মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ১৪

॥ চোদ্দ ॥

দীঘির ঘাটে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরটিতে যখন ফিরে এল আনন্দচন্দ্র, মন্দিরে সন্ধ্যারতি তখন শুরু হয়েছে। গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে বহির্মহলে মন্দিরের দিকে অগ্রসর হল আনন্দচন্দ্র। সন্ধ্যারতির সময় প্রত্যহ সুহাসিনীকে মন্দিরের মধ্যে উপবিষ্ট দেখা যায়, কিন্তু আজ মন্দিরের মধ্যে কোথাও সুহাসিনীকে দেখতে পেল না আনন্দচন্দ্ৰ।

মন্দিরের সামনে দালানটি শ্বেতপাথরে বাঁধানো। সর্বদা ধোয়ামোছার জন্য চকচকে থাকে। দালানের এক পাশে দাঁড়াল আনন্দচন্দ্র। নয় বৎসর বয়েসের সময় কলকাতায় পড়তে এসেছে আনন্দচন্দ্র। ওই বয়েস থেকেই সে বাড়িছাড়া।

প্রথম প্রথম একটুও ভাল লাগত না। খালি কান্না পেত। মন পড়ে থাকত সর্বদা- –কবে ছুটি হবে, কবে দেশে ফিরে যাবে! কিন্তু ইদানীং যেন এখানে মন বসে গিয়েছিল। বরং দেশে যেতেই তেমন ভাল লাগতো না। এবারে কিন্তু এখানে আসা অবধি মনটা আদৌ ভাল লাগছে না। কেবলই মনে হচ্ছে যেন কি একটা নেই।—কে যেন নেই!

আরতি শেষ হলে আনন্দচন্দ্র ঘরে গেল না। ঘরে যেতে ভাল লাগল না। অনেকটা পড়া এগিয়ে গিয়েছে ক্লাসে, ক’টা দিন খুব খাটতে হবে। কিন্তু ইচ্ছা করল না তার ওই মুহূর্তে ঘরে ঢুকে পড়ার বই নিয়ে বসতে। থাক পড়া—ভাল লাগছে না।

দীঘির ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল।

পূর্ণিমা বোধ হয় সামনেই। এর মধ্যেই বেশ বড় একখানি চাঁদ দেখা দিয়েছে আকাশে। চাঁদের আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত। অন্যমনস্ক ভাবেই কিছুটা দীঘির ঘাটের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ একটা চাপা কান্নার শব্দ কানে আসতেই আনন্দচন্দ্র থমকে দাঁড়াল। কে যেন আশেপাশেই মনে হচ্ছে কাঁদছে। কে কাঁদে? এদিক ওদিক তাকায় আনন্দচন্দ্ৰ।

হঠাৎ নজরে পড়ল, দীঘির সামনেই যে সানবাঁধানো বেঞ্চের মত জায়গাটা সেখানে কে যেন বসে। কে ওখানে বসে? আর একটু এগোতেই মনে হল যে বসে সে নারী। কে এক নারী বসে আছে সেখানে। এ সময় এখানে রসে কে?

কৌতূহলী আনন্দচন্দ্র আরো একটু এগুতেই চিনতে পারে মানুষটিকে — সুহাসিনী। চোখে পরিধেয় বস্ত্রের আঁচল চাপা দিয়ে সুহাসিনীই কাঁদছে।

সুহাসিনী একা একা এই নির্জন দীঘির পাড়ে কাঁদছে! কেন কাঁদছে? সুহাসিনীকে তো কখনো আজ পর্যন্ত সে কাঁদতে দেখেনি। মুখে তো ওর সর্বদাই হাসি লেগে আছে।

না?

সুহাসিনী!

কে? চমকে মুখের উপর থেকে আঁচল সরিয়ে তাকাল সুহাসিনী।

আমি আনন্দ—

আনন্দদাদা!

