॥ বারো ॥
আনন্দচন্দ্র ভোলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ভোলার কথাবার্তাগুলোই ওইরকম। দিলখোলা আমুদে মানুষ। হাতের হুঁকায় একটা দীর্ঘ টান দিয়ে ভোলা বললে আবার, যাবি আজ রাতে! খেমটা নাচ আছে— বুঝলি মাগীটাকে দেখলে একেবারে ট্যারা হয়ে যাবি। প্রাণকেষ্ট আমার বন্ধু জানিস তো— আসরের একেবারে সামনের দিকে আমরা বসেছিলাম।
কাল সারারাত আসোনি আর তোমার মা সারাটা রাত তোমার অপেক্ষায় ভাতের থালা কোলে করে বসেছিলেন—
কি দরকার ছিল আমার জন্য অপেক্ষা করার, রাত্রে তো আমি প্রাণকেষ্টদের ওখানেই খেয়ে নিয়েছি। ভোলা বললে।
তা সে কথা যাবার আগে তোমার মাকে বলে গেলেই তো পারতে—মিথ্যে তিনি অমন করে সারাটা রাত তোমার আশায় আশায় ভাতের থালা নিয়ে বসে থাকতেন না।
যেতে দে তো! মার যেমন আদিখ্যেতা—প্রাণকেষ্ট কি বলছিল জানিস আনন্দ?
কি?
একটা কবিগানের দল খুলবে—বেশ মজা হবে, তাই না রে! বললে ভোলা।
কবিগানের দল খুলবে—তা একজন দলে কবি না থাকলে তো দল খোলা যায় না। মুখে মুখে বিপক্ষ দলের কবিয়ালের জবাবে কবিতা বানিয়ে বানিয়ে জবাব দিতে হবে।
খিক্ খিক্ করে হেসে ওঠে ভোলা।
আনন্দচন্দ্র বললে, তা হাসছো কেন?
তা হাসবো না তো কি? দলের কবিয়াল তো আমিই হবো।
তুমি কবিয়াল হবে!
হ্যাঁ, আমি।
তুমি কবিতা বানাতে পারো নাকি?
তবে! পারি না তো কি? মুখে মুখে কত কবিতা আমি বানাই—
বলে কি ভোলাদা, বিস্ময়ে আনন্দচন্দ্র ভোলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যার পেটে বোমা মারলে একটা অক্ষর বেরুবে না—যে একদিনের জন্য পাঠাশালায় পর্যন্ত যায়নি—সে বানাবে কবিতা!
শোনাবো বুঝলি, একদিন মুখে মুখে তোকে কবিতা বানিয়ে শোনাবো। এই তো কাল রাত্রেই আসরে বসে বসে খেমটাওয়ালী মাগীটাকে নিয়ে একটা কবিতা বানিয়ে ফেললাম-
ওগো, চাঁদবদনী
রূপ তোমার কেমনে বাখানি—
আহা তবু না যদি হতো গো
হ্যাঁ রে, মাগীটার একটা চোখ ট্যারা।
তোমার একটি চক্ষু ট্যারা—
ট্যারা!
কিন্তু ওই যে বললে ভোলাদা, ওই কবিতা তোমার!
তবে? কার—এই শর্মার! বুঝলি এই ভোলানাথের! কহেন কবি ভোলানাথ – ট্যারা—রা–রা–রা–বল্ কেমন শুনলি কবিতা?
ভাল। তা ভোলাদা, তুমি লেখাপড়া করলে না কেন?
ধুস্, কি হবে ওইসব তোদের মত লেখাপড়া করে!—তার চাইতে একজন কবিয়ালের কত সম্মান—আসরে আসরে কত বাহবা—কত ফুলের মালা গলায় দেবো―, দেবে শিরোপা!
ভোলানাথ স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায়—কিন্তু আনন্দচন্দ্র আর দাঁড়ায় না—কলেজে যেতে হবে—বেলা অনেক হল।
.
