মধুমতী থেকে ভাগীরথী – ১০

।। দশ ।।

রাধারমণ মল্লিক ধনী লোক—বড়বাজারে তার বিরাট ফলাও ব্যবসা। ধান, চালের ব্যবসা লক্ষ্মী তার ঘরে বাঁধা

মল্লিক মশাইয়ের আদি নিবাস ছিল যশোহর জিলাতেই এবং পরে তাঁর পিতামহ ব্যবসা উপলক্ষে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেছিলেন এবং সেই থেকেই তাঁরা শহরেই থেকে গিয়েছেন। দেশের বাড়িতে আর ফেরেননি।

দেশের ভিটায় যে বাড়ি ছিল সেটা ক্রমশ ভাঙতে ভাঙতে একেবারে জঙ্গলে আর আগাছায় ভরতি হয়ে গিয়েছিল। রাত্রে সেখানে প্রহরে প্রহরে শিয়াল ডাকত। পুত্র আনন্দচন্দ্রকে যখন ভারতচন্দ্র কলকাতায় পড়াশুনার জন্য পাঠাতে মনস্থ করেছিলেন তখন প্রধানত যে দুটি চিন্তা তাঁকে উদ্বিগ্ন করেছিল সেটা হচ্ছে, প্রথমত ছেলেকে কলকাতায় রেখে পড়াতে হলে যে অর্থের প্রয়োজন সে অর্থ তাঁর ছিল না। দ্বিতীয়ত তাঁর শহরে থাকা-খাওয়ারও একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার। ভারতচন্দ্রের সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়েছিলেন রাধারমণ মল্লিক মশাই। দরমাহাটায় তাঁর গৃহেই স্থান দিয়েছিলেন আনন্দচন্দ্রকে, এবং শুধু স্থান নয়, আহারের ব্যবস্থাও তাঁর ওখানেই হয়েছিল।

ভারতচন্দ্র পুত্র সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

তখনকার দিনে পুরো দুটো দিন লাগত ইতিনা গ্রাম থেকে কলকাতায় পৌঁছাতে আনন্দচন্দ্র যখন গঙ্গার ঘাটে এসে নামলেন তখনো ভাল করে দিনের আলো ফোটেনি। আবছা আবছা একটা অন্ধকার, তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অল্প অল্প কুয়াশা। তখনো রেল চলাচল শুরু হয়নি—তাই নৌকায় ও হাঁটাপথে প্রায় তিন দিন লাগত গ্রাম থেকে কলকাতায় পৌঁছাতে, তৃতীয় দিন সকালে গঙ্গার ঘাটে নৌকা থেকে নেমে শতরঞ্জিতে জড়ানো ছোট বিছানা ও টিনের পোর্টম্যান্টটি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছাল দরমাহাটায়। রাস্তাটা খুব বেশী নয়। তবে অত ভোরে রাস্তায় তেমন লোক চলাচল ছিল না। রাস্তা কতকটা ফাঁকা বললেই চলে।

মনটা আনন্দচন্দ্রের তেমন ভাল ছিল না। যাত্রা প্রাক্কালে ইচ্ছা ছিল অন্নদাসুন্দরীর সঙ্গে একটিবার দেখা হয়, কিন্তু তা হয়নি। অন্নদাসুন্দরীর কোন পাত্তাই পায় না আনন্দচন্দ্র।

তবু সতৃষ্ণ নয়ন দুটি তার বারংবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল যদি তার ঘোমটা ঢাকা মুখখানিও একটি বার চোখে পড়ে। কিন্তু পড়েনি।

.