হ্যাঁ, তুমি কাঁদছো? কি হয়েছে সুহাসিনী—কাঁদছিলে কেন?

আচ্ছা আনন্দদাদা——-

বল?

বিধবা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েমানুষের জীবনটা একেবারে মিথ্যা হয়ে যায়, তাই না?

নতুন প্রশ্ন। এই ধরনের প্রশ্ন তো তাকে আজ পর্যন্ত কেউ করেনি! আনন্দচন্দ্র কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। তাই বোধ হয় চুপ করেই থাকে।

সুহাসিনী বলে চলে, তাকে কারো সঙ্গে মিশতে নেই, হাসতে নেই, কোন আনন্দ করতে নেই—তা কেন?

হঠাৎ কথাটা বের হয়ে এল আনন্দচন্দ্রের মুখ থেকে, এসব কথা কে তোমাকে বললে?

সুহাসিনী বললে, সবাই তো বলে। মা ঠাকুরমা আর সাত—থেমে গেল সুহাসিনী।

কাকীমা কি বলেন—

যখন তখন বলেন, পোড়ারমুখী, এ বয়েসেই তুই সব খুইয়ে বসে আছিস! তুই বিধবা। আচ্ছা, সব খুইয়ে বসে আছি সে কি আমার দোষ, তুমিই বল আনন্দদাদা? লোকটা যে অমন করে মরে গেল, তার আমি কি করব? একে বুড়ো, তায় নানান্ অসুখ!

আনন্দচন্দ্র কি জবাব দেবে সুহাসিনীর কথার? চুপ করেই থাকে।

সুহাসিনী বলতে থাকে, যত দোষ যেন আমারই। আমার হাসতে নেই, দশজনের সামনে বেরুতে নেই, মিশতে নেই কারো সঙ্গে। কেন? বিধবা হয়েছি বলে কি আমার সব গেছে?

কাকীমা যা বলেন সে তো তোমার ভালর জন্যেই বলেন সুহাসিনী।

ছাই ভাল! অমন ভাল আমি চাই না। দেখো মা’র জন্য একদিন আমি দীঘির জলে গলায় কলসী বেঁধে ডুবে মরব।

ছিঃ সুহাসিনী, ওসব কথা ভাবাও পাপ।

তুমি জান না আনন্দদাদা, আমার একটুও আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না, সত্যি বলছি।

যাও এসময় আর একা একা দীঘির ঘাটে থেকো না। ভিতরে যাও। কাকীমা হয়ত তোমাকে খুঁজছেন।

আচ্ছা আনন্দদাদা-

কি?

পুরুষের এক বৌ মরে গেলে আবার বিয়ে করে, তবে মেয়েদেরই বা বিয়ে হবে না কেন?

ও তো ধর্মের কথা। ধর্মের বিধান মেনেই তো সবাইকে চলতে হবে।

ভোলাদা বলে—

কি বলে ভোলাদা?

কে এক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তিনি নাকি বলেন, বিধবার বিয়ে হতে পারে। ধর্মের বইতেই নাকি লেখা আছে।

জানি না। বিদ্যাসাগর মশাইকে আমি দেখিনি। তা তিনি তো শুনেছি বিরাট পণ্ডিত লোক—তিনি কি আর মিথ্যা কথা বলেছেন? না বলতে পারেনা?

তবে—তবে তুমিই বল ভোলাদা মিথ্যা বলে না!

তুমি এবারে ভিতরে যাও সুহাসিনী।

সর্বক্ষণ ওই বাড়ির মধ্যে থাকতে আমার ভাল লাগে না।

আনন্দচন্দ্র যেন কি বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বলা হল না, কে যেন দীঘির দিকেই আসছে। তার পদশব্দ পেয়ে আনন্দচন্দ্র সামনের দিকে তাকাল।

মল্লিক মশাইয়ের স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী।

খুকী!