ভোলা সারাটা রাত জেগে খেমটা নাচ দেখেছে দত্তবাড়িতে। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত বেনিয়ান হরেকৃষ্ণ দত্ত মশাইয়ের ছেলে। ছেলে প্রাণকৃষ্ণ ভোলার বন্ধু, আনন্দচন্দ্র জানে। এবং এও জানে দত্তবাড়িতে ওর যাতায়াত আছে।
বেনিয়ান হরেকৃষ্ণ দত্তমশাই। বিরাট ধনী ব্যক্তি। অর্থের যেমন সাচ্ছল্য তেমনি সমাজেও প্রতিপত্তি। কুলীন কায়স্থ। হরেকৃষ্ণ দত্ত মহাশয়ের পিতা ছিলেন অতি সামান্য লোক কিন্তু মানুষটা ছিলেন যেমন কর্মঠ তেমনি ছিল তাঁর উচ্চাশা। পুত্র হরেকৃষ্ণকে সেইভাবেই মানুষ করে তুলেছিলেন। তস্য পুত্র প্রাণকৃষ্ণ অর্থের সাচ্ছল্য থাকায় তাঁর পিতার দৌলতে ব্যবসায় হাত দিয়েছিলেন।
বড়বাজারের দয়েহাট অঞ্চল হরেকৃষ্ণর পিতার আমল থেকেই ছিল ব্যবসায়ীদের অমরাবতীর সিংহদ্বার। মারোয়াড়ী বণিকদের গদিতে গদিতে তখনো কলকাতা শহরের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছেয়ে যায়নি। বড়বাজার ও সুতানটির আদি প্রতিষ্ঠাতা বাঙালী ব্যবসায়ী শেঠ, বসাক, মল্লিক, শীল, বড়াল প্রভৃতি পরিবারদের আধিপত্য তখনো অক্ষুণ্ণ ছিল ওই অঞ্চলটায়। রম্বম্ করতো।
নবকৃষ্ণ বুদ্ধিমান ব্যক্তি, তিনি ব্যবসার গতিবিধিটা সম্যক্ উপলব্ধি করতে পেরেই ওই অঞ্চলেই বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেছিলেন।
তারপর ধীরে ধীরে লক্ষ্মীর উপাসনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু বেশী দিন বাঁচেন নি—তাঁর আরব্ধ কর্ম হাতে তুলে নিয়েছিলেন হরেকৃষ্ণ দত্ত মশাই।
আনন্দচন্দ্র জন্মাবার অনেক আগে থাকতেই এ দেশে ওই কলকাতা শহরেই নতুন ঊষার স্বর্ণদ্বার খুলে গিয়েছে এবং নবজাগরণ শুরু হয়ে গিয়েছে, যার ফলে সমাজে নতুন এক শ্রেণীর মানুষের উদ্ভব হয়েছে—বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়।
রামমোহন রায় যে জ্ঞানের প্রদীপটি জ্বেলে দিয়েছিলেন—যে চেতনায় এ দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন—সে চেতনার স্রোত অনেক দূর পর্যন্ত বহে গিয়েছে ইতিমধ্যে।
মধুমতীর জল অনেক গড়িয়েছে—ভাগীরথীর কূলে কূলে নবজাগরণের বুনিয়াদ শক্ত, আরো শক্ত হয়েছে একটু একটু করে।
ভাগীরথীর পশ্চিমের সরস্বতী নদীর তীরে মধ্যযুগের সূর্যাস্তের পর ভাগীরথীর পূবে নতুন যুগের সূর্যের আলোয় তখন ক্রমশ ঝলমল করে উঠেছে কলকাতা শহর।
নবযুগের স্রোতের কনকপদ্ম শহর কলকাতা।
মধুমতীর তীরে বাস-গ্রামের মানুষ ভারতচন্দ্রের সেটা বুঝতে দেরি হয়নি বলেই পুত্র আনন্দচন্দ্রকে নয় বৎসর বয়েসেই কলকাতা শহরে প্রেরণ করেছিলেন এবং মল্লিক মশাইয়ের আশ্রয়ে থেকে তার পড়াশুনার ব্যবস্থা করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে যৌবনের প্রারম্ভে ও যৌবনের সময় কবিরাজী শিক্ষা অর্জনের জন্য কলকাতার কাছেই ভাটপাড়ায় কাটাতে হয়েছিল কবিরত্ন যোগেশচন্দ্র বিদ্যালঙ্কারের আশ্রয়ে।