দরমাহাটা জায়গাটা তখন যেমন নোংরা তেমনি অস্বাস্থ্যকর। ছোট ছোট অপরিসর রাস্তা, দু’পাশে কাঁচা নর্দমা পাকভর্তি। সর্বক্ষণ দিনের বেলা মাছিতে ভনভন করে, আর রাত্রে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা সেই পাঁকের উপর বসে চারিদিকে তাদের আক্রমণ চালায়।

বিরাট বাড়ি মল্লিক মশাইয়ের। অন্দরমহল ও বহির্মহলের মধ্যে প্রশস্ত একটি আঙ্গিনা। বহির্মহলে মল্লিক মশাইয়ের আশ্রিতজনেরা থাকে। সেই আশ্রিতজনেদের মধ্যেই স্থান পেয়েছিল আনন্দচন্দ্র।

আনন্দচন্দ্র মল্লিক মশাইয়ের বাড়িতে এসে যখন পৌঁছায় তখন সে রীতিমত ক্লান্ত। সারাটা রাত ঘুম হয়নি, ক্ষুধায় দেহ অবসন্ন

সদর দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা হয়ে গেল ভবতারিণী দেবীর সঙ্গে, মল্লিক মশাইয়ের বৃদ্ধা মা। রাধারমণের যখন মাত্র বাইশ বৎসর বয়েস, তখন তাঁর স্বামী—রাধারমণের পিতা হঠাৎ সান্নিপাতিক জ্বরে মারা যান।

পরম নিষ্ঠাবতী ধর্মভীরু মহিলা। কিন্তু অত্যন্ত মমতাময়ী। আনন্দচন্দ্রকে বিশেষ স্নেহ করতেন—আনন্দকে দেখে বললেন—আনন্দ, কখন এলি বাবা?

এই আসছি জেঠাইমা। আনন্দচন্দ্র এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই মল্লিক গিন্নী বললেন–থাক, থাক বাবা, বেঁচে থাক। হ্যাঁরে, মুখটা অমন শুকিয়ে গেছে কেন রে? কাল রাতে কিছু খাওয়া হয়নি বুঝি? পথে নৌকায় বুঝি খুব ভিড় ছিল? এক কাজ কর বাবা, দীঘিতে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ওই জামা-কাপড় বদলেনে। রান্নাঘরে মঙ্গলা দিদি বোধ হয় আছে, কিছু চেয়ে নিয়ে খাগে।

মল্লিক গিন্নী চলে গেলেন। হাতে তাঁর একটা ঘটি ও নামাবলী গায়ে, গঙ্গাস্নান করতে চলেছেন। তাঁর প্রাত্যহিক ব্যাপার ওটা। দরমাহাটা থেকে সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে যান গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে।

মল্লিক মশাই ধনী লোক, তাঁর বাড়িতে নিত্য ব্যবহারের জন্য দুটো ঘোড়ায় টানা ব্রুহাম গাড়ি থাকা সত্ত্বেও মল্লিক মশাইয়ের মাতাঠাকুরানী কখনো সে গাড়িতে চেপে গঙ্গাস্নানে যাননি।

ছেলে বারংবার বলেছে তার মাকে, বাড়িতে দু’দুটো পালকি গাড়ি আছে, তবু তুমি অত দূরে হেঁটে রোজ গঙ্গাস্নানে যাও কেন?

না বাবা, আমি তো গুরুর কৃপায় এখনো অথর্ব হয়ে যাইনি। বেশ শক্ত সমর্থই আছি, হেঁটে গিয়ে গঙ্গাস্নান করে আবার হেঁটে আসতে তো কোন কষ্টই হয় না।

কষ্টের কথা নয় মা, রাধারমণ মল্লিকের মা তুমি! তুমি হেঁটে রোজ গঙ্গাস্নানে যাও, লোকে দেখলেই বা আমাকে কি বলবে।

ভবতারিণী মৃদু হেসে বলেছেন—কিছু বলবে না

সংসারে অনেক ধরনের লোক আছে মা। পরের ঐশ্বর্যে, সাফল্যে ঈর্ষাতুর, তারা বলবে, রাধারমণ তার মাকে সংসারের এক ধারে অবহেলিত রেখে দিয়েছে।

নারে না, কিছু বলবে না বাবা! কেউ কিছু বলবে না। তুই কিছু ভাবিস না।

.

