॥ তেরো ॥
ভোলানাথ আবার প্রশ্ন করে, কি রে, বিয়ের পর বোবা হয়ে গিয়েছিস নাকি!
আনন্দচন্দ্র জানতো সুহাসিনীর প্রতি ভোলানাথের বিশেষ একটা দুর্বলতা আছে। কয়েকবার আনন্দচন্দ্রের নজরেও পড়েছে, সুহাসিনীকে দেখলেই ভোলানাথ তার সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করে, আলাপ জমাবার চেষ্টা করে। সুহাসিনীও যে একেবারে চুপচাপ থাকে তাও নয়—সেও জবাব দেয়।
আর তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয় দীঘির ধারেই।
কিন্তু কি জানি কেন, আনন্দচন্দ্রের ব্যাপারটা খুব ভাল লাগে না। সুহাসিনী বিধবা সেইজন্যই ব্যাাপারটা হয়তো আনন্দচন্দ্রের তেমন ভাল লাগে না।
বাড়ির মধ্যে আর কারো ওদের মেলামেশার ব্যাপারটা চোখে পড়েছে কিনা তাও জানে না আনন্দচন্দ্ৰ।
আনন্দচন্দ্র তাই চুপ করেই খাতা-বই নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
ঘরের মধ্যে একা একা ভোলানাথ হাসতে থাকে।
আনন্দচন্দ্র দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করে।
কিন্তু ভোলানাথের কথাটা তার মনের মধ্যে আনাগোনা করতে থাকে : আমাদের সুহাসিনীর মত সুন্দর! মনের মধ্যে পাশাপাশি দুটো ছবি ভেসে ওঠে। দুটো মুখ—একটি অন্নদাসুন্দরীর, অন্যটি সুহাসিনীর।
ছোট ছোট গোলগাল কপালে রক্তবর্ণ সিন্দুরের গোল একটি টিপ। অনেকটা দুর্গা ঠাকরুনের মত যেন মুখখানি অন্নদাসুন্দরীর। কপালের উপর লতিয়ে নামা কয়েকগাছি চুল—সেই ঠোঁট টিপে চাপা হাসি—দু’চোখের সেই ধারালো দৃষ্টি। দাঁত বের করে বড় একটা হাসে না অন্নদাসুন্দরী,—কিন্তু ঠোঁট খুলে হাসলে ভারী সুন্দর দেখায় তাকে। নাকের নোলকটা—সঙ্গে সেই সাদা মুক্তোর সঙ্গে লাল পাথরটা একটু একটু দুলতে থাকে তখন, মুক্তোর মত দুসারি দাঁত বের করে হাসলে।
আর সুহাসিনী!
তার মুখখানিও সুন্দর।
অন্নদাসুন্দরীর মত তার গাত্রবর্ণ অত গৌর নয়, তাহলেও লম্বাটে ধরনের কিছুটা মুখখানা, সুন্দরই তো লাগে দেখতে আনন্দর। অন্নদাসুন্দরীর মত নাকে নোলক নেই বটে এবং কপালে লাল রক্তবর্ণ সিন্দুরের টিপটিও নেই—আর তাই বোধ হয় মনের মধ্যে ভেসে-ওঠা পাশাপাশি দুখানি মুখের মধ্যে ওই মুহূর্তে আনন্দচন্দ্রের মনে হয়, অন্নদাসুন্দরীই বেশী সুন্দর। হ্যাঁ, অন্নদাসুন্দরীই সুন্দর।
ভাবতে ভাবতে কখন পৌঁছে গিয়েছে আনন্দচন্দ্র হিন্দু কলেজের গেটের সামনে। দলে দলে বই-খাতা হাতে ছেলের দল আসছে কলেজে।
ক্লাস শুরু হবে সেই দশটায়।
গেটের কাছেই সতীর্থ অম্বিকাচরণের সঙ্গে দেখা। অম্বিকাচরণের বাবা রাধিকাচরণের অবস্থা মোটামুটি ভাল। তবে ধনী যাকে বলে তা ঠিক তিনি নন।
কলেজের কাছেই বলতে গেলে ঠনঠনিয়ায় তাদের বাড়ি। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পাশেই।
অম্বিকাচরণ ক্লাসের একজন সেরা ছাত্র।
বিশেষ করে ইংরেজী সাহিত্যে তার বিশেষ দখল। কবি মধুসূদন দত্তর সে একজন অন্ধ ভক্ত।
মধ্যে মধ্যে বলে, সেও নাকি খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করবে।
একদিন আনন্দচন্দ্ৰ শুধিয়েছিল, কেন নিজের ধর্ম বিসর্জন দিয়ে তুমি খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করতে চাও অম্বিকা?
