথ ছুটে এল। জানকীর মৃতদেহের উপর উপুড় হয়ে পড়ে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। বয়েসে অনেক ছোট শিবনাথ জানকীর থেকে। পিতার মতই শিবনাথ তার জ্যেষ্ঠকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে এসেছে, ভালবেসে এসেছে। দেবতুল্য চরিত্র ছিল তার জ্যেষ্ঠভ্রাতার, কোথা থেকে যে রাক্ষুসী এসে জুটল, সোনার সংসারটা তাদের যেন ছারখার হয়ে গেল।

প্রথমটায় কিছু জানতেই পারেনি। সে তার কলেজের পড়াশুনা নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত থাকত। সংসারের কোথায় কি ঘটছে সে জানত না, খবরও রাখত না। কিন্তু হঠাৎ যেদিন তার মাতৃসমা বৌদি একদিন পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল, তারপরই পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে গেল, ক্রমে ক্রমে সে সব কথা জানতে পারল।

ঘৃণায়, লজ্জায় ও দুঃখে যেন শিবনাথ প্রথমটায় পাথর হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে সে কেবল গোপনে অশ্রুমোচনই করেছে নিরুপায় বেদনায়, লেখাপড়া করে যেটুকু সময় পেয়েছে বৌদির সেবা-শুশ্রূষা করেছে।

খবরটা শিবনাথ পেয়েছিল তাদেরই এক আশ্রিতা বিধবা প্রৌঢ়া পিসীর কাছ থেকে। সে-ই শিবনাথকে সব কিছু বলেছিল।

কে একটা মাগী নাকি তার জ্যেষ্ঠের স্কন্ধে ভর করেছে! ব্যবসাপত্র সব অবহেলা করে তাকে নিয়েই জানকী দত্ত সর্বদা নির্লজ্জের মত মত্ত। গদিতেও যায় না নিয়মিত। সরকারবাবুই সব দেখাশোনা করেন। জানকী দিবারাত্র সেই মাগীর বাড়িতেই পড়ে থাকে।

সেই মাগীকেই অনেক গহনাপত্র, টাকাকড়ি ও বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে নাকি তার জ্যেষ্ঠ।

জ্যেষ্ঠের মৃত্যুসংবাদ পেয়েই সেই প্রথম এল শিবনাথ এ বাড়িতে। জলদের দিকে সে ফিরেও তাকাল না। শিবনাথই সমস্ত ব্যবস্থা করল।

পাড়াপ্রতিবেশী তার সমবয়সী কয়েকটি যুবককে ডেকে এনে সকলে মিলে যখন শবদেহ নিয়ে শ্মশান যাত্রা করল তখন ভোর হয়ে গিয়েছে। বাইরে রোদ উঠেছে। রাধারমণ শিবনাথকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন।

শূন্য ঘরের মধ্যে দুজনে, রাধারমণ ও জলদবালা। জলদবালা চোখের জল ছিল না। সে একপাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল। রাধারমণ বললেন, আমি তাহলে এবার যাই জলদ?

জলদবালা রাধারমণের দিকে তাকাল নিঃশব্দে।

বলছিলাম, আমি তাহলে এবার যাই?

আপনি আবার আসবেন তো?

রাধারমণ কি জবাব দেবেন বুঝতে পারেন না।

আপনি কি আর আসবেন না এখানে? জলদ একটু থেমে আবার বলল, বুঝতে পেরেছি, আর আসবেন না আপনি। কথাগুলো বলতে বলতে সুন্দর ডাগর চক্ষু দুটি জলদবালার অশ্রুতে যেন টলমল করে উঠল।

আসব জলদ। রাধারমণ বললেন

আসবেন! সত্যিই আসবেন!

আসব।

ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাধারমণ সোজা এসে রাস্তায় পড়লেন, তার পর হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু একজোড়া জলভরা চোখের মিনতি যেন তাঁর পিছনে পিছনে তাকে অনুসরণ করতে লাগল।

.