এই যে কাকীমা! আসুন, ওই যে বসে আছে সুহাস।

অন্নপূর্ণা সামনে এসে দাঁড়াল, বলি কি আক্কেল তোর খুকী। এই রাত্রে একা একা বসে আছিস।

আমিও তাই বলছিলাম কাকীমা। আনন্দচন্দ্র বললে, এ সময় একা একা এখানে থাকা ভাল নয়।

সে খেয়াল কি ওই সোমখ মাগীর আছে? সোয়ামী বেঁচে থাকলে এতদিনে তিন ছেলের মা হত। ঢং করে আবার বসে রইলি কেন? চল্ ঘরে চল্!

না। যাব না।

তা যাবে কেন আবাগী? বড্ড বাড় বেড়েছে তোমার—একদিন ঝেঁটিয়ে বিষ নামাব। চল্‌!

না।

আনন্দচন্দ্র বলে, যাও সুহাস ঘরে যাও, কাকীমা বলছেন। কাকীমার কথা শুনতে হয়।

সুহাস উঠে গজগজ করতে করতে দুপদাপ করে বাড়ির দিকে চলে গেল।

অন্নপূর্ণা বললে, আমার হয়েছে মরণ, এই বয়েসে সব খেয়ে বসে আছে!

এখনো বড় ছেলেমানুষ ও কাকীমা, তাই—তা ছাড়া বুঝবারও তো বয়েস হয়নি।

সে কি আর আমি বুঝি না—সবই অদৃষ্ট আনন্দ। না হলে এই বয়েসে সব খুইয়ে বসে আছে! সাধ-আহ্লাদ-

একটা কথা বলব কাকীমা?

কি কথা বাবা?

ওই ভোলাদার সঙ্গে সুহাসকে বেশী মিশতে দেবেন না।

তেমন মেয়ে কিনা! শোনে. আমার কথা? বললেও শুনবে না। তোমার কাকামশাইকে কথাটা বলো, তাঁর প্রশ্রয়েই ও আরো বিগড়ে যাচ্ছে। বিধবা মেয়ে বিধবার মত থাকবে, তা না তাকে পাড়ওয়ালা শাড়ি পরাবেন, গায়ে গহনা, যা খুশি তাই মেয়ে করে বেড়াচ্ছে, কিছু বলবেন না। আমার হয়েেেছ শতেক জ্বালা।

কাকামশাই তো সব সময় বাড়িতে থাকেন না!

যতটুকু সময় বাড়িতে থাকেন, তাও কি এতটুকু শাসন করেন? কি হয়েছে মা- কি তোমার চাই মা…..তাতে করেই তো ওর আরো বাড় বেড়েছে! আর ওই ভোলাটা হয়েছে যেন এ সংসারে শনি। তখুনি ঠাকরুনকে বলেছিলাম, বিধবা মাকে স্থান দিচ্ছেন দিন, ওই ঝামেলা স্বীকার করবেন না। তা শুনলেন কি আমার কথা?

যতদূর জানি আমি কাকীমা, ভোলাদাও তেমন একটা বাড়ির ভিতরে যায় না। ও তো বাইরে বাইরেই থাকে।

ভিতরে ও না গেলে কি হবে! সুহাসিনী তো বাইরে যখন তখন আসছে। দিনের বেলা সংসারের নানান্ কাজে ব্যস্ত থাকি, টের পাই না—সব সময় চোখ রাখাও যায় না।

মনের আশা মিটিয়ে অন্নপূর্ণার আরো অনেক কথাই বলবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সে সুযোগ আর সে পেল না। দাসী মোক্ষদা তাকে খুঁজতে খুঁজতে ওই সময় দীঘির ঘাটে এসে উপস্থিত হল। এই যে মা-ঠাকরুন তুমি হেথায়, আর ওদিকে কত্তাবাবু যে তোমায় ডাকছেন!

ওমা, কত্তা ফিরেছেন নাকি?