ধুৎ, হিন্দু ধর্ম একটা ধর্ম নাকি! বলেছিল অম্বিকাচরণ নাক সিটকে। কেবল অন্ধ গোঁড়ামি আর যত কুসংস্কার। মন হাঁপিয়ে ওঠে মধ্যে মধ্যে আমার, যেন একটা এঁদো পুকুরের জলে সাঁতার কাটছি! তাই তো মনে স্থির করেছি—খ্রীস্টধর্মই গ্রহণ করবো আমি।
তুমি বুঝি হেদুয়ায় ডাফ্ সাহেবের গৃহে তাদের যে সভা বসে সেখানে যাতায়াত কর? বললে আনন্দচন্দ্ৰ।
করিই তো। তুমি কি ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের সমর্থন করো না আনন্দ! অম্বিকাচরণ বললে।
তাদের মননশীলতা, তাদের শিক্ষার প্রচেষ্টা ও আদর্শকে ‘আমি শ্রদ্ধা করি, কিন্তু—
কিন্তু কি?
শ্রদ্ধা করি না আমাদের হিন্দু ধর্মের প্রতি তাদের অবজ্ঞা ও অবহেলাকে আর তাদের মদ্যপানের অভ্যাসকে। বরং শ্রদ্ধা করি যাঁরা ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার করেন তাঁদের—
তা যদি বল তো—মূলত দুই দলের নীতিই এক—একেশ্বরবাদ।
না, এক নয়। আনন্দচন্দ্র বললে।
কেন নয়? আমাকে বুঝিয়ে দাও, আনন্দ।
বোঝালেও তুমি বুঝবে না।
ওই ব্যাপারটাকেই তো রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বলে, কূপমণ্ডূকতা আর গোঁড়ামি।
আনন্দচন্দ্রের দুই বৎসর পূর্বেই অম্বিকাচরণের বিবাহ হয়ে গিয়েছিল। তারই উল্লেখ করে আনন্দচন্দ্র একদিন অম্বিকাচরণকে বলছিল, তা তুমি তো বিবাহিত অম্বিকা, তোমার স্ত্রীও কি তোমার সঙ্গে ধর্মান্তর গ্রহণ করবেন?
যদি আমি ধর্মান্তর গ্রহণ করি তো তাকেও করতে হবে বৈকি।
কিন্তু তিনি যদি রাজী না হন?
কেন হবে না, স্ত্রীর ধর্মই হচ্ছে স্বামীর অনুগামিনী হওয়া সর্বক্ষেত্রে, সর্ব ব্যাপারে— আনন্দচন্দ্র হেসে প্রত্যুত্তর দিয়েছিল, ওটা কিন্তু তোমাদের অবহেলিত হিন্দু শাস্ত্রেরই কথা।
ওটা সব শাস্ত্রেরই কথা—wife must follow the path of her husband just like a shadow!
আচ্ছা অম্বিকা—
কি?
তোমার বাবা তোমার মনের খবর জানেন?
জানেন না এখনো। তবে—
কি, তবে?
সময় হলেই জানতে পারবেন।
তোমার বাবাকেও আমি চিনি—তিনি কিন্তু মনে নিদারুণ পীড়া পাবেন—অত্যন্ত মর্মাহত হবেন।
I can’t help! তারপর একটু থেমে বললে, only I would be sorry for him!
পিতার প্রতি যে সন্তানের একটা কর্তব্য আছে সেটা তো তুমি স্বীকার করো অম্বিকা?