বেলা সকাল আটটা নাগাদ রাধারমণ গৃহে ফিরে এলেন। ঘরে ঢুকতেই তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে চোখাচোখি হল।

সারাটা রাত কোথায় ছিলে? অন্নপূর্ণা শুধাল।

রাধারমণ স্ত্রীর প্রশ্নে তার মুখের দিকে একবার তাকালেন মাত্র, তার কথার কোন জবাব দিলেন না—জামা ছেড়ে মাথায় তেল মেখে গামছাটা কাঁধে ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

আজ তিনি গঙ্গাস্নান করবেন।

অন্নপূর্ণা একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিল, গতরাত্রে সিন্দুক খুলে তার স্বামী যে টাকার তোড়াটা নিয়ে গিয়েছিলেন সেটা তো আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেনই, সেই সঙ্গে আর একটা তোড়া।

অন্নপূর্ণা কি ভেবে টাকার তোড়া দুটো চাবি দিয়ে সিন্দুক খুলে তার ভিতরে রেখে দিল।

স্নান করে সন্ধ্যা আহ্নিক করে উঠবার পরই অন্নপূর্ণা এক গ্লাস মিছরির সরবৎ এনে স্বামীর সামনে রাখল। প্রচণ্ড পিপাসা পেয়েছিল রাধারমণের, গলাটা যেন শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত সরবৎটুকু এক চুমুকে ঢকঢক করে পান করে নিলেন।

আঃ!

চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে সারাটা রাত ঘুমাওনি! অন্নপূর্ণা বললে।

কাল জানকী মারা গেল—

কে মারা গেল?

আমার বন্ধু জানকী দত্ত।

জানকী দত্তর নামটা অন্নপূর্ণার একেবারে অপরিচিত নয়। কিন্তু অন্নপূর্ণা জানত না তার স্বামীর সঙ্গে জানকী দত্তর অত ঘনিষ্ঠতার কথাটা। বললে, তা কি হয়েছিল?

কিছুই না। সামান্য কয়েক দিনের জ্বর—

সংসারে আর তাঁর কে কে আছেন? অন্নপূর্ণা শুধাল।

এক ছোট সহোদর ভাই আর পঙ্গু স্ত্রী। সৎকারের সব ব্যবস্থা করতে গিয়েই রাত শেষ হয়ে গেল। যেন কতকটা কৈফিয়তের মত কথাগুলো বললেন স্ত্রীকে রাধারমণ।

সারাটা রাত তাহলে ঘুমই হয়নি, এখন একটু শুয়ে বিশ্রাম নাও না।

না, গদিতে একবার যেতে হবে।

একটা দিন নাই বা গেলে!

ব্যবসা কি কর্মচারীদের হাতে নিশ্চিন্ত হয়ে ছেড়ে রাখা যায়?

অন্নপূর্ণা আর কিছু বলল না। স্বামীর সঙ্গে বেশী কথা সে কোনদিনই বলে না, আজও বলল না। ইচ্ছা ছিল সুহাসিনীর কথাটা বলে, কিন্তু ওই সময় আর বলতে তার মন চাইল না।

.

কিন্তু গদিতে গিয়েও রাধারমণের কাজে মন বসে না। কেবলই ঘুরে ফিরে একখানি সুন্দর মুখ ও দুটি জলভরা চোখ মনের পাতায় রাধারমণের ভেসে উঠতে থাকে। রূপ তো নয়, যেন আগুনের শিখা। অমন রূপ রাধারমণ জীবনে দেখেননি। চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনিই যেন দুর্লঙ্ঘ্য এক আকর্ষণ তাকে জলদবালার গৃহে অনুক্ষণ টানতে থাকে।

দ্বিপ্রহরে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে আহারে বসলেন। কিন্তু বিশেষ কিছু খাচ্ছেন না, কেবল এটা-ওটা নাড়াচাড়াই করছেন দেখে অন্নপূর্ণা সামনেই একখানা পাখা হাতে বসেছিল, শুধাল, খাচ্ছ না তো কিছুই! শরীরটা কি সুস্থবোধ করছ না?

চমকে ওঠেন রাধারমণ। বলেন, অ্যাঁ! ঠিক তা নয়—

শরীর কি ভাল নেই?

কি বললে, শরীর? কেন, শরীর তো ভালই আছে!

তোমাকে যেন কেমন—

আমাকে? কি হয়েছে আমার? রাধারমণ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন। তবে তাঁর মনের অস্থিরতার কথাটা কি অন্নপূর্ণা জানতে পেরে গেছে? সে কি সব বুঝতে পেরেছে?

কেমন যেন তুমি অন্যমনস্ক!

অন্যমনস্ক! আমি! কই না তো! রাধারমণ যেন হাসবার চেষ্টা করলেন।

কিছু হয়েছে নাকি?