একই সঙ্গে তাঁকে সংস্কৃত পাঠ ও কবিরাজী বিদ্যা আয়ত্তের সাধনায় নিমগ্ন থাকতে হয়েছিল আর সেই সময়ই তাঁর নবযুগের কলকাতার সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
সংবাদ তিনি সব কিছুরই রাখতেন, কলকাতা শহর থেকে দূর গ্রামে বসে থাকলেও। অর্থাভাবে তাঁর জীবন সফল হয়ে ওঠেনি, উঠতে পারেনি—পুত্র আনন্দচন্দ্রের বেলাতেও নিদারুণ সেই অর্থাভাব থাকলেও একমাত্র ছেলেকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে সাধ্য বা যত্নের ত্রুটি করেননি।
আনন্দচন্দ্র অবিশ্যি তার পুরোপুরি ফলটা পাননি—তবে ভারতচন্দ্রের সেই স্বপ্ন তাঁর পৌত্রদের মধ্যে দিয়ে একদা সফল হয়ে উঠেছিল।
আনন্দচন্দ্রের রামমোহনকে দেখবার সৌভাগ্য হয়নি বটে তবে নবযুগের সূর্যোদয়কে যে দুজন প্রধান অভিনন্দন জানিয়েছিলেন—অর্থাৎ রামমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—তাঁদের মধ্যে ওই শেষোক্ত ব্যক্তিটির সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন। এবং আসতে পেরে আনন্দচন্দ্র ধন্য হয়েছিলেন।
রামমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্র উভয়ের মধ্যে ব্যবধান দুই পুরুষের হলেও—দুজনের জন্মস্থানের ব্যবধান খুব বেশী নয়।
হুগলী জেলার আরামবাগ অঞ্চলেই দুজনার জন্ম। মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমা ও হুগলীর আরামবাগ মহকুমা একই পরগণার মধ্যে অবস্থিত ছিল।
রামমোহনের জন্ম দক্ষিণ আরামবাগ, খানাকুল—কৃষ্ণনগরের অনতিদূরে। আর বিদ্যাসাগরের জন্ম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমায় বীরসিংহ গ্রামে। রাধানগর আর বীরসিংহ গ্রামের মধ্যে চার ঘণ্টার হাঁটা-পথ, মাত্র বারো-চোদ্দ মাইল ব্যবধান!
কিন্তু ওই ব্যবধানটুকু বোধ করি নামে মাত্রই। তাই বোধ করি একজনের আরব্ধ কর্মের পরিণতির প্রতিজ্ঞা অন্যজনের মধ্যে আপনা থেকেই বর্তেছিল। রামমোহনের পরবর্তীকালে বাইরের সমাজ জীবনে যে বহুমুখী খরস্রোত বইছিল সেই খরস্রোতের মধ্যেই শুরু হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মজীবন। এবং তাঁর কর্মজীবনের প্রেরণা তো বটেই—তাঁর প্রত্যেকটি নীতি, পন্থা ও পরিকল্পনাও বুঝি তাঁর সমসাময়িক সমাজ জীবন থেকেই আহরণ করেছিলেন এবং সেই সঙ্গে ছিল তাঁর চরিত্রগত নির্মম বাস্তবতাবোধ, গভীর সমাজচেতনা, সত্যনিষ্ঠা ও নির্মল যুক্তিবাদিতা—যেগুলো সহজে বাইরে থেকে বোঝা যেত না কারণ সেগুলো অন্তঃসলিলার মতই তাঁর হৃদয়মধ্যে প্রবাহিত ছিল।