করবো না কেন, তাই বলে আমার কর্তব্যপালনের পথে সেটা যদি অন্তরায় হয়— অতীব দুঃখের ব্যাপার হলেও তাকে আমাকে ত্যাগ করতেই হবে।
ওই কথার পর আর কথা চলে না। তাই আনন্দচন্দ্রও আর সে কথার জের টানেনি। ইচ্ছাও করেনি।
.
কলেজের গেটের সামনে দেখা হতেই অম্বিকাচরণ বন্ধুকে শুধাল, দেশ থেকে কবে ফিরলে আনন্দ?
আজ সকালেই।
তারপর? হঠাৎ পিতাঠাকুর জরুরী তলব পাঠিয়েছিলেন কেন?
বিবাহের ব্যাপার ছিল। মৃদু হেসে আনন্দচন্দ্ৰ বলে।
বিবাহ? কার?
আমার।
অম্বিকাচরণ বললে, তুমি তাহলে বিবাহ করতেই দেশে গিয়েছিলে আনন্দচন্দ্ৰ?
আনন্দচন্দ্র কোন জবাব দেয় না। সলজ্জ হেসে মুখখানি নীচু করে
কিন্তু অম্বিকাচরণের পরবর্তী প্রশ্নে আবার বন্ধুর মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাল আনন্দচন্দ্ৰ।
তা সে বালিকাটির বয়স কত? অম্বিকাচরণের গলার স্বরে যেন একটা ব্যঙ্গের সুর।
বালিকা!
হ্যাঁ, তোমার বালিকা স্ত্রীর বয়স কত? সাত না আট? না তারও কম?
আনন্দচন্দ্র বললে, নয় উত্তীর্ণ হয়ে দশে পড়েছে বোধ হয়
আমাদের সমাজের ওই আর একটা পচা কুসংস্কার!
তা তোমার স্ত্রীও তো শুনেছিলাম বিবাহের সময় মাত্র আট বৎসরের বালিকা ছিলেন—
হ্যাঁ, এখন দশ বৎসর দুই মাস। এখনো পুতুল খেলে, রান্নাবাটি খেলা খেলে। তা তোমার স্ত্রীও খেলেন নাকি?
জানি না।
জান না মানে—
মানে এই, জানবার অবকাশ মেলেনি আর কি।
আমার মতে কিন্তু পাত্রের বয়স ১৮/১৯, আর পাত্রীর বয়স অন্ততপক্ষে বারো তেরো হওয়া উচিত—তাহলে at least they can understand each other!
এত কালের প্রথাটাই তুমি তাহলে উলটে দিতে চাও অম্বিকাচরণ? বাপ ঠাকুর্দারা যা—
রাখ তো তোমার বাপ-ঠাকুর্দার কথা! কুসংস্কার — কুসংস্কার—সমাজের ওই কুপ্রথাগুলো যত তাড়াতাড়ি আমরা বর্জন করতে পারি ততই জেনো সমাজের পক্ষে মঙ্গল।
কিন্তু আর কথা বলার সুযোগ হল না দুই বন্ধুর। ক্লাস শুরুর ঘণ্টা বাজলো। দুই বন্ধুতেই এগিয়ে গেল ক্লাসরুমের দিকে।
অম্বিকাচরণের চালচলন কথাবার্তা সব কিছুর মধ্যেই যেন একটা বিদ্রোহের সুর। অথচ কতই বা বয়স হবে অম্বিকাচরণের—তার চাইতে মাত্র কয়েক মাসের বড়। সবে ঠোঁটের উপরে গোঁফের রেখা জেগেছে।
অম্বিকাচরণের কথাগুলো শুনতে আনন্দচন্দ্রের খুব একটা যে খারাপ লাগে তা নয়, কিন্তু কেন জানি মন থেকে সেটা মেনে নিতে পারে না। সে ইয়ং বেঙ্গলের মানে বিপ্লবটাকে যেন ঠিক মনেপ্রাণে স্বীকার করতে পারে না।
গঙ্গাস্নানের কথায় সেদিনকার অম্বিকাচরণের ব্যঙ্গোক্তি—আমি রসিককৃষ্ণ মল্লিক মশাইয়ের মতের সঙ্গে একমত— I do not believe in the sacredness of the Ganges! বুঝলে আনন্দ, if there is anything we hate from the bottom of our heart, it is Hinduism!