না—কিছু তো না, কি আবার হবে?

স্বামীকে পাত ছেড়ে উঠতে দেখে অন্নপূর্ণা বলল, ও কি! দুধটুকু না খেয়েই উঠে পড়ছ যে?

না থাক, ক্ষিদে নেই তেমন—

কিন্তু কিছুই তো খেলে না, সবই তো পড়ে রইল পাতে।

রাধারমণ আর বসলেন না পাতে, আচমন করতে বাইরে চলে গেলেন।

.

শয্যায় এসে শয়নের পর ভৃত্য এসে তামুক সেজে গড়গড়ার নলটা হাতে তুলে দিয়ে গেল। তামুক সেবন করতে লাগলেন চোখ বুজে রাধারমণ।

একটু তন্দ্রার মত এসেছিল বোধ হয় একসময়, কিন্তু সেই তন্দ্রার মধ্যেও—সেই জলদবালা—সেই অগ্নিশিখারূপিণী জলদবালা! জলদবালা যেন তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসছে।

বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা এল। রাধারমণ শয্যা ছেড়ে উঠলেন। মুখ ধুয়ে জামা কাপড় পরে বের হয়ে গেলেন। অন্নপূর্ণা তখন সংসারের কাজে ব্যস্ত।

ভাদ্র মাস প্রায় শেষ হতে চলল। এবার আশ্বিনের মাঝামাঝি দুর্গোৎসব। বৎসর চারেক হল রাধারমণ দুর্গোৎসব করছেন আর কালীপূজা করছেন। কালীপূজা অবিশ্যি তাঁর পিতামহের আমল থেকেই চলে আসছে। গৃহে যদিও রাধানাথের মূর্তিস্থাপন করে গিয়েছিলেন রাধারমণের পিতাঠাকুর, তথাপি দোল-দুর্গোৎসব সবই করেছেন। পিতামহ ছিলেন ঘোর শাক্ত, কিন্তু রাধারমণের পিতা ছিলেন আবার বৈষ্ণব মতাবলম্বী। শাক্ত মত ও বৈষ্ণব মত যেন দুটো মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল মল্লিকবাড়িতে।

।রাধারমণের পিতাঠাকুর বলতেন, মতামত যাই থাকুক না কেন—এই দেবতার পূজা করব, ওই দেবতার পূজা করব না, সে আবার কেমন কথা! রাধানাথও দেবতা, মা- দুর্গা মা-কালীও দেবতা—সকলেরই পূজা হবে।

রাধারমণ অবিশ্যি না শাক্ত, না বৈষ্ণব। পূজার ব্যাপারেও যে তাঁর খুব একটা নিষ্ঠা আছে তাও নয়। তবে পূজার্চনা তিনি করে থাকেন। ধর্মকে মানেন ঠিকই, কিন্তু কোন অন্ধ কুসংস্কার বা ধর্মান্ধতা নেই। অবিশ্যি সেটা হয়েছিল বোধ হয় হিন্দু কলেজে কিছুদিন পাঠ নেওয়ার জন্য।

.

জলদবালা যেন রাধারমণের অপেক্ষাতেই ছিল। দরজায় ধাক্কা দিতেই সে এসে দরজা খুলে দিল।

কে?

আমি—রাধারমণ!

আসুন, আসুন।

দোতলার ঘরে এনে বসালো জলদবালা রাধারমণকে।

আজ জলদবালার বেশের ও সাজের তেমন পারিপাট্য ছিল না। সাধারণ একখানা কস্তাপাড় ধোয়া শাড়ি পরনে। চুল বাঁধেনি। বোধহয় কিছুক্ষণ পূর্বে স্নান করেছে। একরাশ ভিজা চুল পিঠের উপর ছড়ানো। কিন্তু ওই সামান্য বেশেই যেন জলদবালাকে অসামান্যা দেখাচ্ছিল।

বসুন ওই চৌকিতে।

রাধারমণ বসলেন।

আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধ হয় আসবেনই না।

কেন?

আমার মত সাধারণ এক মেয়েছেলের কথা কি আর আপনার মনে থাকবে?

কেন থাকবে না?

না থাকাটাই তো স্বাভাবিক মল্লিক মশাই।

তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন জলদ, বোস!

তামুক সেজে আনি।

তামুক!

হ্যাঁ, তামুক সেবন করেন না?

করি, তবে এখন থাক।