আনন্দচন্দ্র যখন প্রথম কলকাতা শহরে বিদ্যার্জনের জন্য আসে, অর্থাৎ পিতা ভারতচন্দ্র এসে পুত্রকে মল্লিক মশাইয়ের গৃহে রেখে গেলেন তখন কলকাতা শহরে দুই শ্রেণীর লোকের বাস মোটামুটি ভাবে দেখতে গেলে বা বিচার করে দেখতে গেলে। এক, নতুন ধনী বণিক অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ আর দুই, অজ্ঞাতকুলশীল শহরের অধিকাংশ মানুষ, যাদের পরস্পরের সঙ্গে বুঝি বলতে গেলে কোনরকম যোগাযোগই ছিল না।
কলকাতা শহরে আসবার মাসখানেক পরের কথা, সেই একটা বিশেষ দিন যেদিনটার স্মৃতি নয় বৎসরের বালক আনন্দচন্দ্র কোনদিনই বুঝি ভুলতে পারেনি।
১৮৪৩ খ্রীস্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার
সারা শহরে সেদিনটায় কি না হৈ-চৈ।
মিশন রো-তে ওল্ড মিশন চার্চে মধুসূদন দত্ত নামে তাদেরই জেলার এক ধনী ব্যক্তির একমাত্র পুত্র–হিন্দু কলেজের প্রতিভাবান ছাত্র খ্রীস্টধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করছেন।
সমস্ত হিন্দুসমাজে সে কি প্রচণ্ড আলোড়ন!
মধুসূদনের বয়স তখন উনিশ কি কুড়ি।
আর আনন্দচন্দ্র নয় বৎসরের বালক।
আনন্দ পরে শুনেছিল, সেদিন সেই ধর্মান্তর উৎসবে মধুসূদন নাকি তাঁর নিজের রচিত ইংরাজী গান গেয়েছিলেন।
Long sunk in superstition’s night
By sin and Satan driven
I saw not, cared not for this light,
That leads the Blind to Heaven.
আশ্চর্য লেগেছিল আনন্দচন্দ্রের পরবর্তী জীবনে, ওই খ্রীস্টধর্মে দীক্ষিত ছেলেটি— কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তর লেখা মেঘনাদ বধ কাব্যখানি যখন তার হাতে এসেছিল!
কি অত্যাশ্চর্য লেখা!
সম্মুখ সমরে পড়ি বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণী,
কোন বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে।
বড় ভাল লাগত আনন্দচন্দ্রের ওই কাব্যখানি। বারংবার পড়ে পড়ে আনন্দচন্দ্র একেবারে মুখস্থ করে ফেলেছিল বললেও হয়।
কিন্তু সে তো অনেক—অনেক পরের কথা। আবার ফিরে আসা যাক মল্লিক বাড়ির বহির্মহলের সেই ঘরটিতে। ভোলা তামুক সেবনে পরিতৃপ্ত হয়ে পাতা মলিন শয্যাটার উপরে শুয়ে পড়ে এক হাঁটুর উপরে অন্য পাটি তুলে দিয়ে গুন গুন করে গান গাইছে। বোধ হয় গত রাত্রে শোনা খেমটাওয়ালীরই কোন গান।
ভারতচন্দ্র তাঁর একগুঁয়ে একরোখা ছেলেকে খুব ভাল ভাবেই চিনতেন। তবু নয় বৎসরের বালককে মল্লিক মশায়ের আশ্রয়ে রেখে যাবার সময় যে কথাটি বিশেষ করে তাকে বলেছিলেন, ছুটিছাটায় দেশে গিয়ে ফিরে আসার সময়ও সেই কথাটিই বলতেন, বুঝিছো, ভাল করে মন দিয়ে পড়াশুনা করবা। তোমারে মানুষ হতি হবে। শহরে নানা রকমের অসৎ প্রলোভন আছে—অসৎ সংসর্গ সর্বদা এড়ায়ে চলবা। কথাডা আমার মনে থাকবে তো? এতদিন তুমি আমার চোখের সামনে ছিলে, আমার কোন চিন্তা ছিল না। কিন্তু এখন সর্বক্ষণ তোমার জন্যি আমার চিন্তা থাকবে।