আনন্দচন্দ্ৰ সত্যিই অবাক হয়েছিল সেদিন অম্বিকাচরণের কথা শুনে। হিন্দুর ছেলে হয়ে সে বলে কিনা হিন্দুত্বকে সে ঘৃণা করে?
এক-একবার মনে হয়েছে আনন্দচন্দ্রের, অম্বিকাচরণের সঙ্গে সে আর মিশবে না। কিন্তু কি যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ আছে অম্বিকাচরণের!
বিশেষ করে অম্বিকাচরণ যখন হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি কুসংস্কার ও ইংরেজী শিক্ষা সম্পর্কে বলতে থাকে। কেন যেন আনন্দচন্দ্র ওর কোন কথারই প্রতিবাদ করতে পারে না। ইংরেজী ভাষার উপরে আশ্চর্য দখল যেন অম্বিকাচরণের।
অনেকটা সাহেবেদের মতই ইংরেজী বলে।
ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যখন অম্বিকাচরণ বলতে শুরু করে, ও যেন থামতেই চায় না।
তবু একদিন আনন্দচন্দ্র বলেছিল বন্ধুকে, তবু অম্বিকা আমি স্বীকার করি না তোমার কথাটা!
কোন্ কথাটা?
আজকের দিনে সত্যিকারের শিক্ষা পেতে হলে তোমার ওই ইংরেজী ভাষাটা ছাড়া আর গতি নেই!
সত্যিই নেই, বুঝেছো আনন্দচন্দ্র, সত্যিই নেই। ওই সোপান ছাড়া জ্ঞানার্জনের আর কোন সত্যিকারের পথই নেই।
কেন নেই আমাকে বলো?
বুঝবে না—তুমি ঠিক বললেও বুঝবে না আনন্দচন্দ্ৰ।
আনন্দচন্দ্র বললে, কেন বুঝবো না? বুঝিয়ে দিলেই বুঝবো।
বুঝতে হলে ভাল করে ইংরেজী ভাষাটা জানা দরকার। ইংরেজী—ইংরেজী শেখো। Learn English-read English literature-Homer-Milton-Shakespeare—
আমাদের সংস্কৃত ও বাংলা ভাষাই বা কম কিসে? আনন্দচন্দ্র বললে।
কিসে আর কিসে! তুমি তো পড়োনি মেকলের সুযুক্তিপূর্ণ মন্তব্যপত্রটা! না পড়িনি, তা কি আছে তাতে?
১৮১৩ সালে ইংরেজী শিক্ষা সম্বন্ধে যে আদেশ প্রচারিত হয়েছিল, তারই উপরে ওই নির্ধারণপত্র মেকলে সাহেবের। তিনি এক জায়গায় কি লিখেছেন জান? Who could deny that a single shelf of a good European Library was worth the whole native literature of India and Arabia! এক শেল্ফ ইংরেজীয় কিতাবে যে জ্ঞানের কথা, সমুদয় ভারতবর্ষ ও আরব দেশের সাহিত্যে তা নাই।
তাই নাকি?
তবে! গর্বের সঙ্গে বললে অম্বিকাচরণ, তাই তো দেখতে পাচ্ছো না—কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী মশাই সকলে মেকলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। তাঁরাই তো আজ এ দেশের আশা ভরসা!
তাহলে আমাদের মহাকবি কালিদাস—তাঁর সব অমর কাব্যগ্রন্থ—
শেক্সপীয়ার পড়, বুঝলে আনন্দচন্দ্র, শেক্সপীয়ার, পড়—মিলটন পড়। বেদবেদান্ত গীতা নয়, পড় বাইবেল। তা ছাড়া তুমি তো মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়বে বলে স্থির করছো—
হ্যাঁ, তা তো করেছি।
কিন্তু সেখানে ইংরেজীতেই ইউরোপীয় পদ্ধতিতে চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষা দেওয়া হয়। ইংরেজী—ইংরেজী ভাষা ভাল করে না জানলে—ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে ভাল করে পরিচিত না হলে, তুমি কখনোই তাদের শিক্ষাপদ্ধতিকে অনুসরণ করতে পারবে না! একজন ভাল চিকিৎসকও হতে পারবে না। তুমি তো কখনো কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরীতে যাওনি, সেখানে অনেক ভাল ভাল বই আছে। ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে ভাল করে পরিচয় হলে দেখবে তোমার ধর্মের কুসংস্কারটাও একটু একটু করে কেটে যাবে।
আনন্দচন্দ্র বললে, কি জানি ভাই, আমি তোমার সঙ্গে একমত নই!