হ্যাঁ, এই তো কিছুক্ষণ?

তা আমাকে একটা খবর দিবি তো হতভাগী?

অন্নপূর্ণা আর দাঁড়াল না, অন্দরের দিকে পা বাড়াল। মোক্ষদা তাকে অনুসরণ করে। কত্তা এইসময় বড় একটা ফেরেন না। তাঁর ফিরতে ফিরতে সেই রাত দশটা। অন্নপূর্ণা চিন্তিত হয়েই অন্দরে গিয়ে প্রবেশ করে।

অন্দরমহলে পশ্চিম দিকের বড় ঘরটায় মল্লিক মশাই থাকেন। একদিকে বিরাট একটা পালঙ্ক পাতা, তার উপরে শয্যা বিছানো। তারই পাশে বড় লোহার সিন্দুকটা। চকচকে মাছি পিছলে যাওয়া কালো পাথরের মেঝে।

রাধারমণ মল্লিকমশাই ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন। স্ত্রীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে তাকালেন তার মুখের দিকে।

ঘরের কোণে উঁচু পিলসুজের উপর একটা প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের মৃদু আলোয় ঘরের মধ্যে একটা আলো-আঁধারির সৃষ্টি হয়েছে।

অন্নপূর্ণার মাথায় ঘোমটা টানা। মুখের উপরের অংশ সবটাই প্রায় ঢাকা

এই যে বড় বৌ!

তুমি এত তাড়াতাড়ি ফিরলে?

হ্যাঁ, কিছু টাকার দরকার। সিন্দুকের চাবিটা কোথায়?

আঁচল থেকে চাবির তোড়াটা খুলে এগিয়ে দিল অন্নপূর্ণা স্বামীর দিকে। রাধারমণ

চাবি দিয়ে সিন্দুক খুলে টাকা বের করতে লাগলেন।

এই রাত্রে টাকার কি প্রয়োজন হলো?

রাধারমণ স্ত্রীর প্রশ্নের কোন জবাব দিলেন না। টাকার একটা ছোট থলি হাতে নিয়ে চাবির তোড়াটা স্ত্রীর হাতে ফিরিয়ে দিলেন।

ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বললেন, সুহাসিনীকে দেখলাম না! সে কোথায়?

কে জানে তোমার আদরের দুলালী কোথায় আছে? শোন একটা কথা ছিল—

রাত্রে ফিরে এসে শুনব।

রাধারমণ মল্লিক আর দাঁড়ালেন না। টাকার তোড়াটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

অন্নপূর্ণার ওই একটি মাত্রই সন্তান—সুহাসিনী।

সূতিকাগৃহেই পর পর দুটি পুত্রসন্তানের মৃত্যুর পর ওই কন্যাসন্তান সুহাসিনী। আর কোন সন্তানাদি তাদের হয়নি।

ভবতারিণী দেবীর ক্ষোভের অন্ত নেই। একটি পুত্রসন্তান হল না রাধারমণের। পিতৃপুরুষদের আত্মারা পরলোকে এক গণ্ডূষ জল পাবে না। এত বড় বংশটা লোপ পাবে। তাই অনেকবার বলেছিলেন পুত্রকে আর একটি বিবাহ করতে। কিন্তু রাধারমণ মায়ের প্রস্তাবে মাথা পাতেন নি।

বলেছেন, না মা, বিয়ে আমাকে করতে বলো না।

তবে কি তুই চাস তোর পিতৃপুরুষদের বংশটা লোপ পাবে, এক গণ্ডূষ জল পাবে না কেউ?

কিন্তু বিবাহ আবার করলেই যে আমার পুত্রসন্তান হবে তারই বা প্রতিশ্রুতি কোথায়? দুটি তো পুত্রসন্তান হয়েছিল, সূতিকাগৃহেই মারা গেল—

ও অন্নপূর্ণার গর্ভের দোষ।

মৃদু হেসে বলেছেন রাধারমণ, তা যে নতুন বৌ আসবে তারও তো বড় বৌয়ের মত গর্ভের দোষ থাকতে পারে!