পিতা ভারতচন্দ্রের কথাটা তখন নয় বৎসরের এক বালকের পক্ষে সম্যক্ উপলব্ধির কথা নয়। তাছাড়া এতটা কাল অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে ও আদরে কেটেছে—বাড়িতে তো ওই একটি মাত্রই ছেলে—
মনটা তাই তার কিছুদিন পর্যন্ত রীতিমত বিষণ্ণ হয়েই থাকত।
কোন কিছু ভাল লাগত না আনন্দচন্দ্রের।
দেশের মত অবাধ মুক্তি কোথায় এখানে! এখানে সর্বত্র যেন কেমন একটা কৃত্রিমতা। কিন্তু ক্রমশ মনের সেই বিষণ্ণতাটা আনন্দচন্দ্রের কেটে গিয়েছিল। পড়াশুনা শুরু করবার পর সেখানকার জীবন যেন তার সামনে এক নতুন জগতের দ্বার খুলে দিয়েছিল।
তারপর সঙ্গী জুটেছিল ওই ভোলাদা।
ভোলাদাদাকে আনন্দচন্দ্রর খুব যে ভাল লাগতো তা নয়। তার আচার-আচরণ একটুও আনন্দচন্দ্রের পছন্দ হত না কিন্তু তবু ভোলাদার বিশেষ একটা আকর্ষণ ছিল যেন। ধনী ব্যক্তিদের কেন্দ্র করে কলকাতা সমাজের বুকে যে বহুবিধ বিলাস ও কুকর্মের স্রোত বইতো, ভোলানাথ নানা ভাবে তার সঙ্গে জড়িত ছিল, বিশেষ করে ধনীপুত্র বয়াটে প্রাণকৃষ্ণর সংসর্গে মিশে।
সে-ই এনে দিত আনন্দচন্দ্রকে মধ্যে মধ্যে অন্য এক জগতের সংবাদ। যে সংবাদের মধ্যে কৌতূহল আছে ও একটা আকর্ষণও আছে।
মল্লিক বাড়িতে দুটি সংবাদপত্র নিয়মিত আসতো। কে পড়তো কে জানে, তবে আনন্দচন্দ্র পড়তো।
একটি ‘সম্বাদভাস্কর’, অন্যটি ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’।
নানা ধরনের বিচিত্র সংবাদ ‘সম্বাদভাস্করে’ প্রকাশিত হত। সমাজের ধনিক সম্প্রদায় বা বড়লোকদের কুৎসিত বিলাস বৈচিত্র্যের নানা ধরনের সংবাদ।
গঙ্গাবক্ষে ভাসমান বজরাতে বাবুদের নর্তকীদের সঙ্গে উদ্দাম নৃত্য—খেমটা নৃত্য গঙ্গাতীরে গেলেই দেখা যেত এবং সেটা একদিন ভোলাদাই তাকে সন্ধ্যায় গঙ্গাতীরে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিল।
এ ধরনের জীবনযাত্রার সঙ্গে গাঁয়ের ছেলে আনন্দচন্দ্রের কোন পরিচয় ছিল না। বাবুরা বজরায় বজরায় নর্তকীদের নিয়ে নাচানাচি ঢলাঢলি করছে—আনন্দচন্দ্র দেখে তো অবাক। আনন্দচন্দ্রর বয়স তখন চোদ্দ হবে—কলকাতায় আসার বছর পাঁচেক পরে।
কৈশোরের শেষপ্রান্তে তখন সে পৌঁছেছে।
তার মনে হয়েছিল এ তো লাম্পট্য।
সুখের কথা আনন্দচন্দ্রের মনকে ওইদিকে তেমন আকর্ষণ করতে পারেনি, ভোলানাথের সাহচর্য থাকা সত্ত্বেও।
বরং মনটা আনন্দচন্দ্রের অন্য দিকেই ঝুঁকেছিল।