আমি কি জানি না, বুঝি না তা আনন্দচন্দ্র? জানি, বুঝি। তোমাদের অনেকেরই কি হয়েছে জান? অম্বিকাচরণ সোৎসাহে বলে চলে, ধর্মের গোঁড়ামি আর কুসংস্কারগুলোকে আঁকড়ে ধরে আছ বলেই নব যুগের আলো তোমাদের চোখের দৃষ্টিকে খুলে দিতে পারেনি। You are still blind!
তর্ক তোমার সঙ্গে আমি করতে চাই না অম্বিকাচরণ—
এ তো তর্কের কথা নয়। তা ছাড়া সত্য যা, কি করেই বা তুমি তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবার তর্কে নামতে পারো?
তবু আমি বলবো অম্বিকাচরণ একটা কথা—
কি, বলো?
নতুন যুগের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তোমরা যে আমাদের এতকালের সনাতন হিন্দু ধর্মকে একেবারে নস্যাৎ করে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো, তাতে করে জেনো হিন্দুধর্মের কিছুই এসে যাবে না।
ধর্ম—ধর্ম তুমি কাকে বল আনন্দচন্দ্র? তোমাদের এই হিন্দুধর্মটা কি একটা ধর্ম! অন্ধ গোঁড়ামি আর দীর্ঘদিনের একটা কুসংস্কারের অন্ধ অনুসরণ!
অতঃপর আনন্দচন্দ্র চুপ করে গিয়েছে।
অম্বিকাচরণের তর্ক করতে সঙ্গে যেন আর ইচ্ছা করেনি।
অম্বিকাচরণ যাই বলুক—যতই যুক্তির অবতারণা করুক আনন্দচন্দ্রের কাছে, হিন্দু ধর্মের একটা বিশেষ রূপ—বিশেষ সংজ্ঞা—বিশেষ অর্থ আছে।
জন্ম তার গ্রামে—শিক্ষার শুরুও গ্রামে—গ্রামের পাঠাশালায়। তাই তার কৈশোরকাল পর্যন্ত তার মনের মধ্যে যে একটা ছাপ পড়েছিল, কলকাতা শহরে এসে সে ছাপটাকে যেন সে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারে না। কোথায় একটা নাড়ির টান যেন সে অনুভব করে।
আবার এও মনে হয়, হয়ত অম্বিকাচরণই ঠিক। ইংরাজী ভাল করে না শিখতে পারলে—ইংরাজী শিক্ষা-দীক্ষার সঙ্গে ভাল করে পরিচিত না হতে পারলে সে চিকিৎসা- শাস্ত্রও ভাল করে আয়ত্তে আনতে পারবে না।
মধ্যে মধ্যে ওই দোটানায় মনটা যেন তার বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।
অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় আনন্দচন্দ্র।
কলেজের পাঠ শেষ করে সেদিনকার মত আনন্দচন্দ্র যখন মল্লিক মশাইয়ের গৃহে ফিরে এল তখন সবে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে।
মল্লিক মশাইয়ের গৃহদেবতা রাধানাথের মন্দিরে আর একটু পরে সন্ধ্যারতি শুরু হবে।
প্রত্যহ সে সন্ধ্যারতির সময় মন্দিরের ভেতরে গিয়ে বসে। ধূপ-ধূনা ও বেল- মল্লিকা-চাঁপার গন্ধে বাতাস ম-ম করে। ভাল লাগে আনন্দচন্দ্রের, ভারী ভাল লাগে।
রাধানাথের মূর্তির দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এর চাইতে বড় সত্য বুঝি আর কিছু নেই। এই সত্য—এই চিরন্তন।