বালাই ষাট! ও কি অলুক্ষুণে কথা?

না মা ও মতলব তুমি ছেড়ে দাও, বিয়ে আর আমি করব না। তা ছাড়া এক স্ত্রী জীবিত থাকতে আর এক স্ত্রীকে ঘরে আনা—না মা, না, আমার দ্বারা তা সম্ভব হবে না।

কেন হবে না শুনি! দুটো তিনটে বিয়ে কি কেউ করে না? তোর জন্মদাতারও তো দুই বিয়ে ছিল। প্রথম পক্ষের পর পর তিনটি কন্যাসন্তান হওয়ায় আমাকে বিবাহ করে এনেছিলেন।

জানি। কিন্তু বড়মার কথা ভুলে গিয়েছ—নদীর জলে আত্মহত্যা করেছিলেন। আত্মহত্যা হবে কেন—কুমীরে নিয়েছিল দিদিকে। তাই তো মৃতদেহটা তার আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তুমি জান না, তা ঠিক নয়।

কি জানি না? কি ঠিক নয়?

বড়মার মৃতদেহ তিনদিন পরে নদীর ধারে তিন ক্রোশ দূরে পাণ্ডুয়ার চরে আটকে ছিল। দেহে কোন ক্ষতচিহ্ন ছিল না, পা দুটো তাঁর শাড়ির আঁচল দিয়ে শক্ত করে বাঁধা ছিল।

কে বললে তোকে এসব কথা?

আমাদের বাড়িতে যে নমশূদ্দুর চাকরটা ছিল, রাখালদা— সে-ই একদিন বলেছিল আমায়।

ভবতারিণী দেবীর মুখ দিয়ে আর বাক্য সরে না। কারণ সত্য কথাটা তাঁরও অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সকলে মিলে সযত্নে যা গোপন করে রাখতে চেয়েছিলেন তা গোপন থাকেনি, সত্য আপনা হতেই প্রকাশ পেয়েছে।

তুমি কি চাও মা, তারই পুনরাবৃত্তি হোক এ সংসারে আবার।

ভবতারিণী ওই মুহূর্তে আর কিছু বললেন না বটে পুত্রকে তাঁর, তবে অন্য পথ ধরলেন। পুত্রবধূ অন্নপূর্ণাকে এবারে ধরলেন কয়েকটা দিন পর।

বৌমা একটা কথা বলছিলাম—

কি মা?

তোমার শ্বশুরের বংশটা লোপ পাবে তা তুমি তাঁর পুত্রবধূ হয়ে ‘নিশ্চয়ই চাও না!

স্বামীকে যে আর একটি বিবাহ করবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন ঠাকরুন সেটা অন্নপূর্ণার অজ্ঞাত ছিল না। বাড়ির মধ্যে. সব কথাই তার কানে আসত। ভয়ে অন্নপূর্ণার বুকের ভিতরটা কাঁপত

পুরুষের মন বলা তো যায় না, হয়ত কোন দুর্বল মুহূর্তে স্বামী তার বিবাহে সম্মতি দিয়ে বসবেন। তাছাড়া কোন অন্যায়ও তো নেই ব্যাপারটার মধ্যে। পুরুষেরা তো একাধিক বিবাহ করেই থাকে। ঠাকরুনের প্রস্তাব সেদিক দিয়ে কোন অযৌক্তিক কিছু নয়। কিন্তু অন্নপূর্ণা ভাবতে পারেনি, আক্রমণটা সম্পূর্ণ অন্যদিক দিয়ে আসতে পারে— কঠিন প্রশ্নটার মুখোমুখি তাকে নিজেকেই এইভাবে হতে হবে।

ভবতারিণী প্রশ্নটা করে পুত্রবধূর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

অন্নপূর্ণা আবক্ষ ঘোমটা টেনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কি হল বৌমা, আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন!