কলকাতা শহরে অনেক বিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ায় যে নতুন একটা বিদ্বৎ-সমাজ গড়ে উঠেছিল সেই সমাজই তার মনকে বেশী আকর্ষণ করেছিল।
কিন্তু আনন্দচন্দ্ৰ জানত না, ওই নবজাত বিদ্বৎ-সমাজ কলকাতার জনসমাজে তখন পর্যন্ত তেমন করে তার প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
যুবক ঈশ্বরচন্দ্র তখন লালদীঘির কলেজে সিভিলিয়ান ছাত্রদের পড়াতে পড়াতে মনে মনে স্বপ্ন দেখছেন, কলকাতা শহরের লম্পট বিদ্যাশিক্ষার পাঠশালাগুলো ভেঙে ফেলে অথবা আমূল সংস্কার করে এ দেশে নতুন পাঠশালা গড়ে তুলবার।
কিন্তু আনন্দচন্দ্র তখনো যুগমানব ঈশ্বরচন্দ্রের দর্শন পায়নি বা তাঁর সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য তার হয়নি।
ভারতচন্দ্রের আশা নিষ্ফল হয়নি। আনন্দচন্দ্রের মনটা পড়াশুনার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল।
ভোলানাথ যে তা জানত না তা নয়।
তা সত্ত্বেও সে আনন্দচন্দ্রকে তার দলে টানবার চেষ্টা করতো।
সকাল প্রায় সোয়া আটটা হবে—বেশ কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হয়—তাই আনন্দচন্দ্র একটু সকাল সকালই স্নান ও আহার সম্পন্ন করে কলেজের উদ্দেশে বের হয়ে পড়ে।
দীঘিতে স্নান করে জামাকাপড় ছেড়ে আনন্দচন্দ্র সোজা রন্ধনশালার দিকে চলে গেল—রন্ধনশালার বাইরের দাওয়ায় উঠে ডাকল, মঙ্গলা দিদি!
কে, আনন্দ? সাড়া এল ভিতর থেকে।
হ্যাঁ দিদি, ভাত হয়েছে?
ভাত হয়ে গিয়েছে, ডালটায় সম্বরা দিয়ে ভাত দিচ্ছি। মঙ্গলা ভিতর থেকে বললে, তুই পিঁড়ি পেতে বোস।
গরম গরম ভাত ডাল আর বেগুনপোড়া। এর বেশী এত সকালে কিছু একটা কোন দিনই জোটে না আনন্দচন্দ্রের বরাতে। তাও প্রত্যহ জোটে না—কেবল ডাল আর ভাতই খেয়ে যেতে হয়।
হ্যাঁ রে আনন্দ, তোর ভোলাদাকে দেখলি?
মঙ্গলার প্রশ্নে খেতে খেতে আনন্দচন্দ্ৰ মুখ তুললো। তারপর ধীরকণ্ঠে বললে, হ্যাঁ, ভোলাদা তো ঘরে শুয়ে আছেন-
কাল সারাটা রাত কোথায় ছিল রে?
দত্তদের বাড়িতে। সেখানে—
তা রাত্রে তো বোধহয় কিছুই খায়নি!
খেয়েছেন তো বলছিলেন—
কি খেল? কোথায় খেল?
দত্তদের বাড়িতে।
কায়েতের বাড়িতে বামুনের ছেলে পাত পেতে এল! কি যে হয়েছে ছেলেটা— কিছুটা মানে না জাতধর্মের।
আনন্দচন্দ্ৰ কোন জবাব দেয় না।
খাওয়া সেরে উঠে পড়ল। দীঘিতে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে কামিজটা গায়ে চাপাচ্ছে হঠাৎ ভোলানাথের গলা শোনা গেল।
তোর বৌ কেমন হল রে আনন্দ?
ফিরে তাকাল আনন্দচন্দ্র ভোলানাথের দিকে।
বলি বৌ কেমন হল তোর? দেখতে কেমন?
আনন্দচন্দ্র কোন জবাব দেয় না।
তাই বলে ভোলানাথ কিন্তু থেমে থাকে না। আবার প্রশ্ন করে, কি রে, দেখতে কেমন? আমাদের সুহাসিনীর মত সুন্দর?
এবারও আনন্দচন্দ্ৰ চুপ।