আনন্দচন্দ্র তার নিজের ছোট ঘরটিতে ঢুকে কাপড়জামা বদলে সঙ্গে আনা একটা ভ্যারাণ্ডার ডালের দাঁতন সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পিছনে দীঘির দিকে চলে গেল। বিরাট দীঘি না হলেও তাদের দেশের মত দীঘিটা বেশ প্রশস্তই। ইট দিয়ে সুন্দর করে বাঁধানো সিঁড়ি। পরিষ্কার টলটলে জল তার। ওই সকালে শীতের কুয়াশার একটা পাতলা আবরণ সারা দীঘির বুকে বিছিয়ে থাকার দরুন জল স্পষ্ট চোখে পড়ে না।

ধাপে ধাপে একেবারে শেষ ধাপে গিয়ে দাঁড়াল আনন্দচন্দ্র। শীতের দীঘি ততটা ভর-ভরাট নয়, বর্ষাকালে যদিও একেবারে টইটম্বুর হয়ে ওঠে যেন। দীঘির পাড়ে পাড়ে কিছু নারিকেল, খেজুর ও তালগাছ।

দাঁতন করে মুখ ধুয়ে সবে ফিরে দাঁড়িয়েছে আনন্দচন্দ্র, কানে এসে বাজল পায়ের মলের ঝমঝম শব্দ। আনন্দচন্দ্রের মনে হল সঙ্গে সঙ্গে, নিশ্চয়ই সুহাসিনী – রাধারমণ মল্লিকের একমাত্র কন্যাসন্তান, কিশোরী সুহাসিনী। কিশোরী বৈকি! বয়স ত এখনো চোদ্দই পার হয়নি।

কিন্তু বড় অভাগিনী মেয়েটা। অমন গা-ভরতি প্রতিমার মত রূপ, কিন্তু এই বয়েসেই সব খুইয়ে বসে আছে।

অনেক খুঁজেপেতে রাধারমণ মল্লিক মশাই তাঁর একমাত্র কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন মূলাজোড়ের চৌধুরী বাড়িতে। চৌধুরীদের রীতিমত শাঁসালো অবস্থা। ক্ষেত ভরা ফসল, মরাই ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু। তা ছাড়া জাহাজে জাহাজে খাদ্য সরবরাহের ব্যবসা, যা থেকে প্রচুর অর্থাগম হয়ে থাকে। নানা দেশ থেকে কলকাতার বন্দরে জাহাজ আসে মাল খালাস করতে ও মাল বোঝাই করে নিয়ে যেতে। সেই সব জাহাজে খাদ্য সরবরাহ করে চৌধুরীরা। জগৎ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র নবীন চৌধুরীর সঙ্গেই বিবাহ দিয়েছিলেন তাঁর একমাত্র আদরিণী কন্যা সুহাসিনীর।

সুহাসিনীর চাইতে নবীন বয়সে বেশ বেশীই ছিল। তা হোক, রাধারমণ তাতে কোন আপত্তির কারণ দেখতে পাননি।

কিন্তু যে ব্যাপারটা তিনি বিবাহের পূর্বে জানতে পারেননি; নবীনের যকৃতে অত্যধিক মদ্যপানের জন্য একটা কঠিন রোগ ছিল, যেটা বিবাহের দেড় বৎসরের মধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করে তার অকাল মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।

সুহাসিনীর বয়স তখন মাত্র বারো বৎসর।

জামাতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রাধারমণ ছুটে গেলেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এবং মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে এলেন নিজগৃহে। বাড়ির সবাই কেঁদেছেন, কিন্তু এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেননি মল্লিক মশাই। আকস্মিক আঘাতটা তাঁকে যেন একেবারে পাথর করে দিয়েছিল।

স্ত্রী অন্নপূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন রাধারমণ—শোন, মেয়েকে আমার তুমি বিধবার সাজ পরিও না।

কি বলছ তুমি! বিস্ময়ের যেন অবধি থাকে না অন্নপূর্ণার

ঠিকই বলেছি। ও যেমন আছে তেমনি থাকবে। যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটিই ওকে থাকতে দাও।