অন্নপূর্ণা তথাপি নীরব।

আমার কথায় তো কিছুতেই ঘাড় পাতছে না রাধারমণ, তুমি তাকে বুঝিয়ে বল একটু বৌমা—এতে কোন মহাপাপ হবে না। সংসারে এ আকছারই ঘটে থাকে ও ঘটছে। তা ছাড়া এ বিবাহ তো প্রয়োজনের বিবাহ।

আমাকে যা বলবেন তাই করবো।

তুমি আমার লক্ষ্মী বৌ, জানি না কি আমি। তুমিই ওকে আবার একটি বিবাহে সম্মত করাতে পার এ বাড়িতে। তোমার আসনটি কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না—তুমিই থাকবে মল্লিকবাড়ির সত্যিকারের বৌ হয়ে।

আমি বলব মা।

লক্ষ্মী মা আমার। বেঁচে থাক। আজ সত্যিই তুমি নিশ্চিন্ত করলে মা।

সেইরাত্রেই অন্নপূর্ণা কথাটা রাধারমণ মল্লিককে বলেছিল। সত্যিই তো—সে তো কোন বংশধর দিতে পারল না তার স্বামীকে। তার জন্য তার শ্বশুরের বংশের কেউ পরলোকে কেউ এক গণ্ডূষ জল পাবে না! প্রেতযোনিতে সকলে হাহাকার করে বেড়াবে একটু তৃষ্ণার জলের জন্য! না, তার কোন প্রয়োজন নেই। নেহাতই তার দুর্ভাগ্য, নচেৎ দু-দুটি পুত্রসন্তান হয়েও সূতিকাগৃহেই তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে কেন?

দু’দিন পরে এক রাত্রে আহারাদির পর রাধারমণ শয্যার উপরে বসে তাম্বুল চর্বণ করতে করতে গড়গড়ায় তামুক সেবন করছিল, অন্নপূর্ণা এসে ঘরে ঢুকল।

এসো বড় বৌ। আহার হল?

দেখো তোমাকে একটা কথা কয়েকদিন থেকেই বলব বলব ভাবছিলাম—

কি কথা?

বলছিলাম ঠাকরুনের ইচ্ছা—

বুঝতে পেরেছি, অবশেষে মা তোমাকে ধরেছেন! কিন্তু তা হবে না—

শুধু ঠাকরুণের কেন, আমারও তাই ইচ্ছা। আর একটি তুমি বিবাহ কর।

তুমিও ওই কথা বল বড় বৌ?

সত্যিই তো, তোমার পিতৃপুরুষরা পরলোকে এক গণ্ডূষ জল পাবে না!

ওসব বাজে কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি—

না না, ছিঃ, ও কথা বলতে নেই। তা ছাড়া ধর্মশাস্ত্রে কখনো কিছু মিথ্যা লেখা থাকে না।

আমিও মিথ্যা বলিনি। বলেছি কুসংস্কার। একটা অন্ধ গোঁড়ামি।

লক্ষ্মীটি তুমি অমত করো না। ঠাকরুনের চিন্তা দূর কর।

না বড়. বৌ, আবার আর একজনকে বিবাহ আমার দ্বারা হবে না। কারোর অনুরোধেই নয়।

অন্নপূর্ণার বুকের পাষাণ ভারটা ততক্ষণে নেমে গিয়েছে। মনে মনে সে একটা পরম স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছে। তবু বললে, বিশ্বাস কর তুমি, আমার কোন দুঃখ হবে না তুমি আর একটি বিবাহ করলে।

তোমার দুঃখ হবে কি না হবে সেটা বড় কথা নয় বড় বৌ, এত বড় অন্যায় আমি প্রাণ গেলেও করতে পারব না। যাক, অনেক রাত হয়েছে, এবারে শুয়ে পড়।