একগুঁয়ে জেদী স্বামীকে অন্নপূর্ণা ভাল করেই চিনত—প্রতিবাদ জানাতে গেলে যে স্বামী তার আরো কঠোর হয়ে উঠবে সে জানত। তাই চুপ করেই থাকল

মনে করো, সুহাসের বিয়ে আমরা দিইনি। ওর বিয়ে হয়নি, ও কুমারী।

সমাজে যে সবাই ছি ছি করবে।

করুক।

আমাদের সবাই এক ঘরে করবে।

করুক, আমরা এক-ঘরেই হয়ে থাকব।

মাত্র বারো বছরের এক বালিকা সুহাসিনীও বোধ হয় বুঝতে পারেনি তার কত বড় সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। তার জীবনটা কি ভাবে ওলটপালট হয়ে গিয়েছে।

এক-একজন সংসারে থাকে, যারা অল্প বয়সেই কিছুটা অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে সব কিছু সম্পর্কে। কিন্তু সংসারে আবার এমনটিও আছে, যাদের মনটা দীর্ঘদিন শিশুর মতই সরল থেকে যায়। সুহাসিনী ছিল ওই শেষোক্ত দলের

তার জীবনে যে এত বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে, সে বোধটুকুও যেন তার নেই। সে পাড়ওলা শাড়ি পরে, গায়ের অলংকার তার যেমনটি ছিল তেমটিই আছে। কেবলমাত্র মাথার সিন্দুরটুকু অন্নপূর্ণা মুছে দিয়েছিল সুহাসিনীর। তা সেজন্যে অবিশ্যি সুহাসিনীর বিশেষ কিছু এসে যায়নি। সিন্দুরের মর্ম বুঝবার মত মনও তার ছিল না, বয়সও তো ছিল না।

বিবাহের পর একবার মাত্র মাস ছয়েকের জন্য সুহাসিনী স্বামীগৃহে গিয়েছিল। কিন্তু নবীন তখন রোগে, বলতে গেলে একপ্রকার শয্যাশায়ী। অবিশ্যি সংবাদটা তখনো রাধারমণ পাননি।

মাস ছয়েক বাদে মেয়েকে তার শ্বশুরালয়ে দেখতে গিয়ে প্রথম ব্যাপারটা জানতে পারলেন। বেয়াইকে শুধালেন—কি ব্যাপার বেয়াই মশাই? বাবাজী যে এত অসুস্থ, তা তো আমাকে কই জানাননি?

মনটন ভাল ছিল না। জগৎ চৌধুরী বললেন। তা ছাড়া যা করবার তা তো করছিই।

কে চিকিৎসা করছে?

কালীধন কবিরাজ।

কত দিন ধরে চিকিৎসায় আছে তার, বাবাজী?

তা সে শুরু থেকেই?

কি বলছেন তিনি?

যকৃতের রোগ বলছেন।

আপনি এক কাজ করুন। কলকাতায় নিয়ে চলুন বাবাজীকে। সাহেব ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাব আমি।

তা করতে চান ভাল কথাই। তবে একটা চিকিৎসা যখন চলেছে

কিন্তু সে চিকিৎসায় তো কোন কাজই হচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে।

তা ছাড়া এ অবস্থায় বেশী নাড়াচাড়া করা কি রোগীর পক্ষে ভাল হবে?

রাধারমণ আর তর্ক করেননি। কলকাতায় ফিরে গিয়ে মেডিকেল কলেজে থেকে একজন সাহেব ডাক্তার এনে দেখিয়েছিলেন জামাতাকে।

সাহেব ডাক্তার নবীনকে পরীক্ষা করে মুখ গম্ভীর করলেন। বললেন—it is the last stage. সিরোসিস লিভারের—অত্যাধিক মদ্যপানের জন্যই হয়েছে। পেটেও জল জমেছে।

রাধারমণ বুঝতে পারলেন, জামাতা তার আর সুস্থ হয়ে উঠবে না।

গৃহে ফিরে এলেন।

কিন্তু তারপর এক মাসও গেল না। জামাতার মৃত্যুসংবাদ এল।

রাধারমণ ছুটে গেলেন কন্যার শ্বশুরালয়ে এবং একপ্রকার জোর করেই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে এলেন।

মাস দুই পরে জগৎ চৌধুরী এসেছিলেন তাঁর পুত্রবধূকে নিয়ে যেতে। কিন্তু রাধারমণ কন্যাকে দিলেন না। বললেন, না, ওকে পাঠাব না।

পাঠাবেন না?

না।

কিন্তু ও আমার পুত্রবধু।

হ্যাঁ, সে যতদিন নবীন বেঁচে ছিল তাই ছিল। এখন আর ও আপনাদের কেউ নয়। কি বলছেন আপনি, মল্লিক মশাই!

ঠিকই বলছি।

ঠিকই বলছেন!

হ্যাঁ। ওর আমি বিবাহ দিইনি মনে করব।

আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন!

লজ্জা করছে না আপনার? একটা মদ্যপ অসুস্থ ছেলের সব কিছু গোপন করে তার বিবাহ দিয়েছিলেন?

গোপন করেছি!

হ্যাঁ, করেছেন। অনেকদিন আগে থাকতেই ও-দেহে রোগ দেখা দিয়েছিল। বিবাহের সময়ই ও অসুস্থ ছিল। জোচ্চোরি করেছেন আপনি আমার সঙ্গে।

জগৎ চৌধুরী যেন একেবারে ফেটে পড়লেন। বললেন—কি বললেন, আমি ….জোচ্চোর? ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি, তবে এও বলে যাচ্ছি, দশ দিনের মধ্যে যদি বধূমাতাকে আমার গৃহে না পৌঁছে দেন তো জানবেন, সে গৃহে আর তার স্থান হবে না এ জীবনে। জগৎ চৌধুরী হনহন করে চলে গেলেন।

অন্নপূর্ণা পাশের ঘরেই ছিল। জগৎ চৌধুরী চলে যেতেই সে এসে ঘরে ঢুকে স্বামীকে বললে—ছিঃ, ছিঃ, এ তুমি কি করলে!

ঠিকই করেছি। একটা জোচ্চোর, ঠগ—আমার বন্দুক থাকলে ওকে আমি গুলি করে মারতাম।

.

আনন্দচন্দ্রের অনুমান মিথ্যা নয়।

সুহাসিনীই দীঘির ঘাটে বোধ হয় মুখ ধুতে এসেছে। পরনে একটা দামী কালোপাড় জলডুরে শারি। কাঁধে একটা গামছা। একরাশ কালো চুল পিঠের ওপরে এলানো।

আনন্দচন্দ্রকে দেখে সুহাসিনীর ওষ্ঠপ্রান্তে হাসি জেগে ওঠে।

আনন্দ দাদা, কখন এলে? সুহাসিনী বললে।

এই তো একটু আগে। বললে আনন্দচন্দ্ৰ।

তারপর বৌ কেমন হল?

বৌ!

হ্যাঁ গো বৌ। জানি গো জানি, তুমি যে দেশে বিয়ে করতে গিয়েছিলে আমি জানি। তারপর বৌ কেমন হল বল।

ভালই—

খুব সুন্দর বুঝি?

তা সুন্দরই তো!

আমার চাইতেও সুন্দর?

পাশাপাশি আনন্দচন্দ্রের মনের পাতায় ভেসে ওঠে অন্নদাসুন্দরীর দেবী প্রতিমার মত মুখখানা—সেই দুটি টানাটানা চোখ, টিকালো নাসা, কয়েক গাছি চূর্ণ কোঁকড়া কুন্তল লতিয়ে এসে নেমেছে ছোট কপালটির উপর

কি হল, জবাব দিলে না যে।

কিসের জবাব?